দ্বিতীয় খণ্ড – রহস্য-সংযোগ

দ্বিতীয় খণ্ড – রহস্য-সংযোগ

প্রথম পরিচ্ছেদ – সন্দেহ কি সত্য?

ইন্দ্রানন্দ সেই দিবসেই পুলিসের সহিত দেখা করা স্থির করিলেন। গুণারাজের পুত্র বলিয়া নইনিতালে তাঁহার বিশেষ মান-সম্ভ্রম ছিল। ইন্দ্রানন্দ চেষ্টা করিয়া পুলিস-ইনস্পেক্টরের উপর একখানি পত্র লইলেন।

ইনস্পেক্টর তাঁহাকে বিশেষ সমাদর করিয়া বসাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি প্রয়োজনে আসিয়াছেন?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বোধ হয়, আপনি বীরবিক্রম সাহেবের নাম শুনিয়াছেন।”

“হাঁ, তাহাকে বিশেষরূপে চিনি।”

“বোধ হয় শুনিয়াছেন, যে, আমার ভগিনীর সহিত তাঁহার বিবাহের সকলই স্থির হইয়াছিল।”

“হাঁ, শুনিয়াছিলাম বটে।”

“বীরবিক্রম সাহেব কিছুদিন নিরুদ্দেশ হইয়াছেন।”

“তাহাও জানি।”

“আমরা তাঁহার জন্য বিশেষ ভাবিত হইয়াছি।”

“হইবারই কথা।“

“সেইজন্য আপনার কাছে আসিয়াছি—পুলিসে সংবাদ দেওয়া উচিত মনে করিলাম।”

“কেন? তিনি ত কোন কাজে অন্যত্রে যাইতে পারেন?”

“তাহা হইলে নিশ্চয়ই পত্র লিখিতেন।”

“আর কখনও এরূপ অনুপস্থিত হইয়াছিলেন?”

“হাঁ, তাঁহাকে কাজের জন্য অনেক সময়ে নইনিতাল হইতে অন্যত্রে যাইতে হইয়াছে; তবে তিনি পত্র লিখিয়াছেন, কিম্বা যাইবার সময় বলিয়া গিয়াছেন। এরূপ কখনও হয় নাই।”

“আপনি তবে কি মনে করিতেছেন? তিনি কোথায় গিয়াছেন?”

“আমরা মনে করিয়াছিলাম, তিনি কাজেই গিয়াছেন। কিন্তু—”

“কিন্তু কি?”

“একটি ভদ্রলোক তাঁহার সন্ধানে গিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “হয় ত দয়ামলের ন্যায় তাঁহাকেও কেহ খুন করিয়াছে।”

“তাঁহার সঙ্গে কাহারও ঝগড়া-বিবাদ ছিল কি না জানেন।”

“না, তাঁহার সঙ্গে কাহারই ঝগড়া-বিবাদ ছিল না।”

“দয়ামলের সহিত তাঁহার ঝগড়া ছিল?”

“তাঁহার ছিল না। দয়ামল তাঁহার পিতার নিকট এক সময় চাকরী করিত, তাঁহার পিতার সমস্ত সম্পত্তি প্রতারণা করিয়া লইয়াছিল সত্য; কিন্তু তিনি দয়ামলের উপর কখনও রাগ প্রকাশ করেন নাই। এ কথা উঠিলে বলিতেন, ‘যদি সে প্রতারণা করিয়া থাকে, ঈশ্বর তাহাকে দণ্ড দিবেন, আমরা বিচারের কে?”

“আচ্ছা, আমরা তাঁহার অনুসন্ধান করিব।”

“আরও একটা কথা।“

“বলুন।”

“যিনি গিয়াছিলেন-“

“তিনি কে?”

“আপনাদের লোক বলিয়া আমাদের সন্দেহ হইয়াছিল।”

“তিনি আর কি বলিয়াছিলেন?”

“তিনি আরও এক ভয়ানক কথা বলিয়াছিলেন।”

“কি বলুন।”

“তিনি বলেন, বীরবিক্রম কোন দূর দেশে গিয়া আত্মহত্যা করিতে পারেন।”

“কেন?”

“কেন? তিনি বলিলেন, ফাঁসী হতে বাঁচিবার জন্য।”

“কেন, তিনি কি কোন খুন করিয়াছেন?”

ইন্দ্রানন্দ কি বলিবেন, স্থির করিতে পারিলেন না—ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিলেন। ইনস্পেক্টর তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি কি এরূপ সন্দেহ করেন?”

প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রানন্দ এ সন্দেহ বরাবরই করিতেছিলেন; তিনি কি বলিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না, নীরবে রহিলেন।

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “আপনি সন্দেহ করেন যে, বীরবিক্রম খুন করিয়াছেন। সম্প্রতি দয়ামলই খুন হইয়াছে, সুতরাং তিনিই দয়ালমলকে খুন করিয়াছেন?”

ইন্দ্রানন্দ বলিয়া উঠিলেন, “না—না—না—তিনি কখনও খুন করিতে পারেন না। একটা পোকা মারিলে যাঁহার প্রাণে কষ্ট হয়, তিনি কখনও মানুষ খুন করিতে পারেন না।”

ইনস্পেক্টর ধীরে ধীরে বলিলেন, “রাগে–প্রতিহিংসায়—দ্বেষে—মানুষ সবই করিতে পারে।” ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, তিনি বন্ধুর উপকার করিতে গিয়া ঘোর অনিষ্ট করিয়াছেন। তিনি বলিলেন, “না, না তিনি এমন কাজ করেন নাই।”

“না করিলেই ভাল।”

“আপনারা তাঁহার অনুসন্ধান করিবেন?”

“আমরা বাধ্য। আমাদের এ ত কৰ্ত্তব্য।”

ইন্দ্রানন্দ উঠিলেন। ইনস্পেক্টরও উঠিলেন। উঠিয়া ইন্দ্রানন্দকে বলিলেন, “আপনি আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি?”

বিস্মিত হইয়া ইন্দ্ৰানন্দ তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি বলুন।”

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “আপনি দেওপাট্টা ঘাটে পড়োবাড়ীতে কাহারও সন্ধান করিতেছিলেন?” ইন্দ্রানন্দ ‘ইনস্পেক্টরের এই কথায় একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। বলিলেন, “আপনি কিরূপে জানিলেন?”

ইনস্পেক্টর একটু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “আমাদের অনেক সন্ধান রাখিতে হয়। সরকার বাহাদুর এই জন্যই আমাদের মাহিনা দেন। যাহা হউক, আমরা বীরবিক্রম সাহেবের অনুসন্ধান করিতেছি। কোন সংবাদ পাইলেই আপনাকে জানাইব।”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অত্যন্ত বিস্ময়

ইনস্পেক্টরকে ইন্দ্রানন্দের অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হইল, কিন্তু তিনি কিছুই পারিলেন না, ইনস্পেক্টর তাঁহাকে বিদায় করিয়া অন্য কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন।

তখন ইন্দ্রানন্দ ভাবিতে ভাবিতে বীরবিক্রমের বাড়ীর দিকে চলিলেন। ভাবিলেন, “দেখিতেছি, পুলিসও এই পড়োবাড়ীর উপর নজর রাখিয়াছে। তাহাই বদমাইসের দল এখান হইতে পলাইয়াছে। যাহাই হউক, আমি আজ রাত্রে আর একবার এ বাড়ীটা ভাল করিয়া দেখিব। স্পষ্ট জানা যাইতেছে যে, বীরবিক্রম দয়ামলকে খুন করিয়াছেন, নতুবা মীনা মিথ্যাকথা বলিবে কেন? এখন বীরবিক্রম ফাঁসী যাবার ভয়ে, লোক লজ্জায় কোনখানে গিয়ে আত্মহত্যা করিয়াছেন। দরি এ সব কথা কিছুই বিশ্বাস করিল না, আমি আর কি করিব। আজ একবার শেষ চেষ্টা করিয়া বাড়ী ফিরিয়া যাইব।”

ইন্দ্ৰানন্দ গৃহে প্রত্যাগত হইয়া রাত্রির প্রতীক্ষায় রহিলেন। তিনি রাত্রের জন্য একটু প্রস্তুতও হইলেন। একটা পিস্তল পকেটে রাখিলেন। একখানা খুক্রী কোমরে বাঁধিলেন। একটা বাতী ও দিয়াশলাই সঙ্গে লইলেন।

রাত্রি নয়টার সময় যখন লোক চলাচল ক্রমে বন্ধ হইয়া আসিল, তখন তিনি নিঃশব্দে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া দেওপাট্টা ঘাটের দিকে চলিলেন। তিনি তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, চারিদিক নিৰ্জ্জন, অন্ধকার নিবিড়, কুয়াশা প্রচুর—এক হাত দূরে কিছুই দেখা যায় না।

কোন দিকে কোন পুলিসের লোক আছে কি না, তিনি প্রথমে তাহাই দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু কোথাও কাহাকে দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি ভাবিলেন, “বোধ হয় এত রাত্রে আর এখানে তাহারা নাই।”

তিনি অতি সন্তর্পণে অন্ধকারে পা টিপিয়া টিপিয়া পড়োবাড়ীর দিকে চলিলেন। এত অন্ধকার যে, তিনি পায়ে কাঠ লাগিয়া দুই একবার পড়িয়া যাইতে যাইতে বাঁচিয়া গেলেন।

তিনি পড়োবাড়ীর সন্নিকটবর্ত্তী হইয়া স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। সেই নির্জ্জন রাত্রে তিনি নিকটে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। শুনিয়া দাঁড়াইলেন, কান পাতিয়া শুনিতে লাগিলেন। তিনি প্রথমে মনে করিয়াছিলেন যে, তাঁহার নিজের পায়ের শব্দে চমকিত হইয়াছিলেন। তৎপরে তিনি ভাবিলেন, হয় ত কোন ব্যক্তি পথ দিয়া যাইতেছে।

তিনি এবার স্থিরকর্ণে শুনিতে লাগিলেন—স্পষ্ট পায়ের শব্দ, তাঁহার ন্যায় কেহ পড়ো বাড়ীর দরজার দিকে যাইতেছে। তিনি, কে যাইতেছে দেখিবার চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু অন্ধকারে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। বোধ হয়, যে ব্যক্তি যাইতেছিল, সে-ও তাঁহার পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছিল— বোধ হয় সে-ও তাঁহার পদশব্দ শুনিয়া দাঁড়াইয়াছিল,—তাঁহারই ন্যায় যথার্থ মানুষের পদশব্দ কিনা তাহাই জানিবার প্রয়াস পাইতেছে; কারণ ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, আর পায়ের শব্দ শুনা যায় না— তিনিও দাঁড়াইলেন।

আবার পায়ের শব্দ আরম্ভ হইল। ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, এই নিশাচর যে-ই হউক, সে পুনরায় বাড়ীর দিকে যাইতেছে। তিনি ভাবিলেন, “ হয় ত মীনা–না হয় তার দাদিয়া। বদমাইস দলের কেহ হইলেও হইতে পারে—পুলিসের কোন লোকও সম্ভব। যে-ই হউক, আমাকে দেখিতে হইল।”

তিনি পা টিপিয়া টিপিয়া অতি নিঃশব্দে, অতি সাবধানে অগ্রসর হইলেন। এবার তিনি অন্ধকারে সম্মুখে স্পষ্ট একটি মনুষ্য-মূর্ত্তি দেখিলেন। তাঁহার ন্যায় সেই মূর্তি পড়োবাড়ীর দিকে যাইতেছে।

তিনি নিঃশব্দে আরও অগ্রসর হইলেন। আরও সন্তর্পণে যাইতে লাগিলেন। তাঁহার সম্মুখস্থ ব্যক্তি তাহার পশ্চাতে যে কেহ আসিতেছে, তাহা জানিতে পারিল না।

তিনি প্রায় তাহার নিকটবর্ত্তী হইলেন। ঘোর অন্ধকারসত্ত্বেও তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার সম্মুখে যে যাইতেছিল, সে পুরুষ নহে—স্ত্রীলোক।

তিনি মীনা ভাবিয়া সত্বর অগ্রবর্ত্তী হইতেছিলেন। কিন্তু স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। ভাবিলেন, “যদি মীনা না হয়—তাহার দাদিয়া হয়, তবে তাহার সম্মুখে যাওয়া কোন মতেই উচিত নয়। কে ভাল করিয়া আগে দেখা উচিত।”

তিনি সেইরূপ সন্তর্পণে সম্মুখস্থ মূর্ত্তির আরও নিকটস্থ হইলেন। এবার তাহার চলনের ভাব দেখিয়া স্পষ্ট তিনি বুঝিলেন যে, এ বৃদ্ধা নয়—বালিকা। তখন তাঁহার ধ্রুব বিশ্বাদ জন্মিল যে, এ মীনা ব্যতীত আর কেহই নয়। তিনি লম্ফ দিয়া তাহার পার্শ্ববর্ত্তী হইলেন। অমনি তাঁহার চোখের উপর একখানা শাণিত খুক্রী ঝকিয়া উঠিল। তিনি খানিকটা পশ্চাতে হটিয়া আসিলেন। মৃত্যু আসন্ন ভাবিয়া চক্ষু মুদিত করিলেন। কিন্তু তাঁহার বক্ষে ছোরা পড়িল না; তিনি চক্ষু মেলিলেন। তিনি দেখিলেন, বালিকা তাড়াতাড়ি কাষ্ঠস্তূপের পশ্চাতে লুকাইতেছে। “মীনা, আমি।” বলিয়া ইন্দ্রানন্দ আবার তাহার নিকটস্থ হইলেন।

তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া সেই বালিকা বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “মীনা, আমি কয়দিন থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য ঘুরিতেছি, যাইয়ো না, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব মাত্র।”

বালিকা কোন কথা কহিল না। ইন্দ্রানন্দ তাহার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তখন সেই বালিকা বলিল, “দাদা—আমি।”

ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত—অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “আমি—আমি!”

সে বলিল, “হাঁ, দাদা, আমি দরি।”

সহসা সম্মুখে অত্যদ্ভুত কিছু দেখিলে লোকের যেরূপ ভাব হয়, আমাদের ইন্দ্রানন্দেরও তাহাই হইল; তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “তুই—তুই—দরিয়া——তুই এখানে?”

দরিয়া নতমুখে রহিল। কোন উত্তর করিল না।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দরিয়ার সাহস

ইন্দ্রানন্দ বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “তুই একেবারে পাগল হইয়া গিয়াছিস। কোন্ সাহসে এই রাত্রে এখানে একা এসেছিস?”

দরিয়া বলিল, “দাদা, আমার ভয় কি?” সে অঙ্গুলী নির্দেশে নিজের সেই শাণিত খুক্রী ভ্রাতাকে দেখাইল।

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বাবা শুনিলে রক্ষা রাখিবেন না।”

“তিনি জানিতে পারিবেন না। দাদা, আমি বাড়ীতে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকিতে পারি নাই—”

“এখন এস। আর এখানে এক মুহূৰ্ত্ত থাকা উচিত নয়।”

“আমি এ বাড়ীতে কে আছে, না দেখিয়া এক পাও নড়িব না—কিছুতেই না।”

ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর হাত ধরিতে অগ্রসর হইলেন; কিন্তু সে সরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আমি না দেখিয়া কিছুতেই যাইব না।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তুমি একটা অনর্থ না ঘটাইয়া ছাড়িবে না, দেখিতেছি।”

দরিয়া বলিল, “আমাদের ভয় কি।”

“আমি বলিতেছি, এ বাড়ীতে কেহ নাই।”

“তুমি জান না, দাদা।”

“আমি বেশ ভাল করিয়া দেখিয়াছি।”

“তুমি জান না। আমি একটু আগে উপরের জানালায় আলো দেখিয়াছি।”

“তোর ভুল হয়েছিল দরি, পাগলামী করিস না, বাড়ী চল।”

“ভুল নয়—আমি স্পষ্ট দেখিয়াছি; আরও সেই আলোয় একজনের মুখ দেখিয়াছি।”

“কাহার মুখ?”

“তোমার মীনার।”

“তোর মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে, সে এখানে নাই—আমি ভাল করিয়া দেখেছি—এ বাটীতে আর জন-প্রাণী নাই।

“তোমারই ভুল হয়েছে দাদা—আমি স্পষ্ট দেখিয়াছি। আমি এই বাড়ী না দেখিয়া কিছুতেই যাইব না।”

“বাড়ীর দরজায় চাবী দেওয়া—কোন রকমে ভিতরে যাইবার উপায় নাই।”

“আছে, তুমি এসেছ, ভালই হয়েছে। আমি একা পারিতাম না।”

“কি ভাল হইয়াছে?”

“আমরা দুজনে ধরাধরি করিয়া একখানা বড় কাঠ এই জানালায় লাগাইব; সেই কাঠে উঠিয়া উপরে যাইব।”

ভগিনীর উপর ইন্দ্রানন্দ বিরক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাহার সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়া মনে মনে প্রীতও হইলেন। ভাবিলেন, “হয় ত সত্য সত্যই মীনা এই বাড়ীর ভিতরে আছে— তিনিও যেন ঐ জানালায় একবার তাহার মুখ দেখিয়াছিলেন।” ক্রমে ভগিনীর ন্যায় তাঁহারও একবার বাড়ীর ভিতরটা দেখিবার ইচ্ছা বলবতী হইয়া উঠিল।

তিনি বলিলেন, “যখন তুই কিছুতেই ছাড়বি না—তখন একবার দেখাই যাক।”

দরিয়াও পাহাড়িয়া মেয়ে—তাহার দেহেও শক্তির অভাব ছিল না। তখন দুই জনে ধরাধরি করিয়া একটা বড় লম্বা কাঠ তুলিলেন। সেই কাঠখানা বাড়ীর প্রাচীরে লাগাইলেন। সেটা গিয়া জানালা পৰ্য্যন্ত পৌঁছিল।

দরিয়া বলিল, “আমার কাছে বাতী দিয়াশলাই আছে।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমার কাছেও আছে।” ইন্দ্ৰানন্দ প্রথমে কাঠ বাহিয়া উপরে উঠিলেন। সবলে জানালায় আঘাত করায় উহা খুলিয়া গেল। গবাক্ষে কাঠের গরাদ ছিল; বলবান ইন্দ্রানন্দের তাহা ভাঙ্গিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। তিনি গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। পশ্চাতে শব্দ হওয়ায় ফিরিয়া দেখিলেন, দরিয়াও উপরে আসিয়াছে। পাহাড়িয়া বালিকার পক্ষে এরূপ কাঠ বাহিয়া উঠা অতি সহজ কাজ।

তাঁহারা উভয়ে অন্ধকারময় গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া নিশ্বাস বন্ধ করিয়া উৎকর্ণ হইয়া রহিলেন; কিন্তু কোন দিকে কোন শব্দ শুনিতে পাইলেন না। অথচ তাঁহাদের বোধ হইল যেন, পাশের ঘরে একটা আলো জ্বলিতেছে; ঐ আলো গৃহের দ্বারের ফাঁক দিয়া এই ঘরে অল্প অল্প আসিতেছে। তাঁহারা উভয়েই সত্বরে সেই দ্বারের নিকট আসিলেন। কিন্তু আর কোন আলো দেখিতে পাইলেন না।

তখন ইন্দ্রানন্দ আলো জ্বালিলেন। সেই আলোকে গৃহটি ভাল করিয়া দেখিলেন, গৃহ মধ্যে সামান্য দুই-একটা দ্রব্য পড়িয়া আছে, তবে গৃহটি যেরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাহাতে তিনি বুঝিলেন, এ গৃহে নিশ্চয়ই কোন লোক বসবাস করে; নতুবা পড়োবাড়ীর পড়োঘর এরূপ কখনও হইতে পারে না। দরিয়াও ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল। বলিল, “দাদা, এখানে নিশ্চয়ই মানুষ আছে।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “চল দেখি।”

তখন উভয়ে আলো ধরিয়া এই গৃহের দ্বারের নিকট আসিলেন। দ্বারে ধাক্কা মারিলেন, দেখিলেন দ্বার রুদ্ধ।

ইন্দ্রানন্দ সবলে দ্বার ঠেলিলেন। তাঁহার বোধ হইল, যেন অপর দিক হইতে কে সবলে দ্বার চাপিয়া আছে। খিল দেওয়া থাকিলে দ্বার এরূপ হয় না।

তিনি ভগিনীর হাতে বাতিটা দিয়া তাঁহার শরীরে যত বল ছিল, তাহা দিয়া দ্বার ঠেলিলেন। সহসা দ্বার খুলিয়া গেল, তিনি পড়িয়া যাইতেছিলেন। অতি কষ্টে আত্মরক্ষা করিলেন।

তিনি ভগিনীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “দরি, এ দরজা কে চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিল। এ বাড়ীতে লোক আছে—আমরা আসিয়া ভাল করি নাই।“

দরিয়া বলিল, “যেই থাক; আমাদের হাতে খুক্রী আছে।”

নেপালিদের হাতে খুক্রী থাকিলে এ বিশ্ব-সংসারে তাহারা কাহাকেও ভয় করে না।

উভয়ে দ্বিতীয় গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দরিয়ার বুদ্ধি

সে প্রকোষ্ঠে কিছুই ছিল না, তাহারা পরবর্ত্তী প্রকোষ্ঠে আসিলেন। এই সময়ে তাঁহারা কাহার পদশব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইলেন, বোধ হইল, কে যেন দ্রুতবেগে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া যাইতেছে। ইন্দ্রানন্দ সিঁড়ির দিকে ছুটিলেন।

সিঁড়ির নিকটে আসিয়া তিনি কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। কাহারও পদশব্দ আর শুনিতে পাইলেন না। কিন্তু তাঁহারা উভয়েই স্পষ্ট শুনিয়াছিলেন যে, কে দুম করিয়া ছুটিয়া নীচে অতি দ্রুতবেগে নামিয়া গেল।

তাঁহারা উভয়েই স্তম্ভিত হইয়া সিঁড়ির নিকটে দাঁড়াইলেন। দরিয়া বলিল, “দেখিলে দাদা— তুমি বলিতেছিলে এ বাড়ীতে কেউ নেই। যে-ই থাক্, তার সঙ্গে আমরা দেখা করিব। সে নিশ্চয়ই বীরবিক্রমের বিষয় সব বলিতে পারিবে।”

ইন্দ্রানন্দ উচ্চকণ্ঠে বলিলেন, “মীনা—মীনা, যদি তুমি এখানে থাক, একবার দেখা কর। মীনা—মীনা—”

এবারও কেহ কোন কথা কহিল না। কোন দিকে কোন শব্দ হয় কিনা শুনিবার জন্য উভয়ে কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন; কিন্তু কেহ কোন কথা কহিল না। কোন দিকে কোন শব্দ শোনা গেল না। চারিদিকে ঘোর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিতেছে।

তখন তাঁহারা ফিরিয়া অন্যান্য ঘর দেখিতে লাগিলেন। একটা দ্বার খুলিয়া দরিয়া বলিয়া উঠিল, “দাদা, এদিকে দেখ—দেখ।”

ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, এই ঘরের একপার্শ্বে একটি বিছানা রহিয়াছে। আর দুই-চারিটি দ্রব্যও বেশ গুছান রহিয়াছে। ঘরটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দেখিলেই বোধ হয়, কেহ এ গৃহ মধ্যে সৰ্ব্বদা বাস করে।

দরিয়া বলিল, “দাদা, এ তোমার মীনার ঘর।”

নানা কারণে ইন্দ্রানন্দের মন ভাল ছিল না। তাঁহার হৃদয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “আমার মীনা—আমার মীনা আবার কি!”

দরিয়া সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিল, “এ ঘরে পুরুষ মানুষ থাকে না, তা বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে; এটা কোন স্ত্রীলোকের শোবার ঘর—এই দেখ এখানে স্ত্রীলোকের পোষাকও রয়েছে।”

এই সকল দেখিয়া ইন্দ্রানন্দের বিশেষ বিশ্বাস হইল যে, মীনা নিশ্চয়ই এই বাড়ীতে আছে তবে কেন সে দেখা করিতেছে না। কোনখানে সে নিশ্চয়ই লুকাইয়া আছে; যেমন করিয়া হয়, তিনি তাহাকে বাহির করিবেন-ই।

তিনি ভগিনীকে বলিলেন, “চল, নীচেটা দেখি।” তাঁহারা উভয়ে নীচে আসিলেন।

তিনি সেই রাত্রে নীচের ঘর যেরূপ দেখিয়াছিলেন, আজও দেখিলেন, সব ঘর সেইরূপ‍ই আছে। তাঁহারা উভয়ে নীচের সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিলেন, কিন্তু কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলেন না।

সদর দরজায় গিয়া দেখিলেন, দ্বারের ভিতরদিকে খিল নাই। ঠেলিয়া দেখিলেন, বাহিরে চাবি বন্ধ।

তাঁহারা ফিরিয়া উপরে যাইতেছিলেন, এই সময়ে বাহিরে একটা শব্দ হইল। উভয়েই সেই শব্দে চমকিত হইয়া দাঁড়াইলেন।

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “কি পড়িল?”

দরিয়া বলিল, “দাদা, এরা আমাদের এই বাড়ীর মধ্যে বন্দী করিয়াছে।”

“কেন?”

“দেখিতেছ না, কাঠখানা ফেলিয়া দিয়াছে। এ দরজায় চাবী দেওয়া আমরা উপর থেকে এখন কেমন করে নামিব?”

ভগিনীর কথায় ইন্দ্রানন্দের মুখ শুকাইয়া গেল। তিনি বলিলেন, “তোর পাগলামীর জন্য এই হ’ল—এখন উপায় কি বল্ দেখি?”

দরিয়া ভয় পাইবার মেয়ে নয়। বলিল, “আগে দেখি সত্যসত্যই কাঠটা ফেলিয়া দিয়াছে কিনা।”

তাঁহারা উভয়ে সত্বর উপরের দিকে ছুটিলেন। জানালার নিকট আসিয়া দেখিলেন, যথার্থই কে কাঠ ফেলিয়া দিয়াছে। সে দিক দিয়া আর নীচে নামিবার উপায় নাই। তাঁহারা যেখানে ছিলেন— নীচে হইতে সে স্থান প্রায় বিশ হাত উপরে।

ইন্দ্রানন্দের ললাট স্বেদাক্ত হইল। তিনি বলিলেন, “এখান হইতে আমি লাফাইয়া পড়িতে পারি,—কিন্তু তুই—”

দরিয়া স্থিরভাবে নীচের দিকে চাহিয়া বলিল, “এখান হতে লাফাইলে পা হাত ভাঙিবে।” ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “চল নীচের দরজা ভাঙিয়া বাহির হইব।”

দরিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া কি ভাবিতেছিল—সহসা সে ছুটিয়া তথা হইতে অন্য গৃহে চলিল। তাহাকে একাকী কোনখানে যাইতে দেওয়া কৰ্ত্তব্য নহে ভাবিয়া, ইন্দ্ৰানন্দ তাহার পশ্চাতে ছুটিলেন। নিজের যাহা হয় হউক, তিনি প্রাণ দিয়াও ভগিনীকে রক্ষা করিবেন। তিনি ছুটিয়া আসিয়া দরিয়ার হাত ধরিলেন।

দরিয়া বলিল, “ভয় নাই, আমি উপায় স্থির করেছি। ঐ ঘরের বিছানায় দু-তিনখানা কম্বল আছে। ঐগুলা কাটিয়া জোড়া দিলে মাটি পর্য্যন্ত পড়িবে। আমরা তার একদিক জানালায় বেঁধে ঝুলিয়ে দিব। তার পর তা ধরে অনায়াসেই নীচে নামিয়া যাইতে পারিব।

ভগিনীর বুদ্ধিতে ইন্দ্রানন্দ নিতান্ত বিস্মিত ও সন্তুষ্ট হইলেন।

দরিয়া ক্ষিপ্রহস্তে খুক্রী দিয়া কম্বল কাটিয়া সকলগুলি একত্রে জোড়া দিয়া একগাছা সুদীর্ঘ রজ্জু প্রস্তুত করিতে লাগিল।

ইন্দ্রানন্দ জানালার সম্মুখে বাতী ধরিয়া সেই আলোকে নীচে কেহ আছে কিনা দেখিবার চেষ্টা পাইলেন। দেখিলেন, কেহ নাই। সেই কাঠখানা কেবল পড়িয়া আছে।

যে কেহ এই কাঠ ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া থাকুক, সে জানালার নিচে নাই—নিশ্চয়ই নিকটে কোথায়ও লুকাইয়া আছে।

ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর নিকট কম্বল লইয়া তাহার একদিক দৃঢ়রূপে জানালায় বাঁধিলেন। তৎপরে অপর দিক ঝুলাইয়া দিয়া বলিলেন, “দরি, এই ঘরের দরজা ভাল করে বন্ধ করিয়া দাও, আমি আগে নামিব। যে লোক কাঠ ফেলিয়া দিয়াছে, সেই লোক দলবলসহ নিশ্চয়ই নিকটে কোথায় লুকাইয়া আছে—তা থাক, আমি ভয় করি না। তোমার এ ঘরের দরজা বন্ধ থাকিলে কেহ এখানে আসিতে পারিবে না। দরজা ভাঙ্গিবার আগেই তুমি নীচে নামিতে পারিবে।”

দরিয়া গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া জানালায় ফিরিয়া আসিল। ইন্দ্রানন্দ আবার একবার বাতির আলোকে নীচেটা ভাল করিয়া দেখিয়া লইলেন। তৎপরে কম্বল ধরিয়া ঝুলিয়া পড়িলেন।

কিন্তু তিনি যেমন মাটিতে পা দিয়াছেন, কোথা হইতে আসিয়া পাঁচ-সাত জন লোকে তাঁহাকে আক্রমণ করিল; দুই-চারি জনে তাঁহার মুখ চাপিয়া ধরিল। ইন্দ্রানন্দ কথা কহিতে পারিলেন না।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – পুলিসের হাতে

নীচে একটা ঠেলাঠেলির শব্দ হইল, দরিয়া বাতীর আলো জানালার বাহিরে আনিয়া দেখিল, পাঁচ-সাত জন লোকে তাহার দাদাকে আক্রমণ করিয়াছে।

দরিয়া নিমেষমাত্র বিলম্ব না করিয়া দাঁত দিয়া সুদৃঢ়রূপে খুক্রী চাপিয়া ধরিল; এবং দুই হাতে কম্বল ধরিয়া ঝুলিয়া পড়িল।

সে বাম হস্তে কম্বল ধরিয়া দক্ষিণ হস্তে মুখ হইতে খুক্রী লইতেছিল, কিন্তু তাহা পারিল না। নিম্নে যাহারা ছিল, তাহারা তাহার হাত ধরিল। মুহূর্ত মধ্যে তাহাকে বাঁধিয়া ফেলিল। ইন্দ্রানন্দ ও বন্দী হইলেন।

তখন তাহাদের মধ্য হইতে কেহ কেহ ঐ কম্বল ধরিয়া উপরে উঠিয়া গেল। একজন দরিয়া ও ইন্দ্রানন্দকে টানিয়া একপাশে আনিল। দুই-তিন জন সদর দরজা ভাঙ্গিবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। তখন ইন্দ্ৰানন্দ বুঝিলেন যে, তাঁহারা বদমাইসের হাতে পড়েন নাই—পুলিস তাঁহাদের গ্রেপ্তার করিয়াছে; ইহাতে তিনি ভীত না হইয়া বরং আশ্বস্ত হইলেন।

তিনি ব্যাপার কি পুলিস-কৰ্ম্মচারিদিগকে তাহা বুঝাইবার চেষ্টা পাইলেন; কিন্তু তাহারা তাঁহার কোন কথায় কর্ণপাত করিল না। হাসিয়া উড়াইয়া দিল।

একজন বলিল, “বাপু, ভদ্রলোকের ভাণ করে এই ছুঁড়ীকে দিয়ে ভুলিয়ে কত লোককে এখানে এনে সর্ব্বনাশ করেছ, তাকি মনে নাই?” দরিয়ার দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “এমন রত্নটিকে কোথায় পেয়েছিলে, বাপু?”

ইন্দ্রানন্দের সর্ব্বাঙ্গ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু এখন ক্রোধ প্রকাশ করা বৃথা ভাবিয়া তিনি আত্মসংযম করিলেন।

দরিয়া বলিল, “দাদা, ইহাদের ভুল হইয়াছে—পরে বুঝিবে।”

পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি ব্যঙ্গস্বরে বলিল, “হাঁ, ভুল হয়েছে বটে। গুণমণি কত লোক এখানে ভুলিয়ে এনেছ? কত জন তার খুন হয়েছে? থানায় চল—সেখানে সোজা হইয়া যাইবে। আমাদের ভারি কষ্ট দিয়াছ!”

আর একজন বলিল, “সংসারে লোক চেনা দায়—কে কবে ভেবেছিল, এই লোক এই রকম ভয়ানক কাণ্ড করতে পারে। এই রকম করে রাত্রে টাকা রোজগার—আর দিনের বেলায় লাটসাহেবী। বাবা, বাহাদুরী আছে, বটে!”

আর একজন বলিল, “কত খুন করেছে, কে জানে।”

পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি বলিল, “উপস্থিত এই দয়ামলের কাণ্ডেই কাজ শেষ হ’য়ে যাবে।”

ক্রোধে, দুঃখে, ক্ষোভে ইন্দ্রানন্দ তাহাদের কথা নীরবে বসিয়া শুনিতেছিলেন। এখন তাহাদের সহিত তর্কবিতর্ক করিয়া কোনই ফল নাই, তবে তিনি ভগিনীর উপরও অতিশয় বিরক্ত হইতেছিলেন। সে-ই এই সকল অনিষ্টের মূল, সে-ই এ বিপদ আনিয়াছে। তিনি জানিতেন যে, পুলিস ভুল করিয়া তাঁহাদের ধৃত করিয়াছে। তাঁহাদের খালাস হইতে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইবে না—তবে লোক সমাজে আর মুখ দেখাইবার উপায় রহিল না। পিতাকেই বা কিরূপে মুখ দেখাইবেন। অতি বিষণ্ণ ও উদ্বিগ্নচিত্তে তিনি নীরবে বসিয়া রহিলেন।

দরিয়া বলিল, “দাদা, আমাদের ভয় কি!”

ইন্দ্রানন্দ তখন অত্যন্ত রুষ্ট, কোন কথা কহিলেন না।

ক্রমে পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ বাড়ীর ভিতর হইতে বাহিরে আসিল। এবং তাহাদের আসামী লইয়া চলিল।

তখন প্রায় ভোর হইয়াছে। সৌভাগ্যের বিষয় পথে অধিক লোকজন নাই; নতুবা ইন্দ্রানন্দের লজ্জার সীমা থাকিত না। নইনিতালে তাঁহাকে অনেকেই জানে। তাহাদের সম্মুখে পুলিসের হস্তে বন্দী হইয়া এরূপভাবে ভগিনীর সহিত যাইতে তাঁহার মাথা কাটা যাইত।

তাঁহারা থানায় নীত হইলেন। তখনও ইনস্পেক্টর সাহেব উঠেন নাই। পুলিস-কৰ্ম্মচারিরা তখন আসামী কোথায় রাখিবে, তাহাই স্থির করিতে লাগিল। একজন বলিল, “ইনস্পেক্টর সাহেব যতক্ষণ না উঠেন, হাজত ঘরে থাক।”

অপরে বলিল, “স্ত্রীলোক পুরুষ একসঙ্গে কেমন করে রাখা যায়?”

প্রথম ব্যক্তি বলিল, “ওকে দাদা বল্‌ছিল, বোধ হয়, দুজনে ভাই বোন। তার উপর কতক্ষণই বা থাকবে—সকাল হয়ে গেছে। এখনই ইনস্পেক্টর সাহেব উঠবেন।”

তাহাই হইল।

একজন কনষ্টেবল তথায় পাহারায় রহিল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – মুক্তি

প্রাতে ইনস্পেক্টর নিজের আফিসে আসিয়া বসিলেন। অন্যান্য কার্য্যের পর তিনি বলিলেন, “বলবন্ত সিং, আপনার আসামী কই?”

সব-ইনস্পেক্টর বলবন্ত সিং বলিলেন, “হাজত ঘরে।”

ইনস্পেক্টর। এবার আপনার নিশ্চয় প্রমোসন হবে। আপনি একটা প্রধান বদমাইসের দলের সর্দ্দারকে গ্রেপ্তার করেছেন।

সব-ইনস্পেক্টর। সকলই আপনার অনুগ্রহ।

ইনস্পেক্টর। তাদের এখানে নিয়ে আসুন।

বলবন্ত সিং আসামী আনিতে প্রস্থান করিলেন। তিনি একটা মহা দুৰ্জ্জয় দস্যুকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন। তাঁহার আসামীকে দেখিবার জন্য থানার আফিস ঘরে থানাস্থ সকলে সমবেত হইলেন। সকলই উৎসুক ও ব্যগ্র।

ইন্দ্রানন্দ ও দরিয়া ইনস্পেক্টরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ইন্দ্রানন্দ লজ্জায় মাথা তুলিতে পারিলেন না। তাঁহাদের উভয়ের হাতেই হাতকড়ি।

ইনস্পেক্টর কিয়ৎক্ষণ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া, চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া রহিলেন তৎপরে ভয়ানক উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে চেয়ারে ঠেস দিয়া বসিলেন।

বলবন্ত সিং হাসির অর্থ কি, না বুঝিয়া সমধিক বিস্ময়ে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন।

ইনস্পেক্টরের হাসিতে চমকিত হইয়া ইন্দ্ৰানন্দ তাহার দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, যে ব্যক্তি বীরবিক্রমের সন্ধানে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তিনিও পার্শ্বে দাঁড়াইয়া হাসিতেছেন।

ইনস্পেক্টর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বলবন্ত সিং, এ কাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া আনিয়াছেন? বলবন্ত সিং বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “কেন বীরবিক্রম—যে দয়ামলকে খুন করেছে। আর এই মেয়েটা পথ থেকে লোককে ভুলিয়ে নিয়ে যেত।”

ইনস্পেক্টর আরও অধিক হাসিয়া উঠিলেন। বলবন্ত সিং বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আপনি ইহাতে হাসিবার কি পাইলেন?”

ইনস্পেক্টর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আপনার সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড হইয়াছে— ইনি বীরবিক্রম নহেন।”

ইনস্পেক্টর একজনকে বলিলেন, “শীঘ্র হাতকড়ি খুলে দাও।” তৎপরে আর এক ব্যক্তিকে বলিলেন, “দুখানা চেয়ার আনিয়া ইঁহাদের বসিতে দাও।”

তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রানন্দ ও দরিয়ার হাতকড়ি খুলিয়া দেওয়া হইল। ইনস্পেক্টর বলিলেন, “বসুন।” তাঁহারা উভয়ে বসিলেন।

তখন ইনস্পেক্টর হাসিয়া বলিলেন, “বলবন্ত সিং বুঝি বা প্রমোসনের পরিবর্তে আর কিছু হয়।” ইনস্পেক্টরের কথায় সকলেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল। বলবন্ত সিং অতিশয় রাগত হইলেন—তাঁহার মুখ লাল হইয়া উঠিল।

যে ব্যক্তি বীরবিক্রমের বাড়ী গিয়াছিলেন, তাঁহার দিকে ফিরিয়া ইনস্পেক্টর বলিলেন, “গুরুগোবিন্দ সিং বীরবিক্রমকে খুব ভাল রকম চিনেন। কি বলেন গুরুগোবিন্দ সিং,—আমাদের বলবন্ত সিং সাহেব বীরবিক্রম বলিয়া ইঁহাকে ধরিয়া আনিয়াছেন?”

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “বলবন্ত সিং সাহেবের ভুল হইয়াছে। ইনি বীরবিক্রম নহেন। ইনি গুণারাজ সাহেবের ছেলে—ইন্দ্রানন্দ—নইনিতালের অনেকেই ত ইঁহাকে চিনে।”

ইনস্পেক্টর বলবন্তকে বলিলেন, “শুনিলেন।”

সর্ব্বসমক্ষে এরূপ অপদস্থ ও হাস্যাস্পদ হওয়ায় বলবন্ত সিং উন্মত্তপ্রায় হইয়াছিলেন। তাঁহার কণ্ঠ হইতে বাক্য নিঃসরণ হইল না। তিনি কষ্টে বলিলেন, “ইহাদের সেই বাড়ীতেই গ্রেপ্তার করিয়াছি।”

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “তা ত নিশ্চয়ই, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইঁহারা তাহাদের দলের কেহ নহেন।” তৎপরে তিনি ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া দরিয়াকে দেখাইয়া বলিলেন, “ইনি কে?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “ইনি আমার ভগিনী।

ইনস্পেক্টর। ওঃ! ইঁহারই সঙ্গে না বীরবিক্রম সাহেবের বিবাহের কথা হয়?

ইন্দ্ৰানন্দ। হাঁ।

ইনস্পেক্টর। ভুল ক্রমে আমাদের লোকে আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিয়াছিল—কিছু মনে করিবেন না।

ইন্দ্রানন্দ। না, এখন আমরা বাড়ী যাইতে পারিলেই হয়।

ইনস্পেক্টর। আপনারা বীরবিক্রমের সন্ধানেই সেখানে গিয়াছিলেন?

ইন্দ্ৰানন্দ। হাঁ।

ইনস্পেক্টর। বীরবিক্রম সাহেব যে এখানে যাওয়া-আসা করেন, তাহা আপনারা কিরূপে জানিলেন?

গোপন করা বৃথা দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের বিছানায় যে পত্র দেখিয়াছিলেন, সে কথা বলিলেন। শুনিয়া ইনস্পেক্টর জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা হলে বীরবিক্রমের সন্ধানে আপনি সেখানে আগেও গিয়াছিলেন?”

ইন্দ্ৰানন্দ। হাঁ, গিয়াছিলাম।

ইনস্পেক্টর। কি দেখিয়াছিলেন, আমাকে সব খুলিয়া বলুন।

ইন্দ্রানন্দ সকলই বলিলেন। শুনিয়া ইনস্পেক্টর জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাড়ীর দরজায় চাবী বন্ধ ছিল, আজ আপনারা কিরূপে বাড়ীর ভিতরে গিয়াছিলেন?”

ইন্দ্ৰানন্দ আনুপূর্ব্বিক সকল কথা বলিলেন। তখন ইনস্পেক্টর বলিলেন, “তবে আপনার বিশ্বাস যে, এই বাড়ীর ভিতর লোক ছিল?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “হাঁ।”

ইনস্পেক্টর পার্শ্বস্থ একব্যক্তির সহিত নিম্নস্বরে কি পরামর্শ করিতে লাগিলেন। পরক্ষণে ইন্দ্রানন্দের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনারা এখন যাইতে পারেন।”

ইন্দ্রানন্দ ও দরিয়া সত্বর থানা হইতে বহির্গত হইলেন। ইন্দ্রানন্দের পথে আসিতে বড়ই লজ্জা বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার বোধ হইল, যেন সকলেই তাঁহাদিগকে সহাস্যে দেখিতেছে। তিনি ভগিনীকে টানিয়া লইয়া দ্রুতপদে চলিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – গুপ্তশত্রু

এরূপভাবে ভগিনীকে লইয়া নইনিতালের রাজপথে যাইতে ইন্দ্রানন্দ বড়ই লজ্জা বোধ করিতে লাগিলেন। তিনি সত্বর দুইখানা ডাণ্ডি ডাকিলেন। একখানায় ভগিনীকে তুলিয়া দিয়া অপরখানায় নিজে উঠিয়া বসিলেন।

সমস্ত রাত্রির জাগরণে, নিদারুণ উদ্বেগে ও চিন্তায় তাঁহার শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল তিনি আর চলিতে পারিতেছিলেন না। তিনি ডাণ্ডিওয়ালাকে তাঁহাদিগকে গৃহে লইয়া যাইতে বলিয়া ক্লান্তভাবে ডাণ্ডি ঠেসান দিয়া বসিলেন। তিনি জানেন না, কখন যে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। নিদ্রিত হইয়াই স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, যেন তিনি মীনার হাত ধরিয়া তাঁহাদের উদ্যানে বেড়াইতেছেন। আবার তখনি দেখিলেন, মহা সমারোহে দরিয়ার সহিত বীরবিক্রমের বিবাহ হইতেছে, তিনি দাঁড়াইয়া দেখিতেছেন। এমন সময়ে সহসা কে যেন পশ্চাৎ হইতে তাঁহার কাপড় ধরিয়া টানিল তিনি চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন—মীনা। মীনা হাসিতে হাসিতে বলিল, “আমাদের এমনই করে কবে বে হবে?” তিনি মীনাকে চুম্বন করিবার জন্য ধরিতে হাত বাড়াইলেন। মীনা ছুটিয়া পলাইল। ইন্দ্রানন্দ উর্দ্ধশ্বাসে তাহার পশ্চাতে ছুটিলেন—কিন্তু সে যেন এক মুহূর্তে বাতাসে মিলাইয়া গেল। ঠিক এই সময়ে ইন্দ্রানন্দের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি কোথায়, বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার বোধ হইল যেন, তিনি তখনও স্বপ্ন দেখিতেছেন। তিনি দেখিলেন, হ্রদের পাশ দিয়া যাইতেছেন। হ্রদে একখানি ক্ষুদ্র নৌকা ভাসিতেছে। মীনা সেই নৌকা লগি ঠেলিয়া বাহিয়া যাইতেছে। এবং একটি চতুৰ্দ্দশ বর্ষীয় বালক এক পার্শ্বে বসিয়া আছে।

ইন্দ্রানন্দ দুই হস্তে চক্ষু মদিত করিলেন। তখন তিনি বুঝিলেন, স্বপ্ন নয়। তিনি ডাণ্ডিতে চলিয়াছেন, হ্রদের পার্শ্বস্থ পথ দিয়া তাঁহার ডাণ্ডি চলিয়াছে। সত্য সত্যই মীনা নৌকায় যাইতেছে। তিনি কখনও কি সে মূর্তি ভুলিতে পারেন?

তিনি চীৎকার করিয়া ডাণ্ডি নামাইতে বলিলেন। বোধ হয়, তাঁহার কণ্ঠস্বর নৌকাস্থিত বালিকা শুনিতে পাইল। সে মুহূর্ত মধ্যে নৌকার খোলের ভিতর লুকাইল। তখন সেই বালক লগিটা তুলিয়া লইয়া দুই হস্তে সবলে ঠেলিতে লাগিল। নৌকা ক্রমে তীর হইতে দূরে সরিয়া যাইতে লাগিল।

ইন্দ্রানন্দ ছুটিয়া তীরে আসিলেন। তিনি “মীনা মীনা” বলিয়া চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন। কেহ উত্তর দিল না।

তখন তিনি সেই বালককে ডাকিতে লাগিলেন। কিন্তু সে তাঁহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া সবলে লগি ঠেলিয়া চলিল।

ইন্দ্রানন্দ পুরস্কারের প্রলোভন দেখাইলেন, তৎপরে ভয় দেখাইতে লাগিলেন; কিন্তু সে কিছুতেই মনোযোগ দিল না। বোধ হইল, যেন সে কালা, তাহার কানে কোন কথাই প্রবেশ করিতেছে না।

নিকটে আর কোন নৌকা ছিল না, ইন্দ্রানন্দ নিরুপায় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। নৌকাও ততক্ষণে অনেক দূরে গিয়া পড়িল।

তাঁহাকে ডাণ্ডি নামাইতে দেখিয়া দরিয়াও নিজের ডাণ্ডি নামাইল। সে সত্বরে ভ্রাতার নিকট আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “ঐ নৌকায় মীনা আছে।”

“কেমন করে জানলে?”

“আমি স্বচক্ষে তাকে দেখেছি।”

“এখন ত কেবল একটা ছোঁড়া আছে।’

“নৌকার খোলের ভিতর মীনা লুকাইয়াছে।”

দরিয়া কিয়ৎক্ষণ নৌকার দিকে চাহিয়া রহিল। ক্ষণপরে বলিল, “নৌকা অনেক দূরে গিয়াছে, না হলে সাঁতরাইয়া যাইয়া ধরিতাম। এখন গেলে ধরিতে পারিব না।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “সে নিশ্চয় ঐ নৌকায় আছে।”

দরিয়া বলিল, “দাদা, যে জন্যই হক, সে তোমার সঙ্গে দেখা করিতে চায় না; ইহার ভিতরে অনেক ব্যাপার আছে; এখন বাড়ী চল, বিবেচনা করে যা করা উচিত, করা যাবে।”

অগত্যা ইন্দ্রানন্দ আসিয়া আবার ডাণ্ডিতে উঠিলেন। দরিয়াও উঠিল, তখন তাঁহারা আবার গৃহাভিমুখে চলিলেন।

গৃহে আসিয়াও তাঁহারা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না; শুনিলেন, সেই বুড়ী আবার বাড়ীর চারিদিকে ঘুরিতেছিল। মালিদের কাছে বীরবিক্রমের এবং দরিয়ার সংবাদ লইতেছিল; শুনিয়া ইন্দ্রানন্দের হৃদয় সবেগে স্পন্দিত হইয়া উঠিল।

তিনি ভাবিলেন, “এই বৃদ্ধা নিশ্চয়ই মীনার দাদিয়া। সে কেন এখানে ঘুরিতেছে? নিশ্চয়ই তাহার মতলব ভাল নয়; একটা কি বিপদ ঘটাইবে, দেখিতেছি।”

তাঁহারা উভয়ে ডাণ্ডি হইতে নামিয়া সিঁড়ী দিয়া বাটীতে প্রবেশ করিতেছিলেন। এই সময়ে সহসা বন্দুকের আওয়াজে চারিদিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ চীৎকার করিয়া দরিয়া ভূপতিতা হইল।

ইন্দ্রানন্দ ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধরিলেন; দেখিলেন, গুলি তাহার স্কন্ধ বিদীর্ণ করিয়া গিয়াছে। ভগবান তাহাকে রক্ষা করিয়াছেন; মস্তকে বা বুকে গুলি লাগিলে সে কিছুতেই রক্ষা পাইত না।

সৌভাগ্যের বিষয় আঘাত তেমন গুরুতর হয় নাই। ইন্দ্রানন্দ তৎক্ষণাৎ নিজের রুমাল দিয়া তাহার স্কন্ধ বাঁধিয়া দিলেন। বলিলেন, “ভয় নাই, বেশী লাগে নাই।”

দরিয়া প্রথমে বিচলিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহার সাহস তৎক্ষণাৎ দেখা দিল, সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, “দাদা কে?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “কেমন করে বলব?”

দরিয়া কাতরে বলিল, “আমি ত কারও কোন ক্ষতি করি নাই!”

বন্দুকের শব্দ শুনিয়া চারিদিক হইতে লোক ছুটিয়া আসিয়াছিল। যেখান হইতে বন্দুকের শব্দ হইয়াছিল, অনেকে সেইদিকে ছুটিয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাহারা কোথাও তাহাকে দেখিতে পাইল না।

ইন্দ্রানন্দ বাগান ও বাড়ী সর্ব্বত্র তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিতে আজ্ঞা করিলেন। তাঁহার লোকজন সমস্ত স্থান তোলপাড় করিয়া ফেলিল; অথচ কোথায়ও কাহাকে দেখিতে পাইল না।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – আবার সন্ধান

ইন্দ্রানন্দের আর এরূপ গোয়েন্দাগিরি করিবার ইচ্ছা ছিল না। প্রারম্ভেই তাঁহার যথেষ্ট শিক্ষালাভ হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহার ভগিনী তাঁহাকে মহা বিভ্রাটে ফেলিল।

দরিয়ার স্কন্ধে সামান্যমাত্র আঘাত লাগিয়াছিল; সে বেদনা দুই-একদিনের মধ্যেই সারিয়া গেল। সে তখন তাহার দাদাকে আবার বীরবিক্রমের জন্য জ্বালাতন করিয়া তুলিল। দাদা তাহার জ্বালায় অস্থির হইয়া উঠিলেন।

ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের সন্ধানে না গেলে দরিয়া নিজে যাইতে চাহে; তিনি কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।

তাঁহারা লোক পরম্পরায় শুনিলেন যে, বীরবিক্রম না কি এখন কোন কোন দিন রাত্রে বাড়ী আসেন। ইহা শুনিয়া দরিয়া আরও অধীর হইয়া উঠিল; সে ভ্রাতাকে তাঁহার সন্ধানে যাইবার জন্য আরও পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল।

তবে ইন্দ্রানন্দ মনে মনে এবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, তিনি ভগিনীকে একাকী রাখিয়া কখনই আর বাড়ী হইতে যাইবেন না। তিনি বুঝিয়াছিলেন, যে কারণেই হউক তাঁহার ভগিনীর জীবন নিরাপদ নহে; যে গুলি করিয়াছিল—সে তাহাকে হত্যা করিবার জন্যই গুলি করিয়াছিল।

দরিয়ার উপর কাহার এরূপ ভয়াবহ আক্রোশ, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না। মীনার দাদিয়াই তাঁহাদের বাড়ী আসিয়া দরিয়ার সংবাদ লইয়াছিল; তবে কি সে-ই তাহাকে গুলি করিয়াছিল? দাদিয়ারই বা দরিয়াকে খুন করিবার ইচ্ছা কেন? সে তাহার কি ক্ষতি করিয়াছে? কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে না পারিয়া ইন্দ্রানন্দ অস্থির হইয়া উঠিলেন।

এই সময়ে তাঁহার পিতা গৃহে ফিরিলেন। তাঁহাকে বাড়ী ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া তিনি অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলেন; অনেক সাহস পাইলেন।

দরিয়াকে কে অলক্ষ্যে থাকিয়া গুলি করিয়াছিল, শুনিয়া গুণারাজ তাঁহার লোকজনকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করিলেন; লোকজন আরও বাড়াইলেন; যাহাতে অপরিচিত কোন লোক তাঁহার বাড়ীর নিকটে কোনরূপে আসিতে না পারে, সে বিষয়ে বিশেষ বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু মুখে প্রকাশ না করিলেও তিনি মনে মনে বড়ই ভাবিত ও সশঙ্ক হইলেন। বুঝিলেন, তিনি শত্রু-পরিবেষ্টিত হইয়াছেন। সকল অনর্থের মূল বীরবিক্রম, তাঁহাকে দরিয়া ভালবাসিয়াই এ অনর্থ ঘটাইয়াছে।

ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, নিশ্চয়ই বীরবিক্রমের কোন শত্রু তাঁহার কিছু করিতে না পারিয়া দরিয়াকে হত্যা করিবার চেষ্টা পাইয়াছে। হয় ত আরও কোন বালিকা বীরবিক্রমকে ভালবাসিয়াছে; ঈর্ষায় উন্মত্ত হইয়া দরিয়াকে খুন করিবার চেষ্টা পাইয়াছিল; পাহাড়িয়া বালিকার এরূপ হইলে প্রায়ই জ্ঞান থাকে না। আবার এমনও হইতে পারে, দাদিয়া মীনাকে বীরবিক্রমের হাতে সমর্পণ করিতে চাহে, বীরবিক্রম সম্মত হয় না, বিঘ্ন দরিয়া—আমাদের দরিয়ার জন্য দাদিয়া কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেছে না, তাহাই সে এখন দরিয়াকে সরাইয়া নিজের কার্য্যোদ্ধার করিবে স্থির করিয়াছে। যাহাই হউক, ইন্দ্রানন্দ বিশেষ সাবধানে রহিলেন। দরিয়াকে একেবারেই বাড়ীর বাহির হইতে দিতেন না—সর্ব্বদাই তাহাকে চোখে চোখে রাখিতেন।

সৌভাগ্যের বিষয়, গুণারাজ দরিয়ার পড়োবাড়ী যাইবার কোন সংবাদ জানিতে পারিলেন না। ইন্দ্রানন্দকে বীরবিক্রমের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন, “না, বীরবিক্রমের কোন সংবাদই তিনি পান নাই।”

ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমকে লইয়া অত্যন্ত জ্বালাতন হইয়াছিলেন। মনে করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার কথা একেবারেই ভাবিবেন না; কিন্তু দরিয়া তাঁহাকে নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে দেয় কই?

এখন বীরবিক্রম রাত্রে বাড়ী আসেন শুনিয়া দরিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছিল; কিন্তু পিতা তাহাকে চোখে চোখে রাখিয়াছেন, তাহার বাড়ীর বাহির হইবার উপায় নাই।

দরিয়া ইন্দ্রানন্দকে পাগল করিয়া তুলিল। ইন্দ্রানন্দ তাহাকে অনেক বুঝাইলেন, কিন্তু সে বুঝিবার মেয়ে নহে।

ইন্দ্রানন্দ অবশেষে বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তুই আমাকে পাগল না করিয়া ছাড়িবি না দেখিতেছি। বীরবিক্রমের সঙ্গে আমাকেও ফাঁসী যাইতে হইবে।”

দরিয়া বলিয়া উঠিল, “দাদা, অমন কথা বলিয়ো না। আমি জানি, তিনি ইহার কিছুই জানেন না।”

ইন্দ্রানন্দ অতিশয় বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তুই আমার মাথা জানিস্।”

যাহাই হউক, ইন্দ্ৰানন্দ আবার বীরবিক্রমের সন্ধানে যাইতে বাধ্য হইলেন। তিনি এ জীবনে কখন মিথ্যা কহেন নাই, মিথ্যা কাহাকে বলে জানিতেন না; এখন তাঁহাকে প্রতিপদক্ষেপেই মিথ্যাকথা বলিতে হইতেছে।

তিনি পিতাকে বলিলেন, “আজ নইনিতালে আমার নিমন্ত্রণ আছে।”

গুণারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায়?”

ইন্দ্রানন্দ একজন বন্ধুর নাম করিলেন।

গুণারাজ বলিলেন, “এখন আমাদের চারিদিকে শত্রু; যাইবে যাও, কিন্তু একা যাইয়ো না। দুইজন লোক সঙ্গে লইয়া যাইয়ো।”

অগত্যা বাধ্য হইয়া ইন্দ্রানন্দ দুইজন বলবান গুর্খা সঙ্গে লইয়া অশ্বারোহণে সন্ধ্যার পূর্ব্বে নইনিতালের দিকে যাত্রা করিলেন।

প্রায় রাত্রি নয়টার সময় ইন্দ্রানন্দ নইনিতালে পৌঁছিলেন। পাছে সঙ্গিদ্বয় তিনি কোথায় যান, তাহা তাঁহার পিতাকে বলিয়া দেয়, এই ভয়ে তিনি তাহাদিগকে বলিলেন, “তোমরা ঘোড়া নিয়ে এইখানে অপেক্ষা কর। আমি ফিরিয়া আসিয়া তোমাদের ডাকিয়া লইব।”

গুর্খাদ্বয় অগত্যা তথায় থাকিতে বাধ্য হইল। তখন ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের বাড়ীর দিকে চলিলেন।

তিনি ভাবিলেন, “আজ আবার একটা কি কাণ্ড হয়—আমার মন যেন কেবল বলছে আজও একটা বিপদ আছে। দরিয়া আমাকে প্রাণে না মারিয়া ছাড়িবে না।”

তিনি চিন্তিতমনে ধীরে ধীরে বীরবিক্রমের বাড়ীর দ্বারে আসিলেন। দেখিলেন, দ্বার রুদ্ধ— তবে ইহাও দেখিলেন, তাঁহার বসিবার ঘরে আলো জ্বলিতেছে। তিনি পুনঃ পুনঃ দ্বারে করাঘাত করিলেন, কেহ দ্বার খুলিতে আসিল না।

তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে বীরবিক্রমের ভৃত্যকে ডাকিতে লাগিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে ইন্দ্রানন্দ পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। কে আসিয়া অতি সাবধানে দ্বার একটু খুলিল।

ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, বীরবিক্রম।

নবম পরিচ্ছেদ – মীনার দৌত্য

বীরবিক্রম ইন্দ্রানন্দকে অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “এস।” নিঃশব্দে ইন্দ্রানন্দ প্রবিষ্ট হইলেন। বীরবিক্রম সাবধানে দ্বার রুদ্ধ করিলেন।

ইন্দ্রানন্দ ভিতরে আসিলেন বটে, কিন্তু বীরবিক্রমের ভাব দেখিয়া তিনি নিতান্ত অশান্তি বোধ করিতে লাগিলেন। তিনি বীরবিক্রমের মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিত হইলেন। তাঁহার চেহারার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে, চক্ষু বসিয়া গিয়াছে, মুখে কালিমার দাগ পড়িয়াছে।

ইন্দ্রানন্দ গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্র তাঁহার দৃষ্টি বীরবিক্রমের টেবিলের উপর পড়িল। তিনি দেখিলেন, টেবিলের উপর একখানা মনি অর্ডারের ফরম পড়িয়া আছে। বীরবিক্রম সেখানি লিখিতে লিখিতে দরজা খুলিয়া দিতে গিয়াছিলেন।

সেখানি যে ইন্দ্রানন্দ দেখিয়াছেন, বীরবিক্রম গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াই তাহা বুঝিলেন। উভয়ে উভয়ের দিকে চাহিলেন। সহসা ইন্দ্রানন্দের সমস্ত মুখ লাল হইয়া উঠিল।

বীরবিক্রম টেবিলের সম্মুখস্থ চেয়ারে বসিয়া বলিলেন, “বস, বাড়ীর সকলে ভাল?”

ইন্দ্রানন্দ বসিলেন। বলিলেন, “হাঁ, এক রকম সব ভাল। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য তোমার বাড়ীতে ছিলাম। তুমি কোথায় গিয়াছিলে?”

“বিশেষ একটা কাজ পড়াতে নেপাল গিয়াছিলাম।”

“একখানা চিঠিও লিখিতে হয়—দরি তোমার জন্য ভাবিয়া অস্থির।”

বীরবিক্রম সে কথায় কোন উত্তর না দিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন। তৎপরে সহসা ইন্দ্রানন্দের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “কাহাকে এই মনিঅর্ডার করিতেছি জান?”

ইন্দ্রানন্দ ‘হাঁ’ ‘না’ করিয়া শেষে বলিলেন, “হাঁ, নামটা আমার চোখে পড়েছিল।”

বীরবিক্রম অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হাঁ, এ টাকা আমি দয়ামলের স্ত্রীকে পাঠাইতেছি। দয়ামল এক সময়ে আমার বাবার কাছে চাকরী করিত।”

ইন্দ্রানন্দ কেবলমাত্র বলিলেন, “হাঁ, আমি শুনিয়াছি।”

বীরবিক্রম বিকট হাস্য করিলেন। সেই হাসিতে চমকিয়া ইন্দ্ৰানন্দ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বিস্মিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন।

বীরবিক্রম সেইরূপ হাসিয়া বলিলেন, “তবে তুমি কেবল এই পৰ্য্যন্ত শুনেছ। নিজে এ বিষয়ে কোন সন্ধান লও নাই—দেওপাট্টা ঘাটের পড়োবাড়ীতে এ বিষয়ের সন্ধানে যাও নাই?”

যে বিষয় ইন্দ্ৰানন্দ বিশ্বাস করিয়াও করিতে পারিতেছিলেন না—পড়োবাড়ীর বদমাইসের সহিত বীরবিক্রমের যে কোন সম্বন্ধ আছে, এ কথা ইন্দ্রানন্দের মনে সহস্রবার হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তিনি কিছুতেই ইহা বিশ্বাস করিতে চাহেন নাই। এক্ষণে বীরবিক্রমের কথায় তাঁহার সকল সন্দেহ দূর হইল। তাঁহার হৃদয় দ্রুততরবেগে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “হাঁ, আমি দেওপাট্টা ঘাটে গিয়াছিলাম। দরি নিতান্ত অস্থির হওয়ায় আমি গিয়াছিলাম।”

বীরবিক্রম তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তাকে কি বলেছ?”

ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, দরি যে এখানে আসিয়াছিল, তাহা বীরবিক্রম জানিতে পারেন নাই। ইহাতে তিনি অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন। বলিলেন, “তাকে আর কি বলিব। বলিয়াছিলাম, তুমি ক্ষেপিয়া গিয়াছ।”

বীরবিক্রম তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর তুমি নিজে কি মনে কর?”

ইন্দ্রানন্দ কি বলিবেন, স্থির করিতে পারিলেন না। অবশেষে বলিলেন, “সত্য কথা বলিতে কি, আমি কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।”

এই সময়ে কে দ্বারে আঘাত করিল। বীরবিক্রম চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দ্বারে কে পুনঃ পুনঃ আঘাত করিতে লাগিল। তখন বীরবিক্রম নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে দ্বারের দিকে গেলেন। ইন্দ্রানন্দ সেইখানেই বসিয়া রহিলেন।

ইন্দ্রানন্দ শব্দে জানিতে পারিলেন যে, বীরবিক্রম দ্বার খুলিলেন, তৎপরে কে জিজ্ঞাসা করিল, “এই কি বীরবিক্রম সাহেবের বাড়ী?”

কণ্ঠস্বরে ইন্দ্রানন্দ চমকিত হইলেন। পরে শুনিলেন, বীরবিক্রম বলিলেন, “হাঁ।”

যে আসিয়াছিল, সে বলিল, “আপনার সঙ্গে কথা আছে, ভিতরে যাইতে পারি?” বীরবিক্রম ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “তোমার যা বলিবার আছে, এইখানেই বলিতে পার।” বোধ হয়, সে তাহার এ কথা শুনিতে পাইল না। বরাবর গৃহ মধ্যে চলিয়া আসিল। ইন্দ্রানন্দ উঠিয়া গৃহের একপার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি দেখিলেন একটি বালিকা গৃহ মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইল। বালিকা তাহাকে দেখিতে পাইল না।

ইন্দ্ৰানন্দ তাহাকে দেখিয়া চিনিতে পারিলেন; তিনি কি কখনও সে মূর্ত্তি ভুলিতে পারেন? তিনি দেখিলেন, বালিকা—মীনা।

মীনা নতশিরে মাটির দিকে চাহিয়া ছিল। সে সেইভাবেই বলিল, “মনিয়াকে পুলিস ধরে নিয়ে গেছে, আপনি তাকে খালাস করে দিন।”

বীরবিক্রম বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “কে?”

মীনা সেইরূপ মাটির দিকে চাহিয়া বলিল, “এই কথা বলার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে।” বীরবিক্রম বলিলেন, “কে তোমায় পাঠাইয়াছে?”

মীনা বলিল, “দাদিয়া।”

ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, এই কথা শুনিয়া বীরবিক্রমের মুখে কালিমার ছায়া পড়িল। ইন্দ্রানন্দ স্পষ্ট দেখিলেন, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ মুহূর্ত্তের জন্য কাঁপিয়া উঠিল।

বীরবিক্রম নীরব।

দশম পরিচ্ছেদ – বালিকা—রহস্যময়ী

বীরবিক্রমকে কথা কহিতে না দেখিয়া মীনা বলিল, “তবে আমি যেতে পারি?”

বীরবিক্রম ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “না, অপেক্ষা কর।”

তিনি একদৃষ্টে বালিকাকে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতেছিলেন। কিন্তু সে পাষাণ-মূর্ত্তির ন্যায় মাটির দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়াছিল। গৃহ মধ্যে আসিয়া সে একবারও মুখ তুলে নাই।

বীরবিক্রম বিস্মিতভাবে তাহাকে দেখিতেছিলেন। এরূপ বিষাদমাখা অথচ তেজপূর্ণ মুখ তিনি আর কখনও দেখেন নাই।

ইন্দ্রানন্দও ব্যাকুলভাবে বালিকাকে দেখিতেছিলেন। সেই বালিকার মূর্ত্তি এ কয়দিনে তাঁহার হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইয়াছিল; তিনি যত তাহাকে ভুলিবার চেষ্টা করিয়াছেন, ততই সেই মুখ তাঁহার হৃদয়ে আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। তিনি তাহার সহিত একবার মাত্র দেখা করিবার জন্য কত না চেষ্টা করিয়াছেন।

সহসা বীরবিক্রম জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”

বালিকা ধীরভাবে বলিল, “আমি জানি না।“

বীরবিক্রম বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “জানি না!”

বালিকা বলিল, “তাহাতে আপনার প্রয়োজন কি?”

বীরবিক্রম বলিলেন, “প্রয়োজন আছে—তুমি কে না জানিলে আমি তোমার কথা কিরূপে বিশ্বাস করি?”

বালিকা মুখ তুলিল না। বলিল, “আমি দাদিয়ার সঙ্গে পড়োবাড়ীতে থাকি।”

“তুমি দাদিয়ার সঙ্গে থাক? কই, আমি যখন সেখানে গিয়াছি, তোমাকে ত দেখি নাই।”

“তা জানি। দাদিয়া কখনও আমাকে আপনার সম্মুখে যেতে দেয় নাই। তবে আমি আপনাকে দেখেছি, আমি আপনাকে—”

বালিকা সহসা থামিল।

ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, বীরবিক্রমের সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল।

বীরবিক্রম বলিলেন, “আচ্ছা তুমি যাও, আমি নিজে এখনই সেখানে যাইব।”

বালিকা বলিল, “আপনি সেখানে এখনই যাবেন।”

মীনা যেরূপভাবে ও স্বরে এই কথা বলিল, তাহাতে ইন্দ্রানন্দ স্পষ্ট বুঝিলেন যে, যদি বীরবিক্রম আজ পড়োবাড়ীতে যান, তবে তাঁহার বিপদ ঘটিতে পারে। তিনি অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “তা হ’লে আমিও তোমার সঙ্গে যাইব।”

ইন্দ্রানন্দের কণ্ঠস্বরে চমকিত হইয়া মীনা ফিরিল। কিয়ৎক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া রহিল। তৎপরে তাহার মুখ রক্তাভ হইয়া উঠিল। সে মস্তক অবনত করিল। অতি মৃদুস্বরে সলজ্জভাবে বলিল, “আপনি এখানে?” তৎপর মুহূর্ত্তেই সে অতি ব্যাকুলস্বরে বলিল, “আপনি কি সেখানে যাবেন? “

ইন্দ্ৰানন্দ অগ্রবর্ত্তী হইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “হাঁ, আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে যাইব। তোমাদের বাড়ীর ব্যাপার যতদূর আমি সেদিন দেখিয়াছি, তাহাতে আমার মতে একা না গিয়া দুজনে যাওয়া ভাল।”

মীনা কেবলমাত্র বলিল, “জানি না। দাদিয়া হয় ত রাগ করিবে।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তোমার দাদিয়ার রাগের জন্য আমি বিশেষ চিন্তিত নই—তবে বীরবিক্রম যদি না যায় সে স্বতন্ত্র কথা।”

মীনা কোন কথা কহিল না। মস্তক অবনত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আমি তোমাকে সেখানে এই রাত্রে যেতে কিছুতেই পরামর্শ দিই না।”

কিন্তু বীরবিক্রম যাওয়াই স্থির করিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “ভয় নাই—আমি যাব স্থির করিয়াছি।”

ইন্দ্রানন্দ ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “একজন পুলিসের লোক সঙ্গে লইলে ভাল হয় না?“

বীরবিক্রম সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, “না—না—না।” তৎপরে সংযতভাবে বলিলেন, “আমার একটি লোকের সঙ্গে এখনই দেখা করিবার কথা আছে।”

ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, বীরবিক্রম তাঁহাকে বিদায় করিতে চাহেন। তিনি বলিলেন, “তুমি যদি পড়োবাড়ীতে যাও, তবে আমি তোমার সঙ্গে যাইব।”

বীরবিক্রম ম্লানহাসি হাসিয়া বলিলেন, “আনন্দ, তোমার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে। যখন কোন বন্ধু গোলমালে পড়ে, তখন আর সে বন্ধুর সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখা উচিত নয়—ইহাই সংসারের নিয়ম।”

ইন্দ্রানন্দ কোন উত্তর দিবার পূর্ব্বেই তিনি মীনার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “তুমি এখন যাইতে পার। আমি নিজেই তোমার দাদিয়ার সঙ্গে দেখা করে সকল কথা শুনিব।”

মীনা সে কথায় কোন উত্তর না দিয়া তাহার বিশাল নয়নদ্বয় বিস্ফারিত করিয়া ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া বলিল, “আপনি কি ইঁহার সঙ্গে যাইবেন বলিয়া স্থির করিয়াছেন?”

ইন্দ্রানন্দ তাহার কথায় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন, “হাঁ।”

বীরবিক্রম তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। তিনি ভাবিলেন, “এই বালিকা কেন এরূপ বলিতেছে? তবে কি আজ সেখানে গেলে বিপদের আশঙ্কা আছে?“

তিনি মীনার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “যদি আমরা তোমাকে সঙ্গে লইতে না চাই?”

মীনা বলিল, “লইতে চাহিবেন।”

বীরবিক্রম কিয়ৎক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তৎপরে বলিলেন, “আচ্ছা, তাহাই। তোমরা এইখানে অপেক্ষা কর, আমি আমার কাজ সারিয়া এখনই আসিতেছি। তারপর একসঙ্গে যাইব।”

তিনি বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, কিন্তু ফিরিয়া ইন্দ্রানন্দকে ডাকিলেন। উভয়ে সে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া অন্য গৃহে আসিলেন।

একাদশ পরিচ্ছেদ – কৌশলে কাৰ্য্যসিদ্ধি

ইন্দ্রানন্দ ও বীরবিক্রম অন্য প্রকোষ্ঠে আসিলেন। বীরবিক্রম বলিলেন, “তুমি এই বালিকাকে কোথায় দেখিয়াছিলে—পড়োবাড়ীতে?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “হাঁ, সে ঐ বাড়ীর বাহিরে রাত্রে বেড়াইতেছিল—ভয়ে বাড়ীর ভিতর যাইতে পারিতেছিল না। বলিল, বাড়ীর ভিতরে কাহার মৃতদেহ রয়েছে।”

“ও রকম মেয়ের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা করিয়ো না।”

“কি রকম মেয়ে—কেন উহার দোষ কি?”

“যাই হউক, আমার কথা শোন ত মেয়েটিকে বিদায় করে দাও।”

“এখন কিরূপে হয়, ও সঙ্গে যেতে চাহিতেছে—কেমন করে বিদায় করি।”

“তবে অপেক্ষা কর, আমি আসছি।”

এই বলিয়া বীরবিক্রম সত্বর দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গেলেন। কিন্তু তিনি দুইপদ অগ্রসর হইতে-না-হইতে ইন্দ্রানন্দ তাঁহার হাত ধরিলেন। ধরিয়া বলিলেন, “দেখ বিক্রম, আমাদের বোধ হয় একে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ভাল।”

বীরবিক্রম মৃদুস্বরে শ্লেষ করিয়া বলিলেন, “তাদের দলের একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে অদ্য অধিক নিরাপদ হব—এই তোমার বুদ্ধি!”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি, মীনার দ্বারা উপকার ভিন্ন কোন অপকার হইবে না।”

“তবে তাই—আমি এখনই আসিতেছি।” এই বলিয়া বীরবিক্রম দ্রুতপদে অন্ধকারে অন্তর্হিত হইলেন।

ইন্দ্রানন্দ ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, মীনা সেইরূপ পাষাণ-মূর্তির ন্যায় মস্তক অবনত করিয়া এখনও দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বীরবিক্রম দশ মিনিটের মধ্যে ফিরিয়া আসিবে বলিয়াছে।”

মীনা বলিল, “আপনি তা জানেন।”

ইন্দ্রানন্দ মীনার হাত ধরিলেন। মীনা হাত টানিয়া লইল না। ইন্দ্রানন্দ তখন সস্নেহে বলিলেন, “তুমি সেই পৰ্য্যন্ত দাঁড়িয়ে আছ? এস, বস।”

সেই স্নেহস্পর্শে মীনার সর্ব্বশরীর এক মুহূর্ত্তে পুলকিত হইয়া উঠিল; সে যখন এই স্নেহাবেগের মর্ম্ম বুঝিতে পারিল না, তখন সে তৎসম্বন্ধে কোন কথা কহিতে পারিল না। নিষ্পলকনেত্রে, অবাঙ্গুখে প্রাণহীনার ন্যায় ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ইন্দ্রানন্দ তাহার হাত ধরিয়া লইয়া গিয়া একখানা চেয়ারে বসাইলেন। সে যন্ত্রচালিতের ন্যায় বসিল।

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য দুইদিন পড়োবাড়ীতে গিয়াছিলাম, তুমি দেখা কর নাই কেন?”

সে বলিল, “আমি ছিলাম না।”

“কোথায় গিয়াছিলে?”

“বলিব না।”

ইন্দ্রানন্দ কিয়ৎক্ষণ তাহার দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া রহিলেন। অবশেষে বলিলেন, “তুমি একদিন রাত্রে সেখানে নিশ্চয় ছিলে—তুমি দরজা চাপিয়া ধরিয়াছিলে—তুমিই সিঁড়ী দিয়া ছুটিয়া পালিয়েছিলে।”

মীনা আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া মুখ তুলিল। বলিল, “না, আমি ছিলাম না।”

ইন্দ্রানন্দ সে রাত্রের ঘটনা আনুপূর্ব্বিক বলিলেন। মীনা শুনিয়া যেন বিস্মিত হইল। বলিল, “আমি ছিলাম না।”

ইন্দ্রানন্দ তাহার কথা বিশ্বাস করিলেন। বলিলেন, “তবে কে ছিল?”

মীনা বলিল, “জানি না।”

“তোমার দাদিয়া নয়?”

“কিরূপে জানিব?”

“তার পর দিন নৌকায় তোমায় দেখিয়াছিলাম। আমায় দেখে নৌকার ভিতরে লুকাইয়াছিলেন। কেমন নয় কি? বল, সে-ও তুমি নয়?”

“মিথ্যাকথা বলিব কেন? হাঁ, আমি নৌকায় ছিলাম।’

“তবে আমায় দেখিয়া লুকাইলে কেন?”  

“আপনি পুলিসে খবর দিবেন বলিয়াছিলেন—আমি মনে করিয়াছিলাম, আপনার সঙ্গে পুলিসের লোক আছে।”

“পুলিসকে তোমার এত ভয় কেন?”

“আমাদের জন্য নয়—আপনার বন্ধুর জন্য।”

“আমার বন্ধুরই বা ভয় কি?”

“সে কথা আপনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন।”

“বীরবিক্রম কাহাকেও যে খুন করিয়াছেন, তাহা আমি বিশ্বাস করি না।”

“তবে তাঁহার এত ভয় কেন?”

ইন্দ্রানন্দ এ কথায় কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিলেন। তৎপরে সবেগে বলিয়া উঠিলেন, “যদি কেহ খুন করিয়া থাকে, তবে তোমার দাদিয়াই করিয়াছে—সে সব পারে।”

একটু বিস্মিতভাবে মীনা ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে চাহিল। বলিল, “যদি দাদিয়াই খুন করে থাকে, তবে আপনার বন্ধুর এত ভয় কেন? আর দাদিয়াকেই বা এত ভয় করেন কেন? আর দাদিয়াকে বাঁচাইবার জন্য এত চেষ্টা করেন কেন?”

ইন্দ্রানন্দ এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলেন না। মীনা বলিল, “তবে কেন ইনি দাদিয়ার হুকুম পাইলেই ছুটিয়া তার কাছে যান? আমি নিজে তোমার বন্ধুকে খুন করিতে দেখি নাই—কিন্তু মড়াটা তাঁহাকে টানিয়া আনিতে দেখিয়াছি; তাঁহার হাত দুখানা রক্তে ডুবিয়া গিয়াছিল।” বলিয়া মীনা শিহরিয়া উঠিল। ইন্দ্রানন্দেরও বীরবিক্রমের সেদিনকার সেই রক্তাক্ত হাত মনে পড়িল।

উভয়েই কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। সহসা মীনা মুখ তুলিয়া বলিল, “এখনও যে তিনি ফিরিলেন না, বোধ হয়, এখন আর তিনি আসিবেন না; আমার বোধ হইতেছে, তিনি আপনাকে সঙ্গে লইবেন না বলিয়া ফাকী দিয়া চলিয়া গিয়াছেন।”

এই কথা শুনিয়া ইন্দ্ৰানন্দ লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যস্ত হইয়া উদ্বিগ্নমুখে কহিলেন, “তুমি সকলই জান, অথচ আমাকে বল নাই।”

ইন্দ্রানন্দ মনে করিলেন, এই ধূর্তা বালিকা কৌশলে তাঁহাকে এখানে রাখিয়াছে। আর তাঁহার বন্ধুকে একাকী বিপদের মুখে যাইতে দিয়াছে।

মীনা তাঁহার মনের ভাব বুঝিল। তাহার দীর্ঘায়ত চক্ষুদুটি অশ্রুপূর্ণ হইয়া ছলছল করিতে লাগিল।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – বিবাহ-প্রস্তাব

তাহার চোখে জল দেখিয়া ইন্দ্রানন্দের হৃদয়ে দারুণ বেদনা অনুভূত হইল। তিনি তাহাকে অবিশ্বাস করিয়াছেন ভাবিয়া, মনে মনে বড়ই লজ্জিত হইলেন। তিনি মীনার হাত ধরিয়া সাদরে বলিলেন, “আমার বন্ধুর জন্য আমি বড়ই ব্যস্ত হইয়াছি; তুমি কি মনে কর, তাঁহার কোন বিপদ্ হইতে পারে?”

মীনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া সংক্ষেপে কহিল, “সম্ভব।”

ইন্দ্রানন্দ সত্বর দরজার দিকে চলিলেন। প্রাণ থাকিতে তিনি জানিয়া-শুনিয়া বন্ধুকে কখনই বিপদের মুখে যাইতে দিতে পারেন না।

কিন্তু মীনা ক্ষিপ্রহস্তে তাঁহার হাত ধরিল। বলিল, “প্রায় এক ঘণ্টা হইল তিনি চলিয়া গিয়াছেন, এখন আপনি গিয়া তাঁহার কোন উপকারই করিতে পারিবেন না। হয় ত তাঁহার কোন বিপদ্ হইবার সম্ভাবনা নাই। দাদিয়াকে তিনি ভাল রকমেই জানেন। কিন্তু আপনার কথা স্বতন্ত্র।”

ইন্দ্রানন্দ তাহার হাত ছাড়াইয়া লইয়া বলিলেন, “যাহাই হউক, আমি এখনই সেখানে যাইব।” মীনা ব্যগ্র হইয়া আবার তাঁহার হাত চাপিয়া ধরিল। কাতরভাবে বলিল, “না— না—আমি আপনাকে সেখানে কিছুতেই যাইতে দিব না। জানেন না, আপনি কোথায় যাইতেছেন।”

বালিকার কথায় ও ভাবে বিস্মিত হইয়া ইন্দ্ৰানন্দ বলিলেন, “আমি তোমার কথা কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না।”

মীনা বলিল, “আপনি সেখানে গেলে আপনার জীবনের আশঙ্কা আছে।”

ইন্দ্রানন্দ নিজের হাত ছাড়াইয়া লইলেন। বলিলেন, “আমি এতদূর কাপুরুষ নই।”

তিনি দ্বারের দিকে ছুটিলেন। মীনা আসিয়া তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইল। বলিল, “যদি আপনি যান, তাহা হইলে আমিও যাইব।”

তাঁহারা বাহির হইতেছিলেন, সম্মুখে দেখিলেন—পুলিসের একজন ইনস্পেক্টর—আর দুইজন কনষ্টেবল। পুলিস দেখিয়া নিমেষ মধ্যে মীনা অন্ধকারে দরজার পার্শ্বে লুকাইল। ইনস্পেক্টর ইন্দ্রানন্দকে ডাকিয়া বলিলেন, “বীরবিক্রম সাহেব বাড়ীতে আছেন কি?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “না, তিনি বাড়ী নাই। তাঁহাকে কেন?”

ইনস্পেক্টর তাঁহার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “ও! আপনি ইন্দ্রানন্দ সাহেব—আপনাকে আমি জানি। বীরবিক্রমের নামে একখানা ওয়ারেন্ট আছে।”

ইন্দ্রানন্দ ভীত ও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের ওয়ারেন্ট?”

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “খুনের—তিনি দয়ামলকে খুন করিয়াছেন। আমরা একবার তাঁহার বাড়ীর ভিতরটা, দেখিব।”

ইন্দ্রানন্দ কোন কথা কহিতে পারিলেন না। নীরবে পুলিস-কৰ্ম্মচারিদিগের সহিত গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন।

এই সকল ব্যাপারে তাঁহার মস্তিষ্ক এত আলোড়িত হইয়াছিল যে, মীনা লুকাইয়াছে, তখন সে কথা তাঁহার মনেই পড়িল না।

ইনস্পেক্টর সমস্ত বাড়ীটা দেখিয়া বলিলেন, “না তিনি এখানে নাই,” বলিয়া তিনি সে বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।

বীরবিক্রমের এই ভয়াবহ বিপদের সংবাদ পাইয়া ইন্দ্ৰানন্দ নিতান্তই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন। কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সহসা কে তাঁহার পৃষ্ঠে হস্ত দেওয়ায় তিনি চমকিত হইয়া ফিরিলেন, দেখিলেন—মীনা। তাহাকে দেখিয়া ইন্দ্রানন্দের সকল কথা মনে পড়িল। তাঁহার বন্ধু যে, এখন ওয়ারেন্ট অপেক্ষাও অধিকতর বিপদে পড়িয়াছেন, তাহা তাঁহার স্মরণ হইল।

তিনি বলিলেন, “তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”

মীনা বলিল, “লুকাইয়াছিলাম।”

“কেন?”

“কেন? পুলিস যে!”

ইন্দ্রানন্দের হৃদয় স্পন্দিত হইল। তিনি বলিলেন, “আমাদের অনেক দেরী হইয়া গিয়াছে— শীঘ্র চল।”

মীনা কোন কথা না কহিয়া ইন্দ্রানন্দের অনুসরণ করিল।

তাঁহারা দ্রুতপদে চলিতেছিলেন। সহসা মীনা বলিল, “এ পথে নয়—হয় ত এদিককার পথে পুলিস আছে। তারা আমাকে দেখিলে ধরিতে পারে—তাহা হইলে পড়োবাড়ীতে ফিরিবার উপায় থাকিবে না।”

ইন্দ্ৰানন্দ ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, “আর কোন পথ আছে?”

মীনা বলিল, “আমার সঙ্গে আসুন—আমি যে পথে লইয়া যাইব, সে পথে কেহ নাই।” বহুক্ষণ উভয়ে নীরবে চলিলেন। তৎপরে সহসা ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মীনা, তুমি পড়োবাড়ীতে এই রকম ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে, দেখে-শুনে আবার সেইখানেই কি থাকবে?”

“না।”

“কোথায় থাকবে?”

“জানি না।”

“সে কি, কোথায় থাকবে জান না?”

“হাঁ, আজ আমি যখন সে বাড়ী ছেড়ে এসেছিলাম, তখন মনে মনে স্থির করেই এসেছিলাম, আর সেখানে ফিরে যাব না।”

“কেন, তোমার দাদিয়া কি তোমায় আর যত্ন করেন না?”

“না, আগে করিতেন, এখন আর নয়। তার পর–”

“তার পর কি মীনা? “

“বলিতে পারি না।”

“আমাকেও না?”

“না।”

আবার উভয়ে নীরবে চলিলেন। তৎপরে ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “কোথায় থাকিবে মীনা?” মীনা অতি হতাশভাবে বলিল, “যেখানে ভগবান রাখিবেন।”

ইন্দ্রানন্দ আত্মবিস্মৃত হইলেন। অত্যন্ত আগ্রহের সহিত সপ্রেমকণ্ঠে বলিলেন, “আমাদের বাড়ীতে চল না কেন? “

মীনা আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তৎপরে ধীরে ধীরে অতি মৃদুকণ্ঠে বলিল, “আপনার বাড়ীতে থাকিলে লোকে বলিবে কি?”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “কেন, আমি তোমায় বিবাহ করিব।” মীনা সবিস্ময়ে ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ভীষণ ঘটনা

বোধ হয়, এ কথা শুনিবার প্রত্যাশা মীনা কখনও করে নাই; সে কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিল। অবশেষে কি ভাবিয়া মৃদুহাস্য করিল।

তাহার হাসি দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ অত্যন্ত উৎসাহের সহিত বলিলেন, “হাসিতেছ কেন? ইহাতে হাসির কথা কি আছে? আমি নিশ্চয়ই তোমাকে বিবাহ করিব।”

সহসা মীনার মুখ একেবারে ম্লান হইয়া গেল। সে ত বিষণ্নমুখে—অতি মৃদুস্বরে কহিল, “আপনার মন ভাল–আপনি সংসারের এখনও কিছুই জানেন না–তাহাই এরূপ মনে করিতেছেন। আমি অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াছি—এখনও মনে দুঃখ কষ্ট পাইতেছি—আমি পিতৃমাতৃবিহীনা—অজ্ঞাতকুলশীলা ভিখারিনী, আপনার বাবা আমার সঙ্গে আপনার বিবাহ দিবেন কেন?’

একটা মধুরতর আবেগে ইন্দ্রানন্দের সমগ্র হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। ইন্দ্রানন্দ মীনাকে এরূপভাবে কথা কহিতে কখনও শুনেন নাই। এ বালিকা কি কখন ভদ্রঘরের কন্যা না হইয়া আর কিছু হইতে পারে? তিনি সোৎসাহে বলিলেন, “সে আমি দেখিব, তোমার কোন আপত্তি আছে কিনা, তাহাই আমাকে বল।”

মীনার চক্ষু জলে পূর্ণ হইল। অন্ধকারে ইন্দ্রানন্দ তাহা দেখিতে পাইলেন না। তবে তাহার বাষ্পকম্পিত গদগদস্বরে বুঝিলেন, মীনা অতি কষ্টে কথা কহিতেছে। মীনা বলিল, “আমায় মাপ করুন। আপনার বন্ধু এখন বিপন্ন—এখন আপনার কি এরূপ কথা কহা উচিত?”

এই ক্ষুদ্র বালিকার কথায় ইন্দ্রানন্দ নিতান্ত লজ্জা বোধ করিলেন; তিনি যে নিতান্তই অপদার্থ ও নরাধম, তাহা এই বালিকার কথায় তাঁহার বিশেষ উপলব্ধি হইল। তিনি নীরবে মীনার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন।

উভয়ে কেহই কাহারও সহিত আর কথা কহিল না। ইন্দ্রানন্দ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মীনার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। সহসা মীনা একস্থানে দাঁড়াইল। চারিদিক ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল। অবশেষে পথ ঠিক করিয়া লইয়া কহিল, “এইদিকে আসুন।”

ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, তিনি হ্রদের তীরে আসিয়াছেন। মীনা জলের দিকে অনেকখানি নামিয়া গিয়াছে।

চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। একান্ত নির্জ্জনতায় প্রকৃতি গম্ভীরা। কোনদিকে কিছুই দেখা যায় না। তাঁহারা যেখানে আসিয়াছেন, সেদিকে রাত্রে—রাত্রে কেন?—দিনে কখনও লোক চলে না।

মীনা কাহাকে “মনিয়া মনিয়া” বলিয়া খুব উচ্চকণ্ঠে ডাকিল; স্বর বহুদূরে গেল, কিন্তু কেহ উত্তর দিল না। তখন সে ইন্দ্রানন্দের দিকে ফিরিয়া বলিল, “এদিকে আমাদের পিছনে পুলিস আসিতে পারিবে না। আমরা এখান হইতে নৌকায় যাইব, তাহা হইলে কেহই আমাদের সঙ্গ নিতে পারিবে না। আর নৌকায় গেলে আমরা শীঘ্র যাইতেও পারিব।”

সত্যকথা বলিতে কি, ইন্দ্রানন্দের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁহার মনে সন্দেহের উদ্রেক হইতেছিল। ভয়ও যে হইতেছিল না—তাহাও নহে। তবে তিনি প্রাণ থাকিতে মীনাকে কখনও অবিশ্বাস করিতে পারেন না।

ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনিয়া কে?”

মীনা বলিল, “যে ছেলেটিকে আপনি সেদিন নৌকায় দেখিয়াছিলেন। সে-ও আমাদের মত গরীব—আমাকে বড় ভালবাসে।”

“সে নৌকায় আছে?”

“না, নৌকা রেখে কোথায় গিয়াছে—সে ত এমন কখনও করে না। নৌকাই তার ঘর-বাড়ী— নৌকা ভাড়া দিয়া কিছু কিছু রোজ পায়।”

“তবে উপায়?”

“সে এইখানেই কোনখানে আছে।’

মীনা এবার স্বর আরও উচ্চে তুলিয়া “মনিয়া মনিয়া” বলিয়া ডাকিল; এবারও কেহ উত্তর দিল না।

তখন ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “সে নাই, তাহা হইলে কি হবে?”

মীনা বলিল, “তার নৌকা এখানে আছে—সে নিশ্চয়ই এইখানে কোথায় গিয়াছে। সে না থাকে, না থাক, আমি নৌকা লইয়া যাইব—আমার এ অভ্যাস খুব আছে—আসুন।”

ক্ষুদ্র নৌকা সেইখানে বাঁধা ছিল। মীনা নৌকা খুলিয়া দুই হাতে নৌকা চাপিয়া ধরিয়া ইন্দ্রানন্দকে বলিলেন, “উঠুন।”

ইন্দ্রানন্দ নীরবে উঠিলেন। ভাল মন্দ বিচারের সময় তখন তাঁহার একেবারেই ছিল না।

অন্ধকারে মীনা নৌকা বাহিয়া চলিল। তখন প্রায়ই নৌকা চলাচল বন্ধ হইয়াছিল—বোধ হইতেছিল, যেন দূরে দূরে দুই-একখানি নৌকা যাইতেছে।

নীরবে মীনা নৌকা বাহিয়া চলিতেছিল—ক্রমে তাহার নৌকা দেওপাট্টা ঘাটের নিকটস্থ হইল। অন্ধকারে সেই পড়োবাড়ীটা বিকটাকার দৈত্যের মত দাঁড়াইয়া আছে।

সে এতক্ষণ পরে কথা কহিল। বলিল, “আমরা সেই বাড়ীর কাছে এসেছি—এইখান দিয়ে এ বাড়ীর থেকে একটা সুড়ঙ্গ পথ আছে—ওটা সময়ে সময়ে জলে ডুবে যায়, ঐখান দিয়ে তারা দয়ামলকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল।”

ইন্দ্রানন্দ শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন—কোন কথা কহিলেন না।

হঠাৎ মীনা বলিয়া উঠিল, “এ কি?” তৎপরে সে বিস্ফারিতনয়নে জলের দিকে চাহিয়া রহিল।

ইন্দ্ৰানন্দ ভীত হইয়া বলিলেন, “কি! কি!”

মীনা কম্পিত, অস্ফুটস্বরে বলিল, “দেখুন—দেখুন কে?

ইন্দ্রানন্দ স্পন্দিতহৃদয়ে জলের দিকে চাহিলেন। তিনি অন্ধকারসত্ত্বেও স্পষ্ট দেখিলেন যে, জলে একটা মনুষ্য-দেহ ভাসিতেছে।

তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ বাত্যাবিতাড়িত বংশপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল। হৃদয় সবেগে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি নিঃসংজ্ঞের ন্যায় সেই দেহের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

মীনা নৌকা বাহিয়া সেই ভাসমান মনুষ্য-দেহের অতি সন্নিকটে আনিল। বলিল, “কি সৰ্ব্বনাশ! এ কে!”

ইন্দ্রানন্দ সাহসে ভর করিয়া দুইহাতে টানিয়া দেহটা নৌকার নিকটে আনিলেন; এবং তৎপরে তাহার মস্তক জল হইতে উপরে তুলিলেন।

তখনই তাঁহার কণ্ঠ হইতে এক বিকট শব্দ নির্গত হইল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ ভগবান, কি ভয়ানক—এ যে আমাদেরই বীরবিক্রম! “

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – অসহায়

এইবার বীরবিক্রমের কথা বলিব।

যে কারণেই হউক, বীরবিক্রমের ইন্দ্রানন্দকে সঙ্গে লইয়া যাইবার ইচ্ছা ছিল না। তিনি ফিরিয়া আসিবেন বলিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে ইচ্ছা তাঁহার ছিল না।

তিনি দ্রুতপদে অন্ধকারে সকলের অলক্ষ্যে পড়োবাড়ীর দিকে আসিতেছিলেন। পাছে কেহ তাঁহাকে দেখিতে পায় বা তাঁহার অনুসরণ করে, ভয়ে তিনি মধ্যে মধ্যে চারিদিকে চাহিতেছিলেন।

তিনি অবশেষে পড়োবাড়ীর দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, কোথায় কেহ নাই। পুলিসের লোক আর এ বাড়ীর পাহারায় নাই। তাহারা ভাবিয়াছিল, যখন এখানকার বদমাইসগণ পুলিসের ভয়ে পলাইয়াছে, তখন আর শীঘ্র ফিরিবে না।

তাহাদের অপেক্ষা দাদিয়া যে সহস্রগুণ অধিক চালাক ছিল, তাহা তাহাদের জ্ঞান ছিল না। দাদিয়া জানিত, দয়ামলের খুনের পর এই বাড়ীর উপর পুলিসের দৃষ্টি পড়িবে, তাহাই সে মীনাকে লইয়া এখান হইতে সরিয়া গিয়াছিল।

তাহার পর সে পুলিসকে বেশ জানিত। সে নিশ্চয় জানিত, পুলিস একবার এ বাড়ী দেখিয়া- শুনিয়া গেলে আর আসিবে না। তাহাই সে নিশ্চিন্তমনে আবার এখানে ফিরিয়া আসিয়াছিল।

বীরবিক্রম দ্বারের নিকট কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া পরে দ্বারে আঘাত করিতে লাগিলেন। কেহ দ্বার খুলিতে আসিল না।

তিনি আবার পুনঃ পুনঃ দ্বারে আঘাত করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি ভিতরে কাহার পদশব্দ শুনিলেন; অগৌণে দ্বারের ছিদ্র দিয়া আলো দেখা দিল। তিনি বুঝিলেন, কে দ্বার খুলিতে আসিতেছে।

দাদিয়া আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। বীরবিক্রম গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন বৃদ্ধা আবার অতি সাবধানে দ্বার রুদ্ধ করিল। বীরবিক্রমকে বিরক্তভাবে চারিদিকে চাহিতে দেখিয়া সে বিকট হাস্য করিয়া উঠিল। বলিল, “এখানে তোমার জন্য কৌচ, টেবিল ভাল ভাল আস্রাব আছে কি না তাই দেখছ?”

বীরবিক্রম আরও বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “না, তাহা দেখিতেছি না।”

বৃদ্ধা আবার হাসিল। তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। বীরবিক্রম তাহার দিকে না চাহিয়া বলিলেন, “আজ আমি এসেছি কেন জান?”

বৃদ্ধা আবার সেইরূপ বিকট হাস্য করিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, “কর্তব্য-কৰ্ত্তব্য— কর্তব্যের জন্য এসেছ। আমাকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে এসেছ।”

বীরবিক্রম বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “বাজে কথায় কাজ নাই—তুমি আমাকে একটা কথা বলবার জন্য একটি মেয়েকে পাঠাইয়াছিলে?”

“হাঁ।”

“তুমি একজনকে পুলিসের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে বলেছ? তুমি কি মনে কর যে, তোমার যত বদমাইসকে আমি পুলিসের হাত থেকে উদ্ধার করিব?”

বৃদ্ধার চক্ষু যেন আরও জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, “হাঁ, তাই আমার ইচ্ছা।”

বীরবিক্রম ক্রোধে বলিলেন, “তোমার ইচ্ছা হতে পারে—আমার নয়। আমি তোমার অনেক কথা—সব কথা শুনেছি—আর শুনতে পারি না।”

বৃদ্ধা বহুক্ষণ ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “জান, এখানে কে এসেছিল? একজন স্ত্রীলোক তোমার সন্ধানে এখানে এসেছিল— কোনদিন না কোনদিন সে তোমাকে—“

বীরবিক্রম বাধা দিয়া বলিলেন, “সে কে?”

“আর কে—দয়ামলের স্ত্রী।”

এই সংবাদে বীরবিক্রম যে বিশেষ বিচলিত হইলেন, তাহা চেষ্টাসত্ত্বেও তিনি গোপন করিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, “সে বেচারীর জন্যে আমি অতিশয় দুঃখিত আছি। আমার যা সাধ্য, তার উপকার করিবার চেষ্টা পাইতেছি। আমি তাকে টাকা পৰ্য্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছি।”

বৃদ্ধা বিকট শব্দ করিয়া উঠিল। বিকট শব্দে বলিল, “আরে বোকা, তোর সে সর্ব্বনাশ করেছিল, তা বুঝতে পারিস নাই?”

বীরবিক্রম বৃদ্ধার ভাবে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “কেন, কি হয়েছে?”

বৃদ্ধা ক্রোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “কেন, কি হয়েছে—বুঝিতে পারিতেছ না, সে তোকেই সন্দেহ করিবে?”

“টাকা আমি বেনামী করিয়া পাঠাইয়াছি।”

“বেনামী করে পাঠিয়েছ?” বৃদ্ধা বিকট হাস্য করিয়া উঠিল। সহসা ক্রোধে তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল।

বীরবিক্রমও কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিলেন। অবশেষে বলিলেন, “যদিই বা সে জানতে পারে যে, আমি টাকা পাঠিয়েছি, তাহাতেই বা আমার ভয় কি? তুমি ভুগিবে, না আমি?”

বৃদ্ধা পেচকের মত কর্কশকণ্ঠে বলিল, “তুই—তুই—তুই—আমি নয়। তুই ফাঁসী যাবি, আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না। আমি যেমন এই গর্তে আছি—তেমনই মাটির ভিতর মিশিয়ে যাব—কেউ খুঁজে পাবে না—খুঁজবেও না।”

বৃদ্ধার এইরূপ কঠোরবাক্যে বীরবিক্রমের সর্ব্বাঙ্গ ক্রোধে কাঁপিতে লাগিল। রুদ্ধরোষে শ্বেতবর্ণ হইয়া তিনি বলিলেন, “আমার ফাঁসী হয়, তাতে তোমার কি আনন্দ হবে?”

বৃদ্ধা বিকট হাস্য করিল। সে সময়ে বৃদ্ধাকে যে দেখিত, সেই বলিত যে, বৃদ্ধা পাগল— ভয়াবহ পাগল। এই অবস্থায় সে সবই করিতে পারে। বোধ হয়, বীরবিক্রমের মনেও তাহাই হইল। তিনি সভয়ে দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু মুহূৰ্ত্ত মধ্যে বৃদ্ধা তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দাঁড়াইল। বীরবিক্রম আপনা-আপনিই দুই-চারিপদ পশ্চাতে হটিয়া আসিলেন।

বৃদ্ধা তাঁহার হাত ধরিতে যাইতেছিল। তিনি আরও অনেকখানি সরিয়া দাঁড়াইলেন।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – রাক্ষসী না উন্মাদিনী?

বৃদ্ধা বলিল, “আমার কাছ থেকে সরিয়া যাও কেন? আমাকে ছাড়িয়া যাইতে এত ইচ্ছা কেন? এতেই আমি পাগলের মত হই। কেন আমার সঙ্গে তুমি এ দেশ থেকে চলে যেতে চাও না?”

বীরবিক্রম বলিলেন, “আমি কি কখনও যাব বলিয়াছি? আমি তা কিছুতেই পারিব না।

বৃদ্ধা আবার সেইরূপ বিকট হাস্যের সহিত বলিল, “ কেন, কেন?”

বীরবিক্রম বিরক্ত হইয়া কোন উত্তর দিলেন না।

বৃদ্ধা পুনরপি ভয়ানক হাসি হাসিয়া বলিল, “সব জানি—সব জানি—গুণারাজের মেয়ে দরিয়াকে ছেড়ে যেতে চাও না—হা—হা—হা”

বৃদ্ধার কথায় বীরবিক্রম শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি দরিয়ার জন্য অতিশয় ভীত হইলেন। এই বৃদ্ধা কিরূপে দরিয়ার কথা জানিল? সে সব করিতে পারে—তিনি তাহার কথায় স্পষ্টই বুঝিলেন যে, দরিয়ার উপরেও ইহার ভয়ানক রাগ। দরিয়াকে কে গুলি করিয়াছিল জানিতে পারিলে, তিনি এখন কি ভাবিতেন, বলা যায় না। যাহা হউক, তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া কথা ফিরাইয়া লইবার জন্য বলিলেন, “যে মেয়েটিকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে, সে কে?”

বৃদ্ধা উপেক্ষাভরে কহিল, “সে কথা না-ই শুনলে, শুনে লাভ? সে এখানে থাকে—তাকে আমরা মীনা বলে ডাকি।”

“সে কার মেয়ে?”

“তাহাতেই বা তোমার দরকার কি?”

“দরকার আছে—আমি জানিতে চাই, সে কে।”

“তবে শোন—তোমার বোন।”

বীরবিক্রম ভাবিলেন, এই উন্মত্তা স্ত্রীলোক তাঁহার সহিত উপহাস করিতেছে। তিনি বিস্মিতভাবে বৃদ্ধার দিকে চাহিয়া রহিলেন।

বৃদ্ধা তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া বলিল, “মিথ্যা কথা নয়—সত্য। সব কথা পরে বলিব।”

“কই, এখানে আমি পূর্ব্বে এই মেয়েটিকে দেখি নাই।”

“আমি দেখিতে দিই নাই।”

“কেন?”

“সে আমার ইচ্ছা।”

“তাকে কি এমন করে এখানে রাখা উচিত?”

বৃদ্ধা আবার হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, “তাই ত, বোনের উপর যে ভারি মায়া, দেখছি। ভয় নাই, সে আর আসবে না—তাকে আমি দূর করে দিয়েছি।”

“কোথায়?”

“জাহান্নমে।”

“কাজটা কি ভাল হয়েছে?”

“ভাল কি মন্দ, সে আমি বুঝি।”

বীরবিক্রম অতিশয় রাগত হইলেন। বলিলেন, “আর কোন কথা আছে? আমি এখানে সমস্ত রাত্রি থাকিতে পারি না।”

বৃদ্ধার চক্ষু অধিকতর জ্বলিল। সে বলিল, “আছে—আর একটু আছে; এই দিকে এস, একটা জিনিষ তোমাকে দেখাই।”

বীরবিক্রমের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। তিনি ভাবিলেন, হয় ত আর একটা খুন হইয়াছে। তিনি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “আমি কিছু দেখিতে চাই না।”

“ভয় নাই—ভয় নাই,” বলিয়া বৃদ্ধা বীরবিক্রমের হাত ধরিল। তাহার স্পর্শে বীরবিক্রমের সর্ব্বশরীর যেন জড়তা প্রাপ্ত হইল। বৃদ্ধা তাঁহাকে টানিয়া লইয়া চলিল—তিনি নীরবে চলিলেন। বৃদ্ধা তাঁহাকে একটা ঘরের মধ্যে আনিয়া তাঁহার হাত ছাড়িয়া দিল। এবং তৎক্ষণাৎ— বীরবিক্রমকে বিস্ময় প্রকাশের অবসর না দিয়া, বৃদ্ধা সেই গৃহের দরজায় চাবী বন্ধ করিয়া দিয়া চাবী নিজের বস্ত্রাঞ্চলে লুকাইল।

বীরবিক্রম বন্দী হইলেন, সেই ঘরের ভিতরে আবদ্ধ হইয়া বীরবিক্রমের সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল। এই সেই ঘর—এই ঘরে দয়ামল একদিন রাত্রে ছিল। তিনি ব্যাকুলভাবে বৃদ্ধার দিকে চাহিলেন।

বৃদ্ধা বিকট হাস্য করিল। তাহার চক্ষু অন্ধকারে নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল। সে বিকট হাস্য করিয়া বলিল, “এ ঘরের কথা মনে পড়ে—সেই দয়ামল—মনে পড়ে তার কথা? তাকে এরই নীচে রেখে দিয়েছি।”

বীরবিক্রমের সর্ব্বশরীরের রক্ত যেন এক পলকে জল হইয়া গেল। তিনি কম্পিতস্বরে কহিলেন, “তাহাকে জলে পাওয়া গিয়াছিল।”

বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়া কহিল, “পথ আছে।”

বীরবিক্রমের বড় ভয় হইল; তিনি সবেগে ছুটিয়া গিয়া দ্বারে পদাঘাত করিলেন। বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি তাড়কারাক্ষসীর ন্যায় বীরবিক্রমকে আক্রমণ করিল; এবং প্রচণ্ডবেগে একটা ধাক্কা দিয়া ঘরের মাঝখানে ঠেলিয়া দিল। তিনি গৃহের মধ্যস্থলে গিয়া ভূপতিত হইলেন।

বীরবিক্রম তৎক্ষণাৎ উঠিবার প্রয়াস পাইলেন; কিন্তু উঠিবার পূর্ব্বেই তাঁহার পায়ের নীচ হইতে ঘরের মেজেটা সরিয়া গেল। তিনি নীচে পড়িয়া গেলেন—যেখানে পড়িলেন, সেখানে গভীর জল। তিনি আত্মরক্ষার জন্য প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। চীৎকার করিয়া উঠিলেন। উপর দিকে চাহিয়া দেখিলেন, বৃদ্ধা গহ্বরের একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে। এবং উল্কাপিণ্ডের ন্যায় তাহার চোখদুটা ভীষণভাবে জ্বলিতেছে—কি ভয়ানক! তাহার মুখ দেখিয়া বীরবিক্রমের ভয় হইল। কিন্তু তিনি এক মুহূর্তের জন্য ভাবিলেন না যে, বৃদ্ধা তাঁহাকে সত্য-সত্যই এরূপভাবে জলে ডুবাইবে। তিনি বৃদ্ধাকে বলিলেন, “সব সময়ই উপহাস; দেখ না, আমি আর জলের উপর থাকতে পারছি না।”

বৃদ্ধা কেবল উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। তখন তাহার ভাবভঙ্গী দেখিয়া যথার্থই বীরবিক্রম অত্যন্ত ভীত হইলেন। তিনি উপরে উঠিতে প্রয়াস পাইলেন—কিছুতেই উপরে উঠিতে সক্ষম হইলেন না।

বৃদ্ধা ক্ষিপ্তা বাঘিনীর ন্যায় একদৃষ্টে জলে, অন্ধকারে, গহ্বরে বীরবিক্রমের এই ঘোর জীবন যুদ্ধ দেখিতেছিল—এবং একটা ভীতিপ্রদ বিভীষিকা তাহার মুখে বিকীর্ণ হইতেছিল। ভয়ে, ঘৃণায় বীরবিক্রম মুখ অন্যদিকে ফিরাইয়া লইলেন। তিনি যখন বুঝিলেন যে, বৃদ্ধা যথার্থই তাঁহাকে খুন করিবার অভিপ্রায় করিয়াছে, তখন তিনি দন্তে দন্ত পেষিত করিয়া উপরে উঠিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন—তিনি লম্ফ দিয়া মেজের একখানা তক্তা এক হস্তে ধরিলেন। কিন্তু পর মুহূর্ত্তে বৃদ্ধা রাক্ষসীর ন্যায় কুৎসিত মুখভঙ্গী করিয়া তাঁহার মস্তকে এক ঘা লাঠী বসাইয়া দিল। তিনি চারিদিকে অন্ধকার দেখিলেন—তাঁহার কানে বৃদ্ধার বিকট হাস্য একবারমাত্র ধ্বনিত হইল। তখনই তাঁহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – শুশ্রূষা

মীনা মিথ্যা বলে নাই। এই বাড়ার ভিতর একটা ঘরের নীচে হইতে একটা সুড়ঙ্গ ছিল। ঐ সুড়ঙ্গ হ্রদের সহিত মিলিত ছিল; কাহাকেও ঐ ঘরের ভিতরস্থ গর্ভে ফেলিতে পারিলে, তাহার আর রক্ষা পাইবার উপায় ছিল না।

গর্ভের মুখ সুকৌশলে তক্তা দিয়া ঢাকা থাকিত। উহা এমন সুকৌশলে স্থাপিত ছিল যে, মেজের একস্থান সবলে টিপিলে তৎক্ষণাৎ গর্ভের মুখের তক্তা সরিয়া যাইত—যে সেখানে সেই সময়ে দাঁড়াইয়া থাকিত, সে-ই গর্ভের ভিতরে পড়িত। আবার মুহূর্ত মধ্যে গর্ভের মুখ বন্ধ করা যাইতে পারিত; সুতরাং একবার ইহার মুখ বন্ধ করিয়া দিলে, কাহারই এই গর্তের ভিতর বাঁচিয়া থাকিবার সম্ভাবনা ছিল না।

বৃদ্ধা এই গর্তের মধ্যেই দয়ামলের মৃতদেহ ফেলিয়া দিয়াছিল। সেই মৃতদেহ ভাসিতে ভাসিতে শেষে হ্রদের জলে গিয়া পড়িয়াছিল।

বৃদ্ধা একদিন ইন্দ্রানন্দকেও এই গর্তে ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছিল। সেইদিন মীনা তাঁহাকে রক্ষা না করিলে তাঁহার কোন মতেই রক্ষা পাইবার উপায় ছিল না।

অদ্য বৃদ্ধা বীরবিক্রমকে তাহাই করিল। বীরবিক্রমকে গর্ভে ফেলিয়া দিয়া গর্ভের মুখ বন্ধ করিয়া দিল। তিনি ভাসিতে ভাসিতে হ্রদে গিয়া পড়িলেন।

পরে মীনা ও ইন্দ্রানন্দ সংজ্ঞাহীন বীরবিক্রমকে হ্রদের জলে ভাসিতে দেখিলেন। দেখিয়া ইন্দ্ৰানন্দ নিতান্ত বিচলিত হইয়া পড়িলেন।

মীনা বলিল, “ছাড়িবেন না, ধরে থাকুন। আমি নৌকা তীরে লাগাই। আপনি একলা ওঁকে নৌকায় তুলতে পারবেন না—টানিবেন না—ও রকম করলে নৌকাখানা যে উল্টাইয়া যাইবে।”

ইন্দ্রানন্দ ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “যদি বেঁচে থাকে—যদি বেঁচে থাকে—তাহলে আর জলে থাকলে বাঁচবে না।”

মীনা গম্ভীরমুখে বলিল, “আমার কথা আপনি না শুনলে, ওঁর বাঁচবার কোন আশা থাকবে না।”

ইন্দ্ৰানন্দ হতাশ হইয়া বলিলেন, “তুমি যা বলবে তাহাই করিব।”

মীনা কহিল “খুব জোর করে ধরে থাকুন—কিছুতেই ছাড়িবেন না। আমি নৌকা তীরে লাগাই।”

ইন্দ্রানন্দ নীরবে সবলে বীরবিক্রমের দেহ ধরিয়া রহিলেন। নৌকা তীরে লাগিল। এই সময়ে পথ দিয়া অন্ধকারে কাহাকে যাইতে দেখিয়া মীনা ডাকিল, “মনিয়া—তুমি?”

যাহাকে ডাকিল, সে বলিল, “কে আমায় ডাকে?”

“আমি মীনা।”

“মীনা! এত রাত্রে তুমি এখানে?”

“শীঘ্র এদিকে এস।”

মনিয়া ছুটিয়া নিকটে আসিল। ইন্দ্রানন্দ কি অন্ধকারে ধরিয়া আছেন, দেখিতে না পাইয়া বলিল, “ও কি?”

মীনা বলিল, “একজন লোক জলে ডুবেছেন—ধর, এঁকে তীরে তুলিতে হইবে।”

মীনার হুকুম মনিয়ার নিকট বেদবাক্য ছিল। সে দ্বিরুক্তি না করিয়া একহাঁটু জলে নামিয়া বীরবিক্রমের দুই পা ধরিল। তখন তাহারা তিনজনে ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে তীরে তুলিল। মীনা বলিল, “চল।”

তিনজনে সেই দেহ লইয়া চলিলেন। ইন্দ্রানন্দের এতক্ষণ বাক্শক্তি রহিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি যখন দেখিলেন যে, মীনা সেই পড়োবাড়ীর দিকে যাইতেছে, তখন তিনি আর নীরবে থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “ও বাড়ীতে তাহারা সব আছে।”

মীনা কহিল, “কেউ নাই, দাদিয়া এ কাণ্ড করে এখানে এক মুহূর্ত্তও নাই—তখনই এখান থেকে চলে গেছে। বাড়ীতে কেউ নাই—এস।”

ইন্দ্রানন্দ আর কথা কহিলেন না। তিনজনে নীরবে বীরবিক্রমকে পড়োবাড়ীর ভিতরে লইয়া আসিলেন।

মীনা ছুটিয়া কোথায় চলিয়া গেল। দুই মিনিটের মধ্যে একটা বালিশ ও কয়েকখানা কম্বল লইয়া ফিরিয়া আসিল। একটা বাতী জ্বালিয়া একপাশে রাখিল। মনিয়াকে কহিল, “এই সব কাঠের কুচো দিয়া শীঘ্র একটু আগুন কর।”

মনিয়া তৎক্ষণাৎ সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইল। মীনা কম্বল পাতিয়া একটা বিছানা করিল। তৎপরে ইন্দ্রানন্দকে বলিল, “ধরুন, ইঁহাকে এই বিছানায় শোয়াইতে হইবে।”

এই ক্ষুদ্র বালিকার সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং উৎসাহ দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ নিতান্ত লজ্জিত হইলেন। তাঁহার কিছু করিবার ক্ষমতা একেবারে লোপ পাইয়াছিল—মীনাকে দেখিয়া তাঁহার হৃদয়ে ক্রমে শক্তি সঞ্চার হইতে লাগিল।

মীনা বীরবিক্রমের বস্ত্রাদি খুলিয়া দিয়া শুষ্ক কম্বলে তাঁহার গাত্র মুছাইয়া দিল। তৎপরে বলিল, “মনিয়া, তুমি ইঁহার দুই পায়ে খুব গরম শেক দাও।” বলিয়া ইন্দ্রানন্দকে বলিল, “আপনি ইহার সর্ব্বাঙ্গে নিজের হাত দিয়া খুব রগড়াইতে থাকুন।”

মীনা যেরূপ আদেশ করিল, তাঁহারা উভয়ে সেইরূপ করিতে লাগিলেন।

এদিকে মীনা যাহাতে বীরবিক্রমের শীঘ্র নিশ্বাস-প্রশ্বাস আরম্ভ হয়, সেজন্য দুই হাতে তাঁহার দুই হাত ধরিয়া একবার তাঁহার মস্তকের উপর এবং আবার তাঁহার পার্শ্বে রাখিতে লাগিল। মীনা নিজের নিশ্বাস বন্ধ করিয়া ক্রমান্বয়ে এইরূপ করিতে লাগিল।

মীনার মুখ লাল হইয়া উঠিল; তাহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। শিক্ষিতা শুশ্রূষাকারিণীরাও বোধ হয়, এরূপ করিতে পারিত না। মীনা ক্রমে ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছে দেখিয়া, ইন্দ্রানন্দ ব্যাকুলস্বরে বলিলেন, “আমাকে দাও, আমি ঐ রকম করিতেছি।”

মীনা নিজের ওষ্ঠে ওষ্ঠ পেষিত করিয়া বলিল, “না, আপনাকে যা বলিয়াছি, তাহাই করুন।”

প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা মীনা দম না ফেলিয়া বীরবিক্রমের নিশ্বাস-প্রশ্বাস যাহাতে পড়ে, তাহাই করিতে লাগিল। সহসা সে আনন্দপূর্ণস্বরে বলিল, “বাঁচিয়া আছেন—ভয় নাই।”

ইন্দ্রানন্দ আনন্দে লম্ফ দিয়া উঠিলেন। কিন্তু মীনা এমনই ক্রুদ্ধভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিল যে, তিনি ভয়ে বসিয়া পড়িয়া আবার সবলে বীরবিক্রমের অঙ্গে হস্তাবমর্ষণ করিতে লাগিলেন।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – আশার সঞ্চার

বীরবিক্রমের নিশ্বাস বহিতে আরম্ভ হইয়াছে, দেখিয়াই মীনা বলিয়া উঠিয়াছিল, “ভয় নাই— বেঁচে আছেন।” কিন্তু তখনও সে সেইরূপভাবে তাঁহার দুই হাত উপর-নীচে করিতেছিল।

ইন্দ্রানন্দ নীরবে থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “আমি একজন ডাক্তার ডেকে আনিব?”

মীনা বলিল, “ডাক্তার ইহার বেশী আর কি করিবেন? তবে এখানে ইঁহাকে কিছুতেই রাখিতে পারা যায় না—ডাক্তার আসিয়া এখন কিছুই করিতে পারিবে না। আর মাথার আঘাতও তেমন গুরুতর বলিয়া বোধ হইতেছে না।”

ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “মাথায় আঘাত!’

মীনা বলিল, “হাঁ, এইজন্য ইনি এ যাত্রা বাঁচিয়া গিয়াছেন। ঐ আঘাতে অজ্ঞান না হইলে জল খেয়ে ডুবিয়া যাইতেন। আপনি গা-ঘসা বন্ধ করিবেন না।”

·

কিয়ৎক্ষণ পরে বীরবিক্রম দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন; তৎপরে তিনি তাঁহার চক্ষু অৰ্দ্ধ নিমীলিত করিলেন। দেখিয়া মহানন্দে ইন্দ্ৰানন্দ প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। মীনার কৃষ্ণতড়াগতুল্য চক্ষুদুটিও জলে একেবারে পূর্ণ হইয়া গেল। ইন্দ্রানন্দ গদগদকণ্ঠে বলিলেন, “মীনা, তুমিই ইঁহার প্রাণরক্ষা করিয়াছ।”

তাঁহার কণ্ঠস্বরে বীরবিক্রম চক্ষু বিস্তৃত করিয়া চাহিলেন, কিন্তু তখনও তাঁহার সম্পূর্ণ সংজ্ঞা হয় নাই—তিনি মৃদু হাস্য করিবার চেষ্টা পাইলেন; অবশেষে যেন কাহার কথা শুনিবার জন্য কান পাতিয়া রহিলেন।

মীনা ইন্দ্রানন্দের কানের নিকটে মুখ লইয়া গিয়া কহিল, “এঁকে এখান থেকে যত শীঘ্র হয়, নিয়ে যেতেই হবে।”

ইন্দ্রানন্দ ব্যাকুলস্বরে বলিলেন, “আমি এ অবস্থায় কোথায় নিয়ে যাই—কেমন করে নিয়ে যাই?”

মীনা বলিল, ‘এখন এঁকে এঁর বাড়ী নিয়ে যেতে পারা যায় না—সেখানে পুলিস এসেছিল— আবার আসবে।”

“তবে কোথায় আমি ইঁহাকে লইয়া যাই?”

“আপনাদের বাড়ীতে নিয়ে যান।”

‘সেখানেও ত পুলিস যেতে পারে?”

“যাতে ইনি সেখানে আছেন, তা পুলিস না জানতে পারে, তাই করতে হবে।”

“কেমন করে এঁকে এ অবস্থায় এতদূর নিয়ে যাব?’

“মনিয়া যেমন করে হয়, একটা ডাণ্ডি যোগাড় করে আনবে।”

মীনা তৎক্ষণাৎ মনিয়াকে ডাণ্ডির সন্ধানে যাইতে আদেশ করিল। আদেশ পাইয়া মনিয়াও তীরবেগে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।

এই সময়ে বীরবিক্রম পাশ ফিরিলেন। তাঁহার নিশ্বাস এখন স্বাভাবিকভাবে পড়িতে আরম্ভ হইল। তিনি চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন।

মীনা তাঁহার নিকট মুখ লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এখন আপনি ভাল বোধ করছেন?”

বীরবিক্রম ধীরে ধীরে বলিলেন, “হাঁ, কিন্তু আমি—আমার কিছু মনে পড়ছে না।”

একদিন ইন্দ্রানন্দ মীনার জন্য যে ব্রাণ্ডী আনিয়াছিলেন, তাহা সেইরূপই ছিল। মীনা সত্বর ছুটিয়া গিয়া ব্রাণ্ডীটুকু লইয়া আসিল। বলিল, “আপনি একটু ইহা খান দেখি।”

বীরবিক্রম পান করিলেন। তৎপরে কিয়ৎক্ষণ মীনার মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “আমি কোথায় যেন তোমায় দেখিয়াছি—আর—আর যেন কোন চেনা লোকের কথা শুনিতে পাইলাম।”

সহসা বীরবিক্রমের সকল কথা মনে পড়িল। তাঁহার মুখ বিভীষিকায় বিকৃত হইল—তিনি ব্যাকুলভাবে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন; অবশেষে বলিয়া উঠিলেন, “তিনি কোথায়—তিনি কোথায়? “

মীনা বলিল, “এই আপনার বন্ধু ইন্দ্রানন্দ এখানেই আছেন। তিনি আপনাকে লইয়া যাইবেন।” ইন্দ্ৰানন্দ নিকটস্থ হইয়া সজলনয়নে গদগদকণ্ঠে বলিলেন, “হাঁ, এই যে আমি আছি।”

বীরবিক্রম বলিলেন, “তুমি-তুমি—এখানে? “

ইন্দ্রানন্দ সোৎসাহে বলিলেন, “আমি এখনই তোমাকে আমাদের বাড়ী নিয়ে যাব, আমরা ডাণ্ডি আনতে লোক পাঠিয়েছি।”

বীরবিক্রম কোন কথা কহিলেন না। চক্ষু মুদিত করিলেন।

এই সময়ে মনিয়া ডাঙি লইয়া আসিল। তাঁহারা সকলে ধরাধরি করিয়া বীরবিক্রমকে ডাণ্ডিতে শোয়াইয়া দিলেন।

তখন বীরবিক্রম চক্ষুরুন্মীলন করিলেন। ব্যাকুলভাবে মীনার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি এস।”

ডাণ্ডিওয়ালা ডাণ্ডি তুলিল। তখন ইন্দ্রানন্দ মীনার নিকটে আসিয়া তাহার হাত ধরিলেন। বলিলেন, “এস।”

মীনা অন্যমনস্কভাবে বলিল, “আমি আপনাদের বাড়ী?—না।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “কোথায় যাইবে? আমি তোমাকে কিছুতেই এখানে থাকিতে দিব না।” মীনা আবার বলিল, “না।”

ইন্দ্রানন্দ তাহার হাত ধরিয়া অতি কাতরভাবে অনুনয় করিয়া বলিলেন, “বীরবিক্রম এখনও ভাল হয় নাই; যদি পথে তাঁর অসুখ বাড়ে, আমি কি করিব—আমার মাথার ঠিক নাই। তুমি না থাকিলে আমি তাঁকে বাঁচাইতে পারিব না।”

মীনা কোন কথা না কহিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। ডাণ্ডিওয়ালাগণ তাড়াতাড়ি করিতে লাগিল। তখন ইন্দ্রানন্দ পুনরপি কাতরভাবে বলিলেন, “তুমি এঁর প্রাণ রক্ষা করিয়াছ, এখন কি ইহাকে পথে মরিতে বল। অন্ততঃ একে আমাদের বাড়ী পর্য্যন্ত পৌঁছাইয়া দাও—তার পর যাহা হয় করিয়ো।”

মীনা কোন কথা কহিল না। চলিল—ডাণ্ডির পশ্চাতে পশ্চাতে চলিল। অতিশয় আনন্দিত হৃদয়ে ইন্দ্রানন্দ তাঁহার পার্শ্বে পার্শ্বে চলিলেন। মীনাকে কোন কথা বলিতে তাঁহার সাহস হইল না।

তখন সেই অন্ধকার রাত্রে—ইন্দ্রানন্দ আর মীনা বীরবিক্রমকে লইয়া বাড়ীর দিকে চলিলেন।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – পথিমধ্যে

বহুক্ষণ ইন্দ্রানন্দ নীরবে চলিলেন। মীনাও একটি কথা কহিল না।

ক্রমে এইরূপে নীরবে যাওয়া ইন্দ্রানন্দের পক্ষে কষ্টকর হইয়া উঠিল। তিনি মীনাকে কহিলেন, “তুমি কি মনে কর?”

মীনা কহিল, “কি বিষয়ে?”

“এই বীরবিক্রমকে কে জলে ফেলিয়া দিয়াছিল?”

“ইনি ভাল হউন—ইনিই নিজে বলিবেন! “

“কিন্তু আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, এ তোমার ঐ পিশাচী দাদিয়ার কাজ।”

“আপনার ভুল—দাদিয়া কিছুই করে নাই।”

“কেন?”

“যতদিন বীরবিক্রম আসেন নাই, ততদিন দাদিয়া বড় ভাল ছিল, আমাকে ভারি যত্ন করিত— আমাকে খুব ভালবাসিত। বীরবিক্রম আসা পর্য্যন্ত, বিশেষ সেইদিন—যেদিন তিনি তাকে মেরে ফেলেন—“

“না—না—তিনি কখনও একাজ করিতে পারেন না।”

“সব শুনুন।”

“বল।”

“সেইদিন হইতে দাদিয়া যেন আর একজন মানুষ হল—বোধ হয়, সেদিন থেকে দাদিয়া ক্ষেপে গিয়েছিল। কিন্তু আমি আর একটা বিষয় জানতে পেরেছিলাম।”

“কি?”

“অনেক রাত্রে কে একজন লোক দাদিয়ার কাছে আস্ত— কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, সে কেমন করে বাড়ীর ভিতর আস্ত তা বলা যায় না। আমি দুদিন তাকে দেখেছিলাম, তার পরে সে কে— কেমন করে বাড়ীর ভিতর আসিল, দেখিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় — সব দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল।”

“হয় ত দড়ি বহিয়া জানালা দিয়ে আসিত।”

“কিন্তু সে যখন আসত, তখন দাদিয়াকে আর দেখতে পেতাম না। আমি লুকাইয়া দাদিয়াকে কত খুঁজেছি, কিন্তু দেখিতে পাই নাই।”

“তুমি সেই লোকটার মুখ দেখিয়াছিলে?”

“হাঁ, তবে ভাল করে মুখ দেখতে পাই না—তবে মনে হয়েছে যে, তিনি—”

“কে তিনি?”

“তিনি –তিনি তোমার বন্ধু বীরবিক্রম।”

“বীরবিক্রম কেন লুকিয়ে রাত্রে এখানে আসিবেন?“

“আজ তিনি এসেছিলেন কেন? আগেও অনেকবার এসেছেন।”

“রাত্রে যে লোকটা লুকিয়ে আসত, সে আর কেউ হতে পারে।”

“আমি একদিন তার মুখ দেখেছিলাম।”

“তাহার মুখ কি ঠিক বীরবিক্রমের মত?”

“ঠিক বলিতে পারি না, তবে ঐ রকম মনে হয়েছিল। তবে একটা কথা হইতেছে যে, তাহার বয়স ইঁহার অপেক্ষা যেন অনেক বেশী।”

ইন্দ্রানন্দ কি বলিবেন, স্থির করিতে না পারিয়া নীরবে রহিলেন। মীনা তাহার স্বর অতি মৃদু করিয়া কম্পিতকণ্ঠে কহিল, “সে যে-ই হোক, সে-ই তাকে মেরে ফেলেছিল—আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম।”

ইন্দ্ৰানন্দ সোৎসাহে বলিলেন, “সে বীরবিক্রম না হইতেও পারে।”

মীনা কেবল বলিল, “তা হতে পারে।”

আবার উভয়ে বহুক্ষণ নীরবে চলিল। এবার মীনা প্রথমে কথা কহিল। বলিল, “আমি আপনাদের বাড়ীর দরজা পর্য্যন্ত যাইব—বাড়ীর ভিতরে যাইব না।“

ইন্দ্রানন্দ দুঃখিতভাবে বলিলেন, “কেন মীনা?”

মীনা অতি বিষণ্নমুখে বলিল, “আমার বয়স কম বটে, কিন্তু আমি অনেক দেখেছি, অনেক ভুগেছি—আপনার বাড়ীতে আমার থাকা উচিত নয়।”

“কেন মীনা?”

“আপনি কি তা বুঝিতে পারিতেছেন না?”

“কি মীনা, আমি যে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আমি প্রাণ থাকিতে তোমায় কোথায়ও যাইতে দিব না।”

মীনা দাঁড়াইল। বিস্ফারিতনয়নে ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া অতি মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে বলিল, “আমরা দুইজনে একসঙ্গে থাকিলে দুইজনেই চির-জীবনের জন্য দুঃখী হইব। আপনার সঙ্গে আমার বিবাহ হইবার সম্ভাবনা নাই, আপনি বড়লোক—আমি গরীব—আমার মা বাপ কে, তাহাও আমি জানি না।”

ইন্দ্রানন্দ মীনার হাত ধরিলেন। উদ্বিগ্নমুখে বলিলেন, “বল, তুমি আমায় একটু ভালবাস, আমি জগত-সংসার কাহাকেও গ্রাহ্য করিব না, আমি তোমায় বিবাহ করিব। না হয়, তোমায় লইয়া লোকালয় ছাড়িয়া জঙ্গলে থাকিব।”

মীনা ম্লানমধুর হাসি হাসিল। ইন্দ্রানন্দ কি করিবেন, মীনা তা বুঝিতে পারিবার পূর্ব্বেই ইন্দ্রানন্দ তাহার ওষ্ঠে, গণ্ডে, কপালে চিবুকে শত শত চুম্বন করিলেন। মীনার মুখ লাল হইয়া উঠিল তাহার সর্ব্বাঙ্গ বেপমান হইয়া উঠিল; সে নিজেকে সংবরণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

মীনা ক্রুদ্ধ হইয়াছে ভাবিয়া ইন্দ্ৰানন্দ ভীত হইলেন। কিন্তু মীনা কোন কথা কহিল না- লজ্জিতভাবে মুখ ফিরাইয়া লইল। তখন তাহার বড় বড় নয়নপল্লব দুটি অশ্রুপ্লাবিত হইয়া এক অভিনব সৌন্দৰ্য্য সৃষ্টি করিল।

কিয়ৎক্ষণ পরে মীনা অশ্রুস্নাত চোখদুটি মুছিয়া কহিল, “ডাণ্ডি অনেক আগে গিয়াছে। চলুন, এখানে দেরি করিবেন না—অন্ততঃ ইঁহাকে আপনাদের বাড়ী পর্য্যন্ত রেখে আসা আমার কর্ত্তব্য।”

ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বল, তুমি চলিয়া আসিবে না।”

মীনা বলিল, “ও রকম করেন ত আমি আর যাইব না।”

ইন্দ্রানন্দ ভয়ে আর কোন কথা কহিলেন না।

তখন তাঁহারা উভয়ে আবার নীরবে সেই নিৰ্জ্জন পাৰ্ব্বত্যপথ অতিক্রম করিতে লাগিলেন।