দ্বিতীয় খণ্ড – খুনী কে?

দ্বিতীয় খণ্ড – খুনী কে?

প্রথম পরিচ্ছেদ – অপরাধী কে?

পরদিবস দুই প্রহরের সময়ে কৃষ্ণজী বলবন্ত কীর্ত্তিকর নিজ আফিসে আসিয়া দাদাভাস্করকে আহ্বান করিলেন। দাদাভাস্কর তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন; সংবাদ পাইবামাত্র আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “চুরী সম্বন্ধে উপস্থিত আর কোন সংবাদ সংগ্রহ হইল?”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “হাঁ, ফ্রামজী বলিতেছে, কে তাহাকে ডাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাইয়াছে। লিখিয়াছে যে, এই টাকা রস্তমজীকে খালাস করিবার জন্য খরচ করিতে। চিঠীখানা বেনামী।”

কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে পাঠাইয়াছে, মনে কর?”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “কেহই পাঠায় নাই। চুরীর টাকা ত কোন গতিকে খরচ করিতে হইবে—তাই এই কাণ্ড।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “তাহা হইলে দেখিতেছি, তুমি এখন তোমার হরমসজীকে ছাড়িয়া ফ্রামজীকে ধরিয়াছ।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “যদি রস্তমজী ও হরমসজী টাকা না লইয়া থাকেন—তবে নিশ্চয়ই ফ্রামজী লইয়াছে। সে রস্তমজীর বিশেষ বন্ধু, তাহার পক্ষে গুপ্তকথা জানা শক্ত নয়।”

কীৰ্ত্তি। তুমি কি শুনিয়াছ যে, রস্তমজী আবার হাজতে গিয়াছে?

দাদা। (সবিস্ময়ে) কেন?

কীর্ত্তি। এ খবর কিছুই রাখ না—অথচ খুব বুক ফুলাইয়া গোয়েন্দাগিরী করিতেছ। তোমার এই পর্য্যন্ত—আর কিছু হইতেছে না।

দাদা। আমি এই চুরীর ব্যাপার লইয়াই ব্যস্ত, অন্যদিকে তত নজর রাখি নাই। আবার হাজতে কেন?

কীর্ত্তি। খুনের জন্য।

দাদা। (আরও বিস্ময়ে) খুনের জন্য! কোন্ খুন?

কীর্ত্তি। তুমি একেবারে আকাশ হইতে পড়িলে দেখিতেছি। পেস্টনজীর খুন—গাড়ীর ভিতরে খুন।

দাদা। রস্তমজী তার কি জানে? সে খুন ত স্পষ্টই জানা যায়, ফ্রামজী করিয়াছে। ফ্রামজী ক্লোরাফর্ম্ম কিনিয়াছিল; তাহার রুমাল লাসের মুখের উপরে পাওয়া গিয়াছে। সে খুন হইবার একটু পরেই সেই স্থানের নিকটেই গাড়ীতে উঠিয়াছিল। সেই রাত্রে নিজের বাড়ীর নিকটে গাড়ী হইতে নামিয়াছিল। আর প্রমাণ কি চাই?

কীৰ্ত্তি। ফ্রামজী কি জন্য পেষ্টনজীকে খুন করিবে? জানই ত উদ্দেশ্য সপ্রমাণ না করিতে পারিলে আসামীর সাজা হয় না।

দাদা। উদ্দেশ্য! অবশ্য তার নিজের যে কোন আক্রোশ পেষ্টনজীর উপরে ছিল, ইহার প্রমাণ আছে কিনা তা এখন বলিতে পারি না। তবে বন্ধুর জন্য বন্ধু সব করিতে পারে। এ কে তদন্তের ভার লালুভাই এর উপরে আছে; তিনি এ বিষয় নিশ্চয় তদন্ত করিয়াছেন।

কীৰ্ত্তি। তিনিও একজন মহাপণ্ডিত। তোমার ফ্রামজীকে না গ্রেপ্তার করিয়া রস্তমজীকে করিয়াছেন। রিপোর্ট আমাকে না দেখাইয়া তাড়াতাড়ি কমিশনার সাহেবকে বলিয়া ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছেন। পণ্ডিত ভাবিয়াছিলেন, যখন এ লোকটা হাজত হইতে এক মোকদ্দমায় খালাস হইয়াছে, তখন নিশ্চয়ই ফেরারী হইবে।

দাদা। আমার বিশ্বাস, লালুভাই ভায়া একেবারে উল্টা বুঝিয়াছেন। যদি কাহারও বিরুদ্ধে খুনের প্রমাণ থাকে—তবে সে ফ্রামজী।

কীর্ত্তি। রস্তমজীর বিরুদ্ধে লালুভাই কি প্রমাণ পাইয়াছেন, তাহা এখনই জানা যাইবে। আমি তাহাকে রিপোর্ট লইয়া আসিতে বলিয়াছি। সে কথা পরে হইবে—এখন তোমার উপর যে ভার আছে, তাহাতেই তুমি মনোনিবেশ কর। আমি হরমসজীর উপর নজর রাখিয়াছি; সুতরাং হরমসজী বা তাঁহার বাড়ীর কাহারও সম্বন্ধে কোন সন্ধান-সুলভে তোমার আবশ্যকতা নাই।

দাদা। ফ্রামজীর সম্বন্ধে কি করিব?

কীর্ত্তি। ফ্রামজীর সম্বন্ধে কিছু করিতে হইবে না। ফ্রামজী, রস্তমজী ও হরমসজী ব্যতীত যে আর দুইজন লোক আছে, তাহা দেখিতেছি, তুমি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছ।

দাদা। কে?

কীর্ত্তিকরের চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। তিনি রুক্ষস্বরে বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! তুমি এই বুদ্ধি লইয়া ভিটেক্‌টিভগিরী করিতেছ—মাথাটা একেবারে গোময়পূর্ণ। তোমার দ্বারা যে কখনও ডিটেকটিভ লাইনের কোন প্রকার উন্নতি হইবে, সে আশা আমার নাই।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “আপনি গুরুদেব আছেন।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “গুরুদেব গাধা পিটে ঘোড়া করিতে পারে কি?”

দাদাভাস্কর বলিবেন, “হাঁ, মনে পড়েছে—বর্জরজী আর মাঞ্চারজী।”

কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইঁহারা সর্ব্বদাই হরমসজীর বাড়ীতে যাওয়া-আসা করেন। ইঁহাদের বিষয় কি জান?”

“মাঞ্চারজী হরমসজীর শালীর ছেলে—আর বর্জরজী তাঁহার স্ত্রীর আত্মীয়।”

“এ ছাড়া আর কিছু জান না? ইঁহারা বোম্বের লোক নহেন।”

“তা জানি, কয়েক মাস মাত্র এখানে আছেন।”

“ইহারা কে, ইঁহাদের পূর্ব্ব ইতিহাস কি, তাহা কি আমাদের এখন জানা নিতান্ত আবশ্যক নহে?”

“নিশ্চয়ই। ইঁহারা যে পরিচয় দিয়াছেন, মিথ্যা হইতেও পারে।”

“মিথ্যা এবং সত্য, দুইই হইতে পারে, সুতরাং ইঁহাদের সকল কথা আমাদের জানা প্রয়োজন।”

“তবে কি আপনি মনে করেন, ইঁহারাই টাকা চুরী করিয়াছেন?”

“আমি তোমার মত আগে হইতে একটা যাহা কিছু মনে করি না।”

“আমাকে এখন কি করিতে বলেন?”

“বর্জরজীর একজন চাকরের দরকার হইয়াছে, তুমি সেই চাকর হও; বিশেষ নজর রাখ। সেখানে যাহা ঘটিবে, আমায় বলিবে।”

“কালই চাকর হইব।”

এই সময়ে অপর ডিটেটিভ ইনস্পেক্টর বৃদ্ধ লালুভাই উপস্থিত হইয়া কীর্ত্তিকর সাহেবকে অভিবাদন করিলেন। কীর্ত্তিকর বলিলেন, “এই যে লালুভাই সাহেব। এখন খুনের ব্যাপারটা শোনা যাক্।”

দাদাভাস্কর উঠিয়াছিলেন। কীর্ত্তিকর বসিতে ইঙ্গিত করিলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – সন্দেহের কারণ

কীর্ত্তিকর লালুভাইকে বসিতে অনুজ্ঞা করিলেন। লালুভাই বসিয়া সম্মুখস্থ টেবিলের উপর একটা বাণ্ডিল রাখিলেন। তৎপরে অতি সাবধানে ধীরে ধীরে একতাড়া কাগজ বাহির করিয়া কীর্ত্তিকরের সম্মুখে স্থাপন করিলেন।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “লালুভাই সাহেব, আপনার বন্ধু দাদাভাস্কর বলিতেছে যে, আপনি রস্তমজীকে গ্রেপ্তার করিয়া গাধার মত কাজ করিয়াছেন। খুন রস্তমজী করে নাই—ফ্রামজী করিয়াছে।”

লালুভাই চোখ রাঙাইয়া দাদাভাস্করের দিকে চাহিলেন। দাদাভাস্কর অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, “মাষ্টার মহাশয় অন্যায় বলিতেছেন, আমি গাধা বলি নাই।”

লালুভাই মস্তকান্দোলন করিতে করিতে বলিবেন, “কে গাধা, এই চুরীর ব্যাপারেই তাহা জানিতে পারা গিয়াছে। আসামী আবার খালাস হইয়া যাইবে—এমন কাজ আমি করি না। প্রমাণ—অকাট্য প্রমাণ হস্তগত না করে লালুভাই কখনও আসামী প্রেপ্তার করেন না।”

কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “এখন আপনার এই অকাট্য প্রমাণগুলা একে একে শোনা যাক্।”

লালুভাই বলিলেন, “প্রথমতঃ—মাঞ্চারজী সেই রাত্রে রস্তমজীকে পেষ্টনজীর সঙ্গে কথা কহিতে দেখিয়াছিলেন। দ্বিতীয়তঃ—তিনি যেখানে এই দুজনকে দেখেন, সেইখানেই গাড়ী ভাড়া করা হয়। তৃতীয়তঃ—ঐ গাড়ীতে রস্তমজী পেষ্টনজীকে তুলিয়া দেয়। আসামীও এ কথা স্বীকার করিয়াছে। চতুর্থতঃ—গাড়োয়ান শপথ করিয়া বলিতেছে, যে ব্যক্তি অপর মাতাল ব্যক্তিকে গাড়ীতে তুলিয়া দেন, তিনিও গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন। পঞ্চমতঃ—গিরগামের মোড়ে এ ব্যক্তি নামিয়া যান। ষষ্ঠতঃ— আর একজন গাড়োয়ান বলিতেছে, ঠিক ঐ সময়ে এক ব্যক্তি তাহার গাড়ী ভাড়া করিয়া কলবাদেবী রোডে নামিয়া যায়। সে যেরূপ ঐ লোকের বর্ণনা করে, তাহাতে সে রস্তমজী ভিন্ন আর কেহ হইতে পারে না। তাহার পর আরও দেখুন, কলবাদেবী রোডের পাহারাওয়ালা বলিতেছে যে, সে যাহাকে দেখিয়াছিল, তিনি ফ্রামজী নহেন। প্রথমে তাহাই মনে করিয়াছিল বটে, কিন্তু এখন বিশেষ করিয়া ভাবিয়া দেখিয়া বলিতেছে যে, সে যে ব্যক্তিকে দেখিয়াছিল, তিনি ফ্রামজী হইতে লম্বা। আর রস্তমজীকে সেই পোষাকে দেখিয়া বলিতেছে, সম্ভবতঃ ইনি সেই লোক। সপ্তমতঃ-ফ্রামজী যে বাড়ীতে থাকেন, সেই বাড়ীর নীচের একজন দোকানদার বলিতেছে, যেদিন খুন হয়, তাহার পূর্ব্বদিন সন্ধ্যায় সে এক ব্যক্তিকে হাতের উপর একটা কোট ঝুলাইয়া লইয়া যাইতে দেখিয়াছে। তখন অন্ধকার হইয়াছিল, সুতরাং সে লোকটার মুখ ভাল করিয়া দেখিতে পায় নাই। সে রস্তমজীকে খুব ভালরূপ চিনে। তাহার বিশ্বাস, সে লোক রস্তমজী ভিন্ন আর কেহ নহে। অষ্টমতঃ—ফ্রামজীর চাকর তাহার মনিবের সহিত ক্লোরাফর্ম্ম লইয়া কতাবার্তা কহিতে শুনিয়াছে; সুতরাং বোঝা যাইতেছে, রস্তমজীর জন্যই ফ্রামজী ক্লোরাফর্ম্ম কিনিয়াছিল। নবমতঃ—রস্তমজী ও পেষ্টনজী উভয়েই কমলাবাঈকে ভালাবাসিত, উভয়েই তাহাকে বিবাহ করিবার জন্য পাগল, সুতরাং উভয়ের প্রতি উভয়েরই দারুণ ঈর্ষা ছিল। তাহার পর আরও দেখুন, রস্তমজীর চাকর বলিয়াছে যে, একদিন পেষ্টনজী ও রস্তমজীতে খেলা লইয়া ঝগড়া হয়, উভয়ে মারামারি হইয়াছিল। পেষ্টনজী বাহির হইয়া গেলে রস্তমজী বলিয়াছিল, ‘তোমার রক্ত না দেখি ত আমি রস্তমজী নই।’ আর কি প্রমাণ চাই! এর যদি ফাঁসী না হয়, তবে এতদিন ডিটেক্‌টিভ লাইনে কাজ করিলাম বৃথা!”

এই বলিয়া বৃদ্ধ লালুভাই সগৰ্ব্বে মাথা তুলিয়া সম্মুখে টেবিলের উপরে সজোরে এক চপেটাঘাত করিলেন।

কীর্ত্তিকর মৃদুহাস্যে বলিলেন, “তাহা ত নিশ্চয়। কিন্তু লালুভাই সাহেব, লাসের যে কোটটা পরা ছিল, তাহা কি আপনি ভাল করিয়া দেখিয়াছেন?”

লালু। না। প্রয়োজন কি?

কীৰ্ত্তি। দেখুন দেখি, এই কোটটা। এই কোটই পেষ্টনজীর পরা ছিল। ইহার ভিতরটা দেখুন। দেখিতেছেন, এইখানে কোটের অস্তরের কাপড়ের নীচে কিছু সেলাই করা ছিল।

লালুভাই। তাহা ত দেখিতেছি।

কীৰ্ত্তি। এই কোটের নীচে দুইখানা কাগজ সেলাই করা ছিল। সেই দুইখানা কাগজ কেহ কাপড় ছিঁড়িয়া তাড়াতাড়ি বাহির করিয়া লইয়াছিল। ছেঁড়াটা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা যায়, যখন পেষ্টনজী গাড়ীর ভিতরে খুন হয়, তখনই কেহ এই কাগজ লইয়াছিল।

দাদা। ছেঁড়াটা নূতন সন্দেহ নাই।

কীর্ত্তি। হাঁ, তাহার পর কাগজ কাপড়ের নীচে সেলাই করা হইয়াছিল; কাজেই কাগজের খানিকটা শুদ্ধ সেলাই হইয়া গিয়াছিল। যে এই কাগজ লইয়াছিল, সে তাড়াতাড়ি কাগজ টানিয়া লয়, কাজেই কাগজের খানিকটা কোণ কোটের কাপড়ের নীচেই থাকিয়া যায়। এই দুই টুক্রা কাগজ থাকিয়া গিয়াছিল। আমি কাপড় কাটিয়া ইহা পাইয়াছি। দেখুন দেখি, এ কোন্ কাগজের কোণ?

লালুভাই ও দাদাভাস্কর উভয়েই বিশেষ করিয়া সেই কাগজ দুই টুকরা, দেখিলেন। অবশেষে লালুভাই বলিলেন, “এর একখানা বিবাহের সার্টিফিকেট, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।”

দাদা। অন্যখানা বোধ হইতেছে, জন্ম সার্টিফিকেট।

কীৰ্ত্তি। হাঁ, তাই। সরকারী ভিন্ন ভিন্ন ফরমে ভিন্ন ভিন্ন মার্কা থাকে। এই দুই টুক্রায় যে মার্কার কতকাংশ আছে তাহাতে স্পষ্টই জানা যাইতেছে, একখানা বিবাহের, অপরখানা জন্মের সার্টিফিকেট। এখন কথা হইতেছে, পেষ্টনজী এ দুইখানা কাগজ এত গোপনে, এত যত্নে নিজের কোটের ভিতরকার কাপড়ের নীচে রাখিয়াছিল কেন?

লালু। নিশ্চয়ই তাঁহার এই দুইখানি ভারি দরকারী কাগজ ছিল।

কীৰ্ত্তি। তা হইলে বুঝিতে পারা যাইতেছে, যে লোক তাঁহার নিকট হইতে এই দুইখানি কাগজ ছিনাইয়া লইয়াছিল, তাহারও এ দুইখানি কাগজ ভারি দরকারী। আরও দেখুন, লোকটা এই দুইখানা কাগজ লইবার জন্যই পেষ্টনজীকে ক্লোরাফর্ম্ম দিয়া অজ্ঞান করিয়াছিল। সম্ভবতঃ ইহাকে তাহার খুন করিবার ইচ্ছা ছিল না। পেষ্টনজী ভয়ানক মাতাল হইয়াছিল, তাহাই সে ক্লোরাফর্ম্ম সহ্য করিতে পারে নাই, মরিয়া গিয়াছে। ডাক্তারও পোষ্টমর্টেম পরীক্ষায় এই কথাই বলিয়াছেন।

লালু। হাঁ।

কীৰ্ত্তি। তাহা হইলে, এ খুন কোন স্ত্রীলোকের ভালবাসার ঈর্ষায় হয় নাই। এই দুইখানা সার্টিফিকেটের জন্যই হইয়াছে।

লালু। তাহা ত এখন দেখিতেছি।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ছিন্নপত্র

লালুভাই ও দাদাভাস্কর বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। অবশেষে দাদাভাস্কর বলিলেন, “তবে আপনি কি মনে করেন যে, রস্তমজী ও ফ্রামজী এ দুজনের কেহই খুন করে নাই?”

কীর্ত্তিকর বিরক্তভাবে বলিলেন, “তুমি গাধার মত পুনঃপুনঃ জিজ্ঞাসা করিয়ো না, ‘আপনি কি মনে করেন?’ তোমাকে উত্তর দিতে দিতে আমি নাস্তানাবুদ। আমি কিছুই মনে করি না। আমি বলিতেছি যে, এই খুন এই দুইখানা সার্টিফিকেটের জন্য হইয়াছে।”

দাদা। এখন তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি। তবে লালুভাই সাহেব কি বলিতে চাহেন, তাহাই শুনিতে ইচ্ছা করিতেছি।

লালুভাই। হাঁ, আমি যে রকমে কেস্ প্রস্তুত করিয়াছিলাম, এখন তাহার একটু গোলযোগ ঘটিল বটে। এখন স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, এই দুইখানা সার্টিফিকেট লইবার জন্যই লোকটাকে ক্লোরাফর্ম্ম করিয়াছিল।

দাদা। নিশ্চয়ই।

কীর্ত্তি। আঃ! বোকার মত কেবল নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই করিয়ো না।

দাদা। না, মাষ্টার, না।

কীর্ত্তিকর। এখন অনুসন্ধান করিতে হইবে, এই দুইখানা সার্টিফিকেট কাহার বিবাহের ও কাহার জন্মের?

লালুভাই। তাহা হইলেই জানা যাইবে, ইহার সঙ্গে রস্তমজীর কোন সম্বন্ধ আছে কি না। কীর্ত্তিকর। আরও একটা বিষয় সন্ধানের ভার আপনাকে দিব। রস্তমজী স্বীকার করিয়াছে যে, সেই রাত্রে পেষ্টনজীর সহিত গিরগামের নিকট তাহার দেখা হইয়াছিল।

লালুভাই। হাঁ, আরও বলিয়াছে যে, সে গাড়ী ডাকিয়া মাতাল পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়াছিল। অথচ সে যে তাহার সঙ্গে গাড়ীতে গিয়াছিল, তাহা স্বীকার করে না। বলে যে তাহাকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া তখনই সে চলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু কোথায় গিয়াছিল, তা কিছুতেই প্রকাশ করে না।

কীর্ত্তিকর। আচ্ছা, আমি তাহার সহিত জেলে দেখা করিব। আমি জানিয়াছি, সেইদিন রাত্রে কমলাবাঈএর সহিত তাহার এলফিষ্টোন সার্কেলের মধ্যে দেখা হয়। কমলাবাঈ বলে, রস্তমজী তাহার নিকট হইতে বাহিরে গেলে একটি বালক তাহার হাতে একখানা পত্র দেয়, তাহার পর সেইখানেই তাঁহার সঙ্গে বর্জরজীর দেখা হয়। দুইজন দুইদিকে চলিয়া যায়। পরে কমলাবাঈ দেখিতে পায় যে, মাঞ্চারজী গোপনে তাঁহার অনুসরণ করেন।

দাদা। আপনি কি মনে

কীর্ত্তি। (বাধা দিয়া) আবার ঐ মনে করেন! তুমি আমাকে অস্থির করিয়া তুলিলে! একটু চুপ করিয়া থাকিতে পার না?

দাদা। না মাষ্টার; তা হলে এর ভিতরেও অনেক গোলমাল আছে।

কীৰ্ত্তি। তোমার বিশ্বাস, তুমি যে কেসে থাক, সেইটাতেই বড় গোলমাল। লালুভাই। কিন্তু সহজগুলাই ভায়ার হাতে পড়ে।

দাদা। বদলে নিন্ না কেন? আপনি চুরীর কেস নিন্—আমাকে এই খুনের কেসটা দিন। তাহা হইলে বুঝিতে পারিবেন, কত ধানে কত চাল।

কীর্ত্তি। তাহার পর যাহা বলিতেছিলাম—আমি যেরূপে হউক, কমলাবাঈএর নিকট এ সকল সংবাদ পাইয়াছি। তোমরা যেন কোন রূপে কমলাবাঈকে বিরক্ত করিয়ো না।

দাদা। কবে আপনার কথা অমান্য করিয়াছি?

কীৰ্ত্তি। বেশ—আগেই বলিলাম, সেই রাত্রে রস্তমজীকে একটি বালক একখানা চিঠী দেয়। আমি সেই চিঠীর তল্লাসে তাঁহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম। তাঁহার ছেঁড়া বাতীল কাগজ-পত্ৰ যে ঝুড়িতে ছিল, তাহার মধ্যে এইটুকু পাইয়াছি।

কীর্ত্তিকর একখানা পত্রের অর্দ্ধাংশ লালুভাই এর সম্মুখে রাখিলেন।

পত্রাংশ এইরূপ;

“রস্তমজী সাহেব মহাশয়,
নিতান্ত প্রয়োজনে লিখিলাম, স্ত্রী
মৃত্যু শয্যায়। বিশেষ কথা আ
আপনার উপকার হইবার বিশেষ স
আমাকে অতি অভাগিনী জানিবেন, আপ
অদ্য বুধবার নিশ্চয় লোকের সহিত
সে আপনাকে সঙ্গে করিয়া
না হইলে সকল কথা”

লালুভাই পত্রাংশ বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। দাদাভাস্করও দেখিলেন।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “কি বুঝিলেন?”

লালুভাই। ভাল কিছুই বুঝিতেছি না।

কীর্ত্তিকর। কেন? স্পষ্টই জানা যাইতেছে যে, কোন স্ত্রীলোক মৃত্যুশয্যা হইতে রস্তমজীকে সে রাত্রে এই পত্র লিখিয়াছিল। পত্র স্ত্রীলোকের হাতের লেখা।

দাদা। তাহাও দেখিতেছি।

কীর্ত্তিকর। নিশ্চয়ই রস্তমজী সেই স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন, সুতরাং তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহাই সম্ভব। তিনি পেষ্টনজীর সঙ্গে গাড়ীতে যান নাই। তাঁহারই মত পোষাক- পরা আর একজন গাড়ীতে গিয়াছিল।

দাদা। ফ্রামজী।

কীর্ত্তিকর। ব্যস্ত হইয়ো না। আগে হইতে হঠাৎ কোন একটা অনুমান করে ধারণাটা খারাপ করিয়ো না, তাহা হইলেই গোলমাল। দোষীকে ধরিয়া তাহার উপযুক্ত দণ্ড দেওয়া যেমন আমাদের একটা কর্ত্তব্য, তেমনই নির্দোষী যাহাতে দণ্ডিত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখা তদপেক্ষা এক মহান্ কৰ্ত্তব্য। লালুভাই সাহেব, এই পত্র কে লিখিয়াছে, এখন তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা আপনার কাজ। এ বিষয়ে মনোনিবেশ করুন।

লালুভাই। বিশেষ চেষ্টা করিব।

কীৰ্ত্তিকর। এখন এই পর্য্যন্ত। দুই দিন পরে কতদূর কি করেন, আমাকে সংবাদ দিবেন। লালুভাই। অবশ্যই দিব।

কীর্ত্তিকর। ব্যস্ত হইয়া হঠাৎ কোন কাজ করিবেন না।

উভয় পুলিস কর্ম্মচারী স্বকার্য্যোদ্ধারে প্রস্থান করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কীর্ত্তিকরও একটা ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ইনি কে?

বারংবার বিপদে পড়িয়া রস্তমজী একেবারে মর্মাহত হইয়া পড়িয়া ছিলেন। নানা চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। কি করিবেন—এ বিপদে তাঁহাকে কে রক্ষা করিবে? শেষে কি বিনাপরাধে ফাঁসী কাঠে ঝুলিবেন, এইরূপ নানা চিন্তায় তিনি উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাঁহার আহার নিদ্রা ছিল না।

সহসা দ্বার উদ্ঘাটনের শব্দ পাইয়া তিনি চমকিত হইয়া সেই দিকে ফিরিলেন। দেখিলেন, একটি বৃদ্ধ মারাঠী ভদ্রলোক। দেখিবা মাত্রেই তিনি তাঁহাকে চিনিলেন। যেদিন রস্তমজী দ্বিতীয়বার পুলিস কর্তৃিক ধৃত হন, সেইদিন ইনিই তাঁহার প্রতি সেই অভয়বাণী প্রয়োগ করিয়াছিলেন।

বৃদ্ধ তাঁহার নিকটস্থ হইয়া বলিলেন, “বোধ হয়, তুমি আমাকে চিনিতে পার নাই—না পারিবারই কথা। বহুকাল দেখা-সাক্ষাৎ নাই। তোমার পিতার সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তোমার বিপদের কথা শুনিয়া আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। ভয় নাই, তুমি নিৰ্দ্দোষ — তোমার ভয় কি বাপু?”

বিপদে বন্ধুলাভ করিলে কাহার না হৃদয়ে আনন্দ জন্মে? রস্তমজীর হৃদয়ে প্রথমে একটু সন্দেহের উদ্রেক হইয়াছিল, কিন্তু এক্ষণে বৃদ্ধের মিষ্ট কথায় সে সন্দেহ মুহূৰ্ত্ত মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

বৃদ্ধ বলিলেন, “আমার নাম কাশীনাথ নায়েক। বোধ হয়, তোমার একটু একটু আমাকে মনে পড়িতে পারে। তোমাকে আমি ছেলে মানুষ দেখিয়াছিলাম।”

রস্তমজী ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন, “ঠিক মনে পড়ে না। আপনি যে এ বিপদে আমাকে সাহায্য করিতে আসিয়াছেন, ইহাতে আমি যে কি আনন্দিত হইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না।”

বৃদ্ধ কাশীনাথ নায়েক বলিলেন, “এখন যদি এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার হইতে চাও, তবে আমাকে সব কথা খুলিয়া বল।”

রস্তমজী। কি বলিব—আমি ইহার কিছুই জানি না।

কাশীনাথ বলিলেন, “পুলিস তোমার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছে।”

রস্তমজী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “তা আমি জানি। আমার আর রক্ষা পাইবার উপায় নাই।”

কাশীনাথ বলিলেন, “হতাশ হইয়ো না। চুরী সম্বন্ধেও তোমার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ সংগ্রহ হইয়াছিল, কিন্তু পুলিস পরে বুঝিয়াছিল যে, তুমি চুরী কর নাই।”

“খুন সম্বন্ধে আমার আর আশা নাই।”

“কেন? আমাকে সব খুলিয়া বল, নিশ্চয়ই তুমি মুক্তি পাইবে।”

“কি বলিব, আমার কিছুই বলিবার নাই।”

“তোমার সঙ্গে সে রাত্রে পেষ্টনজীর দেখা হইয়াছিল?”

“হাঁ”

“তুমি তাহাকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়াছিলে?”

“হাঁ, দিয়াছিলাম।”

“তাহার পর তুমি সেই গাড়ীতে উঠিয়াছিলে?”

“না।”

“তবে কে উঠিয়াছিল?”

“কি রূপে বলিব? অগ্নিদেব জানেন।”

“তুমি যদি না উঠিয়া থাক, তবে ত ভাল কথা। তুমি কোথায় গিয়াছিলে, এইটা প্রমাণ হইলেই তুমি মুক্তি পাইবে।”

“কিন্তু আমি কোথায় গিয়াছিলাম, তাহা বলিব না। আপনি শত্রুই হউন, আর মিত্রই হউন, প্রাণ থাকিতে বলিব না, কাহাকেও বলিব না।”

“ইচ্ছা করিয়া ফাঁসীকাঠে ঝুলিবে? এ উন্মত্ততা ব্যতীত আর কিছুই নহে। দেখ, আমি তোমার পিতৃবন্ধু, তোমার সাহায্যের জন্য আসিয়াছি; আমাকে কিছু গোপন করিয়ো না— কোথায় গিয়াছিলে বল।”

“ক্ষমা করুন—”

“না, জীবন নিয়ে টানাটানি ব্যাপারে ক্ষমার কথা বলিয়ো না। সে কথা আমি শুনিব না, কোথায় গিয়াছিলে বল।”

“বলিব না—কিছুতেই না।”

“তুমি কি পাগল হইয়াছ? তোমার কি বুদ্ধি একেবারে লোপ পাইয়াছে? তোমার মাথার উপরে ভয়ানক বিপদের খাঁড়া উদ্যত রহিয়াছে—তাহা কি তুমি বুঝিতেছ না। তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ নও।”

“আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তাহা বলিবার উপায় নাই।”

“আচ্ছা, আম নিজেই সন্ধান করিয়া বাহির করিব।”

“সে স্ত্রীলোক আর নাই।”

“বটে স্ত্রীলোক,—তার নাম কি?”

রস্তমজী সহসা স্ত্রীলোকের কথা বলিয়া ফেলিয়াছিলেন। এক্ষণে বলিলেন, “মহাশয়, আমাকে ক্ষমা করুন, এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন না। তাহা হইলে আমি আর কোন কথা কহিব না।”

কাশীনাথ যেন একটু হতাশ হইয়া গেলেন। বলিলেন, “না বল, কি করিব! আমাকে নিজেই সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। এখন আমি আর একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করিব, বলিবে কি?”

রস্তম। বলুন।

কাশী। তোমার এই খুনের জন্য কাহারও উপর সন্দেহ হয় কি না?

রস্তম। হয়, কিন্তু বলিব না।

কাশী। তুমি যদি না বল, আমি তোমার হইয়া বলিতেছি।

রস্তম। বলিতে পারেন।

কাশী। তোমার ভূতপূর্ব্ব মনিব হরমসজী এই হতভাগ্য পেষ্টনজীকে খুন করিয়াছে।

রস্তমজী লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আপনাকে কে ইহা বলিল?”

কাশী। ওঃ! এই ব্যাপার; তোমারও বিশ্বাস, তাহা হইলে দেখিতেছি হরমসজীই খুনী। কেন তিনি খুন করিয়াছেন, তাহাও তুমি জান; কেবল কমলার জন্য বলিতেছ না। ভালবাসা খুব ভাল জিনিস, সন্দেহ নাই, তবে ভালবাসার জন্য নিজের-প্রাণ অনর্থক দেওয়া উন্মত্ততা ব্যতীত আর কিছুই নহে। আর সে সকল উপন্যাসে বেশ শোভন হয়।”

রস্তম। হরমসজীর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই।

কাশী। যথেষ্ট আছে।

রস্তম। তিনি কেন খুন করিতে যাইবেন?

কাশানাথ রস্তমজীর কানের নিকটে মুখ লইয়া চুপি চুপি কি বলিলেন।

রস্তমজী আবার লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আপনাকে কে বলিল?”

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – বিভ্রাটে রস্তম

কাশীনাথ সস্নেহে রস্তমজীর হাত ধরিয়া বসাইলেন, এবং তাঁহার মাথায় ধীরে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “স্থির হইয়া বস—চঞ্চল হইয়ো না। তুমি নিৰ্দ্দোষ, আমি তোমাকে “রক্ষা করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, সুতরাং তুমি বল না বল, আমি সকল কথাই জানিতে পারিব। সে ক্ষমতা আমি রাখি।”

রস্তমজী কোন কথা কহিলেন না; নীরবে বসিয়া রহিলেন।

কাশীনাথ বলিলেন, “দেখ, আমি অনেক কথাই জানি। যদি আমি তোমায় বলি যে, হরমসঙ্গী এ খুনের কিছুই জানেন না, তাহা হইলে কি তুমি আমাকে বলিবে, তুমি সে রাত্রে কোথায় গিয়াছিলে?”

রস্তমজী কোন উত্তর দিলেন না। অবনতমস্তকে ভূমি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

কাশীনাথ বলিলেন, “সেই রাত্রে এলফিষ্টোন সার্কেলের বাগানে কমলাবাঈ-এর সঙ্গে তোমার দেখা হইয়াছিল?”

“আপনাকে কে বলিল?”

“সে নিজেই বলিয়াছে।”

“আপনি কি তবে তাহার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেন?

“হাঁ, তার পর তাহার নিকট হইতে বাহিরে আসিলে একটি বালক তোমার হাতে একখানা পত্র দিয়াছিল। কোন স্ত্রীলোক মৃত্যুশয্যা হইতে তোমাকে সেই পত্র লিখিয়াছিল।”

“আপনাকে এ সকল কথা কে বলিল?”

“তোমার বাসাতেই বিছানার উপরে সেই পত্রের কতকাংশ আমি পাইয়াছিলাম।”

“আমি সে পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি।”

“হাঁ, আমি তাহার কতকাংশ পাইয়াছি; বাকী আধখানা পাই নাই। তুমি সেই স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা করিয়াছিলে?”

রস্তমজী নিরুত্তর।

কাশীনাথ বলিলেন, “দেখিতেছ, আমি অনেক কথাই জানি, সুতরাং আমাকে গোপন করা বৃথা।”

“হাঁ, আমি সেই রাত্রে পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম।”

“তাহার নাম কি?”

“তাহা আমি বলিব না।”

“সে বাঁচিয়া আছে, কি মরিয়াছে?”

“না—সে বাঁচিয়া নাই।”

“সে তোমাকে কেন ডাকিয়াছিল?”

“তাহা আমি বলিব না।”

“তাহা হইলে তোমার হইয়াঁ আমিই বলি,” বলিয়া কাশীনাথ, রস্তমজীর কানের নিকটে মুখ লইয়া কি বলিলেন।

রস্তমজী বলিলেন, “আপনি যাহা অনুমান করুন না কেন, সে যাহা বলিয়াছিল, তাহা আমি কিছুতেই বলিব না।”

“ফাঁসীতে ঝুলিবে, তবুও বলিবে না?”

“না।”

“কমলাবাঈ অনুরোধ করিলেও বলিবে না?” রস্তমজী কথা কহিলেন না।

বৃদ্ধ বলিলেন, “তোমার সহিত হরমসজীর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, সুতরাং এই স্ত্রীলোক হরমসজী সম্বন্ধে কোন কথা বলিবার জন্য তোমাকে ডাকিয়াছিল, ইহাই নয় কি?”

“ক্ষমা করুন, আমি কোন কথা বলিব না।”

বৃদ্ধ কাশীনাথ বুঝাইয়া বলিলেন, “দেখ রস্তমজী, অন্য লোক হইলে তোমার উপর রাগ করিত, কিন্তু আমি তোমার পিতার বাল্য-বন্ধু, সুতরাং তোমার উপর রাগ করিব না। তুমি কি উন্মত্ততা প্রকাশ করিতেছ, তাহা কি বুঝিতেছ না?এ উন্মত্ততার পরিণাম যে কি ভয়ানক হইবে, তাহা যে তুমি না বুঝিতে পার, এমন নহে।”

রস্তমজীর দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল। তিনি বলিলেন, “মহাশয়, রাগ করিবেন না। আমার সব কথা খুলিয়া বলিবার উপায় থাকিলে নিশ্চয়ই আপনাকে বলিতাম।”

কাশীনাথ কহিলেন, “তবে এই স্ত্রীলোক কোথায় ছিল, তাহা তুমি আমাকে কিছুতেই বলিবে না। আচ্ছা আমিই খুঁজিয়া লইব,” বলিয়া বৃদ্ধ উঠিলেন। উঠিয়া রস্তমজীকে বলিলেন, “এখনও সময় আছে, ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখ। কেন পাগলামী করিয়া নিজের মৃত্যু নিজে ডাকিয়া আনিবে। ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়া কেন বংশে কালী দিবে? একে চোর অপবাদ হইয়াছে, তাহার উপর আবার খুনী অপবাদ আনিয়া বাপ-পিতামহের মুখে কালী দাও কেন? ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখ, সকল কথা খুলিয়া বলিলে তোমার কোনই ভয় নাই। আমি আবার দুই তিন দিন পরে তোমার সহিত দেখা করিব।”

রস্তমজী কোন কথা কহিলেন না। বৃদ্ধ কাশীনাথ নায়েক ধীরে ধীরে কারাগার হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – অবগুণ্ঠিতা

রাত্রি প্রায় আটটার সময় বৃদ্ধ কাশীনাথ নায়েক এলফিষ্টোন সার্কেলের মধ্যে একখানি বেঞ্চের উপরে বসিয়া কাহার অপেক্ষা করিতেছিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে একটি অবগুণ্ঠিতা মারাঠী রমণী তথায় উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিলে সে যে কোন বাড়ীর দাসী, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়।

সে নিকটে আসিলে নায়েক মহাশয় তাহাকে সেই বেঞ্চে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। সে তথায় বসিল; সেই স্থানে গাছের ছায়ার জন্য গ্যাসের আলো পড়িতে পায় নাই—সুতরাং নিতান্ত নিকটে না গেলে তাঁহাদের উভয়কে সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না।

কাশীনাথ বলিলেন, “নূতন কিছু খবর আছে?”

রমণী বলিল, “নূতন কিছুই নাই। তবে এইটুকু জানিয়াছি যে, রাজাবাঈ ও কমলাবাঈ উভয়েই বর্জরজীকে বড় ভয় করে—কেন তা এখনও ঠিক জানিতে পারি নাই।”

কাশী। বর্জরজী এখনও সেইরূপ যাওয়া আসা করে?

রমণী। কাল হরমসজী কি কাজে বেন্দোরা গিয়াছিলেন—বর্জরজী রাজাবাঈ এর নিকটে প্রায় রাত্রি একটা পৰ্য্যন্ত ছিল।

কাশী। কি কথা হইল, কিছু শুনিতে পাইলে?

রমণী। না।

কাশী। মাঞ্চারজী কোথায় ছিল?

রমণী। সে-ও ছিল, কমলাবাঈ-এর সঙ্গে কথা কহিতেছিল।

কাশী। কমলাবাঈ কোন কথা বলে?

রমণী। না, সে একাকী হইলেই গোপনে কাঁদে। তাহার প্রাণে কোন কারণে একটা যে দারুণ আঘাত লাগিয়াছে—তাহা তাহাকে দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়। মনে হয়, সে যেন কি একটা দুঃসহ যন্ত্রণা বুকের মধ্যে পোষণ করিতেছে। আর তাহার উপর আমার রাগ নাই—আমি বড় কষ্ট পাইতেছি বটে, কিন্তু সে হয় ত আমার চেয়েও কষ্ট পাইতেছে। আমি ছেলেবেলা থেকে অনেক কষ্ট পাইয়াছি, অনেক সহ্য করিতেও পারি; আহা, সে যে কখনও কোন কষ্ট পায় নাই!

কাশী। রস্তমজীর সংবাদ পাইয়াছ?

রমণী। পাইয়াছি—সকলেই পাইয়াছে। কাশী। এ বিষয়ে তুমি কি মনে কর?

রমণী। তিনি যে নির্দোষ, তাঁহাকে কি আপনি জানেন না? তিনি কি চুরী করিতে পারেন? তিনি কি খুন করিতে পারেন?

কাশী। তাহা আমি জানি—কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে অনেক প্ৰমাণ

রমণী। সব মিথ্যা। প্রমাণসত্ত্বেও তাঁহাকে নিৰ্দ্দোষ সপ্রমাণ করিব। তাঁহাকে একবার দেখিতে বড় ইচ্ছা হয়, অনেক দিন দেখি নাই। একবার দেখা করিতে পারি না কি? আপনি কি ইহার একটা কোন উপায় করিতে পারেন না?

কাশী। সেই কথা বলিবার জন্য আসিয়াছি।

রমণী। আপনি যাহা বলিবে, তাহাই করিব।

কাশী। পেষ্টনজীর সঙ্গে তাঁহার খুনের রাত্রে দেখা হইয়াছিল, রস্তমজীই তাঁহাকে গাড়ীতে তুলিয়া দেন। কিন্তু তিনি সে গাড়ীতে চড়েন নাই, আর একজন চড়িয়াছিল।

রমণী। সে কে?

কাশী। তাহাকেই ত খুঁজিতেছি। তাহাকে পাইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যায়।

রমণী। রস্তমজী কি বলেন?

কাশী। তিনি কমলাবাঈ-এর সঙ্গে দেখা হইবার পরে একখানি পত্র পাইয়াছিলেন। কোন স্ত্রীলোক মৃত্যুশয্যায় তাঁহাকে তাহার সহিত দেখা করিতে অনুরোধ করে। পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া তিনি তাহার সহিত দেখা করিতে যান, কিন্তু তিনি কোথায় গিয়াছিলেন এবং সে স্ত্রীলোকের নামই বা কি—তাহা কিছুতেই তিনি বলিতে চাহেন না।

রমণী। কি বলিলেন—একজন স্ত্রীলোক মৃত্যুশয্যায় তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিল। আমাকেও যেন কে এই রকম দেখা করিতে ডাকিয়াছিল, আমি যাই নাই। আমার ঠিক মনে পড়িতেছে না।

কাশী। কি রকম? তোমাকেও খবর দিয়াছিল? চিঠী লিখেছিল কি?

রমণী। না—আমার মনে পড়িয়াছে—হাঁ ঠিক হইয়াছে।

যেদিন রাত্রে পেষ্টনজী খুন হন, সেইদিন বৈকালে তিনি আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন। তিনিই আমাকে বলিয়াছিলেন, একজন স্ত্রীলোকের মৃত্যু আসন্ন—সে একবার তাঁহাকে দেখিতে চাহিয়াছে।

কাশী। কে সে স্ত্রীলোক, তাহা কিছু বলিয়াছিল?

রমণী। না, আমি উপহাস মনে করিয়া সে কথায় তখন কান দিই নাই; হাঁ—তিনি যাইবার সময় হাসিতে হাসিতে বলিয়াছিলেন, — দেখা করিলে লাভ আছে, যেয়ো।

কাশী। কোথায় যেতে হবে, তা কিছু বলিয়াছিলেন?

রমণী। হাঁ, বোধ হইতেছে যেন বলিয়াছিলেন; কিন্তু আমার এখন কিছুতেই মনে পড়িতেছে না। তখন তাঁহার কথায় আমি তেমন কান দিতে পারি নাই; মন বড় অস্থির ছিল। তাহার পর এই সব বিপদ আপদে আমার অনেক কথাই মনে নাই।

কাশী। রস্তমজী ফাঁসী যাইবেন তাহাও স্বীকার, তবুও তিনি সে স্ত্রীলোকের কোন কথা কিছুতেই বলিবেন না। কাজেই এখন আমাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। খুব ভাল করে মনে করিয়া দেখ।

রমণী। এখন কিছুই মনে হইতেছে না—পরে মনে হইতে পারে।

কাশী। খুব চেষ্টা কর। সেই স্ত্রীলোককে আমাদের বাহির করিতেই হইবে। তার পর যাহা বলিতে আসিয়াছিলাম, আমার ইচ্ছা, তোমাদের দুজনকে আমি একবার রস্তমজীর কাছে লইয়া যাই। তোমাকে এ অবস্থায় দেখিলে, আর কমলাবাঈ অনুরোধ করিলে তিনি নিশ্চয়ই সব কথা বলিতে পারেন। পারিবে কি?

রমণী। তাঁহার জন্য যখন এত পারিতেছি, তখন ইহাও পারিব।

কাশী। সকল কথা বলিয়া কমলাবাঈকে সম্মত করিবে।

রমণী। আপনি যাহা বলিবেন, তাহার করিব।

কাশী। যথার্থ তোমার ভালবাসাই ভালবাসা—তুমি দেবী। –

রমণী। আমি মহা পাপিয়সী! তাঁহার পায়ের ধূলার যোগ্যও নহি

তখনই রমণী বস্ত্রাঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া সত্বর সেখান হইতে উঠিয়া প্রস্থান করিল।

বৃদ্ধ কাশীনাথ নায়েকও চিন্তিত মনে ধীরে ধীরে অন্যত্রে প্রস্থান করিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – কাজের কথা

পরদিবস অতি প্রত্যূষে দাদাভাস্কর কীর্ত্তিকরের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। এখন দেখিলে দাদাভাস্করকে দাদাভাস্কর বলিয়া চেনা যায় না। সাধারণতঃ পার্শী ভৃত্যগণ যে বেশ ব্যবহার করিয়া থাকে, এক্ষণে তিনি সেই বেশে সজ্জিত।

তাঁহাকে দখিয়া কীর্ত্তিকর মৃদুহাস্য করিলেন। দেখিয়া দাদাভাস্কর বলিলেন, “এখন কে আমাকে পুলিস-ইনস্পেক্টর দাদাভাস্কর বলিয়া চিনুক দেখি।”

কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “দাদাভাস্কর, তুমি এক সময়ে উন্নতি করিতে পারিবে। এ ছদ্মবেশে তোমার বড় বাহাদুরী প্রকাশ পাইতেছে।”

“তবুও ত গুরুদেব আমাকে গাধা বলেন।”

“সে আদর করিয়া বলি। নতুবা তোমার কার্য্যকুশলতার উপর আমার প্রগাঢ় বিশ্বাস আছে।”

“আদর করিয়া গাধা বলা, আপনারই সাজে।”

“থাক্, এখন খবর কি বল।”

“হাঁ, বেশীক্ষণ দেরী করিতে পারিব না। এখনি বেটা আমাকে খুঁজিবে।”

“তোমাকে সন্দেহ করিতে পারে নাই ত?”

“তাহার অনেক দেরী আছে।”

“কি জানতে পারিলে বল।”

“আপনি যাহা মনে করিয়াছিলেন, তাহাই।”

“কি?”

“বর্জরজী আর মাঞ্চারজী রাজাবাঈ-এর আত্মীয় বা কুটুম্ব নয়।”

“কি করিয়া জানিলে?”

“সব বলিতেছি। কাল রাত্রে এ দুজনের ভারি ঝগড়া হইয়াছে; আমি দরজার পাশে লুকাইয়া থাকিয়া সব শুনিয়াছি।”

“কিসের জন্য ঝগড়া?”

“টাকা-কড়ির বখরা লইয়া।”

“তার পর?”

“তাদের দুজনের ঝগড়াতে বুঝিলাম যে, মাঞ্চারজী বর্জরজীর চেলা। তাহাকে বর্জরজীই খেলাইতেছে। ভাবে বোধ হয়, দুজনের কিছু সম্বন্ধও আছে।”

কীর্ত্তিকর একবার কি ভাবিলেন। ক্ষণের নীরবে থাকিয়া বলিলেন, “বর্জরজী, মাঞ্চারজীকে কি বলিল, তাহাই শুনিতে চাই।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “বর্জরজী ক্রোধে মাঞ্চারজীকে বলিল, “তোকে এতদিন খাইয়ে মানুষ করলেম। রাজাবাঈকে জোগাড় করে দিলাম, এখন তুই টাকার ভাগ চাস? এত বড় আস্পদ্ধা! আচ্ছা, তোমায় আমি ঠিক করে দিচ্ছি।”

কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহাতে মাঞ্চারজী কি উত্তর দিল?”

দাদা। সে বলিল, “তার সমস্ত গহনা আমায় দিয়েছে, ভয়ে হরমসজীর কাছে এখন টাকা চাহিতে পারিতেছে না—তা হলে আমার চলে কিসে?’ তখন বর্জরজী বলিল, ‘এত বাবুগিরী কর কেন?”

সে উত্তর করিল, ‘কেন করব না, টাকা ত আমিই সব জোগাড় করেছি। তুমি আর কি করছো? অমন কর যদি, আমি সমস্তই গোল করে দেব।’ এই কথা শুনিয়া বর্জরজী একটু নরম হইল। বলিল, ‘দেখ মাঞ্চারজী, যদি আমাদের দুজনে এখন ঝগড়া হয় তবে সব কাজই পণ্ড হবে। তোমার যে অবস্থা ছিল, তাই আবার দাঁড়াবে। দিন কতক চুপ চাপ করে থাক। হরমসজী বেটার মৃত্যু-শর আমার হাতে আছে। যত টাকা ইচ্ছা, তার কাছে আদায় হবে।”

কীর্ত্তি। মাঞ্চারজী কি বলিল?

দাদা। সে বলিল, ‘এখন আমার চলে কিসে?’ তাহাতে বর্জরজী উত্তর করিল, “তার উপায় করে দিচ্ছি। গণেশমলের কাছে গহনাগুলো বাঁধা আছে। আর বাঁধা রেখে কাজ কি? তার কাছে বেচে ফেলে এখন অনেক নগদ টাকা পাওয়া যায়।”

কীৰ্ত্তি। গণেশ মল?

দাদা। হাঁ, গণেশ মল। সে নাম কি আমি ভুলি?

কীৰ্ত্তি। তা জানি।

দাদা। মাঞ্চারজী তাতে খুব সন্তুষ্ট হইল; বলিল, ‘তবে আজই বিক্রী করে দাও। আমার হাতে এক পয়সাও নাই।’ বরজী বলিল, ‘আচ্ছা, তাই হবে।’ তাহার পর কিছু পরেই দুজন বাহির হইয়া গেল।

কীৰ্ত্তি। তাহা হইলে কি বুঝিলে?

দাদা। বুঝিলাম, বর্জরজী বেটা মহা পাজী। এই ছোঁড়াটাকে দিয়ে হরমসজীর সর্ব্বনাশ করিতেছে।

কীৰ্ত্তি। তবে রাজাবাঈ নিজের গহণাগুলি পর্য্যন্ত মাঞ্চারজীকে দিয়াছে! ওঃ। ইহার ভিতর একটা মহা জটিল রহস্য নিহিত আছে।

দাদা। প্রেমের জন্য স্ত্রীলোকেরা সব পারে।

কীর্ত্তি। মাঞ্চারজী রাজাবাঈ-এর ছেলের বয়সী।

দাদা। স্ত্রীলোকের পক্ষে সব সম্ভব।

কীৰ্ত্তি। আমি জানিয়াছি, রাজাবাঈ আর কমলা বাঈ উভয়েই বর্জরজীকে ভয় করে, কেন?

দাদা। পাছে বর্জরজী গুপ্ত-রহস্য হসমসজীকে বলিয়া দেয়।

কীৰ্ত্তি। সম্ভব, কিন্তু কমলাবাঈ ভয় করিবে কেন?

দাদা। একই কারণে।

কীর্ত্তি। এখন চুরি যে হরমসঙ্গীর বাড়ীর লোক দিয়া হইয়াছে, তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছ?

দাদা। বেশ বুঝিয়াছি। মাঞ্চারজীর রোজ টাকার দরকার। আর গহনা নাই যে দিবে; তাহাই রাজাবাঈ গোপনে সিন্দুক হইতে টাকা বাহির করিয়া লইয়াছিল। কমলাবাঈ জানিতে পারিয়া প্রতি বন্ধক দিতে যায়। তাহার পর যাহা হইয়াছে, আমরা জানি

কীৰ্ত্তি। ঠিক তাহা নহে। তবে ইহাও সম্ভব বটে। যাহাই হউক, শীঘ্রই চোর ধরা পড়িবে। বর্জরজী ও মাঞ্চারজীর উপর বিশেষ নজর রাখিয়ো।

দাদা। এটি করিতেছি না।

কীৰ্ত্তি। কাল কোন গতিকে ছুটি লইয়া আমার সহিত একবার আফিসে দেখা করিয়ো।

দাদা। করিব।

দাদাভাস্কর প্রস্থান করিলে কীর্ত্তিকর বহুক্ষণ চিন্তিতমনে গৃহমধ্যে পদচারণা করিতে লাগিলেন। তৎপরে লালুভাইকে ডাকিয়া আনিতে আজ্ঞা দিয়া একজন ভৃত্যকে প্রেরণ করিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – খুন সম্বন্ধে

যতক্ষণ লালুভাই না আসিলেন, ততক্ষণ কীর্ত্তিকর কক্ষমধ্যে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। তিনি যে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন, তাহা তাঁহাকে দেখিলেই সহজে বুঝিতে পারা যায়। পরে তিনি সহসা টেবিলের সম্মুখে যাইয়া বসিলেন—একখানা ‘কাগজ টানিয়া লইলেন। আবার বহুক্ষণ কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি একখানি পত্র লিখিয়া ভৃত্যের হাতে দিলেন; বলিলেন, হরমসজীর বাড়ীর পিছনে যে গলি আছে, সেই গলিতে শিশ দিলে একটি স্ত্রীলোক বাহির হইয়া আসিবে, তাহাকে এই পত্র দিবে। খুব সাবধানে আর গোপনে দিবে, যেন কেহ দেখিতে না পায়।

ভৃত্য সেলাম দিয়া চলিয়া গেল। ক্ষণপরে লালুভাইও তথায় উপস্থিত হইলেন।

কীর্ত্তিকর তাঁহাকে বলিলেন, “কতদুর কি করিলেন? সাহেব আমাকে বলিতেছিলেন যে, খুনের মোকদ্দমা আর ফেলিয়া রাখা যায় না। এ অবস্থায় মোকদ্দমা হইলে আসামী খালাস হইয়া যাইবে।”

বৃদ্ধ লালুভাই বলিলেন, “তা ত দেখিতেছি।”

“রস্তমজী খুন করে নাই, সুতরাং তাহাকে হাজতে রাখা অন্যায়।”

“সেই ছোকরাকে পাইয়াছি।”

“কোন্ ছোকরা?”

“যে ছোকরা সেদিন রাত্রে রস্তমজীকে পত্র দেয়।”

“সে কি বলে?”

“তাহাকে সঙ্গে আনিয়াছি।”

“এইখানে ডাকুন।”

লালুভাই উঠিয়া গিয়া ছিন্নবস্ত্র পরিহিত, ধূলি-ধূসরিত এই বালককে সেখানে উপস্থিত করিলেন।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনি ইহাকে কিরূপে পাইলেন?”

“এলফিষ্টোমন সার্কেলের নিকটে অনেক ছেলে খেলা করে, তাহাদের মধ্যে সন্ধান করিয়া ইহাকে পাইয়াছি।”

“ও কি বলে?”

“আপনিই শুনুন।”

কীর্ত্তিকর সেই বালকের দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই একদিন রাত্রে একজন পার্শী ভদ্রলোককে একখানা চিঠী দিয়াছিলি?”

বালক। হাঁ।

কীৰ্ত্তি। কে তোকে চিঠী দিয়াছিল?

বালক। একজন মেয়েমানুষ।

কীৰ্ত্তি। সে কে?

বালক। জানি না।

কীৰ্ত্তি। পার্শী, ভাটিয়া না মারাঠী?

বালক। মারাঠী।

কীৰ্ত্তি। কোথায় তোকে চিঠী দিয়াছিল?

বালক। বাগানের দরজায়।

কীৰ্ত্তি। কি বলিল?

বালক। ‘ঐ পার্শী বেরিয়ে এলে এই চিঠী ওকে দিস্। এই নে তোকে একটা টাকা দিলেম।’

কীর্ত্তি। তার পর সে কোথায় গেল?

বালক। তা জানি না।

কীর্ত্তি। দূর হ, এখান থেকে

বালক নিমেষ মধ্যে অন্তর্হিত হইল।

কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “লালুভাই সাহেব, এই বালকের তল্লাসে না থাকিয়া যদি মড়া পোড়াইবার ঘাটে সন্ধান লইতেন, তাহা হইলে কাজ হইত।”

লালুভাই বলিলেন, “কি হইত?”

“এই দেখুন,” এই বলিয়া কীর্ত্তিকর টেবিলস্থ কাগজ-পত্রের ভিতর হইতে একখানা কাগজ টানিয়া বাহির করিলেন। বলিলেন, “আমি ঘাট হইতে যে দিন খুন হয়, তাহার পর দিনের মৃত্যু রেজেষ্টারীর কাপি আনিয়াছি।”

“সে স্ত্রীলোক কি মরিয়াছে?”

“সেইদিন রাত্রেই সে মারা যায়।”

“আপনি কেমন করিয়া জানিলেন। সে মরিয়াছে জানিলে আমি নিশ্চয়ই ঘাটে সন্ধান লইতাম।”

‘যাহাই হউক, এই দেখুন; সেদিন সাতটি মারাঠীর মৃত্যু হইয়াছে। ইহার মধ্যে তিনটি -পুরুষ আর চারিটি স্ত্রীলোক।”

“তাহা হইলে এই চারিজন স্ত্রীলোকের মধ্যে সে নিশ্চয়ই একজন।”

“নিশ্চয়ই। দেখুন, ইহার মধ্যে দুটি বড়লোকের বাড়ীর—জাদা বনিয়াদী ঘর। এ দুটি নয়।”

“কেন?”

“রস্তমজী যে চিঠী পাইয়াছিলেন, তাহা ত দেখিয়াছেন।”

“আপনার কাছেই ত দেখিলাম।”

“ভাল—সেই চিঠী অতি জঘন্য কাগজে লেখা। বড়লোকের ঘরে সেরূপ কাগজ থাকা সম্ভব নয়।”

“হাঁ, ঠিক বলিয়াছেন বটে।”

“তাহা হইলে সে স্ত্রীলোক এই দুইটির মধ্যে একটিও নহে।”

“সম্ভব।”

“সম্ভব নয়—নিশ্চয়ই। তাহা হইলে থাকিল আর দুইটি। ইহার মধ্যে দেখিতেছি, একটি সধবা—সুতরাং সেটিও হইতে পারে না।”

“কেন?”

কীৰ্ত্তিকর ভ্রুকুটি-কুটিল মুখে বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আপনি ডিটেক্‌টিভগিরী করিয়া চুল পাকাইয়া ফেলিলেন; ইহাও আবার আপনাকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে? স্বামী থাকিতে কোন্ স্ত্রীলোক মৃত্যুশয্যা হইতে নিজে অপরিচিত ভদ্রলোককে পত্র লিখিবে? লিখিতে হইল তাহার স্বামী বা আত্মীয় কেহ লিখিত।”

“হাঁ বুঝিয়াছি।”

“তা হইলে থাকিতেছে একটি, সেইটিই এ স্ত্রীলোক।”

“এ ত দেখিতেছি, লিখিয়াছে বারবণিতা।”

“তাহাই হওয়া বিশেষ সম্ভব, পরে সকলই জানিবেন। ইহার ঠিকানাটি লিখিয়া লউন। এ কে, ইহার বৃত্তান্ত বা কি সমস্তই অনুসন্ধান করিবার ভার আপনার উপর থাকিল।”

“আমি এখনই রওনা হইলাম।”

“কতদূর কি হয়, আমাকে আফিসে সংবাদ দিবেন।”

লালুভাই প্রস্থান করিলে কীর্ত্তিকর স্নান আহারাদি করিতে গেলেন।

নবম পরিচ্ছেদ – উদ্যানে

ঠিক দুই প্রহরের সময় কমলাবাঈ তাহার দাসী সমভিব্যাহারে ভিক্টোরিয়া গার্ডেনে কাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। বাগানের একপার্শ্বে একখানি বেঞ্চে তাহারা দুইজনে বসিয়াছিল। কেহ কাহারও সহিত কথা কহিতেছিল না।

কিয়ৎক্ষণ পরে কমলাবাঈ বলিল, “কই তিনি ত এখনও আসিলেন না।”

দাসী কহিল, “তিনি একটার সময় আসিবেন, আমাকে লিখিয়া ছিলেন। এখনও একটা বাজে নাই।”

আবার উভয়ে বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল। সহসা দাসী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “এই যে তিনি আসিতেছেন।”

কমলাবাঈ সেই দিকে চাহিয়া দেখিল, একটি বৃদ্ধ মারাঠী ভদ্রলোক তাহাদের দিকে আসিতেছেন। বৃদ্ধ মারাঠী নিকটে আসিয়া কমলাবাঈকে বলিল, “আপনার নাম কমলাবাঈ? ধনাঢ্য পার্শী ব্যাঙ্কার হরমসজীর কন্যা?”

কমলাবাঈ সলজ্জভাবে ঘাড় নাড়িল। বৃদ্ধ বলিলেন, “আমি রস্তমজীর পিতার বাল্য-বন্ধু- আমার নাম কাশীনাথ নায়েক। তাঁহার বিপদ্ শুনিয়া তাঁহাকে বিপদ্ হইতে রক্ষা করিতে আসিয়াছি। লোক পরম্পরায় শুনিলাম, আপনি তাঁহাকে বড়—

সহসা কমলার কমনীয় কপোলযুগ আরক্ত হইয়া উঠিল। দেখিয়া বৃদ্ধ কাশীনাথ কথা ফিরাইয়া লইয়া বলিলেন, “যেদিন পেষ্টনজী খুন হয়, সেদিন রাত্রে তাঁহার সহিত পেষ্টনজীর সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তিনিই তাঁহাকে গাড়ীতে তুলিয়া দেন—কিন্তু তিনি আর সে গাড়ীতে তাঁহার সঙ্গে যান নাই। অপর কেহ গিয়াছিল।”

“তবে তিনি খুন করিলেন কিরূপে?”

“সেই কথাই হইতেছে। তিনি সে রাত্রে পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া, কাহার সঙ্গে যে দেখা করিয়াছিলেন, ইহা কিছুতেই বলিতেছেন না। আমি অনেক বুঝাইয়াছি।”

“কেন?”

“তাহাও তিনি বলেন নাই। তিনি পেষ্টজনীর সঙ্গে গাড়ীতে না গিয়া অন্যত্রে গিয়াছিলেন; ইহা প্রমাণ করিতে পারিলেই তিনি মুক্তি পাইতে পারেন, অথচ তিনি এমন নির্ব্বোধ—ইহা কিছুতেই বলিবেন না। এমন অবুঝ লোক কি করিয়া যে আপনার পিতার এত বড় কারবার চালাইতেন, আমি ত কিছুই ভাবিয়া পাই না। তিনি কিছুতেই প্রকৃত ব্যাপার প্রকাশ করিবেন না।”

“কেন?”

“সেইজন্য, অনেক চেষ্টা করিয়া আপনার দাসীর সহিত পরিচিত হইয়াছি। আমার কথা তিনি ত কিছুতেই শুনিতেছেন না। সম্ভবতঃ আপনার অনুরোধ তিনি রক্ষা করিতে পারেন।”

“তা কি করিবেন?”

“তিনি যদি পাগল হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাদের কি তাঁহাকে বুঝাইবার চেষ্টা করা কর্ত্তব্য নহে? তাঁহার কি বিপদ, তাহা তিনি বুঝিতেছেন না। ফাঁসী—”

শুনিয়া উভয় বমণীই একটি অস্পষ্ট কাতরোক্তি করিয়া উঠিল।

কাশীনাথ বলিলেন, “নিদোষী কখনও সাজা পায় না। তিনি নির্দোষ, তাঁহার ভয় কি?”

“তিনি কি মুক্তি পাইবেন?”

“নিশ্চয়ই—সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”

“আমাকে কি করিতে বলেন?”

“আপনাকে একবার তাঁহার সহিত দেখা করিতে বলি।”

“কিরূপে দেখা করিব?”

জেলের সাহেবের সহিত আমার আলাপ-পরিচয় আছে। আমার সঙ্গে গেলে তিনি আপনাকে রস্তমজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে দিবেন।”

“বাবা জানিতে পারিলে আমাকে কি বলিবেন? আপনার সহিত এরূপে দেখা করিয়াই হয় ত আমি ভাল করি নাই।”

“একজন লোক বিনা দোষে ফাঁসী যায়, আর আপনি একটা কাজ করিলে যদি সে বাঁচে, তাহা কি আপনার করা কর্ত্তব্য নহে?”

“আমি জেলে তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছি, এ কথা প্রকাশ হইলে আমাকে বড়ই লজ্জা পাইতে হইবে। বাবা শুনিলেও আমাকে তিরস্কার করিবেন। তাঁহাকে না বলিয়া আমার কি কোন কাজ করা কর্ত্তব্য?”

“ঘটনা বিশেষে কৰ্ত্তব্য। একজনের জীবন-মরণ লইয়া কথা—বিবেচনা করিয়া দেখুন।”

এই সময়ে দাসী কমলার দুইটি হাত ধরিয়া করুণকণ্ঠে বলিল, “চলুন।”

কাশীনাথ বলিলেন, “হাঁ, চলুন। আপনি অনুরোধ করিলে তিনি নিশ্চয়ই বলিবেন যে, তিনি সে রাত্রি কাহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন। ইহা জানিতে পারিলে তিনি নিশ্চয়ই মুক্ত হইবেন। আমার বিশ্বাস, আপনার কথা তিনি ঠেলিতে পারিবেন না।”

কমলা। তিনি কি আমার অনুরোধ রাখিবেন?

কাশী। তিনি আপনাকে প্রাণের সহিত ভালবাসেন। যদি কাহারও অনুরোধ তিনি রক্ষা করেন, তবে আপনারই অনুরোধ রক্ষা করিবেন।

কমলার কপোল রক্তাভ হইয়া উঠিল। সে সলজ্জভাবে মস্তক অবনত করিয়া বলিল, “তবে চলুন।”

কাশীনাথ অগ্রে অগ্রে চলিলেন। কমলা ও দাসী তাঁহার অনুসরণ করিল।

বৃদ্ধ কাশীনাথ নায়েক উদ্যানের বাহিরে একখানি গাড়ী ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। গাড়ীর নিকটে আসিয়া তিনি কমলা ও তাহার দাসীকে গাড়ীতে উঠিতে বলিলেন। তাহারা গাড়ীতে উঠিয়া দেখিল, গাড়ীর ভিতর দুইখানি গাত্রবস্ত্র রহিয়াছে।

বৃদ্ধ গাড়ীতে উঠিয়া বলিলেন, “আপনাদের জন্য এই দুইখানা গাত্র বস্ত্র আনিয়াছি। বেশ ভাল করিয়া গায়ে দিন। অবগুন্ঠন ভাল করিয়া দিন, তাহা হইলে আপনাদের কেহই চিনিতে পারিবে না। আপনারা যে জেলে রস্তমজীর সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলেন, তাহাও কেহ জানিবে না।”

বৃদ্ধের কথামত উভয়ে গাত্রবস্ত্র দ্বারা অবগুণ্ঠন করিয়া লইল। গাড়ীও সবেগে জেলের দিকে ছুটিল।

দশম পরিচ্ছেদ – কারাগৃহে

গাড়ী আসিয়া জেলখানার দ্বারে দাঁড়াইল। বৃদ্ধ গাড়ী হইতে নামিয়া গেলেন।

এখানে আসিয়া কমলাবাঈ-এর হৃদয়ের অন্তস্তত প্রদেশ একেবারে বসিয়া গেল। তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। কিরূপে জেলের ভিতরে প্রবেশ করিবে, তাহাই ভাবিয়া মনে মনে অত্যন্ত ব্যাকুল হইতে লাগিল।

তাহার অবস্থা দেখিয়া দাসী বলিল, “স্থির হউন, এমন ভাঙিয়া পড়িবেন না। আপনি অধীরা হইলে রস্তমজী সাহেবকে রক্ষা করিতে পারা যাইবে না।”

কমলা। আমি ত স্থির আছি।

দাসী। হাঁ—না হইলে লোকে আমাদের দেখিবে।

কমলা। তুমি যদি কাহাকেও কখনও ভালবাসিতে, তাহা হইলে আমার মনের অবস্থা বুঝিতে পারিতে।

দাসী কোন উত্তর না দিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। তাহার হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে একটি দীর্ঘনিশ্বাস বহির্গত হইল। কমলা চমকিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল।

এই সময়ে কাশীনাথ গাড়ীর নিকটে আসিয়া বলিলেন, “আসুন।”

উভয়ে গাড়ী হইতে নামিল। কমলা বড় উদ্বেগে বড় কাঁপিতেছিল; দাসী তাহাকে ধরিয়া লইয়া চলিল। সকলে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে জেলখানার মধ্যে প্রবেশ করিল।

একজন প্রহরী তাহাদিগকে পথ দেখাইয়া চলিল। এক স্থানে আসিয়া সে দাঁড়াইল; এবং ঘোর রোলে লৌহদ্বার খুলিল। কমলা ও দাসীকে সেখানে রাখিয়া কাশীনাথ গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তাহারা উভয়ে অবগুণ্ঠনাবৃত হইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিল।

কাশীনাথকে আসিতে দেখিয়া রস্তমজী মাথা তুলিয়া তাঁহার দিকে চাহিলেন। কাশীনাথ বলিলেন, “কমলাবাঈ তোমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে?”

রস্তমজী চমকিত হইয়া বলিলেন, “কে?”

কাশীনাথ কোন উত্তর না দিয়া বাহিরে গিয়া উভয়কে ভিতরে আসিতে ইঙ্গিত করিলেন। কম্পিতপদে, স্পন্দিতহৃদয়ে কমলাবাঈ ধীরে ধীরে নতমুখে কারাগৃহে প্রবেশ করিল।

অতীব বিস্ময়ে রস্তমজী লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। তাঁহার মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির হইল না এবং তাঁহার চোখ দুটি জলে ভরিয়া গেল।

কমলাবাঈ আত্মসংযম করিতে পারিল না। সে-ও কাঁদিয়া ফেলিল। বস্ত্রাঞ্চলে মুখ ঢাকিল। আর দাসী—সে অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া প্রাচীর অবলম্বনে নিস্পন্দভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।

কাশীনাথ বলিলেন, “আমার কথায় তুমি সব কথা প্রকাশ কর নাই। তাহাই অনেক চেষ্টায় কমলা বাঈকে আনিয়াছি। তুমি ইচ্ছা করিয়া এরূপ ঘোরতর উন্মত্ততা প্রকাশ করিলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকি কিরূপে?”

রস্তমজী কাতরভাবে বলিলেন, “আপনাকে কি বলিব? আমাকে কষ্ট দিতেছেন কেন?” কাশীনাথ বলিলেন, “আমি তোমার পিতার বাল্য-বন্ধু, আমি তোমাকে বিনা কারণে কিরূপে ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে দেখিব?”

রস্তমজী কোন কথা কহিলেন না। তখন কাশীনাথ কমলার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি অনুরোধ করুন। ইনি আমার কোন কথাই শুনিতেছেন না।”

কমলা কথা কহিবার চেষ্টা করিয়াও পারিল না; তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। তখন কাশীনাথ দাসীকে বলিলেন, “তুমি তোমার কর্ত্রী ঠাকুরাণীকে বল। আমি ত বাবু আর পারি না।”

অতি কষ্টে দাসী আসিয়া কমলার হাত ধরিল। কিন্তু আত্মসংযমে সক্ষম হইল না। তাহার কণ্ঠ হইতে অস্পষ্ট ক্রন্দনধ্বনি শ্রুত হইল। সেই সময়ে তাহার অবগুণ্ঠন একটু অপসারিত হইল।

রস্তমজী বিস্ময় ও আবেগপূর্ণকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “তুমি!”

দাসী নিজের অসাবধানতা বুঝিতে পারিল; চকিতে অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল। কমলা চমকিত হইয়া রস্তমজীর দিকে চাহিল, তৎপরে দাসীর দিকে চাহিল। তাহার সমস্তই যেন একটা মস্ত প্রহেলিকা বোধ হইতে লাগিল।

রস্তমজী লজ্জিত হইলেন। মনে মনে বলিলেন, “আমি কি পাগল হইয়াছি। সে কিরূপে কমলার দাসী হইবে। কিন্তু যেন ঠিক সেই মুখ।”

কাশীনাথ রস্তমজীকে বলিলেন, “দেখ, দাসী কমলাবাঈকে এত ভালবাসে যে, সে-ও তোমার জন্য কাঁদিতেছে। একটা কথা বলিলে যদি সকল গোল মিটিয়া যায়, তবে কেন তুমি সে কথা বলিতেছ না? আমরা যে তোমার জন্য এত করিতেছি, ইহা দেখিয়া একান্ত অকৃতজ্ঞ না হইলে এরূপ ব্যবহার কেহ করে না।”

রস্তমজী বিনীতভাবে বলিলেন, “ক্ষমা করুন, আমার বলিবার উপার নাই, নতুবা বলিতাম।”

এবার কমলা কথা কহিল। বলিল, “বলুন না।”

রস্তমজী আবেগের সহিত বলিলেন, “কমলা, তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না। কেমন করিয়া তোমার কথা ঠেলিতে হয় তাহা আমি এখনও শিখি নাই—আমাকে কৰ্ত্তব্যভ্রষ্ট করিয়ো না।”

কমলা বলিল, “আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”

রস্তমজী। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না।

কমলা সহসা রস্তমজীর পদতলে বসিয়া পড়িল। বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “যদি কখনও আমাকে বিন্দুমাত্র ভালবাসিয়া থাক, তবে বল, সে রাত্রে তুমি কাহার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলে। পরের জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করা কি উচিত?”

রস্তমজী কমলাকে হাত ধরিয়া উঠাইলেন। বলিলেন, “কমলা, তুমি কি জিজ্ঞাসা করিতেছ, তাহা তুমি জান না।”

কমলা ব্যাকুলভাবে বলিল, “জানি-না-জানি বুঝি না। আমি সামান্য স্ত্রীলোক বই ত নই। তুমি পরের জন্য কেন—”

কাশীনাথ মধ্যপথে বাধা দিয়া বলিলেন, “সামান্য একটা স্ত্রীলোকের জন্য— রস্তমজী সবেগে বলিলেন, “হাঁ, স্ত্রীলোকের জন্য সত্য।”

কমলা অশ্রুপূর্ণনেত্রে রস্তমজীর মুখের দিকে চাহিল। তৎপরে কাঁদিয়া উঠিল।

অভাগিনী দাসীও অবগুন্ঠন মধ্য হইতে অশ্রুপূর্ণনেত্রে চাহিল, তাহারও বুক চোখের জলে ভিজিতেছিল।

একাদশ পরিচ্ছেদ – সেইভাব

বহুক্ষণ সকলেই নীরব। অবশেষে বৃদ্ধ বলিলেন, “দেখ রস্তমজী, তোমাকে স্পষ্ট কথা বলি, তুমি একটি ভয়ানক বদলোক। এই বালিকা তোমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, তোমার পায়ে পৰ্য্যন্ত পড়িল, আর তুমি এমনই পাষণ্ড যে, একবার ইহার মুখের দিকে চাহিলে না!”

রস্তমজী নিতান্ত দুঃখের সহিত বলিলেন, “মহাশয়, আপনি জানেন না, কমলাও জানে না। কমলার জন্যই আমার কোন কথা বলিবার উপায় নাই।”

কমলা মাথা তুলিয়া চমকিত ভাবে বলিল, “আমার জন্য!”

কাশীনাথ বলিলেন, “ইহার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে, ইহার কথায় কান দিবেন না। আমি দেখিতেছি, ইহাকে পাগল বলিয়াই বিচারকালে সপ্রমাণ করতে হইবে; আর কোন উপায় নাই।”

রস্তমজী বলিলেন, “আমি পাগল নই। কমলা, আমি সত্যই বলিতেছি, তোমার জন্যই আমার কিছুই বলিবার যো নাই। ইহাতে আমায় যদি ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে হয়, তাহাও শ্রেয়ঃ- কিছুতেই আমি কোন কথা প্রকাশ করিব না—করিতে পারিব না।”

কমলা ধীরে ধীরে আসিয়া রস্তমজীর হাত ধরিল। বলিল, “আমার বিষয় ভাবিয়ো না। বরং আজীবন আমি চিরদুঃখ ভোগ করিব; তুমি এ বিপদ্ হইতে রক্ষা পাও। তোমার কিছু হইলে আমি কি বাঁচিব? তবে তুমি কেন আমার বিষয় ভাবিতেছ? আমার যাহাই হউক না কেন, তুমি সব কথা খুলিয়া ইহাকে বল। আমার সম্মুখে বলিতে না চাও, আমি এখনই চলিয়া যাইতেছি।” রস্তমজী করুণকণ্ঠে বলিলেন, “কমলা, হয় ত এক সময়ে আমি বলিলেও বলিতে পারিতাম, কিন্তু এখন আর উপায় নাই। আমি জানি যে, এ খুনের দায় হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় আছে; আমি সে রাত্রে কার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলাম বলিলেই মুক্তি পাই; কিন্তু আমার বলিবার উপায় নাই। আমি কিছুতেই বলিতে পারিব না।”

কমলা ব্যাকুলভাবে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। দাসীও এতক্ষণ কাঁদিতেছিল। সহসা সে রস্তমজীর নিকটবর্ত্তী হইল; বোধ হইল, যেন সে রস্তমজীর হাত ধরিতে যাইতেছিল, কিন্তু আত্মসংযম করিল। রস্তমজী স্তম্ভিত হইয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন। বিস্মিতভাবে তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।

কমলা একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া আবার আসিয়া রস্তমজীর হাত ধরিল। অতি ব্যাকুল ও কাতরভাবে বলিল, “যে কারণই থাক্, তাহাতে আমার যাহাই হউক, তুমি বল।”

রস্তমজীও অতি ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “কমলা, তুমি জান না—তুমি আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতেছ।”

কমলা বলিল, “এমন কি ঘটনা হইতে পারে যে, তুমি তাহা বলিতে পার না।”

রস্তমজী বলিলেন, “আর আমাকে কষ্ট দিয়ো না। আমি বলিতে পারিব না।”

কমলা বলিল, “তবে তুমি ইচ্ছা করিয়া আত্মহত্যা করিতেছ। আমি তোমার কাছে কি এমন অপরাধ করিয়াছি?’

কমলা আর সহ্য করিতে পারিল না। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। বৃদ্ধ কাশীনাথ নায়েক না ধরিলে সে ভূপতিতা হইত।

নায়েক রস্তমজীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বুঝিয়াছি, তুমি নিজে পেষ্টনজীকে খুন কর নাই বটে, কিন্তু কে খুন করিয়াছে, তুমি তাহা জান।”

এই বলিয়া তিনি ধীরে ধীরে কমলাকে লইয়া গৃহের বাহির হইয়া গেলেন।

অমনই দাসী অবগুণ্ঠন দূর করিয়া নিমেষমধ্যে আসিয়া রস্তমজীর হাত ধরিল। বলিল, “কথা শোন—কেন কষ্ট দাও।”

সহসা কিছু ভয়াবহ ব্যাপার দেখিলে লোকের যাহা হয়, রস্তমজীরও তাহাই হইল। তিনি বিস্ময়বিহ্বল হইয়া বলিলেন, “তুমি! তবে আমার ভ্রম হয় নাই!”

দাসী বলিল, “হাঁ, আমি। তোমারই জন্য আজ আমি কমলার দাসী। ওঃ! এত নিষ্ঠুর তুমি—এতেও কি তোমার দয়া হয় না? তোমাকে নিষ্ঠুরই বলি কি করিয়া, আমি ত জানি, দয়া-মায়া-স্নেহে তোমার হৃদয় পরিপূর্ণ।”

মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সে গৃহ হইতে অন্তর্হিত হইল। রস্তমজী ভূমে বসিয়া পড়িয়া বালকের ন্যায় কাঁদিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “হা ভগবান্! আমার এ কি করিলে!”

বৃদ্ধ কাশীনাথ, কমলা ও দাসীকে লইয়া গাড়ীতে উঠিলেন। তিনি তাহাদিগকে আবার সেই বাগানে নামাইয়া দিয়া বলিলেন, “আপনারা অস্থির হইবেন না। রস্তমজী না বলুক, কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে সে রাত্রে দেখা করিয়াছিল, তাহা আমি নিজেই সন্ধান করিয়া বাহির করিব।”

উভয়ের কেহই কোন কথা কহিল না। তাহাদের উভয়কে তথায় রাখিয়া বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বাগান হইতে বাহির হইলেন। দূরে একটু অন্তরালে দাঁড়াইয়া দেখিলেন যে, তাহারা বাড়ীর দিকে চলিয়া গেল। তখন তিনিও নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে চলিলেন।

তিনি ভাবিতেছিলেন, “বিশেষ কারণে রস্তমজীর মুখ বন্ধ হইয়াছে। নতুবা কে ইচ্ছা করিয়া ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে চায়? একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল। সে স্ত্রীলোক কে? যে মরিয়াছে, সে পতিতা। সে মৃত্যুকালে রস্তমজীকে ডাকিবে কেন? বিশেষতঃ রস্তমজীর হরমসঙ্গী ব্যতীত আর কোন লোকের সহিত বিশেষ সম্বন্ধ বোম্বাই সহরে নাই। একজন মেয়ে মানুষ, একজন পুরুষকে যখনই ডাকিবে, তখনই জানিতে হইবে যে, তাহার ভিতর আর একজন স্ত্রীলোক আছেই আছে। সে স্ত্রীলোক নিশ্চয়ই কমলা বাঈ। এমন কি কথা সে স্ত্রীলোক বলিতে পারে, যাহা রস্তমজী কমলার জন্য প্রকাশ করিতে পারিতেছে না। সম্ভবতঃ সে বলিয়াছিল যে, সে হরমসজীর বিবাহিতা স্ত্রী। তারপর কোন কারণে হয় ত তাহার অধঃপতন হইয়াছিল। সম্ভব, এ বিবাহ হরমসজী গোপনে করিয়াছিলেন। এই স্ত্রীলোক ঘটনাচক্রে পড়িয়া পেষ্টনজীর হাতে পড়ে। তাহার পর যাহা কিছু ঘটিয়াছে, এ সকল অনুমান হইলেও ইহার ভিতর অনেকাংশ সত্য নিহিত আছে নিশ্চয়। দিবালোকের ন্যায় সমুদয় পরিস্কার বোধ হইতেছে। রস্তমজী সকলই জানেন। এরূপ অবস্থায় রস্তমজী যে এ কথা প্রকাশ করিতে পারিতেছে না, ইহাতে আমার সহানুভূতি আছে। তাহার কর্তব্য জ্ঞানকে আমার ধন্যবাদ।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সন্ধান হইল

লালুভাই মৃত স্ত্রীলোকের ঠিকানা কীর্ত্তিকরের নিকট পাইয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি সেই ঠিকানানুযায়ী পাইদুনির এক ‘চলে’ উপস্থিত হইলেন। বোম্বাই সহরে যে ছয়-সাততলা বাড়ীতে এক একটি ঘর ভাড়া লইয়া পাঁচ-ছয় শত অতি দরিদ্র পরিবার বাস করে, তাহাকেই ‘চল’ বলে।” এই সকল ‘চলে’ নানা জাতীয় নানা প্রকৃতির লোক বাস করে।

লালুভাই যে ‘চলে’ প্রবেশ করিলেন, তাহা নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তিতে পূর্ণ, সুতরাং তদনুরূপ কদর্য্য ও আবর্জ্জনাময়। দুর্গন্ধও এমনই ভয়ানক যে, সহজে ইহাতে প্রবেশ করা দুরূহ। এই সকল ‘চলে’ কাহারও সন্ধান করাও বড় সহজ নহে। লালুভাই প্রথমে নিম্নতল হইতেই আরম্ভ করিলেন। নিম্নতলে অধিকাংশই দোকান। তিনি ইহাকে উহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে, একটি লোক দশ-বার দিন হইল, এই ‘চলে’ মরিয়াছে, কিন্তু সে কোন্ ঘরের লোক এবং স্ত্রীলোক কি পুরুষ, তাহা তাহারা নিশ্চিত বলিতে পারিল না। এই সকল ‘চল’ বাসিগণ প্রায়ই কেহ কাহারও কোন সন্ধান রাখে না, কাজেই কাহারও সন্ধান পাওয়া সহজ নহে। লালুভাই দ্বিতলে উঠিলেন; সেখানেও তিনি বড় বেগতিক দেখিলেন। পুলিসের ভয়ে সেখানকার কেহ কোন সন্ধান দিতে অসম্মত। বিশেষতঃ কাহারও মৃত্যু সন্ধান দিলে পাছে কোন পুলিস-হাঙ্গামা হয় বলিয়া ইহারা কোন কথা বলে না।

দ্বিতলে বিফলমনোরথ হইয়া লালুভাই ত্রিতলে উঠিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন। সকলেই বলে জানি না। অন্য কথা জিজ্ঞাসা করিলে সরিয়া যায়। এখানেও লালুভাইকে হতাশ হইতে হইল।

লালুভাই চতুর্থ তলে উঠিলেন; তথায় একটি ঘরে একটি অতি দরিদ্র রমণী একটি শিশুকে স্তন্যপান করাইতেছিল। লালুভাই তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি বলিতে পার বাছা, কোন্ ঘরে একটি স্ত্রীলোক দশ-বার দিন হইল, মারা গিয়াছে।”

সে কিয়ৎক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ঔষধ ধরিয়াছে দেখিয়া লালুভাই বলিলেন, “তিনি আমার আত্মীয়া ছিলেন।

তখন স্ত্রীলোক বলিল, “উপরে যান। তিনি ৫২ নম্বর ঘরে ছিলেন।”

লালুভাই আর একতল উপরে উঠিলেন। অনেক কষ্টে ৫২ নম্বর ঘর পাইলেন। কিন্তু দেখিলেন, সে ঘরের দ্বারে চাবি বন্ধ।”

তিনি পার্শ্ববর্ত্তী ঘরের লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ ঘরে কে ছিল?”

একজন বলিল, “একটি স্ত্রীলোক ছিল।”

লালুভাই। তার নাম কি?

লোক। তা জানি না।

লালুভাই। তিনি আমার আত্মীয়।

লোক। সে দশ বার দিন হইল, মারা গিয়াছে।

লালুভাই। তার জিনিষ-পত্র কে লইল?

লোক। তা জানি না।

তাহার পর তিনি যাহা জিজ্ঞাসা করেন, তাহাতেই সে বলে “জানি না।” তিনি হতাশ হইয়া নিম্নতলে পূর্ব্বোক্ত স্ত্রীলোকের নিকট আসিলেন।

সে তখনও শিশুকে স্তনপান করাইতেছিল। লালুভাই তাহার নিকট আসিয়া বলিলেন, “যিনি মারা গিয়াছেন, তিনি আমার আত্মীয় ছিলেন। সম্বন্ধে খুড়ী হইতেন। ব্যারাম হইয়াছে বলিয়া আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি সুরাট হইতে আসিতেছি। আহা, দেখা হইল না!”

স্ত্রীলোক বলিল, “হাঁ, তিনি বড় কষ্টে মারা গেছেন। এক পয়সাও ছিল না।”

লালুভাই। আমি আগে সংবাদ পাইলে তাঁহার এ কষ্ট হইত না।

এই বলিয়া তিনি তথায় বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, “আপনি যদি তাঁহার সংবাদ আমাকে দেন, তাহা হইলে আপনাকে আমি একটা টাকা দিব। কেহই আমাকে তাঁহার বিষয় কিছু বলে না।”

টাকা দেখিয়া স্ত্রীলোকটির চক্ষু উজ্জ্বল হইল। সে বলিল, “কি জানিতে চান বলুন।”

“আপনার সঙ্গে কি তাঁহার আলাপ ছিল?”

“হাঁ আমি বড় গরীব, যা পারি তাঁর করেছি। বোধ হয়, চিকিৎসা হলে তিনি মরিতেন না।”

“তিনি আমাদের না জানিয়েই এখানে এসেছিলেন। কত দিন হইল, এখানে এসেছিলেন?”

“প্রায় তিন মাস।”

“কত দিন হইল, তাহার ব্যারাম হইয়াছিল?”

“মাসখানেক হইল।”

“কি ব্যারাম হইয়াছিল?”

“মুখ দিয়ে রক্ত উঠিত।”

“না জানি, কত কষ্ট পাইয়াছেন। একটু আগে যদি আমাদের খবর দিতেন। মরিবার সময়ে কেহ তাঁর কাছে এসেছিল?”

“হাঁ, তিনি সেই রাত্রে আমাকে একখানা পত্র দিয়ে হরমসজী সাহেবের লোক রস্তমজী সাহেবের নিকট পাঠিয়ে দেন।”

“তার পর?”

“আমি খুঁজে খুঁজে এলফিষ্টোন সার্কেলের বাগানে তাঁকে দেখতে পেয়ে একটা ছোকরাকে দিয়ে তাঁকে সেই পত্ৰ দিই।”

“কে তোমায় তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিল?”

“হরমসজী সাহেবের দ্বরওয়ান।”

“তার পর তিনি এসেছিলেন?”

“হাঁ, রাত্রি প্রায় বারটার সময়ে এসেছিলেন।”

“কতক্ষণ ছিলেন?”

“প্রায় দুঘণ্টা ছিলেন।”

“তাঁদের কি কথাবার্তা হলো?”

“তা আমি শুনি নাই। তাঁরা দরজা বন্ধ করে দিয়ে কথাবার্তা কহিতেছিলেন।”

“তার পর?”

“তার পর তাঁর চলে যাবার এক ঘণ্টা পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।”

“তাঁর মৃতদেহের সৎকার করিল কে?”

“বাড়ীওয়ালা লোকজন জোগাড় করে নিয়ে যান।”

“তাঁর জিনিষপত্র কি হল?”

“কিছুই বড় ছিল না। যা ছিল, বাড়ীওয়ালা নিয়ে গেছেন।”

“আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম।” এই বলিয়া লালুভাই রমণীর হস্তে একটি টাকা দিয়া তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – সন্ধানের ফল

লালুভাই নিম্নে নামিয়ে আসিয়া একজন দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাড়ী কার?”

সে বলিল, “মহালক্ষ্মীর দাদাভাই মাণিকজীর।”

লালভাই মহালক্ষ্মীর দিকে রওনা হইলেন।

দাদাভাই মাণিকজী ধন্যাঢ্য ব্যক্তি। লালুভাই তাঁহার বাটী চিনিতেন। তথায় আসিয়া তিনি মাণিকজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন। এক ব্যক্তি তাঁহাকে বসাইয়া মাণিকজীকে সংবাদ দিতে গেলেন। কিয়ংক্ষণ পরে তিনি সেখানে আসিলে লালুভাই উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

দাদাভাই বলিলেন, “আমার নিকটে মহাশয়ের কি দরকার?”

লালুভাই বলিলেন, “আমি ডিটেটিভ ইনস্পেক্টর, লালুভাই।”

“ডিটেটিভ ইনস্পেক্টর! আমার নিকটে কি প্রয়োজন?”

“একটু আছে।”

“বসুন।”

লালুভাই বসিলেন—তিনিও বসিলেন। লালুভাই বলিলেন, “আপনার পাইদুনিতে এক ‘চল’ আছে?”

“আছে।”

“সেই ‘চলে’ দশ দিন হইল একটি স্ত্রীলোক মারা গিয়াছে?”

“হাঁ।”

“কত দিন হইল, সে ঐ বাড়ীতে আসিয়াছিল?”

“আমি ঠিক বলিতে পারি না, আমার কর্ম্মচারী জানেন।”

থাক—সে বিষয়ে আমার তত প্রয়োজন নাই।”

“আপনি এ সন্ধান লইতেছেন, কেন, জিজ্ঞাসা করিতে পারি?”

“আপনি পেষ্টনজী বলিয়া একটি লোকের কথা শুনিয়াছেন কি?”

“হাঁ, সংবাদপত্রে পড়িয়াছি।”

“আমরা যে লোককে গ্রেপ্তার করিয়াছি, সেই লোকটি এই মৃত স্ত্রীলোকের নিকট সেই রাত্রে বহুক্ষণ ছিলেন।”

“তা হলে—”  

লালুভাই বাধা দিয়া বলিলেন, “যখন পেষ্টনজী খুন হয়, তখন তিনি এই স্ত্রীলোকের নিকটে।”

“তা হলে তিনি খুন করেন নাই?”

“না।”

“এখন আমার নিকটে কি জানিতে চান?”

“আপনি এই স্ত্রীলোকের দ্রব্যাদি সব লইয়া আসিয়াছেন?”

“হাঁ, আমার কর্ম্মচারী লইয়া আসিয়াছিলেন। তাহার বিশেষ কিছুই ছিল না বলিয়া আর তাহা পুলিসে পাঠাই নাই।”

“তবু কি ছিল?”

“একটা ভাঙা টিনের বাক্স, তাহার ভিতরে দুই-তিনখানা ছেঁড়া কাপড়।”

“আমি সেটা একবার দেখিতে চাই।”

মাণিকজী এক ব্যক্তিকে ডাকিয়া সেই বাক্সটি আনিতে বলিলেন। বহু আবর্জনার ভিতরে সেই ভাঙ্গা বাক্সটি ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সুতরাং শীঘ্র খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।

বিলম্ব দেখিয়া মাণিকজী বিরক্ত হইয়া স্বয়ং দেখিতে গেলেন। লালুভাই তথায় বসিয়া তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে মাণিকজী ফিরিলেন, একজন ভৃত্য একটা ভাঙ্গা টিনের বাক্স সঙ্গে আনিল। মাণিকজী বলিলেন, “এই সেই বাক্স।”

লালুভাই বাক্সটি খুলিয়া একে একে ছিন্ন মলিন বস্ত্রগুলি হাতে করিয়া তুলিলেন। তাঁহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাক্সের ভিতরে একখানি কাগজের উপর পড়িল। তিনি মাণিকজীর অজ্ঞাতসারে সেটি প্রথমে হস্তস্থ তাহার পর একেবারে পকেটস্থ করিলেন। আবার কাপড়গুলি নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন, তৎপর বলিলেন, “হইয়াছে, আর দেখিবার কিছুই নাই, এ আর আপনাকে পুলিসে পাঠাইতে হইবে না।”

মাণিকজী বিনীতভাবে বলিলেন, “আমার দ্বারা আপনার যদি কোন কাজ হয়, তাহা করিতে সৰ্ব্বদাই আমি প্রস্তুত আছি।”

“তাহা আমরা সকলেই অবগত আছি”, বলিয়া লালুভাই তাঁহার বাড়ী হইতে বাহির হইলেন।

কিয়দ্দুর আসিয়া লালুভাই পকেট হইতে সেই কাগজখানি বাহির করিয়া বিশেষ ঐকান্তিকতার সহিত পাঠ করিলেন। তৎপরে মনে মনে বলিলেন, “কীৰ্ত্তিকর সাহেব আমাকে নিতান্তই অহাম্মুক ঠাওরান। কিন্তু এবার এ কাগজখানা দেখিয়া কি বলিবেন!”

এই সময়ে কে তাঁহার পৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করিলেন। তিনি ফিরিয়া দেখিলেন—স্বয়ং কীৰ্ত্তিকর। হাসিয়া বলিলেন, “আপনি কি সর্ব্বত্রই আছেন?”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “না হলে চলে কই—সরকারী মাহিনা খাই ত। এখন দাদাভাই মাণিকজীর নিকটে কি সংবাদ পাইলেন?”

লালুভাই বলিলেন, “দেখিতেছি, আপনি তাহাও জানেন!”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “সবই কিছু কিছু জানিতে হয়।”

লালুভাই সংক্ষেপে তাঁহাকে সকল কথা বলিয়া সেই কাগজখানি হাতে দিলেন। তিনি এইমাত্র আশা করিয়াছিলেন, সেই কাগজখানি দেখিয়া কীর্ত্তিকর নিশ্চয়ই খুব আশ্চর্যান্বিত হইবেন, কিন্তু সে বিষয়ে তাঁহাকে একেবারে নিরাশ হইতে হইল। কীর্ত্তিকবের মুখে আশ্চর্য্য বা বিস্ময়ের কোন চিহ্ন দেখা গেল না। তিনি কেবলমাত্র বলিলেন, “ইহাতে যাহা আছে, তাহা আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম।”

“জানিতেন?”

“হাঁ।”

“এখন আর এই আসামীকে গ্রেপ্তার করিতে এক মিনিটও দেরী করা উচিত নহে।”

“আফিসে দেখা করিবেন, বিবেচনা করা যাইবে। একটা কাজ আপনার ভূল হইয়াছে।”

“কি বলুন।”

“দাদাভাই মাণিকজীর একজন কর্ম্মচারী সে রাত্রে স্ত্রীলোকটিকে মুমূর্ষু জানিয়া পাইদুনির ‘চলে’ উপস্থিত ছিল; সুতরাং সে রস্তমজীকে নিশ্চয়ই দেখিয়াছে। সে রস্তমজীকে চেনে—কারণ হরমসজীর ব্যাঙ্কের সঙ্গে মাণিকজীরও কাজকাবার আছে।”

“এখন আমাকে কি করিতে বলেন?”

“এই লোককে খুঁজিয়া বাহির করুন।”

“এখনই যাইতেছি।”

তখন দুইজনে দুইদিকে প্রস্থান করিলেন।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – নায়েক মহাশয়ের যুক্তি

ফ্রামজী নিজের বাসায় বসিয়া এন্ড্রু রস্তমজীর কথা ভাবিতেছেন। এমন সময়ে সেখানে কাশীনাথ নায়েক মহাশয় উপস্থিত হইলেন। প্রথমেই তিনি আরম্ভ করিলেন, “আপনার সহিত আমার পরিচয় ছিল না। আমি রস্তমজীর পিতার বাল্য-বন্ধু, তাঁহার বিপদের কথা শুনিয়া স্থির থাকিতে পারিলাম না। তাঁহাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য আসিয়াছি।”

ফ্রামজী তাঁহাকে সসম্মানে একখানি চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন, “রস্তমজীর এ বিপদে সাহায্য করিবার লোক কেহই নাই।”

কাশীনাথ বলিলেন, “শুনিয়াছি, আপনি তাঁহার বিশেষ বন্ধু—”

ফ্রামজী বলিলেন, “বন্ধু হইলেও আমি একাকী কি করিতে পারি? বিশেষতঃ আমার উপরও নাকি পুলিসে এ খুনের সন্দেহ করিয়াছে।”

কাশীনাথ। খুনের সব কথাই শুনিয়াছি। আপনার উপর সন্দেহের অনেকখানি কারণও আছে। আপনি ক্লোরাফর্ম্ম কিনিয়াছিলেন—আপনার ক্লোরাফর্ম্ম মাখা রুমাল লাসের মুখের উপর পাওয়া গিয়াছে। যেখানে খুন হইয়াছিল, আপনি সেই রাত্রে সেইখান হইতে গাড়ী করিয়া নিজের বাড়ীর নিকট নামিয়াছিলেন।

ফ্রামজী। আমি প্রমাণ দিতে পারিব, আমি সে রাত্রে আদৌ বোম্বে সহরে ছিলাম না।

কাশীনাথ। সে রাত্রে আপনার গতিবিধি সম্বন্ধে যদি আপনি সে প্রমাণ দিতে পারেন, তবে আপনার আর ভয় কি? যাহা হইক, কাল রস্তমজীর বিচার আরম্ভ হইবে। সেইজন্য আপনার নিকটে আসিয়াছি, যে কোন উপায়ে তাঁহাকে রক্ষা করা চাই।

ফ্রামজী। আমাকে কি করিতে হইবে, বলুন।

কাশী। প্রথমে একজন ভাল উকীল প্রয়োজন। আপনার নিকট টাকা আছে।

ফ্রামজী। আপনি কেমন করিয়া জানিলেন?

কাশী। শুনিয়াছি, আপনাকে কে রস্তমজীর উদ্ধারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পাঠাইয়া দিয়াছে। যেই পাঠাক, এখন আমাদের কাজে লাগিবে।

ফ্রামজী। বালকিষণ হরকিষণকে ঠিক করিয়া রাখিয়াছি।

কাশী। খুব ভাল করিয়াছেন। আজকাল তিনিই ফৌজদারী মোকদ্দমার প্রধান উকীল।

ফ্রামজী। কিন্তু তিনি বলেন, রস্তমজী যে পেষ্টনজীর সঙ্গে গাড়ীতে যান্ নাই, ইহা প্রমাণ না করিতে পারিলে কিছুতেই কিছু হইবে না।

কাশী। তা জানি। তাঁহার স্বপক্ষে প্রমাণও আমি কিছু কিছু

ফ্রামজী। উকীল লইয়া আমি তাঁহার সঙ্গে জেলে দেখা করিয়া ছিলাম, কিন্তু __ যে, প্রেষ্টনজীর সঙ্গে গাড়ীতে যান নাই, তবে সে রাত্রে কোথায় গিয়াছিলেন, তাহাও কিছুতেই স্বীকার করিবেন না।

কাশী। আমিও জেলে তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছিলাম। তিনি আমার নিকটেও স্বীকার করেন নাই।

ফ্রামজী। বিপদে পড়িয়া তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।”

কাশী। যাহা হউক, তিনি কিছুতেই স্বীকার না করিলেও আমার কাছে এখন তাহা অগোচর নাই; তবে ইহার জন্য আমাকেই একটু কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছিল, তিনি সে রাত্রে কোথায় কাহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি।

ফ্রামজী আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, “তবে রস্তমজী নিশ্চয়ই খালাস হইবেন।”

কাশী। নির্দোষীর দণ্ড কেন হইবে? এখন শুনুন—আমি যাহা বলিতেছি, উকীলকে বলিবেন।

ফ্রামজী। বলুন।

কাশী। সেই রাত্রে রাত্রি দশটার সময় এলফিষ্টোন বাগানের সম্মুখে একটি বালক রমজীকে একখানা পত্র দেয়, এই সেই পত্র।

ফ্রামজী উদ্‌গ্রীব হইয়া পত্র পাঠ করিলেন। বলিলেন, “একটি স্ত্রীলোক মৃত্যুশয্যা হইতে তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠায়?”

কাশীনাথ বলিলেন, “তিনি সেই রাত্রে তাড়াতাড়ি তাঁহার সহিত দেখা করিতে যান। পথে পেষ্টনজীর সহিত সাক্ষাৎ হয়। পেষ্টনজী নিতান্ত মাতাল হইয়াছে দেখিয়া, তিনি তাহাকে একখানা গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া তখনই সেই স্ত্রীলোকের সহিত দেখা করিতে যান।”

“স্ত্রীলোকটি এ কথা বলিবে?”

“সে স্ত্রীলোকটির সেই রাত্রেই মৃত্যু হইয়াছে।”

“তবে উপায়?”

“সেই বাড়ীতে আর একটি স্ত্রীলোকের সহিত মৃত স্ত্রীলোকটির আলাপ ছিল। এই স্ত্রীলোকই পত্র লইয়া রস্তমজীর নিকট আইসে। এলফিষ্টোন সার্কেলের সম্মুখে একটা বালককে দিয়া রস্তমজীর হাতে পত্র দেয়।”

“এ কথা স্ত্রীলোক বলিবে?”

“অবশ্য বলিবে—আরও বলিবে যে, মৃত স্ত্রীলোকের নিকট রস্তমজী দুই ঘণ্টার উপর ছিলেন। তাহা হইলে যখন পেষ্টনজী খুন হয়, তখন রস্তমজী এই স্ত্রীলোকের বাড়ীতে।”

“তা হইলে আর রস্তমজীর ভয় কি?”

“আরও সাক্ষী আছে। যে বাড়ীতে স্ত্রীলোকটি ছিল, সেই বাড়ীটি মহালক্ষ্মীর মাণিকজী সাহেবের। তাঁহার কর্ম্মচারী সে রাত্রে তথায় ছিল। হরমসজীর ব্যাঙ্কের সঙ্গে মাণিকজীরও কাজ-কারবার আছে, কাজেই এই কর্ম্মচারী রস্তমজীকে বেশ জানে। এ রস্তমজীকে সেই বাড়ীতে সে রাত্রে দুইঘণ্টা থাকিতে দেখিয়াছিল।”

“এ কথা সে বলিবে?”

“নিশ্চয় বলিবে—সত্যকথা বলিবে না কেন? আপনার উকীলকে এই তিন সাক্ষী ডাকিতে বলিবেন—বালক, স্ত্রীলোক, কৰ্ম্মচারী।”

“আমি এখনই তাঁহার নিকট চলিলাম।”

“মোকদ্দমা কাল, সুতরাং আজই প্রস্তুত হওয়া আবশ্যক।”

“আমি এখনই যাইতেছি।”

“যদি পারি ত আবার দেখা করিব।”

“আপনার জন্যই রস্তমজী বাঁচিয়া গেলেন। নতুবা তাঁহার বাঁচিবার আশা ছিল না। তিনি চিরকাল আপনার নিকট বিক্রীত রহিলেন।”

“আমার কর্ত্তব্য নয় কি?” এই বলিয়া কাশীনাথ নায়েক প্রস্থান করিলেন। ফ্রামজী ও তৎক্ষণাৎ উকীলের সহিত দেখা করিতে বাহির হইলেন।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – পরামর্শ

অদ্য সন্ধ্যার পর কীর্ত্তিকর নিজ আফিসে বসিয়া লালুভাই ও দাদাভাস্করের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। প্রথমে দাদাভাস্কর আসিলেন।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “বসো, আর কোন খবর আছে?”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “বেশী কিছু নয়, তবে দুজনের কথায় এ বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছি যে, বর্জরজী একটি পাকা বদমায়েস—এর হাতের মধ্যে রাজাবাঈ আর কমলাবাঈ দুজনেই এসে পড়েছে। মাঞ্চারজী এর হাতে কলের পুতুল।”

“চুরী কে করিয়াছে, জানিতে পারিলে কি?”

“বোধ হয়, রাজা বাঈ।”

“রাজাবাঈ-এর সে গুপ্তকথা জানিবার কোন সম্ভাবনা নাই।”

“কেন?”

“হরমসজী সে কথা নিজের স্ত্রীকেও কখনও বলিবে না। এরূপ না হইলে সে এত টাকা উপার্জ্জন করিতে পারিত না।”

“মাঞ্চারজী, রস্তমজীর সহিত খুব মিশিত। হয়ত, সেই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কোন দিন তাহাকে বলিয়া ফেলিয়াছিল।”

“সম্ভব, কিন্তু সে এ কথা স্বীকার করে না।”

“যাই হউক, চোর শীঘ্রই ধরা পড়িবে। আর আমার বর্জরজীর চাকর হইয়া থাকিয়া লাভ নাই। বেটার চাকর হওয়া বড় সহজ ব্যাপার নহে। একবার আমার পিঠের কাপড়টা খুলিয়া দেখাইলেই আপনার তা বেশ উপলব্ধি হইবে।”

কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “তবে, আজ হতেই সরে পড়। দরকার হয়, সে নূতন চাকর খুঁজিয়া লইবে।”

এই সময়ে লালুভাই দেখা দিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া দাদাভাস্কর জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুনের কতদূর কি করিলেন?”

লালুভাই বলিলেন, “আর কিছুই বাকী নাই। এবার যাঁহাকে গ্রেপ্তার করিব, তিনি আর এড়াইতে পারিতেছেন না।”

দাদা। ও কথা ত রস্তমজীকে গ্রেপ্তার করিবার সময়েও বলিয়াছিলেন।

লালু। এবার দেখ।

কীৰ্ত্তি। এই পত্রখানি লালুভাই সাহেব পাইয়াছেন, দেখ।

দাদাভাস্কর পাঠ করিলেন;–

“হরমসজী,

তোমাকে পত্র লিখিবার আমার মুখ নাই, তবে আর বেশীদিন বাঁচিব না, আমি মরিতেছি, তাহাই লিখিতেছি।

যদি তুমি আমাদের বিবাহ গোপন না রাখিতে, তাহা হইলে হয় ত আমার এ দশা হইত না। অদৃষ্টের দোষ দিব না—নিজের পাপের ফল নিজেই ভুগিতেছি।

না বুঝিয়া, পাপের প্রলোভনে পড়িয়া, তোমার মেয়েটি লইয়া, আমি তোমায় ছাড়িয়া পলাইয়াছিলাম। মেয়েটিকে অপরের কাছে রাখিয়া ছিলাম কিন্তু তাহাকে আর পাই নাই। শুনিয়াছি, সে এখনও বাঁচিয়া আছে। হয় ত আমারই অবস্থা তাহারও হইয়াছে। আমি পাপীয়সী তাহার কোন দোষ নাই, তাহাকে সন্ধান করিয়ো। এখন তোমার টাকার অভাব নাই, তাহাকে দেখিয়ো। আইন অনুসারে তোমার সব সম্পত্তির মালিক সে।

এই বিশ বৎসর আমি কি করিয়াছি না করিয়াছি, কিরূপ ছিলাম, তোমাকে শুনাইয়া লাভ নাই। যাহা হউক, শেষে পেষ্টনজী বলিয়া একটা লোকের নিকটে ছিলাম।

তাহার যাহা কিছু ছিল, সে উড়াইয়া দিয়া টাকার চেষ্টায় ফিরিতে থাকে। আমার কাছে সে তোমার কথা শুনে; তোমাকে ভয় দেখাইয়া টাকা আদায়ের চেষ্টায় আমার কাছ থেকে আমাদের বিবাহের সার্টিফিকেট আর মেয়ের জন্মের সার্টিফিকেট ভুলাইয়া লইয়া বোম্বে আসিয়াছে।

তোমার উপর আমার রাগ ছিল বটে, কিন্তু আমার দোহাই দিয়া তোমার কেহ সৰ্ব্বনাশ করে, আমার ইহা ইচ্ছা নয়। তাহাই অনেক কষ্টে আজ আড়াই মাস হইল, তাহার সন্ধানে এখানে আসিয়াছি। কিন্তু এখানে আসিয়া ব্যারামে পড়িয়াছি; বেশ বুঝিয়াছি, আর বাঁচিব না— বাঁচিবার ইচ্ছাও নাই।

পেষ্টনজীর সহিত আজ দেখা হইয়াছে। সে তোমাকে আমার কথা এখনও কিছুই বলে নাই। এমনই অর্থলোভী পিশাচ সে যে, তোমার মেয়েকে বিবাহ করিবার চেষ্টায় আছে। তাহা হইলে তোমার সমস্ত টাকাই তাহার হইবে। যাহাতে সে এ বিবাহ করিতে না পারে, তাহা আমি করিব—তুমিও সাবধান হইয়ো।

আর লিখিতে পারিতেছি না, হাত অসাড় হইতেছে। জানিয়াছি, রস্তমজী বলিয়া একজন তোমার মেয়েকে ভালবাসে, তাহাকেও খবর দিব; পেষ্টনজী জালিয়াৎ জুয়াচোর নৃশংস। তাহার অসাধ্য কৰ্ম্ম এ জগতে কিছুই নাই।”

দাদাভাস্কর পত্রখানি পাঠ করিয়া কীর্ত্তিকরের সম্মুখে রাখিলেন। কীৰ্ত্তিকর জিজ্ঞাসিলেন, “কি বুঝলে?”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “স্ত্রীলোকটি হরমসজীর বিবাহিতা স্ত্রী ছিল। তার চরিত্র খারাপ ছিল বলিয়া, হরমসজী এ বিবাহ গোপন করিয়াছিলেন—এদের একটি মেয়ে হয়।”

কীর্ত্তিকর। তার পর?

দাদা। তার পর মেয়েটিকে নিয়ে এ গৃহত্যাগ করে। পার্শী নাম থাকিলে কেহ চিনিতে পারে বলিয়া মারাঠী নাম লইয়াছিল।

কীর্ত্তিকর। তার পর পেষ্টনজীর কাছে থাকে, সে এর সার্টিফিকেট দুইখানি সংগ্রহ করিয়া হরমসজীর সর্ব্বনাশের চেষ্টায় আসে—এ ত এ চিঠী পড়িলে একজন হস্তীমুখেও বুঝতে পারে।

দাদা। তার পর ইহাও স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, এই স্ত্রীলোক কোন গতিকে হরমসজীকে সকল কথা জানায়। হরমসজী আত্মরক্ষা করিবার জন্য পেষ্টনজীর নিকট হইতে সার্টিফিকেট দুখানা হস্তগত করিবার চেষ্টায় থাকেন।

লালুভাই। তিনি ফ্রামজীকে নিজের দলভুক্ত করেন। ফ্রামজীকে দিয়া ক্লোরাফর্ম্ম ক্রয় করেন। ফ্রামজী ও রস্তমজী একই রকম কোট ব্যবহার করিতেন। সুতরাং ফ্রামজীর নিকট হইতে তাঁহার কোট চাহিয়া লইয়া সে রাত্রে পেষ্টনজীর অনুসরণ করেন।

কীর্ত্তিকর। তার পর?

লালুভাই। রস্তমজীকে দেখে একটু সরিয়া দাঁড়ান। সে চলিয়া যাইবামাত্র পেষ্টনজীর গাড়ীতে উঠিয়া বসেন। তার পর তাহাকে ক্লোরাফর্ম্ম দেওয়া—আর সার্টিফিকেট লইয়া গাড়ী হইতে নামিয়া পড়া—সুপারিন্টেণ্ডেন্ট সাহেব, হরমসজীকে গ্রেপ্তার করিতে আর এক মিনিট ও দেরী করিবেন না।

দাদা। আমারও তাই মত।

কীর্ত্তিকর। পরে দেখা যাইবে। রস্তমজীর মোকদ্দমা চুকিয়া যাক্। কাল তাহার মোকদ্দমা। আপনারা প্রস্তুত হউন।”

লালুভাই ও দাদাভাস্কর উভয়েই আর কোন কথা না কহিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কীর্ত্তিকর তদুভয়কে বিদায় দিয়া কতকগুলা কাগজ-পত্র টানিয়া লইয়া নিজ কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন।