দ্বিতীয় খণ্ড – অদৃষ্ট গণনার ফল (পথে খুন)

দ্বিতীয় খণ্ড – অদৃষ্ট গণনার ফল (পথে খুন)

প্রথম পরিচ্ছেদ – বৃথা চেষ্টা

বিশেষ চেষ্টা করিয়াও দত্ত সাহেব অদ্যাবধি সেই অপহৃত বিষ-গুপ্তির কোন সন্ধানই করিতে পারেন নাই। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হৃদয়ে একদিন তিনি সেই বিষ-গুপ্তির সন্ধানের জন্য বেন্টউড সাহেবের বাটীতে যাইয়া উপস্থিত হইলেন।

বেন্টউড বলিলেন, “সে সম্বন্ধে আমি কিছুই বলিতে পারি না। কারণ সেইদিন হইতে আপনার বিষ-গুপ্তি আমি দেখি নাই। বিষ-গুপ্তিটা রাখিতে আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল, সেইজন্য সেটা আমায় বিক্রয় করিবার জন্য আপনাকে অনুরোধও করিয়াছিলাম; কিন্তু আপনি তাহাতে অস্বীকার করিলেন দেখিয়া, আমাকে আপনার বিষ-গুপ্তির আশা একেবারেই ত্যাগ করিতে হইল। বড়ই দুঃখের বিষয়, এমন দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীটা আপনি এত শীঘ্র হারাইয়া ফেলিলেন।”

রোষসংক্ষুব্ধস্বরে মিঃ দত্ত বলিলেন, “হারাইয়া ফেলিব কেন? কেহ চুরি করিয়াছে। আমার বোধ হয়, জুলেখা—”

বাধা দিয়া বেন্টউড সাহেব বলিলেন, “আপনার অনুমান কত-দূর সত্য, বলিতে পারি না; জুলেখা লইলেও লইতে পারে; কারণ এ তাহাদেরই দেশের জিনিষ, তাহাতে জুলেখার একটা লোভ থাকা সম্ভব বটে। একবার আপনি জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিতে পারেন।”

মিঃ দত্ত বলিলেন, “জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কেবল তাহাকে নহে, সেলিনার মাকেও জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। সেলিনার মার মুখে শুনিলাম, কাল সন্ধ্যার পর জুলেখা বাড়ীর বাহির হয় নাই। কাল অপরাহ্ণে সেলিনাদের বাড়ীতে গেটের ধারে দাঁড়াইয়া জুলেখার সহিত আপনার কি কোন কথাবার্তা হইয়াছিল?”

বেন্ট। হইয়াছিল—কিন্তু বিশেষ কোন কথা হয় নাই। এ কথা আপাকে কে বলিল? সুরেন্দ্রনাথ বুঝি?

দত্ত। সুরেন্দ্রনাথ। কাল হইতে আপনার উপরে সুরেন্দ্রনাথের রাগটা অত্যন্ত প্রবল দেখিলাম। তাহার সহিত আপনার কিছু মনোমালিন্য ঘটিতে পারে, এমন কোন ঘটনা কি কাল সেলিনাদের বাড়ীতে ঘটিয়াছিল?

বেন্ট। কিছুই না। তবে আমার উপরে সুরেন্দ্রনাথের রাগের অন্য একটা কারণ আছে।

দত্ত। কারণটা কি?

বেন্ট। সেদিন তাহার হাত দেখিয়া আমি যে একটা ভবিষ্যৎ ঘটনার কথা বলিয়াছিলাম, তাহা আপনার স্মরণ আছে, বোধ হয়।

দত্ত। আছে—সে বাজে কথা। আপনি ত নিজেই তার কোন একটা অর্থ করিতে পারিলেন না। আমি ত এক তিল বিশ্বাস করি না।

বেন্ট। বিশ্বাস করেন না—বেশ, অপেক্ষা করুন, সময়ে দেখিতে পাইবেন, বিশ্বাসও করিবেন।

সেদিন তাঁহাদের মধ্যে আর কোন কথা হইল না। মিঃ দত্ত বিদায় লইয়া উঠিলেন। বেন্টউড সাহেব বাটীর বহির্দ্বার পর্য্যন্ত তাঁহার সঙ্গে আসিলেন। পরে পরস্পর করপীড়ন করিয়া দত্ত সাহেব নিজের গাড়ীতে উঠিলেন এবং বেন্টউড বাটীমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

যখন দত্ত সাহেব বেন্টউডের নিকটে সন্ধান লইয়া বিষ-গুপ্তি পুনরুদ্ধারের কোন সূত্র পাইলেন না, তখন তিনি একেবারে নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িলেন। তাঁহার হৃদয় উদার, মহৎ এবং দয়াপ্রবণ; বিষ-গুপ্তির জন্য তাঁহার যত দুঃখ না হউক, পাছে সেই বিষ-গুপ্তি লইয়া কোথায় কোন সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত হয়, এই ভয়েই তাঁহার কোমল হৃদয় উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছিল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অবাধ্যতা

সুরেন্দ্রনাথ যখন তাঁহার মাতুল মহাশয়ের নিকট শুনিলেন যে, জুলেখাকে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই; কারণ সেদিন সে সন্ধ্যার পর বাহির হয় নাই। তখন তিনি মনে করিলেন, যদি জুলেখা এ কাজ নিজে না করিয়া থাকে, তবে জুলেখা আর বেন্টউডের পরামর্শে আশানুল্লা দ্বারাই এ কাজ হইয়াছে। আশানুল্লার নিকট একবার সন্ধান লওয়া প্রয়োজন।

সুরেন্দ্রনাথ আশানুল্লার সন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন যে, সে একেবারে নিরুদ্দেশ; কোথায় গিয়াছে, সে সম্বন্ধে গ্রামের কেহ কোন কথা বলিতে পারে না। তখন আশানুল্লাই যে লোভে পড়িয়া দত্তসাহেবের বাড়ী হইতে স্বর্ণ-মণ্ডিত বিষ-গুপ্তিটা চুরি করিয়াছে, এই কথাটা অতি শীঘ্র গ্রামের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করিল।

একদিন অপরাহ্নে দত্ত সাহেবের বাড়ীতে হঠাৎ আশানুল্লা হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত। তাহার একান্ত ইচ্ছা, সুরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিবে। সুরেন্দ্রনাথ আশানুল্লাকে ল‍ইয়া বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন।

তখন দত্ত সাহেব গৃহে ছিলেন না। কোন কাজে বাহিরে গিয়া ছিলেন। বাড়ীতে ফিরিয়া রহিমবক্সের মুখে শুনিলেন, আশানুল্লা সুরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে। এইবার বিষ-গুপ্তির একটা কিনারা হইবে মনে করিয়া দত্ত সাহেব তাড়াতাড়ি সেই বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, তথায় আশানুল্লা নাই, সুরেন্দ্রনাথ একাকী বসিয়া আছেন।

ঘরের চারিদিকে চাহিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “আশানুল্লা কোথায় গেল?” সুরেন্দ্র। এইমাত্র সে চলিয়া গেল।

দ। সে তোমার সহিত কেন দেখা করিতে আসিয়াছিল?

সু। সে কোথায় শুনিয়াছে যে, সে বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে বলিয়া আমি তাহাকে সন্দেহ করিয়াছি; তাই সে নিজের নির্দোষতা সপ্রমাণ করিতে আসিয়াছিল।

দ। তাহার কথার ভাবে কি বুঝিলে?

সু। তাকে নির্দোষ বলিয়াই বুঝিলাম। সে আমাদের বিষ-গুপ্তি চুরি করে নাই।

দ। তবে কে চুরি করিয়াছে?

সুরেন্দ্রনাথ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কি ভাবিতে লাগিলেন। ক্ষণ-পরে কহিলেন, “সে কথা আপনাকে কাল বলিব।”

দ। এখন না বলিবার কারণ?

সু। এখন আমি নিজে কিছু ঠিক করিতে পারি নাই; মনে একটা সন্দেহ হইয়াছে মাত্র। আশানুল্লার নিকটে এ সম্বন্ধে একটা যে সূত্র পাইয়াছি, তাহাই অবলম্বন করিয়া সন্ধান লইতে হইবে। কাল আমি কাজ শেষ করিতে পারিব।

দ। কাহার উপরে তোমার সন্দেহ হইতেছে?

সু। আপনি আমাকে আর কোন প্রশ্ন করিবেন না—আজ আমি আপনার নিকট কোন কথা প্রকাশ করিতে পারিব না।

কথাটা শুনিয়া দত্ত সাহেবের গম্ভীর মুখমণ্ডলে একটা বিষণ্ণতার ছায়া স্পষ্টীকৃত হইল। তন্মুহূর্ত্তে তিনি সে ভাব গোপন করিয়া মৃদুহাস্যের সহিত কহিলেন “যাহা ভাল বুঝিবে, তাহাই করিবে। কেবল তুমি নও, অমরেন্দ্রও আমার সহিত আজকাল এইরূপ ব্যবহার করিতেছে; বড়ই দুঃখের বিষয়!”

সবিস্ময়ে সুরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, অমর দাদা আবার কি করিয়াছেন?”

অতিমাত্র বিরক্ত হইয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “আমার মুণ্ড করিয়াছেন! আমাকে কোন কথা বলা নাই—কহা নাই—কলিকাতায় গিয়াছে। সেখানে তাহাকে কেবল দুই দিন থাকিতে হইবে, সেটা আমাকে জানানো যেন একান্ত অনাবশ্যক। যাইবার সময়ে রহিমবক্সের কাছে দুইছত্র মাত্র লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছে; কেন যাইতেছে, কি দরকার ইহাতে তাহার কোন উল্লেখই করে নাই।”

এই বলিয়া দত্ত সাহেব পকেট হইতে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া সুরেন্দ্রনাথের দিকে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন।

সুরেন্দ্রনাথ সেই কাগজ টুকরা লইয়া পড়িয়া দেখিলেন; তাঁহার মাতুল মহাশয়ের মুখে যাহা শুনিলেন, তদ্ব্যতীত তাহাতে আর কিছু লিখিত ছিল না। তিনি সেখানি দত্ত সাহেবকে প্রত্যর্পণ করিয়া বলিলেন, “আজ আমাকে এখনই একবার আলিপুরে যাইতে হইবে। বোধ হয়, ফিরিতে অনেক রাত হইবে। আমি বাড়ীতে আহার করিব না—হোটেলে আহার করিব।”

বালিগঞ্জ হইতে আলিপুর অন্যূন এক ক্রোশ দূরে। আলিপুরে বেন্টউড সাহেবের বাড়ী।

দত্ত। আলিপুরে যাইবে কেন?

সু। একটা বিশেষ কাজ আছে।

দ। কি কাজ, তাহার কোন নাম নাই? সুরেন্, আমি নিজে বুকে করিয়া তোমাদিগকে মানুষ করিয়াছি; তোমাদের উপরে আমার কত স্নেহ, তোমরা তাহা নিশ্চয়ই বুঝ না! তোমাদের এরূপ ব্যবহারে আমার মর্মান্তিক কষ্ট হয়! আমার কাছে কোন কথা গোপন করা তোমাদের ভাল দেখায় না।

সু। যে কাজে যাইতেছি, তাহা যদি এখন ঘুণাক্ষরে প্রকাশ পায়, তাহা হইলে হয়ত আমার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যাইবে। তবে আপনি এইমাত্র জানিয়া রাখুন, আমি বিষ-গুপ্তির পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় যাইতেছি। আপনি আর আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। আমি কাল নিজেই আপনার কাছে সমুদয় প্রকাশ করিব; তখন আপনি বুঝিতে পারিবেন, আমি আপনার নিকটে পূৰ্ব্বে ইহা গোপন করিয়া নির্ব্বোধের কাজ করি নাই।

দীর্ঘনিঃশ্বাস টানিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “বেশ বাপু, তাহাই ভাল; এখন তোমরা বড় হইয়াছ, জ্ঞান-বুদ্ধি হইয়াছে, নিজের ভাল-মন্দ নিজেই বুঝিয়া চলিতে পারিবে।”

সুরেন্দ্রনাথ বিনীতভাবে বলিলেন, “কাল আপনি আমাদের সম্বন্ধে সকল কথাই জানিতে পারিবেন।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “অমরেন্দ্রের সম্বন্ধেও?”

সুরেন্দ্রনাথ মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “নিশ্চয়ই।”

সন্দেহাকুল হইয়া উত্তেজিতকণ্ঠে দত্ত সাহেব কহিলেন, “তাহা হইলে অমর যে কেন কলিকাতায় গিয়াছে, তাহাও তুমি জান?”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তাঁহার সম্বন্ধে আমি নিশ্চয় করিয়া কিছু বলিতে পারি না। তবে কেন যে তিনি হঠাৎ কলিকাতায় গিয়াছেন, তাহা অনুমানে অনেকটা বুঝিতে পারিয়াছি। আমার উপরে রাগ করিতে হয় করুন, আমি আজ আর আপনার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিব না। আমাকে এখনই যাইতে হইবে।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “কোচম্যানকে গাড়ী ঠিক করিতে বলিব?”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “না—গাড়ীতে আবশ্যক নাই—আমি হাঁটিয়া যাইব।”

সুরেন্দ্রনাথের এইরূপ ব্যবহারে দত্ত সাহেবের মন নিরতিশয় কৌতূহলাক্রান্ত ও সন্দেহসঙ্কুল হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি সুরেন্দ্রনাথকে সেইরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, তাঁহাকে আর পীড়াপীড়ি করিয়া কোন লাভ নাই; সুতরাং কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না।

ক্ষণপরে সুরেন্দ্রনাথ চলিয়া গেলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – খুন—পথিমধ্যে

দুই ভাগিনেদের উপরে দত্ত সাহেবের স্নেহ অপরিসীম। তিনি তাহাদের দুইজনকে আপনার প্রাণের মতন দেখিতেন। এই দুইজন ছাড়া তাঁহার সংসারে আর কোন বন্ধন ছিল না—এই দুইটি বন্ধনই অনুক্ষণ নিরতিশয় দৃঢ় বলিয়া তাঁহার অনুভব হইত।

আপাততঃ সেই দুইজনের কেহই উপস্থিত না থাকায়, আহারের সময়ে একাকী আহার করিতে দত্ত সাহেবের বড় কষ্ট হইতে লাগিল। তিনি তাহাদের সহিত গল্প করিতে করিতে আহার করিতে ভালবাসিতেন; তাহাতে আহারে তৃপ্তিও হইত। আজ আহারের সময়ে সেখানে না সুরেন্দ্রনাথ, না অমরেন্দ্রনাথ, কেহই ছিলেন না; এক রকম করিয়া তিনি উদরপূর্ণ করিলেন মাত্র। আহারাদি শেষ করিয়াই তিনি অতৃপ্তচিত্তে শয়নগৃহে প্রবেশ করিলেন, এবং একটা সুদীর্ঘ চুরুট ধরাইয়া, চেয়ার টানিয়া সার ওয়াল্টার স্কটের “আইভ্যান্ হো” পড়িতে বসিলেন। চুরুটের অর্দ্ধাংশ মাত্র দগ্ধ হইয়াছে, এবং “আইভ্যান্ হো” পাঁচ-সাত পৃষ্ঠামাত্র পড়া হইয়াছে, এমন সময়ে তাঁহার তন্দ্রা বোধ হইল। চুরুট ফেলিয়া, বই মুড়িয়া তিনি শয্যায় গিয়া শয়ন করিলেন এবং অনতিবিলম্বে নিদ্রাভিভূত হইলেন।

শয়ন-গৃহের বাতায়নগুলি উন্মুক্ত ছিল; পুষ্পপরিমলবাহী হইয়া স্নিগ্ধ বায়ু অবাধে গৃহমধ্যে সঞ্চালিত হইতেছিল। বাহিরে নৈশগগন নির্ম্মল—পরিষ্কার—কোথায় একখানিও মেঘ ছিল না। দূরে বনানীর অন্তরালে চন্দ্রোদয় হইতেছিল। এবং বৃক্ষান্তরাল দিয়া চন্দ্রকরলেখা ধরাবক্ষে বিস্তৃত হইয়া পড়িতেছিল। মুক্ত প্রকৃতি স্থির নিস্পন্দ নীরব মন্ত্রমুগ্ধতুল্য। পরিপ্লব চন্দ্রকিরণে বিশ্বজগৎ যেন এক অপূর্ব্ব রহস্যময় বলিয়া বোধ হইতেছিল। নীরবে চন্দ্রদেব কিরণ বর্ষণ করিতেছিলেন; নীরব আকাশ ব্যাপিয়া নক্ষত্ররাজি নির্নিমেষনেত্রে নীরব ধরণীর দিকে নীরবে চাহিয়াছিল; নীরবে বৃক্ষশ্রেণী তাহাতে স্নান করিতেছিল; নীরবে নৈশসমীরণ সেই জ্যোৎস্না-সমুদ্রে সন্তরণ করিতেছিল; নীরবে দূরবর্ত্তী গঙ্গা-প্রবাহে তরঙ্গভঙ্গ হইতেছিল; নীরবে বিকসিত পুষ্পদল হইতে পরিমল বায়ু-প্রবাহে নিঃসৃত হইতেছিল; এবং সেই অনন্ত নীরবতার মধ্যে বিশ্বপৃথিবী যেন একেবারে মগ্ন হইয়া গিয়াছিল।

এমন সময়ে সহসা সেই বিপুল নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করিয়া, শাণিত ছুরিকার ন্যায় কাহার আকুল আৰ্ত্তনাদ চতুৰ্দ্দিক্ প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিল? সেই আর্ত্তনাদে দত্ত সাহেবের নিদ্রাভঙ্গ হইল, এবং তিনি চকিতে উঠিয়া বসিলেন।

কাহার সেই আর্তনাদ আকাশভেদী, অতি তীব্র, এক মুহূর্ত্তে চরাচর যেন স্তম্ভিত হইয়া গেল? দত্ত সাহেবের বোধ হইল, যেন অদূরবর্ত্তী সেলিনাদের বাটী হইতেই সেই শব্দটা আসিল। তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া সেইদিকে ছুটিলেন। মনে মনে বুঝিতে পারিলেন, অবশ্যই একটা কোন ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছে। ঊর্দ্ধশ্বাসে কিছুদূর ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন, পথের এক পার্শ্বে স্তূপীকৃত হইয়া একটা কি পড়িয়া রহিয়াছে। দত্ত সাহেব তন্নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিলেন, একটা মনুষ্য-দেহ নীরব- নিস্পন্দ; দুই হাতে ফিরাইয়া মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন—দেখিয়া তাঁহার শ্বাস রুদ্ধ হইল, বুকের ভিতরে তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল—এবং সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইবার উপক্রম হইল।

কি সৰ্ব্বনাশ! সে মৃতদেহ যে তাঁহারই প্রিয়তম সুরেন্দ্রনাথের। প্রথমে নিজের চক্ষুকে কিছুতেই বিশ্বাস করিতে দত্ত সাহেবের প্রবৃত্তি হইল না। তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। কাঁপিতে কাঁপিতে তিনি সেই শবদেহ বুকে লইয়া বজ্রাহতের ন্যায় সেইখানে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না।

এমন সময়ে দ্রুতপদে সেইদিকে রহিমবক্স ছুটিয়া আসিতে লাগিল। অদূরে নিজের প্রভুকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে! চীৎকার শুনিয়া আমারও ঘুম ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। হুজুরকে ছুটিয়া আসিতে দেখিয়া আমিও হুজুরের পিছনে পিছনে অসিতেছি।”

দত্ত সাহেব নীরবে ভূপতিত সুরেন্দ্রনাথের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিলেন। মুখে কিছুই বলিলেন না। রহিমবক্স নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিয়া ভয়ে দুইপদ পশ্চাতে হটিয়া আসিল। ভীতিবিক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলিল, “কি মুস্কিল! হা আল্লা, একি করিলে!”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “রহিমবক্স, খুন—খুন—আমার সুরেকে কেহ খুন করিয়াছে।”

দত্ত সাহেব এমন বিকৃতস্বরে কথাগুলি বলিলেন যে, সে স্বর তাঁহার নিজের বলিয়া বোধ হইল না।

রহিমবক্স কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “কে এমন দুন—কে এমন শয়তান–”

দত্ত সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন, “জানি না—কেমন করিয়া বলিব, কোন্ পিশাচ আমার এমন সর্ব্বনাশ করিল? রহিমবক্স, তুমি দুইজন সহিসকে ডেকে আন, আর কোচম্যানকে গাড়ী নিয়ে শীঘ্র ডাক্তার বেন্টউডের বাড়ীতে যাইতে বল।”

রহিমবক্স বলিল, “এত রাত্রে ডাক্তার সাহেবের দেখা—”  

বাধা দিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “কোন কথা কহিয়ো না—আমি যা বলি তাই কর—শীঘ্র যাও।”

প্রভুর আদেশ প্রতিপালন করিতে—প্রভুভক্ত রহিমবক্স উঠিতে পড়িতে ছুটিয়া চলিল।

দত্ত সাহেব সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ বক্ষে লইয়া একাকী সেইখানে বসিয়া রহিলেন। এখন আমরা তাহার মনের আবস্থা বর্ণন করিবার চেষ্টা করিব না—বলিতে কি, সে চেষ্টা সফল হইবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই।

যে পথের ধারে সুরেন্দ্রনাথকে বক্ষে লইয়া দত্ত সাহেব বসিয়াছিলেন, সন্ধ্যার পরে সে পথ দিয়া কেহই গমনাগমন করিত না। একন রাত দশটা বাজিয়া গিয়াছে, সেই স্থান একেবারে জনমানবশূন্য। চন্দ্রালোকে যতদূর দৃষ্টি চলে, দত্ত সাহেব নিজের দৃষ্টিশক্তির উপরে সাধ্যমত বলপ্রয়োগ করিয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন, কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না।

কেহ যে সুরেন্দ্রনাথকে এই নির্জ্জন পথিমধ্যে হত্যা করিয়াছে, সে সম্বন্ধে দত্ত সাহেব নিঃসন্দেহ হইলেন। তিনি সুরেন্দ্রনাথের এমন কোন ভাব দেখেন নাই, যাহাতে সুরেন্দ্রনাথ আত্মহত্যা করিয়াছেন বলিয়া তাঁহার মনে এমন একটা ধারণা হইতে পারে। কিন্তু এ হত্যা কে করিল? দেহে অস্ত্রাঘাতের চিহ্নমাত্রও নাই। তবে কি বেন্টউড সুরেন্দ্রনাথের করকোষ্ঠী দেখিয়া যে ভবিষ্যৎ গণনা করিয়াছিলেন, ইহা তাহারই সূত্রপাত? দত্ত মহাশয়ের মনে এইরূপ অনেক প্রশ্নের উদয় হইতে লাগিল।

অনন্তর দত্ত সাহেব অত্যন্ত অধীরচিত্তে ডাক্তার বেন্টউডের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। এখন নিজের মতি স্থির নহে, শীঘ্র যে স্থির হইবে, তেমন কোন সম্ভাবনাও নাই। তাঁহার মনে হইতে লাগিল, এ সময়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধি বেন্টউড সাহেবের সহিত পরামর্শ করিয়া তিনি হত্যাকারীকে ধরিবার নিশ্চয়ই একটা-না-একটা সূত্র বাহির করিতে পারিবেন।

যথাসময়ে বেন্টউড সাহেব আসিয়া দেখা দিলেন। এক নিঃশ্বাসে দত্ত সাহেব তাঁহাকে সমুদয় বৃত্তান্ত বলিলেন। বেন্টউড সাহেব সুরেন্দ্রনাথের দেহ পর্যবেক্ষণ করিয়া কহিলেন, “শেষ হইয়া গিয়াছে। কোন রকমে দেহস্থ রক্ত বিষাক্ত হওয়াই এই মৃত্যুর কারণ।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই সেই বিষ-গুপ্তি দ্বারা কেহ সুরেন্দ্রকে হত্যা করিয়াছে।”

ডাক্তার বেন্টউড বলিলেন, “হ’তে পারে; আপনি কিম্বা আমি সে সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলিতে পারি না। আপনার বিষ-গুপ্তির বিষের গুণ কি প্রকার, তাহা আপনিও জানেন না, আমিও জানি না।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “দেহস্থ রক্ত বিষাক্ত হওয়ায় যদি সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সেই বিষ-গুপ্তিতেই ইহা ঘটিয়াছে। রক্ত বিষাক্ত করিতে পারে, এমন কোন অস্ত্ৰ ত এ গ্রামের মধ্যে আর কখন কাহারও নিকট দেখি নাই। যে সেই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে, নিশ্চয়ই সেই লোক সুরেন্দ্রকে হত্যা করিয়াছে।”

বেন্টউড সাহেব বলিলেন, “কে বিষ-গুপ্তি লইয়াছে, তাহার কোন সন্ধান পাইয়াছেন কি? বিষ-গুপ্তি চুরি সম্বন্ধে আমার উপরেও আপনার একটা সন্দেহ আছে।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “আমার ভুল হইয়াছিল; এখন আমি বুঝিতে পারিতেছি, আমার সে সন্দেহ মিথ্যা।”

বেন্টউড সাহেব মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “এখন আপনার এরূপ বুঝিবার কোন কারণ দেখিতে পাই না। যেরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে আমার উপরে আপনার সেই সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হইবার কথা। সুরেন্দ্রনাথের সহিত আমার কিছুমাত্র সদ্ভাব নাই—নাই বলিতেছি—ছিল না। আপনি বোধ হয় জানেন, মিস্ সেলিনার জন্য আমরা পরস্পর ঘোরতর শত্রু হইয়া উঠিয়াছিলাম; এরূপ স্থলে যে শুনিবে, সে-ই বিশ্বাস করিবে যে, আমিই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছি, এবং আমিই নিজের পথ সুগম করিবার জন্য সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছি।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “আমি তা’ বিশ্বাস করি না; আপনার উপরে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।”

বেন্টউড সাহেব বলিলেন, “তবে কাহাকে আপনি সন্দেহ করিতেছেন?”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “জুলেখার উপরেই আমার সন্দেহ হয়।”

বেন্টউড বলিলেন, “কিসের জন্য জুলেখা এমন একটা ভয়ানক কাজ করিবে?”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “সুরেন্দ্রের উপরে তাহার বড় রাগ; বিশেষতঃ সেলিনা সুরেন্দ্রকে ভালবাসে, এটা তাহার একান্ত অসহ্য হইয়াছিল। সেলিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়, এ ইচ্ছা তাহার ছিল না।”

বেন্টউড সাহেব বলিলেন, “সত্যকথা বলিতে কি, সে ইচ্ছা আমারও ছিল না। যাক্ সে কথা, আপনি ত ইতঃপূৰ্ব্বে সন্ধান লইয়া জানিয়াছেন যে, জুলেখা আপনার বিষ-গুপ্তি চুরি করে নাই। যদি এখনও আপানার সেই সন্দেহ থাকে, তাহা হইলে আপনি আর একবার সেলিনার মার সহিত দেখা করিয়া সন্ধান লইতে পারেন। একজন ডিটেটিভের সাহায্য গ্রহণ করা এখন আপনার বিশেষ প্রয়োজন। অমরেন্দ্রনাথ এখন কলিকাতায় রহিয়াছে, একজন সুদক্ষ ডিটেক্‌টিভের জন্য তাহাকে টেলিগ্রাফ করিলেন না কেন? তাহা হইলে অনেকটা কাজ হইত।”

দত্ত। [সাশ্চর্য্যে] অমরেন্দ্রনাথ যে এখন কলিকাতায়, এ কথা আপনি কিরূপে জানিলেন?

বেন্ট। আজ সন্ধ্যার পরে! সুরেন্দ্রনাথের মুখেই এ কথা শুনিয়াছিলাম।

দত্ত। আজ সন্ধ্যার পরে সুরেন্দ্রনাথ কি আজ আপনার সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল?

বেন্ট। হাঁ, আজ অপরাহ্নে আমার সহিত দেখা করিবার জন্য সুরেন্দ্রনাথকে আমি একখানা পত্র লিখিয়াছিলাম। আশানুল্লা সেই পত্র লইয়া আসে।

দত্ত। হাঁ, সে একবার ঐ সময়ে আসিয়াছিল বটে। কোন্ প্রয়োজনে আপনি সুরেন্দ্রনাথকে আপনার সহিত দেখা করিতে বলিয়াছিলেন?

বেন্ট। তেমন বিশেষ কোন প্রয়োজন ছিল না; মিস্ সেলিনা পীড়িতা। আমার বিশ্বাস, সেলিনার মা সেলিনার এই পীড়ার কারণ। হঠাৎ তিনি সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেলিনার দেখা-সাক্ষাৎ একেবারে বন্ধ করিয়া ভাল কাজ করেন নাই। বিশেষ চিন্তার পরে আমি বুঝিলাম, সুরেন্দ্রনাথ সেলিনার হৃদয়ে যেরূপ সুদৃঢ় আসন স্থাপন করিয়াছে, তাহাতে সেখানে আর কাহারও স্থান হইবে না। আরও বুঝিতে পারিলাম, যদি সেলিনা সুরেন্দ্রনাথের সহিত মিলিতে না পারে, তাহা হইলে সে অধিক দিন বাঁচিবে না; এবং তাহার কোমল হৃদয় একটু আঘাতেই ভাঙিয়া যাইবে। আমি যতই চেষ্টা করি, আমার আশা যে, কখনও সফল হইবে না, এ বিশ্বাস যখন দৃঢ় হইল, তখন আমি অনর্থক কেন অপরের সুখ-সৌভাগ্যের অন্তরায় হই, মনে করিয়া সুরেন্দ্রনাথকে ডাকিয়া আমার মনের কথা সমুদয় খুলিয়া বলিলাম। এবং যেমন করিয়া হউক, একবার পীড়িতা সেলিনার সহিত শীঘ্র দেখা করিবার জন্য তাহাকে অনুরোধ করিলাম। যাক্, এখন আপনি কি করিবেন, স্থির করিয়াছেন?

দত্ত। আপাততঃ পুলিসে সংবাদ দিব, মনে করিতেছি।

বেন্টউড বলিলেন, “যাহাতে একজন সুদক্ষ ডিটেটিভের হাতে এই কেটা পড়ে, সেজন্যও এখন আপনার বিশেষ চেষ্টা করা উচিত।”

এই বলিয়া পকেট হইতে ঘড়ী বাহির করিয়া দেখিয়া, তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “রাত অনেক হইয়াছে, এখন আমি চলিলাম। বলেন যদি আমি পুলিসে সংবাদ দিতে পারি।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে বড় ভালই হয়।”

বেন্টউড কক্ষের বাহির গেলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – খুনের পরদিন

দত্ত সাহেব সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ক্রোড়ে লইয়া সেই ভীষণ রজনী অতিবাহিত করিতে মনস্থ করিলেন।

তখন বাহিরে নিবিড় বৃক্ষশ্রেণী বায়ু-হিল্লোলে নিশ্বঃসিয়া উঠিতেছিল। এবং একটা নিশাচর পক্ষীর করুণ আর্তনাদ এক-একবার গগন বিদীর্ণ করিতেছিল। পরে রাত্রি যত গভীর, নিৰ্জ্জনতা যত সুস্পষ্ট এবং নীরবতা যত নিবিড় হইতে লাগিল, দত্ত সাহেবের ভগ্নহৃদয়ে দুঃসহ শোক সেই সঙ্গে ক্রমশঃ তেমনি গভীর সুস্পষ্ট এবং নিবিড় হইয়া উঠিতে লাগিল।

যতবার তিনি ব্যাকুলনেত্রে তাঁহার প্রাণাধিক সুরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে ভাল করিয়া দেখিতে যান, দরবিগলিত অশ্রুস্রোতঃ তাঁহার দৃষ্টি রুদ্ধ করিয়া দেয়; এবং তিনি দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বালকের ন্যায় রোদন করিতে থাকেন।

প্রভাতে যখন সেই মৃতের কক্ষ ত্যাগ করিয়া দত্ত সাহেব বাহির হইলেন, তখন তাঁহাকে দেখিয়া আর সহজে চিনিতে পারা যায় না; যেন সেই একটা রাত্রির মধ্য দিয়া বৃদ্ধ দত্ত সাহেবের আরও বিশ বৎসর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। তাঁহার কালিমালিপ্ত চক্ষু ভিতরে বসিয়া গিয়াছে, ললাটে রেখার পর রেখা সুস্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে; এবং দেহযষ্টি জরাজীর্ণের ন্যায় একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।

সূর্যোদয়ের অনতিবিলম্বে শোকার্ত অমরেন্দ্রনাথ ফিরিলেন। প্রথমে একটিও কথা তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইল না; ছুটিয়া গিয়া দুই হস্তে মাতুল মহাশয়কে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার দরবিগলিত উষ্ণ অশ্রুধারাপাতে দত্ত সাহেবের শোকদগ্ধ বক্ষঃ প্লাবিত হইতে লাগিল।

দত্ত সাহেব দেখিলেন, অমরেন্দ্রনাথও হৃদয়ে অত্যন্ত আঘাত পাইয়াছেন। অমরেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; আজ সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে সেই শৈশবের ধূলা-খেলার সুমধুর স্মৃতিগুলি বিষাক্ত শরজালের ন্যায় তাঁহার হৃদয় বিদ্ধ করিতেছে। অনেকক্ষণ পরে অমরেন্দ্রনাথ তাঁহার মাতুল মহাশয়ের প্রশ্নের উত্তর করিলেন, “প্রাতে ডাক্তার বেন্টউডের টেলিগ্রাফ পাইয়াই আমি আসিতেছি; আমি এখানে থাকিলে হয়ত সুরেন্‌কে এমন ভাবে আমাদের হারাইতে হইত না!

তীক্ষ্ণস্বরে দত্ত সাহেব কহিলেন, “এখন তুমি মিস্ সেলিনাকে নির্বিঘ্নে বিবাহ করিতে পারিবে।”

অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ভগ্নকন্ঠে অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “না–আপাততঃ কিছুতেই নহে।”

দত্ত সাহেব ক্ষণকালের জন্য স্থিরদৃষ্টিতে অমরেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। হঠাৎ কি মনে করিয়া অমরেন্দ্রনাথের হাত ধরিয়া টানিয়া সুরেন্দ্রনাথের বক্ষের উপরে রাখিলেন। তাহার পর বলিলেন, “প্রতিজ্ঞা কর, বল, যতদিন না তুমি সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীকে ধরিয়া উপযুক্ত প্রতিফল দিবে, ততদিন সেলিনাকে বিবাহ করিবে না?”

অমরেন্দ্রনাথ সেই প্রতিজ্ঞা করিলেন।

সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু-সংবাদে গ্রামের মধ্যে খুব একটা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। যে পথিপার্শ্বে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেইখানে দলে দলে লোক আসিতে লাগিল। তন্মধ্যে যাহাদের সহিত সুরেন্দ্রনাথের বেশী জানাশুনা ছিল, তাহারা দত্ত সাহেবের বাটীতে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ দেখিতে উপস্থিত হইতে লাগিল। সুরেন্দ্রনাথ নিজের সবিনয় নম্র স্বভাব এবং বিমল চরিত্রের জন্য সকলেরই প্রিয়দর্শন ছিলেন, তাঁহার মৃত্যুতে আজ অনেকেই হৃদয়ে একটা দারুণ আঘাত পাইল। শান্তস্বভাব সুরেন্দ্রনাথকে নিদয়রূপে হত্যা করিতে পারে, তাঁহার এমন শত্রু যে কেহ ছিল, এ কথা প্রথমে সহজে কেহ বিশ্বাস করিতে পারিল না; সুতরাং সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে মহা শোকের সহিত একটা মহাবিস্ময় আর সকলেরই হৃদয় একান্ত অভিভূত করিয়া তুলিল।

সহানুভূতি প্রকাশের জন্য নিকটবর্ত্তী প্রতিবেশিগণের অনেকেই শোকমুমূর্ষু দত্ত সাহেবের সহিত দেখা করিতে আসিলে তিনি কাহারও সহিত দেখা করিলেন না। অপরাহ্ণে ডাক্তার বেন্টউড দেখা করিতে আসিলে তিনি তাঁহাকে লইয়া লাইব্রেরী ঘরে বসিলেন। অমরেন্দ্রনাথও সেখানে রহিলেন। কি করিলে হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়ে, সেই সম্বন্ধে তাঁহাদের মধ্যে একটা গভীর পরামর্শ চলিতে লাগিল।

এমন সময়ে সেলিনার মাতার নিকট হইতে এই দুর্ঘটনার সহানুভূতিসূচক একখানি পত্র আসিল। পত্রখানি পড়িয়া দত্ত সাহেব দূরে নিক্ষেপ করিলেন। বলিলেন, “মিসেস্ মার্‌শনই আমার সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর একমাত্র কারণ; তিনি যদি না সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেরূপ কঠিন ব্যবহার করিতেন, তাহা হইলে সুরেন্দ্রনাথকে আজ এরূপভাবে অকালে প্রাণ হারাইতে হইত না।”

মাতুল মহাশয়ের প্রাগুপ্ত মন্তব্যে প্রতিবাদ করিয়া অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তাঁহার অপরাধ কি? এমন একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটিবে, তাহা তিনি অবশ্যই জানিতেন না। এমন কোন কারণ দেখি, না—”

বাধা দিয়া বিরক্তিব্যঞ্জক মস্তকান্দোলন করিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “অনেক কারণ আছে বাপু, অনেক কারণ আছে; যদি তিনি সহসা এমন কঠিনভাবে সেলিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথকে দেখা করিতে মানা না করিতেন, তাহা হইলে কাল ডাক্তার বেন্টউডের সহিত দেখা করিবার জন্য সুরেন্দ্রনাথের আলিপুরে যাইবার আর কোন প্রয়োজন ছিল না; কাল যদি সুরেন্দ্রনাথ বাড়ীর বাহির না হইত, তাহা হইলে কি আমার এমন সর্বনাশ হয়। সেলিনার মা আর সেই জুলেখা এই খুনের ভিতরে নিশ্চয়ই আছে।”

সেইদিন অপরাহ্ণে রহিমবক্স আসিয়া দত্ত সাহেবকে বলিল, “জুলেখা আপনার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে।”

নাসাভ্রূকুঞ্চিত করিয়া উচ্চকণ্ঠে দত্ত সাহেব বলিলেন, “সে ডাকিনীকে এখান থেকে এখনই দূর করে দাও—এখনই দূর করে দাও!”

ডাক্তার বেন্টউড তখন উপস্থিত ছিলেন। তিনি কহিলেন, “কাজটা ঠিক হয় না। যাহাতে সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারী ধরা পড়ে, বোধ হয়, এমন কোন সন্ধান পাইয়া জুলেখা খবর দিতে আসিতে পারে।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “তা’ আমার কাছে কেন? সে পুলিসে যাক্, আমার সঙ্গে দেখা করিয়া কি হইবে? আপনি ভুল বুঝিয়াছেন, সে ডাকিনী এমন বোকা নহে যে, ফাঁসীর দড়িটা টানিয়া নিজের গলায় জড়াইবে।”

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “জুলেখা যে দোষী, এখনও তাহার এমন কোন বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই—”

বাধা দিয়া, টেবিলের উপরে করাঘাতের উপর করাঘাত করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “শীঘ্রই সে প্রমাণ পাওয়া যাইবে; আমি সহজে ছাড়িব না, যেমন করিয়া পারি, ইহার প্রতিশোধ দিব। জুলেখা আর তার মনিব মিসেস্ মার্‌শন যে এই খুনের ভিতরে আছে, ইহা আমার ধ্রুব বিশ্বাস।”

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “প্রমাণ না পাইলে আপাততঃ কোন কাজই হইবে না। সে যা-ই হোক, এখন জুলেখার সঙ্গে আপনি দেখা করিবেন, না, তাহাকে চলিয়া যাইতে বলিব?”

“হাঁ—হাঁ—না—আচ্ছা, তাই যেতে বল, তার সঙ্গে আমি দেখা করিতে চাহি না; – আচ্ছা, এক কাজ কর অমর; আমার সঙ্গে তার কি কথা আছে, তুমি গিয়া তাহা জানিয়া এস। আমি আর তাহার সঙ্গে দেখা করিব না।” এই বলিয়া দত্ত সাহেব বামকরতলে মস্তক রাখিয়া কি চিন্তা করিতে লাগিলেন।

অমরেন্দ্রনাথ চলিয়া গেলেন। ক্ষণপরে আসিয়া কহিলেন, “সেলিনা জুলেখাকে পাঠাইয়াছে। জুলেখা আর কাহারও নিকটে কোন কথা প্রকাশ করিতে চাহে না।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – আলোচনা

এইবার দত্ত সাহেব কি ভাবিয়া জুলেখাকে সেখানে উপস্থিত হইবার অনুমতি দিলেন। ক্ষণপরে জুলেখা রহিমবক্সের সঙ্গে সেই লাইব্রেরী ঘরে প্রবেশ করিল। প্রথমে সে ডাক্তার বেন্টউডকে তাহার মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টিপাতে চাহিতে দেখিয়া অত্যন্ত চকিত হইয়া উঠিল, এবং তাহার হাত পা কাঁপিতে লাগিল। জুলেখা তাড়াতাড়ি সে ভাব সাম্‌লাইয়া দত্ত সাহেবকে বলিল, “আমাদের মিস্ সেলিনা, হুজুর সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করিতে চান্।।”

রুক্ষস্বরে দত্ত সাহেব কহিলেন, “কেন তিনি আমার সঙ্গে দেখা করিতে চাহে—সে সম্বন্ধে তুমি কিছু বলিতে পার?”

জুলেখা কহিল, “না—আমি জানি না, হুজুর! তাঁর বড় ব্যারাম, সারাদিন ধরে কান্নাকাটি করছেন; তাঁর ভাব দেখে আমার বড় ভয় হয়েছে; এ সময়ে হুজুর সাহেব যদি একবার যান, বড় ভাল হয়; হুজুর সাহেবকে দেখার জন্য তাঁর বড় জেদ্ হয়েছে।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “এখন আমি কিছুতেই তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিব না। বাড়ীতে পুলিস আসিয়াছে; এখন আমি বড় গোলযোগে আছি। কাল আমি দেখা করিতে যাইব। তুমি তাঁহাকে এই কথাই বল গিয়া।”

জুলেখা কহিল, “তিনি আজই আপনাকে দেখার জন্য বড় জেদ করছেন।”

মনের অবস্থা ভাল না থাকায়, এবং জুলেখার পীড়াপীড়িতে দত্ত সাহেব বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। রুষ্টভাবে কহিলেন, “যা” বলিলাম, বল গিয়া, এখন আমার বেশী কথা কহিবার সময় নাই। কাল আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব। জুলেখা, আমি সহজে ছাড়িব না, এই খুনের ভিতরে তোমার অপরাধটা কতদূর, সেটা আজ আমি ভাল করিয়া না দেখিয়া অন্য কাজে হাত দিতেছি না।”

জুলেখা কহিল, “আমি কিছু জানি না, হুজুর।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “তুমি সব জান, আমার এখানে যে ‘চালেনা-দেশম’ ছিল, তারও খবর তুমি জান।”

জুলেখা কহিল, “চালেনা-দেশম’ কি, আমি জানি না, হুজুর—আমি কখন দেখি নি।”

দত্ত সাহেব দেখিলেন, চতুরা জুলেখার মুখ হইতে কোন কথা বাহির করিবার কোন উপায় নাই। তখন তিনি তাহাকে বিদায় করিয়া দিলেন। জুলেখার সঙ্গে ডাক্তার বেন্টউডও একবার বাহির হইয়া গেলেন। কিয়ৎপরে ফিরিয়া আসিয়া, বসিয়া এইরূপ অজুহত দেখাইলেন যে, সেলিনার অবস্থা ভাল নহে; যাহাতে এ সময়ে তাহার উত্তম শুশ্রূষা হয়, সেজন্য তিনি জুলেখাকে সতর্ক করিয়া আসিলেন। তাহার পর কহিলেন, “সেলিনার মানসিক অবস্থা এখন বড়ই বিকৃত হইয়া গিয়াছে; তাহার উপরে, এই সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু-সংবাদ সেলিনা শুনিয়াছে। এখন যে সহজে আরোগ্যলাভ হইবে, এমন ত বুঝিতেছি না।”

জড়িতবাক্যে অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তবে কি মিস্ সেলিনা রক্ষা পাইবে না?”

ডাক্তার বেন্টউড বলিলেন, “রক্ষা পাইবে। কিন্তু তাহার কোমল মস্তিষ্ক চিরকালের জন্য বিকৃত হইয়া যাইতে পারে।”

কথাটা শুনিয়া ডাক্তার বেন্টউডের দ্বারা সুরেন্দ্রনাথে সেই করকোষ্ঠী গণনার কথা দত্ত সাহেবের মন পড়িয়া গেল। তিনি সহসা মাথা তুলিয়া একবার তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনার কথা শুনিয়া বড় ভয় হয়—ভবিষ্যতে কি মন্দ ঘটিবে, সেটা গণনা করিবার ক্ষমতা আপনার যথেষ্ট আছে। একদিন আপনি সুরেন্দ্রনাথের সম্বন্ধে যাহা গণনা করিয়াছিলেন, তাহা এখন ঘটিয়াছে। আজ আবার আপনি মিস্ সেলিনার অশুভ-সূচনা করিতেছেন।”

ডাক্তার বেন্টউড কহিলেন, “আপনি ভুল বুঝিয়াছেন। মিস্ সেলিনা সম্বন্ধে এ কথা এখন সহজে সকলেই অনুভব করিতে পারে; সেলিনা পীড়িতা, তাহার উপরে এই আবার একটা শোকের আঘাত পাইল। যেরূপ তাহার কোমল মনোবৃত্তি, তাহাতে এরূপ একটা অনিষ্টপাতের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। মিস্ সেলিনার সম্বন্ধে আমি ভবিষ্যৎ গণনা করিয়া এ কথা বলিতেছি না, তাহার শোচনীয় অবস্থার জন্য আমি এইরূপ একটা আশঙ্কা করিতেছি।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “আর সুরেন্দ্রনাথের সম্বন্ধে আপনি”

বাধা দিয়া ডাক্তার বেন্টউড বলিলেন, “সে স্বতন্ত্র কথা; আমি তাহার হাত দেখিয়া গণনা করিয়া দেখিয়াছিলাম, তাহার অদৃষ্টে জীবমৃত্যু একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।”

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তখন আমরা আপনার এই জীবমৃত্যুর অন্যরূপ অর্থ করিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, মৃগীরোগ, পক্ষাঘাত কিম্বা এই রকমের একটা পীড়া সুরেন্দ্রনাথকে ভোগ করিতে হইবে। এখন সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বুঝিলাম, আপনার গণনা সর্ব্বৈব মিথ্যা।”

ডাক্তার বেন্টউড বলিলেন, “হাঁ, এখন আমিও দেখিতেছি, গণনা ঠিক হয় নাই; কিন্তু বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার, আমার গণনার কখন ভুল হয় না।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “আপনি গণনা করিয়া বলুন দেখি, কে আমার সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারী?”

বেন্ট। এরূপ গণনা আমার ক্ষমতার বহির্ভূত।

দত্ত। বিষ-গুপ্তি কে চুরি করিয়াছে, বলিতে পারেন?

বেন্ট। আপনার এ উভয় প্রশ্নের আমি কিছুতেই উত্তর করিতে পারিব না।

এই বলিয়া বেন্টউড সাহেব টেবিলের উপর হইতে নিজের টুপীটা হাতে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দাঁড়াইয়া বলিলেন, “কোন সুদক্ষ ডিটেক্‌টিভ এ সকল বিষয়ে আপনাকে যথেষ্ট সাহায্য করিতে পারে। আপনি সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীর সন্ধানে একজন নামজাদা ডিটেটিভ নিযুক্ত করুন—অনেক কাজ হইবে।”

“কোন আবশ্যক নাই; সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীকে উচিত মত প্রতিফল দিতে অপর কাহারও কোন সাহায্য আমি চাহি না। এখন যা’ করিতে হয়, অমর আর আমাকে করিতে হইবে। কি বল অমর?” এই বলিয়া দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রনাথের পৃষ্ঠে মৃদুমন্দ করাঘাত করিতে লাগিলেন।

ভ্রূভঙ্গী করিয়া বেন্টউড বলিলেন, “বটে, কিন্তু আপনারা যে কতদূর কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন, তাহা আমি আপাততঃ ভালরকম অনুমান করিতে পারিতেছি না। এ সময়ে একজন পাকা ডিটেক্‌টিভ নিযুক্ত করিলে, তাহার দ্বারা আপনারা অনেক উপকার পাইতেন।”

ঘাড় নাড়িয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “সে আমরা বুঝিব; আমি বড় কাঁচা নহি।”

বেন্টউড মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “তা’ না হইতে পারেন, কিন্তু আপনি ডিটেক্‌টিভ নহেন।”

“আচ্ছা—আচ্ছা—সে আমি ইহার পর বুঝিব,” বলিয়া বিরক্তভাবে দত্ত সাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন। বেন্টউড আর কিছু না বলিয়া, বাহির হইয়া গেলেন।

ক্ষণপরে দত্ত সাহেব মৃদুস্বরে অমরেন্দ্রকে বলিলেন, “ডাক্তার বেন্টউড লোকটা কেমন? কি বোধ হয়?”

অমর। আমার ত বড় ভাল বলিয়া বোধ হয় না।

দত্ত। লোকটার উপরে আমারও কিছু কিছু সন্দেহ হয়। আমার বোধ হয়, বেন্টউড এ খুনের ভিতরে আছেন, হয় তিনি নিজে খুন করিয়াছেন, না হয় যে লোক খুন করিয়াছেন, তাহাকে জানেন।

অমর। না, আমার তা’ মনে হয় না। এমন কোন কারণ দেখি না, যাহাতে ডাক্তার বেন্টউড় সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছেন বলিয়া আমার মনে কিছুমাত্র সন্দেহ হইতে পারে।

দত্ত। সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেলিনার বিবাহে সে একজন প্রতিযোগী।

অমর। তাহা হইলে সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারী বলিয়া আমার উপরেও আপনার সন্দেহ হওয়া উচিত। বেন্টউডের ন্যায় আমিও সুরেন্দ্রনাথের এ বিবাহে প্রতিযোগী ছিলাম।

কথাটা শুনিয়া দত্ত সাহেব শিহরিয়া উঠিলেন। কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “না—ঈশ্বর যেন না করেন, তোমার উপরে আমাকে কখনও এমন সন্দেহ করিতে হয়! কিন্তু অমর, আজ আমাদের বড়ই দুর্দ্দিন; হত্যাকারীকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার জন্য এখন আমাদের প্রাণপণে চেষ্টা করিতে হইবে। এই গভীর রহস্যের তলদেশ পর্য্যন্ত উদ্ঘাটিত করিয়া ফেলিতে হইবে। জুলেখার উপরেই আমার বেশী সন্দেহ হয়। সেই বিষ-গুপ্তি কেমন করিয়া ব্যবহার করিতে হয়, কেমন করিয়া তাহাতে বিষ দিতে হয়, সব সে জানে। বিষ-গুপ্তির বিষও সে তৈয়ার করিতে জানে।”

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “কিন্তু জুলেখা ত স্পষ্ট বলিয়া গেল, সে বিষগুপ্তি কখনও দেখে নাই।”

“মিথ্যাকথা–মিথ্যাকথা—ঘোরতর মিথ্যাকথা! সব জানে সে—ইহার পর তুমি—যাক্, এখন এই পৰ্য্যন্ত। অন্য সময়ে এই কথার মীমাংসা হইবে।” এই বলিয়া দত্ত সাহেব যে কক্ষে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ছিল, উঠিয়া সেই কক্ষের দিকে চলিলেন।

দেখিতে দেখিতে সেদিনকার দিনটাও কাটিয়া গেল। দত্ত সাহেবের মর্ম্মভেদী শোক-সন্তাপের ন্যায় চারিদিক্‌ হইতে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘোরতর হইয়া আসিল। তখনও সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ উদ্যানপার্শ্ববর্ত্তী নিম্নতলস্থ সেই অনতিপ্রশস্ত গৃহের মধ্যে আপাদমস্তক শুভ্রবস্ত্রাবৃত হইয়া একটি ছোট বিছানার উপরে পড়িয়া আছে। একপার্শ্বে একটা বাতী জ্বলিতেছে। সেই অনুজ্জ্বল আলোকে যেন একটা নীরব ভীষণতা সেইখানে খুব সজাগ হইয়া উঠিয়াছে। সে গৃহের মধ্যে কেহ ছিল না কেবল রহিমবক্স। আজ সারারাত জাগিয়া সেখানে পাহারা দিবার ভার তাহারই উপরে অর্পিত হইয়াছে।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – শেষরাত্রে

কল্য পোষ্ট-মর্টেম পরীক্ষা হইবার কথা। স্থানীয় পুলিসের ইনস্পেক্টর গঙ্গারাম বসু, দত্ত সাহেবের বাড়ীতে পাহারা দিবার জন্য একজন কনেষ্টবলকে রাখিয়া গিয়াছেন। কিন্তু সেই কনেষ্টবল প্রভুর মৃতদেহের জন্য এতদূর শ্রমস্বীকার একান্ত অনাবশ্যক বোধে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে-না-হইতে বাহির বাটীর একটা ঘরে ঢালা বিছানার উপরে নিজের দেহ প্রসারিত করিয়া দিল; এবং অনতিবিলম্বে তাহার নাসিকা-গৰ্জ্জন দূরবর্ত্তীস্থান হইতেও পরিশ্রুত হইতে লাগিল।

গঙ্গারামের ইনস্পেক্টর-পদটা কুম্ভকারের স্বর্ণকারের পদপ্রাপ্তির ন্যায় হইলেও তিনি নিজে অতি সাদাসিধে মেজাজের নিরীহ ভদ্রলোক। এমন একটা রহস্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ডের ভিতর হইতে হত্যাকারীকে ধৃত করিবার কোন একটা সূত্র বাহির করা যে, তাঁহার ন্যায় নিরীহ ভদ্রলোকের পক্ষে বড় সহজ কাজ নহে, তাহা তিনি নিজে বুঝিতেন কি না বলিতে পারি না; কিন্তু তাঁহাকে যাঁহারা ভাল রকমে চিনিতেন, তাঁহারা ইহা অতি সহজেই অনুভব করিতে পারিলেন। তবে আমরা ইহা সাহস করিয়া বলিতে পারি যে, খড়-চুরি, গরু-চুরি, এবং ঘটীবাটী-চুরি সংক্রান্ত যে কোন রহস্যের উদ্ভেদ করিতে তাঁহার একটা অনন্যসুলভ নৈপুণ্য ছিল। হঠাৎ আজ একটা এমন নূতন রকমের কেসে তাঁহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল। তিনি বহু চেষ্টা করিয়াও বিষ-গুপ্তিটার তথ্য কিছুতেই হৃদয়ঙ্গম করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সুতরাং সুরেন্দ্রনাথের এই আকস্মিক মৃত্যুটা অত্যন্ত জটিল রহস্যময় বলিয়া তাঁহার অনুভূত হইতে লাগিল। এ রামা শ্যামার খুন নহে—লোকের মতন লোকের খুন, নামজাদা বনিয়াদী ঘরের খুন—এ খুন-রহস্যটা ভেদ করিয়া যদি তিনি এখন হত্যাকারীকে ধরিতে পারেন, তাহা হইলে অচিরে যে তাঁহার নাম মহিমময়, গৌরবময় এবং যশোময় হইয়া চতুৰ্দ্দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িবে, তাহা গঙ্গারাম সহজেই বুঝিতে পারিলেন বটে; কিন্তু দুঃখের বিষয় সারাদিনটা কাটিয়া গেল, তথাপি তিনি হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিবার কোন পন্থাই সহজ করিতে পারিলেন না।

যাহা হউক, এ হেন গঙ্গারামের হাতে, এ হেন মোকদ্দমা পড়ায় আর কাহারও কিছু না হউক, যিনি হত্যাকারী, তিনি যে এ সংবাদ শ্রবণে মনে মনে পরম সন্তুষ্ট ও আহ্লাদিত হইলেন, এবং মনে মনে বিধাতাকে অজস্র ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন, তাহা আমরা শপথ করিয়া বলিতে পারি।

রাত দশটা না বাজিতেই অমরেন্দ্রনাথ নিজের ঘরে গিয়া শয়ন করিয়াছেন। সারাদিন দারুণ উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগের সহিত যুদ্ধ করিয়া করিয়া তিনি ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন; সুতরাং শয়নমাত্রেই তাঁহার নিদ্রাকর্ষণ হইল।

দত্ত সাহেব স্থির করিলেন, লাইব্রেরী ঘরে সে রাত্রিটা অতিবাহিত করিবেন। তাঁহার শোকোদ্বেলিত হৃদয়-সমুদ্র মথিত হইয়া, প্রতিহিংসার ভীষণ বাড়বানল প্রজ্জ্বলিত করিয়া তুলিয়াছিল। এখন তাঁহার চক্ষে নিদ্রা নাই, অশ্রু নাই—তাঁহার সেই নিরশ্রু চক্ষুদ্বয় হইতে যেন একটা অগ্নিময় জ্বলন্ত শিখা সতত বাহির হইতেছে।

রাত যখন একটা, তখন দত্ত সাহেব বাহিরে গিয়া কনেষ্টবলকে জাগাইলেন। তাহার সহিত দুই-একটা কথা কহিয়া, তিনি যে কক্ষে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রহিমবক্স তখনও দ্বারের পার্শ্বে একখানি টুলের উপর জাগিয়া বসিয়া আছে। তাহার পর তিনি ঘরের চারিদিক্কার রুদ্ধ দরজা জানালাগুলির কোনটা ভ্রম ক্রমে অর্গলাবদ্ধ করা হইয়াছে কি না, পরীক্ষা করিয়া নিজের লাইব্রেরী ঘরে ফিরিয়া গেলেন।

প্রথমে দত্ত সাহেব একখানা চেয়ার টানিয়া বসিয়া, একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করিলেন, দুই-একটান টানিয়া চুরুটটা তিনি দূরে ফেলিয়া দিলেন—ভাল লাগিল না। তাহার পর তিনি টেবিলের উপরে মাথা রাখিয়া নিজের সর্ব্বনাশের কথা ভাবিতে লাগিলেন। সেই সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথের কোমল শৈশবের কোমল স্মৃতিগুলি দত্ত সাহেবের হৃদপিণ্ডের প্রজ্জ্বলিত শোকানলে ঘৃতাহুতি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

অনেকক্ষণ ধরিয়া পরিক্রমণ করিলেন। গত রাত্রে নিদ্রা হয় নাই, তাহার পর এই সকল বিপৎপাতে দত্তসাহেবের মন ও শরীর একান্ত অবসন্ন হইয়া আসিয়াছিল; তিনি একখানা চেয়ারে বসিয়া টেবিলের উপরে পা তুলিয়া অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় নিজের অদৃষ্ট চিন্তা করিতে লাগিলেন। সুযোগ পাইয়া নিদ্রাদেবী নিজের কমলকোমলকরপল্লব দিয়া দত্ত সাহেবের উভয় চক্ষুঃ আবৃত করিয়া দিলেন। সেই স্নেহস্পর্শে দত্ত সাহেব অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় অনতিবিলম্বে গভীর নিদ্রাভিভূত হইলেন।

দেয়ালের ঘড়ীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাজিতে লাগিল। ক্রমে রাত্রি গভীর হইল। বাহিরে চারিদিক্ নিস্তব্ধ এবং আকাশ নিবিড় মেঘাচ্ছন্ন। সেই আকাশব্যাপী মেঘের মধ্যে সনাথনক্ষত্রমালা কোথায় ডুবিয়া গিয়াছে। ধরাতল অবধি আকাশতল পর্য্যন্ত গভীরতম হইয়া অন্ধকাররাশি জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে। এক একবার কোন্ বিনিদ্র নিশাচর পক্ষীর কর্কশকণ্ঠ সেই অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া তীব্রবেগে আকাশের অনেক দূর পর্য্যন্ত উঠিতেছে। যে প্রকোষ্ঠে দত্ত সাহেব নিদ্রাভিভূত, সেখানে বাতায়ন-পথে অবিশ্রাম বায়ু-প্রবাহ মৃদুশব্দে ধীরে ধীরে বহিয়া আসিতেছিল, এবং দেয়ালের গায়ে একটা ঘড়ী অবিশ্রাম টিক্ টিক্ শব্দ করিতে ছিল। আর কোন শব্দ ছিল না।

সহসা দত্ত সাহেব চমকিত হইয়া জাগিয়া উঠিলেন। তাঁহার বোধ হইল, রুদ্ধদ্বারে কে যেন মৃদু করাঘাত করিল; জাগিয়াও একবার তিনি সেই করাঘাতের অনুচ্চ শব্দ স্পষ্ট শুনিলেন। ঘড়ীর দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তিনটা বাজিতে বেশি বিলম্ব নাই। এমন সময়ে কে তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে, বুঝিতে পারিলেন না; অতিশয় চিন্তিত হইলেন। বিস্ময়ের সহিত মনে একটা ভয়ের সঞ্চার হইল। টেবিলের ড্রয়ার হইতে একটা রিভল্ভার বাহির করিয়া লইলেন; এবং দক্ষিণ হস্তে সেটা ঠিক করিয়া ধরিয়া, বাম হস্তে দ্বার ধীরে ধীরে উন্মুক্ত করিলেন।

গৃহস্থ রুদ্ধ দীপালোক উন্মুক্ত দ্বারপথ দিয়া বাহিরে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। দত্ত সাহেব সেই অস্পষ্ট আলোকে দেখিলেন, বাহিরের ছায়ান্ধকার মধ্যে এক স্ত্রীমূর্ত্তি দুইবাহু প্রসারিত করিয়া দাঁড়াইয়া। তাহার আপাদমস্তক ঘন ঘন কম্পিত হইতেছে, পশ্চাতে কৃষ্ণতড়াগতুল্য বিসর্পিত কেশতরঙ্গমালা বায়ু-প্রবাহে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, এবং তাহার আকর্ণায়ত চক্ষুদ্বয় হইতে একটা জ্বলন্ত দীপ্তি প্রতিক্ষণে বিকীর্ণ হইতেছে। দত্ত সাহেব প্রথমে চিনিতে পারিলেন না; পরে চিনিলেন—সে সেলিনা।

সেলিনা উন্মাদিনীর ন্যায় গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। দত্ত সাহেব সরিয়া দাঁড়াইলেন। বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি বলিলেন, “একি ব্যাপার! এমন সময়ে সেলিনা, তুমি এখানে? ব্যাপার কি?”

স্থির, ধীর গম্ভীরস্বরে সেলিনা বলিল, “হাঁ, এমন সময়ে—আমি চুপি চুপি লুকাইয়া চলিয়া আসিয়াছি- –কেহ জানে না, মা না, জুলেখা না। সুরেন্দ্রনাথ কোথায়? আমার সুরেন্—”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “তুমি কি শোন নাই, সুরেন্—”

বাধা দিয়া সেলিনা বলিল—সেই স্থির, ধীর গম্ভীরস্বরে বলিল, “মরিয়াছে, জানি—শুনিয়াছি। সুরেন্ মরিয়াছে—এমন সময়ে আমি তাহাকে একবার দেখিব না? দেখিতে পাইব না? যেখানে সুরেন্ আছে, সেখানে আমাকে নিয়ে চল। এখনও বিলম্ব করিতেছ? কে তুমি? কি পাষাণ! তুমি এমন সময়ে আমায় একবার তাহাকে দেখিতে দিবে না?”

সেলিনা এখন উন্মাদিনী, দত্ত সাহেব তাহা বুঝিলেন; বুঝিয়া ভীত হইলেন। সেলিনার সেই শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া বৃদ্ধের স্নেহশিথিল হৃদয় অত্যন্ত কাতর হইয়া উঠিল। তিনি সেলিনাকে লইয়া, যে কক্ষে সুরেন্দ্রনাথের শবদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, সেই কক্ষাভিমুখে চলিলেন।

গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দত্ত সাহেব স্তম্ভিত হইলেন। উচ্চৈঃস্বরে “কি সৰ্ব্বনাশ! কি সৰ্ব্বনাশ!” বলিতে বলিতে তিনি শয্যার দিকে ছুটিয়া গেলেন। তাঁহার সকাতর চীৎকারে নীরব নিদ্রিত সেই প্রকাণ্ড অট্টালিকা প্রকম্পিত এবং প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।

শয্যা শূন্য—মৃতদেহ নাই!

অষ্টম পরিচ্ছেদ – উন্মাদিনী

শোকবিহ্বল, বিস্ময়বিহ্বল, ভীতিবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় দত্ত সাহেব দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া নীরবে কাঁপিতে লাগিলেন। বাতাস লাগিয়া উজ্জ্বল দীপালোকশিখা তেমনি সঘনে কাঁপিতে লাগিল। সেই কম্পিত দীপালোক কম্পান্বিত দত্ত সাহেবের উচ্চচ্ছাদতলস্পর্শী কম্পিত ছায়া দেয়ালের গায়ে দীর্ঘাকৃতি প্রেতের ন্যায় তেমনি নীরবে, কি ভীষণভাবে কাঁপিতে লাগিল; সেই কম্পিত ছায়ালোক মধ্যে নীরবে দাঁড়াইয়া মুক্ত-কুন্তলা শিথিল-বসনা, উদ্বেগচঞ্চলা, উন্মাদিনী সেলিনা। তাহার পদপার্শ্বে রহিমবক্স মুখ গুঁড়াইয়া নীরবে. পড়িয়া। অন্ধকারাচ্ছন্ন উদ্যানপার্শ্বস্থ একটা উন্মুক্ত গবাক্ষদ্বার অবাধবায়ুপ্রবাহে নীরবে আন্দোলিত হইতেছিল। সেই একান্ত নীরবতার মধ্যে যেন কি একটা বিকটদর্শনা বিভীষিকা-রাক্ষসী কক্ষের চারিদিক্ বেড়িয়া দুর্দান্তবেগে তাণ্ডব-নৃত্য করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

সহসা সেলিনা, “কোথায়—কই আমার সুরেন্দ্র কই, কোথায়—” বলিতে বলিতে উন্মত্তবেগে সেখান হইতে ছুটিয়া গিয়া, বিছানার উপরে দুইখানি বাহুলতা ও আলুলায়িত কুন্তলদাম প্রসারিত করিয়া দিয়া লুণ্ঠিতমস্তকে কাতরকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “কই, এখানে ত নাই, সুরেন্দ্র এখানে নাই— কি মিথ্যাকথা! হায় হায়, তবে কি আর আমি তাহাকে এ জন্মে দেখিতে পাইব না! কি হবে আমার! আমি একবার তাহাকে দেখিব না? আমার একবার বলিয়া দাও, কোথায় সুরেন্দ্র আমার!”

এতটা বয়স হইয়াছে, দত্ত সাহেব আর কখনও এমন আত্মহারা হ’ন নাই। সেলিনার কাতর ক্রন্দন নিঃসংজ্ঞ দত্ত সাহেবের হৃদয়ে চেতনার সঞ্চার করিয়া দিল। তিনি তাঁহার ভীতিবিকৃত উদাস দৃষ্টি রোরুদ্যমানা বেপমানা সেলিনার মুখের উপরে স্থাপন করিয়া বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “ঈশ্বর জানেন, সুরেন্দ্রনাথ কোথায়!”

এদিকে এই বিপদ্, তাহার উপরে সেলিনার এই শোচনীয় অবস্থা; এখন যে তিনি কি করিবেন,—কি করিলে ভাল হয়, কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না—মাথার ভিতরে একটা ভয়ানক গোলমাল বাধিয়া গেল। এমন সময়ে সেই কক্ষ মধ্যে সহসা দ্রুতপদে অমরেন্দ্রনাথকে আসিতে দেখিয়া দত্ত সাহেব অনেকটা ভরসা পাইলেন। অমরেন্দ্রনাথের পরিধানে একটা লংক্লথের ঢিলে পাজামা, ও টুইল কাপড়ের কামিজ। তিনি গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া হতস্থিত প্রজ্বলিত বাতীদান সম্মুখে তুলিয়া দেখিলেন, মাতুল মহাশয় একপার্শ্বে অবাঙ্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন; শয্যায় মৃতদেহ নাই—সেখানে সেলিনা ব্যাকুলভাবে লুণ্ঠিত হইতেছে, এবং রহিমবক্স অচেতন অবস্থায় গৃহতলে পড়িয়া আছে। এই সকল দেখিয়া অমরেন্দ্রনাথ অত্যন্ত শঙ্কাকুল ও স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। তিনি জড়িতকণ্ঠে বলিলেন, “সহসা স্ত্রীলোকের আর্তনাদ শুনিয়া আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল! একি ব্যাপার! কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না; ওখানে ও কে—সেলিনা না? সেলিনাই কি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছিল?”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “হাঁ, সেলিনা। কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেলিনা সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ দেখিবার জন্য পলাইয়া আসিয়াছে।

প্রথমে সেলিনা লাইব্রেরী ঘরে যায়, দেখিলাম সুরেন্দ্রর মৃত্যু-সংবাদে সেলিনা একেবারে উন্মাদিনী হইয়া উঠিয়াছে; এমন কি আমাকেও চিনিতে পারে নাই। সুরেন্দ্রের মৃতদেহ দেখাইলে সেলিনা কতকটা প্রকৃতিস্থ হইতে পারে মনে করিয়া, আমি তাহাকেই এখানে লইয়া আসিলাম। কিন্তু কি ব্যাপার দেখ, অমর!” এই বলিয়া দত্ত সাহেব শয্যার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিলেন।

“কি সৰ্ব্বনাশ—মৃতদেহ নাই!” বলিয়া অমরেন্দ্রনাথ শয্যার দিকে ছুটিয়া গেলেন। কাঁদিতে কাঁেিদত উঠিয়া চারিদিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিতে চাহিতে সেলিনা, “নাই—নাই— আমার সুরেন্, নাই! তোমরা কি ভয়ানক লোক! তাহাকে তোমরা লুকাইয়া রাখিয়াছ। সুরেন্ নাই! তাও কি কখন হয়?”

অমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “রহিমবক্সের কি হইয়াছে?”

দত্ত সাহেব অঙ্গুলি নির্দ্দেশে রহিমবক্সকে দেখাইয়া বলিলেন, “ঐ যে, সে পড়িয়া রহিয়াছে। নিদ্রিত কি মৃত কে জানে! হয় ত মরিয়াছে।”

দত্ত সাহেবের শেষ কথাটা সেলিনার কানে গেল। ‘মরিয়াছে।’ শুনিয়া সে আরও ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতে লাগিল, এবং একান্ত ব্যাকুলভাবে দুই হাতে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিল, “মরিয়াছে—সুরেন্—মরিয়াছে—কি ভয়ানক! ওগো, কে আছ—আমার সুরেকে এনে দাও।”

“এখন আর চুপ করিয়া থাকা ঠিক নয়; আমি বাড়ীর সকলকে ডাকিয়া আনি, এখনই অপহৃত মৃতদেহের একটা অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এখন একটা কোন প্রতিকার না করিলে— “এই বলিয়া অমরেন্দ্রনাথ যেমন ছুটিয়া গৃহের বাহির হইতে যাইবেন, প্রত্যুৎপন্নমতি দত্ত সাহেব তাড়াতাড়ি গিয়া, তাঁহার হাত ধরিয়া গৃহমধ্যে টানিয়া আনিলেন। অমরেন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত মাতুল মহাশয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

দত্ত সাহেব কহিলেন, “তাড়াতাড়ি কোন কাজ করা ভাল নয়। আগে আমাদিগকে হতভাগিনী সেলিনার একটা প্রতিকার করিতে হইবে। তুমি এখনই সেলিনাকে বাড়ীতে পৌঁছাইয়া দিয়া এস তোমরা দুইজনে বাহির হইয়া গেলে, আমি ভৃত্যদিগকে জাগাইয়া মৃতদেহ অনুসন্ধানের একটা বন্দোবস্ত করিব। সেলিনা যে এমন সময়ে একা এখানে আসিয়াছে, তাহা কাহারও কর্ণগোচর না হইলেই ভাল হয়। তুমি কি বল?”

“সে বেশ কথা।” বলিয়া অমরেন্দ্রনাথ সেলিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, “সেলিনা, তুমি আমার সঙ্গে এস। এখন তোমার এখানে থাকা কোন মতে উচিত হয় না।”

সেলিনা সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিল, “সুরেন্দ্র কই! একবার আমি তাহাকে দেখিতে পাইব না?”

অমর। সুরেন্দ্রনাথ এখানে নাই। এস সেলিনা, আমি তোমাকে তোমার মার কাছে দিয়া আসি।

উন্মুক্ত কেশজাল অঙ্গুলি সঞ্চালনে আন্দোলিত করিতে করিতে সেলিনা আপন মনে মৃদুস্বরে একবার, বলিল “মা? মা আমার বড় নিষ্ঠুর! সেখানে যাব? না, যাব না।” তাহার পর অমরেন্দ্রনাথের দিকে দুইপদ সবেগে অগ্রসর হইয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চস্বরে কহিল, “চল—চল, আমার এখআনে বড় কষ্ট হইতেছে। আমি এখানে আর থাকিব না—আমাকে বাড়ী নিয়ে চল। সুরেন্দ্র কোথায় গেল? আজ তার সঙ্গে একবার দেখা হইল না!”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “কাল সব শুনিতে পাইবে। এখন তুমি অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাড়ীতে যাও। অমর, তুমি লাইব্রেরী রুম হইতে আমার শালখানা আনিয়া সেলিনাকে গায়ে দিতে দাও।”

অমরেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি একখানি শাল লইয়া আসিল। দত্ত সাহেব সেই শালখানিতে সেলিনার আপাদমস্তক আবৃত করিয়া মুখের অর্দ্ধাবগুণ্ঠন টানিয়া দিলেন। বলিলেন, “বেশ হইয়াছে, পথে যদি কেহ সেলিনাকে দেখিতে পায়, চিনিতে পারিবে না।”

.

দত্তসাহেব তদুভয়কে সঙ্গে লইয়া গৃহের বাহিরে আসিলেন। প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিয়া জানিতে পারিলেন, অল্প অল্প বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে। তিনি বলিলেন, “বেশ হইয়াছে, এখন পথে কেহ নাই; বেশ গোপনে তোমরা যাইতে পারিবে।” এই বলিয়া তিনি একবার মেঘান্ধকারাচ্ছন্ন ভীষণ আকাশের দিকে চাহিলেন। তাঁহার হৃদয়-আকাশও আজ মেঘান্ধকারপূর্ণ হইয়া এমনই ভীষণ হইয়া উঠিয়াছে।

দত্ত সাহেব সম্মুখদ্বার পর্যন্ত অমরেন্দ্র এবং সেলিনার সঙ্গে আসিলেন। দত্ত সাহেব দ্বারসম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অমরেন্দ্রনাথ ও সেলিনা তথা হইতে দুই-চারি পদ অগ্রসর হইতে- না-হইতে বাহিরের অন্ধকারে মিশিয়া গেলেন। দত্ত সাহেব সশব্দে সম্মুখদ্বার অর্গলরুদ্ধ করিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ – অনুসন্ধান

যে গৃহে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, দত্ত সাহেব পুনরায় তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন। এই সকল গোলযোগে একজন দ্বারবানের নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছিল; সে ভয়ে ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে ধীরে ধীরে দত্ত সাহেবের সম্মুখীন হইল। অন্যান্য ভূত্যকে ডাকিয়া আনিবার জন্য দত্ত সাহেব তাহাকে পাঠাইয়া দিলেন। অনতিবিলম্বে সদ্যোনিদ্রোত্থিত চাকর-বাকরের কলরবে, গৃহ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

মিঃ দত্ত উভয় হস্ত ঊর্দ্ধে আন্দোলন করিতে করিতে বলিলেন, “চুপ কর—এ গোলযোগের সময় নয়। এখন কাজ চাই—কথায় কোন কাজ হইবে না। তোমাদের মধ্যে দু’জন রহিমবক্সকে এখান হইতে তাহার ঘরে লইয়া যাও। একজন গিয়া শীঘ্র কোম্যানকে খবর দাও, সে যেন এখনই গাড়ী লইয়া ডাক্তার বেন্টউডকে আনিতে যায়। আসিবার সময়ে ইনস্পেক্টর গঙ্গারামবাবুকে সঙ্গে করিয়া আনে। আর একজন গিয়া এখনই বাহির বাড়ী হইতে সেই কনেষ্টবলটাকে ডাকিয়া আন। আর বাকী সকলে একটা লণ্ঠন লইয়া বাগানের ভিতরে বাহিরে চারিদিক্ সন্ধান করিয়া দেখ।”

ভৃত্যগণ নির্দেশানুসারে যে যাহার কাজে চলিয়া গেল।

অল্পক্ষণ পরে কোটের বোতাম লাগাইতে লাগাইতে কনেষ্টবল আসিয়া হাজির হইল। এবং শূন্যশয্যা দেখিয়া তাহার হৃদয় একেবারে সাহসশূন্য হইয়া পড়িল। সে একান্ত হতবুদ্ধির ন্যায় একবার শূন্যশয্যার দিকে এবং একবার দত্ত সাহেবের গম্ভীরতর মুখের দিকে ঘন ঘন চাহিতে লাগিল।

দত্ত সাহেব তাহাকে বলিলেন, “হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিলে এখন কোন কাজ হইবে না। এই লও—লণ্ঠন, চারিদিকে বেশ করিয়া সন্ধান করিয়া দেখ, কোথায় কোন লোকের যদি কোন পদচিহ্ন দেখিতে পাও।”

কনেষ্টবল তখনই আদেশ পালনে তৎপর হইল। লণ্ঠন লইয়া উদ্যানের চতুৰ্দ্দিক্ বেষ্টন করিয়া ঘুরিতে লাগিল। উজ্জ্বল আলোকে এবং ভীত মনুষ্য-কলরবে সমগ্র উদ্যানভূমি, প্রকাণ্ড অট্টালিকা এবং ঝটিকাসংক্ষুব্ধ ভীষণ রজনী এক মুহূর্ত্তে প্রদীপ্ত এবং সজীব হইয়া উঠিল।

যথা সময়ে ডাক্তার বেন্টউড এবং ইনস্পেক্টর গঙ্গারাম আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গঙ্গারাম, দত্ত সাহেবের মুখে উপস্থিত দারুণ দুর্ঘটনার কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। এবং তাঁহার তরল মস্তিষ্ক একটা তীব্র আন্দোলনে নিরতিশয় চঞ্চল হইয়া উঠিল। অনেকক্ষণ তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। অনেকক্ষণ পরে তাঁহারা সেই কনেষ্টবলকে বহুবিধ প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। তাহার নিকটে কোন সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেল না দেখিয়া, গঙ্গারাম পুনরায় নিজে লন্ঠন লইয়া বাহির হইলেন। প্রথমে উদ্যানমধ্যে, তাহার পর উদ্যানের বাহিরে পাতি পাতি করিয়া সন্ধান করিতে লাগিলেন। চতুদিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। সেই অন্ধকার-সমুদ্রে ডুবিয়া তাঁহার বোধ হইতে লাগিল, লণ্ঠনের আলোক লাগিয়া, তাঁহার চারিদিক্ বেড়িয়া অন্ধকার স্তূপগুলা ভয়ঙ্করী পিশাচীর মত বিকট নৃত্য করিতেছে।

অনেকক্ষণ পরে গঙ্গারাম ফিরিলেন। গঙ্গারামের প্রত্যাগমনে বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া দত্ত সাহেব মনে করিতেছিলেন, যখন ফিরিতে এত বিলম্ব হইতেছে, তখন যে গঙ্গারাম কর্তৃক একটা ভাল রকম সূত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা নিঃসন্দেহ। কিন্তু গঙ্গারামের উপস্থিতির অনতিবিলম্বে দত্ত সাহেবের সে বিশ্বাস তিরোহিত হইল।

গঙ্গারাম কহিলেন, “মৃতদেহ যে জানালা দিয়া বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে, সে সম্বন্ধে আমি একরূপ কৃতনিশ্চয় হইতে পারিয়াছি। পায়ের চাপে জানালার নীচের ছোট ছোট ফুলের গাছগুলির অনেক ডালপালা ভাঙিয়া গিয়াছে, দেখিলাম। আরও যে চার পাঁচটী পায়ের দাগ দেখিতে পাইয়াছি, তাহাতে বোধ হয়, বাগানের ভিতর দিয়া মৃতদেহ চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। যে ভয়ানক অন্ধকার, নতুবা সেই সকল চিহ্ন অনুসরণ করিয়া অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করিতে পারিতাম।”

একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “আজ রাত্রে আর কিছুই হইবে না। বাড়ীর বেহারারা সকলেই অকৃতকার্য্য হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।”

গঙ্গারাম কহিলেন, “যখন মৃতদেহ চুরি যায়, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?”

দত্ত। লাইব্রেরী ঘরে ঘুমাইতেছিলাম। সহসা রাত তিনটার সময়ে ঘুম ভাঙিয়া যায়।

গঙ্গা। বেশ জানেন আপনি—তখন রাত তিনটা?

দত্ত। হাঁ, আমি জাগিয়া উঠিবার পরক্ষণেই দেয়ালের ঘড়ীতে তিনটা বাজিতে শুনিয়াছি। আমার ভুল হয় নাই। মনে কেমন একটা সন্দেহ হওয়ায়, যে ঘরে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ছিল, সেই ঘরে গেলাম; ঘরের ভিতরে গিয়া দেখি, বিছানায় সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ নাই; পাশের একটা জানালা খোলা রহিয়াছে, আর এক পার্শ্বে রহিমবক্স অজ্ঞানাবস্থায় পড়িয়া আছে।

গঙ্গা। আপনি তখন কোন শব্দ শুনিতে পাইয়াছিলেন?

দত্ত। না, কোন শব্দ শুনিতে পাই নাই। তখন বাহিরে যেরূপ প্রবলবেগে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছিল, তাহাতে আর কোন শব্দ না শুনিতে পাইবারই কথা।

গঙ্গারাম নিজের নোটবুকে দত্ত সাহেবের কথাগুলি লিখিয়া লইয়া বলিলেন, “আপনার সেই রহিমবক্সকে এখন কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করা একান্ত আবশ্যক হইতেছে।”

দত্ত। এখনও সে অজ্ঞান অবস্থায় আছে।

গঙ্গারাম, “চলুন—আমি তাহাকে একবার দেখিব,” বলিয়া উঠিলেন। দত্ত সাহেবও তাঁহার সহিত উঠিলেন। ঘরের বাহিরে আসিয়া গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “অমরেন্দ্রনাথ কোথায়?”

দত্ত সাহেবের ইচ্ছা নহে—সেলিনা যে সেখানে আসিয়াছিল, তাহা পুলিসের কানে উঠে। তিনি বলিলেন, “অমরেন্দ্রনাথ মৃতদেহ অপহরণকারীদের সন্ধানে গিয়াছে, এখনও ফিরে নাই।”

গঙ্গা। যখন আপনি প্রথমে জানিতে পারেন যে, সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ অপহৃত হইয়াছে, তখন কি অমরেন্দ্রনাথ আপনারই সঙ্গে ছিলেন?

দত্ত। তখন অমরেন্দ্রনাথ নিজের ঘরে ঘুমাইতেছিল। আমি তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া এই সব ব্যাপার দেখাই। সে তখনই মুহূৰ্ত্তমাত্র অপেক্ষা না করিয়া অপহৃত মৃতদেহের সন্ধানে বাহির হইয়া গিয়াছে।

দশম পরিচ্ছেদ – শুভ লক্ষণ

দত্ত সাহেবের কথায় সন্দেহের কোন কারণ দেখিতে না পাইয়া গঙ্গারাম পরিতুষ্ট হইতে পারিলেন। যাহাই হৌক, তিনি মনে করিয়াছিলেন, রহিমবক্সের মুখে এখন অনেক কাজের কথা শুনিতে পাইবেন, যাহাতে গাঢ়তর রহস্যটা নিতান্ত তরল হইয়া আসিবে। কিন্তু, ফলতঃ তাহার কিছুই ঘটিল না। রহিমবক্সের ঘরে গিয়া দেখিলেন, তখনও সে মূৰ্চ্ছিতাবস্থায় পড়িয়া। ডাক্তার বেন্টউড তখনই তাহার মুর্ছিতদেহ পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। এবং একজন পরিচারিকাকে ডাকিয়া যেরূপ ভাবে রহিমবক্সের সেবা শুশ্রূষা করিতে হইবে, তাহা বলিয়া দিলেন। ডাক্তার বেন্টউড বলিলেন, “তাই ত রহিমবক্সকেও যে খুব জখম করিয়াছে; রহিমবক্স যেরূপ বলবান্, তাহাকে কায়দা করা যে-সে লোকের কাজ নহে।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “আমার বোধ হয়, রহিমবক্স ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল; নতুবা মৃতদেহ অপহরণকারীরা কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিত না। যদি তখন রহিমবক্স জাগিয়া থাকিত, তাহা হইলে সে অপহরণকারীদিগকে জানালা দিয়া গৃহমধ্যে আসিতে দেখিয়া অবশ্যই চীৎকার করিয়া উঠিতে পারিত।”

বেন্ট। আপনি বলিতেছেন, অপহরণকারীরা; অপহরণকারী যে একজন নয়, তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন?

দত্ত। সুরেন্দ্রনাথের ন্যায় একজন সবল যুবকের মৃতদেহ বহন কহিয়া লইয়া যাওয়া একজন মাত্র লোকের কাজ নহে। দুইজন লোক না হইলে কিছুতেই পারিবে না। আমার অনুমান, ইহার ভিতরে তিনজন আছে। সে যা-ই হোক্, ইহার মানে কি? মৃতদেহ চুরি করিয়া কাহার কি লাভ?

গঙ্গা। আমার বোধ হয়, ‘দানা’ পাইয়াছে।

দত্ত। কি ভয়ানক! আপনি এমন কথা বলিবেন না-বিশ্বাস-যোগ্য নহে।

বেন্ট। আমার মতে মৃতদেহ অপহরণও দানো পাওয়ার ন্যায় বিশ্বাসযোগ্য নহে। বিশ্বাসযোগ্য না হইলেও আপাততঃ আমাদের বিশ্বাস করিতে হইতেছে। ভাল কথা, অমরেন্দ্রনাথ কোথায়? এ সময়ে তাহার এখানে উপস্থিত থাকা উচিত ছিল।

দত্ত সাহেব উত্তর করিতে না করিতে সশব্দে কবাট ঠেলিয়া অমরেন্দ্রনাথ ঘরের ভিতরে ঢুকিলেন। বৃষ্টির জলে তাঁহার পরিধেয় একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে; এবং মুখমণ্ডল শ্রমবিবর্ণীকৃত। পাছে সেলিনা সম্বন্ধে কোন কথা প্রকাশ পায়, সেজন্য দত্ত সাহেব তাড়াতাড়ি অমরেন্দ্রনাথকে সতর্ক করিবার জন্য বলিলেন, “অমর, তুমি ঠিক সময়েই আসিয়াছ, এই মাত্র তোমার কথাই হইতেছিল। তুমি এতক্ষণে মৃতদেহের কোন সন্ধানই করিতে পারিলে না?”

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কই—কিছুই না।”

ডাক্তার বেন্টউড বলিলেন, “এই মৃতদেহ অপহরণ সম্বন্ধে—অমরেন্দ্রনাথ, তুমি কি অনুমান কর?”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এ সকল বিষয়ে আমার বড় একটা অনুমান আসে না। এই যে গঙ্গারামবাবু আছেন—এ সব বিষয়ে গঙ্গারাম বাবুরই অনুমান কাজের হইবে।”

গঙ্গারাম বলিলেন, “এখনও আমি কিছু ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই। ব্যাপার দেখিয়া আমাকেও স্তম্ভিত হইতে হইয়াছে।”

বেন্টউড বলিলেন, “স্তম্ভিত হইবার কথা—প্রথমে বিষ-গুপ্তি চুরি তাহার পর খুন—তাহার পর মৃতদেহ চুরি—সকলই যেন একটা দুর্ভেদ্য রহস্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন; একটু ভাল করিয়া সাজাইয়া লিখিতে পারিলে বেশ একখানি চিত্তোত্তেজক উপন্যাসের সৃষ্টি হয়। যা হোক্, আমার নিজের শরীরটা বড় ভাল নাই; আমি এক্ষণে উঠিলাম।”

বেন্টউড আসন ত্যাগ করিয়া দাঁড়াইলেন।

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “রহিমবক্সের কি হইবে? তাহার কি ব্যবস্থা করিলেন?”

বেন্ট। আমি সমুদয় বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিয়াছি। কাল একবার আসিয়া দেখিব। বোধ করি, কাল রহিমের সংজ্ঞালাভ হইবে।

বেন্টউড কক্ষের বাহির হইয়া গেলেন।

বেন্টউড চলিয়া গেলে দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রকে বলিলেন, “যাও, নিজের ঘরে যাইয়া শয়ন কর; তোমাকে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখিতেছি।”

অনিচ্ছাসত্ত্বে অমরেন্দ্রনাথ উঠিয়া গেলেন। তাহার পর অনেকক্ষণ ধরিয়া দত্ত সাহেব ইনস্পেক্টর গঙ্গারামের সঙ্গে অনেক পরামর্শ করিলেন। গঙ্গারাম অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়াও মৃতদেহ বা মৃতদেহ অপহরণকারীদিগকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার কোন উপায়ই স্থির করিতে পারিলেন না। না পারিবারই কথা, কারণ আমরা পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, তিনি নিজে তেমন একজন নিপুণ ডিটেক্‌টিভ নহেন; তা’ ছাড়া, সে সম্বন্ধে তাঁহার সামান্যমাত্র অভিজ্ঞতারও একান্ত অভাব। যাহা হউক, দত্ত সাহেব যখন দেখিলেন যে, গঙ্গারাম হইতে তাঁহার কিছুমাত্র উপকার প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নাই, তখন তিনি তাঁহাকে আর অধিক কষ্ট দেওয়া নিরর্থক মনে করিয়া বিদায় দিলেন। তিনি একান্ত ব্যাকুলভাবে সেই নির্জন প্রকোষ্ঠমধ্যে পরিক্রমণ এবং নিজের উপায় নিজে চিন্তা করিতে লাগিলেন।

আপন মনে দত্ত সাহেব বলিতে লাগিলেন, “কাহারও দ্বারা কোন কাজ হইবে না। যা’ করিতে হয় নিজে করিব। আমি নিজের কেসে নিজেই একবার ডিটেক্‌টিভগিরি করিয়া দেখিব। দেখি, কিছু করিতে পারি কি না। গঙ্গারাম লোকটা কোন কাজের নয়। কেবল অমরের সাহায্য পাইলেই আমার যথেষ্ট হইবে—আর কাহারও সাহায্য প্রয়োজন হইবে না। প্রথমতঃ দেখিতে হইবে, কে বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে; দ্বিতীয়তঃ, কে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিল; তৃতীয়তঃ, মৃতদেহ অপহরণকারীরাই বা কে? তিনটি বিষয়ই বড় শক্ত ব্যাপার—সহজে কিছু হইবে না। এমন একটা সূত্র দেখিতেছি না, যাহাতে আপাততঃ কাজে হাত দিতে পারি। প্রথমে দেখিতে হইবে, সুরেন্দ্রনাথের কেহ শত্রু আছে কি না; যদি কেহ থাকে, তাহা হইলে রহস্যোদ্ভেদে আর বড় বিলম্ব হইবে না। এ রাতটা কাটিয়া যাক্, কাল সকাল হইতে ইহার জন্য আমি প্রাণপণ করিব—দেখি নিজের চেষ্টায় কিছু করিতে পারি না।”

এই বলিয়া দত্ত সাহেব বাহিরের দিক্কার একটি জানালা খুলিয়া দিলেন। দেখিলেন, ঝড়বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছে, আকাশ বেশ পরিষ্কার—একখানিও মেঘ নাই এবং পূর্ব্বদিক্ ঊষার রক্তরাগে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে; এবং সেই অনন্ত বিভীষিকাময়ী রজনীর অবসান হইয়াছে। দেখিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “আমার কার্যারম্ভের ইহা একটা শুভ লক্ষণ বটে। অন্ধকারের পর আলোক, রাত্রির পর দিন, দেখা যাক্—কত দূর হয়। এমনি ভাবে একদিন সহসা আমার হৃদয়ের এ নিবিড় সংশয়-মেঘও কাটিয়া যাইবে।”