দ্বিতীয় । যুবরাজের যুদ্ধযাত্রা
কুরুক্ষেত্র।
এ নাম শুনলে আজও প্রত্যেক হিন্দুর ধমনিতে চঞ্চল হয়ে ওঠে রক্তস্রোত। এ কেবল কুরু-পাণ্ডবের আত্মঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এখানেই প্রথমে পার্থসারথিরূপে ভগবানের অবতার শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র মুখে আত্মপ্রকাশ করেছিল গীতার মহাবাণী। এখানে একদিকে যেমন ভীমার্জুন, কর্ণ, ভীষ্ম ও দ্রোণ প্রভৃতি মহা মহা যোদ্ধারা অপূর্ব বীরত্ব দেখিয়ে অর্জন করেছিলেন অমরত্ব, আর একদিকে তেমনি নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল আর্য-ভারতের সমস্ত ক্ষাত্র-বীর্য। এই শতস্মৃতি-বিজড়িত ভূমির উপরে গিয়ে দাঁড়ালে আজও হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করা যায় শত মৃত পুত্রের শোকে কাতর গান্ধার-কন্যা গান্ধারীর করুণ ক্রন্দন, নিষ্ঠুর সপ্তরথীর দ্বারা আক্রান্ত বালক অভিমন্যুর নিষ্ফল সিংহনাদ, দুঃশাসনের রক্তপান করে তৃতীয় পাণ্ডবের উন্মত্ত তাণ্ডব, রক্তবন্যায় ভাসতে ভাসতে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণীর উনচল্লিশ লক্ষ ছত্রিশ হাজার ছয় শত সৈন্যের চরম মৃত্যুযন্ত্রণা! এই বিরাট নরমেধযজ্ঞের ফল কী? পাণ্ডবদের মৃত্যুর পরে আর্যাবর্তে এমন কোনও ক্ষত্রিয় রইল না, বিদেশি যবনদের বাধা দেওয়ার জন্যে সবল হস্তে যে অস্ত্রধারণ করতে পারে। তাই তারই কিছুকাল পরে উত্তর ভারতের নাট্যশালার মধ্যে প্রবেশ করতে দেখি ইরানি এবং গ্রিক দিগবিজয়ীদের।
ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কুরুক্ষেত্র বা থানেশ্বরের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন প্রভাকরবর্ধন। তখন গুপ্তসাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল বটে, কিন্তু গুপ্তবংশীয় ক্ষুদ্রতর রাজারা তখনও ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত বলে গণ্য হতেন। প্রভাকরবর্ধনের রানি ছিলেন যশোমতী। তিনি গুপ্তবংশজাতা এবং সেইজন্যে তাঁর স্বামী নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করতেন। তাঁদের দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ রাজ্যবর্ধন এবং কনিষ্ঠ হর্ষবর্ধন। রাজশ্রী নামে তাঁদের এক কন্যার নাম ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি ছিলেন কান্যকুব্জের অধিপতি গ্রহবর্মার সহধর্মিণী।
তখন ভারতের প্রত্যেক রাজাই ভাবতেন, বাহুবলে পররাজ্য অধিকার করাই হচ্ছে রাজার বা বীরের ধর্ম! যে রাজা নিজের রাজ্যের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাইতেন, তাঁদের যোগ্যতা সম্বন্ধে জনসাধারণ উচ্চ ধারণা পোষণ করত না। সত্য কথা বলতে কী, আজও পৃথিবী একটুও বদলায়নি। আজও পৃথিবীর যত যুদ্ধবিগ্রহের একমাত্র কারণ হচ্ছে পররাজ্য লোভ।
গুপ্তরাজকন্যা যশোমতীকে বিবাহ করে প্রভাকরবর্ধনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমেই উচ্চতর হয়ে উঠছিল! উত্তরে পাঞ্জাবের কয়েকটি প্রদেশ করতলগত করে, দক্ষিণে মধ্য-ভারতের মালব দেশ পর্যন্ত তিনি নিজের বিজয়-পতাকা বহন করে নিয়ে গেলেন। মালবের গুপ্তবংশীয় রাজা খুব সম্ভব যুদ্ধক্ষেত্রেই জীবন বিসর্জন দিলেন। সেই বংশের দেবগুপ্তকে সামন্তরাজরূপে মালবের সিংহাসনে বসিয়ে প্রভাকরবর্ধন আবার থানেশ্বরে ফিরে এলেন। তখন ভারতে সম্রাট পদবির চলন ছিল না। যাঁরা সাম্রাজ্যের অধিকারী হতেন তাঁরা গ্রহণ করতেন একরাট কিংবা মহারাজাধিরাজ পদবি। প্রভাকরবর্ধন মহারাজাধিরাজরূপে পরিচিত ছিলেন।
৬০৪ খ্রিস্টাব্দ। খবর এল উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের দুর্ধর্ষ হুনরা আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
প্রভাকরবর্ধন যুবরাজকে ডেকে বললেন, ‘রাজ্যবর্ধন, আমি ক্রমেই বৃদ্ধ হয়ে পড়ছি। অদূর-ভবিষ্যতে তুমিই হবে মহারাজা। আমি বর্তমান থাকতেই তোমার উচিত, রাজকার্যে অভ্যস্ত হওয়া। বিজাতীয় হুনরা বিদ্রোহী হয়েছে, তুমি তাদের দমন করতে যেতে পারবে কি?’
তরুণ যুবক রাজ্যবর্ধন নতমস্তকে হাস্যমুখে বললেন, ‘ক্ষত্রিয় আমি, অস্ত্রধারণ করাই আমার কর্তব্য। মহারাজের আদেশ হলেই আমি যুদ্ধযাত্রা করতে পারি।’
প্রভাকরবর্ধন বললেন, ‘উত্তম, বৎস! এবারে হুনদের এমন শিক্ষা দিয়ে আসবে, ভবিষ্যতে তারা যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু স্মরণ রেখো যুবরাজ, এই হুনরা সহজশত্রু নয়। তোমার জননীর পূর্বপুরুষরা এক সময়ে ছিলেন ভারতবর্ষের সম্রাট। কিন্তু দুরাত্মা হুনদের দৌরাত্ম্যেই তাঁদের বিপুল সাম্রাজ্য আজ পরিণত হয়েছে অতীতের স্বপ্নে।’
রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘স্মরণ রাখব মহারাজ।’
পিতার নয়নের মণি। তিনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললেন, ‘পিতা, আমিও কি ক্ষত্রিয় নই? দাদা যাবেন যুদ্ধে, আর আমি বসে থাকব রাজপ্রাসাদে? কেন, আমার কি অস্ত্রশিক্ষা হয়নি।’
প্রভাকরবর্ধন তার মাথার উপরে সস্নেহে হস্তার্পণ করে বললেন, ‘এখনও সময় হয়নি পুত্র! যথাসময়ে তুমিও যুদ্ধযাত্রা করবে বইকি।’
কিন্তু হষবর্ধন বোঝ মানে না।
মহারাজা তখন বাধ্য হয়ে বললেন, ‘বেশ বাছা, তুমিও কিছু সৈন্য নিয়ে যুবরাজের পিছনে পিছনে যাও। যুদ্ধক্ষেত্রের অনতিদূরে পার্বত্য অরণ্যে তুমি মৃগয়ার অনেক সুযোগ পাবে। সেইখানে শিবির স্থাপন কোরো। দরকার হলে যুবরাজ তোমাকে আহ্বান করবেন।’
এ ব্যবস্থা মন্দের ভালো। হর্ষবর্ধন আর কিছু বললেন না।