দ্বিতীয়। ভাগ্যচক্র
সমরখন্দ। তৈমুর এখন আমির কাজগানের সভাসদ।
বিশ্বজয়ী চেঙ্গিজ খাঁর বংশধররা দুর্বল হয়ে পড়তেই আমির কাজগান মাথা তুলে দাঁড়ান; কিন্তু কাজগান বুঝেছিলেন, তাঁর দেহে রাজরক্ত নেই বলে কেউ তাঁকে রাজা বলে মানতে চাইবে না। কাজেই তিনি চেঙ্গিজের এক শান্তশিষ্ট আমোদপ্রিয় বংশধরকে লোক-দেখানো রাজা সাজিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করেন নিজের হাতেই।
তৈমুরের দেহে রাজরক্ত নেই বটে, কিন্তু তিনি বার্লাস গোষ্ঠীর সর্দারের ছেলে। কাজেই আমির কাজগান সাগ্রহে তাঁকে আশ্রয় দিলেন। তৈমুরও নিজের সাহস, বুদ্ধি ও বীরত্বের পরিচয় দিতে দেরি করলেন না। এমনকী দু-একটা ছোটখাটো যুদ্ধও জিতে ফেললেন।
রাজসভায় যেসব তাতারের ‘বীর’ বলে খ্যাতি ছিল, যুদ্ধযাত্রাকে যারা শোভাযাত্রা বলে মনে করত, লোকে তাদের ডাকত ‘বাহাদুর’ নামে। আমির কাজগান লক্ষ করলেন, তৈমুর বয়সে তরুণ বটে, কিন্তু বাহাদুরদের দলে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তির সীমা নেই। তিনি বুঝলেন, তৈমুর হচ্ছেন অসাধারণ যুবক, তাঁর ভবিষ্যৎ সমুজ্জ্বল।
কিছুদিন যেতে না যেতেই তৈমুর আমিরের সামনে গিয়ে আবেদন জানালেন, ‘আমি বার্লাস গোষ্ঠীর সর্দারের পদ প্রার্থনা করি।’
আমির কাজগান তৈমুরের এই ব্যস্ততা পছন্দ করলেন না; বললেন, ‘অপেক্ষা করো। যথাসময়েই তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।’
আরও কিছুদিন যায়। আমিরের এক পরমাসুন্দরী দৌহিত্রী ছিলেন, নাম তাঁর আলজাই খাতুন আগা। তিনি এক রাজার মেয়ে।
আমির বললেন, ‘আলজাই হবে তৈমুরের বউ।’
তৈমুরও তাঁকে দেখেছিলেন, কারণ সে সময়ে তাতার মুসলমানদের মেয়েরা পরদার আড়ালে বাস করতেন না। তীর্থযাত্রায় ঘোড়ায় চড়ে তাঁরা হতেন পুরুষদের সঙ্গিনী। তাতার নারীরা জানতেন, দিগবিজয়ীদের বংশে তাঁদের জন্ম—বন্ধুর পথের সমস্ত বিপদ অগ্রাহ্য করবার শক্তি তাঁদের আছে।
আলজাইয়ের বয়স পনেরো বৎসর। ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, নতুন চাঁদের মতন ছিল তাঁর রূপ আর তাঁর দেহ ছিল তরুণ লতার মতন!
তৈমুরের সঙ্গে আলজাইয়ের বিবাহ হয়ে গেল; এবং এই বিবাহের ফলে তৈমুরের সম্মান যে বেড়ে উঠল, সে কথা বলা বাহুল্য। তিনি রাজকন্যার স্বামী ও শক্তিমান কাজগানের নাতজামাই!
বউ নিয়ে তৈমুর মহাসমারোহে সবুজ শহরে ফিরে এলেন। ভালো ভালো দামি জিনিস দিয়ে সাজালেন নিজের মস্ত বাড়ি। কুড়ি থেকে চব্বিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত তৈমুরের জীবন কেটে গেল সুখস্বপ্নের মতন। তাঁদের একটি ছেলেও হল, তৈমুর তার নাম রাখলেন জাহাঙ্গির।
তৈমুর এখন একজন ছোটখাটো সেনাপতি, তাঁর হুকুম মানে এক হাজার সৈন্য। সমরখন্দের পশ্চিমে মরুভূমিতে গিয়ে তৈমুর নতুন নতুন যুদ্ধ জয় করলেন। সমরখন্দের দক্ষিণে পাহাড়ের পর পাহাড়ের উপত্যকা এবং সেখানে আছে বিখ্যাত হিরাট শহর। হিরাটের মালিক ছিলেন কাজগানের শত্রু। তৈমুর সেখানে গিয়ে লড়াই করে হিরাটের মালিককে বন্দি করে আনলেন।
কিন্তু তৈমুরের সৌভাগ্য-সূর্য যখন ঊর্ধ্বমুখে, তখন ঘটল এক দুর্ঘটনা।
একদিন আমির কাজগান শিকার করতে গিয়ে আর ফিরে এলেন না। দুই জন বিদ্রোহী সর্দার ধনুকের তির ছুড়ে তাঁকে হত্যা করলে।
খবর পেয়ে তৈমুর ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন। প্রথমে আমিরের সমাধির ব্যবস্থা করলেন, তারপর আবার দলবল নিয়ে ছুটলেন হত্যাকারীদের পিছনে।
হত্যাকারী সরদাররা প্রাণের ভয়ে আমু নদী পার হয়ে দুর্গম পাহাড়ে গিয়ে উঠল; কিন্তু সেখানে গিয়েও নিস্তার নেই—তৈমুরের কঠোর প্রতিজ্ঞা, হত্যাকারীদের হত্যা না করে তিনি আর দেশে ফিরবেন না। এ পাহাড়ে, ও পাহাড়ে—তারা যায় যেখানে, তৈমুরও হাজির হন সেখানে, ছায়া যেন অনুসরণ করছে পলাতক কায়াকে! তারপর চারিধার থেকে তাদের পালাবার পথ বন্ধ করে তৈমুর গিয়ে দাঁড়ালেন দুই হত্যাকারীর সম্মুখে। বিদ্যুতের মতন জ্বলে শূন্যে উঠল নিষ্ঠুর তরবারি,—ধুলায় পড়ে গড়িয়ে গেল দুই সর্দারের মুণ্ড।
প্রতিশোধ নিয়ে তৈমুর দেশে ফিরে এসে দেখলেন, রাজ্যের হালচাল সব বদলে গিয়েছে।
মধ্য এশিয়ার কোনও রাজা মারা পড়লে তাঁর ছেলে সিংহাসন দখল করতে পারেন—যদি তিনি সক্ষম হন! নইলে রাজ্যের বড় বড় সর্দাররা এক হয়ে পরামর্শ করে নতুন রাজা নির্বাচন করেন, কিংবা সিংহাসন নিয়ে হয় ঘরোয়া যুদ্ধের অবতারণা। ওখানকার প্রবাদই হচ্ছে ‘তরবারি ধারণের শক্তি আছে যে হাতের, কেবল সেই হাতই ধারণ করতে পারে রাজদণ্ড!’
আমির কাজগানের ছেলে রাজদণ্ড ধারণের চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু চারিদিকে বিপদের মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে দেখে হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হলেন। তখন দিগবিদিক থেকে তাতারদের মধ্যে প্রধান হওয়ার জন্য যাঁরা এগিয়ে এলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তৈমুরের খুড়ো হাজি বার্লাস। অন্যান্য সামন্ত রাজা বা সর্দারেরা নিজের নিজের কেল্লায় ফিরে গিয়ে স্ব-সম্পত্তি রক্ষা ও পরস্বাপহরণের জন্যে সৈন্য সংগ্রহ করতে লাগলেন।
ঠিক এই সময়ে তৈমুরের সন্ন্যাসী পিতার মৃত্যু হল।
ওদিকে উত্তর দিকের পর্বতমালার পরপার থেকে মহান খাঁয়ের টনক নড়ল। চেঙ্গিজ খাঁর বংশধরদের মধ্যে যাঁরা সম্রাটের মতন সম্মান লাভ করতেন, ‘মহান খাঁ’ বলে ডাকা হত তাঁদেরই। সমরখন্দ প্রভৃতি স্থানে যাঁরা শাসন করতেন, তাঁরা নিজের নিজের এলাকায় যতটাই স্বাধীনতা প্রকাশ করুন, আসলে তাঁদের সকলকার মাথার উপরে থাকতেন ওই মহান খাঁ।
একদিন খবর পাওয়া গেল, মহান খাঁ সদলবলে আসছেন সমরখন্দের দিকে। বহু বৎসর আগে এ অঞ্চলে রাজবিদ্রোহ হয়েছিল, সে কথা হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেছে; এবং সেই ওজর তুলে তিনি পেয়েছেন আজ রুদ্রমূর্তি ধারণ করবার সুযোগ।
শুনেই যত তাতার আমিরদের পিলে দস্তুরমতন চমকে গেল। তাঁরা তাড়াতাড়ি নানান রকম দামি দামি উপঢৌকন পাঠিয়ে মহান খাঁয়ের মন রাখবার চেষ্টা করলেন।
হাজি বার্লাস প্রথমে খাঁয়ের সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলেন; কিন্তু তারপরেই তাঁর সাহস গেল উবে! তিনি তৈমুরকে ডেকে বললেন, ‘চলো, আমরা হিরাটের দিকে সরে পড়ি।’
কিন্তু তৈমুর বললেন, ‘আপনি যেখানে ইচ্ছে যান, আমি খাঁয়ের সঙ্গে দেখা করব।’
তৈমুর বুঝেছিলেন, জাট মোগলের সর্বেসর্বা এই খাঁ কেবল তাঁর পূর্ব দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যে এদিকে আসছেন না, তাঁর মনে প্রাপ্তির আশাও আছে বিলক্ষণ। তিনি আরও বুঝলেন যে, কয়েক শত অনুচর নিয়ে বারো হাজার জাট মোগলকে বাধা দিতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব তৈমুর স্থির করলেন, তিনি বাজি মাৎ করবেন কূট চালে।
নিজের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি—অর্থাৎ ভালো ভালো ঘোড়া, সোনা-রুপো ও হিরা-মুক্তো নিয়ে জাট মোগলদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
মোগলদের অগ্রদূত রূপে প্রথমে সসৈন্যে এল তিনজন সেনানী। তারা তৈমুরের শ্বেতপ্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই তৈমুর সাদরে তাদের অভ্যর্থনা করলেন। তারপর তাদের জন্যে হল ভোজের বিপুল আয়োজন। ভোজের পরে প্রচুর উপঢৌকন পেয়ে সেনানীরা পরম পরিতুষ্ট হল।
তারপর তৈমুর চললেন আসল খাঁয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর নাম তোগলক।
তৈমুর তোগলকের সামনে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে, যথারীতি অভিবাদন করে বললেন, ‘হে মহান খাঁ, হে আমার পিতা, আমি হচ্ছি বার্লাস গোষ্ঠীর সর্দার, সবুজ শহরে আমার বসতি।’
তৈমুরের নির্ভীক ও বীরোচিত মূর্তি দেখে তোগলক বিস্মিত হলেন। তারপর দামি দামি ভেট পেয়ে তাঁর মেজাজ এমন নরম হয়ে গেল যে, তৈমুর সত্যসত্যই বার্লাস গোষ্ঠীর সর্দার কিনা, সে সম্বন্ধে কোনও খোঁজ নেওয়া তিনি দরকার মনে করলেন না।
তৈমুর মনে মনে হেসে বললেন, ‘হুজুরের জন্যে আমি আরও অনেক ভালো উপহার আনতে পারতুম, কিন্তু তিনটে কুকুর সেসব জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।’
তোগলক খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘কে তারা?’
তৈমুর বললেন, ‘পিতা, তারা হচ্ছে আপনারই তিনজন সেনানী।’
তোগলক বললেন, ‘হ্যাঁ, তারা কুকুরই বটে; কিন্তু তারা হচ্ছে আমারই কুকুর আর তাদের লোভ হচ্ছে আমার চোখের বালির মতন!’
তিনি তখনই সেনানীদের কাছ থেকে সমস্ত ধনরত্ন কেড়ে আনবার হুকুম দিলেন।
কিন্তু যা হস্তগত করেছে তা হাতছাড়া করতে রাজি না হয়ে সেনানীরা পালিয়ে গেল এবং নতুন ফৌজ গঠন করে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করল।
তোগলক বললেন, ‘তৈমুর, এখন উপায়?’
তৈমুর বললেন, ‘পিতা, নিজের দেশে ফিরে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করুন।’
তোগলক তাই করলেন এবং যাবার সময়ে তৈমুরকে দশ হাজার সৈন্যের সেনাপতি করে দিয়ে গেলেন। পূর্ববর্তী মোগল যুগে পূর্বপুরুষরা এই সম্মানেরই অধিকারী ছিলেন।
ওদিকে ভাইপোর চালাকির কথা শুনে খুড়ো হাজি বার্লাস হলেন চটে আগুন! তৈমুর ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চায়! স্নেহময় খুড়ো অন্যান্য সর্দারদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করলেন, তৈমুরকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এনে হত্যা করতে হবে।
কিন্তু ষড়যন্ত্র সফল হল না, বুদ্ধিমান তৈমুর ফাঁদে পা দিলেন না। হাজি বার্লাস তখন সদলবলে তৈমুরকে আক্রমণ করবার জন্যে সবুজ শহরে এসে হাজির হলেন। তৈমুরের অধিকাংশ সঙ্গীও হাজি বার্লাসের দলে যোগদান করল। তৈমুর তখন নাচার হয়ে তাঁর স্ত্রীর ভাই কাবুলের আমির হুসেনের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠালেন।
আমির হুসেন ভগ্নীপতিকে সাহায্য করবার জন্যে আফগানি সৈন্যদের নিয়ে ছুটে এলেন। আট-নয় বৎসর এইভাবে কেটে গেল। তারপর আবার হঠাৎ একদিন এই ঘরোয়া যুদ্ধের মাঝখানে হল তোগলকের পুনরাবির্ভাব। হাজি বার্লাস দক্ষিণদিকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ হারালেন ডাকাতের হাতে। আমির হুসেন তোগলককে বাধা দিতে গেলেন, কিন্তু তিনিও যুদ্ধে হেরে পলায়ন করলেন।
তৈমুর কিন্তু মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেন না। তোগলক খুশি হয়ে তাঁকে সমরখন্দের সর্দার করে দিয়ে গেলেন।
কিন্তু তৈমুর খুশি হতে পারলেন না, কারণ তাঁর মাথার উপরে প্রধান হয়ে রইলেন তোগলকের পুত্র ও সেনাপতি বিকিজুক।
উপায়ান্তর নেই দেখে তৈমুর তখনকার মতন মনের রাগ মনেই চেপে রইলেন বটে, কিন্তু কিছুকাল পরে যখন দেখলেন সেনাপতি বিকিজুক সমস্ত সমরখন্দ লুণ্ঠন করছেন, মেয়েদের ধরে বাঁদি করে জাট মোগলদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, এমনকী পূজনীয় সৈয়দদেরও বন্দি করতে ছাড়ছেন না, তখন তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না, জাট মোগলদের বিরুদ্ধে উত্তোলন করলেন বিদ্রোহের পতাকা।
তোগলক হুকুম পাঠালেন—’তৈমুরকে বধ করো!’
ঘোড়ায় চড়ে দেশ ছেড়ে তৈমুর চললেন মরুভূমির দিকে।