দ্বাদশ পরিচ্ছেদ । রাজার ঘোড়ার সওয়ার
কিন্তু আনন্দের এই মাহেন্দ্রক্ষণে ভারতবন্ধু সুবন্ধুকে কেউ দেখতে পেলে না। রক্তসিক্ত কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর পার হয়ে তার অশ্ব বায়ুবেগে ছুটে চলেছে এক অরণ্য-পথ দিয়ে।
এবং তার খানিক আগে আগে তেমনি বেগে ঘোড়া ছুটিয়েছে আর একজন সওয়ার! দেখলেই বোঝা যায়, সে সুবন্ধুর নাগালের বাইরে যেতে চায়!
কিন্তু সুবন্ধুর ঘোড়া বেশি তেজিয়ান—এ-যে সেই রাজার ঘোড়া! প্রতিমুহূর্তেই সে অগ্রবর্তীর বেশি কাছে এগিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ সুবন্ধু তার ভল্ল তুললে। লক্ষ্য স্থির করে অস্ত্র ত্যাগ করলে এবং সেই তীক্ষ্ণধারার ভল্ল প্রবেশ করলে অগ্রবর্তী অশ্বের উদরদেশে।
আরোহীকে নিয়ে অশ্ব হল ভূতলশায়ী। অশ্ব আর উঠল না, কিন্তু আরোহী গাত্রোত্থান করে দেখলে ঠিক তার সমুখেই ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ মেরে নেমে পড়ল সুবন্ধু!
অশ্বহীন আরোহী বললে, ‘যুদ্ধে আমরা পরাজিত। আমি পলাতক। তবু তুমি আমার অনুসরণ করছ কেন?’
সুবন্ধু হা-হা রবে অট্টহাসি হেসে বললে, ‘আমি তোমার অনুসরণ করছি কেন? শশীগুপ্ত, সে কথা কি তুমি বুঝতে পারছ না?’
‘না।’
‘আলেকজান্ডারকে তুমিই যে ভারতে পথ দেখিয়ে এনেছিলে এটা তুমি অস্বীকার করবে না তো?’
‘আমি ছিলুম গ্রিক সম্রাটের সেনাপতি। প্রভুর আদেশ পালন করতে আমি বাধ্য।’
‘প্রভুর আদেশে তাহলে তুমি মাতৃহত্যা করতে পারো?’
শশীগুপ্ত জবাব দিলেন না।
‘মহারাজা চন্দ্রগুপ্ত চান গ্রিক-শৃঙ্খল থেকে ভারতকে মুক্ত করতে। পাছে মহারাজা পুরুর সাহায্য পেয়ে তিনি অজেয় হয়ে ওঠেন, সেই ভয়ে তুমি গ্রিস সেনাপতিকে নিয়ে আবার স্বদেশের বিরুদ্ধে তরবারি তুলেছিলে।’
‘আমি—’
‘চুপ করো। আগে আমাকে শেষ করতে দাও। যুদ্ধে আজ মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের জয় হয়েছে। তোমাদের পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মধ্যে পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য শুয়ে আছে কুরুক্ষেত্রে রক্তশয্যায়। তাই তুমি আবার ফিরে চলেছ নিজের মুল্লুকে। তুমি আবার সৈন্য সংগ্রহ করে আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তনের জন্যে অপেক্ষা করতে চাও। কেমন, এই তো?’
শশীগুপ্ত ঘৃণাভরে বললেন, ‘একজন সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে আমি কথা কাটাকাটি করতে চাই না। পথ ছাড়ো।’
‘পথ ছাড়ব বলে তোমার পথ আগলাইনি। তুমিই হচ্ছ ভারতের প্রধান শত্রু। তোমাকে আজ আমি বধ করব।’
‘তুমি আমাকে হত্যা করবে! জানো, আমি সশস্ত্র?’
‘আমি হত্যাকারী নই, সম্মুখ-যুদ্ধে আমি তোমাকে বধ করব! অস্ত্র ধরো, এই আমি তোমাকে আক্রমণ করলুম।’
মুক্ত তরবারি তুলে সুবন্ধু বাঘের মতো শশীগুপ্তের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নিজের তরবারি তুলে বাধা দিয়ে শশীগুপ্ত এমন ক্ষিপ্রহস্তে তরবারি খেলিয়ে তাকে প্রতিআক্রমণ করলেন যে, সুবন্ধুর বুঝতে বিলম্ব হল না, তাকে লড়তে হবে এক পাকা খেলোয়াড়ের সঙ্গে। সে অধিকতর সাবধান হল।
মিনিট পাঁচেক ধরে দুই তরবারির ঝঞ্ঝনা-সংগীতে বনপথ ধ্বনিত হতে লাগল। শশীগুপ্তের হস্ত ছিল সমধিক কৌশলী, কিন্তু সুবন্ধুর পক্ষে ছিল নবীন যৌবনের ক্ষিপ্রতা।
যুদ্ধের শেষ ফল কী হত বলা যায় না, কিন্তু এমন সময় হঠাৎ এক অদ্ভুত অঘটন ঘটল।
একবার সুবন্ধুর আকস্মিক আক্রমণ এড়াবার জন্য শশীগুপ্ত এক লাফ পিছিয়ে তাঁর ভূপতিত ঘোড়ার দেহের উপরে গিয়ে পড়লেন।
ঘোড়াটা মরেনি, তখনও মৃত্যুযন্ত্রণায় প্রবল বেগে চার পা ছুড়ে বিষম ছটফট করছিল। তার এক পদাঘাতে শশীগুপ্তের দেহ হল পপাতধরণীতলে এবং আর এক প্রচণ্ড পদাঘাতে তাঁর দেহ ছিটকে গিয়ে পড়ল ছয়-সাত হাত তফাতে।
সুবন্ধু হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু শশীগুপ্তের দেহ নিস্পন্দ হয়ে সমানে পড়ে রইল দেখে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
সবিস্ময়ে স্তম্ভিত নেত্রে প্রায়-অন্ধকারে মুখ নামিয়ে দেখলে, অশ্বের পদাঘাতে শশীগুপ্তের খুলি ফেটে হু-হু করে রক্ত বেরুচ্ছে, সে কলঙ্কিত দেহে প্রাণের কোনও চিহ্নই বর্তমান নেই।
অল্পক্ষণ শশীগুপ্তের মৃতদেহের দিকে নীরবে তাকিয়ে থেকে সুবন্ধু ধীরে ধীরে বললে, ‘শশীগুপ্ত, তোমার আত্মা যদি এখানে হাজির থাকে তাহলে শুনে রাখো তুমি দেশদ্রোহী কাপুরুষ! তোমার অদৃষ্টে বীরের মৃত্যু লেখা নেই! মানুষ হয়েও তুমি পশুজীবন যাপন করতে, তাই মরলেও আজ পশুর পদাঘাতে আর আজ রাত্রে তোমার দেহেরও সৎকার করবে বনের হিংস্র পশুরা এসে! চমৎকার!’
অরণ্যের সান্ধ্য অন্ধকার ভেদ করে বহুদূর থেকে ভেসে এল মৌর্য শিবিরের উৎসব কোলাহল! সেই উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্যে সুবন্ধু তাড়াতাড়ি রাজার ঘোড়ার পিঠের উপরে চড়ে বসল।