দ্বাদশ পরিচ্ছেদ । পানামার যুদ্ধ
১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই আগস্ট তারিখে কাপ্তেন মর্গ্যান চাগ্রে দুর্গ ছেড়ে পানামা নগরের দিকে অগ্রসর হল সদলবলে।
যাত্রা শুরু হল জলপথে, নদীতে নৌকোয় চড়ে। যতই অগ্রসর হয়, দেখে নদীর দুই নির্জন তীর মরু-শ্মশানের মতো হা হা করছে, শস্যখেতে কৃষক নেই, গ্রামে বাসিন্দা নেই, পথে কুকুর-বিড়াল নেই, কোথাও জীবনের এতটুকু চিহ্ন পর্যন্ত নেই! স্পানিয়ার্ডরা সবাই পালিয়েছে তাদের ভয়ে এবং সঙ্গে করে নিয়ে গেছে জীবনের যত কিছু আনন্দ!
প্রথম থেকেই ঘটল খাদ্যাভাব। মর্গ্যান সঙ্গে বেশি খাবার নিয়ে ভারগ্রস্ত হতে চায়নি, ভেবেছিল পথে লোকালয়ে নেমে তরোয়াল উঁচিয়ে বিনামূল্যে প্রচুর খাদ্য আদায় করবে। তার সে আশায় ছাই পড়ল। মানুষ নেই, খাবারও নেই। শূন্য উদরের অভাব ভোলবার জন্যে বোম্বেটেরা তামাকের পাইপ মুখে দিয়ে অন্যমনস্ক হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
তারপর জলপথে নৌকোও হল অচল। বৃষ্টির অভাবে নদী ক্রমেই শুকিয়ে আসছে। নৌকো ছেড়ে বোম্বেটেরা ডাঙায় নামল। চলতে চলতে তারা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগল, শত্রুরা তাদের আক্রমণ করতে আসুক! কারণ শত্রুরা এলে খাবারও তাদের সঙ্গে আসবে এবং শত্রু মেরে তারা সেই খাবারে ভাগ বসাতে পারবে!
আজ যাত্রার চতুর্থ দিবস। আজ শত্রুদের বদলে তাদের পরিত্যক্ত একটা ছাউনি পাওয়া গেল, তার ভিতরে পড়ে ছিল অনেকগুলো চামড়ার ব্যাগ, হয়তো ভুলে ফেলে গেছে! ক্ষুধার্ত বোম্বেটেরা পরম আনন্দে সেই শুকনো চামড়ার ব্যাগগুলো নিয়েই কাড়াকাড়ি করতে লাগল—গরম জলে সিদ্ধ ও নরম করে সেই ব্যাগের চামড়াই খেয়ে আজ তারা পেটের জ্বালা নিবারণ করবে!
পঞ্চম দিনে তারা আর এক জায়গায় এসে স্পানিয়ার্ডদের আর একটা পরিত্যক্ত ছাউনি আবিষ্কার করলে। কিন্তু হায় রে, একটা চামড়ার ব্যাগ পর্যন্ত এখানে পাওয়া গেল না! কী দুর্ভাগ্য! এ হতচ্ছাড়া দেশে কি একটা জ্যান্ত কুকুর বা বিড়াল পর্যন্ত ল্যাজ নাড়ে না? নিদেন দু-চারটে ইঁদুর?
লোকে গালাগালিতে জুতো খেতে বলে। তারাও হয়তো জুতো খেতে রাজি ছিল—ব্যাগ আর জুতোর চামড়ায় তফাতটা কী? কিন্তু জুতোগুলোও খেয়ে ফেললে খালি পায়ে এইসব কাঁটাভরা জঙ্গল আর কাঁকরভরা উঁচুনীচু পথ দিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ পার হয়ে ধনরত্ন লুটতে যাবে কেমন করে?
তারা বাংলাদেশের সেপাই হলে জুতোগুলো এত সহজে রেহাই পেত না। বাংলায় খালিপায়ে কাঁকর বেঁধে না, কাঁটা ফোটে না!
অনেকে বোধ করি অবাক হচ্ছেন? কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কী আছে? পেটের জ্বালা কেমন, দুর্ভিক্ষের দেশ তা জানে। পেটের জ্বালায় মানুষ মানুষের মাংসও বাদ দেয় না। ইতালির এক কারারুদ্ধ কাউন্ট নাকি খিদের চোটে নিজের ছেলের মাংসও খেতে ছাড়েননি।
…এই নির্জন মরু-শ্মশানে দেবতার হঠাৎ এ কী আশীর্বাদ! কলির দেবতারাও হয়তো ভীতু, কারণ প্রায়ই তাঁরা অসাধুর দিকেই মুখ তুলে চান। বোম্বেটেরা পথের মাঝে এক পাহাড়ের গুহা আবিষ্কার করলে, তার ভিতরে পাওয়া গেল খাবারের ভাণ্ডার—এমনকি ফল আর মদ পর্যন্ত! সম্ভবত স্পানিয়ার্ডরা পালাবার সময়ে এগুলো এখানে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল।
সবাই উপোসি শকুনির মতো সেই ভাণ্ডার লুণ্ঠন করলে। ভালো করে না হোক, পেট তবু কতকটা ঠান্ডা হল।
ষষ্ঠ দিনেও পথের শেষ নেই। কখনও জলপথ, কখনও স্থলপথ,—যখন যেমন সুবিধা। আবার অশ্রান্ত ক্ষুধার আবির্ভাব। চারিদিক তেমনই নিরালা আর নিঝুম, যারা পালিয়েছে তারা খাবারের গন্ধটুকু পর্যন্ত চেঁছেমুছে নিয়ে পালিয়েছে! বোম্বেটেরা মনে মনে কেবল শত্রুকে ডাকতে লাগল। শত্রু! সেও আজ মিত্রের মতো! কেউ গাছের পাতা ছিঁড়ে ও কেউ মাঠের ঘাস উপড়ে মুখে পুরে উদরের শূন্যতাকে ভরাবার চেষ্টা করতে লাগল। স্পানিয়ার্ডরা লড়ে তাদের এমন জব্দ করতে পারত না! গা ঢাকা দিয়ে তারা তাদের কী মারাত্মক শাস্তিই দিচ্ছে! প্রায় দেড়শো বৎসর পরে নেপোলিয়ন এবং খিস্ট জন্মাবারও আগে পারস্যের এক সম্রাট রুশদেশ আক্রমণ করতে গিয়ে এমনই শাস্তিই পেয়েছিলেন।
শয়তানদের উপরে আবার দেবতার দয়া হল! এবারে এক চাষার বাড়িতে তারা পেলে ভুট্টার ভাণ্ডার। ভাঁড়ার লুটে তারা যত পারলে খেলে, বাকি মাল সঙ্গে করে নিয়ে চলল। কিন্তু বারোশো ক্ষুধার্ত ডাকাতের কাছে সে ভুট্টার অস্তিত্ব আর কতক্ষণ! ক্ষুধা মিটল না, তবে আপাতত প্রাণ রক্ষা হল বটে!
সপ্তম দিনে দেখা গেল—দূরে একটা ছোট শহর, তার উপরে উড়ছে ধোঁয়া। বোম্বেটেরা আনন্দে নেচে উঠল। কারণ বিনা কার্য হয় না, আগুন বিনা ধোঁয়া হয় না। আর আগুন মানুষ ছাড়া আর কেউ জ্বালে না। বাসিন্দারা নিশ্চয়ই রাঁধছে—ও ধোঁয়া উনুনের ধোঁয়া।
পাগলের মতো তারা শহরের দিকে ছুটল—শূন্যে আকাশকুসুম চয়ন করতে করতে! এই তো শহর তাদের সামনেই!
কারণ বিনা কার্য হয় না, আগুন বিনা ধোঁয়া হয় না। আর, আগুন মানুষ ছাড়া আর কেউ জ্বালে না।…হ্যাঁ, এ আগুনও মানুষই জ্বেলেছে বটে, স্পানিয়ার্ডরা শহর ছেড়ে অদৃশ্য হয়েছে এবং যাওয়ার সময়ে শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। বোম্বেটেরা এখানে খুদকুড়োটি পর্যন্ত পেলে না। একটা জ্যান্ত বা মরা কুকুর-বিড়ালও শত্রুরা রেখে যায়নি।
একটা আস্তাবলে পাওয়া গেল কেবল প্রচুর মদ আর পাঁউরুটি। অমনি তারা সারি সারি বসে গেল ফলারে! কিন্তু পানাহার শুরু করতেই তাদের শরীর যাতনায় দুমড়ে পড়ল। চারিদিকে রব উঠল—’শত্রুরা খাবারে বিষ মিশিয়ে রেখে গেছে!’ ভয়ে আঁতকে উঠে থু থু করে তারা তখনই মুখের খাবার ধুলোয় ফেলে দিলে।
অষ্টম দিনে বোম্বেটেরা পানামা নগরের খুব কাছে এসে পড়ল। ঘণ্টাদশেক পথ চলার পর তারা বনের ভিতরে একটা পাহাড়ের কাছে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তাদের উপরে ঝাঁকে ঝাঁকে তির-বৃষ্টি হতে লাগল। তির দেখেই বোঝা গেল, রেড ইন্ডিয়ানরাও স্পানিয়ার্ডদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। বোম্বেটেরা বেজায় ভয় পেয়ে গেল, কারণ এসব তির যারা ছুড়ছে তাদের টিকিটি পর্যন্ত কারুর নজরে পড়ল না।
বোম্বেটেরা বনপথে এগুবার চেষ্টা করলে, অমনি রেড ইন্ডিয়ানরা বিকট চিৎকার করতে করতে তাদের দিকে ছুটে এল। কিন্তু একে তাদের দল বোম্বেটেদের মতো পুরু নয় তার উপরে তাদের আগ্নেয় অস্ত্রেরও অভাব, সুতরাং বেশিক্ষণ তারা যুঝতে পারলে না। রেড ইন্ডিয়ান সরদার আহত হয়ে পড়ে গিয়েও আত্মসমর্পণ করলে না, কোনওরকমে একটু উঠে বসে একটা বোম্বেটের দিকে বর্শা নিক্ষেপ করলে, কিন্তু পর মুহূর্তেই পিস্তলের গুলিতে তার যুদ্ধের শখ এ জীবনের মতন মিটে গেল!
খানিক পরেই একটা বনের ভিতরে পাওয়া গেল দুটো পাহাড়। একটা পাহাড়ের উপরে উঠে বোম্বেটেরা দেখলে, অন্য পাহাড়টার উপরে চড়ে বসে আছে স্পানিয়ার্ড ও রেড ইন্ডিয়ানরা। তারা তখন নীচে এল। তাই দেখে শত্রুরাও নীচে নামতে লাগল। বোম্বেটেরা ভাবলে, এইবারে বুঝি আবার যুদ্ধ বাধে! কিন্তু শত্রুরা এখানে লড়াই না করেই কোথায় সরে পড়ল!
সে রাত্রে বোম্বেটেদের বিষের পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ করবার জন্যে আকাশে দেখা দিলে ঘনঘটা এবং তারপরেই নামল অশ্রান্ত বৃষ্টিধারা। নিরাশ্রয়ের মতো সেই ঝড়বাদলকে তাদের মাথা পেতেই গ্রহণ করতে হল। পরদিন সকালে—অর্থাৎ যাত্রার নবম দিনে প্রায় অনাহারে জলে ভিজে অত্যন্ত দুঃখিতভাবে তারা কাদা ভাঙতে ভাঙতে আবার অগ্রসর হল।
আচম্বিতে পথ সমুদ্রতীরে এসে পড়ল এবং দেখা গেল খানিক তফাতে কতগুলো ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। বোম্বেটেরা তখনই নৌকোয় চেপে দেখতে গেল, সেসব দ্বীপের ভিতরে কী আছে!
সে দ্বীপে পাওয়া গেল গরু, মোষ, ঘোড়া এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় গাধা। বোম্বেটেরা মনের খুশিতে তাদের দলে দলে বধ করতে আরম্ভ করলে। তখনই তাদের ছাল ছাড়িয়ে আগুনের ভিতরে ফেলে দেওয়া হল। মাংস সিদ্ধ হওয়া পর্যন্তও তারা অপেক্ষা করতে পারলে না, ক্ষুধার চোটে প্রায় কাঁচা মাংসই চিবিয়ে খেতে লাগল। আজ এতদিন পরে এই প্রথম তারা মনের সাধে পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ পেলে!
খাবার খেয়ে নতুন শক্তি পেয়ে মর্গ্যানের হুকুমে আবার তারা পথে নামল। সন্ধ্যা যখন হয় হয় তখন দেখা গেল, দূরে প্রায় দুইশত স্পানিয়ার্ড তাদের গতিবিধি লক্ষ করছে এবং তাদের পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে, পানামা শহরের একটা উঁচু গির্জার চুড়ো।
বোম্বেটেরা আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিপুল উল্লাসে জয়ধ্বনি করে উঠল—চারিদিকে পড়ে গেল আনন্দের সাড়া। এইবারে তাদের পথশ্রম, রোদে পোড়া, জলে ভেজা ও পেটের জ্বালা শেষ হল। আসল যুদ্ধ এখনও হয়নি বটে, নগর এখনও নাগালের বাইরে বটে, কিন্তু সে অসুবিধা বেশিক্ষণ আর ভোগ করতে হবে না! আর তাদের বাধা দেয় কে?…সে রাতের মতো তাঁবু গেড়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল হল। শত্রুদের পঞ্চাশজন অশ্বারোহী এসে দূর থেকেই চেঁচিয়ে শাসিয়ে গেল—’ওরে পথের কুকুরের দল! এইবারে আমরা তোদের বধ করব!’—তারপরেই পানামা নগর থেকে গোলাবৃষ্টি আরম্ভ হল—কিন্তু মিথ্যা সে গোলাগুলোর গোলমাল, কারণ গোলাগুলোর একটাও তাদের কাছ পর্যন্ত এসে পৌঁছোল না।
দশম দিনের সকালে বোম্বেটেরা বসে বসে নিশ্চিন্তপ্রাণে খানা খেয়ে নিলে—অনেকেরই এই শেষ খানা!
তারপরেই জেগে উঠল তাদের জয়ঢাক আর রণভেরিগুলো। বোম্বেটেরা শ্রেণিবদ্ধ হয়ে সমতালে পা ফেলতে ফেলতে অগ্রসর হল।
দেখা গেল, দূরে কামানের সারের পর সার সাজিয়ে স্পানিয়ার্ডরা যুদ্ধক্ষেত্রে অপেক্ষা করছে। তারা জানে, বোম্বেটেরা এই পথেই আসবে।
এমন সময়ে সেই পথপ্রদর্শক ডাকাতরা মর্গ্যানকে ডেকে বললে, ‘হুজুর, এ পথে অনেক কামান, অনেক বাধা! বনের ভিতর দিয়ে আর একটা পথ আছে, সেটা ভালো নয় বটে কিন্তু সেখান দিয়ে খুব সহজেই শহরে পৌঁছোনো যাবে।’
মর্গ্যান তাদের কথামতোই কাজ করলে—বোম্বেটেরা অন্য পথ ধরলে।
স্পানিয়ার্ডদের প্রথম চাল ব্যর্থ হল। বোম্বেটেরা যে হঠাৎ পথ বদলাবে, এটা তারা আশা করেনি। তাদের সমস্ত আয়োজন হয়েছিল এইখানেই। বাধ্য হয়ে তারাও অন্য পথে বোম্বেটেদের বাধা দেওয়ার জন্যে ছুটল,—তাড়াতাড়িতে ভারী ভারী কামানগুলোকে এখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ারও সময় পেলে না। এই ভুল হল তাদের সর্বনাশের কারণ।
বোম্বেটেরা সভয়ে দেখলে, শত্রুর যেন শেষ নেই! কাতারে কাতারে লোক তাদের আক্রমণ করবার জন্যে বিকট চিৎকারে ধেয়ে আসছে—তাদের পিছনে আবার কাতারে কাতারে সৈন্য। এত শত্রুসৈন্য এক জায়গায় তারা আর কখনও দেখেনি! অশ্বারোহী, পদাতিক, কামানবাহী—কিছুরই অভাব নেই!
তার উপরে আছে আবার হাজার হাজার বুনো মোষের পাল—রেড ইন্ডিয়ান ও কাফ্রিরা মোষগুলোকে তাদের দিকেই তাড়িয়ে আনছে! সেকালে ভারতের রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে হাতির পাল ব্যবহার করতেন, এরা এই বুনো মোষগুলোকে ব্যবহার করবে সেই ভাবেই!
একটা ছোট পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোম্বেটেরা শত্রুদের এই বিপুল আয়োজন লক্ষ করতে লাগল। এখন তাদের পালাবারও পথ বন্ধ। পিছনে জেগে আছে জনহীন, আশ্রয়হীন ও খাদ্যহীন সেই নির্দয় শ্মশানভূমি! নিজেদের বিপদসঙ্কুল অবস্থার কথা ভেবে বোম্বেটেরা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠল। তারা স্থির করলে—হয় মরবে, নয় মারবে! তারা পালাবেও না, আত্মসমর্পণও করবে না!
রণভেরি বেজে উটল। মর্গ্যান সর্বাগ্রে দুইশত বাছা বাছা সুদক্ষ ফরাসি বন্দুকধারীকে দলের আগে আগে পাঠিয়ে দিলে।
স্পানিয়ার্ডরাও অগ্রসর হতে হতে চিৎকার করে উঠল—’ভগবান আমাদের রাজার মঙ্গল করুন!’
প্রথমেই আসছে শত্রুদের অশ্বারোহী সৈন্যদল। কিন্তু খানিক এগিয়েই তারা এক জলাভূমির উপরে এসে পড়ল—সেখানে ঘোড়া নিয়ে ঘোরাফেরাই দায়!
বোম্বেটে বন্দুকধারীরা এ সুযোগ অবহেলা করলে না, তারা মাটির উপরে এক হাঁটু রেখে বসে, টিপ ঠিক করে বন্দুক ছুড়লে এবং অনেকেরই লক্ষ্য হল অব্যর্থ! ঘোড়সওয়াররা জলাভূমির ভিতরে হাঁকপাঁক করে বেড়াতে লাগল এবং গুলির পর গুলির চোটে হয় ঘোড়া নয় সওয়ার হত বা আহত হয়ে নীচে পড়ে যেতে লাগল।
অশ্বারোহীদের আক্রমণে ফল হল না দেখে, বোম্বেটেদের ছত্রভঙ্গ করবার জন্যে বুনো মোষগুলো লেলিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু মোষেদের বেশির ভাগই গোলাগুলির আওয়াজে চমকে ও ভড়কে অন্যদিকে ছুটে পালাল, যারা এগিয়ে গেল তাদের বেশি রাগ হল মানুষের বদলে রঙিন নিশানগুলোরই উপরে। তারা পতাকা লক্ষ করে তেড়ে এল এবং সেই ফাঁকে বোম্বেটেরা তাদের গুলি করে নিশ্চিন্তপুরে পাঠিয়ে দিলে।
তারপর আরম্ভ হল বোম্বেটেদের সঙ্গে স্পানিয়ার্ড পদাতিকদের লড়াই। বোম্বেটেরা জানত, হারলে তারা কেউ আর প্রাণে বাঁচবে না। তাই তারা এমন মরিয়া হয়ে লড়তে লাগল যে, এক-একজন বোম্বেটেকে তিন-চারজন স্পানিয়ার্ড মিলেও কায়দায় আনতে পারলে না। বোম্বেটেদের এক হাতে পিস্তল, আর এক হাতে তরোয়াল,—দূরের শত্রুকে গুলি ছুড়ে মারে, কাছে পেলে বসিয়ে দেয় তরোয়ালের কোপ! তারা অসম্ভব শত্রু! ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ। স্পানিয়ার্ডরা যে যেদিকে পারলে সরে পড়ল—ছয়শোজন মৃত সঙ্গীর দেহ যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে।
এত আয়োজনের পর এত শীঘ্র লড়াই শেষ হয়ে যাবে, এটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি।
পানামার পতন হল।