উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

দ্বাদশ। যুদ্ধের দুঃখ

দ্বাদশ। যুদ্ধের দুঃখ

এইভাবে কেটে গেল সাড়ে পাঁচ বৎসর।

ওদিকে আর্যাবর্তের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ এবং এদিকে বঙ্গদেশের অনেক অংশ হল হর্ষবর্ধনের করতলগত। তিনি রীতিমতো এক সাম্রাজ্যের অধিকারী।

তাঁর সামরিক শক্তিও হয়ে উঠেছে এখন অতুলনীয়। তিনি ইচ্ছা করলেই যে কোনও সময়ে ৬০ হাজার রণহস্তী, এক লক্ষ অশ্বারোহী ও তার চেয়ে বেশি পদাতিক নিয়ে অবতীর্ণ হতে পারেন রণক্ষেত্রে।

কিন্তু মগধ ও গৌড় থেকে আসছে দুঃসংবাদের পর দুঃসংবাদ। শৈব নরপতি শশাঙ্কের অত্যাচারে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা অত্যন্ত আর্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন।

মধ্য-ভারতে পরাজিত হয়েও শশাঙ্ক স্বরাজ্যে নিজের প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন। তিনি কেবল বুদ্ধগয়া, পাটলিপুত্র ও কুশীনগরের বৌদ্ধ বিদ্রোহীদের দমন করেই ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু পবিত্র বোধিদ্রুম উৎপাটিত এবং বুদ্ধদেবের পদচিহ্ন ও বহু বৌদ্ধকীর্তিও নষ্ট করে ফেলেছেন। বৌদ্ধরা পালিয়ে গিয়ে নেপালের পর্বতমালার মধ্যে আশ্রয় নিয়েও শশাঙ্কের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারছেন না।

 বৌদ্ধধর্মের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অনুরাগ থাকলেও বুদ্ধিমান হর্ষের এটা বুঝতে বিশেষ বিলম্ব হল না যে, অতঃপর তাঁর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে স্বরাজ্যে ফিরে গিয়ে প্রকাশ্যে রাজা-উপাধি গ্রহণ ও রাজমুকুট ধারণ করা। এত দিন তাঁকে নাবালক ভেবে যারা বিরুদ্ধতা করে আসছিল, এইবারে তারা বিশেষভাবে অনুভব করতে পেরেছে তাঁর সবল বীরবাহুর শক্তি। তার অঙ্গুলি তাড়নায় বৃহত্তর আর্যাবর্ত আজ মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে, বিনা বাধায় সিংহাসন অধিকার করবার এমন সুযোগ ত্যাগ করা উচিত নয়। শশাঙ্ক? সে তো হচ্ছে পলাতক সর্প, নিজের বিবর ত্যাগ করে বাইরে আসবার সাহস আর তার হবে না। আগে নিজের সিংহাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করি, তার পর তাকে শাসন করতে বেশি দিন লাগবে না।

প্রায় ছয় বৎসর পরে বিজয়ী বীর হর্ষবর্ধন আবার ফিরে এলেন থানেশ্বরে। প্রজারা তাঁর অভ্যর্থনার আয়োজন করলে মহাসমারোহে। রাজপথে বিপুল জনতা, প্রত্যেক ভবন পত্র-পুষ্প-পতাকায় অলংকৃত, পুরনারীরা অলিন্দে দাঁড়িয়ে শঙ্খধ্বনির সঙ্গে তরুণ রাজপুত্রের মাথার উপরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন লাজাঞ্জলি। সকলের চক্ষে উৎসাহ, মুখে হাসি ও কণ্ঠে জয়ধ্বনি। থানেশ্বর আজ শিলাদিত্যের অপূর্ব বীরত্বের জন্যে গর্বিত, শত্রুরাও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে নিশ্চেষ্ট মৌনব্রত।

কবিবন্ধু বাণভট্ট এসে হাস্যমুখে বললেন, ‘রাজপুত্র শিলাদিত্য, আমার অভিনন্দন গ্রহণ করো।’

হর্ষবর্ধন বললেন, ‘কবি, তোমার অভিনন্দন লাভ করে মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্ধন যুদ্ধজয়ের চেয়ে বেশি গৌরব অনুভব করছেন।’

বাণভট্ট দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললে, ‘মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্ধন’!

—’হ্যাঁ বন্ধু, রাজপুত্র শিলাদিত্য এর পর থেকে ওই নামেই পৃথিবীতে পরিচিত হবেন।’

বাণভট্ট উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘জয় মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্ধনের জয়।

হর্ষবর্ধন অগ্রসর হয়ে বাণভট্টের স্কন্ধে একখানি হাত রেখে স্নিগ্ধস্বরে বললেন, ‘কিন্তু কবি, রাজ্যের চেয়ে কাব্য—আর রাজার চেয়ে কবি বড়। মহারাজা বিক্রমাদিত্য যত দিন বেঁচে ছিলেন, নিজের রাজ্যে নিজে প্রজাদের পূজা পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর সভাকবি কালিদাস সর্বযুগের সর্বদেশের পূজা থেকে বঞ্চিত হবেন না। এ রাজ্যের বাইরের লোকদের কাছে আমি মহারাজাধিরাজ বটে, কিন্তু তুমি যে আমার মনের মানুষ, তোমার কাছে আমি শ্রীহর্ষ ছাড়া আর কেউ নই।’

‘খালি শ্রীহর্ষ নয়, তুমি হচ্ছ মহাকবি শ্রীহর্ষ। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, পৃথিবীর দেশে দেশে তুমি ওই নামেই অমর হয়ে থাকবে।’

‘দুঃখের কথা বন্ধু, বেঁচে থেকে কেউ নিজের অমরত্বের সঠিক প্রমাণ পায় না। তাকে অমর করে ভবিষ্যতের মানুষ।’

‘কিন্তু মহারাজ, তোমার অমরত্বের প্রমাণ পেয়েছি আমি বর্তমানেই। আমি কি তোমার রচনা পাঠ করিনি? তার ছত্রে ছত্রে আছে যে অমরত্বের নিশ্চিত নিদর্শন!’

হর্ষবর্ধন হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার মুখে এ কথা শুনলে লোকে বলবে চাটুবাদ।’

‘লোকের কথায় আমি কান দিই না। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো মহারাজ, এ হচ্ছে আমার আন্তরিক কথা।’

‘উত্তম, তাহলে তোমাকে পুরস্কৃত করবার জন্যে তোমার উদরগহ্বর পরিপূর্ণ করে দেব আমি মিষ্টান্নের স্তূপে। যাই বন্ধু, গুরুতর রাজকার্য আছে।’

হর্ষবর্ধনের প্রস্থান। সেনাপতি সিংহনাদের প্রবেশ। এসেই বললেন, ‘মহারাজা মিষ্টান্নের কথা কী বলছিলেন না?’

‘হ্যাঁ। তিনি বলছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি সিংহনাদকে মিষ্টান্ন জোগাতে জোগাতে তাঁর প্রাণান্ত-পরিচ্ছেদ হয়েছে।’

ঘনঘন ঘাড় নেড়ে সিংহনাদ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘না, মহারাজা এ কথা বলতে পারেন না, এ হচ্ছে তোমারই বানানো কথা। কলম নেড়ে কালি মেখে দিন কাটাও, তুমি কী বুঝবে হে যুদ্ধক্ষেত্রের কথা? সেখানকার অদ্বিতীয় নীতি হচ্ছে—হয় মারো, নয় মরো। সেখানে থাকে কেবল রক্ত আর মড়া, মিষ্ট বা তিক্ত কোনও রকম অন্নই সেখানে পাওয়া যায় না—বুঝলে?’

‘না বুঝলুম না।’

‘এমন সোজা কথাটা বুঝলে না?’

‘উঁহু।’

‘মানে?’

‘বললে, যুদ্ধক্ষেত্র অন্ন পাওয়া যায় না; তাহলে তোমরা ভক্ষণ করতে কী? বায়ু?’

‘যা ভক্ষণ করতুম তা বায়ু না হলেও মোটেই আহার্য বলে স্বীকার করা যায় না। তোমাদের ঘাসের রুটি খাওয়ার অভ্যাস আছে?’

‘থু, থু, রামচন্দ্র! তাও আবার মানুষ খায় নাকি?’

‘সময়ে সময়ে তাও আমাদের অমৃত বলে গ্রহণ করতে হয়েছে।’

‘তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রটা তো দেখছি ভারি খারাপ জায়গা!’

‘খারাপ বলে খারাপ, একেবারে জঘন্য।’

‘আহা, তোমার জন্য আমি দুঃখিত।’

‘ভায়া, সাড়ে পাঁচ বছর আগে আমার উদরদেশটি ছিল এমন প্রশস্ত যে গৃহস্থেরা আমাকে নিমন্ত্রণ করতে ভয় পেত! কিন্তু আজ তার অবস্থা দেখছ?’

‘কই, আমি তো উদরদেশের কিছুই নিরীক্ষণ করতে পারছি না।

‘তুমি ভাসা-ভাসা চোখে খালি উদরের উপরটাই লক্ষ করছ। কিন্তু কুখাদ্য আর অখাদ্য খেয়ে খেয়ে এর ভিতরটা হয়ে গেছে শুকিয়ে এতটুকু।’

‘তাই তো, তুমি আমাকে ভাবালে।’

‘কেন?’

‘মহারাজা এই মাত্র বলে গেলেন, আমার জন্যে প্রচুর মিষ্টান্ন পাঠিয়ে দেবেন। ভেবেছিলুম তোমাকে নিমন্ত্রণ করব। কিন্তু তোমার শুকনো নাড়িতে সুখাদ্য সহ্য হবে কি?’

‘কেন হবে না, আমি প্রাণপণে সহ্য করবার চেষ্টা করব। নিমন্ত্রণ থেকে আমাকে বাদ দিয়ো না দাদা।’

‘বেশ তবে নিমন্ত্রণ রইল।’

‘ধন্যবাদ।’