দ্বাদশ । ‘বজ্র’ বেয়াজিদ ও খঞ্জ তৈমুর
তৈমুরের বিরুদ্ধে তখন একজোট হয়ে দাঁড়িয়েছে নানাদেশি শত্রু—তুর্কি, মামেলুক, সারকাস্যান, জর্জিয়া, টার্কোম্যান ও আরব! এরা সবাই যোদ্ধার জাত এবং এদের মধ্যে তখন সবচেয়ে প্রবল ও দুর্ধর্ষ ছিল তুর্কিগণ।
কিন্তু ভয় পাওয়ার ছেলে নন তৈমুর। তিনি স্থির করলেন, প্রথমেই যাত্রা করবেন বোগদাদের দিকে।
তুরস্কের প্রথম সুলতান উপাধিকারী বেয়াজিদের নাম তখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দিকে দিকে। জার্মানির রাজা ও রোমের সম্রাট সিগিসমান্ড এবং ইউরোপীয় খ্রিশ্চানদের সম্মুখযুদ্ধে বিষম ভাবে হারিয়ে দিয়ে তিনি তখন তৈমুরের চেয়ে অল্প খ্যাতি অর্জন করেননি। এই বেয়াজিদের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তৈমুরের দুই প্রধান শত্রু—টার্কোম্যানদের কারা ইউসুফ ও বোগদাদের সুলতান আমেদ।
প্রথমটা তৈমুরের ইচ্ছা ছিল না যে, বেয়াজিদের সঙ্গে শত্রুতা করবেন। তিনি খুব ভদ্রভাবে লিখে জানালেন যে, সুলতান বেয়াজিদ যদি ইউরোপ নিয়ে খুশি হন, তাঁর তাতে আপত্তি নেই। তাঁর সঙ্গে তৈমুরের ঝগড়া করবারও ইচ্ছা নেই। কিন্তু তাঁর শত্রু ইউসুফ ও সুলতান আমেদকে যদি তিনি ত্যাগ করেন তাহলে বড় ভালো হয়।
বেয়াজিদের ডাকনাম ছিল ‘বজ্র’। এবং বজ্রেরই মতন কঠিন ভাবে তিনি জবাব দিলেন, ‘ওরে রক্তাক্ত কুক্কুর, ওরে খোঁড়া তৈমুর! তুর্কিরা বন্ধুদের তাড়িয়ে দিতে বা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে ভয় পেতে অভ্যস্ত নয়। এ কথা তুই ভালো করেই জেনে রাখিস!’
তৈমুরও চুপ করে থাকবার পাত্র নন। তিনি লিখলেন, ‘মাতঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করবার আগে পতঙ্গের উচিত, নিজের কথা ভেবে দেখা। আপনি আমার কথা না শোনেন, তাহলে পরে আপনাকে অনুতাপ করতে হবে।’
বেয়াজিদ জবাবে লিখলেন : ‘ওরে খোঁড়া তৈমুর! আমার অনেক দিনের সাধ তোর সঙ্গে লড়াই করব। ভগবান আজ সেই সুযোগ দিয়েছেন। এর পরেও তুই যদি আমার দিকে এগিয়ে না আসিস, তবে আমিই এগিয়ে যাব তোর দিকে! তোকে হারিয়ে ভূত করব, তারপর তোর বউকে কেড়ে নেব!’
তৈমুর রাগে জ্বলে উঠে প্রতিজ্ঞা করলেন, বেয়াজিদকে তিনি ভালো করেই শিক্ষা দেবেন।
দূতের মধ্যস্থতায় দুজনের মধ্যে এমনি পত্র ব্যবহার চলেছে, ইতিমধ্যে দুটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ বড় বড় ঘটনা ঘটে গেল।
প্রথমটি হচ্ছে, তৈমুরের দ্বারা তুর্কিরা ছাড়া অন্যান্য শত্রু দমন ও সিরিয়া অধিকার।
এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বেয়াজিদের দ্বারা ক্রিশ্চানদের প্রধান রাজধানী কনস্তান্তিনোপল অবরোধ।
কনস্তান্তিনোপলের পতন হলেই পৃথিবী বিখ্যাত রোম সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্ন লুপ্ত হয়ে যাবে। মুসলমানদের সঙ্গে ধর্মযুদ্ধ ও কনস্তান্তিনোপলকে রক্ষা করবার জন্যে ইউরোপের চারিদিক থেকে ক্রিশ্চানরা ছুটে এসেছেন। কিন্তু মহাবীর্যবান বেয়াজিদ এমন ভাবে শহর ঘিরে রইলেন যে, ক্রিশ্চানদের কোনও জারিজুরিই আর খাটল না। ধর্মযুদ্ধের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অধিকাংশ ক্রিশ্চান বীরই কনস্তান্তিনোপল ছেড়ে সরে পড়লেন।
শহরের ভিতরে দারুণ খাদ্যাভাব। উপবাসী বাসিন্দারা শহরের পাঁচিল টপকে বাইরে গিয়ে শত্রু তুর্কিদের কাছেই ভিক্ষা মাগতে শুরু করল। কনস্তান্তিনোপল আত্মসমর্পণ করবার জন্যে প্রস্তুত—এমন সময়ে খবর এল, সিরিয়া জয় করে খোঁড়া তৈমুর আসছেন ‘বজ্র’ বেয়াজিদের সঙ্গে দেখা করতে!
‘বজ্র’র পিলে গেল চমকে! তৈমুরের এতটা ভরসা হবে তিনি তা কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি ডাকলেন,—আমি ইউরোপ-বিজেতা বজ্র, একটা খোঁড়া তাতারের এত স্পর্ধা!
তারপরেই বোধ হয় ‘বজ্র’র মনে পড়ে গেল,—আমি ইউরোপ বিজয়ী বটে, কিন্তু এই খোঁড়া তাতার ঘৃণ্য হলেও নগণ্য নয়, সেও এশিয়া বিজয়ী।
তখনই ‘বজ্র’র হুকুম হল—’কনস্তান্তিনোপলের চারিধার থেকে তাঁবু তোলো! সওয়াররা ঘোড়ায় চড়ো, পদাতিকরা ছুটে চলো! ইউরোপের যেখানে যত তুর্কি বীর আছে, সবাইকে ডাক দাও! শিয়রে তাতার শত্রু—এখন কনস্তান্তিনোপলের কথা ভুলে যাও!’
কনস্তান্তিনোপল ছেড়ে, ইউরোপ ছেড়ে, তুর্কিরা ছুটল আবার এশিয়া মাইনরের দিকে। এর ফলে কনস্তান্তিনোপলের ক্রিশ্চানরা নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিল আরও পঞ্চাশ বৎসর!
এর মধ্যেই বেয়াজিদের কবল থেকে আর আত্মরক্ষা করা অসম্ভব দেখে কনস্তান্তিনোপলের ক্রিশ্চান সম্রাট ম্যানুয়েল করুণ ভাষায় তৈমুরের কাছে এক আবেদন জানালেন, ‘হে তৈমুর, তুমি আমাকে রক্ষা করো!’
সম্রাট ম্যানুয়েল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন—ইতিহাসে তা ‘শেষ ক্রুসেড’ নামে বিখ্যাত। অথচ তিনিই মুসলমান বেয়াজিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনুরোধ করছেন মুসলমান তৈমুরকে।
প্রথম দৃষ্টিতে ব্যাপারটা হাস্যকর বলে মনে হয়। কিন্তু এর দুটি কারণ থাকতে পারে। ম্যানুয়েল জানতেন, হয়তো তৈমুরের চেয়ে বড় শত্রু বেয়াজিদের আর কেউ নেই। অথবা হয়তো তৈমুরের মধ্যে ধর্মান্ধতা ততটা প্রবল ছিল না।
কিন্তু ম্যানুয়েল সাহায্য ভিক্ষা না করলেও তৈমুর তুর্কিদের আক্রমণ করতে আসতেনই। কারণ তৈমুর জানতেন, লোকে বেয়াজিদকে তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। এটা তাঁর পক্ষে অসহনীয়। তাঁর সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র সূর্য বলে গণ্য হবেন তিনিই স্বয়ং। কেউ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে রাগে তিনি পাগল হয়ে উঠতেন! প্রমাণ, যেসব দেশ সহজে তাঁর বশীভূত হয়েছে, তাদের উপরে তিনি কোনও অত্যাচারই করেননি। কিন্তু যেসব দেশের লোক তাঁর সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছে, তাদের নগর-গ্রামকে তিনি পরিণত করেছেন সমতল ক্ষেত্রে এবং তাদের মুণ্ডগুলো কেটে নিয়ে তৈরি করেছেন ভয়াবহ পিরামিড! তার উপর বেয়াজিদ তাঁকে চূড়ান্ত অপমান করেছেন এবং ইতর ভাষায় গালাগালি দিয়েছেন।
সম্রাট ম্যানুয়েল কেবল তৈমুরকে নয়, বেয়াজিদকেও জানালেন, তিনি যদি তৈমুরকে পরাস্ত করতে পারেন, তাহলে বিনাযুদ্ধেই কনস্তান্তিনোপলকে তাঁর হাতে সমর্পণ করা হবে।
পঞ্চদশ শতাব্দী এখন সবে পৃথিবীতে পদার্পণ করেছে—অর্থাৎ ১৪০২ খ্রিস্টাব্দ।
ইউরোপ-বিজয়ী বেয়াজিদ চারিদিক থেকে নিজের যুদ্ধপ্রবীণ সৈন্যদল সংগ্রহ করতে লাগলেন। তাঁর ফৌজের মধ্যে কেবল তুর্কিরাই ছিল না। ইউরোপের পরাজিত সামন্ত রাজারাও তাঁর আহ্বানে বা আদেশে সৈন্য প্রেরণ করতে বাধ্য হলেন। সার্ভিয়ার রাজা পাঠালেন বিশ হাজার অশ্বারোহী—তাদের সর্বাঙ্গ কঠিন লৌহবর্মে আবৃত, দেখা যায় কেবল তাদের চোখগুলো। এল হাজার হাজার গ্রিক, হাজার হাজার রুমানিয়ান এবং আরও নানা দেশের অসংখ্য ক্রিশ্চান। বেয়াজিদের সৈন্যসংখ্যার সঠিক হিসাব নেই। কেউ বলেন এক লক্ষ বিশ হাজার, কেউ বলেন দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার।
এশিয়া মাইনরের আঙ্গোরা (তুরস্কের বর্তমান রাজধানী) শহরে গিয়ে বেয়াজিদ ছাউনি ফেললেন। সিভা থেকে এদিকে আসবার জন্যে আছে একমাত্র পথ। অতএব বেয়াজিদ আন্দাজ করলেন, এই পথেই তৈমুরের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে।
তুর্কিদের প্রধান শক্তি পদাতিক সৈন্য। আঙ্গোরার উপকণ্ঠে কিছুদিন বিশ্রাম করবার অবসর পেলে তারা হবে আরও তেজিয়ান, আরও বলবান। কিন্তু তৈমুরকে সসৈন্যে আসতে হবে বহু যোজনব্যাপী দুর্গম পথ অতিক্রম করে। সুতরাং তাঁর সেই পথশ্রান্ত সৈন্যদের আক্রমণ ও পরাস্ত করবার জন্যে বেশি বেগ পেতে হবে না। সুলতান বেয়াজিদ নিজের জয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়ে হুকুম দিলেন, ‘সৈন্যগণ, তোমরা খাও-দাও, ফুর্তি করো!’
ইউরোপ-বিজয়ীর সঙ্গে এশিয়া-বিজয়ীর শক্তি পরীক্ষা! সমস্ত পৃথিবী ফলাফল দেখবার জন্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল।