দেয়ালি
ভারতবর্ষের সর্বত্রই দেয়ালি-উৎসব হয় এবং সর্বত্রই ওইদিন আলো জ্বালানো হয়। দিল্লিতেও বিস্তর আলো জ্বালানো হয়েছিল– বহু রঙের বহু ধরনের আলো জ্বালিয়ে দিল্লিবাসীরা তাদের ভিন্ন ভিন্ন রুচির প্রকাশ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে কলকাতাতেও এইরকম রঙ-বেরঙা আলো জ্বালানো হয়।
আমার কিন্তু এখনও ভালো লাগে ছোট শহরের দেয়ালি দেখতে– যেখানে বিজলি বাতি নেই। বিজলির প্রধান দোষ মানুষ নানা রঙের প্রদীপ জ্বালাবার জন্য সহজেই প্রলুব্ধ হয় এবং তাতে যেন রুচির অভাব লক্ষ হয়। দ্বিতীয়ত, পিদিমের শিখার কাঁপনে কেমন যেন একটা প্রাণের পরিচয় পাওয়া যায়, বিজলির নিষ্কম্প আলো বড় ঠাণ্ডা বড় নির্জীব বলে মনে হয়। তৃতীয়ত, বিজলিবাতি একবার জ্বালিয়েই খালাস, তার জন্য কোনও তদারকি করতে হয় না। তাতে করে কেমন যেন জীবনস্পন্দনের কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না মনে হয় সিনেমা-সাজানোর আলোই জ্বালানো হয়েছে, তবে সিনেমা কোম্পানির অঢেল পয়সা নেই। বলে রোশনাইটার খোলতাই হয়নি।
তার চেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন দেখি, একটি মেয়ে তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এ পিদিমে তেল ঢালছে, ও-পিদিমের পলতে উস্কে দিচ্ছে, পিদিমের আলো তার মুখে এসে পড়েছে, ছোট ভাইকে হাতে ধরে এক পিদিম থেকে আর এক পিদিম জ্বালাতে শেখাচ্ছে, তখন মনের ওপর যে ছবিটি আঁকা হয় সে-ছবি বহু বৎসর পরে স্মরণ করেও প্রবাসীর মনে আনন্দ হয়, তার সঙ্গে খানিকটে মধুর বেদনাও এনে দেয়।
দিল্লি শহরও পিদিম জ্বালে। কিন্তু পাশের বাড়িতে বিজলিবাতির রোশনাই থাকলে পিদিমের আলো কেমন যেন ম্লান আর বে-জলুস মনে হয়। তদুপরি দিল্লির যেসব জায়গায় পিদিম জ্বালানো হয় সেসব জায়গার সঙ্গে আমার তো কোনও হার্দিক সম্পর্ক নেই, তাই, ‘অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে।’
এই দেয়ালি দেখে আরেক দেয়ালির কথা মনে পড়ে গেল। আর সে বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তার সঙ্গে তুলনীয় বর্ণনা তিনি তার দীর্ঘ কবিজীবনে অল্পই দিতে পেরেছেন :
‘কবি বলে, যাত্রী আমি, চলিব রাত্রির নিমন্ত্রণে
যেখানে সে চিরন্তন দেয়ালির উৎসব প্রাঙ্গণে
মৃত্যুদূত নিয়ে গেছে আমার আনন্দদীপগুলি,
যেথা মোর জীবনের প্রত্যূষের সুগন্ধি শিউলি
মাল্য হয়ে গাঁথা আছে অনন্তের অঙ্গদে কুণ্ডলে,
ইন্দ্রাণীর স্বয়ম্বর বরমাল্য সাথে; দলে দলে
যেথা মোর অকৃতার্থ আশাগুলি, অসিদ্ধ সাধনা,
মন্দির-অঙ্গনদ্বারে প্রতিহত কত আরাধনা
নন্দন-মন্দারগন্ধ-লুব্ধ যেন মধুকর-পাঁতি,
গেছে উড়ি মর্তের দুর্ভিক্ষ ছাড়ি।’
দেয়ালির উৎসব-আলো দেখে বারবার মনে পড়ল, জীবনের বড় বড় আনন্দদীপগুলো অনন্ত ওপারে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছেন। হায়, কজনের জীবনে কবার তারা এপারের দেয়ালি সর্বাঙ্গসুন্দর করে জ্বালাতে পারে!!