দেশভ্রমণ
ছেলেবেলায় মাস্টারমশাই গোরু সম্বন্ধে রচনা লিখতে হুকুম দিতেন। এখনও মনে পড়ছে, তালুর ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে ধোয়া বেরিয়ে যেত কিন্তু কিছুতেই ভেবে পেতুম না, গোরু সম্বন্ধে লিখব কী? শেষটায় মনে হত, আমি একটা আস্ত গোরু, না হলে গোরু সম্বন্ধে কিছুই লিখতে পারছিনে কেন– যে গোরু ইস্কুল আসতে-যেতে নিত্যি নিত্যি দেখতে পাই। সেকথা একদিন এক বন্ধুকে বলতে সে বাঁকা হাসি হেসে বলেছিল, আত্মজীবনী লেখা তো কঠিন নয়।
শেষটায় অনেক ভেবে-চিন্তে লিখতুম, গোরুর চারখানা পা, দুটো শিং আর একটা ন্যাজ আছে। গুরুমশাই তারই উপর চোখ বুলিয়ে যেতেন, পেটের অসুখ থাকলে দিতেন ছ নম্বর, মর্জি ভালো থাকলে দিতেন আট। আমিও খুশি হয়ে ভাবতুম, এই গোরুর ন্যাজ ধরে পরীক্ষা বৈতরণী ঠিক পেরিয়ে যাব।
কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবতুম, দুটো শিং বলার অর্থ হয়, কারণ গণ্ডারের নাকি একটা শিং। চার পা বলাও অবান্তর নয়, কারণ চার না হয়ে গোরুর দু পা-ও হতে পারত কিন্তু একটা ন্যাজ বলার তো কোনও মানে হয় না– আজ পর্যন্ত তো কোনও জানোয়ারের দুটো ন্যাজের কথা শুনিনি। একদিন মাস্টারমশাইকে প্রশ্নটা শুধালে তিনি বললেন, ইংরেজি ভাষার আইন অনুসারে বলতে হয়, দি কাউ হ্যাজ এ টেল। ‘এ’টা না দিলে ব্যাকরণের গলতি হয়। তখন বুঝলুম ‘এ টেল’টা গোরুর ন্যাজ নয়, ইংরেজি ব্যাকরণের ন্যাজ। কিন্তু তবু প্রশ্ন রয়ে গেল, ‘বাংলাতে যখন ‘একটা’ ব্যবহার না করে দিব্য বলতে পারি ‘গোরুর ন্যাজ আছে’ তখন ইংরেজের মতো সুসভ্য জাত সৃষ্টির প্রথম পূর্বাহে বৃক্ষাবতরণকালে তার মর্কট রূপটি ত্যাগ করার সময় এই বৈয়াকরণিক কিংবা আলঙ্কারিক পুচ্ছটিও বর্জন করল না কেন?’
আমি ইংরেজি লিখতে পারিনে। যাঁরা এই ভাষাতে নাম করেছেন, তাঁদের মুখে শুনেছি, ওই ‘এ’র ন্যাজ নাকি এখনও তাঁদের মুখের উপর মাঝে মাঝে ঝাপটা মারে। তাই শুনে বিঘ্নসন্তোষী মন বিমলানন্দ লাভ করে।
সেকথা থাক।
কিন্তু যখন মাস্টারমশাই হুকুম দিতেন, ‘দেশভ্রমণের উপকারিতা সম্বন্ধে প্রাঞ্জল ভাষায় কিঞ্চিৎ বর্ণনা কর’, তখন সে বৈতরণীর ও-পার আর চোখে দেখতে পেতুম না। গোরু জানোয়ারটা উৎকৃষ্ট হোক নিকৃষ্ট হোক সেটাকে তবু চিনি, না-হক একথা কখনই বলে ফেলব না, ‘গোরু বড় প্রভুভক্ত জীব, সে রাত জেগে চোর-ডাকু খেদায় কিংবা পাড়ার মোন্দারমশাই গোরু চড়ে আদালতে পেশকারি করতে যান।’ কিন্তু দেশভ্রমণ বলতে তো বুঝি দাদির বাড়ি যাবার সময় নৌকোর ছৈয়ের ভেতরের দিকটা ছৈয়ের বাইরে যেতে চাইলেই বাবা রাশভারি গলায় বলতেন, “থাক, থাক, আর বিলে ডুবে মরতে হবে না।’ বাংলা ভাষাটা নিতান্ত পশ্চিম-বাংলার ভাষা। না হলে ‘ডানপিটের মরণ গাছের ডগায়’ না বলে বলত, ‘ডানপিটের মরণ বিলের তলায়’। সেই ছৈয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তো আর দেশভ্রমণের উপকারিতা সম্বন্ধে তত্ত্বজ্ঞান জন্মায় না। কাজেই তখন বাধ্য হয়ে সন্ধান নিতে হত, কোন ‘এসে বুক’ মুখস্থ করে বীরভূমের হেতমপুর ইস্কুলের বিশ্বম্ভর ভড় গেলবার ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হয়েছে। ‘চিত্তের প্রসার’, ‘অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য’, ‘কষ্টসহিষ্ণুতার পরিপূর্ণতা’ ইত্যাদি যাবতীয় উত্তম উত্তম গুণরাজিতে প্রবন্ধটি ভরে দিতে তাই আমাদের তখন আর কণামাত্র অসুবিধে হত না– ইস্কুল-ঘরের চারিটি বেড়ার ভেতর বসে বসে। মাস্টারমশাইও কোনও আপত্তি জানাতেন না, কারণ আমরা বিলক্ষণ জানতুম, তাঁর দৌড়, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ তক’, অর্থাৎ, তাঁর এক ভাগ্নে ম্যাট্রিক ফেল মেরে আগরতলায় পালিয়ে যাওয়াতে তিনি ভয়ে ভয়ে ‘দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী’ জপ করতে করতে অতি অনিচ্ছায় আগরতলা অবধি একবার ‘দেশভ্রমণ’ করেছিলেন। জাত যাবার ভয়ে তিনি সেই যাওয়া-আসাটা সেরেছিলেন নিরম্বু, অপর্ণব্রতে। ফিরে এসে তিনি প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন, কারণ ভিড়ে মেলা জাত-বেজাতের লোক হয়তো তাঁর গাত্রস্পর্শ করে ফেলেছে এবং সবচেয়ে মারাত্মক অগ্নিপরীক্ষা তাকে তখন পেরোতে হয়েছিল, তার সঙ্গে অন্য কোনও পরীক্ষার তুলনা হয় না, সেই একমেবাদ্বিতীয় দেশভ্রমণের ঝাড়া বারোটি ঘণ্টা তিনি তার নর্মসখী কৃশাণুদীপ্ত তাম্রকূটশীর্ষ ডাবাসুন্দরীর সুচিক্কণ কৃষ্ণগণ্ডে একটি মাত্র নিবিড় চুম্বন দিতে পারেননি। তিনি ‘পথি নারী বিবর্জিতা’ এই আপ্তবাক্যটির স্মরণে শুচিস্মিতাকে সজল নয়নে তার সপত্নীর হাতে সমর্পণ করে দৃঢ়পদে পশ্চিমাভিযান করেছিলেন।
এ-জাতীয় গুরু পৃথিবী থেকে লোপ পেয়েছেন। টোলো-পণ্ডিত, আপন চেষ্টায় ইংরেজি শিখেছিলেন, কিন্তু কোনও ডিগ্রি ছিল না বলে ক্লাস সিক্সের উপরে যাবার তার হক ছিল না। কিন্তু সেইটে আসল কথা নয়। আসল কথা এই, তিনি যখন দেশভ্রমণের উপকারিতা সম্বন্ধে ‘পয়েন্ট’ দেবার সময় উচ্চাঙ্গের বক্তৃতা ঝাড়তেন তখন, কেন জানিনে, একমাত্র আমারই মনে সন্দেহ হত যে, তাঁর ভ্রমণ-প্রশস্তি হিন্দু গৃহিণীর ভিন্ন হেঁশেলে মুরগি রান্না করার মতো। ছেলে-ছোকারা খাবে, তিনি রান্নার পর গঙ্গাস্নান করে বুনেদি হেঁশেলে পুঁই-চচ্চড়ি চড়াবেন।
আমি তাই একদিন সাহস করে বলেছিলুম, ঘোরাঘুরি করলেই যদি এত বিদ্যে হয় তবে তো গার্ডসাহেব আজমল আলী আমাদের শহরের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। আশ্চর্য পণ্ডিতমশাই রাগ করলেন না। সন্দিগ্ধ নয়নে, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন শুধু; আমি তাঁর চোখের ভাষাতে পড়লুম, তবে কি রাস্কেলটা আমার মনের গোপন খবর পেয়ে গিয়েছে?
তা সে যাই হোক, পণ্ডিতমশাই কিন্তু তখন একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তার অর্থ, আর পাঁচটা জিনিসের মতো দেশভ্রমণও খুদাতালা আপন হাতে কজা করে রেখেছেন। পাঁচটা জিনিসের মতো দেশভ্রমণের উপকারিতা সম্বন্ধে স্থির-নিশ্চয় হওয়ার পরই মানুষ দেশভ্রমণে বেরোয় না; যার কপালে ওটা লেখা আছে, কিংবা বলুন কপালে নয়, যার পায়ে চক্কর আছে, সে-ই বেরোয় দেশভ্রমণে। কেউ বেরোয় পণ্ডিতমশায়ের মতো গজরাতে গজরাতে, কেউ বেরোয় চেন-ছাড়া পাখির মতো তিড়িং তিড়িং করে, তিন লক্ষে গেট পেরিয়ে।
দেশভ্রমণ করেছি, এরকম একটি খ্যাতি আমার আছে। এ সম্বন্ধে কোনও প্রকারের উচ্চবাচ্য আমি করিনে। অর্থাৎ আমি যেসব ভূমি দেখেছি, শুধুমাত্র সেগুলোর সাদামাটা বর্ণনা দিয়েই ক্লান্ত থাকি। দেশভ্রমণ ভালো কি মন্দ, কোন কোন দেশে গিয়েছিলাম এ সম্বন্ধে কোনও প্রকারের ইঙ্গিত দেবার প্রয়োজন মনে করিনে। অথচ, আমার বহু সহৃদয় পাঠক ধরে নিয়েছেন যে, আমি দেশভ্রমণের নাম শুনলেই মুক্তকচ্ছ হয়ে তদণ্ডেই বন্দর পানে ধাওয়া করি।
এ ধারণা সত্য নয়, কিন্তু তবু এটার প্রতিবাদ আমি করতুম না, যদি না এ ধারণা আমার প্রতি কিঞ্চিৎ অবিচার করত। কিংবা এটা যদি নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হত তা হলেও চুপ করে থাকলে কোনও ক্ষতি হত না। কিন্তু এ ব্যাপারে আমিই সবেধন উজ্জ্বল-নীলমণি নই, আমার চেয়েও হতভাগা গুটি কয়েক আছেন। তাই ব্যক্তিগত কাহিনী বলার সঙ্কোচ অনিচ্ছায় কাটাতে হল।
কেউ যখন বলে, ‘ফলনা দেশভ্রমণ করতে ভালোবাসে’ তখন সে বাক্যে আমি প্রশংসার চেয়ে নিন্দাই দেখতে পাই বেশি। এ যেন অনেকটা ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে, গামছা পর গিয়ে’। তার অর্থ মেয়েটা এমনি মারাত্মক রকমের হন্যে হয়ে উঠেছে বিয়ে করবার জন্য যে, বাপ-মা’র স্নেহ-ভালোবাসার তোয়াক্কা সে আর করে না, আপন বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে তার আর কোনও ক্ষোভ নেই, বিয়ের অপরিহার্য আনুষঙ্গিক শাড়ি-গয়না, বাজনাবাদ্যিরও তার প্রয়োজন নেই, আপন গামছাই পরে পড়ি-মরি হয়ে সে সাতপাক ঘুরবে।
পাঁড় দেশভ্রমণকারীর অর্থও তা-ই। যে মাটিতে তার নাড়ি পেতা আছে, যে নদীর জল খেয়ে সে আজ চলতে শিখেছে, যে আমজামকাঁঠাল তাকে ছায়া দিয়ে শ্যামল শীতল করে রেখেছ, যার প্রতিটি দূর্বাদল তার পদ-তাড়না কামনা করে তারা যেন কিছুই নয়, তারা যেন বানের জলে ভেসে-আসা, ফেলনা। গুরুদের আশীর্বাদ, বাপ-মায়ের স্নেহ, ভাইবোনের ভালোবাসা, বন্ধুজনের সদান্তরিকতা, এসব কথা আর তুললুম না, সেগুলো এতই শুচিশুদ্ধ পবিত্র যে, ওদের স্মরণকে কলঙ্কিত করে মহাপাতকী হতে চাইনে।
অসহিষ্ণু হয়ে শান্ত পাঠক বললেন, ‘কী জ্বালা, লোকটা তো আর চিরকালের তরে দেশত্যাগী হয়ে চলে যাচ্ছে না। দু দিন কিংবা দু বছর পরে আবার তো ফিরে আসবে। ইতোমধ্যে তোমার গাছগুলো তো আর রবি ঠাকুর-এর “হংস-বলাকার মতো ডানা মেলে আকাশের কিনারা খুঁজতে বেরিয়ে যাবে না, কিংবা নদীটি জনকতনয়ার অভিসম্পাতে অন্তঃসলিলা হয়ে যাবেন না, কিংবা–’
বেশ কথা। তা হলে কিছু বলার নেই। এবং সত্যি বলতে কী, সেইটেই কাম্য। আমাদের মুনিঋষিরা সেই নির্দেশই দিয়ে গিয়েছেন। আমাদের বাপ-পিতেমো তাই করেছেন। মুসলমান মৌলানা-দরবেশরা তাই বলেছেন। তাদের ব্যাটা-বাচ্চারা তাই করেছে।
তাই শাস্ত্রকার আদেশ দিয়েছেন, গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চা সমাপ্ত হলে পর তীর্থভ্রমণান্তে (‘দেশভ্রমণ’ কিংবা হালফিলের কথা ‘টুরিজম’) স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করত গৃহস্থাশ্রম-প্রবেশ কর্তব্য। তার পর আর দেশভ্রমণ-টেশভ্রমণের রা-টি কেড়োনি। নিতান্তই যদি বাউণ্ডুলেপনা করতে হয় তবে কর, প্রাণভরে কর, সন্ন্যাস নেবার পর। এমনকি, বাণপ্রস্থ যাবে জনপদভূমির প্রত্যন্ত প্রদেশে। সে অবস্থায়ও যত্রতত্র পর্যটন গহিত।
কিন্তু সন্ন্যাসের বাউণ্ডুলেগিরির প্রতি কর্তারা এত সদয় কেন? তার এক কারণ :
ভোগে রোগভয়ং, কুলে চ্যুতিভয়ং, বিত্তে নৃপা ভয়ং,
মানে দৈন্যভয়ং, বলে রিপুভয়ং, রূপে তরুণ্যা ভয়ং,
শাস্ত্রে বাদীভয়ং, গুণে খলভয়ং, কায়ে কৃতান্তা ভয়ং,
সর্ববস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবা ভয়ং ॥
শুধু বৈরাগ্যেই অভয়। তাই শাস্ত্রকার বলেছেন, যে-মুহূর্তে মনে বৈরাগ্যের উদয় হবে সেই মুহূর্তেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করবে। ব্রহ্মচর্য সমাপ্ত না করে গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করা যায় না, গার্হস্থ্য সমাপন না করে বাণপ্রস্থ গ্রহণ গর্হিত; কিন্তু সন্ন্যাস নেওয়া যায় যে-কোনও সময়ে– ডবল, ট্রিপল প্রমোশন নিয়ে।
কিন্তু সন্ন্যাস নেওয়ার পর আর গৃহে ফিরতে পারবে না। সেইটেই হল সবচেয়ে বড় কথা এবং সেই দিকেই বিশেষ করে আমি আমার পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সন্ন্যাস গ্রহণের পর কোনও জায়গাতেই তিন দিনের বেশি থাকবার নিয়ম নেই, এক বর্ষাকাল ছাড়া। বৌদ্ধ শ্ৰমণদেরও এই বিনয়’।
এর সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য কী? সন্ন্যাস গ্রহণ করলে আত্মার কি প্রসার হয় না-হয় সে সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করবার অধিকার আমার নেই; কিন্তু তাতে করে সমাজ ও সংস্কারের কী ক্ষতিবৃদ্ধি হয় সে সম্বন্ধে বলার অধিকার আমাদের মতো সংসারীদের নিশ্চয় আছে।
আমার মনে হয়, সন্ন্যাস নিয়ে পর্যটন করুন, আর সন্ন্যাস না নিয়ে টুরিস্টের মতো বাউণ্ডুলেপনা করুন, ফল একই। নানা দেশে নানা লোক, বহু সমাজবন্ধন, বহু উচ্ছলতা, বিস্তর ধর্মাচার এবং ততোধিক চার্বাকাঁচরণ দেখে দেখে মানুষের চিত্তের প্রসার হয় বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই প্রসারই তাকে দেশের রীতিনীতি সম্বন্ধে একদিক দিয়ে করে দেয় নির্বিকল্প উদাসীন, অন্যদিক দিয়ে আপন মাটি আপন গ্রামের কল্যাণ কামনায় নিস্পৃহ। ইংরেজিতে একেই বলে ‘জেডেড’, ফরাসিতে ‘ব্লাজে’। এই অবস্থার কল্পনা করেই জার নিকোলাস বলেছিলেন, ‘পরের বেদনা বুঝিতে না পারে, না ভাবে আপন সুখ’। গ্রাম্য ভাষায় একেই বলে ‘দড়কচ্চা হয়ে “ল্যাদা” মেরে যাওয়া’।
এইসব ‘ভবঘুরে’ তখন আর সমাজের ভেতর আপন আসন গ্রহণ করে কর্তব্যাচরণে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। প্রত্যেক সমাজেরই কতকগুলো অন্যায় বন্ধন থাকে, এককালে হয়তো সেগুলোর কোনও অর্থ ছিল, এখন লোকে ভুলে গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আবার মুক্তির রন্ধ্রও থাকে। এ দুয়ের টানাটানির মাঝখানের উত্তম পন্থাটি বের করার নামই সমাজ। আমাদের বাউণ্ডুলেটির কাছে দুটোই অর্থহীন। সে ঘোরাঘুরির ফলে দেখেছে বহু সমাজ, যেখানে অন্য বন্ধন, অন্য মুক্তি। দেশের সমাজের মূঢ়তা যেন তাকে বিচলিত করতে পারে না, তার আদর্শবাদও তাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না, তাই পূর্বেই নিবেদন করেছি, সন্ন্যাসগ্রহণের পর স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন নিষিদ্ধ।
আর যদি ধ্যান-ধারণা সাধনা-তপস্যার কথা তোলেন, তবে তার পরম শত্রু দেশভ্রমণ। গ্যোটে বলেছেন, ‘চরিত্রবল সৃষ্টি করতে হলে জনসমাজে মেশো, কিন্তু যদি প্রতিভার সম্যক প্রফুরণ তোমার কামনা হয়, তবে সাধনা কর নির্জনে।’
আর আমাদের অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ছবি দেখে যদি আমোদ পেতে চাও তবে আকাশে জলে-স্থলে প্রতি মুহূর্তে এত ছবি আঁকা হচ্ছে যে, তার হিসেব নিলেই সুখে চলে যাবে দিনগুলো–’
‘আর যদি ছবি লিখে আনন্দ পেতে চাও তবে আসন গ্রহণ কর এক জায়গায়, দিতে থাক তুলির টানে রঙের পোচ। এ দর্শকের আমোদ নয়, স্রষ্টার আনন্দ।’
চতুর্দিকে নিজেকে বিক্ষিপ্ত বিকীর্ণ করে দিলে এ আনন্দ পাওয়া যায় না।