সোমবার, ৫ অগাস্ট
প্রশ্ন এইঃ সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করতে গেলে কি সমুদয় নিম্নতর সোপান দিয়ে যেতে হবে, না একেবারে লাফিয়ে সেই অবস্থায় যাওয়া যেতে পারে? আধুনিক মার্কিন বালক আজ যে বিষয় পঁচিশ বছরে শিখে ফেলতে পারে, তার পূর্বপুরুষদের সে-বিষয়ে শিখতে এক-শ বছর লাগত। আধুনিক হিন্দু এখন বিশ বছরে সেই অবস্থায় আরোহণ করে, যে-অবস্থা লাভ করতে তার পূর্বপুরুষদের আটহাজার বছর লেগেছিল। শরীরের দৃষ্টি থেকে দেখলে দেখা যায়, গর্ভে ভ্রূণ সেই প্রাথমিক জীবাণুর (amoeba) অবস্থা থেকে আরম্ভ করে নানা অবস্থা অতিক্রম করে শেষে মানুষরূপে ধারণ করে। এই হল আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষা। বেদান্ত আরও অগ্রসর হয়ে বলেন, আমাদের শুধু মানবজাতির সমগ্র অতীত জীবনটা যাপন করলেই হবে না, সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ জীবনটাও যাপন করতে হবে। যিনি প্রথমটি করেন, তিনি শিক্ষিত ব্যক্তি; যিনি দ্বিতীয়টি করতে পারেন, তিনি ‘জীবন্মুক্ত’।
কাল বা সময় কেবল আমাদের চিন্তার পরিমাপক মাত্র, আর চিন্তার গতি অভাবনীয়ভাবে দ্রুত। কত দ্রুত আমরা ভাবী জীবনটা যাপন করতে পারি, তার কোন সীমা নির্দেশ করা যেতে পারে না। সুতরাং মানবজাতির সমগ্র ভবিষ্যৎ জীবন নিজ জীবনে অনুভব করতে কতদিন লাগবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারা যায় না। এক মুহূর্তে হতে পারে, কারও বা পঞ্চাশ জন্ম লাগতে পারে। এটা বাসনা বা ইচ্ছার তীব্রতার উপর নির্ভর করছে। সুতরাং শিষ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী উপদেশও ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হওয়া দরকার। জ্বলন্ত আগুন সকলের জন্যই রয়েছে—তাতে জল, এমন কি বরফের চাঙ্গড় পর্যন্ত নিঃশেষ করে দেয়। একরাশ ছট্রা দিয়ে বন্দুক ছোড়, অন্ততঃ একটাও লাগবে। লোককে একেবারে এক রাশ সত্য দিয়ে দাও, তারা তার মধ্যে যেটুকু নিজের উপযোগী তা নিয়ে নেবে। অতীত বহু জন্মের ফলে সংস্কার গঠিত হয়েছে, শিষ্যের প্রবণতা অনুযায়ী তাকে উপদেশ দাও। জ্ঞান, যোগ, ভক্তি ও কর্ম—এর মধ্যে যে-কোন একটি ভাবকে মূল ভিত্তি কর; কিন্তু অন্যান্য ভাবগুলিও সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা দাও। জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তি দিয়ে সামঞ্জস্য করতে হবে, যোগপ্রবণ প্রকৃতিকে যুক্তিবিচারের দ্বারা সামঞ্জস্য করতে হবে, আর কর্ম—তত্ত্বকে কাজে পরিণত করার সাধনা যেন সকল পথেরই অঙ্গস্বরূপ হয়। যে যেখানে আছে, তাকে সেইখান থেকে ঠেলে এগিয়ে দাও, ধর্মশিক্ষা যেন ধ্বংসমূলক না হয়ে সর্বদা গঠনমূলক হয়।
মানুষের প্রত্যেক প্রবৃত্তিই তার অতীতের কর্ম-সমষ্টির পরিচায়ক। এটি যেন সেই রেখা বা ব্যাসার্ধ, যেটি ধরে মানুষকে চলতে হবে। সকল ব্যাসার্ধ অবলম্বন করেই কেন্দ্রে যাওয়া যায়। অপরের স্বাভাবিক প্রবণতা উলটে দেবার এতটুকু চেষ্টাও কর না, তাতে গুরু এবং শিষ্য উভয়েই পেছিয়ে যায়। যখন তুমি ‘জ্ঞান’ শিক্ষা দিচ্ছ, তখন তোমাকে জ্ঞানী হতে হবে আর শিষ্য যে-অবস্থায় রয়েছে, তোমাকে মনে মনে ঠিক সেইখানে যেতে হবে। অন্যান্য যোগেও এইরূপ। প্রত্যেকটি বৃত্তি এমন ভাবে বিকশিত করতে হবে যে, যেন সেটি ছাড়া আমাদের অন্য কোন বৃত্তিই নেই—এই হচ্ছে তথাকথিত সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতিসাধনের যথার্থ রহস্য, অর্থাৎ গভীরতার সঙ্গে উদারতা অর্জন কর, কিন্তু গভীরতা হারিয়ে উদারতা চেও না। আমরা অনন্তস্বরূপ; আমাদের মধ্যে কোন কিছুর ‘ইতি’ করা যেতে পারে না। সুতরাং আমরা সবচেয়ে নিষ্ঠাবান্ মুসলমানের মত গভীর, অথচ ঘোরতর নাস্তিকের মত উদার-ভাবাপন্ন হতে পারি।
এটি কার্যে পরিণত করার উপায় হচ্ছে মনকে কোন বিষয়বিশেষে প্রয়োগ করা নয়, আদত মনটারই বিকাশ করা ও তাকে সংযত করা। তা হলেই তুমি তাকে যেদিকে ইচ্ছা ফেরাতে পারবে। এইরূপে তোমার গভীরতা ও উদারতা দুই-ই লাভ হবে। জ্ঞান এমনভাবে উপলব্ধি কর যে, যেন জ্ঞানই একমাত্র রয়েছে। তারপর ভক্তিযোগ, রাজযোগ, কর্মযোগ নিয়েও ঐভাবে সাধন কর। তরঙ্গ ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের দিকে যাও, তবেই তোমার ইচ্ছামত তরঙ্গ উৎপন্ন করতে পারবে। তোমার নিজের মন-রূপ হ্রদকে সংযত কর, তা না হলে তুমি অপরের মন-রূপ হ্রদের তত্ত্ব কখনও জানতে পারবে না।
তিনিই প্রকৃত আচার্য, যিনি তাঁর শিষ্যের প্রবণতা অনুযায়ী নিজের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করতে পারেন। প্রকৃত সহানুভূতি ব্যতীত আমরা কখনই ঠিক ঠিক শিক্ষা দিতে পারি না। মানুষ যে দায়িত্বপূর্ণ প্রাণী—এ ধারণা ছেড়ে দাও; কেবল পূর্ণতা-প্রাপ্ত ব্যক্তিরই দায়িত্বজ্ঞান আছে। অজ্ঞান ব্যক্তিরা মোহমদিরা পান করে মাতাল হয়েছে, তাদের সহজ অবস্থা নেই। তোমরা জ্ঞানলাভ করেছ—তোমাদের তাদের প্রতি অনন্ত-ধৈর্যসম্পন্ন হতে হবে। তাদের প্রতি ভালবাসা ছাড়া অন্য কোন প্রকার ভাব রেখ না; তারা যে-রোগে আক্রান্ত হয়ে জগৎটাকে ভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখছে, আগে সেই রোগ নির্ণয় কর; তারপর যাতে তাদের সেই রোগ সেরে যায়, আর তারা ঠিক ঠিক দেখতে পায়, সে বিষয়ে সাহায্য কর। সর্বদা স্মরণ রেখ যে, মুক্ত বা স্বাধীন পুরুষেরই কেবল স্বাধীন ইচ্ছা আছে—বাকী সকলেই বন্ধনের ভিতর রয়েছে—সুতরাং তারা যা করছে, তার জন্য তারা দায়ী নয়। ইচ্ছা যখন ইচ্ছারূপে প্রকাশিত, তখন তা বদ্ধ। জল যখন হিমালয়ের চূড়ায় গলতে থাকে, তখন স্বাধীন বা উন্মুক্ত, কিন্তু নদীরূপ ধারণ করলেই তটের দ্বারা বদ্ধ হয়ে যায়; তথাপি তার প্রাথমিক বেগই তাকে শেষে সমুদ্রে নিয়ে যায়, সেখানে ঐ জল আবার পূর্বের স্বাধীনতা ফিরে পায়। প্রথমটা যেন ‘মানবের পতন’ (Fall of Man) ও দ্বিতীয়টি যেন ‘পুনরুত্থান’ (Resurrection)। একটা পরমাণু পর্যন্ত স্থির হয়ে থাকতে পারে না—যতক্ষণ না সেটি মুক্তাবস্থা লাভ করছে।
কতকগুলি কল্পনা অন্য কল্পনাগুলির বন্ধন ভাঙতে সাহায্য করে। সমগ্র জগৎটাই কল্পনা, কিন্তু একরকমের কল্পনাসমষ্টি অপর প্রকারের কল্পনাসমষ্টিকে নষ্ট করে দেয়। যে-সব কল্পনা বলে—জগতে পাপ দুঃখ মৃত্যু রয়েছে, সে-সব কল্পনা বড় ভয়ানক; কিন্তু আর একরকমের কল্পনা বলে—‘আমি পবিত্রস্বরূপ, ঈশ্বর আছেন, জগতে দুঃখ নাই’, এইগুলিই শুভ কল্পনা, আর এগুলিই অন্যান্য কল্পনার বন্ধন ভাঙতে সাহায্য করে। সগুণ ঈশ্বরই মানবের সর্বোচ্চ কল্পনা, যা আমাদের বন্ধন-শৃঙ্খলের পাবগুলি সব ভেঙে দিতে পারে।
‘ওঁ তৎ সৎ’ অর্থাৎ একমাত্র সেই নির্গুণ ব্রহ্মই মায়ার অতীত, কিন্তু সগুণ ঈশ্বরও নিত্য। যতদিন নায়াগারা-প্রপাত রয়েছে, ততদিন তাতে প্রতিফলিত রামধনুও রয়েছে; কিন্তু এদিকে প্রপাতের জলরাশি ক্রমাগত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। ঐ জলপ্রপাত জগৎপ্রপঞ্চ স্বরূপ, আর রামধনু সগুণ ঈশ্বরস্বরূপ; এই দুইটিই নিত্য। যতক্ষণ জগৎ রয়েছে, ততক্ষণ জগদীশ্বর অবশ্যই আছেন। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করছেন, আবার জগৎ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করছে—দুই-ই নিত্য সত্য। মায়া সৎও নয়, অসৎও নয়। নায়াগারা-প্রপাত ও রামধনু উভয়ই অনন্ত কাল ধরে পরিবর্তনশীল—এরা মায়ার মধ্য দিয়ে দৃষ্ট ব্রহ্ম। জরাথুস্ট্রীয় ও খ্রীষ্টানেরা মায়াকে দু-ভাগে ভাগ করে ভাল অর্ধেকটাকে ‘ঈশ্বর’ ও মন্দ অর্ধেকটাকে ‘শয়তান’ নাম দিয়েছেন। বেদান্ত মায়াকে সমষ্টি বা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন এবং তার পশ্চাতে ব্রহ্মরূপ এক অখণ্ড বস্তুর সত্তা স্বীকার করেন।
মহম্মদ দেখলেন খ্রীষ্টধর্ম সেমিটিক ভাব থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, ঐ সেমিটিক ভাবের মধ্যে থেকেই খ্রীষ্টধর্মের কিরূপ হওয়া উচিত—তার যে একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করা উচিত—এইটিই তাঁর উপদেশের বিষয়। ‘আমি ও আমার পিতা এক’—এই আর্যোচিত উপদেশের উপর তিনি বড়ই বিরক্ত ছিলেন, ঐ উপদেশে তিনি ভয় পেতেন। প্রকৃতপক্ষে মানব থেকে নিত্য পৃথক্ জিহোবা-সম্বন্ধীয় দ্বৈত ধারণার চেয়ে ত্রিত্ববাদ (Trinity) অনেক উন্নত। যে ভাব-পরম্পরা ক্রমশঃ ঈশ্বর ও মানবের একত্বজ্ঞান এনে দেয়, অবতারবাদ তার প্রথম ভাব। লোকে প্রথম বোঝে, ঈশ্বর একজন মানবের দেহে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তারপর দেখে বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন মানবদেহে আবির্ভূত হয়েছেন, অবশেষে দেখতে পায়—তিনি সব মানুষের ভিতর রয়েছেন। অদ্বৈতবাদ সর্বোচ্চ অবস্থা, একেশ্বরবাদ তার চেয়ে নীচের স্তর। বিচারযুক্তির চেয়েও কল্পনা তোমায় শীঘ্র ও সহজে সেই সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে যাবে।
অন্ততঃ কয়েকজন লোক কেবল ঈশ্বরলাভের জন্য চেষ্টা করুক, আর সমগ্র জগতের জন্য ধর্ম জিনিষটা রক্ষা করুক। ‘আমি জনক রাজার মত নির্লিপ্ত’— একথা বলে ভান কর না। তুমি জনক বটে, কিন্তু মোহ বা অজ্ঞানের জনকমাত্র।৭৫ অকপট হয়ে বল, ‘আদর্শ কি, তা আমি বুঝতে পারছি বটে, কিন্তু এখনও তার কাছে এগোতে পারছি না।’ বাস্তবিক ত্যাগ না করে ত্যাগ করবার ভান কর না। যদি বাস্তবিক ত্যাগ কর, তবে দৃঢ়ভাবে ঐ ত্যাগকে ধরে থাক। লড়াইয়ে এক-শ লোকের পতন হোক না, তবু তুমি পতাকা তুলে নাও এবং এগিয়ে যাও; যে পড়ে পড়ুক না কেন, তা সত্ত্বেও ঈশ্বর সত্য। যুদ্ধে যার পতন হবে, সে যেন অপরের হাতে পতাকাটি দিয়ে যায়—যাতে সে ঐ পতাকা বহন করে নিয়ে যেতে পারে। পতাকা কখনও ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না।
* * *
বাইবেলে আছে—প্রথমে ভগবানের রাজ্য অন্বেষণ কর, আর যা কিছু তা তোমাকে দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমি বলি, যখন ধুয়ে পুঁছে পরিষ্কার হলাম, তখন আবার অশুচিতা আমাতে জুড়ে দেবার কি দরকার? তাই বলি, প্রথমেই স্বর্গরাজ্য অন্বেষণ কর, আর বাকী যা কিছু সব চলে যাক। তোমাতে নূতন কিছু আসুক—এ কামনা কর না, বরং সবকিছু ত্যাগ করতে পারলেই খুশী হও। ত্যাগ কর, আর জেন—তুমি দেখতে না পেলেও সফলতা লাভ তুমি করবেই। যীশু বারটি জেলে শিষ্য রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ অল্প ক-টি লোকেই প্রবল রোমক সাম্রাজ্য উড়িয়ে দিয়েছিল।
ঈশ্বরের বেদীতে পৃথিবীর মধ্যে পবিত্রতম ও সর্বোৎকৃষ্ট যা কিছু, তাই বলিস্বরূপ অর্পণ কর। যিনি ত্যাগের চেষ্টা কখনও করেন না, তাঁর চেয়ে যিনি চেষ্টা করেন, তিনি অনেক ভাল। একজন ত্যাগীকে দেখলেই হৃদয় পবিত্র হয়। ঈশ্বরকে লাভ করব—কেবল তাঁকেই চাই—এই বলে দৃঢ়পদে দাঁড়াও, দুনিয়ার যা হবার হোক; ঈশ্বর ও সংসার—এই দুই-এর মধ্যে কোন আপস করতে যেও না। সংসার ত্যাগ কর, কেবল তা হলেই দেহবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে। আর ঐরূপে দেহে আসক্তি চলে যাবার পর দেহত্যাগ হলেই তুমি ‘আজাদ’ বা মুক্ত হলে। মুক্ত হও, শুধু দেহের মৃত্যু আমাদের কখনও মুক্ত করতে পারে না। বেঁচে থাকতে থাকতেই আমাদের নিজ চেষ্টায় মুক্তিলাভ করতে হবে। তবেই যখন দেহপাত হবে, তখন সেই মুক্ত পুরুষের আর পুনর্জন্ম হবে না।
সত্যকে সত্যের দ্বারা বিচার করতে হবে, অন্য কিছুর দ্বারা নয়। লোকের হিত করাই সত্যের কষ্টিপাথর নয়। সূর্যকে দেখবার জন্য আর মশালের দরকার করে না। যদি সত্য সমগ্র জগৎকে ধ্বংস করে, তা হলেও তা সত্যই—ঐ সত্য ধরে থাকো।
ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠানগুলি করা সহজ—এগুলিই সাধারণকে আকর্ষণ করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাহ্য অনুষ্ঠানে কিছু নেই।
‘মাকড়সা যেমন নিজের ভিতর থেকে জাল বিস্তার করে, আবার তাকে নিজের ভিতর গুটিয়ে নেয়, সেইরূপ ঈশ্বরই এই জগৎপ্রপঞ্চ বিস্তার করেন, আবার নিজের ভিতর টেনে নেন!’৭৬
মঙ্গলবার, ৬ অগাস্ট
‘আমি’ না থাকলে বাইরে ‘তুমি’ থাকতে পারে না। এই থেকে কতকগুলি দার্শনিক এই সিদ্ধান্ত করলেন যে ‘আমাতে’ ছাড়া বাহ্য জগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ‘তুমি’ কেবল ‘আমা’তেই রয়েছে। অপরে আবার ঠিক এর বিপরীত তর্ক করে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে, ‘তুমি’ না থাকলে ‘আমার’ অস্তিত্ব প্রমাণই হতে পারে না। তাঁদের পক্ষেও যুক্তির বল সমান। এই দুটো মতই আংশিক সত্য—খানিকটা সত্য, খানিকটা মিথ্যা। দেহ যেমন জড় ও প্রকৃতির উপাদানে গঠিত, চিন্তাও তাই। জড় ও মন উভয়ই একটা তৃতীয় পদার্থে অবস্থিত—এক অখণ্ড বস্তু আপনাকে দু-ভাগ করে ফেলেছে। এই এক অখণ্ড বস্তুর নাম ‘আত্মা’।
সেই মূল সত্তা যেন ‘ক’, সেটিই মন ও জড়—উভয়রূপে নিজেকে প্রকাশ করছে। এই পরিদৃশ্যমান জগতে এর গতি কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রণালী অবলম্বন করে হয়ে থাকে, সেগুলিকেই আমরা ‘নিয়ম’ বলি। এক অখণ্ড সত্তা-রূপে তা মুক্তস্বভাব, বহু-রূপে সেটি নিয়মের অধীন। তথাপি এই বন্ধন সত্ত্বেও আমাদের ভিতর একটা মুক্তির ধারণা সদাসর্বদা বর্তমান রয়েছে, এরই নাম নিবৃত্তি অর্থাৎ ‘আসক্তি ত্যাগ করা’। আর বাসনাবশে যে-সব জড়ত্ববিধায়িনী শক্তি আমাদের সাংসারিক কার্যে বিশেষভাবে প্রবৃত্ত করে; তাদেরই নাম প্রবৃত্তি।
সেই কাজটাকেই নীতিসঙ্গত বা সৎ কর্ম বলা যায়, যা আমাদের জড়ের বন্ধন থেকে মুক্ত করে; তার বিপরীত যা, তা অসৎ কর্ম। এই জগৎপ্রপঞ্চকে অনন্ত বোধ হচ্ছে, কারণ এর মধ্যে সব জিনিষই চক্রগতিতে চলছে; যেখান থেকে এসেছে, সেইখানেই ফিরে যাচ্ছে। বৃত্তের রেখাটি বর্ধিত হয়ে আবার নিজের সঙ্গে মিলে যায়, সুতরাং এখানে—এই সংসারে—কোনখানে বিশ্রাম বা শান্তি নেই। এই সংসার বৃত্ত থেকে আমাদের বেরুতেই হবে। মুক্তিই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য—একমাত্র গতি।
মন্দের কেবল আকার বদলায়, কিন্তু তার গুণগত কোন পরিবর্তন হয় না। প্রাচীনকালে যার শক্তি ছিল, সেই শাসন করত, এখন ধূর্ততা শক্তির স্থান অধিকার করেছে। দুঃখকষ্ট আমেরিকায় যত তীব্র, ভারতে তত নয়; কারণ এখানে (আমেরিকায়) গরীব লোক নিজেদের দুরবস্থার সঙ্গে অপরের অবস্থার খুব বেশী প্রভেদ দেখতে পায়।
ভাল মন্দ—এই দুটো অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত—একটাকে নিতে গেলে অপরটাকে নিতেই হবে। এই জগতের শক্তিমানসমষ্টি যেন একটা হ্রদের মত—ওতে যেমন তরঙ্গের উত্থান আছে, ঠিক তদনুযায়ী একটা পতনও আছে। সমষ্টিটা সম্পূর্ণ এক—সুতরাং একজনকে সুখী করা মানেই আর এক জনকে অসুখী করা। বাইরের সুখ জড়সুখ মাত্র, আর তার পরিমাণ নির্দিষ্ট। সুতরাং এককণা সুখও পেতে গেলে তা অপরের কাছ থেকে কেড়ে না নিয়ে পাওয়া যায় না। কেবল যা জড়জগতের অতীত সুখ, তা কারও কিছু হানি না করে পাওয়া যেতে পারে। জড়সুখ কেবল জড়দুঃখের রূপান্তর মাত্র।
যারা ঐ তরঙ্গের উত্থানাংশে জন্মেছে ও সেইখানে রয়েছে, তারা তার পতনাংশটা—আর তাতে কি আছে, তা দেখতে পায় না। কখনও মনে কর না, তুমি জগৎকে ভাল ও সুখী করতে পার। ঘানির বলদ তার সামনে বাঁধা খড়ের গোছা পাবার জন্য চেষ্টা করে বটে, কিন্তু কোন কালে তার কাছে পৌঁছতে পারে না, কেবল ঘানি ঘোরাতে থাকে মাত্র। আমরাও এইরূপে সুখরূপ আলেয়ার অনুসরণ করছি—সর্বদাই সেটা আমাদের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, আর আমরা শুধু প্রকৃতির ঘানিই ঘোরাচ্ছি। এইরূপ ঘানি টানতে টানতে আমাদের মৃত্যু হল, তারপর আবার ঘানি টানা আরম্ভ হবে। যদি আমরা অশুভকে দূর করে দিতে পারতাম, তা হলে আমরা কখনই কোন উচ্চতর বস্তুর আভাস পর্যন্ত পেতাম না; আমরা তা হলে সন্তুষ্ট হয়ে থাকতাম, কখনও মুক্ত হবার জন্য চেষ্টা করতাম না। যখন মানুষ বুঝতে পারে, জড়জগতে সুখ অন্বেষণের সকল প্রচেষ্টা একেবারে নিরর্থক, তখনই ধর্মের আরম্ভ। মানুষের যত রকম জ্ঞান আছে, সবই ধর্মের অঙ্গমাত্র।
মানবদেহে ভাল-মন্দের এমন ভারসাম্য বজায় আছে যে, তাইতেই মানুষের এ উভয় থেকে মুক্তিলাভ করবার ইচ্ছার সম্ভাবনা রয়েছে।
মুক্ত যে, সে কোনকালেই বদ্ধ হয়নি। মুক্ত কি করে বদ্ধ হল—এই প্রশ্নটাই অযৌক্তিক। যেখানে কোন বন্ধন নেই, সেখানে কার্যকারণ-ভাবও নেই। ‘স্বপ্নে আমি একটা শেয়াল হয়েছিলাম, আর একটা কুকুর আমায় তাড়া করেছিল’—এখন আমি কি করে প্রশ্ন করতে পারি যে, কুকুর কেন আমায় তাড়া করেছিল? শেয়ালটা স্বপ্নেরই একটা অংশ, আর কুকুরটাও ঐ সঙ্গে আপনা হতেই এসে জুটল; কিন্তু দুই-ই স্বপ্ন, বাইরে এদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। আমরা যাতে এই বন্ধনের বাইরে যেতে পারি, বিজ্ঞান ও ধর্ম দুই-ই আমাদের সে-বিষয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করছে। তবে ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে প্রাচীন, আর আমাদের এই কুসংস্কার রয়েছে যে, ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে পবিত্র। এক হিসাবে পবিত্রও বটে, কারণ ধর্ম নীতি বা চরিত্রকে (morality) তার একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ বলে মনে করে, কিন্তু বিজ্ঞান তা করে না।
‘পবিত্রাত্মারা ধন্য, কারণ তাঁরা ঈশ্বরকে দর্শন করবেন। যদি সব শাস্ত্র এবং সব অবতার লুপ্ত হয়ে যায়, তথাপি এই একটিমাত্র বাক্য সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করবে। অন্তরের এই পবিত্রতা থেকেই ঈশ্বর-দর্শন হবে। সমগ্র বিশ্বসঙ্গীতে এই পবিত্রতাই ধ্বনিত হচ্ছে। পবিত্রতায় কোন বন্ধন নেই। পবিত্রতা দ্বারা অজ্ঞানের আবরণ দূর করে দাও, তা হলেই আমাদের যথার্থ স্বরূপের প্রকাশ হবে, আর আমরা জানতে পারব—আমরা কোন কালে বদ্ধ হইনি। নানাত্ব-দর্শনই জগতের মধ্যে সব চেয়ে বড় পাপ—সবকিছুকেই আত্মরূপে দর্শন কর ও সকলকেই ভালবাসো। ভেদভাব সব একেবারে দূর করে দাও।
* * *
পিশাচপ্রকৃতি লোকও ক্ষত বা পোড়া ঘায়ের মত আমার দেহের একটা অংশ। যত্ন করে তাকে ভাল করে তুলতে হবে। দুষ্ট লোককেও ক্রমাগত সাহায্য করতে থাক, যতক্ষণ না সে সম্পূণ সেরে যাচ্ছে এবং অবার সুস্থ ও সুখী হচ্ছে।
আমরা যতদিন আপেক্ষিক বা দ্বৈতভূমিতে রয়েছি, ততদিন আমাদের বিশ্বাস করবার অধিকার আছে যে, এই আপেক্ষিক জগতের বস্তু দ্বারা আমাদের অনিষ্ট হতে পারে, আবার ঠিক সেই ভাবে সাহায্যও পেতে পারি। এই সাহায্য-ভাবের সূক্ষ্মতম ভাবকেই আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি। ঈশ্বর বলতে আমাদের ধারণা আসে যে, আমরা যত প্রকার সাহায্য পেতে পারি, তিনি তার সমষ্টিস্বরূপ।
যা-কিছু আমাদের প্রতি করুণাসম্পন্ন, যা-কিছু কল্যাণকর, যা-কিছু আমাদের সহায়ক, ঈশ্বর সেই সকলের সার সমষ্টিস্বরূপ। ঈশ্বরসমন্ধে আমাদের এই একমাত্র ধারণা থাকা উচিত। আমরা যখন নিজেদের আত্মরূপে ভাবি, তখন আমাদের কোন দেহ নেই, সুতরাং ‘আমি ব্রহ্ম, বিষও আমার কিছু ক্ষতি করতে পারে না’—এই কথাটাই একটা অসম্ভব বাক্য। যতক্ষণ আমাদের দেহ রয়েছে, আর সেই দেহটাকে আমরা দেখছি, ততক্ষণ আমাদের ঈশ্বরোপলব্ধি হয়নি। নদীটাই যখন লুপ্ত হল, তখন তার ভিতরের ছোট আবর্তটা কি আর থাকতে পারে? সাহায্যের জন্য কাঁদ দেখি, তা হলে সাহায্য পাবে—আর অবশেষে দেখবে, সাহায্যের জন্য কান্নাও চলে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যদাতাও চলে গেছেন; খেলা শেষ হয়ে গেছে, বাকী রয়েছেন কেবল আত্মা।
একবার এইটি হয়ে গেলে ফিরে এসে যেমন খুশী খেলা কর। তখন আর এই দেহের দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হতে পারে না; কারণ যতদিন না আমাদের ভিতরে কুপ্রবৃত্তিগুলো সব পুড়ে যাচ্ছে, ততদিন মুক্তিলাভ হবে না; যখন ঐ অবস্থালাভ হয়, তখন আমাদের সব ময়লা পুড়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে নির্ধূম শিখা, তাপ নেই—আলো আছে।৭৭
তখন প্রারব্ধ আমাদের দেহটাকে চালিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু তার দ্বারা তখন কেবল ভাল কাজই হতে পারে, কারণ মুক্তিলাভ হবার পূর্বে সব মন্দ চলে গেছে। চোর ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মরবার সময় তার প্রাক্তন-কর্মের ফল লাভ করলে। পূর্বজন্মে সে যোগী ছিল, যোগভ্রষ্ট হওয়াতে তাকে জন্মাতে হয়; এ জন্মেও পতন হওয়াতে তাকে চোর হতে হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব জন্মে সে যে শুভকর্ম করেছিল, তার ফল ফলল। তার যখন মুক্তিলাভ হবার সময় হল, তখনই তার যীশুখ্রীষ্টের সঙ্গে দেখা হল, আর তাঁর এক কথায় সে মুক্ত হয়ে গেল।
বুদ্ধ তাঁর প্রবলতম শত্রুকেও মুক্তি দিয়েছিলেন, কারণ সে ব্যক্তি তাঁকে এত দ্বেষ করত যে, ঐ দ্বেষবশে সে সর্বদা তাঁর চিন্তা করত। ক্রমাগত বুদ্ধের এত চিন্তায় তার চিত্তশুদ্ধি-লাভ হয়েছিল, আর সে মুক্তিলাভ করবার উপযুক্ত হয়েছিল। অতএব সর্বদা ঈশ্বরের চিন্তা কর, ঐ চিন্তার দ্বারা তুমি পবিত্র হয়ে যাবে।
* * *
(এই ভাবেই শেষ হইয়া গেল আমাদের প্রিয়তম গুরুদেবের ‘দিব্যবাণী’, পরদিন স্বামীজী সহস্রদ্বীপোদ্যান হইতে নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া যান।)