মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই
(ভগবদ্গীতা—কর্মযোগ)
কর্মের দ্বারা মুক্তিলাভ করতে হলে নিজেকে কর্মে নিযুক্ত কর, কিন্তু কোন কামনা কর না—ফলাকাঙ্ক্ষা যেন তোমার না থাকে। এইরূপ কর্মের দ্বারা জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে—ঐ জ্ঞানের দ্বারা মুক্তি হয়। জ্ঞানলাভ করবার পূর্বে কর্মত্যাগ করলে তাতে দুঃখই এসে থাকে। ‘আত্মা’র জন্য কর্ম করলে তা থেকে কোন বন্ধন আসে না। কর্ম থেকে সুখের আকাঙ্ক্ষাও কর না; আবার কর্ম করলে কষ্ট হবে—এ ভয়ও কর না। দেহ-মনই কাজ করে থাকে, আমি করি না। সদাসর্বদা নিজেকে এই কথা বলো এবং এটি প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা কর। চেষ্টা কর—যাতে তোমার বোধই হবে না যে, তুমি কিছু করছ।
সমুদয় কর্ম ভগবানে অর্পণ কর। সংসারে থাকো, কিন্তু সংসারের হয়ে যেও না—যেমন পদ্মপত্রের মূলগুলি পাঁকের মধ্যে থাকে, কিন্তু তা যেমন সদাই শুদ্ধ থাকে, সেইরূপ লোকে তোমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার করুক না, তোমার ভালবাসা যেন কারও প্রতি কম না হয়। যে অন্ধ, তার রঙের জ্ঞান নেই, সুতরাং আমার নিজের ভিতর দোষ না থাকলে অপরের ভিতর দোষ দেখব কি করে? আমরা আমাদের নিজেদের ভিতর যা রয়েছে, তার সঙ্গে বাইরে যা দেখতে পাই, তার তুলনা করি এবং তদনুসারেই কোন বিষয়ে আমাদের মতামত দিয়ে থাকি। যদি আমরা নিজেরা পবিত্র হই, তবে বাইরে অপবিত্রতা দেখতে পাব না। বাইরে অপবিত্রতা থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তার অস্তিত্ব থাকবে না। প্রত্যেক নরনারী, বালকবালিকার ভিতর ব্রহ্মকে দর্শন কর, ‘অন্তর্জ্যোতিঃ’ দ্বারা তাঁকে দেখ, যদি সর্বত্র সেই ব্রহ্মদর্শন হয়, তবে আমরা আর অন্য কিছু দেখতে পাব না। এই সংসারটাকে চেও না, কারণ যে যা চায়, সে তাই পায়। ভগবানকে—কেবল ভগবানকেই অন্বেষণ কর। যত অধিক ক্ষমতা-লাভ হবে, ততই বন্ধন আসবে, ততই ভয় আসবে। একটা সামান্য পিঁপড়ের চেয়ে আমরা কত অধিক ভীত ও দুঃখী। এই সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চের বাইরে ভগবানের কাছে যাও। স্রষ্টার তত্ত্ব জানবার চেষ্টা কর, সৃষ্টের তত্ত্ব জানবার চেষ্টা কর না।
‘আমিই কর্তা ও আমিই কার্য।’ ‘যিনি কামক্রোধের বেগধারণ করতে পারেন, তিনি মহাযোগী-পুরুষ।’৫০
‘অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারাই কেবল মনকে নিরোধ করা যেতে পারে।’৫১
* * *
আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধীর স্থির হয়ে ধর্ম ও ঈশ্বর সম্বন্ধে চিন্তা করে গেছেন, ফলে আমাদেরও ঐ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবার জন্য মস্তিষ্কটুকু রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা লাভের আশায় যে-রকম ছুটোছুটি আরম্ভ করেছি, তাতে সেটি নষ্ট হবার যোগাড় হচ্ছে।
* * *
শরীরের নিজেরই নিজেকে আরোগ্য করবার একটা শক্তি আছে—আর মানসিক অবস্থা, ঔষধ, ব্যায়াম প্রভৃতি নানা বিষয় এই আরোগ্য-শক্তিকে জাগিয়ে দিতে পারে। যতদিন আমরা প্রাকৃতিক অবস্থাচক্রের দ্বারা বিচলিত হই, ততদিন আমাদের জড়ের সহায়তা প্রয়োজন। আমরা যতদিন না স্নায়ুসমূহের দাসত্ব কাটাতে পারছি, ততদিন জড়ের সাহায্য আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
আমাদের সাধারণ জ্ঞানভূমির নীচে মনের আর এক ভূমি আছে—তাকে ‘অজ্ঞানভূমি’ বা ‘অবচেতন মন’ বলা যেতে পারে; আমরা যাকে সমগ্র মানুষ বলি, জ্ঞান তার একটা অংশমাত্র। দর্শনশাস্ত্র মন সম্বন্ধে কতকগুলি আন্দাজমাত্র। ধর্ম কিন্তু প্রত্যক্ষানুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত—প্রত্যক্ষদর্শন জ্ঞানের একমাত্র ভিত্তি। মন যখন জ্ঞানেরও অতীত ভূমিতে চলে যায়, তখন সে যথার্থ বস্তু—যথার্থ বিষয়কেই উপলব্ধি করে। ‘আপ্ত’ তাঁদের বলে, যাঁরা ধর্মকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা যে উপলব্ধি করেছেন, তার প্রমাণ এই যে, তুমিও যদি তাঁদের প্রণালী অনুসরণ কর, তুমিও প্রত্যক্ষ করবে। প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব বিশেষ প্রণালী ও বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। একজন জ্যোতির্বিদ্ রান্নাঘরের সমস্ত হাঁড়িকুড়ির সাহায্য নিয়ে শনিগ্রহের বলয়গুলি দেখাতে পারেন না, তার জন্য দূরবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন। সেইরূপ ধর্মের মহান্ সত্যাসমূহ দেখতে হলে, যারাঁ পূর্বেই সেগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের প্রণালীগুলি অনুসরণ করতে হবে। যে বিজ্ঞান যত বড়, তার শিক্ষা করবার উপায়ও তত নানাবিধ। আমরা সংসারে আসবার পূর্বেই ভগবান্ এ থেকে বেরুবার উপায়ও করে রেখেছেন। সুতরাং আমাদের চাই—শুধু সেই উপায়টাকে জানা। তবে বিভিন্ন প্রণালী নিয়ে মারামারি কর না; কেবল যাতে তোমার অপরোক্ষানুভূতি হয়, তার চেষ্টা কর, আর যে সাধনপ্রণালী তোমার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী হয়, তাই অবলম্বন কর। তুমি আম খেয়ে যাও, অপরে ঝুড়িটা নিয়ে ঝগড়া করুক। খ্রীষ্টকে দর্শন কর, তবে তুমি যথার্থ খ্রীষ্টান হবে। আর সবই বাজে কথামাত্র—কথা যত কম হয়, ততই ভাল।
জগতে যার কিছু বার্তা বহন করবার বা শিক্ষা দেবার থাকে, তাকেই ‘বার্তাবহ’ বা দূত বলা যেতে পারে; দেবতা থাকলে তবেই তাকে মন্দির বলা যেতে পারে, এর বিপরীতটা সত্য নয়।
ততদিন পর্যন্ত শিক্ষা কর, যতদিন পর্যন্ত না তোমার মুখ ব্রহ্মবিদের মত প্রতিভাত হয়, যেমন সত্যকামের হয়েছিল।৫২
আনুমানিক জ্ঞানের বিরুদ্ধে আনুমানিক জ্ঞান নিয়ে কথা বললেই ঝগড়া বাধে। কিন্তু যা প্রত্যক্ষ দর্শন করেছ, তারই সম্বন্ধে কথা বল দেখি—কোন মনুষ্যহৃদয়ই তাকে স্বীকার না করে পারবে না। প্রত্যক্ষানুভূতি করাতেই সেণ্ট পল্কে (St. Paul) ইচ্ছার বিরুদ্ধে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল।
ঐদিন, অপরাহ্ণ
(মধ্যাহ্ন-ভোজনের পর অল্পক্ষণ কথাবার্তা হয়—সেই কথাবার্তা-প্রসঙ্গে স্বামীজী বলেনঃ)
ভ্রমই ভ্রমকে সৃষ্টি করে থাকে। ভ্রম নিজেকেই নিজে সৃষ্টি করে, আবার নিজেকেই নিজে ধ্বংস করে। একেই বলে ‘মায়া’। যেহেতু তথাকথিত সমুদয় জ্ঞানেরই ভিত্তি মায়া, ঐ জ্ঞান ‘অন্যোন্যাশ্রয়দোষদুষ্ট’। এমন এক সময় আসে—যখন ঐ জ্ঞান নিজেই নিজেকে নষ্ট করে। ‘ছেড়ে দাও রজ্জু—যাহে আকর্ষণ।’ ভ্রম কখনও আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। যখনই আমরা সেই দড়িটাকে ধরি, মায়ার সহিত নিজেদের এক করে ফেলি, তখনই মায়া আমাদের উপর শক্তি বিস্তার করে। মায়াকে ছেড়ে দাও, কেবল সাক্ষিস্বরূপ হয়ে থাক। তা হলেই অবিচলিত থেকে জগৎপ্রপঞ্চ-রূপ ছবির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে পারবে।
বুধবার, ২৪ জুলাই
যিনি যোগে সম্পূর্ণ সিদ্ধিলাভ করেছেন, তাঁর পক্ষে যোগসিদ্ধিগুলি বিঘ্ন নয়, কিন্তু প্রবর্তকের পক্ষে সেগুলি বিঘ্নস্বরূপ হতে পারে, কারণ ঐগুলি প্রয়োগ করতে করতে ঐ-সবে একটা আনন্দ ও বিস্ময়ের ভাব আসতে পারে। সিদ্ধি বা বিভূতিগুলি যোগসাধনার পথে যে ঠিক ঠিক অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে, তারই চিহ্নস্বরূপ; কিন্তু সেগুলি মন্ত্রজপ, উপবাসাদি, তপস্যা, যোগসাধন, এমন কি ঔষধ-বিশেষের ব্যবহারের দ্বারাও আসতে পারে। যে যোগী যোগসিদ্ধিসমূহেও বৈরাগ্য অবলম্বন করেন এবং সমুদয় কর্মফল ত্যাগ করেন, তাঁর ‘ধর্মমেঘ’ নামে সমাধিলাভ হয়। যেমন মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করে, তেমনি তিনি যে যোগাবস্থা লাভ করেন, তা চারিদিকে ধর্ম বা পবিত্রতার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
যখন একরূপ প্রত্যয়ের ক্রমাগত আবৃত্তি হতে থাকে, তখনই সেটা ধ্যান-পদবাচ্য, কিন্তু সমাধি এক বস্তুতেই হয়ে থাকে।
মন আত্মার জ্ঞেয়, কিন্তু মন স্বপ্রকাশ নয়। আত্মা কোন বস্তুর কারণ হতে পারে না। কিরূপে হবে? পুরুষ প্রকৃতিতে যুক্ত হবে কিরূপে? পুরুষ প্রকৃতপক্ষে কখনও প্রকৃতিতে যুক্ত হন না, অবিবেকের দরুন বোধ হয়—পুরুষ প্রকৃতিতে যুক্ত হয়েছে।
* * *
লোককে করুণার চক্ষে না দেখে, অথবা তারা অতি হীন দশায় পড়ে আছে—এ-রকম মনে না করে, অপরকে সাহায্য করতে শিক্ষা কর। শত্রু-মিত্র উভয়ের প্রতি সমদৃষ্টি হতে শিক্ষা কর; যখন তা হতে পারবে, আর যখন তোমার কোন বাসনা থাকবে না, তখন তোমার চরমাবস্থা লাভ হয়েছে—বুঝতে হবে।
বাসনারূপ অশ্বত্থবৃক্ষকে অনাসক্তিরূপ কুঠার দ্বারা কেটে ফেল, তা হলেই তা একেবারে চলে যাবে—ও তো একটা ভ্রমমাত্র। ‘যাঁর মোহ ও শোক চলে গেছে, যিনি সঙ্গদোষ জয় করেছেন, তিনিই কেবল ‘আজাদ’ বা মুক্ত।’
কোন ব্যক্তিকে বিশেষভাবে—ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসা হচ্ছে বন্ধন। সকলকে সমানভাবে ভালবাসো, তা হলে সব বাসনা চলে যাবে।
সর্বভক্ষক কাল এলে সকলকেই যেতে হবে; অতএব পৃথিবীর উন্নতির জন্য—ক্ষণস্থায়ী প্রজাপতিকে রংচঙে করবার জন্য কেন চেষ্টা কর? সবই তো শেষে চলে যাবে। সাদা ইঁদুরের মত খাঁচায় বসে কেবল ডিগবাজি খেও না; সদাই ব্যস্ত অথচ প্রকৃত কাজ কিছু হচ্ছে না। বাসনা ভালই হোক আর মন্দই হোক, বাসনা জিনিষটাই খারাপ। এ যেন কুকুরের মত মাংসখণ্ড পাবার জন্য দিনরাত লাফান, অথচ মাংসের টুকরোটা ক্রমাগত সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, আর শেষ পর্যন্ত কুকুরের মত মৃত্যু। ও-রকম হয়ো না। সমস্ত বাসনা নষ্ট করে ফেল।
* * *
পরমাত্মা যখন মায়াধীশ, তখন তিনি ঈশ্বর; পরমাত্মা যখন মায়ার অধীন, তখনই তিনি জীবাত্মা। সমুদয় জগৎপ্রপঞ্চের সমষ্টিই মায়া, একদিন সেটা একেবারে উড়ে যাবে।
বৃক্ষের বৃক্ষত্বটা মায়া—গাছ দেখবার সময় আমরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মস্বরূপকেই দেখছি, মায়া-আবরণে ঢাকা। কোন ঘটনা সম্বন্ধে ‘কেন’—এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসাটাই মায়ার অন্তর্গত। সুতরাং ‘মায়া কিরূপে এল?’—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বৃথা, কারণ মায়ার মধ্য থেকে ওর উত্তর কখনও দেওয়া যেতে পারে না; আর মায়ার পরে কে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে? মন্দ বা মায়া অসদ্দৃষ্টিই ‘কেন’—এই প্রশ্নের সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘কেন’ প্রশ্ন থেকে মায়া আসে না—মায়াই ঐ ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করে। ভ্রমই ভ্রমকে নষ্ট করে দেয়। যুক্তি-বিচার নিজেই একটা বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এটা একটা চক্রস্বরূপ, কাজেই যুক্তি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি একটা আনুমানিক জ্ঞান, আবার সব আনুমানিক জ্ঞানের ভিত্তি অনুভূতি।
অজ্ঞানে যখন ব্রহ্মজ্যোতিঃ প্রতিফলিত হয়, তখনই অজ্ঞান দৃশ্য হয়।স্বতন্ত্রভাবে ধরলে সেটা শূন্য ছাড়া কিছুই নয়। মেঘে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত না হলে মেঘকে দেখাই যায় না।
* * *
চারজন লোক দেশভ্রমণ করতে করতে একটা খুব উঁচু দেওয়ালের কাছে এসে উপস্থিত হল। প্রথম পথিকটি অতি কষ্টে দেওয়াল বেয়ে উঠল, আর পেছন দিকে চেয়ে না দেখেই দেওয়ালের ওপারে লাফ দিয়ে পড়ল। দ্বিতীয় পথিকটি দেওয়ালে উঠল, ভেতরের দিকে দেখলে, আর আনন্দধ্বনি করে ভেতরে পড়ল। তারপর তৃতীয়টিও দেওয়ালের মাথায় উঠল, তার সঙ্গীরা কোথায় গিয়াছে—সে দিকে লক্ষ্য করে দেখলে, তারপর আনন্দে হাঃ হাঃ করে হেসে তাদের অনুসরণ করলে। কিন্তু চতুর্থ পথিকটি দেওয়ালে উঠে তার সঙ্গীদের কি হল জেনে লোককে তা জানাবার জন্য ফিরে এল। এই সংসার-প্রপঞ্চের বাইরে যে কিছু আছে, আমাদের কাছে তার প্রমাণ হচ্ছে—যে-সকল মহাপুরুষ মায়ার দেওয়াল বেয়ে ভেতরের দিকে পড়েছেন, তাঁরা পড়বার আগে যে আনন্দে ‘হাঃ হাঃ’ করে হেসে উঠেন, সেই হাস্য।
* * *
আমরা যখন সেই পূর্ণ সত্তা থেকে নিজেদের পৃথক্ করে তাতে কতকগুলি গুণের আরোপ করি, তখন তাঁকেই আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি। ঈশ্বর হচ্ছেন—আমাদের মনের দ্বারা দৃষ্ট এই জগৎপ্রপঞ্চের মূল সত্তা। জগতের সমুদয় মন্দ ও দুঃখরাশিকে কুসংস্কারাছন্ন মন যেভাবে দেখে, তাকেই ‘শয়তান’ বলে।
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই
(পাতঞ্জল যোগসূত্র)
কার্য তিন প্রকারের হতে পারে—কৃত (যা তুমি নিজে করছ), কারিত (যা অপরের দ্বারা করাচ্ছ), আর অনুমোদিত (অপরে করছে—তাতে তোমার অনুমোদন আছে, কোন আপত্তি নেই)। আমাদের উপর এই তিন প্রকার কার্যের ফল প্রায় একরূপ।
পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের দ্বারা মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি খুব প্রবল হয়ে থাকে। ব্রহ্মচারীকে কায়মনোবাক্যে মৈথুনবর্জিত হতে হবে। দেহটার যত্ন ভুলে যাও। যতটা সম্ভব, দেহচেতনা ভুলে যাও।
যে অবস্থায় স্থিরভাবে ও সুখে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারা যায়, তাকেই ‘আসন’ বলে। সর্বদা অভ্যাসের দ্বারা এবং মনকে অনন্তভাবে ভাবিত করতে পারলে এটি হতে পারে।
একটা বিষয়ে সর্বদা চিত্তবৃত্তি প্রবাহিত করার নাম ‘ধ্যান’। স্থির জলে যদি একটা প্রস্তরখণ্ড ফেলা যায়, তা হলে জলে অনেকগুলি বৃত্তাকার তরঙ্গ উৎপন্ন হয়—বৃত্তগুলি সব পৃথক্ পৃথক্, অথচ পরস্পর পরস্পরের উপর কার্য করছে। আমাদের মনের ভেতরেও এইরূপ বৃত্তিপ্রবাহ চলেছে; তবে আমাদের ভেতর সেটি অজ্ঞাতসারে হচ্ছে, আর যোগীদের ভেতর ঐরূপ কার্য তাঁদের জ্ঞাতসারে হয়ে থাকে। আমরা যেন মাকড়সার মত নিজের জালের মধ্যে রয়েছি, যোগ-অভ্যাসের দ্বারা আমরা মাকড়সার মত জালের যে অংশে ইচ্ছা যেতে পারি। যারা যোগী নয়, তারা যেখানে রয়েছে, সেই নির্দিষ্ট স্থল-বিশেষেই আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়।
* * *
অপরকে হিংসা করলে বন্ধন হয় ও আমাদের সামনে থেকে সত্য ঢাকা পড়ে যায়। শুধু নিষেধাত্মক ধর্মসাধনাই যথেষ্ট নয়। মায়াকে আমাদের জয় করতে হবে, তা হলে মায়াই আমাদের অনুসরণ করবে। যখন কোন বস্তুকে আমাদের আর বাঁধতে পারে না, তখনই আমরা সেই বস্তু পাবার যোগ্যতা লাভ করি। যখন ঠিক ঠিক বন্ধন ছুটে যায়, তখন সবই আমাদের নিকট এসে উপস্থিত হয়। যারা কোন কিছু চায় না, শুধু তারাই প্রকৃতিকে জয় করছে।
এমন কোন মহাত্মার শরণাগত হও, যিনি নিজের বন্ধন ছিন্ন করেছেন, কালে তিনিই কৃপাবশে তোমায় মুক্ত করে দেবেন। ঈশ্বরের শরণাগত হওয়া—এর চেয়ে উচ্চভাব, কিন্তু অতি কঠিন। প্রকৃতপক্ষে এটি কার্যে পরিণত করেছে—এমন লোক শতাব্দীর ভিতর বড়জোর একজন দেখা যায়। কিছু অনুভব কর না, কিছু জেনো না, কিছু কর না, নিজের বলে কিছু রেখ না—সবকিছু ঈশ্বরে সমর্পণ কর আর সর্বান্তঃকরণে বল, ‘তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হোক।’
আমরা বদ্ধ—এই ভাব আমাদের স্বপ্নমাত্র। জেগে ওঠ—বন্ধন চলে যাক। ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও, এই মায়া-মরু অতিক্রম করবার এই একমাত্র উপায়।
‘ছেড়ে দাও রজ্জু, বলো হে সন্ন্যাসি, ওঁ তৎ সৎ ওঁ।’৫৩
আমরা যে অপরের সেবা করতে পারছি, এ আমাদের একটা বিশেষ সৌভাগ্য—কারণ ঐরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারাই আমাদের আত্মোন্নতি হবে। লোকে যে কষ্ট পাচ্ছে, তার কারণ তার উপকার করে আমাদের কল্যাণ হবে। অতএব দাতা দান করবার সময় গ্রহীতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসুন এবং তাকে ধন্যবাদ দিন, গ্রহীতা সম্মুখে দাঁড়িয়ে থেকে দান করতে অনুমতি দিন। সব প্রাণীর মধ্যে সেই প্রভুকে দান করে তাঁকেই দান কর। যখন আমরা আর মন্দ কিছু দেখতে পাব না, তখন আমাদের পক্ষে জগৎপ্রপঞ্চই আর থাকবে না, কারণ প্রকৃতির অস্তিত্বের উদ্দেশ্যই হচ্ছে—এই ভ্রম থেকে আমাদের মুক্ত করা। অপূর্ণতা বলে কিছু আছে—এইটে ভাবাই অপূর্ণতা সৃষ্টি করা। আমরা পূর্ণস্বরূপ ও ওজঃস্বরূপ, এই চিন্তাতেই কেবল ওটা দূর হতে পারে। যতই ভাল কাজ কর না কেন, কিছু মন্দ তাতে লেগে থাকবেই থাকবে। তবে সমুদয় কার্য নিজের ব্যক্তিগত ফলাফলের দিকে দৃষ্টি না রেখে করে যাও, সব ফল ঈশ্বরে সমর্পণ কর, তা হলে ভাল মন্দ কিছুই তোমায় অভিভূত করতে পারবে না।
কাজ করাটা ধর্ম নয় বটে, তবে ঠিক ঠিক ভাবে অনুষ্ঠিত কাজ মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে অপরকে করুণার চক্ষে দেখা অজ্ঞানমাত্র, কারণ আমরা করুণা করব কাকে? তুমি ঈশ্বরকে করুণার চক্ষে দেখতে পার কি? ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু আছে কি? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে, তিনি তোমাকে তোমার আত্মোন্নতির জন্য এই জগৎরূপ একটি নৈতিক ব্যায়ামশালা দিয়েছেন, কিন্তু কখনও ভেবো না—তুমি এই জগৎকে সাহায্য করতে পার। তোমায় যদি কেউ অভিশাপ দেয়, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, কারণ গালাগালি বা অভিশাপ জিনিষটা কি, তা দেখবার জন্য সে যেন তোমার সম্মুখে একখানি আরশি ধরেছে, আর তোমাকে আত্মসংযম অভ্যাস করবার অবসর দিচ্ছে। সুতরাং তাকে আশীর্বাদ কর ও সুখী হও। অভ্যাস করবার অবকাশ না হলে শক্তির বিকাশ হতে পারে না, আর আরশি সামনে না ধরলে আমরা নিজের মুখ নিজে দেখতে পাই না।
অপবিত্র চিন্তা ও কল্পনা অপবিত্র ক্রিয়ার মতই দোষাবহ। কামনা দমন করলে তা থেকে উচ্চতম ফললাভ হয়। কাম-শক্তিকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত কর, কিন্তু নিজেকে পুরুষত্বহীন কর না, কারণ তাতে কেবল শক্তির অপচয় হয়। এই শক্তি যত প্রবল থাকবে, এর দ্বারা তত অধিক কাজ সম্পন্ন হতে পারবে। প্রবল জলের স্রোত পেলে তবেই জলশক্তির সাহায্যে খনির কাজ করা যেতে পারে।
আজকাল আমাদের বিশেষ প্রয়োজন এই যে, আমাদের জানতে হবে, একজন ঈশ্বর আছেন, আর এখানে এবং এখনই আমরা তাঁকে অনুভব করতে—দেখতে পারি। চিকাগোর একজন অধ্যাপক বলেন, ‘এই জগতের তত্ত্বাবধান তুমি কর, পরলোকের খবর ঈশ্বর নেবেন।’ কি আহাম্মকি কথা! যদি আমরা এই জগতের সব বন্দোবস্ত করতে পারি, তবে পরলোকের ভার নেবার জন্য আবার অকারণ একজন ঈশ্বরের কি দরকার?
শুক্রবার, ২৬ জুলাই
(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ)
সব কিছু ভালবাস, কেবল আত্মার ভিতর দিয়ে এবং আত্মার জন্য।
যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলেছিলেন, ‘আত্মার দ্বারাই আমরা সব জিনিষ জানতে পারছি।’ আত্মা কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না—যে নিজে জ্ঞাতা, সে কি করে জ্ঞেয় হবে?৫৪ যিনি নিজেকে আত্মা বলে জানতে পারেন, তাঁর পক্ষে আর কোন বিধিনিষেধ থাকে না। তিনি জানেন—তিনিই এই জগৎপ্রপঞ্চ, আবার এর স্রষ্টাও বটে।
* * *
পুরাতন পৌরাণিক ব্যাপারগুলিকে রূপকের আকারে চিরস্থায়ী করবার চেষ্টা করলে এবং তাদের নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করলে কুসংস্কার উৎপত্তি হয়, আর এটা বাস্তবিকই দুর্বলতা। সত্যের সঙ্গে যেন কখনও কিছুর আপস না করা হয়। সত্যের উপদেশ দাও, আর কোন প্রকার কুসংস্কারের দোহাই দিতে চেষ্টা কর না, অথবা সত্যকে শিক্ষার্থীর ধারণাশক্তির উপযোগী করবার জন্য নামিয়ে এন না।
শনিবার, ২৭ জুলাই
(কঠোপনিষৎ)
অপরোক্ষানুভূতি-সম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত অপর কারও কাছে আত্মতত্ত্ব শিক্ষা করতে যেও না। অপরের কাছে তা কেবল কথার কথামাত্র। প্রত্যক্ষানুভূতি হলে মানুষ ধর্মাধর্ম, ভূতভবিষ্যৎ—সর্বপ্রকার দ্বন্দ্বের পারে চলে যায়। ‘নিষ্কাম ব্যক্তি সেই আত্মাকে দর্শন করেন, আর তাঁর আত্মার শ্বাশ্বতী শান্তি এসে থাকে।’৫৫ শুধু কথা বলা, বিচার, শাস্ত্রপাঠ ও বুদ্ধির চূড়ান্ত পরিচালনা করা, এমন-কি বেদ পর্যন্ত মানুষকে সেই আত্মজ্ঞান দিতে পারে না।
আমাদের ভিতর পরমাত্মা ও জীবাত্মা—দুই-ই আছেন। জ্ঞানীরা জীবাত্মাকে ছায়াস্বরূপ, আর পরমাত্মাকে যথার্থ সূর্যস্বরূপ বলে জানেন।
আমরা যদি মনটাকে ইন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে সংযুক্ত না করি, তা হলে আমরা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি ইন্দ্রিয় দ্বারা কোন জ্ঞানই লাভ করতে পারি না। মনের শক্তি দ্বারাই বহিরিন্দ্রিয়গুলিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গুলিকে বাইরে যেতে দিও না, তা হলে দেহ এবং বহির্জগৎ—এই উভয়েরই হাত থেকে মুক্তি পাবে।
এই যে অজ্ঞাত বস্তুটাকে আমরা বহির্জগৎ বলে দেখছি, মৃত্যুর পর নিজ নিজ মনের অবস্থানুসারে একেই কেউ স্বর্গ, কেউ নরক বলে দেখে। ইহলোক পরলোক—এ দুটোই স্বপ্নমাত্র, পরেরটি আবার প্রথমটির ছাঁচে গড়া। ঐ দুই প্রকার স্বপ্ন থেকেই মুক্ত হও, জানো—সবই সর্বব্যাপী, সবই বর্তমান। প্রকৃতি, দেহ ও মনেরই মৃত্যু হয়, আমাদের মৃত্যু হয় না; আমরা যাই-ও না, আসি-ও না। এই যে মানুষ ‘স্বামী বিবেকানন্দ’—এর সত্তা প্রকৃতির ভিতর, সুতরাং এর জন্মও হয়েছে এবং মৃত্যুও হবে। কিন্তু আত্মা—যাঁকে আমরা স্বামী বিবেকানন্দ-রূপে দর্শন করছি—তাঁর কখনও জন্ম হয়নি; তিনি কখনও মরবেন না—তিনি অনন্ত ও অপরিণামী সত্তা।
আমরা মনঃশক্তিকে পাঁচটা ইন্দ্রিয়শক্তিতেই ভাগ করি বা একটা শক্তিরূপেই দেখি, মনঃশক্তি এক-রকমই থাকে। একজন অন্ধ বলে, ‘প্রত্যেক জিনিষের ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রতিধ্বনি আছে, সুতরাং আমি হাততালি দিয়ে বিভিন্ন জিনিষের প্রতিধ্বনি দ্বারা আমার চতুর্দিকে কোথায় কি আছে, ঠিক ঠিক বলতে পারি।’ সুতরাং ঘন কুয়াশার ভিতর একজন অন্ধ একজন চক্ষুষ্মান্ লোককে অনায়াসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কারণ তার কাছে কুয়াসা বা অন্ধকারে কিছু তফাত হয় না।
মনকে সংযত কর, ইন্দ্রিয়গুলিকে নিরোধ কর, তা হলেই তুমি যোগী; তারপর বাকী যা কিছু—সবই হবে। শুনতে, দেখতে, ঘ্রাণ বা স্বাদ নিতে অস্বীকার কর; বহিরিন্দ্রিয়গুলি থেকে মনঃশক্তিকে সরিয়ে নাও। তুমি তো অজ্ঞাতসারে এটি সদাসর্বদাই করছ—যেমন যখন তোমার মন কোন বিষয়ে মগ্ন থাকে; সুতরাং তুমি জ্ঞাতসারেও এটি করবার অভ্যাস করতে পার। মন যেখানে ইচ্ছা ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রয়োগ করতে পারে। দেহের সাহায্যেই যে আমাদের কাজ করতে হবে, এই মূল কুসংস্কারটি একেবারে ছেড়ে দাও। তা তো করতে হয় না। নিজের ঘরে গিয়ে বস, আর নিজের অন্তরাত্মার ভিতর থেকে উপনিষদের তত্ত্বগুলি আবিষ্কার কর। তুমি সকল বিষয়ের অনন্তখনিস্বরূপ, ভূত-ভবিষ্যৎ সকল গ্রন্থের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যতদিন না সেই ভিতরের অন্তর্যামী গুরুর প্রকাশ হচ্ছে, ততদিন বাহিরের উপদেশ সব বৃথা। বাহিরের শিক্ষাদ্বারা যদি হৃদয়রূপ গ্রন্থ খুলে যায়, তবেই তার কিছু মূল্য আছে—বলা যেতে পারে।
আমাদের ইচ্ছাশক্তিই সেই ‘ক্ষুদ্র মৃদু বাণী’; সেই যথার্থ নিয়ন্তা, যে আমাদের বলছে—এই কাজ কর, এই কাজ কর না। এই ইচ্ছাশক্তি আমাদের যত বন্ধনের মধ্যে এনেছে। অজ্ঞ ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি তাকে বন্ধনে ফেলে, আর সেইটেই জ্ঞানপূর্বক পরিচালিত হলে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। সহস্র সহস্র উপায়ে ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করা যেতে পারে, প্রত্যেক উপায়ই এক এক প্রকার যোগ; তবে প্রণালীবদ্ধ যোগের দ্বারা এটা খুব শীঘ্র সাধিত হতে পারে। ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগের দ্বারা খুব নিশ্চিতরূপে কৃতকার্য হওয়া যায়। মুক্তিলাভ করবার জন্য তোমার যত প্রকার শক্তি আছে, সব প্রয়োগ কর; জ্ঞানবিচার, কর্ম, উপাসনা, ধ্যান—সব পথই অবলম্বন কর, সব পাল এক সঙ্গে তুলে দাও, সব কলগুলি পুরোদমে চালাও, আর গন্তব্যস্থানে উপনীত হও। যত শীঘ্র পার, ততই ভাল।
* * *
খ্রীষ্টানদের ব্যাপ্টিজ্ম্ (baptism) সংস্কার একটা বাহ্যশুদ্ধি-স্বরূপ—এটি অন্তঃশুদ্ধির প্রতীক। বৌদ্ধধর্ম থেকে এর উৎপত্তি।
খ্রীষ্টানদের ইউক্যারিস্ট নামক অনুষ্ঠান অসভ্য জাতিসমূহের একটি অতি প্রাচীন প্রথার অবশেষ। ঐ-সব অসভ্য জাতি—কখনও কখনও তাদের বড় বড় নেতারা যে-সব গুণে মহৎ হয়েছেন, সেইগুলি পাবার আশায় তাঁদের মেরে ফেলত এবং তাঁদের মাংস খেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, যে-সকল শক্তিতে তাদের নেতা বীর্যবান্, সাহসী ও জ্ঞানী হয়েছিলেন, এই উপায়ে সেই শক্তিগুলি তাদের ভিতর আসবে, আর কেবল এক ব্যক্তি ঐরূপ বীর্যবান্ ও জ্ঞানী না হয়ে সমগ্র জাতিটাই ঐরূপ হবে। নরবলি-প্রথা য়াহুদীজাতির ভিতরও ছিল, আর তাদের ঈশ্বর জিহোবা—ঐ প্রথার জন্য অনেক শাস্তি দিলেও তাদের ভিতর থেকে একেবারে লোপ পায়নি। যীশু নিজে শান্তপ্রকৃতি ও প্রেমিক পুরুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁকে য়াহুদীজাতির বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রচার করবার চেষ্টার ফলে খ্রীষ্টানদের মধ্যে এই মতবাদের উৎপত্তি হল যে, যীশু ক্রশে বিদ্ধ হয়ে সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি-রূপে নিজেকে বলি দিয়ে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করলেন। য়াহুদীদের মধ্যে পূর্বে এক প্রথা ছিল—তাঁদের পুরোহিতেরা মন্ত্রপাঠ করে ছাগলের উপর মানুষের পাপ চাপিয়ে দিয়ে তাকে জঙ্গলে তাড়িয়ে দিতেন—এখানে ছাগলের বদলে মানুষ, এই তফাত। এই নিষ্ঠুর ভাব প্রবেশ করার দরুন খ্রীষ্টধর্ম যীশুর যথার্থ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেল এবং তার ভিতর পরের উপর অত্যাচার করবার ও অপরের রক্তপাত করবার ভাব এল।
* * *
কোন কাজ করবার সময় বল না, ‘এটা আমার কর্তব্য’; বরং বল, ‘এটা আমার স্বভাব’।
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্’—সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার হয় না। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হও, তা হলেই তুমি ভগবানকে লাভ করবে।
অতি প্রাচীনকাল থেকে ভারতে ব্রাহ্মণজাতি নিজেদের সর্বপ্রকার বিধিনিষেধের অতীত বলে ঘোষণা করেছেন, তাঁরা নিজেদের ‘ভূদেব’ বলে দাবী করেন। তাঁরা খুব দরিদ্রভাবে থাকেন, তবে তাঁদের দোষ এই যে, তাঁরা আধিপত্য বা প্রভু্ত্ব খোঁজেন। যাই হোক, ভারতে প্রায় ছয় কোটী ব্রাহ্মণের বাস; তাঁদের কোনপ্রকার বিষয়-আশয় নেই, তাঁরা বেশ ভাল লোক, নীতিপরায়ণ। আর এইরূপ হবার কারণ এই যে, বাল্যকাল থেকেই তাঁরা শিক্ষা পেয়ে আসছেন যে, তাঁরা বিধিনিষধের অতীত, তাঁদের কোনপ্রকার শাস্তির বিধান নেই। তাঁরা নিজেদের ‘দ্বিজ’ বা ঈশ্বরতনয় জ্ঞান করে থাকেন।
রবিবার, ২৮ জুলাই
(দত্তাত্রেয়৫৬-কৃত অবধূত-গীতা)
‘মনের স্থিরতার উপর সমুদয় জ্ঞান নির্ভর করছে।’
‘যিনি সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চে পূর্ণভাবে বিরাজ করছেন, যিনি আত্মার মধ্যে আত্ম-স্বরূপ, তাঁকে আমি নমস্কার করি কিরূপে?’
আত্মাকে আমার নিজের স্বভাব—নিজের স্বরূপ বলে জানাই পূর্ণজ্ঞান এবং প্রত্যক্ষানুভূতি।
‘আমিই তিনি, এ-বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় নেই।’
‘কোন চিন্তা, কোন বাক্য বা কোন কার্যই আমার বন্ধন উৎপন্ন করতে পারে না। আমি ইন্দ্রিয়াতীত, আমি চিদানন্দস্বরূপ।’
‘অস্তি নাস্তি’ কিছুই নেই, সবই আত্ম-স্বরূপ। সবই আপেক্ষিক ভাব। সমুদয় দ্বন্দ্ব দূর করে দাও, সব কুসংস্কার ঝেড়ে ফেল, জাতি কুল দেবতা—আর যা কিছু—সব চলে যাক। ব্রহ্ম হওয়া বা হয়ে যাওয়া—এ-সবের কথা কেন বল? দ্বৈত-বা অদ্বৈতবাদের কথাও ছেড়ে দাও। তুমি দুই ছিলে কবে যে, দুই ও একের কথা বলছ? এই জগৎপ্রপঞ্চ সেই নিত্যশুদ্ধ ব্রহ্মমাত্র, তিনি ছাড়া আর কিছু নয়। যোগের দ্বারা শুদ্ধ হব—এ-কথা বল না, তুমি স্বয়ং যে শুদ্ধ-স্বভাব। কেউ তোমায় শিক্ষা দিতে পারে না।
যিনি এই গীতা লিখেছেন, তাঁর মত লোকই ধর্মটাকে জীবন্ত রেখেছেন। তাঁরা বাস্তবিকই সেই ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা কোন কিছু গ্রাহ্য করেন না, শরীরের সুখদুঃখ গ্রাহ্য করেন না, শীত-উষ্ণ বা বিপদ-আপদ বা অন্য কিছু— মোটেই গ্রাহ্য করেন না। জ্বলন্ত অঙ্গার তাঁদের দেহকে দগ্ধ করতে থাকলেও তাঁরা স্থির হয়ে বসে আত্মানন্দ সম্ভোগ করেন, গা যে পুড়ছে, তা তাঁরা টের পান না।
‘জ্ঞাতা-জ্ঞান ও জ্ঞেয়-রূপ ত্রিবিধ বন্ধন যখন দূর হয়ে যায়, তখনই আত্মস্বরূপের প্রকাশ হয়।’
‘যখন বন্ধন ও মুক্তি-রূপ ভ্রম চলে যায়, তখনই আত্মস্বরূপের প্রকাশ হয়।’
‘মনঃসংযম করে থাক তাতেই বা কি, না করে থাক তাতেই বা কি? তোমার অর্থ থাকে তাতেই বা কি, না থাকে তাতেই বা কি? তুমি নিত্যশুদ্ধ আত্মা। বলোঃ আমি আত্মা, কোন বন্ধন কখনও আমার কাছে ঘেঁষতে পারেনি। আমি অপরিণামী নির্মল আকাশ-স্বরূপ; নানাবিধ বিশ্বাস বা ধারণারূপ মেঘ আমার উপর দিয়ে চলে যেতে পারে, কিন্তু আমাকে তারা স্পর্শই করতে পারে না।’
‘ধর্মাধর্ম—পাপপুণ্য উভয়কেই দগ্ধ করে ফেল। মুক্তি ছেলেমানুষি কথামাত্র। আমি সেই অবিনাশী জ্ঞান-স্বরূপ, আমি সেই পবিত্রতা-স্বরূপ।’
‘কেউ কখনও বদ্ধ হয়নি, কেউ কখনও মুক্তও হয়নি। আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি অনন্তস্বরূপ, নিত্যমুক্তস্বভাব। আমাকে আর শেখাতে এস না—আমি চিদ্ঘনস্বভাব, কিসে আমার এই স্বভাব বদলাতে পারে? কাকেই বা শেখান যেতে পারে? কে শেখাতে পারে?’
তর্কযুক্তি, জ্ঞানবিচার ছুঁড়ে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দাও।
‘বদ্ধস্বভাব লোকই অপরকে বদ্ধ দেখে, ভ্রান্ত ব্যক্তিই অপরকে ভ্রান্ত মনে করে, যে অপবিত্র সেই অপবিত্রতা দেখে থাকে।’
দেশ-কাল-নিমিত্ত—এ সবই ভ্রম। তুমি যে মনে করছ তুমি বদ্ধ আছ, মুক্ত হবে—এটাই তোমার রোগ। তুমি অপরিণামী সত্তা। কথা বন্ধ কর, চুপ করে বসে থাক—সব জিনিষ তোমার সামনে থেকে উড়ে যাক—ওগুলি স্বপ্নমাত্র। পার্থক্য বা ভেদ বলে কোন কিছু নেই, ও-সব কুসংস্কারমাত্র। অতএব মৌনভাব অবলম্বন কর, আর নিজের স্বরূপ অবগত হও।
‘আমি আনন্দ-স্বরূপ।’ যেমন আদর্শের অনুসরণ করবার দরকার নেই—তুমি ছাড়া আর কি আছে? কিছুতে ভয় পেও না। তুমি সারসত্তা-স্বরূপ। শান্তিতে থাকো—নিজেকে ব্যতিব্যস্ত কর না। তুমি কখনও বদ্ধ হওনি। পুণ্য বা পাপ তোমাকে স্পর্শ করেনি। এই সমস্ত ভ্রম দূর করে দিয়ে শান্তিতে থাক। কাকে উপাসনা করবে? কেই বা উপাসনা করে? সবই তো আত্মা। কোন কথা কওয়া, কোনরূপ চিন্তা করাই কুসংস্কার। বার বার বল—‘আমি আত্মা, আমি আত্মা।’ আর সব উড়ে যাক।