সোমবার, ১ জুলাই
(শ্রীরামকৃষ্ণদেব)
শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা একজন খুব নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণ ছিলেন—এমন-কি, তিনি সকল প্রকার ব্রাহ্মণেরও দান গ্রহণ করতেন না। জীবিকার জন্য তাঁর সাধারণের মত কোন কাজ করবার জো ছিল না। পুঁথি বিক্রি করবার বা কারও চাকরি করবার জো তো ছিলই না, এমন-কি, তাঁর কোন দেবমন্দিরে পৌরোহিত্য করবারও উপায় ছিল না। তিনি একরূপ আকাশবৃত্তি অবলম্বন করে ছিলেন, যা অযাচিতভাবে উপস্থিত হত, তাতেই তাঁর খাওয়া-পরা চলত; কিন্তু তাও কোন পতিত ব্রাহ্মণের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতেন না। হিন্দুধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও ধর্মের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। হিন্দুদের মতে নিজের জন্য বাড়ী তৈরি করা স্বার্থপরতার কাজ; কেবল দেবতা ও অতিথিদের জন্য বাড়ী তৈরি করা যেতে পারে। সেই জন্য লোকে ভগবানের নিবাস-রূপে মন্দিরাদি নির্মাণ করে থাকে।
অতিশয় পারিবারিক অসচ্ছলতা হেতু শ্রীরামকৃষ্ণ অতি অল্পবয়সে এক মন্দিরে পূজারী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। মন্দিরে জগজ্জননীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল—তাঁকে প্রকৃতি বা কালীও বলে থাকে। একটি নারীমূর্তি একটি পুরুষমূর্তির উপর দাঁড়িয়ে আছেন—তাতে এই প্রকাশ হচ্ছে যে, মায়াবরণ উন্মোচিত না হলে আমরা জ্ঞানলাভ করতে পারি না। ব্রহ্ম স্বয়ং স্ত্রী বা পুরুষ কিছুই নন—তিনি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। তিনি যখন নিজেকে অভিব্যক্ত করেন, তখন তিনি নিজেকে মায়ার আবরণে আবৃত করে জগজ্জননীরূপ ধারণ করেন ও সৃষ্টিপ্রপঞ্চের বিস্তার করেন। যে পুরুষমূর্তিটি শয়ানভাবে রয়েছেন, তিনি শিব বা ব্রহ্ম, তিনি মায়াবৃত হয়ে শব হয়েছেন। অদ্বৈতবাদী বা জ্ঞানী বলেন, ‘আমি জোর করে মায়া কাটিয়ে ব্রহ্মকে প্রকাশ করব।’ কিন্তু দ্বৈতবাদী বা ভক্ত বলেন, ‘আমরা সেই জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি দ্বার ছেড়ে দেবেন, আর তখনই ব্রহ্ম প্রকাশিত হবেন, তাঁরই হাতে চাবি রয়েছে।’
প্রতিদিন মা-কালীর সেবা-পূজা করতে করতে এই তরুণ পুরোহিতের হৃদয়ে ক্রমে এমন তীব্র ব্যাকুলতা ও ভক্তির উদ্রেক হল যে, তিনি আর নিয়মিতভাবে মন্দিরে পূজার কাজ চালাতে পারলেন না। সুতরাং তিনি তা পরিত্যাগ করে মন্দিরের এলাকার ভিতরেই যেখানে একপাশে ছোটখাটো জঙ্গল ছিল, সেইখানে গিয়ে দিবারাত্র ধ্যানধারণা করতে লাগলেন। সেটি ঠিক গঙ্গার উপরেই ছিল; একদিন গঙ্গার প্রবল স্রোতে ঠিক একখানি কুটির-নির্মাণের উপযোগী সব জিনিষপত্র তাঁর কাছে ভেসে এল। সেই কুটিরে থেকে তিনি ক্রমাগত প্রার্থনা করতে লাগলেন ও কাঁদতে লাগলেন—জগজ্জননী ছাড়া আর কোন বিষয়ের চিন্তা, নিজের দেহরক্ষার চিন্তা পর্যন্ত তাঁর রইল না। তাঁর এক আত্মীয় এই সময়ে তাঁকে দিনের মধ্যে একবার করে খাইয়ে যেতেন, আর তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন। কিছুদিন পর এক সন্ন্যাসিনী এসে তাঁকে তাঁর ‘মা’কে পাবার সহায়তা করতে লাগলেন। তাঁর যে-কোন প্রকার গুরুর প্রয়োজন হত, তাঁরা নিজে থেকেই তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হতেন। সকল সম্প্রদায়ের কোন-না-কোন সাধু এসে তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, আর তিনি আগ্রহ করে সকলেরই উপদেশ শুনতেন। তবে তিনি কেবল সেই জগন্মাতারই উপাসনা করতেন—তাঁর কাছে সবই ‘মা’ বলে মনে হত।
শ্রীরামকৃষ্ণ কারও বিরুদ্ধে কখনও কড়া কথা বলেননি। তাঁর হৃদয় এত উদার ছিল যে, সকল সম্প্রদায়ই ভাবত—তিনি তাদেরই লোক। তিনি সকলকেই ভালবাসতেন। তাঁর দৃষ্টিতে সকল ধর্মই সত্য, তাঁর কাছে সকলেরই স্থান ছিল। তিনি মুক্তস্বভাব ছিলেন, কিন্তু সকলের প্রতি সমান প্রেমেই তাঁর মুক্ত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যেত, বজ্রবৎ কঠোরতায় নয়। এইরূপ কোমল থাকের লোকেরাই নূতন ভাব সৃষ্টি করেন, আর ‘হাঁক-ডেকে’ থাকের লোক ঐ ভাব চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। সেণ্ট পল এই শেষ থাকের ছিলেন। তাই তিনি সত্যের আলোক চতুর্দিকে বিস্তার করেছিলেন।
সেণ্ট পলের যুগ কিন্তু এখন আর নেই। আমাদেরই এ যুগের নূতন আলোক হতে হবে। আমাদের যুগের এখন বিশেষ প্রয়োজন—এমন একটি সঙ্ঘ, যা আপনা হতেই নিজেকে দেশকালের উপযোগী করে নেবে। যখন তা হবে, তখন সেইটিই হবে জগতের শেষ ধর্ম। সংসার চক্র চলবে—আমাদের তাকে সাহায্য করতে হবে, তাকে বাধা দিলে চলবে না। নানাবিধ ধর্মভাবরূপ তরঙ্গ উঠছে পড়ছে, আর সেই-সকল তরঙ্গের শীর্ষদেশে সেই যুগের অবতার বিরাজ করছেন। রামকৃষ্ণ বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মশিক্ষা দিতে এসেছিলেন, তাঁর ধর্ম গঠনমূলক, এতে ধ্বংসমূলক কিছু নেই। তাঁকে নূতন করে প্রকৃতির কাছে গিয়ে সত্য জানবার চেষ্টা করতে হয়েছিল, ফলে তিনি বৈজ্ঞানিক ধর্ম লাভ করেছিলেন। সে-ধর্ম কাউকে কিছু মেনে নিতে বলে না, নিজে পরখ করে নিতে বলে; বলে, ‘আমি সত্য দর্শন করেছি, তুমিও ইচ্ছা করলে দেখতে পার। আমি যে-সাধন অবলম্বন করেছি, তুমিও সেই সাধন কর, তা হলে তুমিও আমার মত সত্য দর্শন করবে।’ ঈশ্বর সকলের কাছেই আসবেন—সেই সামঞ্জস্য সকলেরই আয়ত্তের ভিতর রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ যা উপদেশ দিয়ে গেছেন, সেগুলি হিন্দুধর্মের সারস্বরূপ, তাঁর নিজের সৃষ্ট কোন নূতন বস্তু নয়। আর তিনি সেগুলি তাঁর নিজস্ব বলে কখনও দাবীও করেননি; তিনি নামযশের কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা করতেন না। তাঁর বয়স যখন প্রায় চল্লিশ, সেই সময় তিনি প্রচার করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু তিনি ঐ প্রচারের জন্য কখনও বাইরে কোথাও যাননি। যারা তাঁর কাছে এসে উপদেশ গ্রহণ করবে, তাদের জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন।
হিন্দুসমাজের প্রথানুযায়ী তাঁর পিতামাতা তাঁর যৌবনের প্রারম্ভে পাঁচ বছরের একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। বালিকা এক সুদূর পল্লীতে তাঁর নিজ পরিজনের মধ্যেই বাস করতে থাকেন—তাঁর যুবা পতি যে কি কঠোর সাধনার ভিতর দিয়ে ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তার বিষয় তিনি কিছু জানতেন না। যখন তিনি বড় হলেন, তখন তাঁর স্বামী ভগবৎপ্রেমে তন্ময় হয়ে গিয়েছেন। তিনি হেঁটে দেশ থেকে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ীতে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। স্বামীকে দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন—তাঁর কি অবস্থা; কারণ তিনি স্বয়ং মহা পবিত্রা বিশুদ্ধা ও উন্নতস্বভাবা ছিলেন। তিনি তাঁর কাজে কেবল সাহায্য করবার ইচ্ছাই করেছিলেন; তাঁর কখনও এ-ইচ্ছা হয়নি যে, তাঁকে গৃহস্থের পর্যায়ে টেনে নামিয়ে আনেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভারতে মহান্ অবতারপুরুষগণের মধ্যে একজন বলে পূজিত হয়ে থাকেন। তাঁর জন্মদিন সেখানে ধর্মোৎসব-রূপে পরিগণিত হয়ে থাকে।
* * *
একটি বিশিষ্টলক্ষণযুক্ত গোলাকার শিলা বিষ্ণু অর্থাৎ সর্বব্যাপী ভগবানের প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রাতঃকালে পুরোহিত এসে সেই শালগ্রামশিলাকে পুষ্পচন্দন নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজা করেন, ধূপকর্পূরাদির দ্বারা আরতি করেন, তারপর তাঁর শয়ন দিয়ে ঐভাবে পূজা করার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ঈশ্বর স্বরূপতঃ রূপবিবর্জিত হলেও তিনি ঐরূপ প্রতীক বা কোনরূপ জড়বস্তুর সাহায্য ব্যতীত তাঁর উপাসনা করতে পারছেন না, এই দোষ বা দুর্বলতার জন্য পূজারী তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি শিলাটিকে স্নান করান, কাপড় পরান এবং নিজের চৈতন্যশক্তি দ্বারা তাঁর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
একটি সম্প্রদায় আছে, তারা বলে—ভগবানকে কেবল শিব ও সুন্দর-রূপে পূজা করা দুর্বলতামাত্র, আমাদের অশিব রূপকেও ভালবাসতে হবে, পূজা করতে হবে। এই সম্প্রদায় তিব্বত দেশের সর্বত্র বিদ্যমান, আর তাদের ভিতর বিবাহ-পদ্ধতি নেই। এই সম্প্রদায়ের ভারতে প্রকাশ্যভাবে থাকবার জো নেই, সুতরাং তারা গোপনে গোপনে সম্প্রদায় করে থাকে। কোন ভদ্রলোক গুপ্তভাবে ভিন্ন এই-সকল সম্প্রদায়ে যোগ দিতে পারেন না। তিব্বত-দেশে তিনবার সমাধিকারবাদ২৯ কার্যে পরিণত করবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই সে-চেষ্টা বিফল হয়। তারা খুব তপস্যা করে, আর শক্তি (বিভূতি)-লাভের দিক্ দিয়ে খুব সাফল্যও লাভ করে থাকে।
‘তপস্’ শব্দের ধাত্বর্থ তাপ দেওয়া বা উত্তপ্ত করা। এটা আমাদের উচ্চ প্রকৃতিকে ‘তপ্ত’ বা উত্তেজিত করবার সাধনা বা প্রক্রিয়াবিশেষ। যেমন, হয়তো উদয়াস্ত জপ করা—সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্রমাগত ওঙ্কার-জপ। এই-সকল ক্রিয়ার দ্বারা এমন একটা শক্তি জন্মায়, যাকে—আধ্যাত্মিক বা ভৌতিক—যে-কোনরূপে ইচ্ছা পরিণত করা যেতে পারে। এই তপস্যার ভাব সমগ্র হিন্দুধর্মে ওতপ্রোত রয়েছে। এমন-কি হিন্দুরা বলেন যে, ঈশ্বরকেও জগৎসৃষ্টি করবার জন্য তপস্যা করতে হয়েছিল। এটা যেন মানসিক যন্ত্রবিশেষ—এ দিয়ে সব করা যেতে পারে। শাস্ত্রে আছে—‘ত্রিভুবনে এমন কিছু নেই, যা তপস্যা দ্বারা পাওয়া যায় না।’
যে-সব লোক এমন সব সম্প্রদায়ের মতামত বা কার্যকলাপ বর্ণনা করে, যেগুলির সঙ্গে তাদের সহানুভূতি নেই, তারা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মিথ্যাবাদী। যারা সম্প্রদায়বিশেষে দৃঢ়বিশ্বাসী, তারা অপর সম্প্রদায়ে যে সত্য আছে, তা বড় একটা দেখতে পায় না।
ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমানকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—আজ মাসের কোন্ তারিখ? তিনি তাতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘রামই আমার চিরদিনের সন তারিখ সব। আমি আর কোন তারিখ গ্রাহ্য করি না।’
মঙ্গলবার, ২ জুলাই
(জগজ্জননী)
শাক্তেরা জগতের সেই সর্বব্যাপিনী শক্তিকে মা বলে পূজা করে থাকেন—কারণ মা-নামের চেয়ে মিষ্ট নাম আর কিছু নেই। ভারতে মাতাই নারী-চরিত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ। ভগবানকে মাতৃরূপে, প্রেমের উচ্চতম বিকাশরূপে পূজা করাকে হিন্দুরা ‘দক্ষিণাচার’ বা ‘দক্ষিণমার্গ’ বলেন, ঐ উপাসনায় আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়, মুক্তি হয়—এর দ্বারা কখনও ঐহিক উন্নতি হয় না। আর তারঁ ভীষণ রূপের—রুদ্রমূর্তির উপাসনাকে ‘বামাচার’ বা ‘বামমার্গ’ বলে; সাধারণতঃ এতে সাংসারিক উন্নতি খুব হয়ে থাকে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি বড় একটা হয় না। কালে ঐ থেকে অবনতি এসে থাকে, আর যারা ঐ সাধন করে, সেই জাতির একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।
জননীই শক্তির প্রথম বিকাশ-স্বরূপ, আর জনকের ধারণা থেকে জননীর ধারণা ভারতে উচ্চতর বিবেচিত হয়ে থাকে। মা-নাম করলেই শক্তির ভাব, সর্বশক্তিমত্তা—ঐশ্বরিক শক্তির ভাব এসে থাকে, শিশু যেমন নিজের মাকে সর্বশক্তিময়ী মনে করে ভাবে—মা সব করতে পারে। সেই জগজ্জননী ভগবতীই আমাদের অভ্যন্তরে নিদ্রিতা কুণ্ডলিনী—তাঁকে উপাসনা না করে আমরা কখনও নিজেদের জানতে পারি না।
সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া—সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ। জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা যায়, সবই সেই মা। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্। তিনি একজন ব্যক্তি—তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে (যেমন রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)। সেই জগন্মাতার ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমরা যা খুশী তাই করতে পারি। তিনি অতি সত্বর আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন।
তিনি যখন ইচ্ছা—যে-কোনরূপে আমাদের দেখা দিতে পারেন। সেই জগজ্জননীর নাম ও রূপ—দুই-ই থাকতে পারে, অথবা রূপ না থেকে শুধু নাম থাকতে পারে। তাঁকে এই-সকল বিভিন্ন ভাবে উপাসনা করতে করতে আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হই, যেখানে নামরূপ কিছুই নেই, কেবল শুদ্ধসত্তামাত্র বিরাজিত।
যেমন কোন শরীরবিশেষের সমুদয় কোষগুলি (cells) মিলে একটি মানুষ হয়, সেইরূপ প্রত্যেক জীবাত্মা যেন এক-একটি কোষস্বরূপ, এবং তাদের সমষ্টি ঈশ্বর—আর সেই অনন্ত পূর্ণ তত্ত্ব (ব্রহ্ম) তারও অতীত। সমুদ্র যখন স্থির থাকে, তখন তাকে বলা যায় ‘ব্রহ্ম’, আর সেই সমুদ্রে যখন তরঙ্গ ওঠে, তখন তাকেই আমরা ‘শক্তি’ বা ‘মা’ বলি। সেই শক্তি বা মহামায়াই দেশকালনিমিত্ত-স্বরূপ। সেই ব্রহ্মই মা। তাঁর দুই রূপ—একটি সবিশেষ বা সগুণ, এবং অপরটি নির্বিশেষ বা নির্গুণ। প্রথমোক্ত রূপে তিনি ঈশ্বর, জীব ও জগৎ; দ্বিতীয় রূপে তিনি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। সেই নিরুপাধিক সত্তা থেকেই ঈশ্বর, জীব ও জগৎ এই ত্রিত্বভাব এসেছে। সমস্ত সত্তা—যা কিছু আমরা জানতে পারি, সবই এই ত্রিকোণাত্মক অস্তিত্ব; এটিই বিশিষ্টাদ্বৈত-ভাব।
সেই জগদম্বার এক কণা—এক বিন্দু হচ্ছেন কৃষ্ণ, আর এক কণা বুদ্ধ, আর এক কণা খ্রীষ্ট। আমাদের পার্থিব জননীতে সেই জগন্মতার যে এক কণা প্রকাশ রয়েছে, তারই উপাসনাতে মহত্ত্ব লাভ হয়। যদি পরম জ্ঞান ও আনন্দ চাও, তবে সেই জগজ্জননীর উপাসনা কর।
বুধবার, ৩ জুলাই
সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ভয়েতেই মানুষের ধর্মের আরম্ভ। ঈশ্বরভীতিই জ্ঞানের আরম্ভ। কিন্তু পরে তা থেকে এই উচ্চতর ভাব আসে যে, ‘পূর্ণ প্রেমের উদয়ে ভয় দূরে যায়।’ যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা জ্ঞানলাভ করছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা জানতে পারছি—ঈশ্বর কি বস্তু, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু না কিছু ভয় থাকবেই। যীশুখ্রীষ্ট মানুষ ছিলেন, সুতরাং তিনি জগতে অপবিত্রতা দেখতে পেতেন—আর তার খুব নিন্দাও করে গেছেন। কিন্তু ঈশ্বর অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ, তিনি জগতে কিছু অন্যায় দেখতে পান না, সুতরাং তাঁর ক্রোধেরও কোন কারণ নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ বা নিন্দাবাদ কখনও সর্বোচ্চ ভাব হতে পারে না। ডেভিডের হস্ত শোণিতে কলুষিত ছিল, সেই জন্য তিনি মন্দির নির্মাণ করতে পারেননি।৩০
আমাদের হৃদয়ে প্রেম, ধর্ম ও পবিত্রতার ভাব যতই বাড়তে থাকে, ততই আমরা বাইরে প্রেম, ধর্ম ও পবিত্রতা দেখতে পাই। আমরা অপরের কার্যের যে নিন্দাবাদ করি, তা প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিজেদেরই নিন্দা। তুমি তোমার ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডটাকে ঠিক কর—যা, তোমার হাতের ভিতর রয়েছে—তা হলে বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডও তোমার পক্ষে আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে। এ যেন জলস্থিতিবিজ্ঞানের (Hydrostatics) সমস্যার মত—একবিন্দু জলের শক্তিতে সমগ্র জগৎকে সাম্যাবস্থায় রাখা যেতে পারে। আমাদের ভিতরে যা নেই, বাইরেও তা দেখতে পারি না। বৃহৎ ইঞ্জিনের পক্ষে তৎসদৃশ অতি ক্ষুদ্র ইঞ্জিন যেরূপ, সমগ্র জগতের তুলনায় আমরাও সেইরূপ। ক্ষুদ্র ইঞ্জিনটির ভিতর কোন গোলমাল দেখে আমরা বৃহৎ ইঞ্জিনটিতেও কোন গোল হয়েছে, এরূপ কল্পনা করে থাকি।
জগতে যথার্থ যা কিছু উন্নতি হয়েছে, তা প্রেমের শক্তিতেই হয়েছে। দোষ দেখিয়ে দেখিয়ে কোন কালে ভাল কাজ করা যায় না। হাজার হাজার বছর ধরে সেটা পরীক্ষা করে দেখা গেছে। নিন্দাবাদে কোনই ফল হয় না।
যথার্থ বৈদান্তিককে সকলের সহিত সহানুভূতি করতে হবে, কারণ অদ্বৈতবাদ বা সম্পূর্ণ একত্বভাবই বেদান্তের সারমর্ম। দ্বৈতবাদীরা সাধারণতঃ গোঁড়া হয়ে থাকে—তারা মনে করে, তাদের পথই একমাত্র পথ। ভারতে বৈষ্ণব সম্প্রদায় দ্বৈতবাদী, আর তারা অত্যন্ত গোঁড়া। শৈবেরা আর একটি দ্বৈতবাদী সম্প্রদায়; তাদের মধ্যে ঘণ্টাকর্ণ নামক এক ভক্তের গল্প প্রচলিত আছে। সে শিবের এমন গোঁড়া ভক্ত ছিল যে, অপর কোন দেবতার নাম কানে শুনবে না। পাছে অপর দেবতার নাম শুনতে হয়, সেই ভয়ে সে দু-কানে দুটি ঘণ্টা বেঁধে রাখত। শিব তার প্রগাঢ় ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভাবলেন, শিব ও বিষ্ণুতে যে কোন প্রভেদ নেই, তা একে বুঝিয়ে দেব। সেইজন্য তিনি তার কাছে অর্ধশিব অর্ধবিষ্ণু অর্থাৎ হরিহর-মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। সেই সময় ঘণ্টাকর্ণ তাঁকে আরতি করছিল। কিন্তু তার এমন গোঁড়ামি যে, যখন সে দেখলে ধূপধুনার গন্ধ বিষ্ণুর নাকে যাচ্ছে, তখন বিষ্ণু যাতে সেই সুগন্ধ উপভোগ করতে না পান, সেজন্য তাঁর নাক চেপে ধরলে!
* * *
মাংসাশী প্রাণী—যেমন সিংহ—এক আঘাত করেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু সহিষ্ণু বলদ সারাদিন চলেছে, চলতে চলতেই সে খেয়ে ও ঘুমিয়ে নিচ্ছে। চঞ্চল, সদাক্রিয়াশীল ‘ইয়াঙ্কি’ (মার্কিন) ভাতখেকো চীনা কুলির সঙ্গে পেরে ওঠে না। যতদিন ক্ষাত্রশক্তির প্রাধান্য থাকবে, ততদিন মাংসভোজন প্রচলিত থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ কমে যাবে, তখন নিরামিষাশীর দল প্রবল হবে।
* * *
যখন আমরা ভগবানকে ভালবাসি, তখন যেন আমরা নিজেকে দু-ভাগ করে ফেলি—আমিই আমার অন্তরাত্মাকে ভালবাসি। ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আবার আমিও ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছি। আমরা ঈশ্বরকে আমাদের অনুরূপ করে সৃষ্টি করে থাকি। আমরাই ঈশ্বরকে আমাদের প্রভু হবার জন্য সৃষ্টি করে থাকি, ঈশ্বর আমাদের তাঁর দাস করেননি। যখন আমরা জানতে পারি, আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে এক, ঈশ্বর আমাদের সখা, তখনই প্রকৃত সাম্যাবস্থা লাভ হয়, তখনই আমাদের মুক্তি হয়। সেই অনন্ত পুরুষ থেকে যতদিন তুমি আপনাকে এক চুলও তফাত করবে, ততদিন ভয় কখনও দূর হতে পারে না।
ভগবৎ-সাধনা করে—ভগবানকে ভালবেসে জগতের কি কল্যাণ হবে?—বোকার মত এই প্রশ্ন কখনও কর না। চুলোয় যাক জগৎ, ভগবানকে ভালবাস—আর কিছু চেও না। ভালবাস এবং অপর কিছু প্রত্যাশা কর না। ভালবাস—আর সব মত-মতান্তর ভুলে যাও। প্রেমের পেয়ালা পান করে পাগল হয়ে যাও। বল, ‘হে প্রভু, আমি তোমারই—চিরকালের জন্য তোমারই’—এবং আর সব ভুলে গিয়ে ঝাঁপ দাও। ‘ঈশ্বর’ বলতে যে ‘প্রেম’ ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না। একটা বিড়াল তার বাচ্চাদের ভালবেসে আদর করছে দেখে সেইখানে দাঁড়িয়ে যাও, আর ভগবানের উপাসনা কর। সেই স্থানে ভগবানের আবির্ভাব হয়েছে। এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, এ কথা বিশ্বাস কর। সর্বদা বল, ‘আমি তোমার, আমি তোমার’; কারণ আমরা সর্বত্র ভগবানকে দর্শন করতে পারি। তাঁকে কোথাও খুঁজে বেড়িও না—তিনি তো প্রত্যক্ষ রয়েছেন, তাঁকে শুধু দেখে যাও। ‘সেই বিশ্বাত্মা, জগজ্জ্যোতিঃ প্রভু সর্বদা তোমাদের রক্ষা করুন।’
* * *
নির্গুণ পরব্রহ্মকে উপাসনা করা যেতে পারে না, সুতরাং আমাদিগকে আমাদেরই মত প্রকৃতিসম্পন্ন তাঁর প্রকাশ-বিশেষকে উপাসনা করতেই হবে। যীশু আমাদের মত মনুষ্যপ্রকৃতিসম্পন্ন ছিলেন—তিনি ‘খ্রীষ্ট’ হয়েছিলেন। আমরাও তাঁর মত খ্রীষ্ট হতে পারি, আর আমাদের তা হতেই হবে। খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ অবস্থা-বিশেষের নাম—যা আমাদের লাভ করতে হবে। যীশু ও গৌতমের মধ্যে সেই সেই অবস্থা প্রকাশ পেয়েছিল। জগন্মাতা বা আদ্যাশক্তিই ব্রহ্মের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ—তারপর খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণ তাঁর থেকে প্রকাশ হয়েছেন। আমরাই আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা গঠন করে নিজেদের বদ্ধ করি, আবার আমরাই ঐ শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হই। আত্মা অভয়স্বরূপ। আমরা যখন আমাদের আত্মার বাইরে অবস্থিত ঈশ্বরের উপাসনা করি, তখন ভালই করে থাকি, তবে আমরা যে কি করছি, তা জানি না। আমরা যখন আত্মার স্বরূপ জানতে পারি, তখনই ঐ রহস্য বুঝি। একত্বই প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি।
পারসীক সুফীদিগের কবিতায় আছেঃ
‘একদিন এমন ছিল, যখন আমি নারী ও তিনি পুরুষ ছিলেন। উভয়ের মধ্যে ভালবাসা বাড়তে লাগল—শেষে তিনি বা আমি কেউই রইলাম না। এখন এইটুকু মাত্র অস্পষ্টভাবে স্মরণ হয় যে, এক সময়ে দুজন পৃথক্ লোক ছিল; শেষে প্রেম এসে উভয়কে এক করে দিলে।’৩১
জ্ঞান অনাদি অনন্তকাল বর্তমান—ঈশ্বর যতদিন আছেন, জ্ঞানও ততদিন আছে। যে-ব্যক্তি কোন আধ্যাত্মিক নিয়ম আবিষ্কার করেন, তাঁকেই ‘inspired’ বা প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ বা ঋষি বলে; তিনি যা প্রকাশ করেন, তাকে ‘revelation’ বা অপৌরুষেয় বাণী বলে। কিন্তু এরূপ অপৌরুষেয় বাণীও অনন্ত—এমন নয় যে এ-পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতেই তা শেষ হয়ে গেছে, এবং এখন অন্ধভাবে তার অনুসরণ করতে হবে। বিজেতারা হিন্দুদের ধর্মকে এতদিন ধরে সমালোচনা করে এসেছে যে, এখন তারা (হিন্দুরা) নিজেরাই নিজেদের ধর্ম সমালোচনা করতে সাহস করে, আর এর ফলে তারা স্বাধীনচেতা হয়ে গিয়েছে। তাদের বৈদেশিক শাসনকর্তারা অজ্ঞাতসারে হিন্দুদের পায়ের বেড়ি ভেঙে দিয়েছে। হিন্দুরা জগতের মধ্যে সব চেয়ে ধার্মিক জাতি হয়েও বাস্তবিকই ভগবন্নিন্দা বা ধর্মনিন্দা কাকে বলে, তা জানে না। তাদের মতে ভগবান্ বা ধর্মসম্বন্ধে যে-কোন ভাবে আলোচনা করা হোক না, তাতেই পবিত্রতা ও কল্যাণ লাভ হয়ে থাকে। আর তারা অবতার বা শাস্ত্র বা ধর্মধ্বজিতার প্রতি কোন প্রকার কৃত্রিম শ্রদ্ধা বা ভক্তি দেখায় না।
খ্রীষ্টের ধর্মসম্প্রদায় খ্রীষ্টকে তাদের নিজের মতানুযায়ী করে গড়ে তোলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু খ্রীষ্টীয় জীবনাদর্শে নিজেদের গড়বার চেষ্টা করেনি। এজন্যই খ্রীষ্ট-সম্বন্ধে যে-সকল গ্রন্থ উক্ত সম্প্রদায়ের সাময়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার সহায় হয়েছিল, কেবল সেগুলিকেই রাখা হয়েছিল। সুতরাং সেই গ্রন্থগুলির উপর কখনই নির্ভর করা যেতে পারে না। আর এইরূপ গ্রন্থ বা শাস্ত্র-উপাসনা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পৌত্তলিকতা—ওটা আমাদের হাত-পা একেবারে বেঁধে রেখে দেয়। এদের মতে কি বিজ্ঞান, কি ধর্ম, কি দর্শন—সবকিছুই ঐ শাস্ত্রের মতানুযায়ী হতে হবে। প্রটেস্টাণ্টদের এই বাইবেলের অত্যাচার সর্বাপেক্ষা ভয়ানক অত্যাচার। খ্রীষ্টান দেশসমূহের প্রত্যেকের মাথার উপর একটা প্রকাণ্ড গির্জা চাপান রয়েছে, আর তার উপরে একখানা ধর্মগ্রন্থ, কিন্তু তবুও মানুষ বেঁচে রয়েছে, আর তার উন্নতিও হচ্ছে। এতেই কি প্রমাণিত হচ্ছে না যে, মানুষ ঈশ্বরস্বরূপ?
জীবের মধ্যে মানুষই সর্বোচ্চ জীব, আর পৃথিবীই সর্বোচ্চ লোক। আমরা ঈশ্বরকে মানুষের চেয়ে বড় বলে ধারণা করতে পারি না; সুতরাং আমাদের ঈশ্বর মানুষ—আবার মানুষও ঈশ্বর। যখন আমরা মনুষ্যভাবের উপরে উঠে তার অতীত উচ্চতর কোন কিছু সাক্ষাৎ করি, তখন আমাদের এ জগৎ ছেড়ে, দেহ-মন-কল্পনা—এ-সবেরই বাইরে লাফ দিতে হয়। আমরা যখন উচ্চাবস্থা লাভ করে সেই অনন্তস্বরূপ হই, তখন আর আমরা এ জগতে থাকি না। আমাদের এই জগৎ ছাড়া অন্য কোন জগৎ জানবার সম্ভাবনা নেই, আর মানুষই এই জগতের সর্বোচ্চ সীমা। পশুদের সম্বন্ধে আমরা যা জানতে পারি, তা কেবল সাদৃশ্যমূলক জ্ঞান। আমরা নিজেরা যা কিছু করে থাকি অথবা অনুভব করি, তাই দিয়ে আমরা তাদের বিচার করে থাকি।
সমুদয় জ্ঞানের সমষ্টি সর্বদাই সমান—কেবল সেটা কখনও বেশী, কখনও কম অভিব্যক্ত হয়—এই মাত্র। ঐ জ্ঞানের একমাত্র উৎস আমাদের ভিতরে এবং কেবল সেইখানেই ঐ জ্ঞান লাভ করা যায়।
* * *
সমুদয় কাব্য, চিত্রবিদ্যা ও সঙ্গীত কেবল ভাষা, বর্ণ ও ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভাবের অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
* *
*
ধন্য তারা, যারা শীঘ্র শীঘ্র পাপের ফল ভোগ করে—তাদের হিসাব শীঘ্র শীঘ্র মিটে গেল। যাদের পাপের প্রতিফল বিলম্বে আসে, তাদের মহা দুর্দৈব—তাদের বেশী বেশী ভুগতে হবে।
যাঁরা সমত্বভাব লাভ করেছেন, তাঁরাই ব্রহ্মে অবস্থিত বলে কথিত হন। সকল রকম ঘৃণার অর্থ—যেন আত্মার দ্বারা আত্মার হনন। সুতরাং প্রেমেই জীবনের যথার্থ নিয়ামক। প্রেমের অবস্থা লাভ করাই সিদ্ধাবস্থা; কিন্তু আমরা যতই সিদ্ধির দিকে অগ্রসর হই, ততই আমরা কম কাজ (তথাকথিত কাজ) করতে পারি। সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা জানেন ও দেখেন যে, সবই ছেলেখেলামাত্র, সুতরাং তাঁরা কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না।
এক ঘা দিয়ে দেওয়া সোজা, কিন্তু হাত গুটিয়ে স্থির হয়ে থেকে ‘হে প্রভু, আমি তোমারই শরণাগত হলাম’ বলা এবং তিনি যা হয় করুন বলে অপেক্ষা করে থাকা খুবই কঠিন।
শুক্রবার, ৫ জুলাই
যতক্ষণ তুমি সত্যের অনুরোধে যে-কোন মু্হূর্তে বদলাতে প্রস্তুত না হচ্ছ, ততক্ষণ তুমি কখনই সত্য-লাভ করতে পারবে না; অবশ্য তোমাকে দৃঢ়ভাবে সত্যের অনুসন্ধানে লেগে থাকতে হবে।
* * *
চার্বাকেরা ভারতের একটি অতি প্রাচীন সম্প্রদায়—তারা সম্পূর্ণ জড়বাদী ছিল। এখন সে-সম্প্রদায় লুপ্ত হয়ে গেছে, আর তাদের অধিকাংশ গ্রন্থও লোপ পেয়ে গেছে। তাদের মতে আত্মা—দেহ ও ভৌতিক শক্তি থেকে উংপন্ন বলে দেহের নাশে আত্মারও নাশ, এবং দেহনাশের পরও যে আত্মার অস্তিত্ব থাকে, তার কোন প্রমাণ নেই। তারা কেবল ইন্দ্রিয়জন্য প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্বীকার করত—অনুমান দ্বারাও যে জ্ঞান-লাভ হতে পারে, তা স্বীকার করত না।
সমাধি-অর্থে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদভাব, অথবা সমত্বভাব লাভ করা।
জড়বাদী বলেন, আমি মুক্ত বলে আমাদের যে জ্ঞান হয়, সেটা ভ্রমমাত্র। বিজ্ঞানবাদী বলেন, আমি বদ্ধ বলে যে জ্ঞান হয়, সেটাই ভ্রম। বেদান্তবাদী বলেন, তুমি মুক্ত ও বদ্ধ দুই-ই। ব্যাবহারিক ভূমিতে তুমি কখনই মুক্ত নও, কিন্তু পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক ভূমিতে তুমি নিত্যমুক্ত।
মুক্তি ও বন্ধন উভয়েরই পারে চলে যাও।
আমরাই শিবস্বরূপ, অতীন্দ্রিয়, অবিনাশী জ্ঞানস্বরূপ। প্রত্যেক ব্যক্তির পশ্চাতে অনন্ত শক্তি রয়েছে, জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করলেই ঐ শক্তি তোমাতে আসবে।
‘হে মাতঃ বাগীশ্বরি, তুমি স্বয়ম্ভু, তুমি আমার জিহ্বায় বাক্-রূপে আবির্ভূতা হও!’
‘হে মাতঃ, বজ্র তোমার বাণীস্বরূপ—তুমি আমার ভিতর আবির্ভূতা হও! হে কালি, তুমি অনন্ত কালরূপিণী, তুমি অমোঘ শক্তিস্বরূপিণী!’
শনিবার, ৬ জুলাই
(অদ্য স্বামীজী ব্যাসকৃত বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্য অবলম্বন করিয়া উপদেশ দিতে লাগিলেন।)
ওঁ তৎ সৎ!
শঙ্করের মতে জগৎকে দু-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—অস্মদ্ (আমি) ও যুস্মদ্ (তুমি)। আর আলো ও অন্ধকার যেমন সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ বস্তু, ঐ দুটিও সেরূপ; সুতরাং বলা বাহুল্য, এ দুয়ের কোনটি থেকে অপরটি উৎপন্ন হতে পারে না। এই আমি বা বিষয়ীর (subject) উপর তুমি বা বিষয়ের (object) অধ্যাস হয়েছে। বিষয়ীই একমাত্র সত্য বস্তু, অপরটি অর্থাৎ বিষয় আপাতপ্রতীয়মান সত্তামাত্র। ইহার বিরুদ্ধ মত অর্থাৎ বিষয় সত্য ও বিষয়ী মিথ্যা—এ মত কখনও প্রমাণ করা যেতে পারে না। জড়পদার্থ ও বহির্জগৎ শুধু আত্মারই অবস্থাবিশেষ। প্রকৃতপক্ষে একটি সত্তাই রয়েছে।
আমাদের অনুভূত এই জগৎ সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে উৎপন্ন। যেমন বল-সামান্তরিকে৩২ দুই বিভিন্নমুখী বলপ্রয়োগের ফলে একটি বস্তুতে কর্ণাভিমুখী গতির উৎপত্তি হয়, সেরূপ এই সংসারও আমাদের উপর প্রযুক্ত বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তিসমূহের ফলস্বরূপ। এই জগৎ ব্রহ্মস্বরূপ ও সত্য; কিন্তু আমরা জগৎকে সেভাবে দেখছি না; যেমন শুক্তিতে রজত-ভ্রম হয়, তেমনি আমাদেরও ব্রহ্মে জগদ্ভ্রম হয়েছে। একেই বলে ‘অধ্যাস’। যে সত্তা একটা সত্য বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তাকেই অধ্যস্ত সত্তা বলে। যেমন পূর্বে যে দৃশ্য দেখেছি, এখন তার স্মরণ হল। সেই সময়ের জন্য সেটা সত্য বলে বোধ হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা সত্য নয়; অথচ অধ্যাসের দৃষ্টান্ত অপরে এইরূপ দেন—উষ্ণতা জলের ধর্ম বা গুণ নয়, অথবা যেমন আমরা জলে উষ্ণতা কল্পনা করে থাকি। সুতরাং অধ্যাস মানে ‘অ-তস্মিন্ তদ্বুদ্ধিঃ’—যে বস্তু যা নয়, তাতে সেই বুদ্ধি করা। অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, আমরা যখন জগৎ দেখছি, তখন আমরা সত্যকেই দর্শন করছি, কিন্তু যে মাধ্যমের ভেতর দিয়ে দেখছি—তার দ্বারা সত্য বিকৃতভাবাপন্ন হয়ে দেখা যাচ্ছে।
তুমি নিজেকে বাইরে বিষয়রূপে প্রক্ষেপ না করে কখনও নিজেকে জানতে পার না। ভ্রান্তির অবস্থায় আমাদের সামনের বস্তুগুলোকেই আমরা সত্য বলে মনে করি, অদৃষ্ট বস্তুকে কখনও সত্য বলে আমাদের বোধ হয় না। এইরূপে আমরা বিষয়কে (object) বিষয়ী (subject) বলে ভুল করে থাকি। আত্মা কিন্তু কখনও বিষয় (object) হন না। মনে হচ্ছে অন্তঃকরণ বা অন্তরিন্দ্রিয়, আর বহিরিন্দ্রিয়গুলি তারই যন্ত্রস্বরূপ। বিষয়ীতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে বহিঃপ্রক্ষেপশক্তি (objectifying power) আছে—তার দ্বারাই তিনি জানতে পারেন, ‘আমি আছি’। কিন্তু সেই আত্মা বা বিষয়ী নিজেরই বিষয়—মন বা ইন্দ্রিয়ের বিষয় নন। তবে আমরা একটা ভাবকে (idea) আর একটা ভাবের উপর অধ্যাস করতে পারি—যেমন আমরা যখন বলি, ‘আকাশ নীল’—আকাশটা একটা ভাবমাত্র, আর নীলত্বও একটা ভাব—আমরা নীলত্ব ভাবটা আকাশের উপর আরোপ বা অধ্যাস করে থাকি।
বিদ্যা ও অবিদ্যা বা জ্ঞান ও অজ্ঞান—এই দুই নিয়ে জগৎ, কিন্তু আত্মা কোন কালে অবিদ্যায় আচ্ছন্ন হয় না। আপেক্ষিক জ্ঞানও ভাল, কারণ সেটা সেই চরম জ্ঞানে আরোহণ করবার সোপান। কিন্তু ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান বা মানসিক জ্ঞান, এমন কি দেব-প্রমাণজন্য জ্ঞানও কখনও পরমার্থ সত্য হতে পারে না; কারণ ঐগুলি সবই আপেক্ষিক জ্ঞানের সীমার ভিতর। প্রথমে ‘আমি দেহ’ এই ভ্রম দূর করে দাও, তবেই যথার্থ জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা হবে। মানবীয় জ্ঞান পশুজ্ঞানেরই উচ্চতর অবস্থামাত্র।
* * *
বেদের এক অংশে কর্মকাণ্ড—নানাবিধ অনুষ্ঠানপদ্ধতি, যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতির উপদেশ আছে। অপরাংশে ব্রহ্মজ্ঞান ও যথার্থ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মের বিষয় বর্ণিত আছে। বেদের এই ভাগ আত্মতত্ত্ব-সম্বন্ধে উপদেশ দেন, আর সেইজন্যই বেদের ঐ ভাগের জ্ঞান যথার্থ পারমার্থিক জ্ঞানের অতি সমীপবর্তী। সেই অনন্ত পূর্ণ পরব্রহ্মের জ্ঞান কোন শাস্ত্রের উপর বা অপর কিছুর উপর নির্ভর করে না; এই জ্ঞান স্বয়ংপূর্ণ-স্বরূপ। বহুশাস্ত্রপাঠেও এই জ্ঞান লাভ হয় না; এ কোন মতবিশেষ নয়, এ জ্ঞান অপরোক্ষানুভূতি। আরশির উপর যে ময়লা রয়েছে, তা পরিষ্কার করে ফেল। নিজের মনটা পবিত্র কর, তা হলেই দপ্ করে তোমার এই জ্ঞানের উদয় হবে যে, তুমি ব্রহ্ম।
শুধু ব্রহ্মই আছেন—জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, নরহত্যা নেই, কোনরূপ পরিণাম নেই, ভালও নেই, মন্দও নেই,—সবই আমরা ‘রজ্জুকে সর্প’ মনে করছি—ভ্রম আমাদেরই। আমরা তখনই কেবল জগতের কল্যাণ করতে পারি, যখন আমরা ভগবানকে ভালবাসি, এবং তিনিও আমাদের ভালবাসেন। হত্যাকারী ব্যক্তিও ব্রহ্মস্বরূপ—তার উপর হত্যাকারিরূপ যে আবরণ রয়েছে, সেটা তাতে অধ্যস্ত বা আরোপিত হয়েছে মাত্র। আস্তে আস্তে হাত ধরে তাকে এই সত্য জানিয়ে দাও।
আত্মাতে কোন জাতিভেদ নেই; আছে—ভাবাটাই ভ্রম। সেই রকম আত্মার জীবন বা মরণ বা কোন প্রকার গতি বা গুণ আছে—এরূপ ভাবাও ভ্রম। আত্মার কখনও পরিণাম হয় না, আত্মা কোথাও যানও না, আসেনও না। তিনি তাঁর নিজের সমুদয় প্রকাশগুলির অনন্ত সাক্ষিস্বরূপ, কিন্তু আমরা তাঁকে ঐ ঐ প্রকাশ বলে মনে করছি। এ এক অনাদি অনন্ত ভ্রম চিরকাল ধরে চলেছে। তবে বেদকে আমাদের ভূমিতে নেমে এসে উপদেশ দিতে হচ্ছে, কারণ বেদ যদি উচ্চতম সত্যকে উচ্চতম ভাবে বা ভাষায় আমাদের কাছে বলতেন, তা হলে আমরা বুঝতেই পারতাম না।
স্বর্গ আমাদের বাসনাসৃষ্ট কুসংস্কার-মাত্র, আর বাসনা চিরকালই বন্ধন—অবনতির দ্বারস্বরূপ। ব্রহ্মদৃষ্টি ছাড়া আর কোনভাবে কোন বস্তুকে দেখো না। তা যদি কর, তা হলে অন্যায় বা মন্দ দেখবে; কারণ আমরা যে বস্তু দেখতে পাই, তার উপর একটা ভ্রমাত্মক আবরণ প্রক্ষেপ করি, তাই মন্দ দেখতে পাই। এই-সব ভ্রম থেকে মুক্ত হও এবং পরমানন্দ উপভোগ কর। সব রকম ভ্রম থেকে মুক্ত হওয়াই মুক্তি।
এক হিসাবে সকল মানুষই ব্রহ্মকে জানে; কারণ সে জানে, ‘আমি আছি’; কিন্তু মানুষ নিজের যথার্থ স্বরূপ জানে না। আমরা সকলেই জানি যে, আমরা আছি, কিন্তু কি করে আছি, তা জানি না। অদ্বৈতবাদ ছাড়া জগতের অন্যান্য নিম্নতর ব্যাখ্যা আংশিক সত্যমাত্র। কিন্তু বেদের তত্ত্ব এই যে—আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে যে আত্মা রয়েছে, তা ব্রহ্মস্বরূপ। জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যে যা কিছু সব—জন্ম, মৃত্যু, বৃদ্ধি, উৎপত্তি স্থিতি ও প্রলয় দ্বারা সীমাবদ্ধ। আমাদের অপরোক্ষানুভূতি বেদেরও অতীত; কারণ বেদেরও প্রামাণ্য ঐ অপরোক্ষানুভূতির উপর নির্ভর করে। সর্বোচ্চ বেদান্ত হচ্ছে—প্রপঞ্চাতীত সত্তার তত্ত্বজ্ঞান।
‘সৃষ্টির আদি আছে’ বললে সর্বপ্রকার দার্শনিক বিচারের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়।
জগৎপ্রপঞ্চের অন্তর্গত অব্যক্ত ও ব্যক্ত শক্তিকে ‘মায়া’ বলে। যতক্ষণ সেই মাতৃরূপিণী মহামায়া আমাদের ছেড়ে না দিচ্ছেন, ততক্ষণ আমরা মুক্ত হতে পারি না।
জগৎটা আমাদের উপভোগের জন্য পড়ে রয়েছে; কিন্তু কখনও অভাববোধ করে কিছু চেও না। অভাববোধ করাটা দুর্বলতা, অভাববোধই আমাদের ভিক্ষুক করে ফেলে। আমরা ভিক্ষুক নই, আমরা রাজপুত্র!
রবিবার, ৭ জুলাই, প্রাতঃকাল
অনন্ত জগৎপ্রপঞ্চকে যতই ভাগ করা যাক না কেন, তা অনন্তই থাকে, আর তার প্রত্যেক ভাগটাও অনন্ত।
পরিণামী ও অপরিণামী, ব্যক্ত ও অব্যক্ত—উভয় অবস্থাতেই ব্রহ্ম এক। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়কে এক বলে জেন। জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই ত্রিপুটী জগৎপ্রপঞ্চরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। যোগী ধ্যানে যে ঈশ্বর দর্শন করেন, তা তিনি নিজ আত্মার শক্তিতেই দেখে থাকেন।
আমরা যাকে স্বভাব বা অদৃষ্ট বলি, তা কেবল ঈশ্বরেচ্ছা মাত্র। যতদিন ভোগসুখ খোঁজা যায়, ততদিন বন্ধন থেকে যায়। যতক্ষণ অপূর্ণ থাকা যায়, ততক্ষণই ভোগ সম্ভব; কারণ ভোগের অর্থ অপূর্ণ বাসনার পরিপূর্তি। জীবাত্মা প্রকৃতিকে সম্ভোগ করে থাকে। প্রকৃতি, জীবাত্মা ও ঈশ্বর—এদের অন্তর্নিহিত সত্য হচ্ছেন ব্রহ্ম। কিন্তু যতদিন আমরা তাঁকে বাইরে প্রকাশ না করছি, ততদিন তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। যেমন ঘর্ষণের দ্বারা অগ্নি উৎপাদন করতে পারা যায়, তেমনি ব্রহ্মকেও মন্থনের দ্বারা প্রকাশ করতে পারা যায়। দেহটাকে নিম্ন অরণি, প্রণব বা ওঙ্কারকে উত্তরারণি বলে কল্পনা কর, আর ধ্যান যেন মন্থন।৩৩ তা হলে আত্মার মধ্যে যে ব্রহ্মজ্ঞান-রূপ অগ্নি আছে, তা প্রকাশ হয়ে পড়বে। তপস্যা দ্বারা এইটে করতে চেষ্টা কর। দেহকে সরল ভাবে রেখে ইন্দ্রিয়গুলিকে মনে আহুতি দাও। ইন্দ্রিয়কেন্দ্রগুলি সব ভিতরে, তাদের যন্ত্র বা গোলকগুলি কেবল বাইরে।সুতরাং তাদের জোর করে মনে প্রবেশ করিয়ে দাও। তারপর ধারণা-সহায়ে মনকে ধ্যানে স্থির কর। যেমন দুধের ভিতর সর্বত্র ঘি রয়েছে, ব্রহ্মও সেইরূপ জগতের সর্বত্র রয়েছেন। কিন্তু মন্থন দ্বারা তিনি এক বিশেষ স্থানে প্রকাশ পান। যেমন মন্থন করলে দুধের মাখন উঠে পড়ে, তেমনি ধ্যানের দ্বারা আত্মার মধ্যে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার হয়।৩৪
সমুদয় হিন্দুদর্শন বলেন, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় ছাড়া একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। তাই দিয়েই অতীন্দ্রিয় জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে।
* * *
জগৎটা একটা অবিরাম গতি-স্বরূপ; আর ঘর্ষণ (friction) হতেই কালে সমুদয়ের নাশ হবে; তারপর দিন-কতক বিশ্রাম হয়ে আবার সব আরম্ভ হবে।
যতদিন এই ‘ত্বগম্বর’ মানুষকে বেষ্টন করে থাকে, অর্থাৎ যতদিন সে নিজেকে দেহের সঙ্গে অভিন্ন ভাবছে, ততদিন সে ঈশ্বরকে দেখতে পায় না।
ঐ দিন, অপরাহ্ণ
ভারতের ছটি দর্শনকে ‘আস্তিক দর্শন’ বলে; কারণ তারা বেদে বিশ্বাসী। ব্যাসের দর্শন বিশেষভাবে উপনিষদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি সূত্রাকারে অর্থাৎ যেমন বীজগণিতশাস্ত্রে খুব সংক্ষেপে কয়েকটা অক্ষরের সাহায্যে ভাব-প্রকাশ করা হয়, তেমনি ভাবে এটা লিখেছিলেন—এতে কর্তা ক্রিয়া বড় একটা নেই। ব্যাসসূত্র এইরূপ সংক্ষেপে রচিত হওয়ায় শেষে তার অর্থ বুঝতে এত গোল হল যে, ঐ এক সূত্র থেকেই দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এবং অদ্বৈতবাদের উৎপত্তি হল। এই অদ্বৈতবাদই ‘বেদান্ত-কেশরী’। আর এই-সব বিভিন্ন মতের বড় বড় ভাষ্যকারেরা বেদের অক্ষর-রাশিকে তাঁদের দর্শনের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য সময়ে সময়ে ‘জেনে শুনে মিথ্যাবাদী’ হয়েছেন।
উপনিষদে কোন ব্যক্তিবিশেষের কার্যকলাপের ইতিহাস অতি অল্পই পাওয়া যায়; কিন্তু অন্যান্য প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থই প্রধানতঃ কোন ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস।
বেদে প্রায় শুধু দার্শনিক তত্ত্বেরই আলোচনা আছে। দর্শনবর্জিত ধর্ম কুসংস্কারে গিয়ে দাঁড়ায়, আবার ধর্মবর্জিত দর্শন শুধু নাস্তিকতায় পরিণত হয়।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মানে অদ্বৈতবাদ, কিন্তু বিশেষযুক্ত। তার ব্যাখ্যাতা রামানুজ। তিনি বলেন, ‘বেদরূপ ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করে ব্যাস মানবজাতির কল্যাণের জন্য এই বেদান্তদর্শন-রূপ মাখন তুলেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন ‘জগৎপ্রভু ব্রহ্ম অশেষকল্যাণগুণ-সমন্বিত পুরুষোত্তম।’ মধ্ব পুরোদস্তুর দ্বৈতবাদী। … তিনি বলেন, স্ত্রীলোকের পর্যন্ত বেদপাঠে অধিকার আছে। তিনি প্রধানতঃ পুরাণ থেকে তাঁর মত-স্থাপনের জন্য শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, ব্রহ্ম মানে বিষ্ণু—শিব নন, কারণ বিষ্ণু ভিন্ন মুক্তিদাতা আর কেউ নেই।