মঙ্গলবার, ২৫ জুন
যখনই কোন সুখভোগ করবে, তারপর দুঃখ আসবেই আসবে—এই দুঃখ তখন তখনই আসতে পারে, অথবা খুব বিলম্বেও আসতে পারে। যে আত্মা যত উন্নত, তার সুখের পর দুঃখ তত শীঘ্র আসবে। আমরা যা চাই, তা সুখও নয়, দুঃখও নয়। এ উভয়ই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ ভুলিয়ে দেয়। উভয়ই শিকল—একটা লোহার শিকল, অপরটা সোনার শিকল। এ উভয়ের পশ্চাতেই আত্মা রয়েছেন—তাঁতে সুখও নেই, দুঃখও নেই। সুখ-দুঃখ উভয়ই অবস্থাবিশেষ, আর অবস্থামাত্রেই সদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু আত্মা আনন্দস্বরূপ, অপরিণামী, শান্তিস্বরূপ। আত্মাকে যে আমাদের লাভ করতে হবে, তা নয়; আত্মাকে আমরা পেয়েই আছি, কেবল তাঁর উপর যে ময়লা পড়েছে, সেটি ধুয়ে ফেলে তাঁকে দর্শন কর।
এই আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হও, তা হলেই আমরা জগৎকে ঠিক ঠিক ভালবাসতে পারব। খুব উচ্চভাবে প্রতিষ্ঠিত হও; আমি যে সেই অনন্ত আত্মস্বরূপ—এই জেনে আমাদের জগৎপ্রপঞ্চের দিকে সম্পূর্ণ শান্তভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে। এই জগৎটা একটি ছোট শিশুর খেলার মত; আমরা যখন তা জানি, তখন জগতে যাই হোক না কেন, কিছুতেই আমাদের চঞ্চল করতে পারবে না। যদি প্রশংসা পেলে মন উৎফুল্ল হয়, তবে নিন্দায় নিশ্চয় বিষণ্ণ হবে। ইন্দ্রিয়ের—এমন-কি মনেরও সমুদয় সুখ অনিত্য; কিন্তু আমাদের ভিতরেই সেই নিরপেক্ষ সুখ রয়েছে, যে-সুখ কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না। ঐ সুখ সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত সুখ, ঐ সুখ আনন্দস্বরূপ। সুখের জন্য বাইরের বস্তুর উপর নির্ভর না করে যত ভিতরের উপর নির্ভর করব—যতই আমরা ‘অন্তঃসুখ, অন্তরারাম’ হব, ততই আমরা আধ্যাত্মিক হব। এই আত্মানন্দকেই ‘ধর্ম’ বলা হয়।
অন্তর্জগৎ—যা বাস্তবিক সত্য, তা বহির্জগতের চেয়ে অনন্তগুণে বড়। বহির্জগৎটা সেই সত্য অন্তর্জগতের ছায়াময় প্রক্ষেপমাত্র। এই জগৎটা সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, এটা সত্যের ছায়ামাত্র। কবি বলেছেন, কল্পনা সত্যের সোনালী ছায়া।
আমরা যখন সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করি, তখনই তা আমাদের পক্ষে সজীব হয়ে ওঠে। আমাদের বাদ দিলে জগৎটা অচেতন, মৃত জড়পদার্থ মাত্র। আমরাই জগতের পদার্থসমূহকে জীবন দান করছি, কিন্তু আবার মূর্খের মত ঐ কথা ভুলে গিয়ে কখনও তা থেকে ভয় পাচ্ছি, কখনও আবার তাই ভোগ করতে যাচ্ছি।
সেই মেছুনীদের মত হয় না। কয়েকজন মেছুনী আঁষচুবড়ি মাথায় করে বাজার থেকে বাড়ী ফিরছিল—এমন সময় খুব ঝড়বৃষ্টি এলো। তারা বাড়ী যেতে না পেরে পথে তাদের এক আলাপী মালিনীর বাগানবাড়ীতে আশ্রয় নিলে। মালিনী রাত্রে তাদের যে ঘরে শুতে দিলে, তার ঠিক পাশেই ফুলের বাগান। হাওয়াতে বাগানের সুন্দর সুন্দর ফুলের গন্ধ তাদের নাকে আসতে লাগল—সেই গন্ধ তাদের এত অসহ্য বোধ হতে লাগলো যে, তারা কোনমতে ঘুমোতে পারে না। শেষে তাদের মধ্যে একজন বললে, ‘দেখ, আমাদের আঁষচুবড়িগুলোতে জল ছড়িয়ে দিয়ে মাথার কাছে রেখে দেওয়া যাক।’ তাই করাতে যখন নাকের কাছে সেই আঁষচুবড়ির গন্ধ আসতে লাগলো, তখন তারা আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল।
এই সংসার আঁষচুবড়ির মত—আমরা যেন সুখভোগের জন্য ওর উপর নির্ভর না করি; যারা করে, তারা তামসপ্রকৃতি বা বদ্ধজীব। তারপর আবার রাজসপ্রকৃতির লোক আছে, তাদের অহংটা খুব প্রবল, তারা সদাই ‘আমি, আমি’ বলে থাকে। তারা কখনও কখনও সৎকার্য করে থাকে, চেষ্টা করলে তারা ধার্মিক হতে পারে। কিন্তু সাত্ত্বিক প্রকৃতিই সর্বশ্রেষ্ঠ—তারা সদাই অন্তর্মুখ—তারা সদাই আত্মনিষ্ঠ। প্রত্যেক ব্যক্তিতেই এই সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ আছে; এক এক সময় মানুষে এক এক গুণের প্রাধান্য হয় মাত্র।
সৃষ্টি মানে একটা কিছু নির্মাণ বা তৈরি করা নয়, সৃষ্টি মানে—যে সাম্য-ভাব নষ্ট হয়ে গেছে, সেইটাকে আবার ফিরে পাবার চেষ্টা, যেমন একটা শোলার ছিপি (cork) যদি টুকরো টুকরো করে জলের নীচে ফেলে দেওয়া যায়, তা হলে সেগুলো যেমন আলাদা আলাদা বা একসঙ্গে কতকগুলো মিলে জলের উপরে ভেসে ওঠবার চেষ্টা করে, সেই রকম। যেখানে জীবন—যেখানে জগৎ, সেখানে কিছু না কিছু মন্দ, কিছু না কিছু অশুভ থাকবেই থাকবে। একটুখানি অশুভ থেকেই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। জগতে যে কিছু কিছু মন্দ রয়েছে, এ খুব ভাল; কারণ সাম্যভাব এলে এই জগৎই নষ্ট হয়ে যাবে। সাম্য ও বিনাশ যে এক কথা। যতদিন এই জগৎ চলছে, ততদিন সঙ্গে সঙ্গে ভাল-মন্দও চলবে; কিন্তু যখন আমরা জগৎকে অতিক্রম করি, তখন ভাল-মন্দ দুয়েরই পারে চলে যাই—পরমানন্দ লাভ করি।
জগতে দুঃখবিরহিত সুখ, অশুভবিরহিত শুভ—কখনও পাবার সম্ভাবনা নেই; কারণ জীবনের অর্থই হচ্ছে বিনষ্ট সাম্যভাব। আমাদের চাই মুক্তি; জীবন সুখ বা শুভ—এ-সবের কোনটাই নয়। সৃষ্টিপ্রবাহ অনন্তকাল ধরে চলেছে—তার আদিও নেই, অন্তও নেই, যেন একটা অগাধ হ্রদের উপরকার সদা-গতিশীল তরঙ্গ। ঐ হ্রদের এমন সব গভীর স্থান আছে, যেখানে আমরা এখনও পৌঁছতে পারিনি; আর কতকগুলো জায়গা আছে, যেখানে সাম্যভাব পুনঃস্থাপিত হয়েছে—কিন্তু উপরের তরঙ্গ সর্বদাই চলেছে, সেখানে অনন্তকাল ধরে ঐ সাম্যাবস্থা-লাভের চেষ্টা চলেছে| জীবন ও মৃত্যু একটা ব্যাপারেরই বিভিন্ন নামমাত্র, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। উভয়ই মায়া—এ অবস্থাটা পরিষ্কার করে বোঝাবার জো নেই; এক সময়ে বাঁচবার চেষ্টা হচ্ছে, আবার পরমু্হূর্তে বিনাশ বা মৃত্যুর চেষ্টা। আমাদের যথার্থ স্বরূপ আত্মা—এ দুয়েরই পারে। আমরা যখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করি, তা আর কিছু নয়, তা প্রকৃতপক্ষে সেই আত্মাই—যা থেকে আমরা নিজেদের পৃথক্ করে ফেলেছি, আর আমাদের থেকে পৃথক্ বলে উপাসনা করছি! কিন্তু সেই উপাস্য চিরকালই আমাদের প্রকৃত আত্মা—এক ও একমাত্র ঈশ্বর, যিনি পরমাত্মা।
সেই নষ্ট সাম্যাবস্থা ফিরে পেতে গেলে আমাদের প্রথমে তমঃকে ব্যর্থ করতে হবে রজঃ দ্বারা, পরে রজঃকে জয় করতে হবে সত্ত্ব দ্বারা। সত্ত্ব অর্থে সেই স্থির ধীর প্রশান্ত অবস্থা, যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, শেষে অন্যান্য ভাব একেবারে চলে যাবে। বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে দাও, মুক্ত হও, যথার্থ ‘ঈশ্বরতনয়’ হও, তবেই যীশুর মত পিতাকে দেখতে পাবে। ধর্ম ও ঈশ্বর বলতে অনন্ত শক্তি, অনন্ত বীর্য বুঝায়। দুর্বলতা—দাসত্ব ত্যাগ কর। যদি তুমি মুক্তস্বভাব হও, তবেই তুমি কেবল আত্মামাত্র; যদি মুক্তস্বভাব হও, তবেই অমৃতত্ব তোমার করতলগত; যদি মুক্তস্বভাব হন, তবেই বলব—ঈশ্বর যথার্থ আছেন।
* * *
জগৎটা আমার জন্য, আমি কখনও জগতের জন্য নই। ভাল-মন্দ আমাদের দাসস্বরূপ, আমরা কখনও তাদের দাস নই। পশুর স্বভাব—উন্নতি করা নয়, বরং যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় পড়ে থাকা; মানুষের স্বভাব—মন্দ ত্যাগ করে ভালটা পাবার চেষ্টা করা। আর দেবতার স্বভাব—ভাল-মন্দ কিছুর জন্য চেষ্টা থাকবে না—সর্বদা সর্বাবস্থায় আনন্দময় হয়ে থাকা। আমাদের দেবতা হতে হবে। হৃদয়টাকে সমুদ্রের মত মহান্ করে ফেল; সাংসারিক তুচ্ছতার পারে চলে যাও; এমন-কি অশুভ এলেও আনন্দে উন্মত্ত হয়ে যাও; জগৎটাকে একটা ছবির মত দেখ; এইটি জেনে রাখ যে, জগতে কোন কিছুই তোমায় বিচলিত করতে পারে না; আর এইটি জেনে জগতের সৌন্দর্য উপভোগ কর। জগতের সুখ কি রকম জান?—যেমন ছোট ছোট ছেলেরা খেলা করতে করতে কাদার মধ্য থেকে কাচের পুঁতি কুড়িয়ে পেয়েছে। জগতের সুখ-দুঃখের উপর শান্তভাবে দৃষ্টিপাত কর, ভাল-মন্দ উভয়কেই সমান বলে দেখ—দুই-ই ভগবানের খেলা; সুতরাং ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ—সবেতেই আনন্দ কর।
* * *
আমার গুরুদেব বলতেন, ‘সবই নারায়ণ বটে, কিন্তু বাঘ-নারায়ণের কাছ থেকে সরে থাকতে হয়। সব জলই নারায়াণ বটে, তবে ময়লা জল খাওয়া যায় না।’
‘গগনময় থালে রবিচন্দ্র-দীপক’ জ্বলে—অন্য মন্দিরের আর কি দরকার? ‘সব চক্ষু তোমার চক্ষু, অথচ তোমার চক্ষু নেই; সব হস্ত তোমার হস্ত, অথচ তোমার হস্ত নেই।’
কিছু পাবার চেষ্টা কর না, কিছু এড়াবার চেষ্টাও কর না—যা কিছু আসে গ্রহণ কর, ‘যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্ট’ হও। কোন কিছুতেই বিচলিত না হওয়াই মুক্তি বা স্বাধীনতা। কেবল সহ্য করে গেলে হবে না, একেবারে অনাসক্ত হও। সেই ষাঁড়ের গল্পটি মনে রেখ।
একটা মশা অনেকক্ষণ ধরে একটা ষাঁড়ের শিঙে বসেছিল—অনেকক্ষণ বসবার পর তার বিবেক বুদ্ধি জেগে উঠল; হয়তো ষাঁড়ের শিঙে বসে থাকার দরুন তার বড় কষ্ট হচ্ছে—এই মনে করে সে ষাঁড়কে সম্বোধন করে বলতে লাগল, ‘ভাই ষাঁড়, আমি অনেকক্ষণ তোমার শিঙের উপর বসে আছি, বোধ হয় তোমার অসুবিধে হচ্ছে, আমায় মাপ কর, এই আমি উড়ে যাচ্ছি।’ ষাঁড় বললে, ‘না, না, তুমি সপরিবারে এসে আমার শিঙে বাস কর না—তাতে আমার কি এসে যায়?’
বুধবার, ২৬ জুন
যখন আমাদের অহংজ্ঞান থাকে না, তখনই আমরা সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারি, অপরকে আমাদের ভাবে সবচেয়ে বেশী অভিভূত করতে পারি। বড় বড় প্রতিভাশালী লোকেরা সকলেই এ-কথা জানেন। ঈশ্বরই একমাত্র যথার্থ কর্তা—তাঁর কাছে হৃদয় খুলে দাও, নিজে নিজে কিছু করতে যেও না। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, ‘ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।’—হে অর্জুন, ত্রিলোকে আমার কর্তব্য বলে কিছুই নেই। তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর কর, সম্পূর্ণভাবে অনাসক্ত হও, তা হলেই তোমার দ্বারা কিছু কাজ হবে। যে-সব শক্তিতে কাজ হয়, সেগুলি তো আর আমরা দেখতে পাই না, আমরা কেবল তাদের ফলটা দেখতে পাই মাত্র। অহংকে সরিয়ে দাও, নাশ করে ফেল, ভুলে যাও; তোমার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর কাজ করুন—এ তো তাঁরই কাজ। আমাদের আর কিছু করতে হবে না—কেবল সরে দাঁড়াতে হবে, তাঁকে কাজ করতে দিতে হবে। আমরা যত সরে যাব, ততই ঈশ্বর আমাদের ভিতর আসবেন। ‘কাঁচা আমি’টাকে দূর করে দাও। কেবল ‘পাকা আমি’টাই থাক্।
আমরা এখন যা হয়েছি, তা আমাদের চিন্তারই ফলস্বরূপ। সুতরাং তোমরা কি চিন্তা কর, সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রেখো। বাক্য তো গৌণ জিনিষ। চিন্তাগুলিই বহুকালস্থায়ী, আর তাদের গতিও বহুদূরব্যাপী। আমরা যে-কোন চিন্তা করি, তাতেই আমাদের চরিত্রের ছাপ লেগে যায়; এইজন্য সাধুপুরুষদের ঠাট্টায় বা গালাগালিতে পর্যন্ত তাঁদের হৃদয়ের ভালবাসা ও পবিত্রতার একটুখানি রয়ে যায় এবং তা আমাদের কল্যাণসাধনই করে।
কিছুই কামনা কর না। ঈশ্বরের চিন্তা কর, কিন্তু কোন ফল-কামনা কর না। যাঁরা কামনাশূন্য, তাঁদেরই কাজ ফলপ্রসূ। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীরা লোকের দ্বারে দ্বারে ধর্ম বহন করে নিয়ে যান, কিন্তু তাঁরা মনে করেন, আমরা কিছুই করছি না। তাঁরা কোনরূপ দাবীদাওয়া করেন না, তাঁদের কাজ অজ্ঞাতসারেই হয়ে থাকে। যদি তাঁরা (ঐহিক) জ্ঞান-বৃক্ষের ফল২৬ খান, তা হলে তো তাঁদের অহংকার এসে যাবে, আর যা কিছু লোক-কল্যাণ তাঁরা করবেন—সব লোপ পেয়ে যাবে। যখনই আমরা ‘আমি’ এই কথা বলি, তখনই আমরা আহাম্মক বনে যাই আর বলি, আমরা ‘জ্ঞান’ লাভ করেছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘চোখ-ঢাকা বলদের মত’ আমরা ঘানিতেই ক্রমাগত ঘুরছি। ভগবান্ বেশ ভালভাবে আপনাকে লুকিয়ে রেখেছেন, তাই তাঁর কাজও খুব ভাল। এইরূপ যিনি আপনাকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রাখতে পারেন, তিনি সবচেয়ে বেশী কাজ করতে পারেন। নিজেকে জয় কর, তা হলেই সমুদয় জগৎ তোমার পদতলে আসবে।
সত্ত্বগুণে অবস্থিত হলে আমরা সকল বস্তুর আসলস্বরূপ দেখতে পাই, তখন আমরা পঞ্চেন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির অতীত দেশে চলে যাই। অহংই সেই বজ্রদৃঢ় প্রাচীর, যা আমাদের বদ্ধ করে রেখেছে—সত্যের মুক্ত বাতাসে যেতে দিচ্ছে না—সকল বিষয়েই, সকল কাজেই ‘আমি, আমার’ এই ভাব মনে এনে দেয়—আমরা ভাবি, আমি অমুক কাজ করেছি, তমুক কাজ করেছি, ইত্যাদি। এই ক্ষুদ্র আমিত্বটাকে দূর করে দাও, আমাদের মধ্যে এই যে অহংরূপ শয়তানি ভাব রয়েছে, তাকে একেবারে মেরে ফেলো। ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’ এই মন্ত্র উচ্চারণ কর, প্রাণে প্রাণে এটা অনুভব কর, জীবনে ঐ ভাবটাকে নিয়ে এস। যতদিন না এই অহংভাব-গঠিত জগৎটাকে ত্যাগ করতে পারছি, ততদিন আমরা কখনই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারব-না—কেউ কখনও পারেনি, আর পারবেও না। সংসার ত্যাগ করা মানে—এই ‘অহং’টাকে একেবারে ভুলে যাওয়া, অহংটার দিকে একেবারে খেয়াল না রাখা; দেহে বাস করা যেতে পারে, কিন্তু আমরা যেন দেহের না হয়ে যাই। এই দুষ্ট ‘আমি’টাকে একেবারে নষ্ট করে ফেলতে হবে। লোকে যখন তোমায় মন্দ বলবে, তুমি তাদের আশীর্বাদ কর; ভেবে দেখ, তারা তোমার কত উপকার করেছে; অনিষ্ট যদি কারও হয়, তো কেবল তাদের নিজেদের হচ্ছে। এমন জায়গায় যাও, যেখানে লোকে তোমাকে ঘৃণা করে; তারা তোমার অহংটাকে মেরে মেরে তোমার ভেতর থেকে বার করে দিক্—তুমি তা হলে ভগবানের খুব কাছে অগ্রসর হবে। বানরী যেমন তার বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে থাকে, কিন্তু পরিশেষে বাধ্য হলে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাকে পদদলিত করতেও পশ্চাৎপদ হয় না, সেইরূপ আমরাও সংসারটাকে যতদিন পারি আঁকড়ে ধরে থাকি, কিন্তু অবশেষে যখন তাকে পদদলিত করতে বাধ্য হই, তখনই আমরা ঈশ্বরের কাছে যাবার অধিকারী হই। ন্যায়ধর্মের জন্য যদি অপরের অত্যাচার সহ্য করতে হয় তো আমরা ধন্য; যদি আমরা লিখতে পড়তে না জানি তো আমরা ধন্য; ঈশ্বরের কাছ থেকে আমাদের তফাত করবার জিনিষ অনেক কমে গেল।
ভোগ হচ্ছে লক্ষফণা সাপ—তাকে আমাদের পদদলিত করতে হবে। আমরা এই ভোগ ত্যাগ করে অগ্রসর হতে থাকি; কিছুই না পেয়ে হয়তো আমরা নৈরাশ্যে অবসন্ন হই। কিন্তু লেগে থাক, লেগে থাক—কখনই ছেড় না। এই সংসারটা একটা অসুরের মত। এ যেন একটা রাজ্য—আমাদের ক্ষুদ্র ‘অহং’ তার রাজা। তাকে সরিয়ে দিয়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াও। কাম-কাঞ্চন, নাম-যশ ত্যাগ করে দৃঢ়ভাবে ঈশ্বরকে ধরে থাক, অবশেষে আমরা সুখে দুঃখে সম্পূর্ণ উদাসীনতা লাভ করব। ইন্দ্রিয়-চরিতার্থতাই সুখ—এ ধারণা একেবারে জড়বাদী। ওতে এক কণাও যথার্থ সুখ নেই; যা কিছু সুখ, তা সেই প্রকৃত আনন্দের প্রতিবিম্বমাত্র।
যাঁরা ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁরা তথাকথিত কর্মীদের চেয়ে জগতের জন্য অনেক বেশী কাজ করেন। আপনাকে সম্পূর্ণ শুদ্ধ করেছে, এমন একজন লোক হাজার ধর্মপ্রচারকের চেয়ে বেশী কাজ করে। চিত্তশুদ্ধি ও মৌন থেকেই কথার ভিতর জোর আসে।
পদ্মের মত হও। পদ্ম এক জায়গাতেই থাকে, কিন্তু যখন ফুটে ওঠে, তখন চারদিক্ থেকে মৌমাছি আপনি এসে জোটে।
শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেন ও শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের ভিতর পাপ বা অশুভ দেখতে পেতেন না—তিনি জগতে কিছু মন্দ দেখতে পেতেন না, কাজেই সেই মন্দ দূর করবার জন্য চেষ্টা করারও কোন প্রয়োজন বোধ করতেন না। আর কেশবচন্দ্র একজন মস্ত নৈতিক সংস্কারক, নেতা এবং ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দ্বাদশ বর্ষ পরে এই শান্তপ্রকৃতি দক্ষিণেশ্বরের মহাপুরুষ শুধু ভারতে নয়, সমগ্র জগতের ভাবরাজ্যে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়ে গেছেন। এই-সকল নীরব মহাপুরুষ বাস্তবিক মহাশক্তির আধার—তাঁরা প্রেমে তন্ময় হয়ে জীবন-যাপন করে ভব-রঙ্গমঞ্চ হতে সরে যান। তাঁরা কখনও ‘আমি, আমার’ বলেন না। তাঁরা নিজেদের ঈশ্বরের যন্ত্রস্বরূপ জ্ঞান করেই ধন্য মনে করেন। এরূপ ব্যক্তিগণই খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ-সকলের নির্মাতা। তাঁরা সদাই ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে তাদাত্ম্য লাভ করেন, এই বাস্তব জগৎ থেকে বহুদূরে এক ভাব-জগতে বাস করেন। তাঁরা কিছুই চান না এবং জ্ঞাতসারে কিছু করেনও না। তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে জগতের সর্বপ্রকার উচ্চভাবের প্রেরকস্বরূপ—তাঁরা জীবন্মুক্ত, একেবারে অহংশূন্য। তাঁদের ক্ষুদ্র অহংজ্ঞান একেবারে উড়ে গেছে, কোন আকাঙ্ক্ষা একেবারেই নেই। তাঁদের ব্যক্তিত্ব লুপ্ত হয়ে গেছে, তাঁরা শুধুই তত্ত্বস্বরূপ।
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন
(স্বামীজী অদ্য বাইবেলের নিউ টেস্টামেণ্ট লইয়া আসিলেন এবং পুনর্বার ‘জনের গ্রন্থ’ পড়িয়া ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন।)
যীশুখ্রীষ্ট যে শান্তিদাতা পাঠিয়ে দেবেন বলেছিলেন, মহম্মদ আপনাকে সেই ‘শান্তিদাতা’ বলে দাবী করতেন। তাঁর মতে—যীশুখ্রীষ্ট্রের অলৌকিক ভাবে জন্ম হয়েছিল, এ-কথা স্বীকার করবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। সকল যুগে, সকল দেশেই এইরূপ দাবী দেখতে পাওয়া যায়। সকল মহামানব দাবী করেছেন, দেবতা থেকেই তাঁদের জন্ম।
জ্ঞান আপেক্ষিক মাত্র। আমরা ঈশ্বর হতে পারি, কিন্তু তাঁকে কখনই জানতে পারি না। জ্ঞান একটা নিম্নতর অবস্থামাত্র। তোমাদের বাইবেলেও আছে, আদম যখন ‘জ্ঞান লাভ’ করলেন, তখনই তাঁর পতন হল। তার পূর্বে তিনি স্বয়ং সত্যস্বরূপ, পবিত্রতা-স্বরূপ, ঈশ্বরস্বরূপ ছিলেন। আমাদের মুখ আমাদের থেকে কিছু পৃথক্ পদার্থ নয়, কিন্তু আমরা কখনও আসল মুখটা দেখতে পাই না, শুধু প্রতিবিম্বটাই দেখতে পাই। আমরা নিজেরাই প্রেমস্বরূপ, কিন্তু যখন ঐ প্রেমসম্বন্ধে চিন্তা করতে যাই, তখনই দেখি—আমাদের একটা কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। তাতেই প্রমাণ হয় যে, জড়বস্তু চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ।
নিবৃত্তি-অর্থে সংসার থেকে সরে আসা। হিন্দুদের পুরাণে আছে, প্রথম সৃষ্ট চারজন ঋষিকে২৭ হংসরূপী ভগবান্ শিক্ষা দিয়েছিলেন—সৃষ্টিপ্রপঞ্চ গৌণমাত্র; সুতরাং তাঁরা আর প্রজাসৃষ্টি করলেন না। এর তাংপর্য এই যে, অভিব্যক্তির অর্থই অবনতি; কারণ আত্মাকে অভিব্যক্তি করতে গেলে শব্দ দ্বারা ঐ অভিব্যক্তি সাধিত হয়, আর ‘শব্দ ভাবকে নষ্ট করে ফেলে’।২৮ তা হলেও তত্ত্ব জড়াবরণে আবৃত না হয়ে থাকতে পারে না, যদিও আমরা জানি যে অবশেষে এইরূপ আবরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে রাখতে আমরা আসলটাকেই হারিয়ে ফেলি। সকল বড় বড় আচার্যই এ-কথা বোঝেন, আর সেইজন্যই অবতারেরা পুনঃপুনঃ এসে আমাদের মূল তত্ত্বটি বুঝিয়ে দিয়ে যান, আর সেইকালের উপযোগী তার একটি নূতন আকার দিয়ে যান। আমার গুরুদেব বলতেনঃ ধর্ম এক; সকল অবতারকল্প পুরুষ একপ্রকার শিক্ষাই দিয়ে যান, তবে সকলকেই সেই তত্ত্বটি প্রকাশ করতে কোন-না-কোন আকার দিতে হয়। সেইজন্য তাঁরা তাকে তার পুরাতন আকার থেকে তুলে নিয়ে একটি নূতন আকারে আমাদের সামনে ধরেন। যখন আমরা নাম-রূপ থেকে—বিশেষতঃ দেহ থেকে মুক্ত হই, যখন আমাদের ভাল-মন্দ কোন দেহের প্রয়োজন থাকে না, তখনই কেবল আমরা বন্ধন অতিক্রম করতে পারি। ‘অনন্ত উন্নতি’ মানে অনন্তকালের জন্য বন্ধন; তার চেয়ে সকল রকম আকৃতির ধ্বংসই বাঞ্ছনীয়। সব রকম দেহ, এমন-কি দেবদেহ থেকেও আমাদের মুক্তিলাভ করতে হবে। ঈশ্বরই একমাত্র সত্যবস্তু, সত্যবস্তু কখনও দুটি থাকতে পারে না। একমাত্র আত্মাই আছেন, এবং ‘আমিই সেই’।
মুক্তিলাভের সহায়ক বলেই শুভকর্মের যা মূল্য; যে কাজ করে, ঐ কর্ম দ্বারা তারই কল্যাণ হয়—অপর কারও কিছু হয় না।
* * *
জ্ঞান মানে—শ্রেণীবদ্ধ করা, কতকগুলি জিনিষকে এক শ্রেণীর ভিতর ফেলা। আমরা একই প্রকারের অনেকগুলি জিনিষ দেখলাম—দেখে সেই সবগুলির একটা কোন নাম দিলাম, তাতেই আমাদের মন শান্ত হল। আমরা কেবল কতকগুলি ‘ঘটনা’ বা ‘তথ্য’ আবিষ্কার করে থাকি, কিন্তু কেন সেগুলি ঘটছে, তা জানতে পারি না। অজ্ঞানের অন্ধকারেই আরও খানিকটা বেশী জায়গা এক পাক ঘুরে এসে আমরা মনে করি, কিছু জ্ঞানলাভ করলাম। এই জগতে ‘কেন’র কোন উত্তর পাওয়া যেতে পারে না; ‘কেন’র উত্তর পেতে হলে আমাদের ভগবানের কাছে যেতে হবে। ‘জ্ঞাতা’কে কখনও প্রকাশ করা যায় না। এ যেন এক-টুকরো নুনের সমুদ্রে পড়ে যাওয়া—যেই পড়ল, অমনি গলে সমুদ্রে মিশে গেল।
বৈষম্যই সৃষ্টির মূল—একরসতা বা সমতাই ঈশ্বর। এই বৈষম্যভাবের পারে চলে যাও; তা হলেই জীবন ও মৃত্যু—দুই-ই জয় করবে, এবং অনন্ত সমত্বে পৌঁছবে, তখনই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হবে—ব্রহ্মস্বরূপ হবে। মুক্তিলাভ কর, সে চেষ্টায় প্রাণ যায়, তাও স্বীকার। একখানা বইয়ের সঙ্গে তার পাতাগুলির যে সম্বন্ধ, আমাদের সঙ্গে জন্মান্তরের জীবনগুলিরও সেই সম্বন্ধ; আমরা কিন্তু অপরিণামী, সাক্ষিস্বরূপ, আত্মা; আর তাঁরই উপর জন্মান্তরের ছায়া পড়ছে; যেমন একটা মশাল খুব জোরে জোরে ঘোরাতে থাকলে চোখে একটা বৃত্তের প্রতীতি হয়। আত্মাতেই সমস্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গতি; আর যেহেতু আত্মা অনন্ত, অপরিণামী ও অচঞ্চল, সেহেতু আত্মা ব্রহ্মস্বরূপ—পরমাত্মা। আত্মাকে জীবন বলতে পারা যায় না, কিন্তু তাই থেকেই সুখের উৎপত্তি হয়।
* * *
আজকাল জগতের লোক ভগবানকে পরিত্যাগ করছে, কারণ তাদের ধারণা—জগতের যতদূর সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করা উচিত, তা তিনি করছেন না; তাই লোকে বলে থাকে, ‘তাঁকে নিয়ে আমাদের লাভ কি?’ ঈশ্বরকে একজন মিউনিসিপ্যালিটির কর্তা বলে ভাবতে হবে নাকি?
আমরা এইটুকু করতে পারি যে, আমাদের সব বাসনা, ঈর্ষা, ঘৃণা, ভেদবুদ্ধি—এইগুলিকে দূর করে দিতে পারি। ‘কাঁচা আমি’কে নষ্ট করে ফেলতে হবে, মনকে মেরে ফেলতে হবে—একরকম মনে মনে আত্মহত্যা করা আর কি! শরীর ও মনকে পবিত্র ও সুস্থ রাখ—কিন্তু কেবল ঈশ্বরলাভ করবার যন্ত্ররূপে; এইটুকু এদের যথার্থ প্রয়োজন। কেবল সত্যের জন্যই সত্যের অনুসন্ধান কর; তার দ্বারা আনন্দলাভ হবে, এ-কথা ভেব না। আনন্দ আপনা হতে আসতে পারে, কিন্তু তার জন্যই যেন সত্যলাভে উৎসাহিত হয়ো না। ঈশ্বরলাভ ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য রেখ না। সত্যলাভ করবার জন্য যদি নরকের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, তাতেও পেছ-পা হয়ো না।