দেবতার সাজা

থর্‌ নরওয়ে দেশের যুদ্ধ দেবতা।
যুদ্ধের দেবতা কিনা, তাই তাঁর গায়ে অসাধারণ জোর। তাঁর অস্ত্র একটা প্রকাণ্ড হাতুড়ি। সেই সর্বনেশে হাতুড়ির এক ঘা খেলে পাহাড় পর্যন্ত গুঁড়ো হ’য়ে যায়, কাজেই স হাতুড়ির সামনে কেউ এগুতে সাহস পায় না। তার উপর থরের একটা কোমর-বন্ধ ছিল, সেটাকে কোমরে বেঁধে নিলে তাঁর গায়ের জোর দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
থরের মনে ভারি অহঙ্কার, তাঁর সমান বীর আর তাঁর সমান পালোয়ান পৃথিবীতে বা স্বর্গে আর কেউ নেই।
একদিন থর্‌ দেখলেন, একটা পাহাড়ের পাশে একটা প্রকাণ্ড দৈত্য ঘুমিয়ে আছে আর এমন নাক ডাকাচ্ছে যে গাছপালা পর্যন্ত ঠক্‌ঠক্‌ করে কাঁপছে। থর্‌ বললেন, “এই বেয়াদব, নাক ডাকাচ্ছিস্‌ যে?” বলেই হাতুড়ি দিয়ে ধাঁই ধাঁই ক’রে, তার মাথায় তিন ঘা লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ওই হাতুড়ির অমন ঘা খেয়েও দৈত্যের কিছুই হল না, সে খালি মাথা চুলকিয়ে বলল, “পাখিতে কি ফেলল?”
থর্‌ আশ্চর্য হ’য়ে বললেন, “তুমি ত খুব বাহাদুর হে, আমার এ হাতুড়ির ঘা সহ্য করতে পারে, এমন লোক যে কেউ আছে, তা আমি জানতাম না।”
দৈত্য বলল, “তা জান্‌বেন কোত্থেকে, আমাদের দেশে ত যান নি কখন। সেখানে আমার চেয়েও বড়, আমার চেয়েও ষণ্ডা ঢের ঢের দৈত্য আছে।” থর্‌ বললেন, “বটে? তবে ত আমার একবার সেখানে যেতে হচ্ছে।”
দৈত্য তাঁকে দৈত্যপুরীর পথ দেখিয়ে দিল আর বলল, “দেখবেন, সেখানে গিয়ে বেশি বড়াই টড়াই করবেন না কারণ আপনি যত বড়ই দেবতা হন না কেন, সে দেশে বাহাদুরি করতে গেলে শেষে লজ্জা পেতে হবে।”
দৈত্যপুরীর চারদিকে প্রকাণ্ড বরফের দেয়াল— সে এত বড় যে তার নীচে দাঁড়ালে চুড়ো দেখা যায় না। সেই দেয়ালের এক জায়গায় বড় বড় গরাদ দেওয়া আকাশের মত উঁচু ফটক। থর্‌ দেখলেন সে ফটক খোলা তার সাধ্য নয়, তাই তিনি দুটো গরাদের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। দেওয়াল-ঘেরা দৈত্যপুরীর রাজসভায় বসে বসে পাহাড়ের মত বড় বড় দৈত্যরা সব গল্প করছে; তাদের মধ্যে সব চেয়ে বড় যে, সেই হ’চ্ছে দৈত্যের রাজা।
দৈত্যরা থর্‌কে দেখেও যেন দেখেনি এমনিভাবে গল্প করতে লাগল। খানিক পরে দৈত্যরাজ থরের দিকে তাকিয়ে, বড় বড় চোখ ক’রে, যেন কতই আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কেও? আরে, আরে, থর্‌ নাকি? আপনিই কি সেই দেবতা, যাঁর গায়ে ভয়ানক জোর। তা হবেও বা, শুধু শরীর বড় হ’লেই ত আর গায়ে জোর হয় না? আচ্ছা, আপনার সম্বন্ধে যে সকল ভয়ানক গল্প শুনি সে সব কি সত্যি?”
থর্‌ বললেন, “সত্যি কিনা, এখনি বুঝবে। ওরে কে আছিস, আমায় একটু জল দে ত, এক চুমুকে কতখানি খাওয়া যায় তোদের একবার দেখিয়ে দি।”
তখন রাজার হুকুমে একটা শিঙায় ক’রে ঠাণ্ডা জল এনে থর্‌কে দেওয়া হল। রাজা বললেন, “আমাদের মধ্যে বড় বড় পালোয়ান ছাড়া কেউ ওটাকে এক চুমুকে খালি করতে পারে না। সাধারণ দৈত্যরা দুই চুমুকে শেষ করে। তবে যারা নেহাৎ আনাড়ি, তাদের তিন চুমুক লাগে।”
থর্‌ তাড়াতাড়ি শিঙাটা নিয়ে চোঁ চোঁ ক’রে এমন টান দিলেন যে, মনে হল শিঙা নিশ্চয়ই খালি হ’য়ে গেছে। কিন্তু কি আশ্চর্য! শিঙা যেমন ভর্তি প্রায় তেমনই রইল। থর্‌ ভারি লজ্জিত হ’য়ে আবার জল খেতে লাগলেন— ঢক্‌ ঢক্‌ ঢক্‌ ঢক্‌ ঢক্‌ ঢক্‌ ঢক্‌, তবু জল ফুরাল না।
রাজা হো হো ক’রে হেসে বললেন, “তাইত, অনেকটা যে বাকী রাখলেন।”
থর্‌ তখন রেগে খুব একটা দম নিয়ে আবার চুমুক দিলেন; খাওয়া আর থামে না— পেট ঢাক হ’য়ে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হ’য়ে এল, কিন্তু জল তবু ফুরাতে চায় না। তখন থর্‌ আর কি করে? তিনি বললেন, “না, জল খাওয়াতে আর বেশি বাহাদুরী কি? পেটুকের মত খানিকটা জল গিল্‌লেই ত আর গায়ের জোর প্রমাণ হয় না। দেখি ত আমার মত ভারী জিনিস কে তুলতে পারে।” দৈত্যরাজ বললেন, “তা বেশ ত। একটা সহজ পরীক্ষা দিয়েই আরম্ভ করা যাক্‌— ওরে, আমার বেড়ালটাকে নিয়ে আয় ত।” বলতেই ছেয়ে রঙের বেড়াল ঘরের মধ্যে ঢুকল। থর্‌ তাড়াতাড়ি বেড়ালটাকে ঘাড়ে ধ’রে ছুড়ে ফেলতে গেলেন। কিন্তু বেড়ালটা এমনি শক্ত ক’রে মাটি আঁকড়ে রইল যে অনেক টানাটানির পর তার একটি পা মাটি থেকে মাত্র এক আঙুল উঠান গেল!
দৈত্যরাজ বললেন, “না, আমারই অন্যায় হয়েছে। এতটুকু লোক, সে কি ওই ধাড়ি বেড়ালটাকে তুলতে পারে?”
থর্‌ তখন ভয়ানক চটে গিয়ে বললেন, “বটে! এতটুকু হই আর যাই হই— দেখি ত, কে আমার সঙ্গে কুস্তিতে পারে?”
দৈত্য বলল, তবেই ত মুস্কিলে ফেললেন! আপনার সঙ্গে লড়াই করবার লোক এখন আমি কোথায় পাই? আচ্ছা দেখি— ওরে বুড়ী ঝিটাকে ডেকে আনত।”
মান্ধাতার আমলের এক বুড়ী, তার চুল সব শাদা, তার মুখে দাঁত নেই, গাল-টাল সব তুবড়ে গিয়েছে— সে এল কুস্তি করতে। থর্‌ ত চটেই লাল! বললেন, “একি, তামাসা পেয়েছ?” দৈত্যরা তাতে আরো হাসতে লাগল। বলল, “ও বুড়ি, থাক্‌ থাক্‌, ওকে মারিসনে— ও ভয় পেয়েছে।” থর্‌ তখন তেড়ে গিয়ে বুড়িকে এক ধাক্কা দিলেন। তাতে বুড়ী তাঁকে ঘাড় ধ’রে মাটিতে বসিয়ে দিল!
থর্‌ তখন আর কি করেন? লজ্জায় তাঁর মাথা হেঁট হয়ে গেল। সারারাত্রি সে অপমানের কথা ভেবে তাঁর ঘুম হল না। পরদিন সকালবেলাই তিনি বাড়ি চললেন। দৈত্যরাজ খুব খাতির কর তাঁর সঙ্গে সঙ্গে পুরীর ফটক পর্যন্ত এলেন। ফটকের কাছে এসে দৈত্যরাজ হেসে বললেন, “আপনাকে একটা কথা বলছি, কারণ সেটা না বললে অন্যায় হয়। কাল কিন্তু সত্যিই আপনার হার হয় নি। আপনার অহঙ্কার ভাঙবার জন্যই আমরা আপনাকে একটু ফাঁকি দিয়েছি। ঐ যে শিঙাটা দেখলেন, ওটা সমুদ্রের শিঙা। সমস্ত সমুদ্রের জল না ফুরালে ওর জল ফুরায় না। আপনি যে তিন চুমুক দিয়েছিলেন, তাতে কতক জায়গায় সমুদ্রের ধারে চড়া পড়ে গিয়েছে।”
“আর ঐ যে বেড়ালটা কি জানেন? ও হ’চ্ছে ‘স্ক্রাইমিড্‌’— যে সাপের মত সমস্ত পাহাড় নদী সমুদ্র শুদ্ধ পৃথিবীটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখে! আপনার টানে পৃথিবীটা প্রায় দশখানা হয়ে ফাটবার জোগাড় করে ছিল।”
“আর ঐ বুড়ী ঝি হ’চ্ছে জরা, অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়স। বুড়ো বয়সে কা’কে না কাবু করে? আর, কাল সকালে আপনি যে দৈত্যের মাথায় হাতুড়ি মেরেছিলেন আমিই সেই দৈত্য। সে হাতুড়ি আমার মাথায় একটুও লাগে নি। আমি আগে থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য এক মায়া পাহাড়ের আড়াল দিয়েছিলাম— ঐ দেখুন আপনার হাতুড়িতে তার কি দুর্দশা হয়েছে।”
থর্‌ যখন এসব ফাঁকির কথা শুনলেন— তখন তিনি রেগে কাঁপতে লাগলেন। হাতুড়িটাকে মাথার উপরে তুলে বোঁ বোঁ ক’রে ঘুরিয়ে তিনি যেই সেটা ছুঁড়তে যাবেন, অমনি দেখেন— কোথায় দৈত্য, কোথায় পুরী, —চারিদিকে কোথাও কিছু নাই!
মনের রাগ মনে মনেই হজম ক’রে থর্‌ সেদিন বাড়ি ফিরলেন।