স্বর্গের দেবতারা যেখানে থাকেন, সেখান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবার একটিমাত্র পথ; সে পথ রামধনুকের তৈরী। জলের রঙে আগুন আর বাতাসের রং মিশিয়ে দেবতারা সে পথ বানিয়েছেন। আশ্চর্য সুন্দর সেই পথ, স্বর্গের দরজা থেকে নামতে নামতে পৃথিবী ফুঁড়ে পাতাল ফুঁড়ে কোন অন্ধকার ঝরণার নিচে মিলিয়ে গেছে। কোথাও তার শেষ নেই।
পথটি পেয়ে দেবতাদের আনন্দও হল, ভয়ও হল। ভয় হল এই ভেবে যে, ঐ পথ বেয়ে দুর্দান্ত দানবগুলো যদি স্বর্গে এসে পড়ে! দেবতারা সব ভাবনায় বসেছেন, এমন সময় চারদিক ঝলমলিয়ে, আলোর মত পোশাক প’রে, হীমদল এসে হাজির হলেন। হীমদল কে? হীমদল হলেন আদি দেবতা অদীনের ছেলে। তাঁর মায়েরা নয়টি বোন, সাগরের মেয়ে। তাঁদের কাছে পৃথিবীর বল, সমুদ্রের মধু, আর সূর্যের তেজ খেয়ে তিনি মানুষ হয়েছেন। তাঁকে দেখেই দেবতারা সব ব’লে উঠলেন, “এস হীমদল, এস মহাবীর, আমাদের রামধনুকের প্রহরী হয়ে স্বর্গদ্বারের রক্ষক হও।”
সেই অবধিই হীমদলের আর অন্য কাজ নেই, তিনি যুগযুগান্তর রাত্রিদিন স্বর্গদ্বারে প্রহর জাগেন। ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, একটিবার পলক ফেললেই বহুদিনের সমস্ত শ্রান্তি জুড়িয়ে যায়। রামধনুকের ছায়ার নিচে সারারাত শিশির ঝরে, তার একটি কণাও হীমদলের চোখ এড়ায় না। পাহাড়ের গায়ে গায়ে সবুজ কচি ঘাস গজায়, হীমদল কান পেতে তার আওয়াজ শোনেন। ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে ঢুকবে এমন কারও সাধ্যি নেই। হাতে তাঁর এক শিঙের বাঁশি, সেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে স্বর্গ মর্ত পাতাল জুড়ে হুঙ্কার বাজবে, “সাবধান! সাবধান!”—সেই সঙ্গে ত্রিভুবনের সকল প্রাণী কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠবে। এমনি করে প্রস্তুত হয়ে হীমদল সেখানে পাহারা দিতে লাগলেন।
কিন্তু দেবতাদের মনের ভয় তবুও কিছু কমল না। তাঁরা বললেন, “বিপদ বুঝে সাবধান হয়েও যদি বাইরের শত্রুকে ঠেকাতে না পারি, তখন আমাদের উপায় হবে কি? যদি বাঁচতে হয় ত’ অক্ষয়দুর্গ গড়তে হবে। আকাশজোড়া স্বর্গটিকে দুর্গ দিয়ে ঘিরতে হবে।” কিন্তু, তেমন দুর্গ বানাবে কে? নানাজনে নানারকম মন্ত্রণা দিচ্ছেন, কিন্তু কোন কিছুই মীমাংসা হচ্ছে না। এমন সময় কোথাকার এক অজানা কারিগর এসে খবর দিল, হুকুম পেলে আর বকশিশ পেলে সে অক্ষয়দুর্গ বানাতে পারে। হিমের অসুর ঋমতুরষ্ যে ছদ্মবেশে কারিগর হয়ে এসেছেন, দেবতারা তা বুঝতে পারলেন না। তাঁরা বললেন, “কি রকম তুমি বকশিশ চাও?” কারিগর বলল, “চন্দ্র চাই, সূর্য চাই, আর স্বর্গের মেয়ে ফ্রেয়াকে চাই।”
আবদার শুনে দেবতারা সব রেগে উঠলেন। সবাই বললেন, “বেয়াদবকে দূর করে দাও।” কিন্তু দেবতাদের মধ্যে একজন ছিলেন, তাঁর নাম লোকী; তিনি সকম রকম দুর্বুদ্ধির দেবতা। লোকী বললেন, “আচ্ছা, কাজটা আগে করিয়ে নিই না—তারপর দেখা যাবে।” দুষ্ট দেবতার কূট মন্ত্রণা শুনে দেবতারা সব ঋম্তুরষ্কে বললেন, “তুমি চন্দ্র পাবে, সূর্য পাবে, দেবকন্যা ফ্রেয়াকে পাবে, যদি একলা তোমার ঘোড়ার সাহায্যে শীতকালের মধ্যে এ কাজটাকে শেষ করতে পার।” ছদ্মবেশী অসুর বলল, “অতি উত্তম! এই কথাই ঠিক রইল।”
সেদিন থেকে ঋম্তুরষের বিশ্রাম নেই। সারাদিন সে পাথর ব’য়ে ঘোড়াকে দিয়ে স্বর্গে তোলায়, সারারাত দুর্গ বানায়। দেবতারা ঠিক যেমন বলে দিয়েছেন, তেমনি করে পাথরের পর পাথর জুড়ে আকাশ ফুঁড়ে অক্ষয়দুর্গ গড়ে উঠেছে। শীত যখন ফুরোয় ফুরোয়, তখন দেবতারা দেখলেন, সর্বনাশ! দুর্গের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে, একটিমাত্র ফটক বাকি—সে ত শুধু একদিনের কাজ! এখন উপায়? এতদিনের চন্দ্র সূর্য স্বর্গ থেকে খসে পড়বে? সুন্দরী ফ্রেয়া শেষটায় অজানা এক কারিগরকে বিয়ে করবে? ভয়ে ভাবনায় ক্ষেপে গিয়ে সবাই বললে, “হতভাগা লোকীর কথায় আমাদের এই বিপদ হল, ও এখন এর উপায় করুক, তা না হলে ওকেই আমরা মেরে ফেলব।”
লোকী আর করবে কি? সন্ধ্যা হতেই সে স্বর্গ হতে বেরিয়ে দেখল, অনেক দূরে মেঘের নিচে কারিগরের ঘোড়া পাহাড়ের সমান পাথর টেনে ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। লোকী তখন মায়াবলে আকাশ-ঘোটকীর রূপ ধ’রে চিঁহি চিঁহি ক’রে অদ্ভুত সুরে ডাকতে ডাকতে একটা বনের ভিতর থেকে দৌড়ে বেরুল। সেই শব্দে ঋম্তুরষের ঘোড়া চম্কে উঠে, লাগাম ছিঁড়ে, সাজ খসিয়ে, উর্ধ্বমুখে মন্ত্রে-চালান পাগলের মত ছুটে চলল। দিক-বিদিকের বিচার নেই, পথ-বিপথের খেয়াল নেই, আকাশের কিনারা দিয়ে, আধাঁরের ভিতর দিয়ে, বনের পর বন, পাহাড়ের পর পাহাড়, কেবল ছুট্ ছুট্ ছুট্। লোকীও ছুটেছে, ঘোড়াও ছুটেছে, আর ‘হায় হায়’ চিৎকার ক’রে পিছন পিছন ঋম্তুরষ ছুটে চলেছে। এমনি করে শীতকালের শেষ রাত্রি প্রভাত হল, দুষ্ট দেবতা শূন্যে কোথায় মিলিয়ে গেল, অসুর এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘোড়া ধরল। তখন বসন্তের প্রথম কিরণে পুবের মেঘে রং ধরেছে, দক্ষিণ বাতাহ জেগে উঠেছে।
অসুর বুঝল এ সমস্তই দেবতার ফাঁকি। কোথায় বা চন্দ্র সূর্য, কোথায় বা দেবকন্যা ফ্রেয়া! এতদিনের পরিশ্রম সব একেবারেই পণ্ড। ভাবতে ভাবতে অসুরের মাথা গরম হল, ভীষণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে দেবতাদের সে মারতে চলল। দূর থেকে তার মূর্তি দেখেই দেবরাজ থর্ বুঝলেন, অসুর আসছে স্বর্গপুরী ধ্বংস করতে। তিনি তখন ব্যস্ত হয়ে তাঁর বিরাট হাতুড়ি ছুঁড়ে মারলেন। অসুরের বিশাল দেহ চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ল।
কিন্তু, দেবতাদের মনে আর শান্তি রইল না। এই অন্যায় কাজের জন্য তাঁরা লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। দেবতাদের মুখ মলিন দেখে সাগরের দেবতা ঈগিন বললেন, “আমার প্রবালপুরীতে রাজভোজ হবে, তোমরা এস—ভাবনাচিন্তা দূর কর।” দেবতাদের সবাই এলেন, কেবল লোকীকে কেউ খবর দিল না। সবাই যখন ভোজে বসেছেন, লোকী তখন জানতে পেরে ভোজের সভায় হাজির হয়ে সকলকে গাল দিতে দিতে বিনা দোষে ঈগিনের প্রিয় দাস ফন্ফনকে মেরে ফেলল। দেবতারা অনেক দিন অনেক সয়েছেন, আজকে তাঁরা সহ্য করতে পারলেন না। লোকীর সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের কথা তাঁদের মনে পড়ল। তাঁরা বললেন, “এই লোকীর জন্য স্বর্গের সর্বনাশ হচ্ছে। এই হিংসুকে লোকী থরের স্ত্রীর সোনার চুল চুরি করেছিল; এই কাপুরুষ লোকীই বাজি রেখে নিজের মুণ্ড পণ ক’রে বাজি হেরে পালিয়েছিল; এই বিশ্বাসঘাতক লোকীই স্বর্গের অমৃতফল আসুরের হাতে দিয়েছিল; এই হতভাগা লোকীই ফ্রেয়াকে রাক্ষসের কাছে পাঠাতে চেয়েছিল; এই চোর লোকীই ফ্রেয়ার গলার সোনার হার সরাতে গিয়ে হীমদলের হাতে সাজা পেয়েছিল; এই পাষণ্ড লোকীই নিষ্পাপ বলোদরের মৃত্যুর কারণ! এই লোকী পৃথিবীতে গিয়ে অত্যাচার করে, পাতালে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে মন্ত্রণা করে! মারো এই অপদার্থকে।” লোকী প্রাণভয়ে পালাতে গেল কিন্তু স্বয়ং দেবরাজ থর আর আদি দেবতা অদীন যখন তাঁর পিছনে ছুটলেন, তখন সে আর পালাবে কোথায়? বিষের ঝরণার নিচে হাত-পা বেঁধে লোকীকে ফেলে রাখা হল। লোকীর স্ত্রী সিগীন যতক্ষণ ঝরণাতলায় পাত্রে ক’রে বিষ ধরেন আর ফেলে দেন, ততক্ষণ লোকী একটু আরাম পায়; আর সিগীন যদি মুহূর্তের জন্য খেতে যান কি ঘুমিয়ে পড়েন, তবে বিষের যন্ত্রণায় লোকীর আর সোয়াস্তি থাকে না।
দেবতারা ভাবলেন, স্বর্গের পাপ দূর হল, স্বর্গে এবার শান্তি এল। কিন্তু হায়! তার অনেক আগেই পাপের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে। লোকীর জন্য স্বর্গের পাপ মর্তে নেমেছে, পাতালে ঢুকে অসুর পিশাচ দৈত্য দানব সবগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে। যে বনের লোহার গাছে লোহার পাতা, সেই বনের ছায়ায় বসে লোকীর রাক্ষসী স্ত্রী অঙ্গুর্বদা নেকড়ে-মুখো পিশাচ-রাহুদের যত্ন ক’রে পাপীর হাড় আর পাপীর মজ্জা খাইয়ে খাইয়ে বাড়িয়ে তুলছে। তারা চন্দ্র সূর্যের পিছন পিছন যুগের পর যুগ ছুটে বেড়ায়। এতদিনে খেয়ে খেয়ে তাদের মূর্তি এমন ভীষণ হল যে চন্দ্র সূর্য ম্লান হয়ে কাঁপতে লাগল, পৃথিবী চৌচির হয়ে ফেটে উঠল, আকাশের নক্ষত্রেরা খসে খসে পড়তে লাগল। পাতালের রক্তকুকুর আর রাহুর বাপ ফেন্রিস বিকট শব্দে ছুটে বেরুল। লোকী তার বাঁধন ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। সৃষ্টির মেরুদণ্ড য়গদ্রাসিল বা জগৎতরুর শিকড় কেটে মহানাগ নিধুগ বিকট মূর্তিতে বেরিয়ে এল। আর তারই সঙ্গে ভীষণ শব্দে হীমদলের শিঙার আওয়াজ বেজে উঠল—সাবধান! সাবধান! সাবধান!
দেবতারা সব ঘুমের থেকে লাফিয়ে উঠে রামধনুকের রঙিন পথে নেমে আসলেন। যে বিরাট সাপ সমুদ্রের গভীর গুহায় দেবতার ভয়ে লুকিয়ে ছিল, সে আজ সমুদ্রের জল তোলপাড় করে বেরিয়ে এল। হিমের দেশের আসুররা সব ঝাপসা ধোঁয়ার বর্ম প’রে কুয়াশায় চ’ড়ে এগিয়ে এল। অগ্নিপুরীর দৈত্যদানব মশাল জ্বেলে চারিদিক রাঙিয়ে এল। তারপর আকাশ চিরে দৈত্যরাজ সূর্ত্র এলেন; আগুনের শিখার মত, প্রলয়ের উল্কার মত, এসেই তিনি স্বর্গদ্বারের সেতুর উপরে দলেবলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আর রামধনুকের রঙিন সেতু কাচের মত গুঁড়িয়ে গেল।
তারপরেই প্রলয় যুদ্ধ। আদি দেবতা অদীনের একটি মাত্র চোখ, আর নেকড়ে অসুর ফেন্রিসের সঙ্গে লড়তে গিয়েই বিপদে পড়লেন। রাহুর বাপ ফেন্রিস, তার মা হল রাক্ষসী অঙ্গুর্বদা আর বাপ স্বয়ং লোকী। অসুরের প্রকাণ্ড দেহ যুদ্ধের উৎসাহে বাড়তে বাড়তে পাহাড় পর্বত ছাড়িয়ে উঠল; তার রক্তমাখা হাঁ-করা মুখে অদীন একবার ঢুকে গেলেন; আর তাঁকে পাওয়াই গেল না। ফ্রেয়ার ভাই মহাবীর ফ্র গোলমালে তাঁর অজেয় খড়্গ খুঁজেই পেলেন না; তিনি সূর্ত্রের হাতে প্রাণ হারালেন। দেবরাজ থর ভীষণ হাতুড়ির ঘায়ে সমুদ্রের বিরাট সাপকে খণ্ড খণ্ড করে আপনি তার বিষাক্ত রক্তে ডুবে গেলেন। এদিকে অদীনের পুত্র বিদার এসে পিতৃঘাতী ফেন্রিস্কে দুই টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন। বড় বড় দেবতা অসুর একে একে সবাই যখন প্রায় শেষ হয়েছে, তখন সূর্ত্রের হাত থেকে আগুনের খড়্গ ছুটে গিয়ে স্বর্গে মর্তে পাতালে প্রলয়ের আগুন জ্বেলে দিল। গাছপালা পুড়ে গেল, নদীর জল শুকিয়ে গেল, স্বর্গের সোনার পুরী ভস্ম হয়ে মিলিয়ে গেল। তারপর সব যখন ফুরিয়ে গেল তখন বিদার দেখলেন, বড় বড় দেবতা অসুর কেউ আর বাকি নেই। কেবল থরের দুই ছেলে যুদ্ধের শ্মশানে থরের হাতুড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে!
আর লোকী? বিশ্বাসঘাতক লোকী অসুরের দলের মধ্যে ম’রে রয়েছে—হীমদলের খড়্গ তার বুকে বসান। হীমদলও মহাযুদ্ধে অবসন্ন হয়ে বীরের মত রক্তাক্ত বেশে মরে আছেন।