দুর্গে ফিরিয়া কিছুক্ষণ সিঁড়ি ওঠা-নামার ক্লান্তি দূর করিলম। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া বলিল, ‘রামকিশোরবাবু দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলেন। যদি হয়ে যায়, তাহলে ওদের বাড়িতে একটা নাড়াচাড়া তোলাপাড়া হবে; বংশী আর মুরলীধর হয়তো শহরে গিয়ে বাড়ি-ভাড়া করে থাকতে চাইবে। তার আগেই এ ব্যাপারের একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার।’
প্রশ্ন করিলম, ‘ব্যোমকেশ, কিছু বুঝছ? আমি তো যতাই দেখছি, ততাই জট পাকিয়ে যাচ্ছে।’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা আবছায়া চলচ্চিত্রের ছবি মনের পদায় ফুটে উঠছে। ছবিটা ছোট নয়; অনেক মানুষ অনেক ঘটনা অনেক সংঘাত জড়িয়ে তার রূপ। একশ বছর আগে এই নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছিল, এখনও শেষ হয়নি।–ভাল কথা, কাল রাত্রের আলগা পাথরটার কথা মনে ছিল না। চল, দেখি গিয়ে তার তলায় গর্ত আছে কি না।’
‘চল।’
পাথরটার উপর অল্প-অল্প চুন সুরকি জমাট হইয়া আছে, আশেপাশের পাথরগুলির মত মসৃণ নয়। ব্যোমকেশ দেখিয়া বলিল, ‘মনে হচ্ছে পাথরটাকে তুলে আবার উল্টো করে বসানো হয়েছে। এসো, তুলে দেখা যাক।’
আমরা আঙুল দিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলম, কিন্তু পাথর উঠিল না। তখন সীতারামকে ডাকা হইল। সীতারাম করিতকমা লোক, সে একটা খুন্তি আনিয়া চাড়া দিয়া পাথর তুলিয়া ফেলিল।
পাথরের নীচে গর্তটর্ত কিছু নাই, ভরাট চুন সুরকি। ব্যোমকেশ পাথরের উল্টা পিঠ পরীক্ষা করিয়া বলিল, ‘ওহে, এই দ্যাখো, উর্দু-ফারসী লেখা রয়েছে!’
দেখিলাম পাথরের উপর কয়েক পংক্তি বিজাতীয় লিপি খোদাই করা রহিয়াছে। খোদাই খুব গভীর নয়, উপরন্তু লেখার উপর ধূলাবালি জমিয়া প্রায় অলক্ষণীয় হইয়া পড়িয়াছে। ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল, ‘আমার মনে হচ্ছে—। দাঁড়াও, ঈশানবাবুর খাতাটা নিয়ে আসি।’
ঈশানবাবুর খাতা ব্যোমকেশ নিজের কাছে রাখিয়াছিল। সে তাহা আনিয়া যে-পাতায় ফারসী লেখা ছিল, তাহার সহিত পাথরের উৎকীর্ণ লেখাটা মিলাইয়া দেখিতে লাগিল। আমিও দেখিলাম। অর্থবোধ হইল না বটে, কিন্তু দু’টি লেখার টান যে একই রকম তাহা সহজেই চোখে পড়ে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হয়েছে। এবার চল।’
পাথরটি আবার যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়া আমরা ঘরে আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ব্যাপার বুঝলে?’
‘তুমি পরিষ্কার করে বল।’
‘একশ বছর আগের কথা স্মরণ কর। সিপাহীরা আসছে শুনে রাজারাম তাঁর পরিবারবর্গকে সরিয়ে দিলেন, দুর্গে রইলেন কেবল তিনি আর জয়রাম। তারপর বাপবোঁটায় সমস্ত ধনরত্ন লুকিয়ে ফেললেন।
‘কিন্তু সোনাদানা লুকিয়ে রাখার পর রাজারামের ভয় হল, সিপাহীদের হাতে তাঁরা যদি মারা পড়েন, তাহলে তাঁদের স্ত্রী-পরিবার সম্পত্তি উদ্ধার করবে কি করে? তিনি পাথরের উপর সঙ্কেত-লিপি লিখলেন; এমন ভাষায় লিখলেন যা সকলের আয়ত্ত নয়। তারপর ধুলোেকাদা দিয়ে লেখাটা অস্পষ্ট করে দিলেন, যাতে সহজে সিপাহীদের নজরে না পড়ে।
‘সিপাহীরা এসে কিছুই খুঁজে পেল না। রাগে তারা বাপবেটাকে হত্যা করে চলে গেল। তারপর রাজারামের পরিবারবগ যখন ফিরে এল, তারাও খুঁজে পেল না। রাজারাম কোথায় তাঁর ধনরত্ন লুকিয়ে রেখে গেছেন। পাথরের পার্টিতে খোদাই করা ফারসী সঙ্কেত-লিপি কারুর চোখে পড়ল না।’
বলিলাম, তাহলে তোমার বিশ্বাস, রাজারামের ধনরত্ন এখনও দুৰ্গে লুকোনো আছে।’
‘তাই মনে হয়। তবে সিপাহীরা যদি রাজারাম আর জয়রামকে যন্ত্রণা দিয়ে গুপ্তস্থানের সন্ধান বার করে নিয়ে থাকে তাহলে কিছুই নেই।’
‘তারপর বল।’
‘তারপর একশ বছর পরে এলেন অধ্যাপক ঈশান মজুমদার। ইতিহাসের পণ্ডিত ফারসী-জোনা লোক; তার ওপর বন্ধু রামবিনোদের কাছে দুর্গের ইতিবৃত্ত শুনেছিলেন। তিনি সন্ধান করতে আরম্ভ করলেন; প্রকাশ্যে নয়, গোপনে। তাঁর এই গুপ্ত অনুসন্ধান কতদূর এগিয়েছিল জানি না, কিন্তু একটা জিনিস তিনি পেয়েছিলেন-ঐ পাথরে খোদাই করা সঙ্কেত-লিপি। তিনি সযত্নে তার নকল খাতায় টুকে রেখেছিলেন, আর পাথরটাকে উল্টে বসিয়েছিলেন, যাতে আর কেউ না দেখতে পায়। তারপর-তারপর যে কী হল সেইটেই আমাদের আবিষ্কার করতে হবে।’
ব্যোমকেশ খাটের উপর চিৎ হইয়া শুইয়া উর্ধের্ব চাহিয়া রহিল। আমিও আপন মনে এলোমেলো চিস্তা করিতে লাগিলাম। পাণ্ডেজি এবেলা বোধহয় আসিলেন না। …কলিকাতায় সত্যবতীর খবর কি.ব্যোমকেশ হঠাৎ তুলসীর সহিত এমন সস্নেহে কথা বলিল কেন? মেয়েটার চৌদ্দ বছর বয়স, দেখিলে মনে হয় দশ বছরেরটি…
দ্বারের কাছে ছায়া পড়িল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখি, তুলসী আর গদাধর। তুলসীর চোখে শঙ্কা ও আগ্রহ, বোধহয় একা আসিতে সাহস করে নাই, তাই গদাধরকে সঙ্গে আনিয়াছে। গদাধরের কিন্তু লেশমাত্র শঙ্কা-সঙ্কোচ নাই; তাহার হাতে লাট্টু, মুখে কান-এঁটো-করা হাসি। আমাকে দেখিয়া হাস্য সহকারে বলিল, ‘হে হে জামাইবাবুর সঙ্গে তুলসীর বিয়ে হবে-হে হে হে–’
তুলসী বিদ্যুদ্বেগে ফিরিয়া তাহার গালে একটি চড় বসাইয়া দিল। গদাধর ক্ষণেক গাল ফুলাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর গভীরমুখে লাটুতে লেক্তি পাকাইতে পাকাইতে প্ৰস্থান করিল। বুঝিলাম ছোট বোনের হাতে চড়-চাপড় খাইতে সে অভ্যস্ত।
তুলসীকে ব্যোমকেশ আদর করিয়া ঘরের মধ্যে আহ্বান করিল, তুলসী কিন্তু আসিতে চায় না, দ্বারের খুঁটি ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ব্যোমকেশ তখন তাহাকে হাত ধরিয়া আনিয়া খাটের উপর বসাইয়া দিল।
তবু তুলসীর ভয় ভাঙে না, ব্যাধশঙ্কিত হরিণীর মত তার ভাবভঙ্গী। ব্যোমকেশ নরম সুরে সমবয়স্কের মত তাহার সহিত গল্প করিতে আরম্ভ করিল। দুটা হাসি তামাসার কথা, মেয়েদের খেলাধুলা পুতুলের বিয়ে প্রভৃতি মজার কাহিনী্,–শুনিতে শুনিতে তুলসীর ভয় ভাঙিল। প্রথমে দু’ একবার ‘হুঁ’ ‘না’, তারপর সহজভাবে কথা বলিতে আরম্ভ করিল।
মিনিট পনরোর মধ্যে তুলসীর সঙ্গে আমাদের সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হইল। দেখিলাম তাহার মন সরল, বুদ্ধি সতেজ; কেবল তাহার স্নায়ু সুস্থ নয়; সামান্য কারণে স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়া সহজতর মাত্রা ছাড়াইয়া যায়। ব্যোমকেশ তাহার চরিত্র ঠিক ধরিয়াছিল। তাই সমেহ ব্যবহারে তাহাকে আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে।
তুলসীর সহিত আমাদের যে সকল কথা হইল, তাহা আগাগোড়া পুনরাবৃত্তি করিবার প্রয়োজন নাই, তাহাদের পরিবার সম্বন্ধে এমন অনেক কথা জানা গেল যাহা পূর্বেই লিপিবদ্ধ হইয়াছে। বাকিগুলি লিপিবদ্ধ করিতেছি।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখানে এসে যিনি ছিলেন, তোমার বাবার বন্ধু ঈশানবাবু্, তাঁর সঙ্গে তোমার ভাব হয়েছিল?
তুলসী বলিল, ‘হ্যাঁ। তিনি আমাকে কত গল্প বলতেন। রাত্তিরে তাঁর ঘুম হত না; আমি অনেক বার দুপুর রাত্তিরে এসে তাঁর কাছে গল্প শুনেছি।’
‘তাই নাকি! তিনি যে-রাত্তিরে মারা যান সে-রাত্তিরে তুমি কোথায় ছিলে?’
‘সো-রাত্তিরে আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।’
‘ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল! সে কি!’
‘হ্যাঁ। আমি যখন-তখন যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই কিনা, তাই ওরা সুবিধে পেলেই আমাকে বন্ধ করে রাখে।’
‘ওরা কারা?’
‘সবাই। বাবা বড়দা মেজদা জামাইবাবু–’
‘সে-রাত্তিরে কে তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল?’
‘বাবা।’
‘হুঁ। আর কাল রাত্ৰে বুঝি মেজদা তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল?’
‘হ্যাঁ-তুমি কি করে জানলে?’
‘আমি সব জানতে পারি। আচ্ছা, আর একটা কথা বল দেখি। তোমার বড়দার বিয়ে হয়েছিল, বৌদিদিকে মনে আছে?’
‘কেন থাকবে না? বৌদিদি খুব সুন্দর ছিল। দিদি তাকে ভারি হিংসে করত।’
‘তাই নাকি! তা তোমার বৌদিদি আত্মহত্যা করল কেন?’
‘তা জানি না। সে-রাত্তিরে দিদি আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।’
‘ও–’
ব্যোমকেশ আমার সহিত একটা দৃষ্টি বিনিময় করিল। কিছুক্ষণ অন্য কথার পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা তুলসী, বল দেখি বাড়ির মধ্যে তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসো?’
তুলসী নিঃসঙ্কোচে অলজ্জিত মুখে বলিল, ‘মাস্টার মশাইকে। উনিও আমাকে খুব ভালবাসেন।’
‘আর মণিলালকে তুমি ভালবাসো না?’
তুলসীর চোখ দুটা যেন দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল—‘না। ও কেন মাস্টার মশাইকে হিংসে করে! ও কোন মাস্টার মশাইয়ের নামে বাবার কাছে লাগায়? ও যদি আমাকে বিয়ে করে আমি ওকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেব।’ বলিয়া তুলসী ছুটিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
আমরা দুই বন্ধু পরস্পর মুখের পানে চাহিয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘বেচারি’
আধা ঘন্টা পরে স্নানের জন্য উঠি-উঠি করিতেছি, রমাপতি আসিয়া দ্বারে উঁকি মারিল, কুষ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘তুলসী এদিকে এসেছিল না কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, এই খানিকক্ষণ হল চলে গেছে। এস-বোসো।’
রমাপতি সঙ্কুচিতভাবে আসিয়া বসিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘রমাপতি, প্রথম যেদিন আমরা এখানে আসি, তুমি বলেছিলে এবার ঈশানবাবুর মৃত্যু-সমস্যার সমাধান হবে। অথাৎ, তুমি মনে কর ঈশানবাবুর মৃত্যুর একটা সমস্যা আছে। কেমন?’
রমাপতি চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ধরে নেওয়া যাক ঈশানবাবুর মৃত্যুটা রহস্যময়, কেউ তাকে খুন করেছে। এখন আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি তার সোজাসুজি উত্তর দাও। সঙ্কোচ কোরো না। মনে কর তুমি আদালতে হলফ নিয়ে সাক্ষী দিচ্ছ।’
রমাপতি ক্ষীণ স্বরে বলিল, ‘বলুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাড়ির সকলকেই তুমি ভাল করে চেনো। বল দেখি, ওদের মধ্যে এমন কে মানুষ আছে যে খুন করতে পারে?’
রমাপতি সভয়ে কিয়াৎকাল নীরব থাকিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমার বলা উচিত নয়, আমি ওঁদের আশ্রিত। কিন্তু অবস্থায় পড়লে বোধহয় সবাই মানুষ খুন করতে পারেন।’
‘সবাই? রামকিশোরবাবু?’
‘হ্যাঁ।’
‘বংশীধর?’
‘হ্যাঁ।’
‘মুরলীধর?
‘হ্যাঁ। ওঁদের প্রকৃতি বড় উগ্র—’
‘নায়েব চাঁদমোহন?’
‘বোধহয় না। তবে কর্তার হুকুম পেলে লোক লাগিয়ে খুন করাতে পারেন।’
‘মণিলাল?’
রমাপতির মুখ অন্ধকার হইল, সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, ‘নিজের হাতে মানুষ খুন করবার সাহস ওঁর নেই। উনি কেবল চুকলি খেয়ে মানুষের অনিষ্ট করতে পারেন।’
‘আর তুমি? তুমি মানুষ খুন করতে পার না?’
‘আমি–’
‘আচ্ছা, যাক।–তুমি টর্চ চুরি করেছিলে?’
রমাপতি তিক্তমুখে বলিল, ‘আমার বদনাম হয়েছে জানি। কে বদনাম দিয়েছে তাও জানি। কিন্তু আপনিই বলুন, যদি চুরিই করতে হয়, একটা সামান্য টর্চ চুরি করব।’
‘অর্থাৎ চুরি করনি। —যাক, মণিলালের সঙ্গে তুলসীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তুমি জানো?’
রমাপতির মুখ কঠিন হইয়া উঠিল। কিন্তু সে সংযতভাবে বলিল, ‘জানি। কর্তার তাই ইচ্ছে।’
‘আর কারুর ইচ্ছে নয়?’
‘না।’
‘তোমারও ইচ্ছে নয়?’
রমাপতি উঠিয়া দাঁড়াইল,–‘আমি একটা গলগ্ৰহ, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কী আসে যায়। কিন্তু এ বিয়ে যদি হয়, একটা বিশ্ৰী কাণ্ড হবে।’ বলিয়া আমাদের অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ দ্বারের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘ছোকরার সাহস আছে!’