পরিশিষ্ট

দুর্গরহস্য – ২.৫

পাণ্ডেজি ফিরিলেন বেলা বারোটার পর। হেলমেট খুলিয়া ফেলিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন‌, ‘কাজ হল বটে কিন্তু বুড়ো গোড়ায় গোলমাল করেছিল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গোলমাল কিসের?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘বেলা হয়ে গেছে‌, খেতে বসে সব বলব। আপনি কিছু পেলেন?’

‘খেতে বসে বলব।’

আহারে বসিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনি আগে বলুন। কাল তো রামকিশোরবাবু নিমরাজী ছিলেন‌, আজ হঠাৎ বেঁকে বসলেন কেন?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘কাল আমরা চলে আসবার পর কেউ ওঁকে বলেছে যে আপনি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ। তাতেই উনি ঘাবড়ে গেছেন।’

‘এতে ঘাবড়াবার কি আছে? ওঁর মনে যদি পাপ না থাকে–’

‘সেই কথাই শেষ পর্যন্ত আমাকে বলতে হল। বললাম‌, ‘হলাই বা ব্যোমকেশবাবু ডিটেকটিভ‌, আপনার ভয়টা কিসের? আপনি কি কিছু লুকোবার চেষ্টা করেছেন?’ তখন বুড়ো তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল।’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘আমার তাই সন্দেহ হল। কিন্তু ঈশানবাবুর মৃত্যুঘটিত কোনো কথা নয়। অন্য কিছু। যা হোক‌, আমি ঠিক করে এসেছি‌, আজই ওরা দুৰ্গটাকে আপনাদের বাসের উপযোগী করে রাখবে। আপনারা ইচ্ছে করলে আজ বিকেলে যেতে পারেন। কিম্বা কাল সকালে যেতে পারেন।’

‘আজ বিকেলেই যাব।’

‘তাই হবে। কিন্তু আমি আর একটা ব্যবস্থা করেছি। আমার খাস আরদালি সীতারাম আপনাদের সঙ্গে থাকবে।’

‘না না‌, কি দরকার?’

‘দরকার আছে। সীতারাম লাল পাগড়ি পরে যাবে না‌, সাধারণ চাকর সেজে যাবে। লোকটা খুব কুঁশিয়ার; তাছাড়া‌, ওর একটা মস্ত বিদ্যে আছে‌, ও সাপের রোজা। ও সঙ্গে থাকলে অনেক সুবিধে হবে। ভেবে দেখুন‌, আপনাদের জল তোলা কাপড় কাচা বাসন মাজার জন্যেও একজন লোক দরকার। ওদের লোক না নেওয়াই ভাল।’

ব্যোমকেশ সম্মত হইল। পাণ্ডে তখন বলিলেন‌, ‘এবার আপনার হাল বিয়ান করুন।’

ব্যোমকেশ সবিস্তারে ঈশানবাবুর খাতার রহস্য উদঘাটিত করিল। শুনিয়া পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘হুঁ‌, মোহনলাল লোকটা কে ছিল আমারও জানতে ইচ্ছে হচ্ছে‌, কিন্তু একশো বছর পরে আর তার ঠিকানা বার করা সম্ভব হবে না। এদিকে হালের খবর ঈশানবাবু লিখছেন‌, তাঁকে কেউ ভয় দেখিয়ে দুর্গ থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে। তাঁর সন্দেহ বংশীধরের ওপর। কিন্তু সত্যি কথাটা কি? ভয়ই বা দেখালো কী ভাবে?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘এ সব প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া যাবে না। দেখা যাক‌, দুর্গে গিয়ে যদি দুর্গের রহস্য ভেদ করা যায়।’

 

অপরাহ্নে পুলিস ভ্যানে চড়িয়া শৈল-দুর্গে উপস্থিত হইলাম। আমরা তিনজন এবং সীতারাম। পাণ্ডেজি আমাদের ঘর-বসতি করিয়া দিয়া ফিরিয়া যাইবেন‌, সীতারাম থাকিবে। সীতারামের বয়স পয়ত্ৰিশ‌, লিকলিকে লম্বা গড়ন‌, তামাটে ফস রঙ‌, শিকারী বিড়ালের মত গোঁফ { তাহার চেহারার মাহাত্ম্য এই যে‌, সে ভাল কাপড়চোপড় পরিলে তাহাকে ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়‌, আবার নেংটি পরিয়া থাকিলে বাসন-মাজা ভূত্য মনে করিতে তিলমাত্র দ্বিধা হয় না। উপস্থিত তাহার পরিধানে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় কাঁধে গামছা। অথাৎ‌, মোটা কাজের চাকর।

আমাদের সঙ্গে লটবহর কম ছিল না‌, বিছানা বাক্স‌, চাল ডাল আনাজ প্রভৃতি রসদ‌, ইকমিক কুকার এবং আরও কত কি। সীতারাম এবং বুলাকিলাল মালপত্র দুর্গে ঢোলাই করিতে আরম্ভ করিল। পাণ্ডে বলিলেন‌, চলুন‌, গৃহস্বামীর সঙ্গে দেখা করে আসবেন।’

গৃহস্বামী বৃড়ির সদর বারান্দায় উপবিষ্ট ছিলেন‌, সঙ্গে জামাই মণিলাল‌, আমাদের সম্ভাষণ জানাইলেন; আমরা খাবার ব্যবস্থা নিজেরাই করিয়াছি বলিয়া অনুযোগ করিলেন; শহুরে মানুষ পাহাড়ে জঙ্গলে মন বসাইতে পারিব না বলিয়া রসিকতা করিলেন। কিন্তু তাঁহার চক্ষু সতর্ক ও সাবধান হইয়া রহিল।

মিষ্টালাপের সময় লক্ষ্য করিলম‌, বাড়ির অন্যান্য অধিবাসীরা আমাদের শুভাগমনে বেশ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। বংশীধর এবং মুরলীধর চিলের মত চক্রাকারে আমাদের চারিদিকে পরিভ্রমণ করিতেছে‌, কিন্তু কাছে আসিতেছে না। রমাপতি একবার বাড়ির ভিতর হইতে গলা বাড়াইয়া আমাদের দেখিয়া নিঃশব্দে সরিয়া গেল। নায়েব চাঁদমোহন বারান্দার অন্য প্রান্তে থেলো ইঁহঁকোয় তামাক টানিতে টানিতে বক্র দৃষ্টিশলাকায় আমাদের বিদ্ধ করিতেছেন। তুলসী একটা জুই ঝাড়ের আড়াল হইতে কৌতুহলী কাঠবিড়ালীর মত আমাদের নিরীক্ষণ করিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল; কিছুক্ষণ পরে দেখিলাম একটা থামের আড়াল হইতে সে উঁকি মারিতেছে।

ব্যোমকেশ যে একজন খ্যাতনামা গোয়েন্দা এবং কোনও গভীর অভিসন্ধি লইয়া দুর্গে বাস করিতে আসিয়াছে তাহা ইহারা জানিতে পারিয়াছে এবং তদনুযায়ী উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। কেবল গদাধরের জড়বুদ্ধি বোধ হয় এতবড় ধাক্কাতেও সক্রিয় হইয়া ওঠে নাই; তাহাকে দেখিলাম। না।

আমরা গাত্ৰোত্থান করিলে রামকিশোরবাবু বলিলেন‌, ‘শুধু থাকার জন্যেই এসেছেন মনে করবেন। না যেন। আপনারা আমার অতিথি‌, যখন যা দরকার হবে খবর পাঠাবেন।’

‘নিশ্চয়‌, নিশ্চয়।’ আমরা গমনোদ্যত হইলাম। গৃহস্বামী ইশারা করিলেন‌, মণিলাল আমাদের সঙ্গে চলিল; উদ্দেশ্য দুর্গ পর্যন্ত আমাদের আগাইয়া দিয়া আসিবে।

সিঁড়ি দিয়া নামা ওঠার সময় মণিলালের সঙ্গে দুই-চারিটা কথা হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি যে ডিটেকটিভ একথা রামকিশোরবাবু জানলেন কি করে?’

মণিলাল বলিল‌, ‘আমি বলেছিলাম। আপনার নাম আমার জানা ছিল; এর লেখা বই পড়েছি। শুনে কত খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তারপর আপনারা দুর্গে এসে থাকতে চান শুনে ঘাবড়ে গেলেন।’

‘কেন?’

‘এই সেদিন একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেল—’

‘তাই আপনাদের ভয় আমাদেরও সাপে খাবে। ভালো কথা‌, আপনার স্ত্রীও না। সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিলেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘এ অঞ্চলে দেখছি খুব সাপ আছে।’

‘আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমি কখনও চোখে দেখিনি।’

দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া আমরা দুর্গের সিঁড়ি ধরিলাম। হঠাৎ মণিলাল জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কিছু মনে করবেন না‌, আপনারা পুলিসের লোক‌, তাই জানতে কৌতুহল হচ্ছে—ঈশানবাবু ঠিক সাপের কামড়েই মারা গিয়েছিলেন তো?’

ব্যোমকেশ ও পাণ্ডের মধ্যে একটা চকিত দৃষ্টি বিনিময় হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কেন বলুন দেখি? এ বিষয়ে সন্দেহ আছে নাকি?’

মণিলাল ইতস্তত করিয়া বলিল‌, ‘না—তবে-কিছুই তো বলা যায় না—’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘সাপ ছাড়া আর কি হতে পারে?’

মণিলাল বলিল‌, ‘সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। ঈশানবাবুর পায়ে সাপের দাঁতের দাগ আমি নিজের চোখে দেখেছি। ঠিক যেমন আমার স্ত্রীর পায়ে ছিল।’ মণিলাল একটা নিশ্বাস ফেলিল।

দুর্গের তোরণে আসিয়া পৌঁছিলাম। মণিলাল বলিল‌, ‘এবার আমি ফিরে যাব। কর্তার শরীর ভাল নয়‌, তাঁকে বেশিক্ষণ একলা রাখতে সাহস হয় না। কাল সকালেই আবার আসব।’

মণিলাল নমস্কার করিয়া নামিয়া গেল। সূর্য অস্ত গিয়াছিল। রামকিশোরবাবুর বাড়ির মাথার উপর শুক্লা দ্বিতীয়ার কৃশাঙ্গী চন্দ্ৰকলা মুচকি হাসিয়া বাড়ির আড়ালে লুকাইয়া পড়িল। আমরাও তোরণ দিয়া দুর্গের অঙ্গনে প্রবেশ করিলম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ সকালে ডাক্তার ঘটককে তার রুগী সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলাম; এখন দেখছি তার কোনও দরকার ছিল না। সম্পত্তি হস্তান্তরের দলিল রেজিস্ট্রি না হওয়া পর্যন্ত জামাই মণিলাল যক্ষের মত শ্বশুরকে আগলে থাকবে।’

পাণ্ডে একটু হাসিলেন‌, ‘হ্যাঁ-ঈশানবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে এদের খটকা লেগেছে দেখছি। কিন্তু এখন কিছু বলা হবে না।’

‘না।’

আমরা প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া বাড়ির দিকে চলিলাম। পাণ্ডেজির হাতে একটি মুষলাকৃতি লম্বা টর্চ ছিল; সেটির বৈদ্যুতিক আলো যেমন দূরপ্রসারী, প্রয়োজন হইলে সেটিকে মারাত্মক প্রহরণস্বরূপেও ব্যবহার করা চলে। পাণ্ডে টর্চ জ্বালিয়া তাহার আলো সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন‌, বলিলেন‌, ‘এটা আপনাদের কাছে রেখে যাব‌, দরকার হতে পারে। চলুন‌, দেখি আপনাদের থাকার কি ব্যবস্থা হয়েছে।’

দেখা গেল সেই গজল-কন্টকিত ঘরটিতেই থাকার বন্দোবস্ত হইয়াছে। দুইটি লোহার খাট, টেবিল চেয়ার প্রভৃতি আসবাব দেওয়ালের নিরাভরণ দৈন্য অনেকটা চাপা দিয়াছে। সীতারাম ইতিমধ্যে লণ্ঠন জ্বালিয়াছে‌, বিছানা পাতিয়াছে‌, ইকমিক্‌ কুকারে রান্না চড়াইয়াছে এবং স্টেভ জ্বলিয়া চায়ের জল গরম করিতেছে। তাহার কর্মতৎপরতা দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম।

অচিরাৎ ধূমায়মান চা আসিয়া উপস্থিত হইল। চায়ে চুমুক দিয়া পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘সীতারাম‌, কেমন দেখলে?’

সীতারাম বলিল‌, ‘কিল্লা ঘুরে ফিরে দেখে নিয়েছি। হুজুর। এখানে সাপ নেই।’

নিঃসংশয় উক্তি। পাণ্ডে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন‌, ‘যাক‌, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।’

‘আর কিছু?’

‘আর‌, সিঁড়ি ছাড়া কিল্লায় ঢোকবার অন্য রাস্তা নেই। দেয়ালের বাইরে খাড়া পাহাড়।’

ব্যোমকেশ পাণ্ডের দিকে ফিরিয়া বলিলেন‌, ‘এর মানে বুঝতে পারছেন?’

‘কি?’

‘যদি কোনও আততায়ী দুৰ্গে ঢুকতে চায় তাকে সিঁড়ি দিয়ে আসতে হবে। অথাৎ‌, দেউড়ির পাশ দিয়ে আসতে হবে। বুলাকিলাল তাকে দেখে ফেলতে পারে।’

‘হুঁ, ঠিক বলেছেন। বুলাকিলালকে জেরা করতে হবে। কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেছে‌, আজ আর নয়।–সীতারাম‌, তোমাকে বেশি বলবার দরকার নেই। এদের দেখাশুনা করবে‌, আর চোখ কান খুলে রাখবে।’

‘জী হুজুর।’

পাণ্ডেজি উঠিলেন।

‘কাল কোনও সময়ে আসব। আপনারা সাবধানে থাকবেন।’

পাণ্ডেজিকে দুৰ্গতোরণ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিলাম। ব্যোমকেশ টর্চ জ্বলিয়া সিঁড়ির উপর আলো ফেলিল‌, পাণ্ডেজি নামিয়া গেলেন। কিছুকাল পরে নীচে হইতে শব্দ পাইলাম পুলিস ভ্যান চলিয়া গেল। ওদিকে রামকিশোরবাবুর বাড়িতে তখন মিটমিটি আলো জ্বলিয়াছে।

আমরা আবার প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলাম। আকাশে তারা ফুটিয়াছে‌, জঙ্গলের দিক হইতে মিষ্ট বাতাস দিতেছে। সীতারাম যেন আমাদের মনের অকথিত অভিলাষ জানিতে পারিয়া দু’টি চেয়ার আনিয়া অঙ্গনে রাখিয়াছে। আমরা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া উপবেশন করিলম।

এই নক্ষত্রবিদ্ধ অন্ধকারে বসিয়া আমার মন নানা বিচিত্র কল্পনায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। আমরা যেন রূপকথার রাজ্যে উপস্থিত হইয়াছি। সেই যে রাজপুত্র কোঁটালপুত্র কি জানি কিসের সন্ধানে বাহির হইয়া ঘুমস্ত রাজকুমারীর মায়াপুরীতে উপনীত হইয়াছিল‌, আমাদের অবস্থা যেন সেইরূপ। অবশ্য ঘুমন্ত রাজকুমারী নাই‌, কিন্তু সাপের মাথায় মণি আছে কিনা কে বলিতে পারে? কোন অদৃশ্য রাক্ষস-রাক্ষসীরা তাহাকে পাহারা দিতেছে তাহাই বা কে জানে? শুক্তির অভ্যন্তরে মুক্তার ন্যায় কোন অপরূপ রহস্য এই প্রাচীন দুর্গের অস্থিপঞ্জীরতলে লুক্কায়িত আছে?

ব্যোমকেশ ফস করিয়া দেশলাই জ্বলিয়া আমার রোমান্টিক স্বপ্নজাল ভাঙিয়া দিল। সিগারেট ধরাইয়া বলিল‌, ‘ঈশানবাবু ঠিক ধরেছিলেন‌, দুর্গে নিশ্চয় কোথাও গুপ্ত তোষাখানা আছে।’

বলিলাম‌, কিন্তু কোথায়? এতবড় দুর্গের মাটি খুঁড়ে তার সন্ধান বার করা কি সহজ? ‘সহজ নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ঈশানবাবু সন্ধান পেয়েছিলেন; তাঁর মুঠির মধ্যে মোহরের আর কোনও মানে হয় না।’

কথাটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিয়া শেষে বলিলাম‌, ‘তা যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে আরও অনেক মোহর আছে।’

‘সম্ভব। এবং তার চেয়েও বড় কথা‌, ঈশানবাবু যখন খুঁজে বার করতে পেরেছেন তখন অীমরাও পারব।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া অন্ধকারে পায়চারি করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পায়চারি করিবার পর সে হঠাৎ ‘উ’ বলিয়া পড়িয়া যাইতে যাইতে কোনক্রমে সামলাইয়া লইল। আমি লাফাইয়া উঠিলাম–’কি হল!’

‘কিছু নয়‌, সামান্য হোচট খেয়েছি।’ টৰ্চটা তাহার হাতেই ছিল‌, সে তাহা জ্বালিয়া মাটিতে আলো ফেলিল।

দিনের আলোতে যাহা চোখে পড়ে নাই‌, এখন তাহা সহজে চোখে পড়িল। একটা চৌকশ পাথর সম্প্রতি কেহ খুঁড়িয়া তুলিয়াছিল‌, আবার অপটু হস্তে যথাস্থনে বসাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। পাথরটা সমানভাবে বসে নাই‌, একদিকের কোনা একটু উচু হইয়া আছে। ব্যোমকেশ অন্ধকারে ওই উঁচু কানায় পা লাগিয়া হোঁচট খাইয়াছিল।

আলগা পাথরটা দেখিয়া উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম্‌,–’ব্যোমকেশ! পাথরের তলায় তোষাখানার গর্ত নেই তো?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল‌, ‘উঁহু‌, পাথরটা বড় জোর চৌদ্দ ইঞ্চি চৌকশ। ওর তলায় যদি গর্ত থাকেও‌, তা দিয়ে মানুষ ঢুকতে পারবে না।’

‘তবু–’

‘না হে‌, যা ভাবিছ তা নয়। খোলা উঠোনে তোষাখানার গুপ্তদ্বার হতে পারে না। যা হোক‌, কাল সকালে পাথর তুলিয়ে দেখতে হবে।’

ব্যোমকেশ টর্চ ঘুরাইয়া চারিদিকে আলো ফেলিল‌, কিন্তু অন্য কোথাও পাথরের পার্টি নড়াচাড়া হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। অদূরে কামানটা পড়িয়া আছে‌, তাহার নীচে অনেক ধূলামটি জমিয়া কামানকে মেঝের সঙ্গে জাম করিয়া দিয়াছে; সেখানেও আলগা মাটি বা পাথর চোখে পড়িল না।’

এই সময় সীতারাম আসিয়া জানাইল‌, আহার প্রস্তুত। হাতের ঘড়িতে দেখিলাম পৌঁনে দশটা। কখন যে নিঃসাড়ে সময় কাটিয়া গিয়াছে জানিতে পারি নাই।

ঘরে গিয়া আহারে বসিলাম। ইকমিক্‌ কুকারে রাঁধা খিচুড়ি এবং মাংস যে এমন অমৃততুল্য হইতে পারে তাহা জানা ছিল না। তার উপর সীতারাম অমলেট ভাজিয়াছে। গুরুভোজন হইয়া গেল।

আমাদের ভোজন শেষ হইলে সীতারাম বারান্দায় নিজের আহার সারিয়া লইল। দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল‌, ‘হুজুর‌, যদি হুকুম হয়‌, একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ তো। তুমি শোবে কোথায়?’

সীতারাম বলিল‌, ‘সেজন্যে ভাববেন না হুজুর। আমি দোরের বাইরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকব।’

সীতারাম চলিয়া গেল। আমরা আলো কমাইয়া দিয়া বিছানায় লম্বা হইলাম। দ্বার খোলাই রহিল; কারণ ঘরে জানালা নাই‌, দ্বার বন্ধ করিলে দম বন্ধ হইবার সম্ভাবনা।

শুইয়া শুইয়া বোধহয় তন্দ্ৰা আসিয়া গিয়াছিল‌, ব্যোমকেশের গলার আওয়াজে সচেতন হইয়া উঠিলাম‌, ‘দ্যাখো‌, ঐ গজালগুলো আমার ভাল ঠেকছে না।’

‘গজাল! কোন গজাল?’

‘দেয়ালে এত গজাল কেন? পাণ্ডেজি একটা কৈফিয়ত দিলেন বটে‌, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে।’

এত রাত্রে গজালকে সন্দেহ করার কোনও মানে হয় না। ঘড়িতে দেখিলাম। এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে। সীতারাম এখনও এদিক ওদিক দেখিয়া ফিরিয়া আসে নাই।

‘আজ ঘুমাও‌, কাল গজালের কথা ভেব।’ বলিয়া আমি পাশ ফিরিয়া শুইলাম।