পরদিন প্রাতরাশের সময় পাণ্ডে বলিলেন, ‘দুর্গে গিয়ে থাকার সঙ্কল্প ঠিক আছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, আপনি ব্যবস্থা করুন। বড় জোর দু-তিন দিন থাকিব, বেশি নয়।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘আমার কিন্তু মন চাইছে না, কি জানি যদি সত্যিই সাপ থাকে।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘থাকলেও আমাদের কিছু করতে পারবে না। আমরা সাপের রোজা।’
‘বেশ, আমি তাহলে রামকিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করে সব ঠিকঠাক করে আসি। —আচ্ছা, দুর্গের বদলে যদি রামকিশোরবাবুর বাড়িতে থাকেন তাতে ক্ষত কি?’
‘অত ঘেঁষাঘেঁষি সুবিধা হবে না, পরিপ্রেক্ষিত পাব না। দুৰ্গই ভাল।’
‘ভাল। আমি অফিসে বলে যাচ্ছি, আমার মুনশী আতাউল্লাকে খবর দিলে সে ঈশানবাবুর জিনিসপত্র আপনাদের দেখাবে। গুদাম ঘরের চাবি তার কাছে।’
পাণ্ডেজি মোটর-বাইকে চড়িয়া প্ৰস্থান করিলেন। ঘড়িতে মাত্ৰ নটা বাজিয়াছে, পাণ্ডেজির অফিস তাঁহার বাড়িতেই; সুতরাং ঈশানবাবুর মালপত্র পরীক্ষার তাড়া নাই। আমরা সিগারেট ধরাইয়া সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইয়া গড়িমসি করিতেছি, এমন সময় একটি ছোট মোটর আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ জানোলা দিয়া দেখিয়া বলিল, ‘ডাক্তার ঘটক। ভালই হল।’
ডাক্তার ঘটকের একটু অনুতপ্ত ভাব। আমরা যে তাহার গুপ্তকথা ফাঁস করিয়া দিই নাই এবং ভবিষ্যতে দিব না। তাহা সে বুঝিয়াছে। বলিল, ‘কাল আপনাদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলবার সুযোগ পেলাম না, তাই–’
ব্যোমকেশ পরম সমাদরের সহিত তাহাকে বসাইয়া বলিল, ‘আপনি না এলে আমরাই যেতম। কেমন আছেন বলুন। পুরোনো বন্ধুরা সব কেমন? মহীধরবাবু?’
ডাক্তার বলিল, ‘সবাই ভাল আছেন।’
ব্যোমকেশ চক্ষু মিটমিট করিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, ‘আর রজনী দেবী? ডাক্তারের কান দু’টি রক্তাভ হইল, তারপর সে হাসিয়া ফেলিল। বলিল, ‘ভাল আছে রজনী। আপনারা এসেছেন শুনে জানতে চাইল মিসেস বক্সী এসেছেন কি না।’
‘সত্যবতী এবার আসেনি। সে–’ ব্যোমকেশ আমার পানে তাকাইল।
আমি সত্যবতীর অবস্থা জানাইয়া বলিলাম, সত্যবতী আমাদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরাও প্রতিজ্ঞা করেছি, একটা সুখবর না পাওয়া পর্যন্ত ওমুখে হব না।’
ডাক্তার হাসিয়া ব্যোমকেশকে অভিনন্দন জানাইল, কিন্তু তাহার মুখে হাসি ভাল ফুটিল না। ক্ষুধিত ব্যক্তি অন্যকে আহার করিতে দেখিলে হাসিতে পারে, কিন্তু সে হাসি আনন্দের নয়।
ব্যোমকেশ তাহার মুখের ভাব দেখিয়া মনের ভাব বুঝিল, পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ‘বন্ধু, মনে ক্ষোভ রাখবেন না। আপনি যা পেয়েছেন তা কম লোকের ভাগেই জোটে। একসঙ্গে দাম্পত্য-জীবনের মাধুর্য আর পরকীয়াপ্রীতির তীক্ষ্ণ স্বাদ উপভোগ করে নিচ্ছেন।’
আমি যোগ করিয়া দিলাম, ‘ভেবে দেখুন, শেলী বলেছেন, হে পবন, শীত যদি আসে বসন্ত রহে কি কভু দূরে। ফুলের মরসুম শেষ হোক, ফল আপনি আসবে।’
এবার ডাক্তারের মুখে সত্যকার হাসি ফুটিল। আরও কিছুক্ষণ হাসি-তামাসার পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডাক্তার ঘটক, কাল রামকিশোরবাবুর বাড়িতে বিষয়-ঘটিত আলোচনা খানিকটা শুনেছিলাম, বাকিটা শোনবার কৌতুহল আছে। যদি বাধা না থাকে আপনি বলুন।’
ডাক্তার বলিল, ‘বাধা কি? রামকিশোরবাবু তো লুকিয়ে কিছু করছেন না। মাসখানেক আগে ওঁর স্বাস্থ্যু হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে; হৃদযন্ত্রের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। এখন অনেকটা সামলেছেন; কিন্তু ওঁর ভয় হয়েছে হঠাৎ যদি মারা যান তাহলে বড় ছেলেরা মামলা-মোকদ্দমায় সম্পত্তি নষ্ট করবে। হয়তো নাবালক ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করবার চেষ্টা করবে। তাই বেঁচে থাকতে থাকতেই উনি সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতে চান। সম্পত্তি সমান চার ভাগ হবে; দুভাগ বড় দুই ছেলে পাবে, বাকি দুভাগ রামকিশোরের অধিকারে থাকবে। তারপর ওঁর মৃত্যু হলে গদাই আর তুলসী ওয়ারিসান সূত্রে ওঁর সম্পত্তি পাবে, বড় দুই ছেলে আর কিছু পাবে না।’
ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল, ‘বুঝেছি। দুর্গ নিয়ে কি ঝগড়া হচ্ছিল?’
‘দুৰ্গটা রামকিশোরবাবু নিজের দখলে রেখেছেন। অথচ দুই ছেলেরই লোভ দুর্গের ওপর।’
‘মণিলালকে দুর্গ দেবার কথা উঠল কেন?’
‘ব্যাপার হচ্ছে এই—ব্রামকিশোরবাবু স্থির করেছেন তুলসীর সঙ্গে মণিলালের বিয়ে দেবেন। মণিলাল ওঁর বড় মেয়েকে বিয়ে করেছিল, সে-মেয়ে মারা গেছে, জানেন বোধ হয়। কাল কথায় কথায় রামকিশোরবাবু বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর বসতবাড়িটা পাবে গদাই, আর মণিলাল পাবে দুর্গ। মণিলাল মানেই তুলসী, মণিলালকে আলাদা কিছু দেওয়া হচ্ছে না। তাইতেই বংশী আর মুরলী ঝগড়া শুরু করে দিলে।’
‘হুঁ। কিন্তু তুলসীর বিয়ের তো এখনও দেরি আছে। ওর কতাই বা বয়স হবে।’
‘আধুনিক মতে বিয়ের বয়স না হলেও নেহাৎ ছোট নয়, বছর তোর-চোদ হবে। রামকিশোরবাবু বোধহয় শীগগিরই ওদের বিয়ে দেবেন। যদি হঠাৎ মারা যান, নাবালক ছেলেমেয়েদের একজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবক চাই তো! বড় দুই ছেলের ওপর ওঁর কিছুমাত্র আস্থা নেই।’
‘যেটুকু দেখেছি তাতে আস্থা থাকার কথা নয়। মণিলাল মানুষটি কেমন?’
‘মাথা-ঠাণ্ডা লোক। রামকিশোরবাবু তাই ওর ওপরেই ভরসা রাখেন বেশি। তবে যেভাবে শ্বশুরবাড়ি কামড়ে পড়ে আছে তাতে মনে হয় চক্ষুলজ্জা কম।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ শূন্যে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিল, ‘ডাক্তার ঘটক, আপনি রুগী সম্বন্ধে একটু সাবধান থাকবেন।’
ডাক্তার চকিত হইয়া বলিল, ‘রুগী! কোন রুগী?’
‘রামকিশোরবাবু। তাঁর হৃদযন্ত্র যদি দলিল রেজিস্ট্রি হবার আগেই হঠাৎ থেমে যায় তাহলে কারুর সুবিধা হতে পারে।’
ডাক্তার চোখ বড় বড় করিয়া চাহিয়া রহিল।
বেলা দশটা নাগাদ ডাক্তার বিদায় লইলে আমরা মুনশী আতাউল্লাকে খবর পাঠাইলাম।
আতাউল্লা লোকটি অতিশয় কেতাদুরন্ত প্রৌঢ় মুসলমান, বোধহয় খানদানী ব্যক্তি। কৃশ দেহে ছিটের আচকান, দাড়িতে মেহেদির রঙ, চোখে সুমা, মুখে পান; তাহার চোস্ত জবানের সঙ্গে মুখ হইতে ফুলিঙ্গের ন্যায় পানের কুচি ছিটুকাইয়া পড়িত। লোকটি সজ্জন।
আমাদের অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া মুনশী আতাউল্লা দুইজন আরদালির সাহায্যে ঈশানবাবুর বিছানা ও তোরঙ্গ আনিয়া আমাদের খিদমতে পেশ করিলেন। বিছানাটা নামমাত্র। রঙ-ওঠা সতরঞ্চিতে জড়ানো জীৰ্ণ বাঁদিপোতার তোষক ও তেলচিটে বালিশ। তবু ব্যোমকেশ উহা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল। তোষকটি ঝাড়িয়া এবং বালিশটি টিপিয়া টুপিয়া দেখিল, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে গুপ্ত ধাতব পদার্থের অস্তিত্ব ধরা পড়িল না।
বিছানা স্থানান্তরিত করিবার হুকুম দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘মুন্শীজি, একটা মোহর ছিল সেটা দেখতে পাওয়া যাবে কি?’
‘বেশক্, জনাব। আপনার যদি মরজি হয় তাই আমি মোহর সঙ্গে এনেছি।’ আতাউল্লা আচুকানের পকেট হইতে একটি কাঠের কোটা বাহির করিলেন। কোটার গায়ে নানাপ্রকার সাঙ্কেতিক অক্ষর ও চিহ্ন অঙ্কিত রহিয়াছে। ভিতরে তুলার মোড়কের মধ্যে মোহর।
পাক সোনার মোহর; আকারে আয়তনে বর্তমান কালের চাঁদির টাকার মত। ব্যোমকেশ। উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া বলিল, ‘এতে উর্দুতে কি লেখা রয়েছে পড়তে পারেন?’
আতাউল্লা ঈষৎ আহত-কণ্ঠে বলিলেন, ‘উর্দু নয় জনাব, ফারসী। আসরফিতে উর্দু লেখার রেওয়াজ ছিল না। যদি ফরমাস করেন পড়ে দিতে পারি, ফারসী আমার খাস জবান।’
ব্যোমকেশ অপ্ৰস্তুত হইয়া বলিল, ‘তাই নাকি! তাহলে পড়ে বলুন দেখি কবেকার মোহর।’ আতাউল্লা চশমা আটিয়া মোহরের লেখা পড়িলেন, বলিলেন, ‘তারিখ নেই। লেখা আছে। এই মোহর নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলে ছাপা হয়েছিল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে জানকীরামের কালের মোহর, পরের নয়।–আচ্ছ মুনশীজি, আৰু বহুত বহুত ধন্যবাদ, আপনি অফিসে যান, যদি আবার দরকার হয় আপনাকে খবর পাঠাব।’
‘মেহেরবানি’ বলিয়া আতাউল্লা প্ৰস্থান করিলেন।
ব্যোমকেশ তখন অধ্যাপক মহাশয়ের তোরঙ্গটি টানিয়া লইয়া বসিল। চট-ওঠা টিনের তোরঙ্গটির মধ্যে কিন্তু এমন কিছুই পাওয়া গেল না যাহা তাঁহার মৃত্যুর কারণ-নির্দেশে সাহায্য করিতে পারে। বস্ত্ৰাদি নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলি দেখিলে মনে হয় অধ্যাপক মহাশয় অল্পবিত্ত ছিলেন কিম্বা অতিশয় মিতব্যয়ী ছিলেন। দুইখানি পুরাতন মলাট-ছেড়া বই; একটি শ্যামশাস্ত্রী-সম্পাদিত কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰ, অন্যটি শয়র-ই-মুতাক্ষরিনের ইংরেজি অনুবাদ। ইতিহাসের গণ্ডীর মধ্যে অধ্যাপক মহাশয়ের জ্ঞানের পরিধি কতখানি বিস্তৃত ছিল, এই বই দু’খানি হইতে তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বই দু’খানির সঙ্গে একখানি চামড়া-বাঁধানো প্রাচীন খাতা। খাতাখানি বোধ হয় ত্রিশ বছরের পুরাতন; মলাটা ঢলঢলে হইয়া গিয়াছে, ব্বিৰ্ণ পাতাগুলিও খসিয়া আসিতেছে। এই খাতায় অত্যন্ত অগোছালভাবে, কোথাও পেন্সিল দিয়া দু’চার পাতা, কোথাও কালি দিয়া দু’চার ছত্র লেখা রহিয়াছে। হস্তাক্ষর সুছাঁদ নয়, কিন্তু একই হাতের লেখা। যাহাদের লেখাপড়া লইয়া কাজ করিতে হয় তাহারা এইরূপ একখানি সর্বাংবহা খাতা হাতের কাছে রাখে; যখন যাহা ইচ্ছা ইহাতে টুকিয়া রাখা যায়।
খাতাখানি সযত্নে লইয়া আমরা টেবিলে বসিলাম! ব্যোমকেশ একটি একটি করিয়া পাতা উল্টাইতে লাগিল।
প্রথম দুই-তিনটি পাতা খালি। তারপর একটি পাতায় লেখা আছে
ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা
যদি মানুষের ভাষায় কথা বলিতে
পারিতেন তবে তিনি মহরমের
বাজনার ছন্দে বলিতেন–
ধনানর্জয়ধ্বম্! ধনানর্জয়ধ্বম্!
ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল, ‘মহরমের বাজনার মত শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু মানে কি?
বলিলাম, মনে হচ্ছে, ধন উপার্জন করহ, ধন উপার্জন করহ। তোমার ঈশানবাবু দেখছি সিনিক ছিলেন।’
ব্যোমকেশ লেখাটাকে আরও কিছুক্ষণ দেখিয়া পাতা উল্টাইল। পরপৃষ্ঠায় কেবল কয়েকটি তারিখ নোট করা রহিয়াছে। ঐতিহাসিক তারিখ; কবে হিজরি অব্দ আরম্ভ হইয়াছিল, শশাঙ্ক দেবের মৃত্যুর তারিখ কি, এইসব। বোধ হয়। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াইবার জন্য নোট করিয়াছিলেন। এমনি আরও কয়েক পৃষ্ঠায় তারিখ লেখা আছে, সেগুলির উল্লেখ করিবার প্ৰয়োজন নাই।
ইহার পর আরও কয়েক পাতা শূন্য। তারপর সহসা এক দীর্ঘ রচনা শুরু হইয়াছে। তাহার আরম্ভটা এইরূপ–
‘রামবিনোদের কাছে তাহার বংশের ইতিহাস শুনিলাম। সিপাহী-যুদ্ধের সময় লুঠেরাগণ বোধ হয় সঞ্চিত ধনরত্ন লইয়া যাইতে পারে নাই; অন্তত রামবিনোদের তাঁহাই বিশ্বাস। সে দুর্গ দেখিয়া আসিয়াছে। তাহার উচ্চাশা, যদি কোনও দিন ধনী হয় তখন ঐ দুর্গ কিনিয়া তথায় গিয়া বাস করিবে।’
অতঃপর জানকীরাম হইতে আরম্ভ করিয়া রাজারাম জয়রাম পর্যন্ত রমাপতির মুখে। যেমন শুনিয়াছিলাম ঠিক তেমনি লেখা আছে, একচুল এদিক ওদিক নাই। পাঠ শেষ হইলে আমি বলিলাম, যাক, একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, রমাপতি মিথ্যে গল্প বলেনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘গল্পটা রমাপতি ঠিকই বলেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু গল্পটা ঈশানবাবুর মৃত্যুর রাত্রে শুনেছিল তার প্রমাণ কি? দুদিন আগেও শুনে থাকতে পারে।’
‘তা—বটে। তাহলে–?’
‘তাহলে কিছু না। আমি বলতে চাই যে, ও সম্ভাবনাটাকেও বাদ দেওয়া যায় না। অৰ্থাৎ রমাপতি সে-রত্রে এই গল্পই শুনেছিল এবং পরদিন ভোরবেলা গল্পের বাকিটা শোনবার জন্যে ঈশানবাবুর কাছে গিয়েছিল তার কোনও প্রমাণ নেই।’
আবার কিছুক্ষণ পাতা উল্টাইবার পর এমন একটি পৃষ্ঠায় আসিয়া পৌঁছিলাম, যেখানে তীব্র কাতরোক্তির মত কয়েকটি শব্দ লেখা রহিয়াছে–
–রামবিনোদ বাঁচিয়া নাই। আমার
একমাত্র আকৃত্রিম বন্ধু চলিয়া গিয়াছে।
সে কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু! দুঃস্বপ্নের মত
সে-দৃশ্য আমার চোখে লাগিয়া আছে।
ব্যোমকেশ লেখাটার উপর কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থাপিত রাখিয়া বলিল, ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয় না। খোঁজ করা দরকার।’ আমার মুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন দেখিয়া মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করিল, ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ ভাই, পাইলে পাইতে পার লুকানো রতন।’
খাতার সামনের দিকের লেখা এইখানেই শেষ। মনে হয় রামবিনোদের মৃত্যুর পর খাতাটি দীর্ঘকাল অব্যবহৃত পড়িয়া ছিল, হয়তো হারাইয়া গিয়াছিল। তারপর আবার যখন লেখা আরম্ভ হইয়াছে, তখন খাতার উল্টা পিঠ হইতে।
প্রথম লেখাটি কালি-কলমের লেখা; পীতবর্ণ কাগজে কালি চুপসিয়া গিয়াছে। পাতার মাথার দিকে লেখা হইয়াছে–
রামকিশোরের বড় ছেলে বংশীধর কলেজে পড়িতে আসিয়াছে।
অনেকদিন পরে উহাদের সঙ্গে আবার সংযোগ ঘটিল। সেই
রামবিনোদের মৃত্যুর পর আর খোঁজ লই নাই।
পাতার নীচের দিকে লেখা আছে-বংশীধর এক মারাত্মক
কেলেঙ্কারি করিয়াছে। তাহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছি।
হাজার হোক রামবিনোদের ভ্রাতুষ্পুত্ৰ।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বংশীধরের কেলেঙ্কারির হদিস বোধ হয় দু’চার দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এ কি?’
দেখা গেল বাকি পাতাগুলিতে যে লেখা আছে তাহার সবগুলিই লাল-নীল পেন্সিলে লেখা। ব্যোমকেশ পাতাগুলি কয়েকবার ওলট-পালট করিয়া বলিল, ‘অজিত, তেরঙ্গের তলায় দেখ তো লাল-নীল পেন্সিল আছে কি না।’
বেশি খুঁজতে হইল না, একটি দুমুখো লাল-নীল পেন্সিল পাওয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক, বোঝা গেল। এর পর যা কিছু লেখা আছে ঈশানবাবু দুর্গে আসার পর লিখেছেন। এগুলি তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়।’
প্ৰথম লেখাটি এইরূপ
দুৰ্গে গুপ্তকক্ষ দেখিতে পাইলাম না।
ভারি আশ্চর্য! দুর্গের সোনাদানা কোথায় রক্ষিত হইত?
প্ৰকাশ্য কক্ষে রক্ষিত হইত বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয়
কোথাও গুপ্তকক্ষ আছে। কিন্তু কোথায়? সিপাহীরা
গুপ্তকক্ষের সন্ধান পাইয়া থাকিলে গুপ্তকক্ষ আর গুপ্ত
থাকিত না, তাহার দ্বারা ভাঙ্গিয়া রাখিয়া যাইত, তখন
উহা সকলেরই দৃষ্টিগোচর হইত। তবেই গুপ্তকক্ষের
সন্ধান সিপাহীরা পায় নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অধ্যাপক মহাশয়ের যুক্তিটা খুব বিচারসহ নয়। সিপাহীরা চলে যাবার পর রাজারামের পরিবারবর্গ ফিরে এসেছিল। তারা হয়তো ভাঙা তোষাখানা মেরামত করিয়েছিল, তাই এখন ধরা যাচ্ছে না।’
পাতা উল্টাইয়া ব্যোমকেশ পড়িল—
কেহ আমাকে ভয় দেখাইয়া দুৰ্গ হইতে তাড়াইবার চেষ্টা
করিতেছে। বংশীধর? আমি কিন্তু সহজে দুর্গ ছাড়িব
না! ধনানর্জয়ধ্বম্! ধনানর্জয়ধ্বম্!
জিজ্ঞাসা করিলম, ‘আবার মহরমের বাজনা কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোহরের গন্ধ পেয়ে বোধ হয় তাঁর স্নায়ুমণ্ডলী উত্তেজিত হয়েছিল।’
অতঃপর কয়েক পৃষ্ঠা পরে খাতার শেষ লেখা। আমরা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। বাংলা ভাষায় লেখা নয়, উর্দু কিংবা ফারসীতে লেখা তিনটি পংক্তি। তাহার নীচে বাংলা অক্ষরে কেবল দুইটি শব্দ-মোহনলাল কে?
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘সত্যিই তো, মোহনলাল কে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া আমাদের কর্ম নয়। ডাকো মুনশী আতাউল্লাকে।’
আতাউল্লা আসিয়া লিপির পাঠোদ্ধার করিলেন। বলিলেন, ‘জনাব, মৃত ব্যক্তি ভাল ফারসী জানতেন মনে হচ্ছে। তবে একটু সেকেলে ধরনের। তিনি লিখেছেন, যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিন্মায় গচ্ছিত রহিল।’
‘মোহনলালের জিম্মায়–!’
‘জী জনাব, তাই লেখা আছে।’
‘হুঁ। আচ্ছা, মুনশীজি, আপনি এবার জিনিসপত্র সব নিয়ে যান। কেবল এই খাতাটা আমার কাছে রইল।’
দু’জনে সিগারেট ধরাইয়া আরাম-কেদারার কোলে অঙ্গ ছড়াইয়া দিলাম। নীরবে একটা সিগারেট শেষ করিয়া তাহারই চিতাগ্নি হইতে দ্বিতীয় সিগারেট ধরাইয়া বলিলাম, ‘খাতা পড়ে কি মনে হচ্ছে?’
ধনানর্জয়ধ্বম্। ধনানর্জয়ধ্বম্।
‘ঠাট্টা নয়, কি বুঝলে বল না।’
‘পরিষ্কারভাবে কিছুই বুঝিনি এখনও। তবে ঈশানবাবুকে যদি সত্যিই কেউ হত্যা করে থাকে তাহলে হত্যার মোটিভ দেখতে পাচ্ছি।’
‘কি মোটিভ?’
‘সেই চিরন্তন মোটিভ–টাকা।’
‘আচ্ছা, ফারসী ভাষায় ঐ কথাগুলো লিখে রাখার তাৎপৰ্য কি?’
‘ওটা উনি নিজে লেখেননি। অর্থাৎ হস্তাক্ষর ওঁর, কিন্তু রচনা ওঁর নয়, রাজারামের। উনি লেখাটি দুর্গে কোথাও পেয়েছিলেন, তারপর খাতায় টুকে রেখেছিলেন।’
‘তারপর?’
‘তারপর মারা গেলেন।’