দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া আসিয়া দেখিলাম, বুলাকিলাল দুইটি বৃহৎ পাত্রে ভাঙের সরবৎ। লইয়া ঢালাঢালি করিতেছে; গদাধর এবং তুলসী পরম আগ্রহভরে দাঁড়াইয়া প্রক্রিয়া দেখিতেছে।
আমাদের আগমনে গদাধর বিরাট হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল; তুলসী সংশয়-সঙ্কুল চক্ষু আমাদের উপর স্থাপন করিয়া কোণাচে ভাবে সরিয়া গিয়া মাস্টার রমাপতির হাত চাপিয়া ধরিল। রমাপতি তিরস্কারের সুরে বলিল, ‘কোথায় ছিলে তোমরা? আমি চারিদিকে তোমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
তুলসী জবাব দিল না, অপলক দৃষ্টিতে আমাদের পানে চাহিয়া রহিল। গদাধরের গলা হইতে একটি ঘড়ঘড় হাসির শব্দ বাহির হইল। সে বলিল, ‘সাধুবাবা গাঁজা খাচ্ছিল তাই দেখছিলাম।’
রমাপতি ধমক দিয়া বলিল, ‘সাধুর কাছে যেতে তোমাদের মানা করা হয়নি?’
গদাধর বলিল, ‘কাছে তো যাইনি, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।’
‘আচ্ছা, হয়েছে–এবার বাড়ি চল।’ রমাপতি তাহাদের লইয়া বাড়ির দিকে চলিল। শুনিতে পাইলাম, কয়েক ধাপ উঠিবার পর তুলসী ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলিতেছে, ‘মাস্টারমশাই, ওরা সব কারা?’
বুলাকিলাল গেলাস ভরিয়া আমাদের হাতে দিল। দধি গোলমরিচ শসার বীচি এবং আরও বহুবিধ বিকাল সহযোগে প্ৰস্তুত উৎকৃষ্ট ভাঙের সরবৎ; এমন সরবৎ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া আর কোথাও প্রস্তুত হয় না। পাণ্ডে তারিফ করিয়া বলিলেন, ‘বাঃ, চমৎকার হয়েছে। কিন্তু বুলাকিলাল, তুমি এত ভাঙ তৈরি করেছ কার জন্যে? আমরা আসব তা তো জানতে না।’
বুলাকিলাল বলিল, ‘হুজুর, আমি আছি, সাধুবাবাও এক ঘটি চড়ান–’
‘সাধুবাবার দেখছি কিছুতেই অরুচি নেই। আর—’
‘আর-গণপৎ এক ঘটি নিয়ে যায়।’
‘গণপৎ-মুরলীধরের খাস চাকর? নিজের জন্যে নিয়ে যায়, না মালিকের জন্যে?’
‘তা জানি না হুজুর।’
‘আচ্ছা বুলাকিলাল, তুমি তো এ বাড়ির পুরোনো চাকর, বাড়িতে কে কোন নেশা করে বলতে পারো?’
বুলাকিলাল একটু চুপ করিয়া বলিল, ‘বড়কর্তা সন্ধের পর আফিম খান। আর কারুর কথা জানি না ধর্মাবতার।’
বোঝা গেল, জানিলেও বুলাকিলাল বলিবে না। আমরা সরবৎ শেষ করিয়া, আর এক প্রস্থ তারিফ করিয়া বাড়ির সিঁড়ি ধরিলাম।
এদিকেও সিঁড়ির সংখ্যা সত্তর-আশি। উপরে উঠিয়া দেখা গেল, সূর্য অস্ত গিয়াছে, কিন্তু এখনও বেশ আলো আছে। বাড়ির সদরে রমাপতি উপস্থিত ছিল, সে বলিল, ‘কর্তার সঙ্গে দেখা করবেন? আসুন।’
রমাপতি আমাদের যে ঘরটিতে লইয়া গেল সেটি বাড়ির বৈঠকখানা।
টেবিল চেয়ার ছাড়াও আর একটি ফরাস-ঢাকা বড় তক্তপোশ আছে। তক্তপোশের মধ্যস্থলে রামকিশোরবাবু আসীন; তাঁহার এক পাশে নায়েব চাঁদমোহন, অপর পাশে জামাই মণিলাল। দুই ছেলে বংশীধর ও মুরলীধর তক্তপোশের দুই কোণে বসিয়াছে। ডাক্তার ঘটক এবং উকিল হিমাংশুবাবু তক্তপোশের কিনারায় চেয়ার টানিয়া উপবিষ্ট আছেন। পশ্চিম দিকের খোলা জানালা দিয়া ঘরে আলো আসিতেছে; তবু ঘরের ভিতরটা ঘোর ঘোর হইয়া আসিয়াছে।
ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে শুনিতে পাইলাম, মুরলীধর পেঁচালো সুরে বলিতেছে, যার ধন। তার ধন নয়, নেপোয় মারে দৈ! মণিলালকে দুর্গ দেওয়া হবে কেন? আমি কি ভেসে এসেছি? দুৰ্গ আমি নেব।’
বংশীধর অমনি বলিয়া উঠিল, ‘তুমি নেবে কেন? আমার দাবি আগে, দুৰ্গ আমি নেব। আমি ওটা মেরামত করিয়ে ওখানে বাস করব।’
রামকিশোর বারুদের মত ফাটিয়া পড়িলেন, ‘খবরদার! আমার মুখের ওপর যে কথা বলবে জুতিয়ে তার মুখ ছিঁড়ে দেব। আমার সম্পত্তি আমি যাকে ইচ্ছে দিয়ে যাব। মণিলালকে আমি সর্বস্ব দিয়ে যাব, তোমাদের তাতে কি! বেয়াদব কোথাকার।’
মণিলাল শান্তস্বরে বলিল, ‘আমি তো কিছুই চাইনি–।’
মুরলীধর মুখের একটা ভঙ্গী করিয়া বলিল, ‘না কিছুই চাওনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাবাকে বশ করেছ। মিট্মিটে ডান–’
রামকিশোর আবার ফাটিয়া পড়িবার উপক্ৰম করিতেছিলেন, ডাক্তার ঘটক হাত তুলিয়া বলিল, ‘রামকিশোরবাবু্, আপনি বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন, আপনার শরীরের পক্ষে ওটা ভাল নয়। আজ বরং কথাবার্তা বন্ধ থাক, আর একদিন হবে।’
রামকিশোরবাবু ঈষৎ সংযত হইয়া বলিলেন, না ডাক্তার, এ ব্যাপার টাঙিয়ে রাখা চলবে না। আজ আছি কাল নেই, আমি সব হাঙ্গামা চুকিয়ে রাখতে চাই। হিমাংশুবাবু্, আমি আমার সম্পত্তির কি রকম ব্যবস্থা করতে চাই আপনি শুনেছেন; আর বেশি আলোচনার দরকার নেই। আপনি দলিলপত্র তৈরি করতে আরম্ভ করে দিন। যত শীগগির দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে যায় ততাই ভাল।’
‘বেশ, তাই হবে। আজ তাহলে ওঠা যাক।।’ হিমাংশুবাবু গাত্ৰোত্থান করিলেন। এতক্ষণে সকলের নজর পড়িল যে আমরা তিনজন ন যযৌ ন তন্থেী ভাবে দ্বারের নিকটে দাঁড়াইয়া আছি। রামকিশোর ভ্রূ তুলিয়া বলিলেন, ‘কে?’
পাণ্ডে আগাইয়া গিয়া বলিলেন, ‘আমি। আমার দু’টি কলকাতার বন্ধু বেড়াতে এসেছেন, তাঁদের দুর্গ দেখাতে এনেছিলাম।’ বলিয়া বোমকেশের ও আমার নামোল্লেখ করিলেন।
রামকিশোর সমােদর সহকারে বলিলেন, ‘আসুন, আসুন। বসতে আজ্ঞা হোক।’ কিন্তু তিনি ব্যোমকেশের নাম পূর্বে শুনিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না।
বংশীধর ও মুরলীধর উঠিয়া গেল। ডাক্তার ঘটক আমাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত ও অপ্ৰতিভ হইল, তারপর হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। ডাক্তারের সঙ্গে দু’একটা কথা হইবার পর সে উকিল হিমাংশুবাবুকে লইয়া প্ৰস্থান করিল। ঘরের মধ্যে রহিয়া গেলাম আমরা তিনজন এবং ও-পক্ষে রামকিশোরবাবু্, নায়েব চাঁদমোহন এবং জামাই মণিলাল।
রামকিশোর হাকিলেন, ‘ওরে কে আছিস, আলো দিয়ে যা, চা তৈরি কর।’ চাঁদমোহন বলিলেন, ‘আমি দেখছি—’ তিনি উঠিয়া গেলেন। চাঁদমোহনের চেহারা কালো এবং চিমশে কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে ধূৰ্ততা ভরা। তিনি যাইবার সময় ব্যোমকেশের প্রতি একটি দীর্ঘ-গভীর অপাঙ্গদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গেলেন।
দুই চারিটি সৌজন্যমূলক বাক্যালাপ হইল। বাহিরের লোকের সহিত রামকিশোরের ব্যবহার বেশ মিষ্ট ও অমায়িক। তারপর ব্যোমকেশ বলিল, ‘শুনলাম ঈশানবাবু এখানে এসে সর্পাঘাতে মারা গেছেন। আমি তাঁকে চিনতাম, একসময় তাঁর ছাত্র ছিলাম।’
‘তাই নাকি!’ রামকিশোর চকিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, ‘আমার বড় ছেলেও—। কি বলে, ঈশান আমার প্রাণের বন্ধু ছিল, ছেলেবেলার বন্ধু। সে আমার বাড়িতে এসে অপঘাতে মারা গেল, এ লজ্জা আমি জীবনে ভুলব না।’ তাঁহার কথার ভাবে মনে হইল, সপাঘাতে মৃত্যু সম্বন্ধে যে সন্দেহ আছে তাহা তিনি জানেন না।
ব্যোমকেশ সহানুভূতি দেখাইয়া বলিল, ‘বড়ই দুঃখের বিষয়। তিনি আপনার দাদারও বন্ধু ছিলেন?’
রামকিশোর ক্ষণেক নীরব থাকিয়া যেন একটু বেশি ঝোঁক দিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু দাদা প্ৰায় ত্ৰিশ বছর হল মারা গেছেন।’
‘ও-তাহলে কর্তমানে আপনার সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল।–আচ্ছা, তিনি এবার এখানে আসার আগে এ বাড়ির কে কে তাঁকে চিনতেন? আপনি চিনতেন। আর-?’
‘আর আমার নায়েব চাঁদমোহন চিনতেন।’
‘আপনার ড্রাইভার তো পুরোনো লোক, সে চিনত না?’
‘হ্যাঁ, বুলাকিলাল চিনত।’
‘আর, আপনার বড় ছেলেও বোধহয় তাঁর ছাত্র ছিলেন?’
গলাটা পরিষ্কার করিয়া রামকিশোর বলিলেন, ‘হ্যাঁ।’
এই বাক্যালাপ যখন চলিতেছিল তখন জামাই মণিলালকে লক্ষ্য করিলম। ভোজনরত মানুষের পাতের কাছে বসিয়া পোষা বিড়াল যেমন একবার পাতের দিকে একবার মুখের দিকে পৰ্যায়ক্রমে চক্ষু সঞ্চালন করে, মণিলাল তেমনি কথা বলার পর্যয়ক্রমে ব্যোমকেশ ও রামকিশোরের দিকে দৃষ্টি ফিরাইতেছে। তাহার মুখের ভাব আধা-অন্ধকারে ভাল ধরা গেল না, কিন্তু সে যে একাগ্রমনে বাক্যালাপ শুনিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঈশানবাবুর মুঠিতে একটি মোহর পাওয়া গিয়েছিল। সেটি কোথা থেকে এল বলতে পারেন?
রামকিশোর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। ঈশানের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। অন্তত মোহর নিয়ে বেড়াবার মত ছিল না।’
‘দুর্গে কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া সম্ভব নয় কি?’
রামকিশোর বিবেচনা করিয়া বলিলেন, ‘সম্ভব। কারণ আমার পূর্বপুরুষদের অনেক সোনা-দানা ঐ দুর্গে সঞ্চিত ছিল। সিপাহীরা যখন লুঠ করতে আসে তখন এক-আধটা মোহর এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়া বিচিত্র নয়। তা যদি হয় তাহলে ও মোহর আমার সম্পত্তি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার সম্পত্তি হলে ঈশানবাবু মোহরটি আপনাকে ফেরত দিতেন না কি? আমি যতদূর জানি, পরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লোক তিনি ছিলেন না।’
‘তা ঠিক। কিন্তু অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়। তা ছাড়া, মোহরটা কুড়িয়ে পাবার সময়েই হয়তো তাকে সাপে কামড়েছিল। বেচারা সময় পায়নি।’
এই সময় একজন ভৃত্য কেরোসিনের ল্যাম্প আনিয়া টেবিলের উপর রাখিল, অন্য একজন ভৃত্য চা এবং জলখাবারের ট্ৰে লইয়া আমাদের সম্মুখে ধরল। আমরা সবিনয়ে জলখাবার প্রত্যাখ্যান করিয়া চায়ের পেয়ালা তুলিয়া লইলাম।
চায়ে চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখানে বিদ্যুৎ বাতির ব্যবস্থা নেই। ঈশানবাবুও নিশ্চয় রাত্রে কেরোসিনের লণ্ঠন ব্যাবহার করতেন?’
রামকিশোর বলিলেন, ‘হ্যাঁ। তবে মৃত্যুর হস্তাখানেক আগে সে একবার আমার কাছ থেকে একটা ইলেকট্রিক টর্চ চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর আর সব জিনিসই পাওয়া গেল কেবল ঐ টৰ্চটা পাওয়া যায়নি।’
‘তাই নাকি! কোথায় গেল টাৰ্চটা?’
এতক্ষণে মণিলাল কথা কহিল, গম্ভীর মুখে বলিল, ‘আমার বিশ্বাস ঐ ঘটনার পরদিন সকালবেলা গোলমালে কেউ টৰ্চটা সরিয়েছে।’
পাণ্ডে প্রশ্ন করিলেন, ‘কে সরাতে পারে? কারুর ওপর সন্দেহ হয়?’
মণিলাল উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়াছিল, রামকিশোর মাঝখানে বলিয়া উঠিলেন, ‘না না, মণি, ও তোমার ভুল ধারণা। রমাপতি নেয়নি, নিলে স্বীকার করত।’
মণিলাল আর কথা কহিল না, ঠোঁট চাপিয়া বসিয়া রহিল। বুঝিলাম, টর্চ হারানোর প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচিত হইয়াছে এবং মণিলালের সন্দেহ মাস্টার রমাপতির উপর। একটা ক্ষুদ্র পরিবারিক মতান্তর ও অস্বাচ্ছন্দ্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
অতঃপর চা শেষ করিয়া আমরা উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই সূত্রে আপনার সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য হল। বড় সুন্দর জায়গায় বাড়ি করেছেন। এখানে একবার এলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।’
রামকিশোর আনন্দিত হইয়া বলিলেন, ‘বেশ তো, দুদিন না হয় থেকে যান না। দুদিন পরে কিন্তু প্ৰাণ পালাই-পালাই করবে। আমাদের অভ্যোস হয়ে গেছে তাই থাকতে পারি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার নিমন্ত্রণ মনে রাখব। কিন্তু যদি আসি, ঐ দুর্গে থাকতে দিতে হবে। ক্ষুধিত পাষাণের মত আপনার দুর্গটা আমাকে চেপে ধরেছে।’
রামকিশোর বিরসমুখে বলিলেন, ‘দুর্গে আর কাউকে থাকতে দিতে সাহস হয় না। যা হোক, যদি সত্যিই আসেন তখন দেখা যাবে।’
দ্বারের দিকে অগ্রসর হইয়াছি, কালো পদার আড়ালে জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। তুলসী এতক্ষণ পদার কাছে দাঁড়াইয়া আমাদের কথা শুনিতেছিল, এখন সরীসৃপের মত সরিয়া গেল।
রাত্রে আহারাদির পর পাণ্ডেজির বাসার খাওলা ছাদে তিনটি আরাম-কেদারায় তিনজন অঙ্গ এলাইয়া দিয়াছিলাম। অন্ধকারে ধূমপান চলিতেছিল। এখানে কার্তিক মাসের এই সময়টি বড় মধুর; দিনে একটু মোলায়েম গরম, রাত্রে মোলায়েম ঠাণ্ডা।
পাণ্ডে বলিলেন, ‘এবার বলুন কি মনে হল।’
ব্যোমকেশ সিগারেটে দু’ তিনটা টান দিয়া বলিল, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন, গলদ আছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে যতক্ষণ না চেপে বসা যাচ্ছে ততক্ষণ গলদ ধরা যাবে না।’
‘আপনি তো আজ তার গৌরচন্দ্ৰিক করে এসেছেন। কিন্তু নিতান্তাই কি দরকার–?’
‘দরকার। এতদূর থেকে সুবিধা হবে না। ওদের সঙ্গে ভাল করে মিশতে হবে তবে ওদের পেটের কথা জানা যাবে। আজ লক্ষ্য করলাম, কেউ মন খুলে কথা কইছে না, সকলেই কিছু-না-কিছু চেপে যাচ্ছে।’
‘হুঁ। তাহলে আপনার বিশ্বাস হয়েছে যে ঈশানবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক সর্পাঘাতে মৃত্যু নয়?’ ‘অতটা বলবার এখনও সময় হয়নি। এইটুকু বলতে পারি, আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যাচ্ছে তা সত্যি নয়, ভেতরে একটা গুঢ় এবং চমকপ্রদ রহস্য রয়েছে। মোহর কোথা থেকে এল? টৰ্চটা কোথায় গেল? রমাপতি যে-গল্প শোনালে তা কি সত্যি? সবাই দুৰ্গটা চায় কেন? মণিলালকে কর্তা ছাড়া কেউ দেখতে পারে না কেন?’
আমি বলিলাম, ‘মণিলালও রমাপতিকে দেখতে পারে না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা স্বাভাবিক। ওরা দু’জনেই রামকিশোরবাবুর আশ্রিত। রমাপতিও বোধহয় মণিলালকে দেখতে পারে না। বাড়ির কেউ কাউকে দেখতে পারে না। সেটা আমাদের পক্ষে সুবিধে।’ দগ্ধাবশিষ্ট সিগারেট ফেলিয়া দিয়া সে বলিল, ‘আচ্ছা পাণ্ডেজি, বংশীধর কতদূর লেখাপড়া করেছে জানেন?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘ম্যাট্রিক পাশ করেছে জানি। তারপর বহরমপুরে পড়তে গিয়েছিল, কিন্তু মাস কয়েক পরেই পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসে।’
‘গোলমাল ঠেকছে। বহরমপুরে ঈশানবাবুর সঙ্গে বংশীধরের জানা-শোনা হয়েছিল—তারপর বংশীধর হঠাৎ লেখাপড়া ছেড়ে দিলে কেন?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘খোঁজ নিতে পারি। বেশি দিনের কথা নয়, যদি গোলমাল থাকে কলেজের সেরেস্তায় হদিস পাওয়া যাবে।’
‘খবর নেবেন তো। —আর মুরলীধরের বিদ্যে কতদূর?’
‘ওটা আকাট মুখ্খু।’
‘হুঁ, বংশটাই চাষাড়ে হয়ে গেছে। তবে রামকিশোরবাবুর ব্যবহারে একটা সাবেক ভদ্রতা আছে।’
‘কিন্তু বাল্যবন্ধুর মৃত্যুতে খুব বেশি শোক পেয়েছেন বলে মনে হল না; বরং মোহরটি বাগাবার মতলব!’
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।–কাল সকালে ঈশানবাবুর জিনিসপত্রগুলো পরীক্ষা করতে হবে, খাতাটা পড়তে হবে। তাতে হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।’
‘তারপর?’
‘তারপর দুর্গে গিয়ে গ্যাট হয়ে বসব। আপনি ব্যবস্থা করুন।’
‘ভাল। কিন্তু একটা কথা ওদের দেওয়া খাবার খাওয়া চলবে না। কি জানি কার মনে কি আছে—’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আপনার ইকমিক কুকার আছে?’
‘আছে।’
‘ব্যস, তাহলেই চলবে।’
কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। ব্যোমকেশ আর একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল, ‘অজিত, রামকিশোরবাবুকে দেখে কিছু মনে হল?’
‘কি মনে হবে?’
‘আজ তাঁকে দেখেই মনে হল, আগে কোথায় দেখেছি। তোমার মনে হল না?’
‘কৈ না!’
‘আমার কিন্তু এক নজর দেখেই মনে হল চেনা লোক। কিন্তু কবে কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না।’
পাণ্ডে একটা হাই চাপিয়া বলিলেন, ‘রামকিশোরবাবুকে আপনার দেখার সম্ভাবনা কম; গত পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি লোকালয়ে পা বাড়িয়েছেন। কিনা সন্দেহ। আপনি হয়তো ওই ধরনের চেহারা অন্য কোথাও দেখে থাকবেন।’
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই হবে বোধ হয়।’