বৈকালে পুলিসের মোটর চড়িয়া তিনজনে বাহির হইলাম। ছয় মাইল পাথুরে পথ অতিক্রম করিতে আধা ঘন্টা লাগিল।
কুয়ার নিকট অবধি পৌঁছিয়া দেখা গেল সেখানে আর একটি মোটর দাঁড়াইয়া আছে। আমরাও এখানে গাড়ি হইতে নামিলাম; পাণ্ডে বলিলেন, ‘ডাক্তার ঘটকের গাড়ি। আবার কারুর অসুখ নাকি?’
প্রশ্ন করিয়া জানা গেল, আমাদের পরিচিত ডাক্তার অশ্বিনী ঘটক এ বাড়ির গৃহ-চিকিৎসক। বাড়ির দিকে অগ্রসর হইতেছি, দৃষ্টি পড়িল কুয়ার ওপারে তরুগুচ্ছ হইতে মৃদুমন্দ ধোঁয়া বাহির হইতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা কি? ওখানে ধোঁয়া কিসের?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘একটা সাধু ওখানে আড্ডা গেড়েছে।’
‘সাধু! এই জঙ্গলের মধ্যে সাধু! এখানে তো ভিক্ষা পাবার কোনও আশা নেই।’
‘তা নেই। কিন্তু রামকিশোরবাবুর বাড়ি থেকে বোধ হয় বাবাজীর সিধে আসে।’
‘ও। কতদিন আছেন। এখানে বাবাজী?’
‘ঠিক জানি না। তবে অধ্যাপক মহাশয়ের মৃত্যুর আগে থেকেই আছেন।’
‘তাই নাকি? চলুন, একবার সাধু দর্শন করা যাক।’
একটি গাছের তলায় ধূনি জ্বলিয়া কৌপীনধারী বাবাজী বসিয়া আছেন। আমরা কাছে গিয়া দাঁড়াইলে তিনি জবার্যক্ত চক্ষু মেলিয়া চাহিলেন, কিছুক্ষণ অপলকনেত্রে আমাদের পানে চাহিয়া রহিলেন। তারপর শ্মশ্রুসমাকুল মুখে একটি বিচিত্র নীরব হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি আবার চক্ষু মুদিত করিলেন।
কিছুক্ষণ অনিশ্চিতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া চলিয়া আসিলাম। পথেঘাটে যেসব ভিক্ষাজীবী সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় ইনি ঠিক সেই জাতীয় নন। কোথায় যেন একটা তফাৎ আছে। কিন্তু তাহা আধ্যাত্মিক আভিজাত্য কিনা বুঝিতে পারিলাম না।
পাণ্ডে বলিলেন, ‘এবার কোথায় যাবেন? আগে রামকিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন, না। দুর্গ দেখবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দুৰ্গটাই আগে দেখা যাক।’
দেউড়ির পাশ দিয়া দুর্গের সিঁড়ি ধরিব, মোটর চালক বুলাকিলাল তাহার কোটর হইতে বাহিরে আসিয়া ডি. এস. পি. সাহেবকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। পাণ্ডে বলিলেন, ‘বুলাকিলাল, ডাক্তার এসেছে কেন? কারুর কি অসুখ?
বুলাকিলাল বলিল, ‘না। হুজুর, ডাক্তার সাহেব এসেছে, উকিল সাহেবও এসেছেন। কি জানি কি গুফত-গু হচ্ছে।’
‘উকিল? হিমাংশুবাবু?’
‘জী হুজুর। একসঙ্গে এসেছেন। এত্তালা দেব?’
‘থাক, আমরা নিজেরাই যাব।’
বুলাকিলাল তখন হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘হুজুর, ঠাণ্ডাই তৈরি করছি। যদি হুকুম হয়—’
‘ঠাণ্ডাই-ভাঙ? বেশ তো, তুমি তৈরি কর, আমরা দুর্গ দেখে এখনই ফিরে আসছি।’
‘জী সরকার।’
আমরা তখন সিঁড়ি ধরিয়া দুর্গের দিকে উঠিতে আরম্ভ করিলাম। পাণ্ডে হাসিয়া বলিলেন, ‘বুড়ো বুলাকিলাল খাসা ভাঙ তৈরি করে। ঐ নিয়েই আছে।’
পঁচাত্তরটি সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া দুৰ্গতোরণে উপনীত হইলাম। তোরণের কবাট নাই, বহু পূর্বেই অন্তৰ্হিত হইয়াছে। কিন্তু পাথরের খিলান এখনও অটুট আছে। গতগতির বাধা নাই।
তোরণপথে প্রবেশ করিয়া সবাগ্রে যে বস্তুটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তাহা একটি কামান। প্রথম দেখিয়া মনে হয় তাল গাছের একটা গুড়ি মুখ উচু করিয়া মাটিতে পড়িয়া আছে। দুই শতাব্দীর রৌদ্রবৃষ্টি অনাবৃত কামানের দশ হাত দীর্ঘ দেহটিকে মরিচা ধরাইয়া শঙ্কাবৃত করিয়া তুলিয়াছে। প্রায় নিরেট লৌহস্তম্ভটি জগদ্দল ভারি, বহুকাল কেহ তাহাকে নড়াচাড়া করে নাই। তাহার ভিতরের গোলা ষ্টুড়িবার ছিদ্রটি বেশি ফাঁদালো নয়, কোনও ক্রমে একটি ছোবড়া-ছাড়ানো নারিকেল তাহাতে প্রবেশ করিতে পারে। তাহাও বর্তমানে ধূলামাটিতে ভরাট হইয়া গিয়াছে; মুখের দিকটায় একগুচ্ছ সজীব ঘাস মাথা বাহির করিয়া আছে। অতীতের সাক্ষী ক্ষয়িষ্ণু দুর্গটির তোরণমুখে ভূপতিত কামানটিকে দেখিয়া কেমন যেন মায়া হয়; মনে হয় যৌবনে সে বলদৃপ্ত যোদ্ধা ছিল, জরার বশে ধরাশায়ী হইয়া সে ঊর্ধ্বমুখে মৃত্যুর দিন শুনিতেছে।
কামান ছাড়া অতীতকালের অস্থাবর বস্তু দুৰ্গমধ্যে আর কিছু নাই। প্রাকার-ঘেরা দুৰ্গভুমি আয়তনে দুই বিঘার বেশি নয়; সমস্তটাই পাথরের পার্টি দিয়া বাঁধানো। চক্রাকার প্রাকারের গায়ে ছোট ছোট কুঠুরি; বোধ হয় পূর্বকালে এগুলিতে দুৰ্গরক্ষক সিপাহীরা থাকিত। এগুলির অবস্থা ভগ্নপ্রায়; কোথাও পাথর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, কোথাও দ্বারের সম্মুখে কাঁটাগাছ জন্মিয়াছে। এই চক্রের মাঝখানে নাভির ন্যায় দুর্গের প্রধান ভবন। নাভি ও নেমির মধ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণের অবকাশ।
গৃহটি চতুষ্কোণ এবং বাহির হইতে দেখিলে মজবুত বলিয়া মনে হয়। পাঁচ ছয়টি ছোট বড় ঘর লইয়া গৃহ; মামুলিভাবে মেরামত করা সত্ত্বেও সব ঘরগুলি বাসের উপযোগী নয়। কোনও ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরিয়াছে, কোনও ঘরের ছাদ ফুটো হইয়া আকাশ দেখা যায়। কেবল পিছন দিকের একটি ছোট ঘর ভাল অবস্থায় আছে। যদিও চুন সুরকি খসিয়া স্কুল পাথরের গাঁথুনি প্রকট হইয়া পড়িয়াছে। তবু ঘরটিকে বাসোপযোগী করিবার জন্য তাহার প্রবেশ-পথে নূতন চৌকাঠ ও কবাট লাগানো হইয়াছে।
আমরা অন্যান্য ঘরগুলি দেখিয়া এই ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। পাণ্ডে চৌকাঠের দিকে আঙ্গুল দেখাইয়া বলিলেন, ‘অধ্যাপক মহাশয়ের লাস ঐখানে পড়ে ছিল।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, ‘সাপে কামড়বার পর তিনি যদি চৌকাঠে মাথা ঠুকে পড়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে মাথায় চোট লাগা অসম্ভব নয়।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘না, অসম্ভব নয়। কিন্তু সারা বাড়িটা। আপনি দেখেছেন; ভাঙ্গা বটে। কিন্তু কোথাও এমন আবর্জনা নেই। যেখানে সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। অধ্যাপক মহাশয় বাস করতে আসার সময় এখানে ভাল করে কার্বলিক অ্যাসিডের জল ছড়ানো হয়েছিল, তারপরও তিনি বেঁচে থাকাকালে বার দুই ছড়ানো হয়েছে—’
‘অধ্যাপক মহাশয় আসবার আগে এখানে কেউ বাস করত না?’
পাণ্ডে মুখ টিপিয়া বলিলেন, ‘কেউ কবুল করে না। কিন্তু মুরলীধর—’
‘হুঁ–বুঝেছি।’ বলিয়া ব্যোমকেশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।
ঘরটি লম্বায় চওড়ায় আন্দাজ চৌদ্দ ফুট। মেঝে শান বাঁধানো। একপাশে একটি তক্তপোশ এবং একটি আরাম-কেন্দারা ছাড়া ঘরে অন্য কোনও আসবাব নাই। অধ্যাপক মহাশয়ের ব্যবহারের জন্য যে-সকল তৈজস ছিল তাহা স্থানান্তরিত হইয়াছে।
এই ঘরে একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করিলম যাহা অন্য কোনও ঘরে নাই। তিনটি দেয়ালে মেঝে হইতে প্ৰায় এক হাত উর্ধের্ব সারি সারি লোহার গজাল ঠোকা রহিয়াছে, গজালগুলি দেয়াল হইতে দেড় হাত বাহির হইয়া আছে। সেগুলি আগে বোধ হয় শাবলের মত স্কুল ছিল, এখন মরিচা ধরিয়া যেরূপ ভঙ্গুর আকৃতি ধারণ করিয়াছে তাহাতে মনে হয় সেগুলি জানকীরামের সমসাময়িক।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেয়ালে গোঁজ। কেন?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘এ ঘরটা বোধহয় সেকালে দুর্গের দপ্তর কিম্বা খাজনাখানা ছিল। গোঁজের ওপর তক্তা পেতে দিলে বেশ তাক হয়, তাকের ওপর নানান জিনিসপত্র, বই খাতা, এমন কি টাকার সিন্দুক রাখা চলত। এখনও বিহারের অনেক সাবেক বাড়িতে এইরকম গোঁজ দেখা যায়।’
ব্যোমকেশ ঘরের মেঝে ও দেয়ালের উপর চোখ বুলাইয়া দেখিতে লাগিল। এক সময় বলিল, ‘অধ্যাপক মহাশয় নিশ্চয় বাক্স-বিছানা এনেছিলেন। সেগুলো কোথায়?’
‘সেগুলো আমাদের অর্থাৎ পুলিসের জিন্মায় আছে।’
‘বাক্সর মধ্যে কি আছে দেখেছেন?’
‘গোটাকিয়েক জামা কাপড় আর খান-তিন-চার বই খাতা। একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা তিনটে দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা পয়সা ছিল।’
‘আর তাঁর মুঠির মধ্যে যে মোহর পাওয়া গিয়েছিল সেটা?’
‘সেটাও আমাদের জিম্মায় আছে। এ মামলার একটা নিম্পত্তি হলে সব জিনিস তাঁর ওয়ারিসকে ফেরত দিতে হবে।’
ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ ঘর পরীক্ষা করিল, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া গেল না। তখন সে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, ‘চলুন। এখানকার দেখা শেষ হয়েছে।’
দুর্গ প্রাঙ্গণে আসিয়া আমরা তোরণের দিকে অগ্রসর হইয়াছি, একটি ছোকরা তোরণ দিয়া প্রবেশ করিল। মাস্টার রমাপতিকে এই প্রথম দেখিলাম। ছিপছিপে গড়ন, ময়লা রঙ, চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ; কিন্তু সঙ্কুচিত ভাব। বয়স উনিশ-কুড়ি। তাহাকে দেখিয়া পাণ্ডে বলিলেন, ‘কি মাস্টার, কি খবর?’
রমাপতি একটু অপ্রতিভ হাসিয়া বলিল, ‘বাড়িতে ডাক্তারবাবু আর উকিলবাবু এসেছেন। তাঁদের নিয়ে কর্তার ঘরে কি সব কাজের কথা হচ্ছে। বড়রা সবাই সেখানে আছেন। কিন্তু গদাই আর তুলসীকে দেখতে পেলাম না, তাই ভাবলাম হয়তো তারা এখানে এসেছে।’
না, তাদের তো এখানে দেখিনি।’ পাণ্ডে আমাদের সহিত রমাপতির পরিচয় করাইয়া দিলেন, ‘এঁরা আমার বন্ধু, এখানে বেড়াতে এসেছেন।’
রমাপতি একদৃষ্টি ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া সংহত স্বরে বলিল, ‘আপনি কি-সত্যান্বেষী ব্যোমকেশবাবু?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, ‘হ্যাঁ! কিন্তু সিলেন কি করে; আমার ছবি তো কোথাও বেরোয়নি।’
রমাপতি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল, স্থলিত স্বরে বলিল, ‘আমি-না, ছবি দেখিনি–কিন্তু দেখে মনে হল-আপনার বই পড়েছি।–কদিন ধরে মনে হচ্ছিল-আপনি যদি আসতেন তাহলে নিশ্চয় এই ব্যাপারের মীমাংসা হত—’ সে থতমত খাইয়া চুপ করিল।
ব্যোমকেশ সদয় হাসিয়া বলিল, ‘আসুন, আপনার সঙ্গে খানিক গল্প করা যাক।’
নিকটেই কামান পড়িয়ছিল, ব্যোমকেশ রুমাল দিয়া ধূলা ঝাড়িয়া তাহার উপর বসিল, পাশের স্থান নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘বসুন।’ রমাপতি সসঙ্কোচে তাহার পাশে বসিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি বললেন আমি এলে এ ব্যাপারের মীমাংসা হবে। ঈশানবাবু তো সাপের কামড়ে মারা গেছেন। এর মীমাংসা কী হবে?’
রমাপতি উত্তর দিল না, শঙ্কিত নতমুখে অঙ্গুষ্ঠ দিয়া অঙ্গুষ্ঠের নখ খুঁটিতে লাগিল। ব্যোমকেশ তাহার। আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখিয়া লইয়া সহজ স্বরে বলিল, ‘যাক ও কথা। ঈশানবাবু যে-রাত্রে মারা যান। সে-রাত্ৰে প্ৰায় সাড়ে ন’টা পর্যন্ত আপনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কি কথা হচ্ছিল?’
রমাপতি এবার সতর্কভাবে উত্তর দিল, বলিল, ‘উনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি ওঁর কাছে এলে আমার সঙ্গে নানারকম গল্প করতেন। সে-রাত্রে—’
‘সে-রাত্রে কোন্ গল্প বলছিলেন?’
‘এই দুর্গের ইতিহাস বলছিলেন।’
‘দুর্গের ইতিহাস! তাই নাকি! কি ইতিহাস শুনলেন বলুন তো, আমরাও শুনি।’
আমি আর পাণ্ডে গিয়া কামানের উপর বসিলাম। রমাপতি যে গল্প শুনিয়াছিল। তাহা বলিল। রাজা জানকীরাম হইতে আরম্ভ করিয়া সিপাহী বিদ্রোহের সময় রাজারাম ও জয়রাম পর্যন্ত কাহিনী বলিয়া গেল।
শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ, সত্যি ইতিহাস বলেই মনে হয়। কিন্তু এ ইতিহাস তো পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায় না। ঈশানবাবু জানলেন কি করে?’
রমাপতি বলিল, ‘উনি সব জানতেন। কর্তার এক ভাই ছিলেন, কম বয়সে মারা যান, তাঁর নাম ছিল রামবিনোদ সিংহ, অধ্যাপক মশায় তাঁর প্রাণের বন্ধু ছিলেন। তাঁর মুখে উনি এসব কথা শুনেছিলেন; রামবিনোদবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত বংশের সব ইতিহাস এর জানা ছিল। একটা খাতায় সব লিখে রেখেছিলেন।’
‘খাতায় লিখে রেখেছিলেন? কোথায় খাতা?’
‘এখন খাতা কোথায় তা জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি। বোধহয় ওঁর তোরঙ্গের মধ্যে আছে।’
ব্যোমকেশ পাণ্ডের পানে তাকাইল। পাণ্ডে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘পেন্সিলে লেখা একটা খাতা আছে, কিন্তু তাতে কি লেখা আছে তা জানি না। বাংলায় লেখা।’
‘দেখতে হবে; যা হোক–’ ব্যোমকেশ রমাপতির দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আপনার কাছে অনেক খবর পাওয়া গেল। —আচ্ছা, পরদিন সকালে সবার আগে আপনি আবার দুর্গে এসেছিলেন কেন, বলুন তো?’
রমাপতি বলিল, ‘উনি আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল ভোরবেলা এসো, বাকি গল্পটা বলব!’
‘বাকি গল্পটা মানে–?’
‘তা কিছু খুলে বলেননি। তবে আমার মনে হয়েছিল যে সিপাহী যুদ্ধের পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এ বংশের ইতিহাস আমাকে শোনাবেন।’
‘কিন্তু কেন? আপনাকে এ ইতিহাস শোনাবার কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি-?’
‘তা জানি না; তাঁর যখন যা মনে আসত আমাকে বলতেন, আমারও ভাল লাগত। তাই শুনতাম। মোগল-পাঠান আমলের অনেক গল্প বলতেন। একদিন বলেছিলেন, যে-বংশে একবার ভ্রাতৃহত্যার বিষ প্রবেশ করেছে সে-বংশের আর রক্ষা নেই; যতবড় বংশই হোক তার ধ্বংস অনিবাৰ্য। এই হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষ্য।’
আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। পাণ্ডের ললাট ভ্রূকুটি-বন্ধুর হইয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘সন্ধ্যে হয়ে আসছে। চলুন, এবার ওদিকে যাওয়া যাক।’
খাদের ওপারে বাড়ির আড়ালে সূর্য তখন ঢাকা পড়িয়াছে।