রামকিশোরবাবুকে খাতির করিয়া বসানো হইল। পাণ্ডেজি বোধ করি চায়ের হুকুম দিবার জন্য বাহিরে গেলেন।
ডাক্তার ঘটক হাসিয়া বলিল, ‘আমার রুগীর পক্ষে বেশি উত্তেজনা কিন্তু ভাল নয়। উনি জোর করলেন বলেই সঙ্গে নিয়ে এসেছি, নইলে ওঁর উচিত বিছানায় শুয়ে থাকা।’
রামকিশোর গাঢ়স্বরে বলিলেন, ‘আর উত্তেজনা! আজ সকাল থেকে আমার ওপর দিয়ে যা গেছে তাতেও যখন বেঁচে আছি তখন আর ভয় নেই ডাক্তার।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সত্যিই আর ভয় নেই। একে তো সব বিপদ কেটে গেছে, তার ওপর ডাক্তার পেয়েছেন। ডাক্তার ঘটক যে কত ভাল ডাক্তার তা আমি জানি কিনা। কিন্তু একটা কথা বলুন। সন্ন্যাসীকে দাদা বলতে কি আপনি এখনও রাজী নন?
রামকিশোর লজ্জায় নতমুখ হইলেন।
‘ব্যোমকেশবাবু্, নিজের লজ্জাতে নিজেই মরে আছি, আপনি আর লজ্জা দেবেন না। দাদাকে হাতে পায়ে ধরেছিলাম, দাদা সংসারী হতে রাজী হননি। বলেছিলাম, আমি হরিদ্বারে মন্দির করে দিচ্ছি। সেখানে সেবায়েৎ হয়ে রাজার হালে থাকুন। দাদা শুনলেন না। শুনলে হয়তো অপঘাত মৃত্যু হত না।’ তিনি নিশ্বাস ফেলিলেন।
পাণ্ডেজি ফিরিয়া আসিলেন, ‘তাঁহার হাতে আমাদের পূর্বদৃষ্ট মোহরটি। সেটি রামকিশোরকে দিয়া বলিলেন, ‘আপনার জিনিস আপনি রাখুন।’
রামকিশোর সাগ্রহে মোহরটি লইয়া দেখিলেন, কপালে ঠেকাইয়া বলিলেন, ‘আমার পিতৃপুরুষের সম্পত্তি। তাঁরা সবই রেখে গিয়েছিলেন, আমাদের কপালের দোষে এতদিন পাইনি। ব্যোমকেশবাবু্, সত্যিই কি সন্ধান পেয়েছেন?’
‘পেয়েছি বলেই আমার বিশ্বাস। তবে চোখে দেখিনি।’
‘তাহলে—তাহলে—!’ রামকিশোরবাবু ঢোক গিলিলেন।
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিল।
‘আপনার এলাকার মধ্যেই আছে। খুঁজে নিন না।’
‘খোঁজবার কি ত্রুটি করেছি, ব্যোমকেশবাবু? কেল্লা কিনে অবধি তার আগাপাস্তলা তন্ন তন্ন করেছি। পাইনি; হতাশ হয়ে ভেবেছি সিপাহীরা লুটেপুটে নিয়ে গেছে। আপনি যদি জানেন, বলুন। আমি আপনাকে বঞ্চিত করব না, আপনিও বাখরা পাবেন। এঁদের সালিশ মানছি, পাণ্ডেজি আর ডাক্তার ঘটক যা ন্যায্য বিবেচনা করবেন তাই দেব। আপনি আমার অশেষ উপকার করেছেন, যদি অর্ধেক বাখরাও চান–’
ব্যোমকেশ নীরস স্বরে বলিল, ‘বখর চাই না। কিন্তু দুটো শর্ত আছে।’
‘শর্ত! কী শর্ত?’
‘প্রথম শর্ত, রমাপতির সঙ্গে তুলসীর বিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, বিয়ের যৌতুক হিসেবে আপনার দুর্গ রমাপতিকে লেখাপড়া করে দিতে হবে।’
ব্যোমকেশ যে ভিতরে ভিতরে ঘটকালি করিতেছে তাহা সন্দেহ করি নাই। সকলে উচ্চকিত হইয়া উঠিলাম। রমাপতি লজ্জিত মুখে সরিয়া গেল।
রামকিশোর কয়েক মিনিট হেঁট মুখে চিন্তা করিয়া মুখ তুলিলেন। বলিলেন, ‘তাই হবে। রমাপতিকে আমার অপছন্দ নয়। ওকে চিনি, ও ভাল ছেলে। অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আবার হয়তো একটা ভূত-বাঁদর জুটবে। তার দরকার নেই।’
‘আর দুর্গ?’
‘দুর্গ লেখাপড়া করে দেব। আপনি চান পৈতৃক সোনাদানা তুলসী আর রমাপতি পাবে, এই তো? বেশ তাই হবে।’
‘কথার নড়াচড় হবে না?’
রামকিশোর একটু কড়া সুরে বলিলেন, ‘আমি রাজা জানকীরামের সন্তান। কথার নড়াচড় কখনও করিনি।’
‘বেশ। আজ তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কাল সকালে আমরা যাব।’
পরদিন প্ৰভাতে আমরা আবার দুর্গে উপস্থিত হইলাম। আমরা চারজন-আমি, ব্যোমকেশ পাণ্ডেজি ও সীতারাম। অন্য পক্ষ হইতে কেবল রামকিশোর ও রমাপতি। বুলাকিলালকে হুকুম দেওয়া হইয়াছিল দুর্গে যেন আর কেহনা আসে। সে দেউড়িতে পাহারা দিতেছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনারা অনেক বছর ধরে খুঁজে খুঁজে যা পাননি ঈশানবাবু দুহাপ্তায় তা খুঁজে বার করেছিলেন। তার কারণ তিনি প্রত্নতত্ত্ববিৎ ছিলেন, কোথায় খুঁজতে হয় জানতেন। প্ৰথমে তিনি পেলেন একটা শিলালিপি, তাতে লেখা ছিল,–’যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিম্মায় গচ্ছিত রহিল।’ এ লিপি রাজারামের লেখা। কিন্তু মোহনলাল কে? ঈশানবাবু বুঝতে পারলেন না। বুঝতে পারলে মনে হয় গণ্ডগোলই হত না, তিনি চুরি করবার বৃথা চেষ্টা না করে সরাসরির রামকিশোরকে খবর দিতেন।
‘তারপর ঈশানবাবু পেলেন গুপ্ত তোষাখানার সন্ধান; ভাবলেন সব সোনাদোনা সেইখানেই আছে। আমরা জানি তোষাখানায় একটি গড়িয়ে পড়া মোহর ছাড়া আর কিছুই ছিল না; বাকি সব কিছু রাজারাম সরিয়ে ফেলেছিলেন। এইখানে বলে রাখি, সিপাহীরা তোষাখানা খুঁজে পায়নি; পেলে হাঁড়িকলসীগুলো আস্ত থাকত না।
‘সে যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, মোহনলাল কে, যার জিন্মায় রাজারাম তামাম ধনসম্পত্তি গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় মোহনলাল মানুষ হতে পারে না। দুর্গে সে সময় রাজারাম আর জয়রাম ছাড়া আর কেউ ছিল না; রাজারাম সকলকে বিদেয় করে দিয়েছিলেন। তবে কার জিন্মায় সোনাদানা গচ্ছিত রাখলেন? মোহনলাল কেমন জীব?
‘আমিও প্রথমটা কিছু ধরতে পারছিলাম না। তারপর অজিত হঠাৎ একদিন পলাশীর যুদ্ধ আবৃত্তি করল—’আবার আবার সেই কামান গর্জন-গৰ্জিল মোহনলাল.’। কামান—মোহনলাল। সেকালে বড় বড় বীরের নামে কামানের নামকরণ হত। বিদ্যুতের মত মাথায় খেলে গেল মোহনলাল কে! কার জিম্মায় সোনাদানা আছে। ঐ যে মোহনলাল।’ ব্যোমকেশ অঙ্গুলি দিয়া ভূমিশয়ান কামনটি দেখাইল।
আমরা সকলেই উত্তেজিত হইয়াছিলাম; রামকিশোর অস্থির হইয়া বলিলেন, ‘অ্যাঁ! তাহলে কামানের নীচে সোনা পোঁতা আছে।’
‘কামানের নীচে নয়। সেকালে সকলেই মাটিতে সোনা পুতে রাখত; রাজারাম অমন কাঁচা কাজ করেননি। তিনি কামানের নলের মধ্যে সোনা ঢেলে দিয়ে কামানের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঐ যে দেখছেন কামানের মুখ থেকে শুকনো ঘাসের গোছা গলা বাড়িয়ে আছে, একশো বছর আগে সিপাহীরাও অমনি শুকনো ঘাস দেখেছিল; তারা ভাবতেও পারেনি যে ভাঙা অকমণ্য কামানের পেটের মধ্যে সোনা জমাট হয়ে আছে।’
রামকিশোর অধীর কণ্ঠে বলিলেন, ‘তবে আর দেরি কেন? আসুন, মাটি খুঁড়ে মোহর বের করা যাক।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোহর? মোহর কোথায়? মোহর আর নেই। রামকিশোরবাবু। রাজারাম এমন বুদ্ধি খেলিয়েছিলেন যে সিপাহীরা সন্ধান পেলেও সোনা তুলে নিয়ে যেতে পারত না।’
‘মানে-মনে-কিছু বুঝতে পারছি না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পাণ্ডেজি, তোষাখানায় একটা উনন আর হাপর দেখেছিলেন মনে আছে? সোহাগাও একটা হাঁড়িতে ছিল। বুঝতে পারলেন? রাজারাম তাঁর সমস্ত মোহর গলিয়ে ঐ কামানের মুখে ঢেলে দিয়েছিলেন। ওর ভেতরে আছে জমাট সোনার একটা খাম।’
‘তাহলে–তাহলে–’
‘ওর মুখ থেকে মাটি খুঁড়ে সোনা দেখতে পাবেন হয়তো। কিন্তু বার করতে পারবেন না।’
‘তবে উপায়?’
‘উপায় পরে করবেন। কলকাতা থেকে আকসি-অ্যাসিটিলিন আনিয়ে কামান কাটতে হবে; তিন ইঞ্চি পুরু লোহা ছেনি বাটালি দিয়ে কাটা যাবে না। আপাতত মাটি খুঁড়ে দেখা যেতে পারে আমার অনুমান সত্যি কি না–সীতারাম।’
সীতারামের হাতে লোহার তুরপুন প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ছিল। আদেশ পাইয়া সে ঘোড়সওয়ারের মত কামানের পিঠে চড়িয়া বসিল। আমরা নীচে কামানের মুখের কাছে সমবেত হইলাম। সীতারাম মহা উৎসাহে মাটি খুঁড়িতে লাগিল।
প্রায় এক ফুট কাটিবার পর সীতারাম বলিল, ‘হুজুর, আর কাটা যাচ্ছে না। শক্ত লাগছে!’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘লোগাও তুরপুন!’
সীতারাম তখন কামানের মুখের মধ্যে তুরপুন ঢুকাইয়া পাক দিতে আরম্ভ করিল। দু’চারবার ঘুরাইবার পর চাকলা চাকলা সোনার ফালি ছিটকাইয়া বাহিরে আসিয়া পড়িতে লাগিল। আমরা সকলে উত্তেজনায় দিশাহারা হইয়া কেবল অর্থহীন চীৎকার করিতে লাগিলাম।
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘ব্যস, সীতারাম, এবার বন্ধ কর। আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রামকিশোরবাবু্, দুর্গের মুখে মজবুত দরজা বসান, পাহারা বসান; যতদিন না। সব সোনা বেরোয় ততদিন আপনারা সপরিবারে এসে এখানে বাস করুন। এত সোনা আলগা ফেলে রাখবেন না।’
সেদিন বাসায় ফিরিতে বেলা একটা বাজিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম ব্যোমকেশের নামে ‘তারা’ আসিয়াছে। আমাদের মুখ শুকাইয়া গেল। হঠাৎ ‘তার কেন? কাহার ‘তার’–সত্যবতী ভাল আছে তো!
তারের খাম ছিড়িতে ব্যোমকেশের হাত একটু কাঁপিয়া গেল। আমি অদূরে দাঁড়াইয়া অপলকচক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম।
‘তার’ পড়িতে পড়িতে তাহার মুখখানা কেমন এক রকম হইয়া গেল; তারপর সে মুখ তুলিল। গলা ঝাড়া দিয়া বলিল, ‘ওদিকেও সোনা।’
‘সোনা!’
‘হ্যাঁ-ছেলে হয়েছে।’
ছয় মাস পরে বৈশাখের গোড়ার দিকে কলকাতা শহরে গরম পড়ি-পড়ি করিতেছিল। একদিন সকালবেলা আমি এবং ব্যোমকেশ ভাগাভাগি করিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছি, সত্যবতী একবাটি দুধ ও ছেলে লইয়া মেঝেয় বসিয়াছে, দুধ খাওয়ানো উপলক্ষে মাতাপুত্ৰে মল্লযুদ্ধ চলিতেছিল, এমন সময় সদর দরজায় খট্খটু শব্দ হইল। সত্যবতী ছেলে লইয়া পলাইবার উপক্ৰম করিল। আমি দ্বার খুলিয়া দেখি রমাপতি ও তুলসী। রমাপতির হাতে একটি চৌকশ বাক্স, গায়ে সিঙ্কের পাঞ্জাবি, মুখে সলজ্জ হাসি।
তুলসীকে দেখিয়া আর চেনা যায় না। এই কয় মাসে সে রীতিমত একটা যুবতী হইয়া উঠিয়াছে। অগ্রহায়ণ মাসে তাহদের বিবাহ উপলক্ষে আমরা নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম, কিন্তু যাইতে পারি নাই। ছয় মাস পরে তাহদের দেখিলাম।
তুলসী ঘরে আসিয়াই একেবারে ঝড় বহাইয়া দিল। সত্যবতীর সহিত পরিচয় করাইয়া দিবার সঙ্গে সঙ্গে সে তাহার কোল থেকে খোকাকে তুলিয়া লইয়া তাহাকে চুম্বন করিতে করিতে ঘরময় ছুটাছুটি করিল; তারপর তাহাকে রমাপতির কোলে ফেলিয়া দিয়া সত্যবতীর আঁচল ধরিয়া টানিতে টানিতে পাশের ঘরে লইয়া গেল। তাহদের কলকাকলি ও হাসিয়া শব্দ পদ ভেদ করিয়া আমাদের কানে আসিতে লাগিল।
তুলসীর চরিত্ৰ যেন পাথরের তলায় চাপা ছিল, এখন মুক্তি পাইয়াছে। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।
ঘর ঠাণ্ডা হইলে ব্যোমকেশ রমাপতিকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাক্স কিসের? গ্রামোফোন নাকি?’
‘না। আমরা আপনার জন্যে একটা জিনিস তৈরি করিয়ে এনেছি্,–বলিয়া রমাপতি বাক্স খুলিয়া যে জিনিসটি বাহির করিল। আমরা তাহার পানে মুগ্ধনেত্ৰে চাহিয়া রহিলাম। আগাগোড়া সোনায় গড়া দুর্গের একটি মডেল। ওজন প্রায় দুই সের, অপূর্ব কারুকার্য। আসল দুর্গের সহিত কোথাও এক তিল তফাত নাই; এমন কি কামানটি পর্যন্ত যথাস্থানে রহিয়াছে।
আমরা চমৎকৃত স্বরে বলিলাম, ‘বাঃ!’
তারপর খাওয়া-দাওয়া গল্পগাছ রঙ্গতামাসায় বেলা কাটিয়া গেল। রামকিশোরবাবুদের খবর জানা গেল, কর্তার শরীর ভালই যাইতেছে, বংশীধর নিজের জমিদারীতে বাড়ি তৈয়ারি করিয়াছে; মুরলীধর শহরে বাড়ি কিনিয়া বাস করিতেছে; গদাধর তুলসী ও রমাপতিকে লইয়া কর্তা শৈলগৃহেই আছেন; চাঁদমােহন আবার জমিদারী দেখাশুনা করিতেছেন। দুর্গটিকে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করানো হইতেছে। তুলসী ও রমাপতি সেখানে বাস করিবে।
অপরাহ্নে তাহারা বিদায় লইল। বিদায়কালে ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুলসী, তোমার মাস্টার কেমন?’
মাস্টারের দিকে কপট-কুটিল কটাক্ষপাত করিয়া তুলসী বলিল, ‘বিচ্ছিরি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। একদিন আমার কোলে বসে মাস্টারের জন্যে কেঁদেছিলে মনে আছে?’
এবার তুলসীর লজ্জা হইল। মুখে আচল চাপা দিয়া সে বলিল, ‘ধেৎ!’