ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক, এতদিনে রামবিনোদ সত্যি সত্যি দেহরক্ষা করলেন।’
‘রামবিনোদ!’
‘তুমি যে আকাশ থেকে পড়লে। বুঝতে পারনি? ধন্য তুমি।’
ধুনিতে ইন্ধন নিক্ষেপ করিয়া বহ্নিমান করিয়া তোলা হইয়াছে। বাবাজীর শব তাহার পাশে শক্ত হইয়া পড়িয়া আছে। আমরা দুইজনে কিছুদূরে মুখোমুখি উপু হইয়া বসিয়া সিগারেট টানিতেছি।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মনে আছে, প্রথম রামকিশোরবাবুকে দেখে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল? আসলে তার কিছুক্ষণ আগে বাবাজীকে দেখেছিলাম। দুই ভায়ের চেহারায় সাদৃশ্য আছে; তখন ধরতে পারিনি। দ্বিতীয়বার রামকিশোরকে দেখে বুঝলাম।’
‘কিন্তু রামবিনোদ যে প্লেগে মারা গিয়েছিল?’
‘রামবিনোদের প্লেগ হয়েছিল, কিন্তু সে মরবার আগেই বাকি সকলে তাকে চড়ায় ফেলে পালিয়েছিল। চাঁদমোহনের কথা থেকে আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। তারপর রামবিনোদ বেঁচে গেল। এ যেন কতকটা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলার মত।’
‘এতদিন কোথায় ছিল?’
‘তা জানি না। বোধ হয় প্রথমটা বৈরাগ্য এসেছিল, সাধু-সন্ন্যাসীর লে মিশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তারপর হঠাৎ রামকিশোরের সন্ধান পেয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছিল। কিন্তু ওকথা যাক, এখন মড়া আগলাবার ব্যবস্থা করা দরকার। অজিত, আমি এখানে আছি, তুমি টর্চ নিয়ে যাও, সীতারামকে ডেকে নিয়ে এস। আর যদি পারো, বুলাকিলালের ঘুম ভাঙিয়ে তাকেও ডেকে আনো। ওরা দু’জনে মড়া পাহারা দিক।’
বলিলাম, তুমি একলা এখানে থাকবে? সেটি হচ্ছে না। থাকতে হয় দু’জনে থাকিব, যেতে হয় দু’জনে যাব।’
‘ভয় হচ্ছে আমাকেও সাপে ছোব্লাবে! এ তেমন সাপ নয় হে, জাগা মানুষকে ছোব্লায় না। যা হোক, বলছি। যখন, চল দু’জনেই যাই।’
দেউড়িতে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘দাঁড়াও, বুলাকিলালকে জাগানো যাক।’
অনেক ঠেলাঠেলির পর বুলাকিলালের ঘুম ভাঙিল। তাহাকে বাবাজীর মৃত্যুসংবাদ দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ সাধুবাবা ভাঙি খেয়েছিলেন?’
‘জী, এক ঘটি খেয়েছিলেন।’
‘আর কে কে ভাঙি খেয়েছিল?’
‘আর বাড়ি থেকে চাকর এসে এক ঘটি নিয়ে গিয়েছিল।’
‘বেশ, এখন যাও, বাবাজীকে পাহারা দাও গিয়ে। আমি সীতারামকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
বুলাকিলাল বিমাইতে ঝিমাইতে চলিয়া গেল। মনে হইল, ঘুম ভাঙিলেও তাহার নেশার ঘোর কাটে নাই।
দুর্গে ফিরিয়া দেখিলাম সীতারাম জাগিয়া বসিয়া আছে। খবর শুনিয়া সে কেবল একবার চক্ষু বিস্ফারিত করিল, তারপর নিঃশব্দে নামিয়া গেল।
ঘরের মধ্যে রমাপতি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহাকে জাগাইলাম না, বাহিরে আসিয়া বসিলাম। রাত্রি সাড়ে বারোটা।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ আর ঘুমানো চলবে না। অন্তত একজনকে জেগে থাকতে হবে। অজিত, তুমি না হয় ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে নাও, তারপর তোমাকে তুলে দিয়ে আমি ঘুমবো।’
উঠিতে মন সরিতেছিল না, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হইয়াছিল। প্রশ্ন করিলম, ‘ব্যোমকেশ, বাবাজীকে মারলে কে?’
‘ঈশানবাবুকে যে মেরেছে সে।’
‘সে কে?’
‘তুমিই বল না। আন্দাজ করতে পারো না?’
এই কথাটাই মাথায় ঘুরিতেছিল। আস্তে আস্তে বলিলাম, ‘বাবাজী যদি রামবিনোদ হন তাহলে কে তাঁকে মারতে পারে? এক আছেন রামকিশোরবাবু—’
‘তিনি ভাইকে খুন করবেন?’
‘তিনি মুমূর্ষ ভাইকে ফেলে পালিয়েছিলেন। সেই ভাই ফিরে এসেছে, হয়তো সম্পত্তির বখরা দাবি করেছে—’
‘বেশ, ধরা যাক রামকিশোর ভাইকে খুন করেছেন। কিন্তু ঈশানবাবুকে খুন করলেন কেন?’
‘ঈশানবাবু রামবিনোদের প্রাণের বন্ধু ছিলেন, সন্ন্যাসীকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন। হয়তো রামকিশোরকে শাসিয়েছিলেন, ভ্যালয় ভালয় সম্পত্তির ভাগ না দিলে সব ফাঁস করে দেবেন। সন্ন্যাসীকে রামবিনোদ বলে সনাক্ত করতে পারে দু’জন-চাঁদমোহন আর ঈশানবাবু। চাঁদমোহন মালিকের মুঠোর মধ্যে, ঈশানবাবুকে সরাতে পারলে সব গোল মিটে যায়—’
ব্যোমকেশ হঠাৎ আমার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল, ‘অজিত! ব্যাপার কি হে? তুমি যে ধারাবাহিক যুক্তিসঙ্গত কথা বলতে আরম্ভ করেছ! তবে কি এতদিনে সত্যিই বোধোদয় হল! কিন্তু আর নয়, শুয়ে পড় গিয়ে। ঠিক তিনটের সময় তোমাকে তুলে দেব।’
আমি গমনোদ্যত হইলে সে খাটো গলায় কতকটা নিজ মনেই বলিল, ‘রমাপতি ঘুমোচ্ছে—না মটকা মেরে পড়ে আছে?–যাক, ক্ষতি নেই, আমি জেগে আছি।’
বেলা আটটা আন্দাজ পাণ্ডেজি আসিলেন। বাবাজীর মৃত্যুসংবাদ নীচেই পাইয়াছিলেন, বাকি খবরও পাইলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি লাস নিয়ে ফিরে যান। আবার আসবেন কিন্তু—আর শুনুন—’
ব্যোমকেশ তাঁহাকে একটু দূরে লইয়া গিয়া মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ কথা বলিল। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘বেশ, আমি দশটার মধ্যেই ফিরব। রমাপতিকে ঘর থেকে বেরুতে দেবেন না।’
তিনি চলিয়া গেলেন।
সাড়ে ন’টার সময় আমি আর ব্যোমকেশ রামকিশোরবাবুর বাড়িতে গেলাম। বৈঠকখানায় তক্তপোশের উপর রামকিশোর বসিয়া ছিলেন, পাশে মণিলাল। বংশীধর ও মুরলীধর তক্তপোশের সামনে পায়চারি করিতেছিল, আমাদের দেখিয়া নিমেষের মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইল। বোধ হয়। পারিবারিক মন্ত্রণা-সভা বসিয়াছিল, আমাদের আবিভাবে ছত্ৰভঙ্গ হইয়া গেল।
রামকিশোরের গাল বসিয়া গিয়াছে, চক্ষু কোটরগত। কিন্তু তিনি বাহিরে অবিচলিত আছেন। ক্ষীণ হাসিয়া বলিলেন, ‘আসুন-বসুন।’
তক্তপোশের ধারে চেয়ার টানিয়া বসিলাম। রামকিশোর একবার গলা ঝাড়া দিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বলিলেন, ‘সন্ন্যাসী ঠাকুরকেও সাপে কামড়েছে। ক্ৰমে দেখছি। এখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠল। বংশী আর মুরলী দু’একদিনের মধ্যে চলে যাচ্ছে, আমরা বাকী ক’জন এখানেই থাকিব ভেবেছিলাম। কিন্তু সাপের উৎপাত যদি এভাবে বাড়তেই থাকে–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শীতকালে সাপের উৎপাত-আশ্চর্য!’
রামকিশোর বলিলেন, ‘তার ওপর বাড়িতে কাল রাত্রে আর এক উৎপাত। এ বাড়িতে আজ পর্যন্ত চোর ঢোকেনি–’
মণিলাল বলিল, ‘এ মামুলি চোর নয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি হয়েছিল?’
রামকিশোর বলিলেন, ‘আমার শরীর খারাপ হয়ে অবধি মণিলাল রাত্রে আমার ঘরে শোয়। কাল রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময়—। মণিলাল, তুমিই বল। আমার যখন ঘুম ভাঙল চোর তখন পালিয়েছে।’
মণিলাল বলিল, ‘আমার খুব সজাগ ঘুম। কাল গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, মনে হল দরজার বাইরে পায়ের শব্দ। এ বাড়ির নিয়ম রাত্রে কেউ দোরে খিল দিয়ে শোয় না, এমন কি সদর দরজাও ভেজানো থাকে। আমার মনে হল আমাদের ঘরের দোর কেউ সস্তপণে ঠেলে খোলবার চেষ্টা করছে। আমার খাট দরজা থেকে দূরে; আমি নিঃশব্দে উঠলাম, পা টিপে টিপে দোরের কাছে গোলাম।। ঘরে আলো থাকে না, অন্ধকারে দেখলাম দোরের কপাট আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। এই সময় আমি একটা বোকামি করে ফেললাম। আর একটু অপেক্ষা করলেই চোর ঘরে ঢুকতো, তখন তাকে ধরতে পারতাম। তা না করে আমি দরজা টেনে খুলতে গেলাম। চোর সতর্ক ছিল, সে দুড় দুড় করে পালাল।’
রামকিশোর বলিলেন, ‘এই সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাকে চোর মনে করছেন সে তুলসী নয় তো? তুলসীর শুনেছি। রাত্রে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যোস আছে।’
রামকিশোরের মুখের ভাব কড়া হইল, তিনি বলিলেন, ‘না, তুলসী নয়। তাকে আমি কাল রাত্রে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম।’
ব্যোমকেশ মণিলালকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘চোরকে আপনি চিনতে পারেননি?’
‘না। কিন্তু—’
‘আপনার বিশ্বাস চেনা লোক?’
‘হ্যাঁ।’
রামকিশোর বলিলেন, ‘লুকোছাপার দরকার নেই। আপনারা তো জানেন রমাপতিকে কাল আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। মণিলালের বিশ্বাস সেই কোন মতলবে এসেছিল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক কাঁটার সময় এই ব্যাপার ঘটেছিল বলতে পারেন। কি?’
রামকিশোর বলিলেন, ‘ঠিক পৌঁনে বারোটার সময়। আমার বালিশের তলায় ঘড়ি থাকে, আমি দেখেছি।’
ব্যোমকেশ আমার পানে সঙ্কেতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিল, আমি মুখ টিপিয়া রহিলাম। রমাপতি যে পৌঁনে বারোটার সময় ব্যোমকেশের খাটে শুইয়া ছিল তাহা বলিলাম না।
রামকিশোর বিষন্ন গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘আজ সকালে আর একটা কথা জানা গেল। রমাপতি তার জিনিসপত্র নিয়ে যায়নি, তার ঘরেই পড়ে ছিল। আজ সকালে ঘর তল্লাস করালাম। তার টিনের ভাঙা তোরঙ্গ থেকে এই জিনিসটা পাওয়া গেল।’ পকেট হইতে একটি সোনার কাঁটা বাহির করিয়া তিনি ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।
মেয়ের যে-ধরনের লোহার দুভাঁজ কাঁটা দিয়া চুল বাঁধেন সেই ধরনের সোনার কাঁটা। আকারে একটু বড় ও স্কুল, দুই প্রাস্ত ছুচের মত তীক্ষ্ণ। সেটিকে নাড়িয়া চাড়িয়া ব্যোমকেশ সপ্রশ্নচক্ষে রামকিশোরের পানে চাহিল; তিনি বলিলেন, ‘আমার বড় মেয়ে হরিপ্রিয়ার চুলের কাঁটা। তার মৃত্যুর পর হারিয়ে গিয়েছিল।’
কাঁটা ফেরৎ দিয়া ব্যোমকেশ পূর্ণদৃষ্টিতে রামকিশোরের পানে চাহিয়া বলিল, ‘রামকিশোরবাবু্, এবার সোজাসুজি বোঝাপড়ার সময় হয়েছে।’
রামকিশোর যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, ‘বোঝাপড়া!’
‘হ্যাঁ। আপনার দাদা রামবিনোদবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।’ রামকিশোরের মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল। তিনি কথা বলিবার জন্য মুখ খুলিলেন, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তারপর অতিকষ্টে নিজেকে আয়ত্ত করিতে করিতে অর্ধরুদ্ধ স্বরে বলিলেন, ‘আমার দাদা–! কার কথা বলছেন। আপনি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কার কথা বলছি তা আপনি জানেন। মিথ্যে অভিনয় করে লাভ নেই। সর্পাঘাত যে সত্যিকার সর্পাঘাত নয় তাও আমরা জানি। আপনার দাদাকে কাল রাত্রে খুন করা হয়েছে।’
মণিলাল বলিয়া উঠিল, ‘খুন করা হয়েছে!’
‘হ্যাঁ। আপনি জানেন কি, সন্ন্যাসীঠাকুর হচ্ছেন আপনার শ্বশুরের দাদা, রামবিনোদ সিংহ।’
রামকিশোর এতক্ষণে অনেকটা সামলাইয়াছেন, তিনি তীব্ৰস্বরে বলিলেন, ‘মিথ্যে কথা! আমার দাদা অনেকদিন আগে প্লেগে মারা গেছেন। এসব রোমান্টিক গল্প কোথা থেকে তৈরি করে আনলেন? সন্ন্যাসী আমার দাদা প্ৰমাণ করতে পারেন। সাক্ষী আছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একজন সাক্ষী ছিলেন ঈশানবাবু্, তাঁকেও খুন করা হয়েছে।’
রামকিশোর এবার ক্ৰোধে ফাটিয়া পড়িলেন, ঊর্ধ্বস্বরে বলিলেন, ‘মিথ্যে কথা! মিথ্যে! এসব পুলিসের কারসাজি। যান। আপনারা আমার বাড়ি থেকে, এই দণ্ডে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যান। আমার এলাকায় পুলিসের গুপ্তচরের জায়গা নেই।’
এই সময় বাহিরে জানালায় মুরলীধরের ভয়ার্ত মুখ দেখা গেল—’বাবা! পুলিস বাড়ি ঘেরাও করেছে।’ বলিয়াই সে অপসৃত হইল।
চমকিয়া দ্বারের দিকে ফিরিয়া দেখি পায়ের বুট হইতে মাথার হেলমেট পর্যন্ত পুলিস পোষাক-পরা পাণ্ডেজি ঘরে প্রবেশ করিতেছেন, তাঁহার পিছনে ব্যাগ হাতে ডাঃ ঘটক!