দেউড়ি পর্যন্ত নামিবার পর দেখিলাম বাড়ির দিকের সিঁড়ি দিয়া বংশীধর গট্রিগাঢ় করিয়া নামিয়া আসিতেছে। আমাদের দেখিতে পাইয়া তাহার সতেজ গতিভঙ্গী কেমন যেন এলোমেলো হইয়া গেল; কিন্তু সে থামিল না, যেন শহরের রাস্তা ধরিবে এমনিভাবে আমাদের পিছনে রাখিয়া আগাইয়া গেল।
ব্যোমকেশ চুপি চুপি বলিল, ‘বংশীধর সাধুবাবার কাছে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে ভড়কে গিয়ে অন্য পথ ধরেছে।’
বংশীধর তখনও বেশি দূর যায় নাই, পাণ্ডেজি হাঁক দিলেন, ‘বংশীধর বাবু।’
বংশীধর ফিরিয়া ভ্রূ নত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আমরা কাছে গেলাম, পাণ্ডেজি কৌতুকের সুরে বলিলেন, ‘কোথায় চলেছেন হনহনিয়ে?
বংশীধর রুক্ষ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘বেড়াতে যাচ্ছি।’
পাণ্ডেজি হাসিয়া বলিলেন, ‘এই তো শহর বেড়িয়ে এলেন। আরও বেড়াবেন?’
বংশীধরের রাগের শিরা উচু হইয়া উঠিল, সে উদ্ধতম্বরে বলিল, ‘হ্যাঁ, বেড়াবো। আপনি পুলিস হতে পারেন, কিন্তু আমার বেড়ানো রুকতে পারেন না।’
পাণ্ডেজিরও মুখ কঠিন হইল। তিনি কড়া সুরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ, পারি। কলেজ হোস্টেলে আপনি একজনকে বিষ খাইয়েছিলেন, সে মামলার এখনও নিম্পত্তি হয়নি। ফৌজদারি মামলার তোমাদি হয় না। আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারি।’
ভয়ে বংশীধরের মুখ নীল হইয়া গেল। উগ্রতা এত দ্রুত আতঙ্কে পরিবর্তিত হইতে পারে চোখে না দেখিলে বিশ্বাস হয় না। সে জালাবদ্ধ পশুর ন্যায় ক্ষিপ্ৰচক্ষে এদিক ওদিক চাহিল, তারপরে যে পথে আসিয়াছিল সেই সিঁড়ি দিয়া পলকের মধ্যে বাড়ির দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।
পাণ্ডেজি মৃদুকণ্ঠে হাসিলেন।
‘বংশীধরের বিক্রম বোঝা গেছে। —চলুন।’
সাধুবাবার নিকট উপস্থিত হইলাম। চারিদিকের ঝাঁকড়া গাছ স্থানটিকে প্রায় অন্ধকার করিয়া তুলিয়াছে। জ্বলন্ত ধুনির সম্মুখে বাবাজী বসিয়া আছেন। আমাদের দেখিয়া নীরব অথচ ইঙ্গিতপূর্ণ হাস্যে তাঁহার মুখ ভরিয়া উঠিল, তিনি হাতের ইশারায় আমাদের বসিতে বলিলেন।
পাণ্ডেজি তাঁহার সহিত কথা আরম্ভ করিলেন। বলা বাহুল্য, হিন্দীতেই কথাবার্তা হইল। পাণ্ডেজির গায়ে পুলিসের খাকি কামিজ ছিল, সাধুবাবা তাঁহার সহিত সমধিক আগ্রহে কথা বলিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ সাধারণভাবে কথা হইল। সন্ন্যাস জীবনের মাহাত্ম্য এবং গাৰ্হস্থ্য জীবনের পঙ্কিলতা সম্বন্ধে আমরা সকলেই একমত হইলাম। হৃষ্ট বাবাজী বুলি হইতে গাঁজা বাহির করিয়া সাজিবার উপক্ৰম করিলেন।
পাণ্ডেজি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এখানে গাঁজা কোথায় পান। বাবা?’
বাবাজী উর্ধের্ব কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন, ‘পরমাৎমা মিলিয়ে দেন বেটা।’
চিমটা দিয়া ধুনি হইতে একখণ্ড অঙ্গার তুলিয়া বাবাজী কলিকার মাথায় রাখিলেন। এই সময়ে তাঁহার চিমটাটি ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলম। সাধুরা যে নিৰ্ভয়ে বনে-বাদাড়ে বাস করেন তাহা নিতান্ত নিরন্ত্রভাবে নয়। চিমটা ভালভাবে ব্যবহার করিতে জানিলে ইহার দ্বারা বোধ করি বাঘ মারা যায়। আবার তাহার সূচাগ্রতীক্ষা প্রান্ত দু’টির সাহায্যে ক্ষুদ্র অঙ্গর খণ্ডও যে তুলিয়া লওয়া যায় তাহা তো স্বচক্ষেই দেখিলাম। সাধুরা এই একটি মাত্র লৌহাস্ত্ৰ দিয়া নানা কাৰ্য সাধন করিয়া থাকেন।
যা হোক, বাবাজী গাঁজার কলিকায় দম দিলেন। তাঁহার গ্ৰীবা এবং রাগের শিরা-উপশিরা ফুলিয়া উঠিল। দীর্ঘ একমিনিটব্যাপী দম দিয়া বাবাজী নিঃশেষিত কলিকাটি উপুড় করিয়া দিলেন।
তারপর ধোঁয়া ছাড়িবার পালা। এ কার্যটি বাবাজী প্ৰায় তিন মিনিট ধরিয়া করিলেন; দাড়ি-গোঁফের ভিতর হইতে মন্দ মন্দ ধূম বাহির হইয়া বাতাসকে সুরভিত করিয়া তুলিল।
বাবাজী বলিলেন, ‘বম! বম শঙ্কর’
এই সময় পায়ের শব্দে পিছন ফিরিয়া দেখিলাম, একটি লোক আসিতেছে। লোকটি আমাদের দেখিতে পাইয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। তখন চিনিলাম, রামকিশোরবাবু! তিনি আমাদের চিনিতে পারিয়া স্থলিত স্বরে বলিলেন, ‘ও-আপনারা–!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন।’
রামকিশোর ঈষৎ নিরাশ কষ্ঠে বলিলেন, ‘না, আপনারা সাধুজীর সঙ্গে কথা বলছেন বলুন। আমি কেবল দর্শন করতে এসেছিলাম।’ জোড়হস্তে সাধুকে প্ৰণাম করিয়া তিনি প্ৰস্থান করিলেন।
সাধুর দিকে ফিরিয়া দেখিলাম তাঁহার মুখে সেই বিচিত্ৰ হাসি। হাসিটিকে বিশ্লেষণ করিলে কতখানি আধ্যাত্মিকতা এবং কতখানি নষ্টামি পাওয়া যায় তাহা বলা শক্ত। সম্ভবত সমান সমান।
এইবার ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাধুবাবা, আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন। সেদিন একটি লোক এখানে সর্পাঘাতে মারা গেছে, জানেন কি?’
সাধু বলিলেন, ‘জানতা হ্যায়। হম ক্যা নাহি জনতা!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা, সে রাত্রে কেউ দুর্গে গিয়েছিল কি না। আপনি দেখেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, দেখা।’
বাবাজীর মুখে আবার সেই আধ্যাত্মিক নষ্টামিভরা হাসি দেখা গেল। ব্যোমকেশ সাগ্রহে আবার তাঁহাকে প্রশ্ন করিতে যাইতেছিল, আবার পিছন দিকে পায়ের শব্দ হইল। আমরা ঘাড় ফিরাইলাম, বাবাজীও প্রখর চক্ষে সেই দিকে চাহিলেন। কিন্তু আগন্তুক কেহ আসিল না; হয়তো আমাদের উপস্থিতি জানিতে পারিয়া দূর হইতেই ফিরিয়া গেল।
ব্যোমকেশ আবার বাবাজীকে প্রশ্ন করিতে উদ্যত হইলে তিনি ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া পরিষ্কার বাঙলায় বলিলেন, ‘এখন নয়। রাত বারোটার সময় এস, তখন বলব।’
আমি অবাক হইয়া চাহিলাম। ব্যোমকেশ কিন্তু চট করিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, ‘আচ্ছা বাবা, তাই আসিব। ওঠ অজিত।’
বৃক্ষ-বাটিকার বাহিরে আসিয়া দেখিলাম রাত্রি হইয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ ও পাণ্ডেজি চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন, কিন্তু সন্দেহভাজন কাহাকেও দেখা গেল না।
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আমি আজ এখান থেকেই ফিরি। রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারলে হত। কিন্তু উপায় নেই। কাল সকালেই আসব।’
পাণ্ডেজি চলিয়া গেলেন।
দুর্গে ফিরিতে ফিরিতে প্রশ্ন করিলম, ‘সাধুবাবা বাঙালী?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাক্ষাৎ বাঙালী।’
দুৰ্গে ফিরিয়া ঘড়ি দেখিলাম, সাতটা বাজিয়াছে। মুক্ত আকাশের তলে চেয়ার পাতিয়া বসিলাম।
সাধুবাবা নিশ্চয় কিছু জানে। কী জানে? সে রাত্রে ঈশানবাবুর হত্যাকারীকে দুর্গে প্রবেশ করিতে দেখিয়ছিল? বৃক্ষ-বাটিকা হইতে দুর্গে উঠিবার সিঁড়ি দেখা যায় না; বিশেষত অন্ধকার রাত্রে। তবে কি সাধুবাবা গভীর রাত্রে সিঁড়ির আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়?…তাহার চিমটা কিন্তু সামান্য অস্ত্র নয়–ঐ চিমটার আগায় বিষ মাখাইয়া যদি–
ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলম; সে কেবল গলার মধ্যে চাপা কাশির মত শব্দ করিল।
রাত্রি দশটার মধ্যে আহার সমাধা করিয়া আমরা আবার বাহিরে গিয়া বসিলাম। এখনও দুঘন্টা জাগিয়া থাকিতে হইবে। সীতারাম আহার সম্পন্ন করিয়া আড়ালে গেল; বোধ করি দু’ একটা বিড়ি টানবে। লণ্ঠনটা ঘরের কোণে কমানো আছে।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটার দিকে চলিয়াছে। মনের উত্তেজনা সত্ত্বেও ক্রমাগত হাই উঠিতেছে–
‘ব্যোমকেশবাবু!’
চাপা গলার শব্দে চমকিয়া জড়তা কাটিয়া গেল। দেখিলাম, অদূরে ছায়ার মত একটি মূর্তি দাঁড়াইয়া আছে। ব্যোমকেশ উঠিয়া বলিল, রমাপতি! এস।’
রমাপতিকে লইয়া আমরা ঘরের মধ্যে গেলাম। ব্যোমকেশ আলো বাড়াইয়া দিয়া তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল, ‘এবেলা কিছু খাওয়া হয়নি দেখছি।–সীতারাম!’
সীতারাম পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকটা ডিম ভাজিয়া আনিয়া রমাপতির সম্মুখে রাখিল। রমাপতি দ্বিরুক্তি না করিয়া খাইতে আরম্ভ করিল। তাহার মুখ শুষ্ক্্, চোখ বসিয়া গিয়াছে; গায়ের হাফ-শার্ট স্থানে স্থানে ছিঁড়িয়া গিয়াছে, পায়ে জুতা নাই। খাইতে খাইতে বলিল, ‘সব শুনেছেন তাহলে? কার কাছে শুনলেন?’
‘তুলসীর কাছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
‘জঙ্গলে। তারপর দুর্গের পিছনে।’
‘বেশি মারধর করেছে নাকি?’
রমাপতি পিঠের কামিজ তুলিয়া দেখাইল, দাগড়া দাগড়া লাল দাগ ফুটিয়া আছে। ব্যোমকেশের মুখ শক্ত হইয়া উঠিল।
‘বংশীধর?’
রমাপতি ঘাড় নাড়িল।
‘শহরে চলে গেলে না কেন?’
রমাপতি উত্তর দিল না, নীরবে খাইতে লাগিল।
‘এখানে থেকে আর তোমার লাভ কি?’
রমাপতি অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘তুলসী—’
‘তুলসীকে তুমি ভালবাসো?’
রমাপতি একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, ‘ওকে সবাই যন্ত্রণা দেয়, ঘরে বন্ধ করে রাখে, কেউ ভালবাসে না। আমি না থাকলে ও মরে যাবে।’
আহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ তাহাকে নিজের বিছানা দেখাইয়া বলিল, ‘শোও।’
রমাপতি ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিয়া শয়ন করিল। ব্যোমকেশ দীর্ঘকাল তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল, ‘রমাপতি, ঈশানবাবুকে কে খুন করেছে তুমি জানো?’
‘না, কে খুন করেছে জানি না। তবে খুন করেছে।’
‘হরিপ্রিয়াকে কে খুন করেছিল জানো?’
‘না, দিদি বলবার চেষ্টা করেছিল–কিন্তু বলতে পারেনি।’
‘বংশীধরের বৌ কোন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছিল জানো?’
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া রমাপতি-বলিল, ‘জানি না, কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। দিদি তাকে দেখতে পারত না, দিদির মনটা বড় কুচুটে ছিল। বোধ হয় মুখোশ পরে তাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিল–’
‘মুখোশ?
‘দিদির একটা জাপানী মুখোশ ছিল। ঐ ঘটনার পরদিন মুখোশটা জঙ্গলের কিনারায় কুড়িয়ে পেলাম; বোধ হয়। হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়েছিল। আমি সেটা এনে দিদিকে দেখলাম, দিদি। আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললে।’
‘বংশীধর মুখোশের কথা জানে?’
‘আমি কিছু বলিনি।’
‘সাধুবাবাকে নিশ্চয় দেখেছি। কি মনে হয়?’
‘আমার ভক্তি হয় না। কিন্তু কর্তা খুব মান্য করেন। বাড়ি থেকে সিধে যায়।’
‘ঈশানবাবু কোনদিন সাধুবাবা সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলেছিলেন?’
‘না। দর্শন করতেও যাননি। উনি সাধু-সন্ন্যাসীর ওপর চটা ছিলেন।’
ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘বারোটা বাজে। রমাপতি, তুমি ঘুমোও আমরা একটু চক্ষু বিস্ফোরিত করিয়া রমাপতি বলিল, ‘কোথায়?
‘বেশি দূর নয়, শীগগিরই ফিরব। এস অজিত।’
বড় টৰ্চটা লইয়া আমরা বাহির হইলাম।
রামকিশোরবাবুর বাড়ি নিষ্প্রদীপ। দেউড়ির পাশ দিয়া যাইতে যাইতে শুনিলাম বুলাকিলাল সগর্জনে নাক ডাকাইতেছে।
বৃক্ষ-বাটিকায় গাঢ় অন্ধকার, কেবল ভস্মাচ্ছাদিত ধুনি হইতে নিরুদ্ধ প্ৰভা বাহির হইতেছে। সাধুবাবা ধুনির পাশে শুইয়া আছেন; শয়নের ভঙ্গীটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।
ব্যোমকেশ তাঁহার মুখের উপর তীব্র আলো ফেলিল, বাবাজী। কিন্তু জাগিলেন না। ব্যোমকেশ তখন তাঁহার গায়ে হাত দিয়া নাড়া দিল এবং সশব্দে নিশ্বাস টানিয়া বলিল, ‘অ্যাঁ—?’
টর্চের আলো বাবাজীর সর্বাঙ্গ লেহন করিয়া পায়ের উপর স্থির হইল। দেখা গেল গোড়ালির উপরিভাগে সাপের দাঁতের দু’টি দাগ।