পরিশিষ্ট

দুর্গরহস্য – ১.১ (পূর্বখণ্ড)

পূর্বখণ্ড

ব্যোমকেশের শরীর সারাইবার জন্য সাঁওতাল পরগণার যে শহরে হাওয়া বদলাইতে গিয়াছিলাম‌, বছর না ঘুরিতেই যে আবার সেখানে যাইতে হইবে‌, তাহা ভাবি নাই। এবার কিন্তু স্বাস্থ্যের অন্বেষণে নয়‌, পুরন্দর পাণ্ডে মহাশয় যে নূতন শিকারের সন্ধান দিয়াছিলেন তাঁহারই অন্বেষণে ব্যোমকেশ ও আমি বাহির হইয়াছিলাম।

প্ৰথমবার যখন এ শহরে যাই‌, তখন এখানকার অনেকগুলি বাঙালীর সহিত পরিচয় হইয়াছিল‌, কিন্তু শহরের বাহিরেও যে একটি ধনী বাঙালী পরিবার বাস করেন‌, তাহা কেহ বলে নাই। এই পরিবারটিকে লইয়া এই বিচিত্ৰ কাহিনী। সুতরাং তাহার কথাই সবাগ্রে বলিব। সব কথা অবশ্য একসঙ্গে জানিতে পারি নাই‌, ছাড়া-ছাড়া ভাবে কয়েকজনের মুখে শুনিলাম। পাঠকের সুবিধার জন্য আরম্ভেই সেগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজাইয়া দিলাম।

শহরের দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ জংশন হইতে বিপরীত মুখে প্রায় ছয় মাইল পর্যন্ত একটি রাস্তা গিয়াছে। রাস্তাটি বহু পুরাতন; বাদশাহী আমলের। বড় বড় চৌকাশ পাথর দিয়া আচ্ছাদিত; পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ঘাস ও আগাছা জন্মিয়াছে‌, কিন্তু তবু রাস্তার উপর দিয়া মোটর চালানো যায়। দুই পাশের শিলাকৰ্কশ বন্ধুরতাকে দ্বিধা ভিন্ন করিয়া পথ এখনও নিজের কঠিন অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে।

এই পথের সর্পিল গতি যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেখানে পাশাপাশি দু’টি ক্ষুদ্র গিরিচূড়া। কালিদাসের বর্ণনা মনে পড়ে ‘মধ্যে শ্যামঃ স্তন ইব ভুবঃ।’ বেশি উঁচু নয়‌, কিন্তু দু’টি চুড়ার মাঝখানে খাঁজ পড়িয়াছে। উপমা কালিদাসস্য বাদ দিলেও দৃশ্যটি লোভনীয়।

চুড়া দু’টি নিরাভরণ নয়। একটির মাথায় প্রাচীন কালের এক দুর্গের ভগ্নাবশেষ; অন্যটির শীর্ষে আধুনিক কালের চুনকাম করা বাড়ি। বাড়ি এবং দুর্গের মালিক শ্রীরামকিশোর সিংহ সপরিবারে এই স্থানে বাস করেন।

এইখানে প্রাচীন দুর্গ ও তাহার আধুনিক মালিকের কিছু পরিচয় আবশ্যক। নবাব আলিবর্দীর আমলে জানকীরাম নামক জনৈক দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ নবাবের বিশেষ প্রিয়পাত্ৰ হইয়া উঠিয়াছিলেন। ইনি রাজা জানকীরাম খেতাব পাইয়া কিছুকাল সুবা বিহার শাসন করিয়াছিলেন এবং প্রভুত ধনসম্পত্তি অর্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু দেশে তখন ক্রান্তিকাল আরম্ভ হইয়াছে; ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল বাদশাহী ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে; দুর্দম মারাঠা বগী বারম্বার বাঙলা বিহারে হানা দিয়া চারিদিক ছারখার করিয়া দিতেছে; ইংরেজ বণিক বাণিজ্যের খোলস ছাড়িয়া রাজদণ্ডের দিকে হাত বাড়াইতেছে। দেশজোড়া অশান্তি; রাজা প্ৰজা ধনী দরিদ্র কাহারও চিত্তে সুখ নাই। রাজা জানকীরাম কুশাগ্ৰবুদ্ধি লোক ছিলেন; তিনি এই দুৰ্গম গিরি-সঙ্কটের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র দুৰ্গ তৈয়ার করাইয়া তাঁহার বিপুল ধনসম্পত্তি এবং পরিবারবর্গকে এইখানে রাখিলেন।

তারপর রাষ্ট্রবিপ্লবের প্রবল প্লাবনে অনেক কিছুই ভাসিয়া গেল। কিন্তু জানকীরামের এই নিভৃত দুর্গ নিরাপদে রহিল। তাঁহার বংশধরগণ পুরুষানুক্রমে এখানে বাস করিতে লাগিল।

পলাশীর যুদ্ধের পর আরও একশত বছর কাটিয়া গেল।

কোম্পানীর শাসনে দেশ অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়াছে। জানকীরামের দুর্গে তাঁহার অধস্তন চতুর্থ ও পঞ্চম পুরুষ বিদ্যমান-রাজারাম ও তৎপুত্র জয়রাম। রাজারাম বয়স্থ ব্যক্তি‌, পুত্র জয়রাম যুবক। পিতৃপুরুষের সঞ্চিত অর্থ ও পারিপার্শ্বিক জমিদারীর আয় হইতে স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা চলিতেছে। সঞ্চিত অর্থ এই কয় পুরুষে হ্রাসপ্রাপ্ত না হইয়া আরও বাড়িয়াছে। জানকীরামের বংশধরদের স্বভাব ছিল টাকা হাতে আসিলেই তাহা স্বর্ণে রূপান্তরিত করিয়া রাখা; এইভাবে রাশি রাশি মোহর আসরফি তৈজস সঞ্চিত হইয়া ছিল! কাহারও কোনও প্রকার বদখেয়াল ছিল না। এই জঙ্গলের মধ্যে বিলাস-ব্যসনের অবকাশ কোথায়?

হঠাৎ দেশে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সিপাহী বিদ্রোহের আগুন কেবল নগরগুলির মধ্যেই আবদ্ধ রহিল না। দাবানলের মত বনে জঙ্গলেও প্রসারিত হইল।

রাজারাম সংসারের কতা‌, তিনি উদ্বিগ্ন হইলেন। চারিদিকে লুঠতরাজ; কোথাও ইংরেজ দলের সিপাহীরা লুঠ করিতেছে‌, কোথাও বিদ্রোহী সিপাহীরা লুঠ করিতেছে। রাজারাম খবর পাইলেন একদল সিপাহী এইদিকে আসিতেছে। তিনি সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্ৰস্তুত হইলেন।

কিন্তু সম্পত্তি রক্ষা করিবেন কী উপায়ে? শতবর্ষের পুরাতন দুর্গটি সুশিক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্ৰধারী শত্রুর আক্রমণ রোধ করিতে সমর্থনয়। দুর্গের জীৰ্ণ তোরণদ্বার একটি গোলার আঘাতেই উড়িয়া যাইবে। দুর্গে একটি বড় কামান আছে বটে‌, কিন্তু দীর্ঘকাল অব্যবহারের ফলে উহা মরিচা পড়িয়া অকৰ্মণ্য হইয়াছে‌, উহার গোড়ার দিকের লৌহকপাট এমন জাম হইয়া গিয়াছে যে খোলা যায়। না। তাছাড়া যে-কয়টি গাদা বন্দুক আছে‌, তাহার দ্বারা জঙ্গলে হরিণ শিকার বা চোর তাড়ানো? চলিতে পারে‌, লুণ্ঠন-লোলুপ সিপাহীর দলকে ঠেকাইয়া রাখা একেবারেই অসম্ভব।

রাজারাম উপযুক্ত পুত্রের সহিত পরামর্শ করিয়া পরিবারস্থ নারী ও শিশুদের স্থানান্তরিত করিবার ব্যবস্থা করিলেন। দুর্গ হইতে কয়েক ক্রোশ দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি সাঁওতাল পল্লী ছিল‌, স্ত্রী পুত্র-বধূ ও দুই তিনটি নাতি-নাতিনীকে সেইখানে পঠাইয়া দিলেন। দুর্গের সমস্ত ভৃত্য ও কর্মচারী সেই সঙ্গে গেল; কেবল পুত্ৰ জয়রাম সহ রাজারাম দুর্গে রহিলেন। বিদায়কালে রাজারাম গৃহিণীর অঞ্চলে কয়েকটি মোহর বাঁধিয়া দিলেন। বেশি মোহর দিতে সাহস হইল না‌, কি জানি বেশি সোনার লোভে পরিচরেরাই যদি বেইমানি করে। তারপর তাহারা প্ৰস্থান করিলে পিতাপুত্র মিলিয়া সঞ্চিত সোনা লুকাইতে প্রবৃত্ত হইলেন।

তিন দিন পরে ফিরিঙ্গী নায়কের অধীনে একদল সিপাহী আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজারামের বোধ হয় ইচ্ছা ছিল‌, সোনা দানা লুকাইয়া রাখিয়া নিজেও পুত্রকে লইয়া দুর্গ হইতে অন্তহিঁত হইবেন; কিন্তু তাঁহারা পলাইতে পারিলেন না। সিপাহীরা অতর্কিতে উপস্থিত হইয়া নির্বিবাদে দুর্গে প্রবেশ করিল।

তারপর দুর্গের মধ্যে কি হইল কেহ জানে না। দুই দিন পরে সিপাহীরা চলিয়া গেল। রাজারাম জয়রামকে কিন্তু ইহলোকে আর কেহ দেখিল না। শূন্য দুর্গ পড়িয়া রহিল।

ক্ৰমে দেশ শাস্ত হইল। কয়েক মাস পরে রাজারামের পরিবার ও অনুচরগণ ফিরিয়া আসিয়া দেখিল দুর্গের পাথরগুলি ছাড়া আর কিছুই নাই; তুলিয়া লইয়া যাইবার মত যাহা কিছু ছিল সিপাহীরা লইয়া গিয়াছে। দুর্গের স্থানে স্থানে‌, এমন কি ঘরের মেঝেয় সিপাহীরা পাথর তুলিয়া গর্ত খুঁড়িয়াছে; বোধকরি ভূ-প্রোথিত ধনরত্নের সন্ধান করিয়াছে। কিছু পাইয়াছে কিনা অনুমান করা যায় না‌, কারণ রাজারাম কোথায় ধনরত্ন লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন তাহা কেবল তিনি এবং জয়রাম জানিতেন। হয়তো সিপাহীরা সব কিছুই লুটিয়া লইয়া গিয়াছে; হয়তো কিছুই পায় নাই‌, তাই পিতাপুত্রকে হত্যা করিয়া চলিয়া গিয়াছে।

অসহায়া দুইটি নারী কয়েকটি শিশুকে লইয়া কিছুকাল দুর্গে রহিল‌, কিন্তু যে দুর্গ একদিন গৃহ ছিল তাহা এখন শ্মশান হইয়া উঠিয়াছে। ক্ৰমে ভৃত্য ও কর্মচারীরা একে একে খসিয়া পড়িতে লাগিল; কারণ সংসারযাত্রা নিবাহের জন্য শুধু গৃহই যথেষ্ট নয়‌, অন্নবস্ত্রেরও প্রয়োজন। অবশেষে একদিন দুইটি বিধবা শিশুগুলির হাত ধরিয়া দুৰ্গ হইতে বাহির হইয়া পড়িল। তাহারা কোথায় গিয়া আশ্রয় পাইল তাহার কোনও ইতিহাস নাই। সম্ভবত বাংলা দেশে কোনও দূর আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় পাইল। পরিত্যক্ত দুর্গ শৃগালের বাসভূমি হইল।

অতঃপর প্রায় ষাট বছর এই বংশের ইতিহাস অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়? দশকে বংশের দুইটি যুবক আবার মাথা তুলিলেন। রামবিনোদ ও রামকিশোর সিংহ দুই ভাই। দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁহারা মানুষ হইয়াছিলেন‌, কিন্তু বংশের ঐতিহ্য ভোলেন নাই। দুই ভাই ব্যবসা আরম্ভ করিলেন‌, এতদিন পরে কমলা আবার তাঁহাদের প্রতি মুখ তুলিয়া চাহিলেন। ১ প্রথমে ঘূতের‌, পরে লোহার কারবার করিয়া তাঁহারা লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিলেন।

বড় ভাই রামবিনোদ। কিন্তু বেশিদিন বাঁচিলেন না। যৌবন কালেই হঠাৎ রহস্যময়ভাবে তাঁহার মৃত্যু হইল। রামকিশোর একাই ব্যবসা চালাইলেন এবং আরও অর্থ অর্জন করিলেন।

দিন কাটিতে লাগিল। রামকিশোর বিবাহ করিলেন‌, তাঁহার পুত্রকন্যা জন্মিল। তারপর বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শেষে রামকিশোর প্রাচীন কালের পৈতৃক সম্পত্তি পুনরায় ক্রয় করিয়া দুর্গের পাশের দ্বিতীয় চুড়ায় নূতন গৃহ নিমণ করাইলেন‌, আশেপাশে বহু জমিদারী কিনিলেন এবং সপরিবারে শৈল-গৃহে বাস করিতে লাগিলেন। দুর্গটিকেও পূর্ব গৌরবের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ অল্প-বিস্তর মেরামত করানো হইল; কিন্তু তাহা আগের মতাই অব্যবহৃত পড়িয়া রহিল।