মনটা তোমার খারাপ ক’রে দিলাম? না; আজকের দিনে আমার এ-রকম কোন দুরভিসন্ধি নেই। তাহলে তোমায় অন্য গোটা দুই অভিজ্ঞতার কথা বলি; coincidence বা যোগাযোগের কথায় মনে পড়ে গেল। ঠিক এ ধরণের জিনিস না হলেও বেশ কৌতুকজনক (অবশ্য আমি ব্যাপারটুকুর কৌতুকের দিকটা ধরেই বলছি—pure coincidence-এর দিকটা)। তাতে ছিল অন্য ধরণের অনুভূতি—খানিকটা আত্মপ্রসাদের; ভাবটা গোটা তিন ইংরিজী কথাতে বোধ হয় আরও ভালো ক’রে ধরা পড়ে—ঠিক যাকে বলে, flattering to one’s vanity.
করুণ নয়, ব’লেই তোমায় বলছিও; নয়তো আত্মপ্রসাদের কাহিনী আত্মগতই রাখা নিয়ম আমার; তুমি শুধু এই ধরণের যোগাযোগগুনো কিরকম অদ্ভুতভাবে ঘটে লক্ষ্য করে যেও।
সেবারেও বেরিয়েছি বেড়াতে। দক্ষিণ দিকটার সঙ্গে তখন আমার নতুন পরিচয় হয়েছে আরম্ভ, কোথায় যাব কোথায় যাব করতে করতে বজবজের একটা গাড়িতে গিয়ে বসেছি থার্ড ক্লাসেই। যোগাযোগের সূত্রটা এইখান থেকেই হোলো আরম্ভ, কেননা যতদূর মনে পড়ছে, টিকিট ছিল আমার ইন্টার ক্লাসের। কিছু একটা খেয়াল হয়ে থাকবে, কিম্বা থার্ড ক্লাসের গাড়িটাই সামনে পেয়ে গিয়ে থাকব, উঠে পড়েছিলাম। জায়গাটা পাওয়া গেল ভেতরের দিকে, বেঞ্চের মাঝখানে
ঠিক ভিড় না হোক, ভর্তি ছিল গাড়িটা, কিন্তু গোটা দুই-তিন স্টেশন পরে একরকম খালিই হয়ে গেল। বেঞ্চের মাঝখানে আমার পোষাল না; দেখতে হবে লাইনের পর থেকে একেবারে দূরের আকাশ-রেখা পর্যন্ত, মাঝখানে বসে থাকলে তা হয় না। আমার কামরাটিতে ধারের চারটি কোণই কিন্তু চারজনের দখলে। সামনের কামরাটিতেও তাই; চুপ করে বসে থাকতেই হোল।
পরের স্টেশনে সামনের কামরার ডান দিকের একটা কোণ খালি হোল, লোকও আর উঠল না, আমি প্লাটফর্মে নেমে গিয়ে ও দরজা দিয়ে উঠে সেখানটায় বসলাম।
গাড়ি যখন ছেড়ে দিলে, বেশ খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। আমার সামনের লোকটি বাইরের দিকে ঘুরে ব’সে ছিল, রোগা গোছেরই কিন্তু ফিরে চাইতে তার চেহারা দেখে মনে হোল যেন, খুব খারাপ কোনও অসুখে ভুগছে। বেশই অস্বস্তিতে পড়লাম এবং এই ধাক্কাতে আমায় আর একটা কামরা এগিয়ে যেতে হোল। সেখানেও ধারের দিকে মাত্র একটা জায়গা খালি আছে, এটা যেমন ছিল ডাইনে, ওটা একবারে বাঁদিক ঘেঁষে। অবশ্য তখন আর জায়গা বাছাই করবার উৎসাহ নেই—একটা বয়স্থ লোক ক্রমাগত বেঞ্চ টপকে চলেছি এগিয়ে, একটু লজ্জিতও হয়ে পড়েছি, কিন্তু যখন পাওয়াই গেল খালি, তখন সেইখানটিতেই গিয়ে বসলাম।
এখানে আমার সামনেই একটি ভদ্রলোক, বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ মনে হয়, খুব নিবিষ্ট মনে একখানি বই পড়ছেন আর ফিক্ ফিক্ করে নিজের মনেই হাসছেন।
কৌতূহল হতে একটু গলা তুলে দেখি, আমার ‘বরযাত্রী’ বইটা; বিয়ের আসরে গণশা যেখানে ত্রিলোচনকে বাসরের জন্য গানের অন্তরাটা মক্স করাচ্ছে— “চিত মোর ব্যা-ব্যা-ব্যাকুল হোয়।” ছবিটাও রয়েছে খোলা।
আত্মপ্রসাদের কথা বাদ দিলেও একটা অদ্ভুত রকমের সুড়সুড়ি দেয় না মনে? ঠিক এই মুহূর্তটিতে এই যোগাযোগটুকু ঘটবে তাই আমি তিন শ’ মাইল থেকে এইমুখো হয়েছি এক সময়, নিতান্ত অহেতুকভাবেই বিকেলবেলা একটু বাইরে থেকে বেরিয়ে আসবার ইচ্ছে হোল, ইন্টার ক্লাসের টিকিট নিয়ে থার্ড ক্লাসে উঠে পড়লাম, তাও সেই যোগাযোগটুকু হবে বলে, যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু পূর্ণ করতে হোল ঐ বেঞ্চ টপ্কে টপকে।—কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঐ পরিণতিটুকুর দিকে। ব্যাপারটা কিছু নয় অবশ্য একদিক দিয়ে, আবার অন্য দিক দিয়ে বেশ খানিকটা তো।…মানুষের একেবারে কৈবল্যপ্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত vanity যখন থাকবেই তখন অস্বীকার করি কেন যে ঘটনাটুকু সত্যি ছিল flattering to my vanity. সভা ক’রে ক’রে মানপত্র দেওয়ার চেয়ে, নিতান্তই নিঃসন্দিগ্ধ এক পাঠকের ঠোঁটের ঐ অল্প একটু একটু হাসির যে কী মূল্য তা এক যে লিখেছে সে-ই তো বুঝবে।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হয় আর একখানি বই নিয়ে, সেও নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে নিতান্ত অপরিচিত জায়গায় লেখকে-পাঠকে একেবারে সামনাসামনি। কিন্তু শুধু সামনাসামনি হওয়াটাই বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে যে-ভাবে সামনাসামনি হওয়া গেল। আরও একবার এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার; প্রত্যেকবারেই দেখেছি, কে যেন অলক্ষ্যে থেকে আমায় ঐ যোগাযোগটুকুর দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটা হয় বর্ধমানের কাছে। বর্ধমান থেকে মাইল আষ্টেক উত্তরে সাঁকো বলে একটা জায়গা আছে গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের ওপর। আমার বন্ধু তুলসীবাবু তখন হেডমাস্টার স্কুলে, আমি হয়েছি তাঁর অতিথি। আরও কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে বাসে করে আমরা উত্তরে গল্সীতে রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (River Research Institute) দেখতে যাব। কিসের জন্যে খুব ভিড় যাচ্ছে, কয়েকটা বাস ছেড়ে দিতে হোল বলে মনটা খিঁচড়ে আসছে। কুঁচকি-কণ্ঠা ঠেসে চলেছে, তাদেরও গরজ নেই। শেষে একটার একটু দয়া হোল, কিন্তু সবাই ওঠা পর্যন্ত টেকল না দয়াটুকু, দিলে ছেড়ে। কাজেই দু’দশ গজ যেতে না যেতে, যাঁরা উঠেছিলেন তাঁদের টুপ টুপ করে নেমে পড়তে হোল। এটাতে আর জনদুয়ের সঙ্গে আমারও ওঠা হয়নি, সুতরাং আবার গোটা দুই বাদ দিয়ে যখন একটা পাওয়া গেল, বোধ হয় স্মার্ট না হওয়ার বদনামটা ঘোচাবার জন্যে আমিই চাপ ভিড় ঠেলে আগে পড়লাম উঠে। তারপর বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে চেঁচামেচি শুনে ভিড়ের মধ্যে থেকে মাথাটা গলিয়ে যখন দেখবার অবসর হোল, দেখি আমি ছাড়া আর কেউই স্মার্ট হতে পারে নি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফিরে যাবার জন্যে প্রবলবেগে হাত নাড়ছে। মনের অবস্থাটা বুঝতে পার। খানিকটা ‘হ্যাঁ-না’ করে শেষ পর্যন্ত যাওয়া বন্ধ ক’রে দেওয়াই ঠিক হোল সেদিন। তারপর বাসায় ফিরে যাব এমন সময় আর একটি বাস এসে উপস্থিত হোল। দিব্যি খালি, গিয়ে সবাই উঠে বসলাম দিব্যি গোছগাছ করে। এখানেই আমার পাঠক আমার জন্যে ছিলেন অপেক্ষায়; হাতে… থাক, বইয়ের বিজ্ঞাপনের মতো শোনালো আবার।
কিন্তু দোহাই, সেরকম কোন দুষ্ট উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি এজন্যেই প্রসঙ্গটার অবতারণা করেছি যে সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে একটা প্রশ্নের আকারে দেখা দেয়। ঠিক যেন মনে হয় না কি যে নেপথ্যে কেউ রয়েছে, যে কলকাঠি নেড়ে এইসব ধরণের ব্যাপারগুনো ঘটিয়ে যাচ্ছে? আমার তো মনে হয়। আমার তো হয়ই মনে যে, এগুনো যেন জীবনের গবাক্ষপথ, যার মধ্যে দিয়ে আমরা চকিতে সেই নেপথ্যবাসীর আঙুলের ডগাগুলি এক একবার ফেলি দেখে। আমার বেলায় সে আবার যেন একটু রহস্যপ্রবণ হয়ে ওঠে, কেননা তিনবারেই দেখেছি, বাধা দিয়ে মনের অবস্থা যখন বেশ সঙ্গীণ করে এনেছে তখনই দিয়েছে এই পুরস্কারটুকু হাতে তুলে। যাই বল না কেন, তোমাদের জ্ঞাত বিজ্ঞানের জোরে, সত্যিই বড় আশ্চর্য। এগুনোর সম্বন্ধে মীমাংসটা এই নয় যে কেন হবে না? বরং এগুনোর সম্বন্ধে প্রশ্নটা এই যে, কেন হবে? আর, সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে ওঠে নি এখনও।
হচ্ছে না convinced বোধ হয়। হয়তো বলবে কি আর এমন মহামারী ব্যাপার- নিতান্তই চান্স, সেই চান্সেরই একটা দিক যার সম্বন্ধে Aldous Huxley নাকি বলেছেন, গোটা ছয় বানরের হাতে কলম দিয়ে যদি হিজিবিজি কাটতে দেওয়া হয় তো তারা সুদূর ভবিষ্যতে কোন সময় শেকপিয়ারের সনেট লিখে ফেলবে গোটাকয়েক।
যদি এই জাতীয়ই মত হয় তোমার তো এ গরীবের মতটাও বলি—অন্ধ চান্সকে এত বড় প্রতিষ্ঠা দেওয়া সত্যিই মর্কটকে শেকস্পিয়ারের আসনে বসানো।
তোমায় তাহলে আর একটা উহাদরণ দিই—আমার এক বন্ধুর নিজের অভিজ্ঞতার কথা, তাঁর নিজেরই মুখেই শোনা
একদিন রাত্রের কথা, তাঁর এক অন্তরঙ্গ বন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি এসেছিলেন একটু রাত করেই, তার ওপর আমার বন্ধুটি আবার একটু বেশি মজলিসী, সঙ্গী পেলে শীঘ্র ছাড়েন না; গল্পগুজবে রাত এগিয়েই চলল। যখন এগারোটা হয়ে গেল তখন উঠতে হোল এবং বিদায় দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেবার জন্য বন্ধুও নেমে এলেন; ওঁরা দোতলায় ব’সে গল্পগুজব করছিলেন। গোল্পে লোক, সদর দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা গল্প হোল তারপর নেমেও পড়লেন গলিতে। কলকাতার একটা গলি, খানিকটা গিয়েই সদর রাস্তা; অন্যমনস্ক হয়ে গল্পের জের টানতে টানতে সেখান পর্যন্ত এসে পড়েছেন। এখানেও খানিকটা গল্প হোল, এবং তারপর আবার যে কখন দুজনে গল্পে মশগুল হয়ে চ’লতে আরম্ভ করেছেন হুঁশ নেই। হুঁশ যখন হোল তখন টের পেলেন বাড়ি ছেড়ে অনেকটা এসে পড়েছেন, এবং তার চেয়েও যা বড় কথা, অন্যমনস্ক হয়ে এমন পথ ধরে এসেছেন যেটা ঠিক ওর বন্ধুর বাড়িতে যাবার পথ নয়; যাওয়া যায়, তবে বেশ খানিকটা ঘুর পড়ে। দুজনে একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি ক’রে হাসলেন, মাঝ কলকাতায় নিশিতে পেলে নাকি!! ওদিকে সদর দরজার শিকলটাও তুলে দিয়ে আসা হয়নি।
ফিরবেন, পকেটের মধ্যে হাতটা পড়তে হাতে একটা চিঠি ঠেকল, মনে পড়ল—ঠিক তো, সমস্ত দিনে ওটা পোস্ট করা হয়নি। কাছে একটা লেটার-বক্স আছে, ঠিক যে-গলিটা ধ’রে যাচ্ছেন তার ওপর নয়, আর একটা গলি বেরিয়ে গেছে, তার ভিতর দিকে খানিকটা যেতে হবে। ওঁর বন্ধুকে বললেন, যাবার মুখে ওটা বাক্সয় ফেলে দিয়ে যেতে। তারপর খেয়াল হ’ল বন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছেন, ওঁকে পৌঁছে দিয়ে সোজা রাস্তাটা দিয়েই যাবেন। চিঠিটা বন্ধুরই হাতে, তিনিই আসবেন ফেলে, কিন্তু খানিকটা এগিয়ে চিঠির বাক্সের গলিটা যখন এসে পড়ল, বললেন— “দাও, আমিই চট করে ফেলে আসছি।”
গিয়ে গর্তের মধ্যে হাতটা দিতে যাবেন, দেখেন ঠিক ওপরটিতে একটা সাদা কাগজ আঁটা, আর তাতে কি লেখা রয়েছে; কৌতূহল হ’তে ঝুকে দেখে তাঁর ভূদুটি কুঁচকে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আমার বন্ধুর নাম ক’রে বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে—অমুকের শীঘ্রই একটা ভীষণ বিপদ আসছে।
শকটা সামলাতে একটু সময় লাগল; বুঝতেই পারছ তারপর বন্ধুর ডাকে হুঁশ হতে তাকেও ডেকে দেখালেন লেখাটা।
এখানে আর একটি কথা বলে দেওয়া দরকার। আমার বন্ধুর যা নাম, সেটা একজন মহাপুরুষের নাম কিন্তু খুব কম শোনা যায় বাঙালির মধ্যে—যতীন-বিমলের মতো তো নয়ই, এমন কি শেখর-সুবিমলের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য; আমি সে-নামের মাত্র জন-দুইকে জানি। যে পাড়ায় গিয়ে পড়েছেন, সে-পাড়ায় তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিতও।
তবু আমি একথা বলতে চাইছি না যে, ব্যাপারটা ভৌতিক কিছু একটা, বরং কেউ যদি বলে তো সাধ্যমতো তার সঙ্গে ঝগড়া করব। ভূতে আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু তাই ব’লে যে ইস্কুল- কলেজেরও ভূত আছে আর মানুষের ভূতেদের তাইতে লেখাপড়া করতে যেতে হয়—এতটা বিশ্বাস করা কঠিন। আমার মনে হয় (আর আশাও), ভূত হওয়ার সঙ্গে লেখাপড়ার হাঙ্গামাটা আরও বেশি করে ভূত হ’য়ে যায়, নয়তো লাভ কি হোল অত কষ্ট করে ভূত হয়ে বলো না?…না, ভৌতিক নয়, সম্ভাবনা এই যে ছেলেদের ঝগড়ার ব্যাপার, ঐ নামে পাড়ার কেউ আছে, তার প্রতিই শত্রুপক্ষের একটা সতর্কবাণী, এ আকারে কেন সেটা বলা শক্ত। কিন্তু গোড়ার কথা এইটুকুমাত্র হোলেও যোগাযোগটা অদ্ভুত নয়?—এটা হয় কি করে সেইটেই আমার মাথায় আসে না, অথচ তোমাদের ঐ যে হেলাফেলার জবাবদিহি—’অন্ধ চান্স’ সেটাকেও মেনে নিতে চায় না মন। ঘটনার ধারাটি এমন একটি সুপরিচালিত প্ল্যানের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে যাতে ওদের আক্রোশবশে ( বা যে কারণেই হোক) লেখাটুকুর সঙ্গে তন্নামধেয় নিতান্তই অসংশ্লিষ্ট অন্য এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ঘটবে, যাতে সে নিতান্তই অন্য এক ধরণের অলক্ষ্য এক বিপদের জন্য সাবধান থাকে। হ্যাঁ, সে-কথাটা এখনও বলা হয়নি, আর সেইটেই সমস্ত প্ল্যানটির মধ্যে একটি উদ্দেশ্য নিহিত করে তাকে সার্থক করে তুলেছে, সেই সঙ্গে সমস্ত ঘটনাটুকুকেও ক’রে তুলেছে আরও বিস্ময়কর।
দিন-দুই পরের কথা, আমার বন্ধু সারকুলার রোডে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কোন কারণে একটা বাস নিজের পথ থেকে হঠাৎ একটু যেন বেরিয়ে এসেই তার গা ঘেঁষে তীরবেগে বেরিয়ে গেল। কিছু হোল না অবশ্য—রগের কাছটায় বাসের সামান্য একটু স্পর্শ, কিন্তু ঐ সামান্য থেকে সুনিশ্চিত মৃত্যুর প্রভেদ ছিল মাত্র এক চুল।
এ অংশটুকুর একটা সংগত জবাবদিহি অবশ্য আছে, আমার বন্ধু ঐ অদ্ভুত যোগাযোগের পর থেকে বেশ একটু মনমরা আর অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন মাঝে মাঝে—রাস্তা পেরুবার মুখে তার জন্যেই বোধ হয় অসাবধানতা, যেটাকে বাসের ছিটকে আসা বলে ভ্রম হয়েছে; কিন্তু আরও একটা সম্ভাবনার কথা এসে যায় না কি, যে কারণে বোধ হয় উনি রক্ষা পেলেন সে-যাত্রা? অর্থাৎ ঐ সতর্কলিপিতে অতিরিক্ত সাবধানও তো করে দিয়ে থাকতে পারে যার জন্যে উনি আর রাস্তাটা পেরুতে…
থাক এই পর্যন্তই, অদ্ভুত শুভদৃষ্টির যোগাযোগ থেকে রঙ-বেরঙের অদ্ভুত যোগাযোগের কথা এসে পড়ল; এসব ব্যাপারের কিন্তু মীমাংসা হওয়া শক্ত।…কোন্খানটায় ছিল আমাদের গাড়ি?
হ্যাঁ, হল্ট, নম্বর চার, শুভদৃষ্টির পর মেয়ে নিয়ে ওরা আবার নেমে বাড়ি ফিরে গেল। মায়ের চোখে একেবারে জল নেই, তবে একটু একটু যেন কাঁপছে, মেয়েটিকে আরও চেপে ধরেছে বুকে। চকিতে ডাইনে-বাঁয়ে এক একবার চাইছে—শোকের চেয়ে যেন মস্ত বড় এক লজ্জায় গেছে পড়ে।
আমাদের গাড়ি যেন এইটুকুর জন্যে অপেক্ষা করছিল, ছেড়ে দিলে। একটু এগিয়ে এসে বাঁদিকে একটা মেটে রাস্তা, পালকিটা এসেছে ঐ রাস্তা বেয়ে, হয়তো মেয়ে নিয়ে এরাও। রাস্তার ধারে একটা স্টেশন নেই, একটা হল্ট দিয়েই সেরেছে কোম্পানি, তবু ইস্কুল, রথতলা—রথটা গোলপাতার ছাউনিতে ঢাকা।
জায়গাটার দর আছে বলে মনে হোল।
ব্যাপারটুকুকে হল্টেই রেখে এসেছিলাম, রাস্তাটুকু দেখে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি,—পথ জিনিসটা জীবনের বাহন, কোথা থেকে নিয়ে আসে, কোথায় যায়, কিছুই যেন হিসাব পাওয়া যায় না…কত ভেবেচিন্তে করি তার রচনা, তারপর অভাবনীয়, অচিন্তনীয় কত কী যে তাই বেয়ে হয় উপস্থিত!
না, ঝেড়ে ফেলো মন থেকে, মনে জমিয়ে রেখো না, দুঃখ নয়, এমন কি সুখও নয়, শুধু বোঝা উঠবে বেড়ে, চলার পথে নিত্য-নতুনকে স্পর্শ করে চলো, নিজেও নিত্য-নতুন হয়ে।
দু’দিকের অপস্রিয়মাণ মুক্ত প্রান্তরে কোথায় যেন এই সত্যটাই উঠেছে ফুটে; চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় আমার পেছনে শেষের বেঞ্চটায় হঠাৎ ঝন ঝন করে মন্দিরার শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গেই গান—
সুধামাখা হরিনাম,
গৌর এ নাম কোথায় পেয়েছে রে…
ফিরে দেখি একটি রোগা গোছের ফরসা মাঝবয়সী লোক—গাড়ি ছাড়বার মুখে কখন উঠে পড়েছিল—ভিক্ষে করবে, গানটা ধরেছে। প্রথম কলিটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সর্বাঙ্গে যেন কাঁটা দিয়ে দিয়ে উঠল। এইখানে একটা সতর্কবাণী দরকার,—আমায় যেন মস্ত বড় ভক্ত ঠাউরে বোস না। প্রথম কথা হচ্ছে, গানটা উঠল একেবারে আচমকা, তায় আবার পেছন দিক থেকে, তার ওপর মেয়েটির মৃত্যুবাসর থেকে নিয়ে ম্লান আকাশের তলায় অস্তরাগের বিচিত্র মায়ার মধ্যে কী একটা অপরূপ মিল আছে, শুধু গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা নয়, যে অশ্রুটাকে আমি এতক্ষণ ঠেকিয়ে রেখেছিলাম, তাকে আটকানও হয়ে উঠল দুষ্কর, বেশ ভালো করে মুখটা ঘুরিয়ে আমার গলাটা একটু বাড়িয়েই রাখতে হোল বাইরের দিকে।
আর সুরটা গানের। এত খাঁটি বাংলা সুর যেন কীর্তনেরও নয়। ‘হরিনাম’-এর পর একটা বিরতি, একটু টান দিয়ে; ‘গৌর’ বলে তার এক-চতুর্থাংশ—ঐ বিরতি আর টান, তারপরই সুরটা বাকি তিনটি কথার ওপর দিয়ে গড়িয়ে রে’র ওপর যেন থমকে দাঁড়াল; সে যে কী মিষ্টি, কত গভীরে গিয়ে স্পর্শ করে, ব’লে বোঝানো যায় না, বোঝাতে গেলে যা যা ঘটল, সবসুদ্ধ সেই সময়টুকুকে আবার অনন্ত অতীতের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হয়। গান যে রেডিওর দাসত্ব করার জন্যে নয়, তা মর্মে মর্মে বুঝলাম। সে হুকুমের দাস হয়ে আকাশপথে তোমার জন্যে ছুটে আসবার জিনিস নয়, তার নিজের সময়ে নিজের পরিবেশে সে কোথায় আপনা হতেই বিকশিত হয়ে উঠল— তোমাকেই সেটা বের করতে হবে খুঁজে। অন্তত তাই মনে হোল আমার তখন—গানটার মধ্যে যে প্রশ্ন, বিস্ময়, খোঁজার বেদনা, পাওয়ার উল্লাস; গানের ভাষায় যা দরদ, সুরের যা কারুণ্য, তার মধ্যে দিয়ে সেই বাঙলা যেন চরমভাবেই রূপ পরিগ্রহ করে দাঁড়িয়েছে, যাকে আজ এই তাপদগ্ধ দিনের মধ্যে দিয়ে এসেছি খুঁজে। এই গান ঠিক এই দেশেই গীত হবে, এই দেশ ঠিক এই গানেই ধরবে মূর্তি। দিনের শেষে, যাত্রার শেষে আমার পাওয়া হয়ে গেল; অসীম কৃতজ্ঞতায় আমার মতন পাষাণের মনটাও গলে গলে কার চরণে চাইছে লুটিয়ে পড়তে।
কিন্তু আবার আমরা সেই দুষ্ট গ্রহ—একটা যে একটু ডুবে থাকব, তা হতে দেবে না। সেই মিলিটারী কন্ট্রাক্টরের কথা মনে আছে?—এবার অবশ্য সে নয়, তবে এ যেন আরও অদ্ভুত, আর উদ্ভাবনী শক্তির দিক দিয়ে একেবারে চরম বিস্ময়কর। কল্পনা করতে পার—একটা লোক আস্ত একটা কলম?—একটা কেন বলি, দুটো অর্থাৎ যুগ্ম কলম—একটা কালো কালির, একটা লাল কালির।
ধাঁধায় পড়েছ নিশ্চয়, ব্যাপারটা খুলে বলি—
গানটাতে তন্ময় হয়ে গেছি, পাশের লোকটা “উঃ!” করে শিউরে উঠল। ঘুরে দেখি পিঠের দিকে কোমরের ওপরটায় হাত দিয়ে একটু তেউড়ে মুখটা বিকৃত করে রয়েছে, যেন হঠাৎ কিছু গেছে ফুটে
চাষাভুষো লোক, গা’টা খালি, কাঁধে একটা গামছা মাত্র।
একটা কথা বলা হয় নি, আমাদের গাড়ি ছাড়বার মুখে হঠাৎ কতকগুনো লোক এসে পড়ে স্টেশনে, যেন কাছে পিঠে কোথাও যাত্রা বা কবির গান ভেঙে গেছে বা ভাঙবে ভাঙবে করছে, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে খবর পেয়ে বাইরের দিকের কিছু লোক এসেছে বেরিয়ে। সমস্ত ট্রেনটাই গেছে বেশ ভর্তি হয়ে, তার মধ্যে সামনে থাকার জন্যে আমাদের গাড়িটা একটু বরং বেশিই। সেই যুবকটি আর তার স্ত্রী সামনের বেঞ্চে, সেই ব্যাপারটুকুর পর কেমন যেন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়ায় যেন আরও বেশি করে। আমার পাশে ঐ লোকটি যে শব্দ করে উঠল, তার পাশে একজন শীর্ণকায় মাঝবয়সী লোক; মাথার চুল কাঁচা-পাকা, গায়ে একটা আধ-ময়লা ফতুয়া, কোলের ওপর কতকগুলো খেরোর মহাজনী খাতা, তার ওপর হাত দুটো মুঠো করে যেন একটু গুটিয়েই রাখা, দেখলে মনে হয় পাটোয়ারি বা মহাজনের হিসেব লেখে, অথবা নিজেই ছোটোখাটো মহাজন। একটু নির্বিকারভাবে সামনে চেয়ে আছে। তার পাশেই আট-নয় বছরের একটি ছোট ছেলে—যেমনভাবে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে, বোঝা যায় ওরই কেউ হবে। জন-দুই লোক জায়গার অভাবে দাঁড়িয়েও রয়েছে সামনের বেঞ্চের দম্পতিকে একটু আড়াল করে।
শব্দটা শুনে আমি ঘুরে দেখে প্রশ্ন করলাম— “কি হোল তোমার?”
“ফুটিয়ে দলে মশায়। ওনার কাছে কি রয়েছে, প্যাট্ করে দিলে ফুটিয়ে, এই দেখুন না।”
কোমরের ওপরের দিকটা একটু ঘুরিয়ে নিতে দেখি সত্যই একটা কি যেন বিঁধে গিয়ে মিহি একটি রক্তের ধারা নেমে এসেছে। লোকটা সেটা বোধ হয় এতক্ষণ দেখে নি, যন্ত্রণাতেই উঠেছিল সিঁটকে, রক্তটা বুড়ো আঙুলে মুছে নিয়ে হঠাৎ চটে উঠল— “এ কি রকম কও দিকিন! গাড়িতে চলবে তা খুন করতে করতে!”
ও-লোকটা সেইরকমভাবে নির্বিকার দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে। শুধু ডান হাতের মুঠোটা আবার একটু যেন গুটিয়ে নিলে। তার ভাবগতিক দেখে এ লোকটা আরও গেল চটে, দাঁড়িয়ে উঠে আরও পাঁচজনকে সাক্ষী মেনে চেঁচামেচি করতে যাচ্ছিল, আমি হাত ধরে বসিয়ে দিলাম, বললাম – “অসাবধানে লেগে গেছে, ভিড়, চাপাচাপি…’
“ছুরির ঘা মশায়।”
“ঘা কেন হতে যাবে? ইচ্ছে করে কেউ কাউকে ঘা দিয়ে বসবে?… কেন? মগের মুল্লুক তো নয়। বোস তুমি, ছুরির নখটা কি রকম অসাবধানে লেগে গেছে।…যদি খোলা থাকে তো ছুরিটা বন্ধ করে ফেলুন না মশাই, মোড়া যায় না?”
লোকটা সেইরকম নির্বিকার, শুধু অল্প একটু আমার দিকে ঘাড়টা হেলিয়ে বললে— “আর লাগবে না।” ডান হাতটা আরও গুটিয়ে নিয়ে পিরানের মধ্যে সাঁদ করিয়ে দিলে। ছোট ছেলেটা ওর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।
বললাম—“খোলা যদি থাকে কিম্বা মোড়া যদি না যায় তো আবার লাগবেই। কোথায় আছে ছুরিটা, পকেটে?”
এবার ঘাড়টাও আর বেঁকালে না, সোজা সামনে চেয়েই বললে— “বলছি আর লাগবে না…”
আমারও রাগ ধরে গেল জিদ আর উত্তরের ঢংটা দেখে, আহত লোকটাও আবার তেড়েফুঁড়ে উঠতে যাচ্ছিল, তাকে চেপে রেখে একটু বিরক্তভাবেই বললাম— “ছুরি খোলা থাকলে লাগবে, আপনার বন্ধ করে রাখতে দোষটা কি? যেমন দেখছি, ছুরিটা বেশ ধারালও—পকেটে না হাতে আছে?”
ছোট ছেলেটা যেন আরও ভেবড়ে গেছে, একবার আমার মুখের দিকে চাইলে, একবার লোকটার নির্বিকার মুখের দিকে, তারপর আবার আমার মুখের ওপর দৃষ্টি তুলে কাঁচুমাচু হয়ে বললে— “ছুরি নয়, কলম জ্যাঠামশাইয়ের।’
শুধু এইটুকু দেখলাম, ফতুয়ার মধ্যে জ্যাঠামশাইয়ের হাত যেন আরও সঙ্কুচিত হয়ে গেল; ভাইপোর দিকে একটা বক্র দৃষ্টি হানলে, কিন্তু ঘাড়টা না ফেরানোয় সেটা বোধ হয় পৌঁছালও না ঠিক মতন।
বললাম— “কলমের খোঁচা এইরকম! তা বেশ তো অসাবধানে লেগে গিয়ে থাকে, আর যাতে না লাগে, তার ব্যবস্থা করতে হবে তো? নিবটা উল্টে গুঁজে দিন—আছে কোথায়? পকেটে না হাতেই?”
“বলছি তো আর লাগবে না; না লাগলেই হোল তো?”
রাগটা বেড়ে আসছে আমার, ও লোকটাও ফোঁস ফোঁস করছে, এদিককার হাতটা চেপে আছে… ওদিককারটার বুড়ো আঙুল দিয়ে আর একটু রক্ত মুছে নিয়ে সবার সামনে তুলে ধরলে আঙুলটা; আরও পাঁচজনের মধ্যে আলোচনা-মন্তব্য আরম্ভ হয়ে গেছে, বউটি একটু ভীতভাবেই স্বামীকে জিগ্যেস করলে— “হ্যাঁগা, পাগল-টাগল নয় তো?”—ঘুমন্ত ছেলেটাকে আর একটু টেনে নিলে কোলের মধ্যে।
আমি বললাম— “কিন্তু জিদটা আপনার কিসের? এইরকম চাপ ভিড়, নিবটা উল্টে কলমের মধ্যে গুঁজে দিলেই যদি হওয়া যায় নিশ্চিন্দি তো আপনার আপত্তিটা কিসের? না হয় আমরাই দিচ্ছি উল্টে বসিয়ে, পকেটে কলমটা?”
—পকেটটা দেখবার জন্যে গলাটা একটু বাড়ালাম।
ছেলেটা সেইরকম কুণ্ঠিত দৃষ্টি তুলে বললে-”না, হাতে।”
বললাম— “হাতে তো বের করুন না মশাই, কেউ কেড়েও নিচ্ছে না, ভেঙেও দিচ্ছে না, তার জন্যে আমি দায়ী রইলাম। নিবটা শুধু খুলে উল্টে বসিয়ে দেওয়া; কি নিব?—জি-মার্কা?”
শুধু একবার ছেলেটার দিকে আড়ে চেয়ে কাঠ হয়ে বসে রইল। আমি ধৈর্য হারালাম, “এ কি রকম জিদ!”—বলে অনুচিত হলেও রাগের মাথায় কলমটা টেনেই বের করতে যাচ্ছিলাম, ছেলেটা ব্যাকুলকণ্ঠে হাত দুটো তুলে কতকটা চেঁচিয়েই উঠল— “খোলা যায় না, সে নিব জ্যাঠামশাইয়ের গো!”…
লোকটাও একেবারে খিঁচিয়ে উঠল, লম্বাটে আমসির মতন মুখটা বিকৃত করে ছেলেটার দিকে ভালো করেই ঘাড়টা ফিরিয়ে ধমক দিয়ে উঠল— “তুই চুপ কর্, জ্যাঠা ছেলে। যত কিছু বলছি না তখন থেকে ক্রমাগত ফ্যাচফ্যাচ করছে। খোলা যায় না! খোলা গেলেই যার খুশি টেনে বের করবে, কোম্পানির রাজত্ব উঠে গেছে?”
মুখের চেহারা আর চিবিয়ে চিবিয়ে একেবারে এতগুলি কথা বলতে দেখে আমিও একটু থ হয়ে গিয়েছিলাম, আবার সামলে নিয়ে বললাম— “আর কোম্পানির রাজত্বে যে অকারণ রক্ত বইয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি?”
এবার সোজা আমার দিকেই ঘুরে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল— “ভেসে যাচ্ছে গাড়িসদ্যু সবাই রক্তগঙ্গায়! একসঙ্গে যেতে গেলে লাগে না এমন একটু-আধটু খোঁচা-টোচা? আর আপনার কি কন তো—বলে কার পাড়ে ঢেঁকি পড়ে, কার মাথাব্যথা!”
হাতটা একটু আলগা হয়েই গিয়েছিল, আহত লোকটা নিজের হাতটা একটা হ্যাঁচ্কা দিয়ে ফতুয়ার মধ্যে থেকে টেনে বের করে বলে উঠল— “তাহলে যার মাথাব্যথা, সেই করছে বের।… এই দেখো, এই দেখে থোও আপনারা সমাজের পাঁচজন, এখন পজ্জন্ত রক্তের দাগ কলমে।…
ঝোঁকের মাথায় গড়গড়িয়ে বলেই হঠাৎ অবাক হয়ে থেমে গেল। আমাদের সবারও বাকরোধ হয়ে গেছে। কলম কোথায়? সরু লিকলিকে তর্জনী আর মাঝের আঙুলটার মাথায় সত্যিই দুটো বড় বড় নিব,—সুতো দিয়ে বাঁধা নয়, নখ দুটোই লম্বা করে বাড়িয়ে তারপর নিবের মতন সূঁচলো করে কাটা, এমন আশ্চর্য কাণ্ড জন্মে দেখিনি, লক্ষ্য করে দেখলে মাথায় চেরার দাগটি পর্যন্ত দেখা যায়, পাশেরটিতে কালো কালির ছোপ ধরে আছে, মাঝেরটিতে লাল কালির আঙুলের একটা পাব পৰ্যন্ত।
এতক্ষণ পরে অর্থ উপলব্ধি হোল, জ্যাঠামশাইয়ের কলম!—ঐ আঙুল দুটো দরকার মতন লাল আর কালো কালিতে ডুবিয়ে খেরো লিখে যায়, হারাবার ভয় নেই, পুরনো হবার ভয় নেই, কেনবার বালাই নেই, কেউ যে ধার চাইবে, সে পথও বন্ধ—নি-খরচা, নির্ভাবনার জিনিস; ফাউন্টেন পেনের দৌড় জামার পকেট পর্যন্ত, এ কলম হামে হাল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে; মাঝে মাঝে শুধু নিব দুটো একটু বেড়ে নেওয়া।
এ রকম জাট-কেপ্পন আর দেখেছ? সেই সুতো-চিংড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। অবাক হয়ে চেয়ে আছি সবাই, পাশের সেই লোকটা তুলে ধরে আছে হাতটা, রাগ নেই, আক্রোশ নেই; একটা গোটা মানুষ যে সরু হতে হতে কলমের নিব হয়ে গেছে, অবাক হয়ে তাই দেখছে।
ও-লোকটিও বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে;— “আচ্ছা, হয়েছে, ছাড়ো, তা যার যেমন সুবিধে”—বলে হাতটা ছাড়িয়ে নিলে, সঙ্গে সঙ্গেই ফতুয়ার মধ্যে গুঁজে দিয়ে সেইরকম নির্বিকার হয়ে বসে রইল।
একটু পরেই সরারহাট স্টেশনটা আসতে কয়েকজনের পেছনে ও-ও নেমে গেল; এক অভিনব সৃষ্টি বিধাতার!
“বেহাই আছেন! বেহাই মশাই কোন গাড়িতে।…’
ইঞ্জিনের দিক থেকে আওয়াজটা এগিয়ে আসছে। আমার খেয়াল ছিল না, ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, সেই ভোজন-তথা-শয়ন-বিলাসী মানুষটি; ভিড়ের জন্যে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে থাকায় চোখের আড়ালেও পড়ে গিয়েছিল।
সরারহাটেই তো নামবে। গাড়ি থামলেই আপনি জেগে ওঠে, এবার বোধ হয় বেশি গোলমালে কিরকম ঘুমিয়ে পড়েছে, ডাক দিলাম—
“ও মশাই, উঠুন, শুনছেন?”
ধড়মড়িয়ে উঠেই সেই প্রশ্ন— “এখানে পাওয়া যায় না কিছু? কতক্ষণ দাঁড়াবে গাড়ি?”
বললাম— “গোটা বেহাইটাই পাওয়া যাবে এখানে, আর ভাবনা কি? — সরারহাটে এসে গেছেন।”
ওর প্রশ্নটা যেন আপনিই বেরিয়ে পড়ে, বোধ হয় মনের অন্তস্তলে সর্বদাই একটু বুভুক্ষু আশঙ্কা লেগে থাকবার জন্যেই যে, বুঝি গেল ফসকে
একটু লজ্জিত হয়ে বললে— “না… সেজন্যে নয়…মানে… সরারহাটই বুঝি এটা?…এই যে বেহাই আমি এখানে!” শেষেরটুকু একটু গলা তুলেই।
বেহাই এসে পড়লেন। গোলগাল মানুষটি, গলায় দু’ছড়া তুলসীর কণ্ঠী, বললেন — “এখন তো নামুন, গাড়ি ছেড়ে দেবে যে!..নাঃ, বেহাই আমাদের তেমনটিই রয়ে গেলেন। কোনও কষ্ট হয় নি তো গাড়িতে?”
আমিই উত্তর দিলাম, বললাম— “কষ্ট পেতে হলে জেগে থাকতে হবে তো মানুষকে।”
হেসে বললেন— “এঃ, খুঁড়ছেন আমাদের বেহাইকে? সে-ঘুম আর আছে কোথায় বেহাইয়ের? কন্যা সম্প্রদান করছেন, পুরুতমশাই মন্ত্র পড়িয়ে যাচ্ছেন—যখন আধাআধি, হঠাৎ ফো ফোৎ করে নাক ডাকার শব্দ হতে টের পাওয়া গেল, একতরফা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি ছোট বেহাইকে ডেকে আবার কেঁচে গণ্ডূষ করাতে হয়…”
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, গলা চড়িয়েই বললাম— “কেন, বাড়ির গিন্নির তো জানবার কথা— বেগুনি-ফুলুরিতে ভরে একটা জামবাটি হাতের কাছে রেখে দিলেই পারতেন…”
ঘাড় ফিরিয়ে হেসে বললেন— “বেহান যে আবার বেহাইয়ের গুরু; মেয়ে বিদেয় করছেন, কাঁদবার নাম করে ঘরে গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন…”
কানে গেল—গাড়ির মধ্যে সেই বউটি যেন একটু আঁতকে উঠেই তার স্বামীকে চাপা গলায় জিগ্যেস করছে— “হ্যাঁ গা, দুজনেই এই….চলে কি করে ওদের সংসার?”
সরারহাট ভালো করে দেখাই হোল না এই সবের মধ্যে পড়ে। শুধু যে আমার গাড়িটা একটা ফুলে-বোঝাই গুলঞ্চ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তার গন্ধটা নাকে লেগে আছে।
এদিককার স্টেশনগুনোয় বিশেষ কিছু দেখবার নেই বলেই একটা কিছুও বাদ দিতে চায় না মন। তার কারণ বোধ হয় এই যে খুব বড় সমারোহের মধ্যে যেগুনো নির্বিশেষ—একেবারেই চোখে পড়বার নয়, অভাবের মধ্যে সেগুনোও এখানে সবিশেষ হয়ে ওঠে। শুধু অভাবই বা বলি কেন?— অভাব বলেই সেই অবসর, যা তুচ্ছকেও অসামান্য করে তোলে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছে গাড়ি, গলা বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম—স্টেশনের বাইরে ডানদিকে একটি বটগাছ, মাঝখানে খানিকটা প্রাঙ্গণ ছেড়ে চারিদিকে কতকগুলো বাড়ি কয়েকখানা টালির; যেখানে সেখানে অস্তরবির টীকা, রাঙা রঙটা চিক্চক্ করছে। গাছের মাথায় কিচির-মিচির, যেন দূর থেকেও কান পাতা যায় না—পাখির ঝাঁক বাসার দখল নিয়ে ফয়সালা করে উঠতে পারছে না—আরও আসছে উড়ে; চিল, কাক, শালিক, জটিলতা আরও বাড়বে, তারপর এক সময় শান্তিঃ, শান্তিঃ, সব নির্বিবাদ, নির্বিরোধ। অন্ধকারই ওদের হাইকোর্ট; বিচার যাই করুক, অন্তত মানুষের হাইকোর্টের মতন অন্ধকার বাড়িয়ে তোলে না।
গাছের তলায় একপাল শিশু করছে খেলা, একেবারে ছোট ক’টি উলঙ্গ; তবে মুক্ত সন্ন্যাসীই তো, গায়ে ধূলির ভস্মপ্রলেপ। বোধ হয় একটা হার-জিৎ হয়ে গেল, সমস্ত দলটা একসঙ্গে উল্লসিত আনন্দে চিৎকার করে উঠল—কত রকমের নেচে, কুঁদে, শুয়ে, গড়িয়ে, মুঠো মুঠো ধুলো দিলে উড়িয়ে, ওদের রচা এই মেঘেও অস্তসূর্যের শেষ আশীর্বাদ এসে পড়ল।
গাড়ি একটা বাঁকে ঘুরে গেল। দুদিকে মুক্ত প্রাঙ্গণ, যতদূর দৃষ্টি যায়। সূর্য তার একেবারে শেষের আলোটা যাচ্ছে বুলিয়ে—ঐ তার আশীর্বাদ—মাঠে এক রঙ, গাছের মাথায় এক রঙ, সোনার উলুখড়ের বনে এক রঙ, ঐ জলাটার বীচিভঙ্গের ওপর যেন সম্পূর্ণ আর এক রঙ। আজকের মতন বিদায় দেবার আগে আলোক যেন নতুন করে দেখছি।…তুমিই জীবন, তুমিই তো বৈচিত্র্য, অন্ধকার তো মৃত্যু—একাকার।
উলুখড়ের বনটা ঘুরে গিয়েই এ কি এক অপূর্ব দৃশ্য! কয়েক বিঘা জমি নিয়ে হলুদ রঙের ছড়াছড়ি একেবারে, এখুনি কারা যেন কার গায়ে হলুদ গোলা নিয়ে মাতামাতি করে গেছে। বেশ খানিকটা দূরে বলে প্রথমটা ঠাহর হয় না, তারপর বুঝতে পারলাম পালা-ঝিঙের ক্ষেত। ঝিঙে ফুল নিশ্চয় কখনও একটু অভিনিবিষ্ট হয়ে দেখনি, কেউই দেখে না। কিন্তু অত্যন্ত ফ্যালনা নয়। আসল কথা, আমরা মেয়েদের আর কতগুনো ফুলকে রান্নাঘর থেকে আলাদা করে দেখতে অভ্যস্ত নয়, বিশেষ করে সেই সব উদ্ভিদের ফুল যাদের ফলের জন্মই হচ্ছে আমাদের রান্নাঘরকে পরিপুষ্ট করবার জন্যে। আশ্চর্যের কথা এই যে, মেয়েরা কোথায় এর জন্যে একটু সমব্যথার ব্যথী হবে, না, উল্টে তারাই বেশি,সজনে ফুলের চচ্চড়ি করবে, কুমড়ো ফুলগুনোকে ব্যাসনে ডুবিয়ে আরও সরস করে ছাঁকা তেলে ভাজবে — adding insult to injury –এমন কি যারা কুমড়ো-সজনের দলে নয়, বাগানের এক কোণে থাকে প’ড়ে—বক, রজনীগন্ধা তাদের পর্যন্ত আনবে টেনে!…আমি মল্লিকার মোরব্বা খেয়েছি—মেয়েদের হাতের তৈরি, তাঁদেরই উদ্ভাবনা শক্তির নিদর্শন। “বেতার-জগৎ” কাগজখানা মাঝে মাঝে উল্টে যেও, ওঁরা এখন বাগানে ঢুকে ঐ সব কাণ্ড করছেন— “একপো টাটকা মল্লিকা ফুল নিতে হবে, আধপো গোঁড়া নেবুর রস, আধপো চিনি, এক ছটাক আদা কুঁচি, প্রথমে ফুলগুনিকে খুব মিঠে জ্বালে ঘিয়ে ভেজে নিয়ে…”
থাক, আর চটাব না।
যা যুগ চলেছে গোলাপফুল দেখবারই অবসর নেই মানুষের তো ঝিঙের ফুল! তবুও হাতের কাছে পেলে তুলে নিয়ে একবার দেখো। গড়নে তেমন কিছু নেই, কিন্তু রঙটি একটু লক্ষ্য করে দেখো। সবুজটা হচ্ছে হলদের মিত্রবর্ণ, সেই সবুজের একটি চমৎকার আমেজ আছে কিন্তু ফুলের হলদে রঙে; ঠিক অতসীর হলদে কিম্বা জাফরানের হলদে নয়, বোধহয় ঝিঙের হলদেটাই সেই মিষ্টি রঙ, যেটাকে বাসন্তী রঙ বলা হয়। আর, একটি দিব্যি গন্ধ; খুব উঁচুদরের বলব না, তবে বেশ ভালো, আর একটু নতুন ধরণের যেন। এদিকে খুব মৃদু,—তা ধরলে হেনার তুলনায় ওর মাত্রাজ্ঞান আছে মানতে হবে। গন্ধের ভাষা নেই, তবে তুলনায় যদি কতকটা ধারণা হয় তো বলব চা-গন্ধী (Tea-scented)। গোলাপের চেয়ে ভালো। না, আমি ঝিঙে ফুলের কাছ থেকে ওকালতনামা পাই নি, তবু গরিব বলে কেউ ওর পরিচয় দেবে না, এও তো অসহনীয়।
আর চমৎকার ফোটার সময়টি বেছে নিয়েছে ঝিঙে ফুল; এই সন্ধ্যা। তোমার যদি একটি ফুল তুলে পরখ করবার সময় বা সুযোগ না থাকে তো ঝিঙের ক্ষেতের খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েই গোধুলি আকাশের নিচে এর সমষ্টিগত সৌন্দর্যটা দেখো—যাকে বলব maas effect. শৌখীন মেয়ের মতো এর সময় আর পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে যে চমৎকার একটি জন্মগত সহজজ্ঞান আছে, এ কথাটা না মেনে উপায় নেই। না বিশ্বাস হয় এরই জ্ঞাতি ধুঁধুলের রুচিটা দেখলেই বুঝতে পারবে। ধুঁধুলের ফুল ফোটে সকালে; একই জিনিস, শুধু খানিকটা বড়, কিন্তু তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে ও-রঙ নিয়ে সকালের আকাশের নীচে আত্মপ্রকাশ করায় যেন একটা গ্রাম্যতা আছেই।
এই রকম মানিয়ে ফুটতে আর একটি ফুলকে দেখেছি—জুঁই, সে আবার আরও সুন্দর; আকাশ ধূসর হয়ে এসেছে; এইবার নক্ষত্র ফুটবে, ছোট্ট ছোট্ট পাপড়িগুলি মেলে শুচিশুভ্র জুঁইয়ের দল বেরিয়ে এসে মুখ তুলে দাঁড়াল, ধূসরিমার গায়েই যে ওর শুভ্রতার জেল্লা খুলবে। কার কাছ থেকে যে এই সব নূরজেহানের দল এসব তত্ত্ব আসে শিখে!
যাত্রার শেষদিকে সব কিছুরই বেগ বাড়ে—গরু বলো, ঘোড়া বলো; আমাদের গাড়ির গতিও উদ্দাম হয়ে উঠেছে, এইবার শেষ স্টেশন ফলতা যে। আমিও একটু নড়েচড়ে বসলাম। অস্বীকার করব না এক ধরণের একটা ক্লান্তি এসেছে; যা দেখলাম-শুনলাম, তার প্রতি কণাটি করেছি উপভোগ, কিন্তু তবুও শহরের মানুষ শহরের জন্যে মনটা ভেতরে ভেতরে হয়েই উঠেছে উদগ্রীব। হোক ছোট্ট শহর, তবু বাঁধানো রাস্তাঘাট বাজার-হাট, কিছু গাড়ি, ঘোড়া, রিক্শা —সর্বসমেত একটা সজীবতা— দেখছি এর বিরহ বেশিক্ষণ সয় না আমাদের ধাতে। অন্তত যাত্রাশেষে যে একটা শহরই আছে, এ প্রত্যাশাটা উৎসুক করে রেখেছে মনটাকে।
সে-প্রত্যাশার সঙ্গে আরও একটা প্রত্যাশা আছে। খিদে পেয়েছে; চনচনে নয় অবশ্য, কেননা সিরকোলে নারাণীর হালুয়া তার ধার অনেকটা মেরে দিয়েছে, তবু পেয়েছে খিদে—সেটা অসহনীয় অন্তত এইজন্যে হয়ে উঠছে যে, আমতলার হাটের সেই রসগোল্লাগুনোকে প্রত্যাখ্যান করার কথা ভুলতে পারছি না, ফলতার গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। দক্ষিণের এদিক দিয়ে দাক্ষিণ্যও আছে— জয়নগরের মোয়া, মগরাহাটের রাবড়ি-দই; ফলতারও নিজস্ব কিছু আছে নিশ্চয়ই। আর বাড়ি ফিরতেও তো সেই রাত-দশটা।
শহরের কিছু কিছু লক্ষণ পাচ্ছে প্রকাশ, দু’একখানা করে ভালো-মন্দ বাড়ি, গাছপালার কিছু আধিক্য। সেই মেঠো ভাবটাও ক্রমে ক্রমে আসছে কমে। আমাদের গাড়ি যাচ্ছিল খাড়া পশ্চিমে, এবার দক্ষিণ-মুখো হোল। ডানদিকে আকাশের নিচের দিকটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা বোধ হচ্ছে, তারপর মনে পড়ল শহরের পেছনেই গঙ্গা।
গাড়ি এসে স্টেশনে দাঁড়াল।
আমার মনটাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণ শহরের একটা মন-গড়া রূপ দাঁড় করিয়ে তার রাস্তাঘাটে যে ঘোরাঘুরি করছিলাম, তার কোথায় কি? স্টেশন বলতেও সেই একই জিনিস—এই খেলাঘরের লাইনে তারও যেন একটি গড়া-পেটা ছাঁচ আছে, একটি না হয় গোটা দুই, তাইতে কাদামাটি ঢেলে তারপর শুকিয়ে জায়গায় জায়গায় বসিয়ে দিয়ে গেছে—মাঝেরহাট থেকে এই ফলতা, ঐ দু’রকম দেখলাম, তৃতীয়ের কথা মনে পড়ছে না। রেল দুহাতে টাকা লোটে, কিন্তু অন্তত স্টেশনগুনোকে একটু সুন্দর করে গড়ে না কেন, বুঝে উঠি না। এমন খাঁটি বণিক-মন বোধ হয় আর কোথাও দেখা যায় না। এরা মা-লক্ষ্মীর কাছে এত পায়, কিন্তু দু’খানা গয়না দিয়ে সাজাবার কথা দূরে থাক, পায়ে দুটো ফুল দিয়েও যে মনের কৃতজ্ঞতা জানাবে, তাও তো দেখি না।
না, একটু ভুল হয়ে গেল; মেলা ঘুরি নি, তবু বাগান রাখার রেওয়াজটা অন্তত একটা লাইনে দেখেছি, আমাদেরই ঘরের লাইনে—বি.এন.ডবলিউ.আর-এ (এখন নাম বদলেছে)। শত দোষ থাক, এ গুণটুকু আছে তার মধ্যে। তবে শুনেছি এই বৈশিষ্ট্যের নাকি বিশেষ একটা কারণও আছে। তৎকালীন বি.এন.ডবলিউ.আর-এ ইংলন্ডেশ্বরের নাকি মোটা রকম শেয়ার ছিল, তার তাঁরই নির্দেশে তাঁর রেলে এই রাজকীয় ব্যবস্থাটুকু।…অর্থাৎ আভিজাত্যের ছোঁয়াচে বণিকের জাত গেছে এখানে।
তোমার আধুনিক মন বলবে – sheer waste—ডাহা অপচয়—প্রয়োজনটা কি এটুকুর?
এ কথার ঠিকমতো উত্তর অবশ্য দিতে পারব না। তবে যতটুকু ভেবে দেখছি, তাতে মনে হয় তোমাদের অভিধানের যা ‘প্রয়োজন’ তার হাতে সৃষ্টিকে ছেড়ে দিলে তার আর কিছু বস্তু থাকত না। সৃষ্টিকে সহনীয়, এমন কি লোভনীয়ও করে তুলেছে তোমাদের অভিযানের ‘অপ্রয়োজন’, কতকগুনো আবার ‘অপ্রয়োজন’ও আছে তার মধ্যে। অভিজাতকে তোমরা বিদায় করতে বসেছ, তার সব কেড়ে- কুড়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে, আর একটু নিঃস্ব করে এই রেলের ধারে ফুল পোঁতবার গুণটাও কেড়ে নিয়ে তবে ছেড়ো।
স্টেশনের বাইরেটাও নিরাশ করলে। অন্য যানবাহন দূরের কথা, একখানি রিকশা পর্যন্ত নেই। শুধু একটি ছই-দেওয়া গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, স্টেশন প্রাঙ্গণে ট্রেনটা প্রবেশ করতেই যুবক মেয়েটিকে বললে— “যাক, তোমাদের গাড়িটা এসে গেছে, নিশ্চিন্দি; এখন আবার আমার নৌকোটা ছাড়ে তবে তো…”
উত্তর হোল— “না ছাড়লে আমি পাঁচ টাকার হরির-লুট দোব।”
—মুখটা বেশ ভার।
“তার মানে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনে হরির-লুট দেওয়া। আজ পৌঁছতে না পারলে কি ক্ষতিটা যে হয়ে যেতে পারে, জানো না তো। বন্দুকের গোটাকতক ফাঁকা আওয়াজও যদি আজ করে রাখতে পারা যায়…”
ছই-দেওয়া গাড়ি থেকে একজন সেপাই গোছের লোক এসে জিনিসপত্র নামাচ্ছে। আমি নেমে পড়ে নিচে দাঁড়ালাম।
ওদের স্ত্রী-পুরুষে কথা-কাটাকাটি চলছে, পেছনে পড়ে আর একটু জোরও হয়ে উঠেছে।
“তাই চললেন বীরপুরুষ! অন্য কাউকে দিয়ে বন্দুকটা পাঠিয়ে দেওয়া চলত না যেন!”
“নিজে তোমার আঁচলের তলায় লুকিয়ে থেকে।…ওরে, যে গুনো গোরুর গাড়িতে যাবে আলাদা কর,ঐ সুটকেসটা, জলের কুঁজো, টিফিন-কেরিয়ার—ওগুনো সব নৌকোর জন্যে।”
“আঁচলের তলায় লুকিয়ে থেকে! আর গোরুর গাড়িটা না এসে পড়লে কি করা হোত?— বউ-ছেলে এই আঘাটায় ফেলে চলে যেতে তো—কাজের লোক!”
“কি না হলে কি হোত, সে-সব কথা ওঠে না, ওরকম বিপদটা এসে না পড়লে তো যাবার কথাও উঠত না। (একটু গলা নামিয়ে) তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলে তো এইসব বুলিও শুনতে হোত না। দেখো খোকাকে একটু সাবধানে তুলে নিও, জেগে উঠলে সে বড় মুশকিল হবে।”
“আমি জাগিয়ে দোব; যাও কেমন করে যাবে…”
এগুলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা-কাটাকাটি শুনলে আমার চলবে না। দাঁড়িয়েও যা পড়েছিলাম তা বিপদটা কি সেটা শোনবার জন্যে, একটা কৌতূহল জেগেছে মনে। ও পারটা মেদিনীপুর, দাঙ্গা-হাঙ্গামার জের এখনও চলেছে। কাল সন্ধ্যা, সামনে নদী, স্বামীকে যেতেই হবে পেরিয়ে, স্ত্রী দেবে না যেতে কোনমতেই—বেশ একটু রোম্যান্সের সুর ঘনীভূত হয়ে উঠেছে, যদি লেখার বাই থাকত তো বুঝতে এর মধ্যে থেকে সরে যাওয়া তত সহজ নয়।
তবু পড়লাম এগিয়ে। মাত্র ঘণ্টা দেড়েক সময়, যানবাহন নেই, পায়ে হেঁটেই একটু দেখেশুনে ফিরতে হবে এখুনি। আর মেয়েটিকে বলি—তোমরা বাপু সত্যিই ছেলেগুনোকে অমন আঁচল দিয়ে আগলে রাখবার চেষ্টা কোর না, এই করে আর পাঁচ-ব্যান্যুন-ভাত খাইয়ে শেষ করে দিলে জাতটাকে—একটু বেরুক, মানুষে সমুদ্র পেরিয়ে রাজ্য জয় করছে, এ তো বাঙালির বাচ্ছা ছটাকখানেক গঙ্গা পাড়ি দিয়ে বন্দুকের দুটো ফাঁকা আওয়াজ করতে যাচ্ছে, এটুকুতেই আর পেছু ডেকো না।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা টানা রাস্তা উত্তর-দক্ষিণে, এদিকে স্টেশনের ইয়ার্ড, ওদিকে গায়ে-গায়ে-ঘেঁষা বাড়ি, যাতে পেছনটায় কি আছে অন্তত স্টেশন থেকে বোঝা যায় না। বাড়ির বেশিরভাগই লোহার ঢেউ-তোলা চাদরের (corrugated iron sheets )।
স্টেশনটা তাহলে শহরের ওপরে নয়। অর্থাৎ তখনও আশা। একটা লোককে একটু একলা পেয়ে প্রশ্ন করলাম— “ফলতা শহরটা কোথায় মশাই?”
একটু বিস্মিত হয়েই মুখের দিকে চাইলে, প্রশ্ন করলে— “যাবেন কোথায়, কার বাড়ি?”
এই ভয়েই কাউকে করি না প্রশ্ন। একটা লোকের কাজ নেই কর্ম নেই, বিনা কারণেই ঘর ছেড়ে এসেছে এতদূর, তাও কোথায় এসেছে কিছু না জেনেই—এমন অদ্ভুত কাণ্ডও যে জগতে ঘটছে এটা জাহির করে বলবার নয়। হয় মিথ্যা বলতে হয়, না হয় কৌতূহল চেপে একেবারেই চুপ ক’রে যেটুকু নজরের সামনে এল দেখেশুনে নিতে হয়। আমি তাই করি, এবার অতিরিক্ত কৌতূহলে কিরকম ক’রে ফেলেছিলাম প্রশ্নটুকু।
বললাম— “না, এই স্টেশনের কাছেই একটু কাজ আছে, সেরে নিয়ে ফিরব এই গাড়িতেই।”
পা চালিয়ে দিলাম। যেতে যেতেই শুনছি— “শহর বলে তো কিছু নেই, ডানদিকে খানিকটা গেলে একটি হাট পাবেন আর থানা, আর…
ততক্ষণে রাস্তায় নেমে খানিকটা এগিয়েছি—কি মনে করে বাঁদিকেই; গুরুবল, লোকটার কথাগুনো ডানদিকেই এগিয়ে গেল। নজরটা পেছন দিকে গিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াতে হোল; এক ফালি…হ্যাঁ, গঙ্গাই তো, কিন্তু এ কি!”
তারপরেই নজর পড়ল খানিকটা সামনে কতকগুনো লোক মোটঘাট নিয়ে রাস্তায় ঢালু গা বেয়ে নামছে; তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম।
ঘাট একটা। বাঁধানো নয়, তবে ঘাটই, ফেরিঘাট। সামনে, একেবারে রাস্তার নিচেই গঙ্গা। কিন্তু কলকাতা থেকে কতটুকুই বা এসেছি, এরই মধ্যে এ কী রূপ গঙ্গার! কী প্রসার! কম ক’রে ধরলেও কলকাতার গঙ্গার বোধহয় তিনগুণ হবে। ওপারে সন্ধ্যার আকাশের নীচে নীল তটরেখাটা লি লি করছে, জোয়ারের জল ছোট-বড় ঢেউয়ে এপারের তটরেখাকে মুঠিয়ে মুঠিয়ে ধ’রছে চেপে। ঝড় নেই, এমন কি বাতাস পর্যন্তও নেই বললেই চলে, শুধু নিজের পূর্ণতায়ই জলরাশি যেন অধীর হয়ে ছলকে ছলকে উঠছে।
স্থির হয়ে চেয়ে রইলাম। ডাইনে বাঁয়ে বাড়ি, তাইতে দু’দিকে দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, ঠিক পূর্ণভাবে দেখতে পাচ্ছি না গঙ্গাকে, তবু যা দেখছি চোখ ফেরাতে পারা যাচ্ছে না। আর, বোধ হয় এই সময়, এই আকস্মিকতা,–সে আকস্মিকতা আবার ফলতাকে দেখে নৈরাশ্যের পর—এই সব মিলিয়ে একটা অপূর্ব অনুভূতি ঠেলে উঠছে যেন—যদি বলা যায় গঙ্গাই আমার মধ্যে প্রবেশ ক’রে আমার কূল চেপে ধরেছে তো প্রকৃত অবস্থাটা অনেকটা প্রকাশ করা যায়।..এই আমার নদীমাতৃক দেশের আর একটা রূপ—আর একটা রূপের আভাস বলাই ঠিক—আরও নেমে আরও কত বিস্তার—আরও কত নদী, এইরকম, এর চেয়েও বিশাল—মাতলা, ভৈরব—আরও কত সব, অগণিত, তারপর পদ্মা, মেঘনা,—শুনি ওদিকের কূলের চিহ্নমাত্র যায় না দেখা, কূর্মপৃষ্ঠের মতন বতুল জলরাশির ওপর দিগন্তরেখা এসেছে নেমে।…কত বঞ্চিত হয়েছি, কত দেখবার যে ছিল, অথচ হোল না দেখা…
একটা অদ্ভুত আনন্দ উঠছে ঠেলে—সেটা বুঝি অশ্রু হয়ে উদগত হবে এবার, যতই ক্ষুদ্র হই, নিজের দেশের বিশালতা যে আমারই বিশালতা—আমি সেই নিজেকে করছি অনুভব।
ফলতার ওপর কৃতজ্ঞতায় আমার মনটা উঠছে ভরে। সে আমায় একদিকে নিরাশ করে, একদিকে আমার জন্যে এতখানি সঞ্চয় করে রেখেছে কে জানত?…আর, নিরাশ?…ধরো যদি হোতই বড় শহর, যদি শহর দেখেই যেতাম ফিরে! ও যেন আমার জীবনে এই একটি সন্ধ্যা সৃষ্টি করবার জন্যে নিজেকে বঞ্চিত করেছে এতদিন, একটা তপস্যায় নিজেকে শীর্ণ অসম্পূর্ণ করে রেখেছে।
“কি রে যাবি কেউ!”
চমক ভেঙে ফিরে দেখি, পেছনে আমার সেই সহযাত্রী যুবকটি। পাশে তার স্ত্রী, হাতে টিফিন কেরিয়ারটা, পেছনে সেই সেপাই গোছের লোকটা, তার মাথায় সুটকেসের ওপর হোল্ড-অলে বাঁধা বিছানা; হতে সেই জলের সোরাই।
ফেরিঘাটে গোটা তিন নৌকা রয়েছে—যাবার অপেক্ষায় কয়েকজন যাত্রীও; কিন্তু মাঝিরা নিশ্চেষ্ট, সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে বোধ হয় পাড়ি জমাতে রাজি নয়; —বৈশাখের সন্ধ্যা।
যুবকের ডাকেও কেউ সাড়া দিলে না।
মেয়েটি একটু উৎসাহের সঙ্গে ব’লে উঠল— “ঐ দেখো, ওরা পর্যন্ত সাহস করছে না—বলে, যাদের অষ্টপ্রহর এই কাজ।”
যুবক কিছু উত্তর করলে না, ওদেরই আবার হাঁক দিলে— “যাবি তো বল্, ডবল ভাড়া পাবি।”
মেয়েটি মন্তব্য করলে— “কী জিদ বাবা! দেখিনি এমনটা।—মা কালী করেন যেন নাই রাজি হয়…”
“দেখ, আরও কিছু যদি বেশি চাস…”
মন্তব্য হোল— “সবারই তো টাকা-কড়ি-সম্পত্তি বড় নয়, প্রাণটা আগে।”
ছেলেটি এবার ফিরে চাইলে, বেশ বিরক্ত হয়েই বললে-”জয়া, যত মনে করছি যাবার মুখে কিছু বলব না, কিন্তু না বলিয়ে ছাড়বে না তুমি। এই জন্যেই তোমায় ঘাটে আসতেও বারণ করলাম।…একটা কাজে যাব—কত দরকারী কাজ তাও জান, তবু তখন থেকে টিক্ টিক্ করছ।… এদিকে কলেজে-পড়া মেয়ে, বড় বড় বুলিও শুনি মুখে—যেই নিজের ঘাড়ে পড়ল— ব্যস্, যেমন কলেজে-পড়া তেমনি পুণ্যি-পুকুর ব্রত করা—সব একরকম।…নাও, আরম্ভ হোল ফোঁসফোঁসানি।…”
ফিরে দেখবার উপায় নেই, তবে ফোঁপানিটা কানে গেল। এ দাম্পত্য মান-অভিমান-কলহের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কেমন যেন ঠিক হচ্ছে না; একটু নেমেই দাঁড়িয়েছিলাম, ঘুরে উঠতে যাব, যুবকটির সঙ্গে মুখোমুখি হোল। পেছন ফিরে ছিলাম বলে, আর খানিকটা তফাত ব’লে আগে বোধ হয় চিনতে পারে নি, চোখাচোখি হ’তেই মেয়েটির দিকে মুখটা একটু ফিরিয়ে বললে— “ঐ দেখো, উনিও যাচ্ছিলেন।”
“ফিরে তো আসছেন আবার।”—দুজনের কথাই এবার অপেক্ষাকৃত একটু চাপা গলার হোল।
যুবা কি একটু ভাবলে, সত্যি, আমার উঠে আসাটা তো তার সংকল্পের বিরোধিতাই করে, তারপর তার জিদ যেন আরও চড়ে গেল, আমার দিকেই চেয়ে প্রশ্ন করলে— “আপনি পারে যাচ্ছিলেন?”
হঠাৎ একটা খেয়াল উঠল আমার মাথায় যা আমার মতো নোঙর-ছেঁড়া ভবঘুরের পক্ষেও একটু নতুন।…বেশ তো, যাই না ওপারে—মেয়েটির যা অবস্থা, তবু অনেকটা সাহস পায়, এ দেখছি যখন যাবেই…আছে এর আতিথ্যই, তারপর কোন একটা জায়গার নাম ক’রে সরে পড়লেই হবে— একটা নাম অন্তত মনে আছে—তমলুক…কোথায়, কত দূরে, জানি না—বিশেষ করে এ কোথায় উঠবে তাও যখন জানি না; কিন্তু কিছু একটা হয়েই যাবে ঠিক—এর সঙ্গে গল্প করতে করতেই- সে আত্মবিশ্বাসটা না থাকলে এরকম বিনা-ব্যবস্থায় ঘোরাঘুরি করতে পারতাম না জীবনে।… যাই, মেয়েটি তবু ভরসা পায়।
কাল আর পরশুর যা প্রোগ্রাম কলকাতার, কাজের আর অকাজের, মুছে ফেললাম; যাব।
একটু যে দেরি হল উত্তর দিতে সেটাকে ঢাকবার জন্যে একটু ঘুরে চাইলাম ফেরিঘাটটার দিকে, তারপর দোমনাভাবে একটু টেনে টেনেই বললাম— “যাচ্ছিলাম তো, কিন্তু…”
যুবক ব্যগ্রভাবে বললে— “না, সে ঠিক হয়ে যাবে, আর একটু উঠলেই, এটা ওদের দর বাড়াবার ফন্দি। এই পথ দিয়েই যাওয়া-আসা আমার, জানা আছে তো…চলুন…বাড়তি ভাড়াটা না হয় আমারই; একটু গরজ আছে।”
ঘুরতে যাব, দৃষ্টিটা মেয়েটির মুখের ওপর গিয়ে পড়ল। বাধ্যই পড়তে। সে যে কী হতাশার দৃষ্টি, কী অ্যাপীল, দেখনি, সুতরাং বোঝানো যাবে না। চোখ দুটো আমার ওপর শেষ ভরসায় হয়ে উঠেছে স্থির, বিস্ফারিত, জলে ভাসছে বলে আরও দেখাচ্ছে বড়, পশ্চিমের শেষ আলো এসে পড়ায় আরও করুণ—নদীতটে সেই একখানি নারীমুখের ছবি কখনও মুছবে না আমার মন থেকে, কখনও বর্ণনা করে কাউকে বোঝাতেও পারব না—সে যে কী উদ্বেগ, কী আশা, কী নিরাশা!
তারপর সীমন্তের সেই জ্বলজ্বলে সিঁদুর—নব সোহাগে গাঢ় করে টানা—সে যেন আমার অন্তঃস্তলের মিথ্যাচারটা ধরতে পেরেই ধিক্কার হানছে আমার ওপর।
না, দরকার নেই। উপায়ও নেই, এ জাতের মেয়েরা জন্মায়ই পুরুষকে ঘরে বেঁধে রাখবার জন্যে; দেবতারাই হার মানে তো আমি কোন ছার। একটু দ্বিধা,—একজন পুরুষের দৃষ্টিতে কাপুরুষ প্রতিপন্ন হওয়া আর একজন নারীর চোখের অশ্রুর জন্যে দায়ী হওয়া (কে জানে কতদিনের অশ্রুই বা তা)—কোটে বেছে নিই?
দ্বিধা কিন্তু মুহূর্ত কয়েকের মাত্র, তারপর আর একবার নদীর দিকে ঘুরে দেখে নিয়ে বললাম— “থাক, কালবোশেখীর দিন, একেবারে এরকম গুমট থাকলে যেন আরও ভয় হয়…”
নারীর সীমন্ত-সিন্দুরের ধিক্কারের চেয়ে পুরুষের পুরুষকারের ধিক্কারটা কি বেশিই বাজল? কিন্তু সে-হিসাবের জন্যে আর না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এলাম।
এবার চললাম উত্তরদিকে, হাটটাই না হয় দেখে আসি। ফেরিঘাটে অনেকখানিই সময় গেল নষ্ট হয়ে।
যানবাহনহীন রাস্তা, লোকচলাচলও কম, দুধারে বাড়ি, টিনের দেয়াল, টিনের ছাত, কোনটাতে চায়ের দোকান, খান তিন-চার বোতলে কিছু বিস্কুট-কেক; কোনটায় মুদিখানা। মাঝে মাঝে ফাঁকও আছে, বাঁদিকের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে গঙ্গা যাচ্ছে দেখা। ময়রার দোকান একটাও নেই, এদিকে বেশ খিদে পেয়ে গেছে; দোকান না থাকলে খিদে আবার বেশিই পায়। নেই ঘরে খাঁই বেশি,—তা ঘরেই হোক বা পথেই হোক, মনস্তত্বের দিক থেকে ব্যাপারখানা একই তো। বলবে চা-বিস্কুট কি দোষ করলে? না, আমার ও-পাট নেই। চা-টা আমি আচার্য পি.সি.রায় মশাইকে দিয়েছি, লোকে যেমন জগন্নাথকে আমটা কাঁটালটা দিয়ে দেয়; প্রবাসী, ভারতবর্ষে সে উগ্র প্রবন্ধ তো তুমি পড়নি, সুতরাং বুঝবে না।
পা চালিয়ে দিলাম, দেখি হাটে যদি কিছু জোটে। জায়গার যা চেহারা দেখছি, জুটবে যে কি তাও আন্দাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে না। মাঝেরহাটে সেই মুড়ির যাত্রায় আরম্ভ, শেষও হবে মুড়ি দিয়েই।…তাই না হয় জুটুক।
খানিকটা গিয়ে বাঁদিকে, অর্থাৎ গঙ্গার দিকে আর বাড়ি নেই। আমি একেবারে খোলা রাস্তা দিয়ে চলেছি। রাস্তার নিচে থেকেই গঙ্গা, সামনে পেছনে যেদিকে দেখ। কলকাতার স্ট্র্যান্ডের আর বাহার নেই, বাড়িতে-জেটিতে সব নষ্ট করে দিয়েছে, এক কেল্লার সামনে খানিক ছাড়া; তার চেয়ে চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড ঢের ভালো, তবে এখানকার এটুকুর কাছে যেন কোনটা দাঁড়ায় না। সেটা আর কিছুর জন্যে নয়, নদীর বিস্তারের জন্যে। চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড প্রকৃতই স্ট্র্যান্ড অর্থাৎ নদীর কোলঘেঁষা সড়ক, শৌখিন ফরাসী সাজিয়েও রেখেছিল ভালো করে, প্রশস্ত রাস্তার ওপরেই যত ভালো ভালো বাড়ি, হোটেল, অফিস, বাগানবাড়ি। অপরদিকে বাঁধানো বাঁধের নিচেই গঙ্গা, ওপারে জুটমিলের বাড়িঘর, টানা এমুড়ো-ওমুড়ো চলে গেছে,—সব মিলিয়ে, বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়টিতে, যখন ওপারে আলোর মালা জ্বলে ওঠে, চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড ইন্দ্রপুরী হয়ে ওঠে যেন। কিন্তু তবুও ফলতার এইটুকুকেই ফুল মার্ক দিতে হয়, অন্তত আমার হাতে তো পাবেই; চন্দননগরে এ গঙ্গা কোথায়— ফলতার তুলনায় একটা খাল।
কথাটা হচ্ছে—গয়নার রূপ, না গয়না? প্রশ্নটা এইখানেই যে শেষ হয়ে যায় তাও নয়, আরও একটু এগোয়—
গয়না কি রূপের দোসর জুটিয়ে তাকে খানিকটা বিকৃতই করে দেয় না? নিরলঙ্কার রূপই কি পূর্ণ বিকশিত রূপ নয়? আর নিরলঙ্কার রূপ—নিরহঙ্কারও তো; তাও যে অপরূপ। তটবর্জ্যের সেই নিরহঙ্কার পূর্ণ বিকশিত রূপ দেখবার জন্যে কোন এক সন্ধ্যায় ফলতার এইখানটিতে এসে দাঁড়িও। আর পার তো একটি পূর্ণিমার দিনই বেছে নিও, কোটালের গাং যখন একেবারে কূলে কূলে ভরা।
.
ও কি! জলের মধ্যে থেকে ভেসে উঠল নাকি!…ফলতা যেন আজ ভোজবাজির ঝুলি নিয়ে বসেছে আমার জন্যে-
চমৎকার একটি বাড়ি—একটি হর্ম্যই বলা চলে। একটু আড়ালে ছিল বলে নজরে পড়ে নি, গঙ্গার এত কোলঘেঁষা যে, হঠাৎ দৃষ্টি পড়লে সত্যিই মনে হয় যেন গঙ্গার ভেতর থেকে এই উঠল। সন্ধ্যার গায়ে সাদা চুনকাম ঝিক ঝিক করছে। একটা আশা হোল, তাহলে বোধ হয় শহর একটা আছে, এখান থেকে আরম্ভ হোল।
গতি একটু ভাব-মন্থর হয়ে উঠেই ছিল, পা চালিয়ে দিলাম। একটা নয়, দুইদিকে দুখানা বাড়ি, দেয়াল দিয়ে ঘেরা হ’লেও বোঝা যায় ভেতরে প্রশস্ত বাগান। রাস্তাটা গেছে মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে।
আমি বাঁদিকের বাড়িটাই দেখেছিলাম দূর থেকে, সেইটিই বড়; তটরেখাটা এখানে হঠাৎ অনেকখানি গাঙের ভেতর দিকে চলে গেছে, তাইতেই মনে হচ্ছিল, বাড়িটা যেন জল থেকে উঠছে। বাড়ির লোহার গেট বন্ধ, ভেতরেও লোক নেই, একটু এগিয়ে আর একটা ছোট দরজা। সেটাও বন্ধ।
বাংলার গাঁয়ে গাঁয়ে এই যে সব ঘুমন্ত পুরী—এগুনো বড় আবিষ্ট করে দেয় আমার মনটা। যেগুনো ভেঙে পড়ছে, যে গুনোর জীবন্ত ইতিহাস পড়ে গেছে অনেকখানি দূরে, সেগুনো তো তাদের কুহেলীঘেরা রোম্যান্স দিয়ে করেই, যেগুনো দাঁড়িয়ে আছে… ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে আছে — মালী রয়েছে দেখাশোনা করবার জন্যে, যাদের বাড়ি তাদের যাতায়াত আছে মাঝে মাঝে, সে ধরণের বাড়িগুনোও আমায় কম আবিষ্ট করে না। অবশ্য বড় বাড়িই বেশি করে—হতগৌরব জমিদারীর সঙ্গে সেগুনো সংশ্লিষ্ট করা যায়। আমি বাংলার বইয়ের মানুষ এক হিসেবে, সে গৌরবের যদি কিছু দেখা না থাকত একেবারে তাহলে বোধ হয় এরকমটা হোত না। কিন্তু দেখেছি যে, তাও দেখেছি শৈশবের স্বপ্নময় দৃষ্টিতে।
আমার ছেলেবেলার দুটো বছর কেটেছে চাতরা শ্রীরামপুরে। রক্তে তখনও যেমন এই ভবঘুরে বৃত্তিটা ছিল, বাইরের অবস্থাও এমন ছিল, যাতে সেটা প্রশ্রয় পায় প্রচুর। গঙ্গার ধারে গোসাঁই জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম আমার অনির্দিষ্ট যাত্রাপথে—সকালে, দুপুরে, বিকালে, যখনই ঝোঁক চাপত। সকাল-বিকালের সজীবতা—লোক-লস্কর, জুড়ি-গাড়ি; জমিদার বাড়ির নানা বয়সের পুরুষেরা—সুরূপ সুবেশ; পেরালেটারে শিশুরা, সায়েবদের শিশুর মতন—সংখ্যায় বৈচিত্র্যে—সবটুকুর বাহুল্য—আমার দৃষ্টিকে মোহাচ্ছন্ন করে দিত। দুপুরের নিস্তব্ধতায় যখন দেখতাম, তখন এক দিক দিয়ে সব যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠত। খুব কাছ থেকেও দেখেছিলাম, বছর দুই যে ছিলাম চাতরায় তাতে বোধ হয় বার দুই। নন্দ গোসাঁইয়ের বাড়িতে হোত দোল, ঠাকুরমার সঙ্গে যেতাম। প্রকাণ্ড উঠান, তার চারিদিকে থাম, উঠানের উপর সামিয়ানা; তাই থেকে রং-বেরঙের ঝাড় লালঠেন নেমে এসেছে, আলোয় আলোয় ছয়লাফ। আর, ঝাড়ের ডায়মন্ড-কাঁটা চঞ্চল দোলকগুনো থেকে লাল, নীল, সবজে, বেগুনে—কতরকম আলোর দ্যুতিই যে ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে! সামনে দোলমঞ্চ জমজমে ভাবটা মনে আছে, তবে মূর্তির মধ্যে মনে পড়ছে শুধু গরুড়ের মূর্তিটা, দেহটা মানুষের, শুধু পিঠে ডানা,—আর পাখির চঞ্চুর মতন লম্বা নাক; হাতজোড় করে প্রশান্ত বিশালতায় সামনে চেয়ে বসে আছেন।
পথ দিয়ে যাই বা এই রকম ভেতরেই এসে পড়ি একটা দূরত্ব আর দুরাশার দৃষ্টি দিয়েই দেখতাম এই শ্রী আর সমৃদ্ধির মিছিল। হ্যাঁ, শিশুমনের একটা অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈকি, কিন্তু বরাবরই একটা সম্ভ্রমের ব্যবধান, একটা অপ্রাপণীয়তার আশ্বাস সমস্তটুকুকেই একেবারে অন্য জগতের করে রেখেছিল।
শৈশবের দৃষ্টিতে আকাঙ্ক্ষা থাকে কিন্ত হিংসা থাকে না, তাই দেখাটা এক ধরনের পাওয়ার আনন্দেই আমার কাছে আজও অম্লান হয়ে গেছে।
সুযোগ পেলেই আমি তাকে খুঁজি এই সব ঘুমন্ত পুরীর মধ্যে। দেশে গেলে এইজন্যে প্রায়ই একবার না একবার উত্তরপাড়াটা বেড়িয়ে আসতাম। মনে আছে, একবার দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে দ্বার অবারিত পেয়ে একটা বড় বাড়িতেও করেছিলাম প্রবেশ। প্রশস্ত উঠান, থামের সারি দিয়ে ঘেরা; চণ্ডীমণ্ডপে দেবী মূর্তি। আধুনিকা নয়, এইটুকুই পেলাম সান্ত্বনা—বাড়ির ঠাকুর—দুর্গা, সরস্বতী এখনও প্রায় তাঁদের অন্তঃপুরিকা মূর্তিতেই রয়েছেন—কিন্তু লোক কোথায়? কোথায় এ সমারোহ? সে নিষ্ঠাই বা কোথায়? প্রকাণ্ড পুরী নিস্তব্ধ, বুঝলাম পুরীর যাঁরা অধিকারী তাঁরাও কেউ আসেন না বড় একটা—এমন একটা উপলক্ষ্যেও নয়। দোতলার বারান্দায় মাত্র একজন বয়স্থা মহিলাকে দেখলাম। একদিক থেকে অন্যদিকে কতকটা উদাসীন মন্থরগতিতে চলে যাচ্ছেন।
ওরকম একটা আঘাত জীবনে কম পেয়েছি…কোথায় গেল সব, কি হোল?
এ বাড়িটা সে ধরণের কিছু নয়, তবু এখানকার জমিদারবাড়ি নিশ্চয়। কাছে-পিঠে আর বাড়ি নেই, এ ধরণের তো নেই-ই, তার মানে আমি যে ভেবেছিলাম শহর হোল আরম্ভ সেটা মাত্র ভ্রান্ত আশা একটা।
পথে লোক একেবারেই নেই যে একটু জিগ্যেস করি বাড়িটা কাদের, কে এখানকার জমিদার।
খানিকটা এগুতে দেখি, পেছনেই একটি ভদ্রলোক এসে পড়েছেন। গেঁয়োলোক, বেশ হন হন করেই চলেছেন হাটের দিকে। প্রশ্নটা করলাম। বললেন— “না, জমিদার নয়, জগদীশ … “ ঘোষ বললেন কি বোস বললেন স্পষ্ট বোঝা গেল না।…”ওই যাঁর রেডিও…”
পরিচয়টুকু দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমি যে শটা (shock) পেলাম সেটা যে ধরণের চিন্তার মধ্যে ছিলাম ডুবে, তারই জন্যে। এই শকটুকুর জন্যেই আমার চিন্তাটাও হঠাৎ মোড় ফিরে গেল।…সত্যিই তো, মনে ছিল না, ভরা বৈশ্য যুগ চলছে যে! রেডিও বেচার টাকা ….
এ চিন্তাতেও পড়ল বাধা, নৈলে রেডিও রহস্যটা যেতে যেতেই পরিষ্কার হয়ে যেতে পারত।
কয়েক পা এগুতেই ডানদিকে একটা মেটে রাস্তা। তারই একটু ভেতর দিকে একটা জায়গায় দৃষ্টি গেল আটকে।
একটি ছেলে প্রায় বছর দশেকের, সঙ্গে একটি মেয়ে, বছর দুয়েকের ছোট—কেমন যেন জবুথবু হ’য়ে রাস্তার এক পাশে রয়েছে দাঁড়িয়ে। কৌতূহল হতে এগিয়ে গেলাম। ছেলেটির পরনে একটা ময়লা হাফ প্যান্ট, ডান হাঁটুর কাছটা ছেঁড়া, গলায় পৈতে; মেয়েটির পরনে একটা খাটো ডুরে শাড়ি, তাও নিচে খানিকটা ছেঁড়া, ময়লাই; চেহারাতেও দু’জনের অভাবের ছাপ রয়েছে, তবুও দুজনেই সুশ্রী বলতে হয়। ছেলেটির ডান হাতে একটা কলাই-করা আর একটা কাঁসার বাটি, আমি একটু এগুতেই পেছনে করে নিলে। মেয়েটির দুটি আঁচলে ছোট বড় দু’টি পুঁটলি ক’রে কি বাঁধা; সামনেই ধরে ছিল, আমি এগুতে পিঠে ফেলে দিলে।
কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম— “কি হয়েছে খোকা তোমাদের? ওরকম করে…’
সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে নজর পড়ায় ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল। জিগ্যেস করলাম— “পড়ে গেছে? কি ছিল?”
ছেলেটিই উত্তর দিলে— “তেল আর ঘি।” মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
“কি করে পড়ল?”
“হোঁচট লেগে।”—রাস্তায় একটা গর্তের মতন ছিল, তার দৃষ্টিটা সেইখানে গিয়ে পড়ল।
“তা প’ড়ে গেছে তো আর কি করবে? ইচ্ছে করে তো আর ফেলনি, আবার কিনে নিয়ে যাও, পয়সা নেই কাছে আর?”
একটি লোক এসে দাঁড়াল, প্রশ্ন করলে— “হয়েছে কি?”
বললাম তাকে। ছেলেটিকে বললাম— “না থাকে পয়সা বাড়ি থেকেই নিয়ে এস; কতদূরে বাড়ি?”
লোকটা মাঝবয়সী, একটু কোলকুঁজো আর খেঁকুরে, নির্লিপ্তভাবে কথাটা শুনে এগিয়েছিল, ঘুরে দেখে বললে— “হ্যাঁঃ, ফলছে পয়সা, নিয়ে এলেই হোল। আমাদের ইয়ের ছেলে নয়?”
বাপের নাম না করলেও ছেলেটি মাথা নেড়ে জানালে—হ্যাঁ।
“ফলছে পয়সা। যত সব বেহুঁশ ছেলেপিলে হয়েছে আজকাল। তোদের বাড়িতে তো আজ কুটুম আসবে? আসবে না এয়েছে?”
“আসবে।”—তিরস্কারে ছেলেটি আরও হতভম্ব হয়ে গেছে, কথাটা যে বললে আরও যেন ব্যাকুলভাবেই।
“আসবে তো হরিমটোর খাওয়াস”–ক্রূর মন্তব্যটা ক’রে চলে গেল লোকটা।…মানুষও যে কতরকমের হয়!
“তাহলে…?”—প্রশ্নটা তুলতে যাচ্ছিলাম, ছেলেটা হঠাৎই দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু ক’রে কেঁদে উঠল। মেয়েটিও ব্যাকুলভাবে একবার তার দিকে একবার আমার দিকে দেখে নিয়ে তেমনি করেই ভেঙে পড়ল।
দৃশ্যটি বড় করুণ, পেছনে যে ইতিহাসটুকু তাতে আরও করুণ করে তুলেছে। আমি এগিয়ে দু’হাতে নিলাম কোলের কাছে দু’জনকে টেনে, বললাম— “চুপ কর। গেছে পড়ে তো হবে কি? চলো, আমি হাটেই যাচ্ছি, কিনে দোব।”
মেয়েটি পা বাড়িয়েছিল, ছেলেটি কিন্তু নড়ল না, ফোঁপাতে লাগল।
মেয়েটিও গেল থেমে
হাতের অল্প ঠেলা দিয়ে বললাম— “চলো না।”
নড়ল তো না-ই, কথাও বললে না, সেইজন্যে আমাকেও একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হোল, তারপর আর একবার বলতে ছেলেটি হাত দিয়ে চোখ দুটো মুছে অসম্মতির ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়লে।
প্রশ্ন করলাম— “কেন, দোষটা কি?”
একটু হেঁট হয়েই রইল, তারপর আস্তে আস্তে মাথাটা তুলে বললে— “আপনি কেন কিনে দেবেন?”
—খুব নরম হয়ে কান্নার ভাবটা একেবারে না গেলেও তারই পাশে ঠোঁটে একটু অপ্রতিভ হাসি টেনে এমনভাবে বললে, বেশ বুঝতে পারা গেল, খুব সতর্ক, যেন প্রত্যাখ্যানে আমি কোন আঘাত না পাই। আরও একটু কি ছিল বলাটুকুর মধ্যে যাতে মনে হয় কথা ক’টা বইয়ে পড়া বুলি নয়; এক-একটা পরিবারে হাজার দারিদ্র্যের মধ্যেও একটা সহজ আত্মমর্যাদাবোধ থাকে, এ যেন তারই প্রতিধ্বনি। মাত্র শেখা বুলি হ’লে যেটা পাকামি বলে মনে হোত, সেটা শুধু একটা মিনতির মতন কানে এসে ঠেকল।
বড় মিষ্টি লাগল; বড় পবিত্র। গলার পৈতাটার ওপর স্বতঃই দৃষ্টিটা গিয়ে পড়ল, ছেঁড়া মলিন হাফ প্যান্টটার ওপর এসে পড়েছে। যা শুনলাম তার সঙ্গে এটুকুর কেমন যেন একটা মিল আছে— দারিদ্র্যের ওপর শুচিতার মৌন আধিপত্য।
অপ্রতিভ করে দিয়েছে বৈকি বেশ একটু। একটা গল্পের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে; ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। রোমনগরে একটি বৃদ্ধ মলিন কাপড়-চোপড় পরে টুপি হাতে রাস্তার ধারে ছিল বসে। একটি ভদ্রলোক ভিখারী ভেবে তার টুপিতে একটি মুদ্রা ফেলে দিলেন। বৃদ্ধ টুপি উল্টে সেটা ঝেড়ে ফেলে এমন একটা নীরব তিরস্কারের দৃষ্টিতে চাইলে যে, দানের শখ মিটে গিয়ে ভদ্রলোক পালাতে পথ পায় না।
সত্যিই তো, কি অধিকার আছে আমার এভাবে সাহায্য করতে যাওয়ার? দুঃখ-নৈরাশ্য যখন থাকবেই পৃথিবীতে তখন নিজের শক্তিতেই তা কাটিয়ে উঠুক মর্যাদার সঙ্গে, তাইতেই তো হবে শক্ত মেরুদণ্ডের একটা গোটা মানুষ। আমি যা করতে যাচ্ছিলাম সেটাতে ভিক্ষার হাতেখড়িই হোত না কি?
চিন্তাগুনো বিদ্যুৎগতিতে আমার মনে গেল খেলে; কিন্তু অভিভূত করতে পারলে না আমায়। বিবেকের যুক্তিটা মানলাম, কিন্তু ফলতা আজ আমায় এত দিয়েছে, মনটা উঁচু পর্দায় হয়ে গেছে বাঁধা যে প্রতিদান একটা কিছু না করে আমি নিষ্কৃতি পাচ্ছি না…একটা এরকম অসহায় পরিবার, ঘরে কুটুম আসছে—চুলচেরা তর্ক নিয়েই থাকব?…কিছু করা যায় না?—উচিত নয় কিছু করা?…মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে; সে তো দাদার মতন অত বোঝে না। সময় নেওয়ার জন্যেই প্ৰশ্ন করলাম—
“তোমাদের বাড়িতে কে কে আছেন?”
“বাবা মা, ঠাকুরমা, দিদি, যমুনা, আমি।”
—যমুনা বলবার সময় মেয়েটির মুখের দিকে চাইলে।
“কি করেন তোমার বাবা?”
“স্কুলে পণ্ডিত।”
“এখানে?”
“না, ভিন্ গাঁয়ে।”
“সেখানেই থাকেন?”
“না।”
প্রশ্নগুনো আপনা হ’তেই বেরিয়ে যাচ্ছে মুখ দিয়ে আমার, নেপথ্যে চলছে চিন্তার স্রোত, কি ক’রে কিছু করা যায়, সবদিক বাঁচিয়ে?
প্রশ্ন করছি— “যাওয়া-আসা করেন বুঝি?”
“হ্যাঁ।”
“এসেছেন তিনি?”
“আজ একটু দেরি হবে, জামাইবাবুকে সঙ্গে ক’রে আনবেন কিনা…রাত হয়ে যাবে।”
অন্যমনস্কভাবেই প্রশ্নগুনো করছিলাম, আবার অবস্থার দিকে মনটা অবহিত হয়ে উঠল; গৃহস্বামী নিজে যখন পৌঁছবে—কুটুম সঙ্গে ক’রে—কোনও উপায়ই থাকবে না আর।… কিছু যে না করলেই নয়।
হে ভগবান!
একটা প্রশ্ন মনে পড়ে গেল; জিগ্যেস করলাম— “তিনি নিজে কিছু সঙ্গে করে আনবেন? কুটুমের জন্যে?”
কেন যে প্রশ্নটা করলাম, ঠিক বলতে পারি না; কেননা, ঘি তেলই তো আসল—তা তো আর সঙ্গে করে আনবে না। কিন্তু প্রশ্নটা বোধ হয় দৈবচালিতই ছিল—এক এক সময় এসে যায় ওরকম, কেননা উত্তর যা পেলাম তাইতে এক ঝলক আলো যেন ফুটে উঠল চোখের সামনে, যা হাতড়াচ্ছিলাম গেলাম পেয়ে।
ছেলেটি বললে— “বাবা শুধু দইটা আনবেন, এখানে তো পাওয়া যায় না ভালো।”
দই!!,…..আমার চিন্তায় হঠাৎ একটা আবর্ত উঠল।…By association (পরিভাষা দেখো) ছেলেবেলায় শোনা একটা উপাখ্যান মনে পড়ে গেল।…পথ খুলে গেছে আমার।…আজকের দিনে আমার সবই সার্থক করবেন ভগবান। আমার সকল্পে, আমার দানে কোনখানেই গ্লানি সৃষ্টি করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, একটি অপরিসীম শুচিতা, তার চেয়েও যা বেশি—একটি ভাগবৎ করুণা থাকবে আমার এই দেওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে।
অবশ্য, আমি হয়ে থাকব মিথ্যাচারী। তা হই গে।
গোধূলির রং আর একটু গাঢ় হয়েছে।
আমি অনুভব করছি আমার দৃষ্টির মধ্যে একটা অদ্ভুত প্ৰসন্নতা এসে গেছে; মিথ্যাচারের সঙ্গে তার তো মিশ খাবার কথা নয়!
একটু হেসে ছেলেটির মুখের পানে চাইলাম; বললাম— “চলো, কোন দোষ নেই।”
দাঁড়িয়েই রইল। আমি মুখটা একটু ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করলাম— “সেই গল্পটা শুনেছ? — মধুসূদনদাদার?—গুরুমশাই মারা গেছেন; তাঁর শ্রদ্ধে ছাত্ররা সব জিনিস যোগাবে–এর পড়েছে দইয়ের ভার—অত্যন্ত গরীবের ছেলে, কোথায় পাবে দই?…”
ছেলেটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, কথা কেড়ে নিয়ে বললে— “হ্যাঁ—হ্যাঁ শুনেছি, তারপর তার মা বললেন—তোর মধুসূদনদাদাকে ডাক, তিনিই যুগিয়ে দেবেন দই—তারপর পাঠশালায় যাবার সময় বনের ধারে–’কোথায় মধুসূদন দাদা! কোথায় মধুসূদন দাদা!’ বলে ডাকছে এমন সময় মধুসূদন বুড়ো-ব্রাহ্মণের বেশ ধরে এসে…”
মেয়েটিও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে, জড়তাটুকু গেছে কেটে, গল্প বলবার ছেলেমানুষী আগ্রহ আর চাপতে না পেরে মুখ তুলে ব’লে উঠল— “আমিও জানি, আমিও জানি—এনে বললেন- কি চাও? না, গুরুমশাই ম’রে গেছেন, আমায় দই যোগাতে হবে—তা আমরা গরিব, রোজ ভালো করে খেতেও পাই না, কোথা পাব দই? তখন মধুসূদন দাদা বললেন, এইজন্যে ডাকাডাকি? বলে…”
“বনের মধ্যে গিয়ে এনে দিলেন দই, না?”
“হ্যাঁ ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনেছি…শুয়ে শুয়ে…অ’নে—ক’বার…চমৎকার গল্প”…দুজনেই জড়াজড়ি ক’রে বললে; ফুটন্ত ফুলের মতন কচি মুখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আমিও শুনেছিলাম আমার ঠাকুরমার কাছেই—স্তব্ধ রজনীতে বিছানায় শুয়েই তাঁর কোলের কাছটিতে—অর্থাৎ স্বপ্নলোকে প্রবেশ করবার মুখেই। আর শুনেছিলাম এইরকম একটি শ্যামল স্নিগ্ধ পরিবেশের মধ্যেই—গাছপালায় ঘেরা আমাদের চাতরার বাড়িতে।
আজ তাই পরিবেশের সমতায়ও আমি সেই উপাখ্যানটিকে রূপ দেবার লোভ পারছি না সামলাতে! করিই না সার্থক। বললাম— “শুনেছ তো?…তার মানে তাঁকে যারা ভালোবাসে, মন যাদের পবিত্র, যারা নিষ্পাপ, তারা বিপদে পড়লে তিনি এসে রক্ষে করেন, না? কিছু অভাব হ’লে যুগিয়ে দেন, না?”
“হ্যাঁ।”—মেয়েটির মুখ আরও দীপ্ত হয়ে উঠেছে; ছেলেটির কিন্তু একটু যেন নিষ্প্রভই হয়ে গেছে, সে বুঝেছে গল্পটা কেন।
বললাম— “তাহলে চলো, ‘না’ বলছ কেন?”
ছেলেটি অপ্রতিভভাবে দাঁড়িয়েই রইল মুখের দিকে চেয়ে; মেয়েটিও এতক্ষণে যেন একটু ধাঁধায় পড়ে গেছে।
বললাম— “চলো তাহলে। দাঁড়িয়ে কেন? হাটবাজার আবার উঠে যাবে তো?”
ছেলেটি আবার সেই সজ্জিত দৃষ্টি তুলে বললে— “কিন্তু…কিন্তু আপনি তো বুড়োমানুষ নন্।”
কোন পুণ্যবংশের সন্তান, দারিদ্র্যকে করে আছে আলো! বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে; আপনি তো “মধুসূদন নন্”–বললে যে কথাটা রূঢ় হ’ত সেটুকু পর্যন্ত জ্ঞান আছে।
বললাম— “না, বুড়োমানুষ তো ছিলেন ভগবান নিজে, তিনি তো সব সময় সব জায়গায় যেতে পারেন না, বা যান না, তাঁর চাকরদের দেন পাঠিয়ে।”
গোধূলি আরও একটু গাঢ় হয়ে এসে সহায়তা করেছে আমায়।
“আপনি তাঁর চাকর?”—বিস্মিত প্রশ্ন করলে মেয়েটিই। তবে ছেলেটিও যেভাবে মুখের পানে চেয়ে রয়েছে, মনে হয়, অভিভূতই হয়ে আসছে। আমি মেয়েটির দিকেই চেয়ে উত্তর করলাম- “চাকরের চাকর আমি মা-মণি, তিনি যে কত বড়, কত পুণ্যে যে তাঁর নিজের চাকর হওয়া যায়— সে পুণ্যি কি আমার আছে?…আরও কাছে ডেকে নেবেন বলেই এইরকম কাজে মাঝে মাঝে পাঠিয়ে দেন। নিজের মুখে কি সে-সব কথা বলতে আছে?…তাহলে এটুকুও করবার পুণ্যি থাকবে না যে।…তোমার ঠাকুরমাকে বোলো, তিনি সব বুঝিয়ে দেবেন—তোমাদের বাবাও জানেন, মাও জানেন— “
–ছেলেটির মুখের দিকেও চাইলাম। সেই এবার করলে প্রশ্ন— “তাহলে কোথায় থাকেন আপনি?”—সরল বিশ্বাসকণ্ঠে যেন অমৃত ঢেলে দিয়েছে।
বললাম— “আমি থাকি এখান থেকে বহু—বহু—দূর, আজ তিনি সেইখান থেকে এই কাজের জন্যেই দিয়েছেন পাঠিয়ে আমায়, তোমাদের দেশে এই-আজ নতুন এলাম। চলো, বেশি জিগ্যেস করতে নেই, আমারও বেশি বলতে নেই।
মন্ত্রমুগ্ধের মতন দুজনে সামনে পা বাড়ালেন।
সত্যি, তিনিই তো দিয়েছিলেন। নইলে সেদিনে অত টাকা নিয়ে বেরুব কেন? ফেরবার ভাড়া বাদে যৎসামান্যই বাঁচবার কথা তো। কিন্তু বাক্সয় খুচরো টাকা না থাকায় দুটো দশটাকার নোটই সেদিন নিতে হয়েছিল আমায়; সাধারণত কলকাতায় বা কলকাতার মধ্যে দিয়ে কোথাও যেতে হলে কম টাকাই নিয়ে বেরুই আমি।
দিয়ে অত আনন্দ আর কখনও পাইনি। টায়েটোয়ে ফেরবার ভাড়াটা রেখে যা কিনে দিতে পারলাম—ঘি, তেল, ময়দা, সুজি, চিনি, কিছু তরিতরকারি, মাছ—তাতে একটি কুলি করতে হোল। ওরা আর কোন কথা কইলে না; বুঝছি বিশ্বাসে-বিস্ময়ে বেশই অভিভূত হয়ে পড়েছে।
ফেরবার সময় সেই মোড়টাতে এসে বললাম— “এবার তোমরা যাও, মুটেকে সঙ্গে নিয়ে, এই পয়সা কটা ওকে দিয়ে দিও। আমার যাবার সময় হয়েছে।”
কথায় সাধ্যমতো রহস্যের ভার টেনে যাচ্ছি। মেয়েটি প্রশ্ন করলে— “আবার আসবেন?”
“আসব বৈকি মা-মণি, তিনি পাঠালেই আসব। এবার তোমাদের কষ্ট দেখে পাঠিয়েছিলেন, আবার হয়তো তোমাদের সুখ দেখবার জন্যে পাঠাবেন তিনি; তোমার দাদা পড়বে শুনবে, বড় হবে…”
একটু বুকে চেপে ধরে দু পা সরে এসেছি, ছেলেটি হঠাৎ এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে, তার দেখাদেখি মেয়েটিও।
শুদ্ধ অন্তঃকরণে সে প্রণাম স্বর্গীয়, মানুষের তাতে অধিকার নেই, স্পর্শ করবার আগেই তাড়াতাড়ি মনে মনে বলে উঠলাম—’শ্রীকৃষ্ণায় সমর্পিতমস্তু।’
অনুমোদন করলে না আমার সে-সন্ধ্যার মিথ্যাচারটুকু? দোষ হোল?…কেন, সে উপাখ্যানও তো অলীক; আমি না হয় সেইরকম একটি উপাখ্যান অভিনীতই করলাম।
তবুও হয়েছে দোষ? তাহলে আর করি কি?—
সে দোষও ভগবান শ্রীকৃষ্ণায় সমর্পিতমস্তু।
ওরা ওদিকে চলে গেল, আমিও স্টেশনের পথ ধরলাম। দু’পা এগিয়ে ঘুরে দেখি, ওরা যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়েছে; আবার তখুনি ঘুরিয়ে নিলে।
আমি দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম, একটু এগিয়েই একটা বেশ মোটা গাছ, তার আড়ালে দাঁড়াতে হবে, এবার ঘুরে যেন আর দেখতে না পায়।
তাহলেই তো বাড়িতে গিয়ে চোখ বড় বড় করে বলবে— “হ্যাঁ গো, সত্যি বলছি। ঘুরে একবার দেখলাম তার পরেই আর নেই, না রে যমুনা?…যমুনাকে জিগ্যেস করো, ও তো মিথ্যে বলবে না।…মধুসূদনদাদা না পাঠালে এমন কখনও হয়?”
আমার এই মিথ্যাই ওদিককার মিথ্যাটুকুকে করবে আরও পূর্ণ, আরও শুচি। সবাই করবে না বিশ্বাস, তবে করবেও অনেকে; ঠাকুরমা করবেই, হয়তো মাও করবে বিশ্বাস। অবশ্য, অনেকের মন সন্দেহ-দোলায়ও দুলবে।
একটি উপাখ্যান প্রবেশ করলে আজ এই পবিত্র গৃহস্থলীর মধ্যে—এই উপাখ্যানকে পুষ্ট করবার জন্যে ঠাকুরমার কণ্ঠে আরও সব উপাখ্যানের ধারা নামবে। তারপর ওরা দুই ভাই-বোনে বলবে ওদের সন্তান-সন্ততিকে, তারা তাদের সন্তান-সন্ততির মধ্যে দেবে এগিয়ে—এই ক’রে ভবিষ্যৎ যতদুর, আমার উপাখ্যান থেকে মিথ্যা ততই ঝরে ঝরে পড়বে, আমার উপাখ্যান সত্যের দীপ্তিতে হয়ে থাকবে শাশ্বত।
থাকবেই; আমি যে করছি বিশ্বাস। তাঁর অসীম করুণায় আমায় দিয়ে যেটুকু করালেন তাতেই আমি যে এইটেই করছি উপলব্ধি যে, তিনি এরই জন্য কোন্ সুদূর প্রান্ত থেকে তাঁর দাসানুদাসকে এনেছিলাম ডেকে।
হাত উলটে ঘড়িটা দেখলাম—এখনও তিন কোয়ার্টার সময় আছে। বড় হাল্কা বোধ হচ্ছে; এই রকম একটি দিনের এইরকম একটি সন্ধ্যাই যেন মানায়, বাঙলার একটি অখ্যাত সুদূর পল্লীতে তা আমার জন্যে ছিল গচ্ছিত, বুকে করে তীর্থসম্পদের মতই যাচ্ছি নিয়ে।
তখনও কি জানি পূর্ণতার আরও বাকি আছে?
সেই দুপাশে দুটো বাড়ির কাছে এসে পড়েছি।…তখন সেই লোকটি কি বললে? “ঐ যে যাঁর রেডিও”…নামটা কি বললে যেন…জগদীশ ঘোষ, না বোস?… রেডিও…জগদীশ…যদি বোসই বলে থাকে!…
উগ্র প্রত্যাশায় বুকটা ধক ধক করে উঠছে।…কেমন যেন মনে হচ্ছে এই নগণ্য, অনাড়ম্বর পল্লীতে সবই সম্ভব…কে জানে কত অমূল্য রত্ন আছে এর ভাণ্ডারে লুকানো! রেডিও হবে, জগদীশ বসুও হবে (যদি তাই থাকে বলে)—এত হয়েও যে শেষ পরিণাম মাত্র একজন অখ্যাত বণিক—কৈ, ফলতা কি এ ধরণের প্রবঞ্চনা করতে জানে?
হাট ভেঙে আসছে, লোক বেড়েছে পথে; একজন ভদ্রলোক; সঙ্গে নিলাম।
“কার বাড়ি বলতে পারেন?—ঐ যে রাস্তার দুদিকে।”
“জগদীশ বসুর…”
“কোন জগদীশ বসুর?… আচার্য… স্যার জগদীশ বসু… বৈজ্ঞানিক, মানে যিনি…?”
কি ক’রে গুছিয়ে যথাযথভাবে প্রকাশ করি নিজেকে? ওর উত্তরের একটু এদিক-ওদিকে যে এখুনি এক পরম সম্পদ যাব পেয়ে…বা বসব হারিয়েই।
“জগদীশ বসু, বৈজ্ঞানিক, যিনি প্ল্যান্ট অটোগ্রাফ বের করেছেন—আর ওয়্যারলেস – রেডিও—এসবও তো…আপনি থাকেন কোথায়?”
নিশ্চয় ভেতরে একটা কিছু হয়েছে যার জন্যে মুখে আমার একটা ছেলেমানুষী মুঢ়তা পেয়েছে প্রকাশ। খুব সন্তর্পণে বুকে-অবরুদ্ধ শ্বাসটা মোচন করলাম, বললাম— “না, এদিকে বাড়ি নয়, থাকি কলকাতায়।”
উত্তরটা নিজের কানেই বাজল কলকাতায় থাকে অথচ ফলতার এ বিরাট গৌরবের কথাটি জানে না, এমন মানুষও আছে নাকি! তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বললাম— “ঠিক যে থাকি কলকাতায় তাও নয়—-যাওয়া-আসা আছে…এই ন’মাস ছ’মাসে—থাকি পশ্চিমে, বেহারে…তাও অনেক দূরে…’
“ও। কেন, বহুদিন বাড়ি করেছিলেন এখানে; মাঝে মাঝে এসে থাকতেন—নিরিবিলিতে— নিজের কাজ করতেন।”
“ও।” সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়বার ভয়ে আর কিছু বললাম না।
গতিও শ্লথ করে দিলাম, লোকটা এগিয়ে যাক।
অনেকখানি যখন তফাৎ হয়ে পড়েছে, ঘুরলাম।…একটু যাওয়া যায় না ভেতরে? একটু মাটিও
স্পর্শ করা। তীর্থে এলাম, মন্দিরের দ্বার থাকবে রুদ্ধই?
লোহার ফটকটা তালা দেওয়া, লোক দেখছি না ভেতরে। আর একটু পেছিয়ে এলাম। সেই ছোট দরজাটা একটু খোলা রয়েছে।… সন্ধ্যার সময়, থাকেই লোক তো কিছু বলে না সে! একটু দ্বিধা, তারপর ভেতরে পা দিলাম।
একটু ফুলের বাগান; একজন মালী ঘুরে ঘুরে কি দেখছে।
প্রশ্ন করলাম— “ভেতরে আসতে মানা আছে কি?”
বাঙালি মালী (এও দুর্লভ দৃশ্য) বললে— “আজ্ঞে মানা কিসের? আসুন না।”
“এটা কার বাড়ি?”
তারপর পাছে যা শুনে এসেছি সেটা কোন অজ্ঞাত রহস্যে উলটে যায়, নিজেই তাড়াতাড়ি জুড়ে দিলাম— “জগদীশ বসুর—যিনি রেডিও, বেতার—এইসব করেছেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ তুলে দেখলাম চারিধারটি। সামনেই গঙ্গার ওপর বাড়িটা, চারিদিকে বাগান, কয়েকটি বেডে (bed) ভাগ করা, দু’ধারে ইটের পাড় দেওয়া রাস্তা। ভরা গ্রীষ্মে গাছগুলার খুব জুৎ নেই, তবু যত্ন আছে বোঝা যায়। সমস্ত জায়গাটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। একেবারে বাঁদিক ঘেঁষে ছোট একটি পুকুর; বেশ গভীর বোধ হোল, এদিকটায় পদ্মের লতা, ওদিকে শাপলা, রাঙা, সাদা—দুরকমই। রাঙা কতকগুলো ফুটে রয়েছে।
কেমন যেন মনে হচ্ছে স্বপ্নের ঘোরে রয়েছি।
তবে, বেশ সুস্থ অনুভব করছি। বাইরের সেই সঙ্কোচটা নেই; সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়বার সে লজ্জাটাও নেই। ভয়, সঙ্কোচ, লজ্জা, ও-সব সভ্যতার রোগ। দেয়ালের বাইরে রেখে এসেছি। যেখানে সহজ সেখানে সবই সহজ। সেই জন্যই তো বদনের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পেরেছিলাম অত অনায়াসে; সেই জন্যেই তো নারাণীর সংসারে অত শীগগির অত নিরবশেষ হয়ে মিশে যেতে বাধে নি।
হুঁশ হোল লোকটা নিড়ানি হাতে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে চেয়ে আছে, আমার মতন তারও তো বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে যাবার কথা, সন্ধ্যায় হঠাৎ এই নতুন ধরণের অভ্যাগত দেখে। কিছু বলা দরকার।
প্রশ্নের খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে আগেকার প্রশ্নটার পুনরুক্তি করলাম, কতকটা সময় নেবার জন্যে— “তাহলে…তাঁরই বাড়ি এটা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“এখন তাহলে কাদের দখলে?…কে হন তাঁরা বসুমশাইয়ের?…যাওয়া-আসা আছে?… থাকেন কোথায়? কলকাতায়?”
—একটার গায়ে একটা ক’রে যতগুনো প্রশ্ন এসে গেল মনে সবগুনো বের করে দিলাম।
উত্তরের জন্যে তত মাথাব্যথা ছিল না তখন, ও যতক্ষণ বলবে আমি দাঁড়িয়ে একটু দেখে নোব—সেইজন্যে কি বলে গেল মনে নেই স্পষ্ট, বোধ হয় ওর শেষ হবার আগেই প্রশ্নটা করলাম— “একটু থাকতে পারি এখানে?—-এই খানিকক্ষণ…”
“আজ্ঞে—এখানে তো…” লোকটি ভালো, একটু যে অপ্রতিভভাবে হেসে মুখের দিকে চাইলে তাতে দ্বিতীয়বার আমার সম্বিৎ এল ফিরে, হেসেই বললাম— “ও! না, সে থাকা নয়। আমি একটু দেখতে চাই জায়গাটা ঘুরে ফিরে, একটু বাড়িটার বারান্দায় উঠে বসতাম— আপত্তি না থাকে তো….
বুঝেছি এই অদ্ভুত আচরণের গোড়ার কথাটাও বলে দেওয়া ভালো, একেবারেই সোজা এসে পড়লাম—
“কথাটা হচ্ছে—তুমি নিশ্চয় জানও—যাঁর বাড়ি তিনি আমাদের দেশের মস্ত বড় একজন মানুষ ছিলেন—ছিলেন তো?…আমি এসেছি অনেক দূর থেকে—ফলতায় এই প্রথম এলাম — এইখান দিয়েই যেতে যেতে শুনলাম এটা তাঁর বাড়ি—তাই—দেশের একজন অত বড় লোক- যখন ভাগ্যক্রমে এসেই পড়েছি…”
এদের কাছে সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ার লজ্জা নেই বটে, কিন্তু গুরুত্বটা উপলব্ধি করানোও তো শক্ত; কি ভাষায় করি প্রকাশ?
সেন্টিমেন্টেরই আশ্রয় নিলাম ভালো ক’রে, বললাম— “একটা তীর্থই তো আমাদের পক্ষে, নয় কি? বলো না।”
“আজ্ঞে, তা বৈকি, তিখি ব’লে তিথি!”
কতদূর জানত তাঁকে জানি না, তবুও একজনকে এত বড় করে বলতে দেখে, সাধ্যমতো আর একটু রঙ চড়িয়ে সমর্থন করলে। এইতেই আমাদের আত্মীয়তা দাঁড়িয়ে গেল। ধূর্তেও এক শুনলে দশ ক’রে ব’লে, কিন্তু এদের তো ঠিক সে ধরনের বলা নয়, এ আমার কথাটাকে নিগূঢ় বিশ্বাসে অন্তর দিয়ে করেছে গ্রহণ, তারপর মনের পূর্ণতায় বলেছে।…আমার সেদিন অনেক সাধারণভাবে দরকারী প্রশ্নই জিগ্যেস করা হয়নি—কতদিনের মালী, তাঁকে দেখেছে কিনা—এমন কি নাম পর্যন্ত হয়নি জিগ্যেস করা; তবুও কতকটা তো জানাই সম্ভব,—একটা গৌরব-বোধ ছিলই কোথাও, আমার শ্রদ্ধাবাণীতে সেটুকু জেগে উঠেছে।
মুখটি হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল।
বললে— “তা দেখবেন বৈকি—দেখুন—দেখলে তো কেউ আর মাটি তুলে নিয়ে যাচ্ছে না…”
আজ আমার ভুল হবে না কিছু, কোনখানেই খুঁৎ থাকবে না, কে যেন নেপথ্যে থেকে খেই ধরিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সেই Law of Association তোমাদের মনোবিজ্ঞানের,—আমি পা বাড়িয়েছিলাম, ওর কথাটা শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম—দৃষ্টিটা পুকুরে ফুটন্ত রাঙা শাপলার ওপর গিয়ে পড়েছে, একটু হেসে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললাম— “তোমার ঐ তুলে নিয়ে যাবার কথায় মনে পড়ল,—একটা ভুল হয়ে যাচ্ছিল না?…নিয়ে যেতে হয় বৈকি তুলে, তীর্থের মাটি কপালে লাগিয়ে নিয়ে যেতে হয় না?”
“আজ্ঞে তা হয় বৈকি, বলে তিথিই যখন…”
“তাহলে তোমায় একটা কাজ করতে হবে বাপু…সন্ধে হয়ে গেছে, বলতে একটু কিন্তু হচ্ছি— ঐ শাপলার লতা আমায় যদি একটা তুলে দিতে পার গোড়া থেকে—আমি বকশিশ করব— আমারও পুকুর আছে—বসিয়ে দোব—লোভের হেতুটা বুঝতেই তো পারছ—যখন এতে ক্ষতি নেই তোমার বাগানের…”
“আজ্ঞে, ধারে ধারে জঙ্গল শাপলার—আমি নে’লুম এইক্ষেতিই বা কি আর, বকশিসেরই বা কি আছে এতে?”
.
ক্লান্তি এসেছে; অনেক পাওয়ার ক্লান্তি, একটা অবসাদ। হ্যাঁ, আজকে অনেক কিছুই তো পেলাম—অনেক—অনেক…দু’হাত তুলে কে আমায় দিয়ে গেল, ব’য়ে উঠতে পারছি না।… সুখ আছে, আনন্দ আছে, উল্লাস আছে; অশ্রু আছে, শঙ্কা আছে, সঙ্কোচ আছে; শুধুই সুখ নিয়ে করতাম কি?
আজকের দিনটা আমার সমস্ত জীবনের প্রতীক, একটি দিনে যেন সমস্ত জীবনের প্রতিবিম্ব এসে পড়েছে, যে জীবন প্রায় কাটিয়ে শেষ করে উঠলাম,—প্রভাতটি ছিল প্রশান্ত, দ্বিপ্রহরে উগ্র, তারপর এই সৌম্য গোধূলি। আমি কিন্তু সেদিকটা ভাবছি না—আমার আনন্দ, তাপদগ্ধ দ্বিপ্রহরেও প্রতি মুহূর্তে আমি জীবনকে এসেছি পেয়ে, জীবনের পথে সব মাটি মাড়িয়ে এসেছি আমি। ক্লান্তিতে নিঝুম হয়ে পড়িনি এতটুকুও। আমার পরমায়ুর একটি কণিকাও হতে দিই নি অপচয়।
ক্লান্তি তো তাপেই নয়, তাপের মধ্যেই তো জীবনকে সক্রিয়ভাবে এলাম পেয়ে— বাস্তবে কল্পনায়—বদন—ঠাকুরপুকুর—উদয়রামপুরে সেই শিশুর স্বর্গ—গৃহী-ফকীর নবাবজান—আমতলার হাট—নারাণী—সেই মৃত্যুবাসর—চলার পথে শত-বৈচিত্র্যের জীবন আমার—তার আশীর্বাদ; সব কিছুর মধ্যেই ভূমা-মহিমায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করে ধরেছেন আমার চোখের সামনে।… ক্লান্তি কখনও আসতে পায়?
ক্লান্তি এসেছে এইবার,—যখন যাত্রাশেষে এই দক্ষিণের হাওয়া এসে লাগছে। ক্লান্তি তো খেলার সময় নয়, ক্লান্তি, মা যখন নরম হাত বুলিয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে দেন, অঙ্কে তুলে নেবেন বলে। দক্ষিণের হাওয়ায় সেই আমার মায়ের নিঃশ্বাস…যাওয়ার স্বপ্ন এইবার আমার চোখে ঘনিয়ে আসছে।
****
বাগানটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে নিই না। গাড়িটা ছেড়ে যেতে পারে? তা যাক, এমন করে সামনের ভাবনা আর পেছনের ভাবনা একসঙ্গে ভাবা যায় না; একটা রাত না হয় আকাশের চন্দ্রাতপতলেই যাবে কাটানো, তা-ই যারা কাটাচ্ছে তাদেরও তো কেটে যাচ্ছে,—কি রকম করে, – মন্দে, কি আরও ভালোয় সেইটুকুই না হয় দেখা যাবে।
বাগানের একটা মৌন ভাষা আছে না? এই নৈমিষের ঋষিই তো একদিন পেয়েছিলেন সন্ধান…একপ্রস্থ ফুল এসেছে শুকিয়ে, ঝরে পড়ছে—মরশুমী ফুল—পিঙ্ক, এসটার, পিটোনিয়া, ডালিয়া। কিন্তু, দুঃখ কি তার জন্যে?—এই ঝরে পড়াই তো বাগানের শেষ কথা নয়।
ঐ যে মল্লিকার ঝাড়ে মুক্তাবিন্দু দিয়েছে দেখা, কুঞ্চিত কলির-স্তবক মাথায় করে রজনীগন্ধার শীষ আসছে বেরিয়ে…বাগানের এই হোল মৌন বাণী আজ আমার কাছে—তার নিজের ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখের অটোগ্রাফ নয়, সে শোনাচ্ছে জগৎ-সত্য,—ভাবনা কি? নবীন আসছে নবসজ্জায়, নবোল্লাসে, তোমার মরশুম যখন ফুরিয়েছে, প্রসন্ন দৃষ্টি নিয়েই বিদায় নাও না…
এই বাণীই নিয়ে বারান্দায় উঠে—একেবারে ওদিকে গঙ্গার ধারটিতে গিয়ে বসলাম। মালী গেছে পুকুরধার থেকে শাপলার চারা তুলে আনতে।
বড় অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছি, নিজেই যেন নিজের নাগাল পাচ্ছি না…হাওয়া উঠেছে, ঢেউ উঠেছে—তারই দোলায় মনটা যেন কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে ভেসে—কত দূর-দূরান্তে—কোন্ যুগের উপকূলে…ঐ তো সগররাজার শতপুত্র ভাগীরথীর পুণ্যস্পর্শে সঞ্জীবিত হয়ে উঠল—ঐ তো সাগরসঙ্গমে মহামুনি কপিলের আশ্রয়।…মিলিয়ে গেল—যুগও গেছে পালটে—চন্দ্রবর্ণ বিদেশী বণিকের দল—লুণ্ঠন, অত্যাচার—তার সঙ্গে কল্যাণও আছে বৈকি—সংঘর্ষে সে অগ্নি জ্বলল, তাতে হোমের কুণ্ডও যে হোল প্রজ্বলিত—ধর্মে রামমোহন-রামকৃষ্ণ, কর্মে বিবেকানন্দ-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম এনেছে নূতন ভাষা…ঐ কপিল আশ্রমেরই কাছাকাছি কোথাও সন্ন্যাসিনী কপালকুণ্ডলার কণ্ঠে সেই ভাষার কলি জেগে উঠল— “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
—হারানো পথ খুঁজে পাবারই নবযুগ এসেছে।
যাবার আগে আমার মনটা যেন নতুন করে মাকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছে—সেই দেশমাতৃকাকে, যাঁর কোলে নিয়েছিলাম জন্ম। মনটা টনটন করে উঠছে, কোনও বাণীতেই সান্ত্বনা দিতে পারছে না—যেতেই তো হবে ছেড়ে এবার…
আমার পাশে এসে বসলেন একজন সৌম্য পুরুষ—শ্যামকান্তি, পূর্ণ মুখমণ্ডল, প্রশস্ত ললাট বেষ্টন করে মাথায় দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ, প্রতিভাভাস্বর প্রশান্ত নয়ন।
“আমার এই বাগানের যা বাণী তা তোমায় দেখছি, সান্ত্বনা দিতে পারছে না।”
“অস্বীকার করতে পারছি কৈ, দেব?…আপনি অনন্ত প্রাণের সন্ধান দিলেন, কিন্তু মৃত্যুই কি অনন্ত নয়? তারই ছায়া যে এল ঘনিয়ে…”
“মৃত্যু নেই…”
“বেশ, মৃত্যু বলব না, কিন্তু সেই রূপান্তর–পরিচিতের সঙ্গে নিত্য বিচ্ছেদে—সেও যে কত মর্মন্তুদ!…”
“সে অর্থে রূপান্তর তো নেই—-রূপে রূপে একই অনন্তরূপ হচ্ছে পূর্ণ…”
“ঐ তো সূর্য—সকালে এক, দুপুরে এক, সন্ধ্যায় এক—তারপর সে তো মৃত্যুই–না হয় আবার হোলই পুনর্জন্ম…”
“তোমায় আশীর্বাদ, বেশ একটা ভালো উদাহরণ নিজেই তুমি হাতে তুলে দিলে। ঐ সূর্য মৃত্যুহীন—এমন কি পরিবর্তনহীনও…প্রতি মুহূর্তে ঐ একই সূর্য উষার প্রসন্ন দীপ্তিতে, মধ্যহ্নের প্রচণ্ড জ্বালায়, আর গোধূলির ম্লান বিষণ্ণতায় রয়েছে মূর্তি ধরে—একই সূর্য একই ক্ষণে হচ্ছে উদয় আবার যাচ্ছে অস্ত…লোকোত্তর জগতে এসে আমি এই সত্য আরও পূর্ণভাবে করছি উপলব্ধি—বিলুপ্তি নেই—বিকৃতিও নেই…কোটি মন্বন্তরে যদি ঘটেই বিলুপ্তি তো কে জানে তা কোন্ অজ্ঞাতলোকে আবার পূর্ণতর হয়ে বিকাশেরই অন্য দিক, যেমন সন্ধ্যা অন্য দিক প্রভাতের…না, যে-প্ৰাণকে আবিষ্কার করেছিলাম—লতায়-গুল্মে-শিলায় সে-ই শাশ্বত—লোকে দেখবে তুমি ছেড়ে এলে, কিন্তু তোমার দৃষ্টি লোকোত্তরেই আবদ্ধ থাকবে না কেন?—অনন্ত কাল নিয়ে তুমি যে একই আধারে শিশু-কিশোর-যুবা-প্রৌঢ়-স্থবির—একই মহাকালে যে তোমার জন্ম-জন্মান্তর—সমস্ত বিশ্ব নিয়ে যে তোমার দেশ-দেশান্তর—তবে…?”
****
আঃ, এই মহাসঙ্গীতের গায়ে আবার সেই ফিরে যাওয়ার বংশীধ্বনি! ফলতা মেল শেষে এমন করে বাদ সাধলে?
ব.ভ.ম.