গোটা দুই স্টেশন গিয়ে গাড়ি প্রায় খালি হয়ে গেল। কি ভেবে ছেলেগুলো সব উঠে গুপীর কাছে চলে গেল। খানিকক্ষণ উত্তর-প্রত্যুত্তরটা নাতনীদের মধ্যস্থতায় চলল, তারপর রতনের-মা’র গলা একটু একটু করে খুলল, আর মধ্যস্থতার দরকার রইল না। সকলে যখন শাড়ি আর কাপড়ের খুট ধরাধরি করে মাঝেরহাট স্টেশনে নামল, তখন নারাণীর গলাও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। গ্রামের মেয়ে, লজ্জার ভাগটা কখনই বেশি ছিল না, যেটুকু বা ছিল, আহ্লাদের চোটে, চারিদিকের বাক্যস্রোতের তোড়ে সেটুকুও ভেসে গেল। দলের একটা হুল্লোড় আছে তো?
তা ভিন্ন সে না বাড়ির গিন্নি—রতনের-মায়ের পরই? তার না রতনের মতন সমর্থ ছেলে, অনঙ্গর মতন মেয়ে, তিলির মতন সমর্থ নাতনী?
শেকলের মতন হয়েই সকলে ট্রামে উঠল। খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তার পরেই মুখর হয়ে ওঠে, কর্তা হিসাবে গুপী ধমকায়, ভয় দেখায়, বোঝায়। কথা কয় না শুধু পাল-বৌ, সে যেন শক্তিসঞ্চয় করছে—একেবারে চরম প্রয়োজন না হলে মুখ খুলবে না। এইভাবেই কালীঘাটের ট্রামে বদলি হয়ে শেষে ট্রাম-ডিপোয় এসে নামল।
সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডার হাতে পড়ল, আদি গঙ্গায় স্নান হোল, আহার হোল, তারপর গুপীকে একটু আড়ালে পেয়ে নারাণী বললে— “এইবার আসল, যার জন্যে আসা, তার ব্যবস্থা করো।”
গুপী জিভ্ কেটে, যাতে কথাটা মন্দির পর্যন্ত না পৌঁছায়, এইভাবে বললে— “ও কথাটা আর এখানে দাঁড়িয়ে বলিস নে। আসলে তো এই তিথি করতেই আসা, তিথির চেয়ে আর বড় কি আচে এই ছাই সংসারে?”
—একবার মন্দিরের দিকে আড়ে চেয়ে দৃষ্টিটা টেনে নিলে।
মা-কালীর এলাকার মধ্যে নারাণী আর প্রতিবাদ করলে না বটে, কিন্তু আসল কথা তো তা নয়; এমন কি, শুধু কলকাতা দেখাও নয়, কলকাতার মধ্যে যেটুকু আসল কথার অংশ ছিল, সেটুকু উবেও এসেছে এর মধ্যে—ভিড়ে, চেঁচামেচিতে, নানা রকম গাড়ির হিড়িকে প্রতিপদেই মোড় ফিরতে ফিরতে।…একেবারে আসল কথা বায়স্কোপ। সে নাকি এক আজব জিনিস, কলকাতা শহরের চেয়ে আরও আজব—ছবির লোকেরা হাসে, কাঁদে, নাচে, গান গায়, গাড়ি হাঁকায়, দাড়ি কামায় – হেন জিনিস নেই, যা করে না। বাড়ির মধ্যে দেখেছে এক গুপী, বড়ছেলে আর মেজছেলে। বড়বৌও বলে দেখেছে, শহরের কাছের মেয়ে কিনা, কিন্তু ওর দেমাকের জন্যে ওর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না কারুর।
জিনিসটা সেদিন এসেছিল ওদের মীরগঞ্জে—দাঁয়েদের বড়কর্তার মেয়ের বিয়েতে, তা সামন্তদের সঙ্গে তো ওদের জমি নিয়ে ঝগড়া তখন, কারও দেখা হয় নি।
কলকাতা দেখার কথাটা পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারাণী বায়স্কোপের কথাটাও পাকা করে নিয়েছিল; শেষে আলোচনায় ঐটেই আসল কথা দাঁড়িয়েছে। নারাণী বলে— “শুনতেই সামন্তের পরিবার—অনেকের আবার চোখ টাটায়, বলে আদুরী, তা আদর তো কত! তুশ্চ একটা বায়স্কোপ নিয়ে মীরগঞ্জের এতটুকু মেয়ে পর্যন্ত য্যাখন বড়াই করে, লজ্জায় মাথা তুলতে পারি নে; বড়বৌমার দেমাকের কথা বাদই দিন।”
গুপী ভাবে, না হয় আর একটা আবদার, বায়স্কোপের ওপর তো আর উঠবে না, এই তো শেষ, বলে— “তা এবার তুইও বলবি—একেবারে কলকাতার বায়স্কোপের কথা; মীরগঞ্জের কে তোর সামনে দাঁড়ায় দেখিস না।”
কিছু কেনাকাটা করে, চিড়িয়াখানাটা সেরে সন্ধ্যার একটু পরে সামন্ত পরিবার ভবানীপুরের একটা সিনেমার সামনে ট্রাম থেকে নামল। গুপী থেকে আরম্ভ করে ছোট নাতিটি পর্যন্ত তেরজন। বেটাছেলেদের গায়ে একটা করে পিরান, কাপড়-জামার খুব বেশি মিল নেই, হাতে একজোড়া করে নতুন জুতো, সেজ ছেলেটি পায়ে দিয়ে মুখ কুঁচকে খোঁড়াচ্ছে। গুপীর গায়ে একটা নতুন ফতুয়া, এখানেই রাস্তার ধারে কিনলে। পরনে ক্ষারে-কাচা কাপড়। বাড়ি থেকে পুরনো জুতোটাই পরে এসেছিল, অনেক জায়গায় তালি পড়েছে বলে কালীঘাটের বাসাতেই চাবি বন্ধ করে এসেছে; ঠিক করেছিল একজোড়া কিনবে, তা পায়ের মাপের পাওয়াই গেল না ক’টা দোকান ঘুরে। খালি পায়েই আছে।
বৌ আর মেয়েদের পরনে নীল, সবুজ বা ময়ূরকণ্ঠী সিল্কের শাড়ি, বোধ হয় বেশি তোলা থাকার জন্যে একটু করে রঙ-চটা, গায়ে মোটা মোটা রূপোর গয়না, ক্বচিৎ ছোটখাটো এক-আধটা সোনার, ভ্রুর মাঝখান থেকে মাথার ব্রহ্মতল পর্যন্ত টানা তেলে-গোলা সিঁদুর। নারাণীর চাকচিক্যটা ওরই মধ্যে একটু বেশি।
সিনেমা আরম্ভ হয়ে গেছে, টিকিট-ঘরে ভিড় না থাকলেও কিছু লোক আছে। কয়েকজন পরের শো’র টিকিট কিনছে, কয়েকজন এমনি ঘুরে-ফিরে দেয়ালের ছবিগুনন দেখে বেড়াচ্ছে।
সেই রকম শাড়ি-ধুতির খুঁট ধরাধরি করে সকলে টিকিট-ঘরের একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। যা দেখে, তাই নতুন, উৎসুক প্রশ্ন-মন্তব্যে ছোটদের মধ্যে একটু সোরগোল পড়ে গেল। রতনের-মা প্রভৃতি সঙ্কুচিত হয়ে রইল, তবে পাল-বৌ সবাইকে ধমকে, শহর জায়গায় কি করে চলতে হয় উপদেশ দিয়ে গোলমালটা আরও বাড়িয়ে তুললে। কলকাতায় পা দেওয়ার পর থেকে তার মুখ খুলেছে।
গুপী কাউন্টারে গিয়ে বললে— “টিকিস দেন বাবু—তেরজনের।”
ঘুরে মোটা গলায় জিগ্যেস করলে— “ তেরজনই তো বটে গা? আর একবার গুণে দেখবেনি, বলি ও পাল-বৌ?”
পাল-বৌ ঘরের ও-প্রান্ত থেকে সেই রকম গলাতেই উত্তর দিলে— “বালাই, ষাট, থেকে থেকে মানুষ গোনে কখনও? যত অলুক্ষুণে কাণ্ড তোমাদের বাপু! বলি গাড়িতে ক’খানা টিকিস নেছলে?”
সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল, পাশের ভদ্রলোকটি গুপীকে বললে— “একটু সরে দাঁড়াও, একি এ!”
কারুর কাছে নিচু হওয়া গুপীর ধাতে নেই, তার ওপর আবার নারাণী রয়েছে কাছে, সমস্যায় ফেলে পাল-বৌও মনটা দিয়েছে খিঁচড়ে; ঘুরে বললে— “সরে দাঁড়াবে কেন মশাই? আপনিও পয়সা দে টিকিস কিনচ, আমিও পয়সা দে…”
বুকিংক্লার্কের এতক্ষণে বাক্স্ফুর্তি হোল, বললে— “কিন্তু টিকিস যে আর নেই হে কর্তা।” গুপী
ঘুরে হাঁকলে— “বলি ও পাল-বৌ, টিকিসবাবু যে কয় আর টিকিস নেই, সব ফুইরে গেল, তার কি করচ?”
বুকিংক্লার্ক একটু তামাশা দেখবার জন্যেই বললে— “পাল-বৌকে বলো নিচু ক্লাসের টিকিস ফুরিয়ে গেছে, উঁচু ক্লাসের আছে—একেবারে উঁচু ক্লাসের।”
গুপী ঘুরে শুনে নিয়ে হাঁকলে— “বলি, শুনলে কি কয় টিকিসবাবু—কয়—নিচু কেলাসের টিকিস ফুইরে গেচে, একেবারে উঁচু কেলাসের আচে। রতনের মা কি কয়? একবার লোতুন বৌকেও সুদোবেনি?”
কাউকেও সুধানো পাল-বৌয়ের কোষ্ঠিতে লেখা নেই, সঙ্গে সঙ্গে সেই রকম গলায় ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে উত্তর দিলে— “বলি, নিচের ডালে ফল না পেলে মগডালের ফলটা তুলে নেবেনি?”
গুপী একটু অপ্রতিভ হয়ে বললে— “তা নোবনি? এ কেমনধারা কথা বলতেচ? নিচের ডালে না পেলে মগডালের ফলটা নিতে হবে বৈকি।”
ঘুরে বললে— “তবে দেন বাবু, উঁচু কেলাসের টিকিসই দেন।”
কৌতুকের সঙ্গে অবাক হয়ে যাবার ভাবটা চারিদিকেই বেড়ে গেছে, বুকিং ক্লার্ক একটু হেসে বললে— “কিন্তু এদিকে সিনেমা আরম্ভ হয়ে গেছে বাপু, পাল-বৌ, নতুন-বৌ সবাইকে জিগ্যেস করে দেখো একবার বরং।”
গুপী আবার ঘুরল— “বলি, অ-পাল-বৌ, বাবু যে কয় উদিকে শুরু হয়ে গেচে, তার কি করচ?”
পাল-বৌ এবার একটু রেগেই বললে— “তোমরা শহর জায়গায় এসব ফ্যাসাদ ঘাড়ে করে এসে আর নোক হাসিওনি বাপু। বলি, নেমন্তন্নটা শুরু হয়ে গেলে ফিরে এস, না…”
“তা কি ফিরে এসি? বলি, তাকি ফিরে এসি?” – বলে অপ্রতিভভাবে আবার ঘুরে গুপী বললে— “তাহলে দেন, ঐ শুনলেন তো?”
জটলা বেশ জমেছে। মন্তব্যও শুরু হয়ে গেছে নানারকম – “পাটের টাকা মশাই! দিন কত উঁচু ক্লাসের আছে আপনার, কত্তাকে মটকায় বসিয়ে দিন একেবারে।…বাড়িটাই কিনে নাও না হে কত্তা, টিকিট কেনবার ল্যাটাই চুকে যাক।…গোটা কতক বক্স গছিয়ে দিন না, আছে খালি?…পাল- বৌয়ের সিমিলিমেটাফোরগুনো কি জোরালো দেখছ! আর হাঁ করতে দিলে না কত্তাকে!”
সামন্তের ভ্রুক্ষেপ নেই।
বুকিংক্লার্ক সেই রকম অল্প হাসতে হাসতেই বললে— “তাহলে ঠিক ক’রে গুণে বলো কতগুনো দিতে হবে; আন্দাজে তো আর দেওয়া যায় না।”
গুপীর বোধহয় সাহস কমে আসছিল পাল-বৌকে ঘাঁটাতে, তবু নিরুপায় হয়ে জিগ্যেস করলে— “ঐ শুনলে টিকিস-বাবু কি জিগ্যেস করচেন তোমায়, বলি অ-পাল-বৌ? একবার না গুণলে চলবে না যে, তার কি করচ?”
গুপীর সেজ ছেলে ভগীরথ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল, বললে— “আমি গুনে দেব বাবা?”
“তোদের ঠানদিদিকে সুদো।”
পাল-বৌ বললে— “তবে এক গরু, দু গরু করে গোন; খবরদার ‘জন’ বলবি নি। জানি নে বাপু, যেমন বড় মুখ করে নিয়ে এনু, তেমনি ভালয় ভালয় ফিরিয়ে নে যেতে পারি সবগুনোকে, তবেই…”
প্রবেশ-পর্ব আরম্ভ হোল।
.
এদিকটা, অর্থাৎ শিবানীপুরের পর থেকে আবার অন্য রকম। হোক অল্পটুকু, তার মধ্যে কিন্তু ফলতা লাইনের দৃশ্য-বৈচিত্র্য আছে; ঘোলসাপুর-ঠাকুরপুকুর অর্থাৎ বেহালা-বঁড়শের খিড়কি দিয়ে যেখানে পথ কেটে এসেছে সেখানটা জঙ্গুলে,—সবুজের সঙ্গে যেন মাখামাখি করতে করতে বেরিয়ে এল গাড়িটা; তার পরেই ডায়মন্ডহারবার রোডের মুক্ত প্রাঙ্গণ, নবীন এসে এই সবে নব উৎসাহে পা ফেলেছে;–বাড়ি বাগান, শহর উঠেছে গড়ে, গাঁয়ের বৌ সেজেগুজে যেন চলেছে কলকাতায়। শিবানীপুর থেকে ভাবটা বদলাল। ডান দিকটা প্রায় ফাঁকা, বাঁ দিকে দূরে কাছে একটার পর একটা গ্রাম। একটা বাঙলার পুরনো গ্রাম, ভদ্রপল্লী, বড় বড় নানারকম গাছ, ডোবা, মজা পুকুর, ইটের পুরনো বাড়ি—দোতলাও আছে তার মধ্যে, ঘন গাছপালার মধ্যে খানিকটা আত্মগোপন করে— পতিত অভিজাত কোঁচার ভাঁজে ছেঁড়া নুকুবার চেষ্টা করছে।
গ্রামের বাইরে একটা ইঁটের পাঁজা, জীর্ণ হয়ে গলে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। মাথায় একটা অশত্থ, নিতান্ত ছোট নয়।…একটা আনন্দ-মুখর গৃহ গড়ে ওঠবার কথা ছিল কোন্ দূর অতীতে; তারপর পায়নি গড়ে উঠতে; কে জানে কত আশা-নিরাশার কাহিনী সে।
পুরনো বাঙলার গ্রাম ইতিহাসের ছেঁড়া বই, একটু ইঙ্গিত দিয়ে খেই হারিয়ে চলেছে…তাই তো আরও টানে—আলো-আঁধারিতে আলেয়া, ক্রমাগতই খুঁজে চলো, ক্রমাগতই খুঁজে চলো।
স্টেশন এল দীঘির-পাড়। এই আবার আলেয়ার আলো ঝলকে উঠেছে। কার দীঘি? কি তার কাহিনী? খুঁজে দেখো—কোথায় হাজা দীঘির দামের নিচে, পাড়ের জঙ্গলে পুরনো বাঙলার রূপ-কথা আছে চাপা দেওয়া—রায়েদের প্রতাপ, মুর্শিদাবাদের অর্ধসুপ্ত নবাবের হুঙ্কারের এক আধটা আওয়াজ এসে পৌঁছচ্ছে মাঝে মাঝে, ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের এক আধটা কাহিনীর টুকরো।… বহু দূর ঐ যে টানা নাবাল জমিটা এঁকেবেঁকে বেরিয়ে গেছে, হয়তো ছিল গঙ্গার শাখাই, ওলন্দাজ-পর্তুগীজদের বোম্বেটে ওরই ওপর দিয়ে এসে দিত হানা, ক্বচিৎ আরাকানী মগ, দীঘিরপাড়ের রায়েদের ছিপ থাকত অতন্দ্ৰ প্রহরায় তাদের জন্যে ওৎ পেতে…
জীবন্ত বাঙলার রোম্যান্স,—তার কায়া নেই, আছে ছায়া! মন্দ কি?—ছায়াতে মায়া জাগায় আরও বেশি ক’রে, তারই টানে আসে বঙ্কিমের দল—মাটির রোম্যান্সকে বইয়ের পাতায় অমরত্ব দেয়—দুর্গেশনন্দিনী—সীতারাম—এই রোমান্সই রূপান্তরিত হয়ে ওঠে নববেদ-এ–আনন্দমঠের নব-সুক্ত ‘বন্দে মাতরম’ : রবাহূত হয়ে জেগে ওঠে অরবিন্দ-সুভাষেরা।…বটমূলদীর্ণ-বাঙলার পল্লীগুনোকে অবহেলার চোখে দেখো না।
এক ধরণের মৌন বেদনায় মনটা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে, দিনের আলোটাও আসছে আস্তে আস্তে মলিন হয়ে। নাঃ, এ সময় পুরনো বাঙলার পুরবীকে প্রশ্রয় দিলে আমার অমন গল্পটাকে আর মাথা তুলতে দেবে না। থাক এখন, গুপী-নারাণীদের টিকিস কেনা হয়ে গেছে ওদিকে, আমার মাথার মধ্যে কোথায় সিনেমার দরজার সামনে উদগ্রীব হয়ে আছে দাঁড়িয়ে—
বলছিলাম—প্রবেশপর্ব আরম্ভ হোল। প্রথমে সবার হাতে হাতে টিকিট থাকবে কি একটা সামন্তের হাতেই থাকবে সেই নিয়ে একটা সমস্যা উঠল। সেটা পাল-বৌয়ের একটা উপমায় সমাহিত হয়ে গেলে সবাই দরজার গোড়ায় গিয়ে জমা হোল। গুপী টিকিটগুণো দিয়ে একপা ভেতরে সাঁদ করিয়েই সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এল। পূর্বে যে দুবার গেছে, আলোয়—আলোয় গেছে, মুখটা অন্ধকার করে বললে— “ভেতরে যে অমাবস্যের আঁধার, তার কি করচ, বলি হ্যাঁ পাল-বৌ?”
টিকিট-চেকার বুকিং-ক্লার্কের পানে চেয়ে একটু ঘাড়টা নাড়লে—অর্থাৎ বাধিয়েছেন ভ্যালো এক ফ্যাসাদ! গুপীকে বললে— “কিছু ভাবনা নেই গো কত্তা, ভেতরে আলো দেখিয়ে নিয়ে যাবে, চেঁচামেচি কোর না কিন্তু। এস, এক একজন করে ঢোক।”
ভেতরের গাইডকে বলে দিলে— “একটু কেয়ারফুলি নিয়ে যান।”
পাল-বৌ লাইনটা ঠিক করে দিলে। প্রথমে থাকবে সামন্ত, তারপর নিচের দিক থেকে বয়স হিসাবে ছেলেরা, তারপর বয়স হিসাবে ছোট মেয়েরা, তারপর নারাণী, অনঙ্গ, রতনের-মা; সবশেষে পাল-বৌ পাকা রক্ষী হিসাবে। খুব সাবধান করে দিলে— “কেউ কাউকে ছাড়বি নি, খবরদার! এ মীরগঞ্জের কার্তিক পুজোর মেলা নয়।”
টর্চ জ্বেলে গাইড সামনে চলেছে। জনচারেক যখন ভেতরে গিয়েছে গুপী সাড়া পাবার জন্যে হাঁক দিলে— “ভগা আচিস? তিলি আচিস? লক্ষ্মী আচিস? ন্যাংটা আচিস?”
“সাইলেন্স! সাইলেন্স! চুপ করুন! চুপ কর!”—করে সমস্ত ঘরের মধ্যে একটা কলরব উঠল। এদিকে ভয়ে কচি ছেলেমেয়েগুনো গলা ছেড়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে; এক মুহূর্তেই অন্ধকার ঘরটা আবার উৎকট হয়ে উঠল। একে অন্ধকার, তায় এই ব্যাপার, সামন্ত ঘাবড়ে গিয়ে আরও গলা তুলে হাঁকলো— “পাল-বৌ আছ?—বলি, অ পাল-বৌ, লোতুন-বৌ আচে? – বলি, রতনের মা…?”
কলরব উঠল যেন ছাদ ভেঙে পড়বে— “চুপ কর!… ঘাড় ধরে বের করে দাও!…স্ট, স্টপ্!…বন্ধ করে দাও!…আলো জ্বালো।…লাইট! লাইট…!”
সবার ওপর পাল-বৌয়ের কণ্ঠস্বরের ভগ্নাংশ শোনা গেল— “ঠিক আছি, আমার জন্যে ভেব নি…!”
এমন সময় আলো জ্বলে উঠল। এরা সবাই ততক্ষণে ভেতরে এসে গেছে, আর কোঁচার খুট না ছেড়ে গুপীর চারিদিকে মাঝখানে রাস্তাটার ওপর জটলা করে দাঁড়িয়েছে। ছেলেমেয়েগুনোর কান্না গেছে থেমে, সবাই হাঁ করে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, মুখে কারও প্রশ্ন-মন্তব্য কিছু নেই, সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে।
এদিকে প্রায় হাজারখানেক লোকের প্রত্যেকের দৃষ্টি তাদের ওপর নিবদ্ধ। নির্বাক একটা সূচ ফেললে তার আওয়াজটি যায় শোনা। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তারপরই আবার কলরবটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, যেন আরও উগ্ররূপে। “বের করে দাও! থার্ড ক্লাসের দিকে নিয়ে যাও!… কে ওদের ঢুকতে দিলে?…ম্যানেজার কোথায়?… গেআউট।….
প্রায় সব গাইডগুনোই একত্র হয়ে টানাছেঁড়া করবার উদ্যোগ করেছে— “এদিকে, এদিকে এস…না, ওদের থার্ড ক্লাসে আসতে দিন। টিকিট আছে তোমাদের?…কি করে ঢুকে পড়ল দলবল সুদ্যু?—চলো বাইরে!…”
চারিদিক থেকে থাবা খেয়ে সামন্ত একেবারে মরীয়া হয়ে উঠল। দলের সবাইকে ঠেলে সামনে এসে গলাটা একটু বাড়িয়ে মুখ খিঁচিয়ে বললে— “বাইরে, যেতে হবে! গুণে দু-কুড়ি নোট দিয়ে টিকিস কিনেচি, তার আধখানা এখনও এই মুঠোর মধ্যে রয়েছে!…বলে, কি করে ঢুকলে—বাইরে চলো!—ভারি আমার বাইরে নে’য়াবার গোঁসাই রে!”
ঘাড় ফিরিয়ে বললে— “একবার আল্লাদের কথাটা শুনে থুয়ো পাল-বৌ, —বলে বাইরে যাও।” পাল-বৌ থতমত খেয়ে গিয়েছিল, কি রাগ জমাচ্ছিল, বলা যায় না, সামন্তর কথায় কোমরে দুটো হাত দিয়ে সামন্তের চেয়েও এক পা এগিয়ে একটু ঝুঁকে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললে— “কী আমার সাতপুরুষের কুটুম রে, ওনার কথায় বাইরে যেতে হবে। হাইকোট কলকেতা দেখাতে এসেচে! আইন নেই? আদালত নেই? হাইকোট নেই? এই পাল-বৌ এসে সামনে দাঁড়াল, দেখি একবার অবলা মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে কে…”
এমন সময় ম্যানেজার এসে উপস্থিত হোল। এতক্ষণ টিকিট-ঘরে, গেটে আদ্যোপান্ত তথ্য সংগ্রহ করছিল, সম্ভবত এ অবস্থায় জবরদস্তি বাইরে বের করে দেওয়া চলে কিনা সে-সন্ধানও নিচ্ছিল। শান্ত কণ্ঠে বললে— “ওগো বাছা, থামো। বের করতে যাবে কেন? তার দরকারই বা কি? চলো দিকিন, তোমাদের জন্যে আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি, যাও এবার নিজের নিজের জায়গায় গিয়ে বসো। তাড়াবার কথা কি আছে?”
একজন গাইডকে বললে— “যাও, কত্তাকে, পালবৌকে আর সবাইকে যত্ন করে নিজের নিজের জায়গা দেখিয়ে দাও।”
এতক্ষণ দর্শকদের সবাই নির্বাক ছিল একেবারে, এরা এগুতেই প্রথম শ্রেণীর যারা একেবারে কাছের তাদের মধ্যে অতি-সৌখীনগোছের কয়েকজন প্রবল আপত্তি করে উঠল— “এখানে নয়!…এদিকে নয়!…নিচের দিকে নিয়ে যায়…!”
কিন্তু পাল-বৌয়ের অবলা-নারীত্ব তখন সম্পূর্ণ জেগে উঠেছে। “মেনীমুখোদের কম্ম নয়, তুমি পেছনে যাও।”—বলে সামন্তকে ঠেলে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার এগুতে এগুতে দুলে দুলে আরম্ভ করলে— “উঁচুর টাকা গুণে দিয়ে নিচুতে গিয়ে না বসলে সুখ হবে কেন বাবুদের! ইস, বাবু! নিফাইন ধুতি-চাদর! ফুরফুরে গন্ধ!…এই আমি বসনু, তোরাও সব বোস্ গ্যাট্ হয়ে, কোন্ বাবু ওঠায় একবার দেখি ভালো করে…”
ম্যানেজার চলে গিয়েছিল, আলো নিভে আবার সিনেমা শুরু হয়ে গেল।
.
গল্পটা আমার এখানেই একরকম শেষ হোল। কিন্তু নারাণী এখনও মনটা দখল করে রয়েছে। নাতনীকে যে ভালোবেসে ফেলেছি শুধু তাই নয়, মনে যা চাপ রেখে গেছে তাতে কেমন একটা অস্বস্তি লেগে রয়েছে যে গল্পের নায়িকা হিসেবে বেশ ভালোভাবে ফোটে নি এখনও—কি যেন বাকি রয়েছে—ও যা মেয়ে, এত সহজে সামন্তকে রেহাই দেবার পাত্রী নয়। …বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছি; তারপর ওদের দুজনের সাজগোজের কথা মনে পড়ে গেল—গল্পটা আরও একটু টেনে নিয়ে গিয়ে সামন্তকে আরও একটু নাকাল করিয়ে ছাড়া গেল।…বাঃ, মাত্র চারটি শ’ টাকা দিয়ে খালাস হবে, নারাণী আমাদের এতই খেলো নাকি?
.
বেশ খানিকটা হিড়িক গেল। টাকাও একচোট বের হয়ে গেছে জলের মতনই পুরুষানুবিক্রমে। তা যাক, সামন্তের বিশেষ খেদ নেই, আবদারের হাত থেকে রক্ষা পাবে অন্তত। একটু সুখ হয়েছে, বুড়ো বয়সে শখ করে একটা বিবাহ করলে, তা আবদারে-অভিমানে একেবারে যেন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। আর কি, রেলগাড়ি হোল, টেরাম হোল, বাস হোল, কালীঘাট হোল, সিনেমা হোল— সারা কলকাতাটাই গেল হয়ে, বাকিটা কি রইল?
প্রথম দেখাতেই কিন্তু আবার সেই মুখভার, কথা-বন্ধ। গুপী প্রথমটা তো হাঁ করেই রইল, কথা বের হবার মতো অবস্থা হলে বললে— “ব্যাপারখানা কি রে নারাণী? সবই তো হোল ট্যাকাকে তো ট্যাকাই বললুম নি।”
“ট্যাকা নিয়েই থাকো গিয়ে।”
“না হয় বলই কথাটা কি।”
অনেক সাধাসাধির পর নারাণী মুখ খুললে— “একখানা বনলতা শাড়ি আর এক জোড়া বনলতা ঝুমকো…”
“সে আবার কি? বাপের কালে তো নামও শুনিনি।”
“ঐ যে বায়স্কোপে মেয়েটা পড়েছিল—এইরকম নাক, টানাটানা চোখ…বাজারে ঐ নাম বললে পাওয়া যায়, অবিশ্যি কলকাতার বাজারে…”
“তুই নাম টের পেলি কার কাছে তাই সুদোই। ঝগড়ায় আর অন্ধকারেই তো কেটে গেল!”
মাসখানেক পরে অনেক চেষ্টায় এবং প্রচুর ব্যয়ে হোল সংগ্রহ। খুব গোপনে সরবরাহ করে সামন্ত বললে— “তেমনি কোন কিছু হলে পরবি, নুকিয়ে থো। এবার হোল তো?”
দুটো দিন কিছু নয়, আবার তৃতীয় দিনে মুখভার, অভিমান, কথা-বন্ধ। আবার খানিকটা হাঁ করে থাকবার পর যখন কথা কইবার একটু সামর্থ্য হোল, সামন্ত প্রশ্ন করলে— “আবার কি হোল রে নারাণী? সব দিলুম তো এনে, ট্যাকাকে তো খোলামকুঁচি করে থুলুম।”
“ট্যাকা নিয়ে থাকো তুমি।”
“না হয় শুনিই ভিকথাটা কি তরের?”
“তুমি অমন হেঁটু পজ্জন্ত কাপড় পরে, গায়ের ময়লা গামছা দিয়ে আর বেইরো নি।”
“তবে? চাষার ছেলে, এই করেই তো পুরুষানুবিক্রমে চলে এল রে নারাণী; বলি, তবে?”
“তবে কি? একটা পিরাণ তোয়ের করাও। গলার এখানটা বন্ধ, এই রকম বেঁকা পটির ওপর বোতাম, কনুইয়ের কাছটা খোলা, কব্জির ওপর কড়াক্কর করে চাপা হেঁটু পজ্জন্ত ঝুল। বায়স্কোপে সেই যে ফর্শা ছেলেটার গায়ে ছেল, মেয়েটার বরের। পিরু দরজির কম্ম নয়, সেই কলকাতা থেকে আনতে হবে। কে জানে, বিরুয়া পাঞ্জাবী না কি একটা নাম শুনুন যেন…কত মনে ক’রে রাখবে লোকে? বলে নিজের ভাবনাতেই মরচি।…
এবার যা হাঁ হোল সামন্তের, সহজে আর বন্ধ হোল না।
সমাপ্ত।
গল্প সমাপ্ত হলেও নারাণী কিন্তু সমাপ্ত হতে চাইছে না। একটি অনির্বচনীয় মাধুর্যে মনটা যেন আচ্ছন্ন করে আছে। এ যেন সেতারে মিশ্রতারের ঝঙ্কারটা থেমে যাওয়ার পরও একটা তারের রনরনানি আর যেতে চাইছে না।
ভাবছি কেন এমনটা হয়। নারাণী তো একলা ছিল না, আরও যারা ছিল—দোকানী, গুপী, দোকানীর নাতি, কেউ তো নিজের নিজের জায়গায় কম মধুর ছিল না, বিশেষ করে ঐ কিশোরটি, যদি মাধুর্য আর কমনীয়তার কথাই ধরা যায় তো নারাণী তো ওর কড়ে আঙুলের কাছেও লাগে না। তবু সবাইকে ছায়ায় ঠেলে নারায়ণীই রহিল উজ্জ্বল হয়ে; কেন?
Sex?…গোড়াতেই বলে রাখি Freud নিয়ে তোমাদের অত বাড়াবাড়িতে আমার মন, সায় দেয় না। কোন কোন তত্ত্ব, গড়ে ওঠবার মুখেই তাদের অভিনবত্বে ফ্যাশান হয়ে ওঠে, তাইতে তাদের পরিণতি আপাতত যায় রুদ্ধ হয়ে। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বেরও হয়েছে তাই। আমার মনে হয় এ ঝোঁকটা কেটে গেলে তখন ওর যথার্থ বিশ্লেষণ হবে আরম্ভ, তখনই সত্যের সত্যতর রূপের পাওয়া যাবে সন্ধান, Libido-র এ একছত্রত্ব আর থাকবে না।
যাক সে কথা, আমার চিন্তাটা ঠিক তত্ত্বের পথ ধরে যাচ্ছেও না। আমি ভাবছি একটা অদ্ভুত কথা— প্রশ্নগুলো অনেক সময় অদ্ভুত আকারেই ওঠে আমার মনে,—ধরো এই যে দ্বৈত ব্যবস্থা, স্ত্রী আর পুরুষ, এর পাটই নেই সৃষ্টিতে—শুধু পুরুষ আছে; কি রকম হয় সেটা? সন্তান-কোলে নতদৃষ্টিতে মা নেই বসে, স্ত্রী নেই স্বামীর পথ চেয়ে, সেবা-সুন্দর হাতে বোন নেই ভায়ের পাশে, দেহে-মনে উদগত প্রেমের অর্ঘ্য সাজিয়ে তরুণী নেই তরুণের জন্যে বরমাল্য হাতে করে।…আকাশ রুক্ষ, তাতে বিরহের হা-হুতাশের বাষ্প জমে ওঠে না, মিলনের আনন্দ ওঠে না নক্ষত্র হয়ে ফুটে। বর্ষা ব্যর্থ, বসন্ত নিষ্প্রয়োজন। ফুলের নেই কম-অঙ্গের উপমা হয়ে ফুটে ওঠবার সার্থকতা, কুঁড়ির নেই না-ফুটে ওঠবার গৌরব। সীতা নেই, দ্রৌপদী নেই, তাই বাল্মীকি নেই, ব্যাস নেই; হেলেন নেই, তাই হোমর নেই, বিয়াত্রিচে নেই, তাই দান্তে নেই; জননী-মেরী নেই, তাই জন্মাল না রাফেল, মমতাজ নেই, তাই স্বচ্ছ মর্মর পর্বতকারাতেই রয়ে গেল চিরমৃত্যুর কোলে, কালের কপোলে দুই বিন্দু অশ্রুর অমরত্ব লাভ করতে পারলে না।
বৃন্দাবনে রাধাহীন শ্রীকৃষ্ণ; গাঙ্গিনীর তীরে কার রূপ নিয়ে ঐশীশক্তি হবেন আবির্ভাব যাতে পাটনীর কাঠের সেঁউতি যাবে সোনা হয়ে?
ওরাই কেন্দ্র, ওরাই নানারূপ সৃষ্টির সংহতি, ওরাই সৃষ্টির শ্রী। এক নারাণীই পারে গৃহ হতে দূরে, পথপ্রান্তের একটি বিপণিতে মাত্র একটি ঘণ্টার অবসরে এমন করে সেবা-প্রীতি-স্নেহ-প্রেমে পূর্ণাঙ্গ একটি সংসার গড়ে তুলতে—একাধারে সখী, ভগ্নী, জননী, কন্যা, প্রেয়সী। একই শক্তি দশপূজা; প্রহরণ নয়, প্রসাদময়ী।
.
হরিণডাঙ্গায় গাড়ি বদল করলাম। একলা একলা আর ভালো লাগছে না, তবে একদিকে যেমন সঙ্গীর অভাব অনুভব করছি অন্য দিকে তেমনি আবার ভিড়ের আইডিয়াতেও মনটা সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে। অবস্থার মধ্যে যতটুকু সাধ্য অভিনবত্ব সৃষ্টি করে চলতেই আমার ভালো লাগে—তাতে ভালোও আছে মন্দও আছে, কিম্বা ভালো-মন্দের প্রভেদই নেই।
আমার মনে হয় অভিনবত্ব দিয়ে এই অল্পদিনের আয়ুটাকে অনেকখানি বাড়িয়ে নেওয়া যায়, মহাকালকে দেওয়া যায় ফাঁকি। সময়ের দীর্ঘতার দিক দিয়ে আয়ুর পক্ষপাতী নই আমি মোটেই, একটা ভদ্রগোছের মাপিকসই আয়ু পেলেই সন্তুষ্ট থাকব—অর্থাৎ যতদিন পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের—এই আজন্ম পাঁচটা সঙ্গীর আয়ু আছে অটুট। তারপরেও যে বেঁচে থাকা (থাকার আকাঙ্ক্ষা বলাই ভালো।) সেটাকে হ্যাংলামি ছাড়া অন্য আখ্যা দেওয়া যায় না। অবশ্য প্রকৃতির চক্রান্ত, উপায় নেই, তবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই হ্যাংলামির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার বের করেছিলেন একটা উপায়,—পঞ্চাশের পর বাণপ্রস্থ, তদুর্দ্ধে যতি। যারা ষোড়শোপচারে জীবনটাকে ভোগ করতে পারছে, তাদের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে আর কি হবে? মানসম্ভ্রম নিয়ে সরে পড়ো; বরং একটু নিরিবিলিতে বসে দেখো, এই বিরাট বঞ্চনার কিছু রহস্য ভেদ করতে পার কিনা। মহামায়ার মুখোশটা পার কিনা টেনে নামিয়ে ফেলতে।
যা বলছিলাম,—নিত্য অভিনবত্ব। সময় জিনিসটাকে বাড়ানো যায় না, একঘণ্টাটাকে দুঘণ্টা করা যায় না, একটা দিনকে দুটো দিন নয়, কিন্তু কালের স্থিতিস্থাপকতা রবারের চেয়েও সহস্রগুণ বেশি, একটা দিনের থলিতে কত বৈচিত্র্য যে তুমি ভরে দিতে পার তার লেখা-জোখা নেই, আর যত বৈচিত্র্য ততই নিজেকে পেয়ে নেওয়া বেশি করে।…আয়ু আর কাকে বলবে?—তার তো দুটো লেজ নেই, এই জিনিসই। আমার এই আজকের দিনটাই দেখো না, কতখানি বেঁচে, কতখানি এগিয়ে গেছি আর ছ মাস ধরে সেই যে ছটায় ওঠা, আটটায় স্নান, ন’টায় খাওয়া, দশটায় অফিস; আবার দিনগত সবরকম পাপক্ষয় সেরে রাত এগারটায় শয্যাবলম্বন — এটাকে কি মাত্র একটি দিনেরই পুনরাবৃত্তি বলব না—অনন্ত ১x১-এর গুণে টেনে যাওয়া, যা চিরকালই থেকে যাবে সেই ১-ই; ৫ বা ৫০-এর বহুত্ব-বৈচিত্র্যের কখনই পাবে না নাগাল।
আমার লেখার ঘরটা মন্দ নয়, আলো-বাতাস প্রচুর, খানিকটা শ্রী-ও আছে, কিন্তু বরাবর তার মধ্যে ব’সে লিখতে পারি না, বাগানে গিয়ে বসতে হয়। বলবে সে তো আরও ভালো— ‘শান্তিনিকেতন’; তাহ’লে যাত্রার ভাষায় আর একটু ‘প্রকাশ ক’রে’ বলি—ফুলের বাগান ছেড়ে বেগুনের ক্ষেতের ধারেও বসি মাঝে মাঝে, খালি গ্যারাজেও কখনও কখনও।
রাজসিংহাসনে বসিয়ে আমার মাথায় মুকুট দিয়ে ঘেরেঘুরে বসে থাকবার যদি কারুর অভিসন্ধি থাকে তো বলে দিও প্রথম পুরস্কার তারা যা পাবে রাজার কাছ থেকে তার নাম শূলদণ্ড। বাঃ, ওরাও আমায় আয়ুহীন করছে যে, আমার একটা দিনকে মাত্র একটা দিনের গণ্ডীতেই আটকে রেখে।
নির্জনতাও লাগছে না ভালো, ভিড়েরও ভয়—মাঝামাঝি একটা রফা ক’রে ইন্টারে গিয়ে উঠলাম। সঙ্গী পরিবর্তনও হবে একটু। ‘ইন্টার’ কথাটিও বেশ, মধ্যম, অর্থাৎ মাঝামাঝি।
দেখলাম বঞ্চিত হয়েছি; আমি যখন গুপী-নারাণী-পালবৌদের নিয়ে, ততক্ষণ এখানে চমৎকার খোসগল্প চলেছে। একটি বেশ মোটাসোটা গোছের ভদ্রলোক, কাঁচা-পাকা দাড়ি, তবে পাকাই বেশি, আসনপিঁড়ি হ’য়ে বসেছেন; তাঁকে ঘিরে পাঁচ-ছ’জন, মনে হোল যেন ডেলী প্যাসেঞ্জারই।
মজলিসী লোক আসর জমিয়ে ব’সে গল্প বলছে—এ দৃশ্য একেবারেই বিরল আজকাল। তার ভগ্নাংশ কখনও কখনও লোক্যাল প্যাসেঞ্জারগুলোয় নজরে পড়ে—যেখানে ঘর আর আপিসের মাঝখানে সেই নিরাতঙ্ক কয়েকটা মুহূর্ত থেকে কেরানীবৃন্দ একটু নিশ্চিত্ততার রস নেয় নিংড়ে— নেবার চেষ্টা করে অন্তত। তাও আবার লোক পাওয়া চাই তো,–সেরকম মজলিসী গোল্পে আর কোথায়? কোলোযুগ,—এখন গল্প পড়ো ছাপার পাতায়, গান শোনো গ্রামোফোন-রেডিওয়, নাচ দেখো সিনেমায়, টেলিভিশনও এসে পড়ল বলে; লেকচার শুনবে তাও মাইক, মিনমিনে গলাকে বজ্র-নির্ঘোষে পরিণত করার ফাঁকিবাজি।
আফসোস হচ্ছে। কটা হয়ে গেল কে জানে, আবার যেটার মধ্যে এসে বসলাম সেটারও মুড়োটা বাদই আমার ভাগ্যে। তবে সেটাও আমারই দোষে, একটা চান্স পেয়েছিলাম, কিন্তু একটু সপ্রতিভ হয়ে যে সেটা কাজে লাগাব তা আর হয়ে উঠল না।
আমি যে সেকেন্ড ক্লাসে ছিলাম, সেখান থেকেই নেমে এসেছি, এটা অনেকেই জানে। ভদ্রলোক বোধহয় গল্পে কিছু এলাকাড়ি দিয়ে থাকবেন—মাঝে মাঝে তাগাদা আদায় করাও একটা মজলিসী স্টাইল—আমি আসতেই একটি যুবা বললে— “ঐ দেখুন, উনি সেকেন্ড ক্লাস থেকে উঠে এলেন আপনার গল্প শুনতে।”
ভদ্রলোক আমার পানে চেয়ে একটু হাসলেন, যেটাকে প্রশ্নে রূপান্তরিত করলে দাঁড়ায়— “তাই নাকি?”
—সবাই একটু দুরের শ্রোতা চায় তো?
তালের মাথায় ব’লে দিলেই হয়— “আজ্ঞে হ্যাঁ এলাম বৈ কি, গোড়া থেকেই আরম্ভ করুন, একটু শোনা যাক্।” সে-সব কিছু না বলে আমিও সামান্য একটু হেসে একটা জায়গায় বসে পড়লাম। এটাকে উত্তরে রূপান্তরিত করলে দাঁড়ায়— “শোনেন কেন ছেলেমানুষদের কথা।”
তার মানে আমি গেছি রূপান্তরিত হয়ে—সেই বদনের বন্ধু কি নবাবজানের সাথী আমি আর নেই, আর সেকেন্ড ক্লাসের ছোঁয়াচ লেগেছে, যুবকটির মুখে উল্লেখটুকুর জন্যে আরও বেশি করেই।…আমি লোকটা হব খোস গল্প শোনবার জন্যে লালায়িত? — সেকেন্ড ক্লাসে করি যাতায়াত!…
আমরা কি রকম বহুরূপী দেখো, আর অন্তরে বাইরে কত গরমিল রেখে চলাফেরা আমাদের।
এগুনোও জীবনের বৈচিত্র্য, তা ব’লে এগুনোকেও আয়ুবৃদ্ধির সঙ্গে গোলমাল কোর না যেন। এগুনো ঠিক উল্ট; এগুনো হচ্ছে জীবনের অপমৃত্যু।
মজলিসী গোল্গে রাজাকেও বাদ দেয় না, সেকেন্ড ক্লাস তো কোন্ ছার; শুধু একটু ফাঁক পাওয়া দরকার। সেটুকু আমি তো দিয়েছিই আমার হঠাৎ আভিজাত্যের দেমাকে।…কথাটা হচ্ছে— এলাম যে ওপর থেকে নেমে, তার একটা কারণ থাকা চাই তা।
“বাগের ভয়?…সন্ধ্যে হয়ে এল কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি, মাপ করবেন।”
–সঙ্গে সঙ্গে ‘উঃ!’ করে উঠে ঘ্যাস ঘ্যাস করে নিজের পিঠটা চুলকাতে আরম্ভ করে দিলেন।
বুঝতেই পাচ্ছ, বাগ=Bug—ছারপোকা। কাঠ-রসিকতাই, কিন্তু জমাট আড্ডায় কাজ হয়। ছারপোকা যাদের কাঁদাচ্ছে না, তাদের হাসায়ই; ভদ্রতা রক্ষার চেষ্টার মধ্যেও ‘খুক্-খুক্’ ক’রে সবার মুখে একটু হাসি উঠল। বোধহয় আমার নিজের আচরণে মনের সায় ছিল না বলেই মুখ দিয়ে একটা ভালোরকম উত্তরও বেরুল না, একটু অপ্রস্তুতভাবেই মুখটা ঘুরিয়ে খাঁটি ইন্টারক্লাসেরটি হয়েই বসলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই পাপ আর প্রায়শ্চিত্ত—দুই-ই হয়ে গেল। যাক্, মুড়ো-কাটা গল্পটা যা শুনলাম—
“দমকলওয়ালারা না এলে লোকটা বেঁচে যায়, কিন্তু কপালের লেখন, তা আর হতে পেল কৈ? পাড়ার মধ্যে দিনদুপুরে পোড়ো বাড়ির দোতলার একটা ঘর থেকে একটু ধোঁয়া বেরুচ্ছে ব্যাপারটা কি জানবার হাজার রকম উপায় ছিল, কিন্তু তাহ’লে নিবারণ আচার্য়ি মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার হয়েছে কি করতে, আর খরচ করে দমকলটা আনানোই বা হয়েছে কেন মিউনিসিপ্যালিটি থেকে? তার ওপর আবার সামনেই ইলেক্শন, ভোটের জন্য বাড়ি বাড়ি ছুটতে হবে নিবারণকে, একটা চিঠি লিখে মিউনিসিপ্যাল আপিস থেকে ফায়ার ব্রিগেড তলব করে পাঠালে। আর্জেন্ট একেবারে।…মানে, ঐ তো একছিটে ধোঁয়া, ওটুকুও মিলিয়ে গেলে নিবারণের ইলেকশনের চান্স একটা নষ্ট হয়ে যায় কিনা। আগুন যদি আপনিই নিভে যাবে, কমিশনার হ’য়ে তাহ’লে ও করছিল কি?
ঠিক কুড়িটি মিনিট লাগল, কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে ফায়ারব্রিগেড এসে পৌঁছল; ওরা সাজগোজ করে ‘লাগুক—লাগুক’ জপ করতে থাকে কিনা। ওদের শাস্ত্রও আলাদা; যেমন পুড়ে কাউকে মরতে দেবে না, তেমনি আবার পারতপক্ষে এদিকে যারা না-পোড়া তাদের বাঁচতেও দেবে না কাউকে, পথের মাঝখানে একবার পেলে হোল। গোটা পাঁচেক ছাগলকে সাবড়ে, একটা উচ্ছৃণ্ড্য করা ষাঁড়কে ঘায়েল করে, একটা সাইকেলওয়ালাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে গন গন করে এসে পৌঁছুল। পোড়ো- বাড়িতে ধোঁয়ার হাল্লা শুনে যারা আসেনি দমকলের কারসাজি দেখবার জন্যে ছুটে এল। রীতিমতো একটা মেলা লেগে গেল।
আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা কুচকাওয়াজ শুরু করে দিলে। একবার ঘুরেঘারে বাড়ির চারিদিকটা দেখে এল। মরচেধরা তালাটা ভেঙে কাউকে ওপরে একবার উঠিয়ে দিলে ব্যাপারখানা পরিষ্কার হয়ে যায় কিসের আগুন, কি বৃত্তান্ত –কমিশনার নিবারণ আচার্যি না থাকলে পাড়ার লোকেরা করতও তাই—কিন্তু তাহ’লে আর ওরা ফায়ার ব্রিগেড হয়ে জন্ম নিয়েছে কেন? বাড়ির সদরটা রাস্তার উল্ট দিকে, এদিকে দোতলাটা রাস্তার পাশ থেকেই খাড়া উঠে গেছে, মায় চিলের-চাত পর্যন্ত; সিঁড়িতে সিঁড়িতে মুড়ে, একেবারে ওপরটা আবার যেখানটা কাঠের সিঁড়িতে কুলুল না সেখানটা দড়ির সিঁড়ি লাগিয়ে একজন তরতর করে ওপরে উঠে গেল জানলা পর্যন্ত।”
একটি ছোকরা আর সবার চেয়ে বেশি হাঁ ক’রে শুনছিল, জিজ্ঞেস করে উঠল— “আর আগুন ঠাকুর্দা…ততক্ষণে…?”
“আরে আগুনের কথা ভাবছে কে তখন? ফায়ার ব্রিগেডের কারসাজি দেখে তাক লেগে গেছে।…আর আগুন ছিল কোথায় তোমার? ধোঁয়া যেটুকু ছিল সেটুকুও পাতলা হয়ে এসেছে।…লোকটা জানলার গরাদ ধরে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেতরটা দেখে নিয়ে নিচুপানে চেয়ে বললে— “একঠো আদমি হ্যায়।”
লোকে নায়ক-নায়িকার একটা সর্বাঙ্গসুন্দর কাহিনীই চায়, নৈলে জুৎ হয় না; নিচে থেকে একসঙ্গে জন-কুড়ি চেঁচিয়ে উঠল— “আর আওরৎ নেই হ্যায়?”
ততক্ষণে ভেতরের লোকটা জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যোদো-পাগলা। কোনও দিক দিয়ে উঠে গিয়ে একটা মকাই ঝলসে খাবার ব্যবস্থা করছিল, সেটা হাতে নিয়েই উঠে এসেছে, জষ্টি মাসেও গায়ে খানদুয়েক ছেঁড়া কম্বল, এদিকে হাত পা নেড়ে নেড়ে কাঁপছে; মকাইয়ে একটা কামড় দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে, দার্জিলিঙের নিচে এত ভিড়টা কিসের?
পাগল বলে টের পেতেই ব্রিগেডের সেপাইটা ভয়ে তরতর করে হাত চারেক নেমে এসেছে, নিবারণ আচার্যি নিচু থেকে বললে—’যদু যে, তুই ওখানে করছিস কি?
‘চেঞ্জে এসেছি।’
‘আগুন লাগাবি যে বাড়িটায়।’
‘বরফ, লাগবে না।’
উগ্র পাগল নয়, ঠাণ্ডাই, একটু সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারলেই কাজ হয়, নিবারণ আচার্যি বললে—তা আছিস কবে থেকে দার্জিলিঙে?”
‘আজ ভোর থেকে।’
‘তোর ওয়েট্ যেন বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে, নেমে এসে একবার সিভিল সার্জনকে দেখিয়ে নে; বলে, আবার যাবি, শীতে কষ্ট পাচ্ছিস মিছিমিছি।’
যদু মকাইয়ে তাড়াতাড়ি দুটো কামড় দিয়ে কম্বল দুটো ভালো ক’রে সাপটে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললে— মন্দ বলনি, তাহলে খানাটা শেষ করে নিই। সিঁড়ি কিসের?”
একটা ছোকরা নিচে থেকে চেঁচিয়ে বললে—’সিঁড়ি নয়, দার্জিলিঙের রেল লাইন যদু!’
যদু গরাদে কপালটা চেপে নিচু পর্যন্ত দেখে নিলে, তারপর মাথাটা দুলিয়ে বললে– “ঠিক; দাঁড়াও, খেয়ে নিই।’
সিঁড়ি নামিয়ে নিলেই হোত; ঐ রকম সুরে সুর মিলিয়ে বললে যদু পাকা সিঁড়ি বেয়েই দিব্যি নেমে আসত; কিন্তু ফায়ার ব্রিগেড শহরে এসে পর্যন্ত কিছু পায়নি, ঝুটো হোক, সাচ্চা হোক একটা কেস্ পেয়ে আর ছাড়তে চাইলে না—ওরা ওদের পদ্ধতি মতোই নামিয়ে আনবে।
লোকগুলোরও একটা ইয়ে ছিল ফায়ার ব্রিগেড কি জিনিস বলে, তার ওপর নিবারণ আচার্যিরও সামনেই ইলেকশন, মিউনিসিপ্যালিটিকে কি দাঁড় করিয়েছে একবার পরখ করিয়ে দেখাতে চায়—কেউ আর বাধা দিলে না, সোজা পথ ছেড়ে অযথা বাঁকা পথ ধরা হচ্ছে বলে। জানলার গরাদগুলো জং ধরে ক্ষয়েই এসেছে, লোকটা ওপরে যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়ে কেটে কুটে খানিকটা জায়গা করে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। যদুর মকাই ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে, ধোঁয়াটাও মিনিট দশেক দমকলের তোড় দিয়ে ভালো করে মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে; লোকটা যদুকে ওদের শাস্ত্রমতো ভালো করে দড়ি দিয়ে নিজের পিঠের সঙ্গে বেঁধে বেরিয়ে এল। যদুও গাড়ি চড়ার শখেই হোক বা কালে ধরার জন্যেই হোক, আপত্তি করলে না…”
হাঁ করা ছেলেটি বলে উঠল— “কালে ধরা মানে!—মরে গেল যদু?”
“তা আড়াই তলা থেকে একবার লাফিয়েই দেখ না।”
“আর লোকটা…ব্রিগেডের সেপাইটা…?”
“তার বালাই মরুক। সে হাড়গোড়ভাঙা একটা মানুষের নরম তালের ওপর নেমে এসে বসেছে, কি দায়টা পড়ে গেছে তার মরবার? আর সে মরলে অমন ভালো কাজের জন্যে তকমা ঝোলাবে কার গলায় মুনিসিপ্যালিটি।”
কেসটা তখন অন্য হাতে গিয়ে পড়ল; দমকলওলারা ফিরে যেতে না যেতে পুলিশ এসে হাজির হোল। বললে—পোস্টমর্টেম করতে হবে।
কতকগুলো গাঁজাখোরে মিলে পাড়ায় শ্মশান-বন্ধু বলে একটা দল খাড়া করেছিল, সৎকার করবার লোক নেই এমন কেউ মলে কিছু চাঁদাটাদা তুলে নেশার ব্যবস্থাটা মাঝখান থেকে করে নিত। তাদেরও কয়েকজন জুটেছিল, তারপর যোদোকে পপাত ধরণীতলে হতে দেখে ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাঁশ, খড়, দড়ি, কলসী সব যোগাড় করে দলের আর সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে দেখে পুলিশ লাস আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ব্যাপার কি, না, মড়া ময়না করা হবে।
শ্যাম ঘটক ওদের সর্দার গোছের, এগিয়ে গিয়ে দারোগাকেই বললে— “হুজুর, শুনছি যোদো পাগলাকে নাকি পোস্টমর্টেম করবার হুকুম হয়েছে?”
‘হ্যাঁ, হয়েছে, আপত্তি আছে তোমার?’
শ্যাম ঘটক জিভ কামড়ে কানে হাত দিলে, বললে— “কি যে বলেন হুজুর! হুজুর হচ্ছেন জেলার মালিক, হুজুরের হুকুমের ওপরে কার কথা বলবার একতিয়ার, মেলার তাবৎ লোকগুনোকে ধরে পোস্টমর্টেম করিয়ে দিতে পারেন এক্ষুণি। তবে অভয় দেন তো একটা কথা বলি।’
দারোগা গোঁফের একটা দিক পাকাতে পাকাতে কানের দিকে তুলে দিয়ে বললে—’ফেলই ব’লে।’
আজ্ঞে কথাটা হচ্ছে, পোস্টমর্টেম করা কিসে মোল সেইটে দেখবার জন্যে, তা যোদো পাগলা সে সন্দেহ তো একেবারে মিটিয়েই মরেছে হুজুর। শরীরের মধ্যে একখানি হাড় আস্ত থাকতে দেয় নি, তার ওপর চোখের সামনে ঐ তেতলা, ভাঙা জানলা, আর ফায়ার ব্রিগেডের দলও হুজুরের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল যোদোকে তালগোল পাকিয়ে রেখে। আর হুজুর সন্দেহটা থাকতে পেলে কৈ যে যোদো আছাড় খেয়ে মরেছে?’
‘পুড়ে মরেনি যে তাই বা কে বলবে? এখানে তো একটা অগ্নিকাণ্ড হয়ে গেছে।’
‘আজ বছর পাঁচ-সাতের মধ্যে নয় হুজুর; ঐ তো বাড়িটা জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ার চেয়েও একটা হালকা ধোঁয়া হুজুর, চোখেও পড়ে না, যোদোর কপালের নেকন, তাইতেই কাল হোল, নয়তো সে বলতে গেলে তো শহরের ঘরে ঘরে অগ্নিকাণ্ড চলছে—অন্তত একটা করে চুলোও তো জ্বলছে বাড়ি পিছু, একবারটি ভেবে দেখুন না হুজুর। এ যা কাল ফায়ার ব্রিগেড এসেছে শহরে হুজুর, লোকের বিড়িতে আগুন দিতে হাত কাঁপবে এবার থেকে।
‘যাও আইন ওসব বোঝে না। পোস্টমর্টেম করতেই হবে।’
‘আইন তো হুজুরই। বলছিলাম বামনের ছেলে, জীবনটা তা বেচারীর এইভাবে কাটল, এখন মিত্যুর পরও যদি একটু শুদ্ধভাবে সৎকারটা হোত….’
এই সময় এ্যাম্বুলেন্সের গাড়িটা এসে লাসটা সামলে-সুমলে তুলে নিয়ে গেল। এদিক’কার গোলমালটা গেল মিটে একটু একটু ক’রে।
যোদো পাগলা যতই কেউকেটা হোক, কেসটা নিয় শহরে বেশ একটা গুলতান উঠে গেল, কি রকম দাঁড়াবে, কে কে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়বে, অ্যাকসিডেন্ট, না, মার্ডার, না, আত্মহত্যা; আগুনে পুড়ে মরা, না ছাত থেকে পড়ে—যতই সময় যেতে লাগল ততই আসল ব্যাপারটা থেকে নানারকম ফিখড়ি বেরুতে লাগল, বারলাইব্রেরীতে খুব ঘোঁট চলল, ম্যাজিস্ট্রেট সায়েব সিভিল সার্জেনকে ফোন করলেন- যেমন শোনা যাচ্ছে, ব্যাপারটা খুবই সন্দেহজনক, পোস্টমর্টেমটা যেন খুব কেয়ারফুলি করা হয়। সিভিল সার্জেন উত্তর দিলেন—অন্যের হাতে না দিয়ে আমি নিজেই করব’খন। আরও দর বেড়ে গেল যোদোর কেসের।
সেদিন ফুরসৎ হোল না সিভিল সার্জেনের; তার পরদিন ভোরেই চিরে-ফেড়ে তিনি রিপোর্ট দিলেন—’পয়েজনিং কেস। যোদো পাগলা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।’
যারা শুনছিল, একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল— “সে কি ঠাকুর্দা, বিষ খেলে কখন?..পুড়ে মরাও নয়!”
আমিও বাইরের দিকে মুখ করে শুনছিলাম, চকিত হয়েই ফিরে চাইলাম। ভদ্রলোক আমায় সাক্ষী মেনেই হেসে বললেন— “এই দেখুন এদের আবদার! সে একটা সিভিল সার্জেন, তার লাল মুখ, কে বলেছে যোদো পড়ে মরেছে বলে তাকে সেই কথা মেনে নিতে হবে? তার নিজের একটা শাস্ত্র আছে, তাইতে কি বলছে না বলছে সেইটে বিশ্বাস না করে সে যদি গুজবের ওপরেই নিজের রায় দেয় তাহলে তার এত কষ্ট করে শাস্ত্র পড়াই বা কেন আর মেহনৎ করে নিজের হাতে ছুরি ধরতে যাওয়াই বা কেন? আর এও একটা ভেবে দেখবার কথা— যেমন ফায়ার ব্রিগেড আলাদা, তেমন গভর্নমেন্টেরও পুলিশ বিভাগ আলাদা, হাসপাতাল আলাদা, দেওয়ানী আলাদা, ফৌজদারী আলাদা; পুলিশ যা বললে তা যদি হাসপাতালকে মেনে নিতে হয়, হাসপাতাল যা বললে তা যদি দেওয়ানীকে মেনে নিতে হয়, তাহলে এ খরচ করে, অত বখেড়া করে এতগুলো ডিপার্টমেন্ট রাখবার দরকার কি গভর্নমেন্টের? পোস্টাফিসের মতন মাঝখানে একটা পঞ্চমুখ অফিসার বসিয়ে পাঁচটা জানলা খুলে তাতে পাঁচটা লোক মোতায়েন করে রাখলেই পারত—তোমার গিয়ে মনিঅর্ডার, স্ট্যাম্প, রেজেস্টারি, সেভিংস ব্যাঙ্ক, টেলিগ্রাফ…কি বলেন মশাই, খেলাফ বলছি?”
হেসে বললাম— “কিছুমাত্র না; রইল আলাদা এমারৎ নিয়ে, অথচ একে যা বলছে অন্যে তাইতে সায় দিলে, তাহলে সে রকম আলাদা থাকার মানে? টাকা তো কামড়াচ্ছে না গভর্নমেন্টের!”
“ঐ শোন, সমঝদার লোকে কি বলেন।…সব তালগোল পাকিয়ে গেছে, কোথায় নাড়ি, কোথায় স্টমাক, কোথায় হার্ট, কোথায় লাংস—কিচ্ছু বোঝবার জো নেই, কিন্তু ওস্তাদের হাতে ছুরি, নুকিয়ে যাবে কোথায়?… সিভিল সার্জেন রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলে—পিওর পয়েনিং কেস।
সবাই আবার গোলমাল করে কি বলতে যাচ্ছিল, ভদ্রলোক ডান হাতটা তুলে তাদের থামিয়ে নির্বিকারভাবে বললেন— “পিওর পয়েজিনিং। অন্য কিচ্ছু নয়।”
শহরের গুলতানটা দশগুণ বেড়ে গেল, চায়ের দোকান, পানের দোকান, গলির মোড়, সদরের রক—যেখানেই পাঁচজন জমা হয়েছে, যোদোর পয়েজনিংয়ের গল্প। পাঁচজন থেকে দশজন, দশজন থেকে বিশজনে দাঁড়াচ্ছে, বিশ রকম আন্দাজে, বিশটা মতে হাতাহাতি হবার উপক্রম হচ্ছে, বিশটা বাড়ির কেচ্ছা বেরিয়ে পড়ছে।
এর ওপর, এতদিনে গুলতানটা এদিকেই ছিল, সিভিল সার্জেন রিপোর্ট দেবার পর থেকে ইউরোপীয়ান ক্লাবেও একটা সাড়া পড়ে গেল—কী মারাত্মক জাত এই ইন্ডিয়ানরা—সবার চোখের নিচে, দিনদুপুরে নয় করে দিচ্ছিল, কি ক’রে চালানো যায় এ্যাডমিনট্রেশন
পুলিশ সুপার ডেকে পাঠালেন টাউন দারোগাকে।
‘এই শহরের মাঝখানে একজন বিশিষ্ট বড়লোকের বাড়িতে সম্প্রতি একটা সেনসেশন্যাল পয়েজনিং কেস হয়ে গেছে, জানো বোধ হয়!
‘আজ্ঞে জানি হুজুর।’
‘কবে?’
‘পরশু’।
‘পরশু; তাহলে জানো দেখছি, নেহাৎ নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিলে না। ওটাকে যে অগ্নিকাণ্ড, কি ছাত থেকে প’ড়ে অপঘাত মৃত্যু বলে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টা হচ্ছিল, এটা তোমার জানা আছে কি?’
হ্যাঁ হুজুর, সিভিল সার্জেন নিজে এর মধ্যে না পড়লে হয়তো…’
পুলিশ সুপার গর্জন করে উঠলেন—’সিভিল সার্জেন না পড়লে! তুমি কোথায় ছিলে? তোমার সাহায্য করা সিভিল সার্জেনের ডিউটি, কি সিভিল সার্জেনকে সাহায্য করা তোমার ডিউটি?
ওঁর রিপোর্টের আগে তুমি কি করছিলে?”
দারোগার পা কাঁপতে আরম্ভ হয়েছিল, টেবিলের আড়ালে বলে তাড়াতাড়ি সামলে নিলে।
‘ইনভেটিগেট করছিলাম হুজুর…’
‘কি পেলে?”
‘ঐ পয়েজনিং-ই হুজুর—সিভিল সার্জেনের রিপোর্টে যা কনফারমড্ হোল।
একটু ঠাণ্ডা হলেন পুলিশ সুপার।
‘পয়েজনিং! আত্মহত্যা—স্ব-ইচ্ছায়, কি অন্যে খাইয়েছে বিষ?’
যেরকম আবার ফেটে পড়বার জন্যে মুখের দিকে চেয়ে আছে, স্ব-ইচ্ছায় আত্মহত্যা বলে আর কেসটাকে হাল্কা করবার সাহস হল না দারোগার। বললে— “না, মেরে ফেলবার জন্যে বিষ দেওয়া হয়েছিল হুজুর।’
‘কজন ছিল এর মধ্যে?”
ফার্স্টবয়ের মতন এসবের উত্তর জিভের ডগায় রাখতে হয় ভালো ভালো দারোগাদের, উত্তর করলে—আপাতত একজনকে পাওয়া গেছে হুজুর, যে আসল; ফারদার ইনভেসটিগেশন চলছে। কেসটা জটিল।’
‘তাকে হাজতে দেওয়া হয়েছে?”
‘হ্যাঁ হুজুর; তখুনি।’
রাঙা মুখের রঙটা খুব চড়ে গিয়েছিল, খানিকটা নামল।—বললেন— ‘দেখুন, শহরের পুলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অত্যন্ত ঢিলে হয়ে গেছে, এ কেস্ যদি খারাপ হয় তো দায়িত্ব আপনার। এর মানেটা নিশ্চয় বোঝেন; যান।’
ওদিকে ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি উকিলকে ডেকে পাঠালেন, প্রায় উপরোউপরি কয়েকটা প্রসিকিউশন ফেল করে শহরে অপরাধের সংখ্যা বড্ড বেশি বেড়ে গেছে। এই সেনসেশন্যাল পয়েজনিং কেস্টা যদি না দাঁড়ায় তো তাঁকে সরকারি উকিল বদলাবার কথা চিন্তা করতে হবে।
পুলিশ সুপারের কাছে ব্যাপারটা আপাতত কোনরকমে সামলে টাউন-দারোগা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছিল, আসল লোকটাকে ধরে হাজতে পুরেছে তো বলে এলো সাহেবকে, এখন করা যায় কি? বেটা কিছু বললে না, কিন্তু সন্ধ্যের পর ক্লাবে যাবার মুখে যদি একবার হাজতে ঢুঁ মেরে যাওয়ার খেয়াল হয়, তাহলেই তো চিত্তির।
মোটরবাইকটা খুব আস্তে আস্তে চালিয়ে ভাবতে ভাবতে আসছিল, এমন সময় পুরনো মিডল স্কুলের সামনে এসে তাকে বাইকটা রুখে দিতে হোল। জায়গাটা শহরের একটু বাইরের দিকে, স্কুলটা এখান থেকে অনেক দিন সরে গেছে, কাঁচা ইঁটের বাড়িটাও গেছে প্রায় পড়ে, শুধু একদিকে একটা ঘর কোনরকমে আছে দাঁড়িয়ে।
পোড়ো বাড়ির দিকে দারোগার নজর কেমন যেন সহজেই গিয়ে পড়ে, তাইতেই দেখলে ঘরটার মধ্যে একটা মানুষ যেন পায়চারি করতে করতেই উল্ট দিকে মুখ করে থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘাড়টা হেঁট করা, হাত দুটো বুকে জড়ানো, খুব যেন চিন্তিত; মোটরটা একটা শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়তে একবার ঘুরে চাইলে, তারপর আবার সেইভাবেই রইল দাঁড়িয়ে। খুন হোক আর নাই হোক, খুনী যে এত শীগগির আর এত সহজে হাতের মধ্যে এসে পড়বে এটা আশাই করতে পারে নি দারোগা, একটু ভেবে নিল, তারপরেই বাইক থেকে নেমে পড়ে সেটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে স্কুলটার পানে এগুল।
চারিদিকে আগাছা জমে গেছে বলে একটু ঘুরে যেতে হোল; ঘরের সামনে পৌঁছে কিন্তু দেখে লোকটা তখনও সেইরকমভাবে দাঁড়িয়ে। দূর থেকে আবছায়ার মধ্যে দেখা, কাছে এসে এবার ভালো করে দেখলে, লোকটাও দারোগাকে দেখে ঘুরে এগিয়ে এসেছে,—একটা ছেঁড়া প্যান্ট পরা গায়ে একটা ছেঁড়া ঢিলে কোট, মুখে এক মুখ দাড়িগোঁপ, কিন্তু দেখবামাত্রই বুঝতে পারা গেল সেটা আসল নয়, পরচুলো। বেশ ভালো করে আঁটাও নয়, আর আশ্চর্যের বিষয় লোকটার খেয়ালও নেই সেদিকে, একটু চেয়ে দেখলে, তারপর বেশ হুকুমের টোনেই ইংরেজিতে বললে— “কাম ইন।”
পলাতক আসামী! এমন খাঁটি কেস পাওয়া যায় না সচরাচর; ছদ্মবেশ, তার ওপর পাগলামির ভান, দারোগা মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, বললে—’এখানে কি হচ্ছে? বেরিয়ে এসো।’
একেবারে বেরিয়ে এল না, দু’পা এগিয়ে বললে—’আমি হেডমাস্টার এ স্কুলের, ছেলের এডমিশন নেবেন? কোথায় সে, নিয়ে আসুন।’
দারোগা বার দু’তিন মাথা নাড়লে—অর্থাৎ বুঝেছি, আর বুজরুকিতে কাজ নেই, বললে— ‘আমিও একজন হেডমাস্টার, আগে আমার স্কুলে ভর্তি হবে চলো তো।’
এক কথায় হোল না। লোকটা প্রথমে চোখ রাঙিয়ে ভেংচি কেটেই উঠল—’চলো তো!— আপনি কথা কইতেই জানেন না, একটা হেডমাস্টার, তাকে ‘চলো তো।’…আপনার ছেলেকে অ্যাডমিট করতে পারি না আমি, আপনি যেতে পারেন।’
পাগলামি—বিশেষ করে ভান-করা পাগলামি বরদাস্ত করবার মতন মনের অবস্থা ছিল না দারোগার, তবু অনেক চেষ্টা করে সয়েই গেল, বললে—’অপরাধ হয়েছে, আপনাকে সসম্মানেই নিয়ে যাওয়া হবে, আর রাখাও হবে জামাইয়ের আদরে, দয়া করে চলুন।
‘কার জামাই।’
‘রাজার জামাই…নি-খরচায় খাওয়া-দাওয়া পোশাক, বিছানা, মায় ডাক্তার পর্যন্ত।
লোকটা একবার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে বাঁ হাতের আঙুলটা আস্তে আস্তে চালিয়ে নিলে—পাগলের পার্টটা বেশ ভালোভাবেই করছে—হেডমাস্টারি আর রাজার জামাইগিরির মধ্যে কোন্টা বেছে নেবে যেন তৌল করে দেখছে, তারপর ঘরটার চারদিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে—ঠিক তো?”
‘একেবারে ঠিক।’
‘তাহলে চলো।’
রাজার জামাই আগে আগে, পেছনে দারোগা, চামড়ার কেস্ থেকে রিভলভারটা বের করে নিয়েছে, পালাবার চেষ্টা করলেই জামাতা বাবাজীকে খোঁড়া করবে; মোটর-বাইকটার একটা সাইড- কার ছিলই, তাইতে বসিয়ে একেবারে সোজা হাজতে।
শহরে যে গুলতান চলছিল, তার পরদিন একেবারে দশগুণ গেল বেড়ে—হেঁসেল থেকে নিয়ে বার-লাইব্রেরী পর্যন্ত আর অন্য কোন কথাই নেই। যোদো পাগলাকে যে বিষ দিয়ে মেরেছে, সে ধরা পড়েছে—সুট, পরচুলো পরে একেবারে ভোল ফিরিয়ে পুরানো মিডল স্কুলটার মধ্যে লুকিয়েছিল, পুলিশের কাছে ফটো ছিলই, দারোগার নজরে পড়ে যায়, কাছে রিভলভার ছিল, প্রথমে দারোগাকে ঘায়েল করবার চেষ্টা করে, তারপর ধরা পড়ে পাগলের ভান করে, তারপর ঠাণ্ডিগারদে ফেলে চাপ দিতে এখন নাকি আবার স্বীকারও করেছে সে-ই যোদো পাগলাকে বিষ দিয়েছিল—এর মধ্যে স্ত্রীলোকঘটিত ব্যাপারও আছে—যোদো পাগলা নাকি যথার্থই পাগল ছিল না—পাগলামির অজুহাতে এসব দোষও নাকি ছিল ভেতরে ভেতরে…।
এইরকম আর এইরকম ধরণের বহু মুখরোচক গল্প মুখে মুখে তোয়ের হয়ে সারা শহরটায় এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে, কখন যে সেই একটু ধোঁয়া দেখা গিয়েছিল বাড়িটার মধ্যে সেসব কথা একেবারে কাহিনী হয়ে গেল।
পুলিশ সুপার, ম্যাজিস্ট্রেট, জজ, সিভিল সার্জেন, সরকারি উকিল একে একে সবাই এসে আসামীকে হাজতে দেখে গেলেন। তবে ঐ পর্যন্তই, সেনসেশন্যাল কেস্–বাজে লোক কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হোল না। একেবারেই বেলাল্লা, তাতে আবার নিজের মুখেই দোষ স্বীকার করছে, ডিফেন্সে নিতান্তই নেমরক্ষা করবার জন্যে একজন জুনিয়ার উকিল দাঁড়াল, যথারীতি কেস উঠল আদালতে।…দাঁড়া, বিড়িতে দুটো টান দিয়েনি।
ভদ্রলোক বিড়িটা ধরিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে টানতে লাগলেন, সবাই মুখের পানে চেয়ে হাঁ করে রয়েছে, কখন আবার আরম্ভ করবেন। তাদের উৎকণ্ঠাটা আরও বাড়িয়ে তুলেছে ওঁর মুখের ভাবে, আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়ছেন আর তার সঙ্গে একটা মিঠে মিঠে দুষ্টু হাসি, যাতে অন্তত আমার মনে হোল, গল্পটা সদ্য সদ্যই তোয়ের করে যাচ্ছেন, আর ক্লাইমেক্সটা যাতে একেবারে মোক্ষমভাবে এই গল্পেরই ক্লাইমেক্স হয়ে ওঠে, এমন ধরণের কিছু একটা যেন উঁকি মারছে মাথার মধ্যে।
একটু পরে বিড়িটা ফেলে দিয়ে বললেন,–”ফাঁসির দিন সমস্ত শহরটা ভেঙে পড়ল…”
“ফাঁসিও হয়ে গেল!”—হৈ-হৈ করে উঠল সবাই একসঙ্গে।
ভদ্রলোক একবার হাসি-হাসি চোখ দুটো সবার ওপর বুলিয়ে নিলেন, যেন কত অবুঝদের গল্প শোনাচ্ছেন, তারপর আবার আমায় সাক্ষী মানলেন—’শুনুন মশাই, এদের আবদারের কথা। সিভিল সার্জেন নিজে ময়না করেছে, ম্যাজিস্ট্রেট, জজ মাথায় হাত দিয়ে বসেছে,—অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বুঝি আর রইল না, দারোগার যায় বুঝি চাকরি, সরকারি-উকিল হয় বরখাস্ত—এমন অষ্টবজ্র সম্মেলনেও ওর যদি ফাঁসি না হয় তো বিচারটা কি শুধু একটা ফার্স?…তোরা কি ভেবেছিস, সত্যিই তাকে রাজার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছিল?”
শুধু এমনি ফাঁসি নয়, জেলের দোর বন্ধ না করে। পাবলিক হ্যাঙিং (Public hanging ) – সবাই দেখুক—এ-পাপের সাজা কি—একটা এক্সেমপ্লারি পানিশমেন্ট (Examplary punishment)। জেলের বাইরে বড় ময়দানটার মাঝখানে ফাঁসিকাঠ দাঁড় করানো হোল—দরকার ছিল না, তবুও ম্যাজিস্ট্রেট সায়েব ট্যাড়াটাও পিটিয়ে দেওয়ালেন—বিচার আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের জয়জয়কার তো, সবাই এসে দেখুক—যারা দেখতে চায়। শহর—যাকে বলে একেবারে ভেঙে পড়ল।
পাঁচটা আটে সূর্যোদয়, সেই সময় ফাঁসি; আসামীকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসা হোল। আগে-পেছনে চারটে চারটে করে পুলিশ, ডোম ব্যাটা ওদিকে মঞ্চের ওপর এটেনশন হয়ে যমদূতের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটার কিন্তু বিশেষ ভূক্ষেপ নেই, খাড়া চেহারা, লম্বা লম্বা পা ফেলে চলেছে, যেন সে-ই পুলিশটাকে নিয়ে চলেছে ফাঁসি দিতে; পাগলামির ঠাটটা বজায় রেখে যাচ্ছে আর কি শেষ পর্যন্ত। তার আর একটা লক্ষণ, মুখে তখনও সেই মিথ্যে দাড়ি-গোঁফের বোঝা—ওকে নাকি জিগ্যেস করা হয়েছিল ওর শেষ ইচ্ছা যদি কিছু থাকে তো জানাতে, তাতে বলেছিল ওর দাড়ি-গোঁফ যেন শেষ পর্যন্ত খুলে নেওয়া না হয়; ভোরের পাতলা অন্ধকারে একমুখ মিথ্যে দাড়ি-গোঁফ সুদ্ধু গটগট করে গিয়ে মঞ্চের ওপর উঠল। বোধ হয়, আট-দশ হাজার লোকের মেলা, কিন্তু একটা ছুঁচ ফেল, শুনতে পাওয়া যাবে।…তোদের শুনতেই এই অবস্থা, আর তারা চাক্ষুস দেখছে, বুঝে দেখ না।
দু’মিনিট…এক মিনিট…আর কয়েকটা সেকেন্ড, ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন—রেডি! ডোম দড়িটা পরাবার আগে কালো কাপড়ের ঢাকনাটা গলিয়ে দিতে যাবে, আসামী হঠাৎ হাত দুটো তুলে বললেন—’থামো!’
একটু যে ডোমটা থতমত খেয়ে গেল তার মধ্যেই দুহাতে একসঙ্গে দাড়িগোঁফ ফেলে দিয়ে গলাটা লোকগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ‘আমি কে!’ বলে এক চিৎকার, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই সেই পেটেন্ট হাসি…
‘আরে যোদো পাগলা! —যোদো পাগলা!’—সেই দশ হাজার লোকের গলার আওয়াজে আকাশ যেন ফেটে চৌচির হয়ে যায়—’নামিয়ে আন্!—নামিয়ে আন!—কিন্তু নামায় কে তখন যোদোকে?—ফাঁসির কাঠ জড়িয়ে ধরে তার সেই হাসি—আমি নিজেকে মেরে ফাঁসি যাচ্ছি! আমি নিজেকে মেরে ফাঁসি যাচ্ছি কাজির বিচারে—হাঃহা—হা—হা—হা—হা!…’
ভদ্রলোক নিজেও হো-হো করে হাসতে লাগলেন, আমিও জানলার বাইরে মুখ বের করে হাসছি, ওদেরও বেশির ভাগ যোগ দিয়েছে, বাকি প্রথম বিস্ময়ের ঘোরে চুপ করে রয়েছে, একজন—নিশ্চয়, সমালোচনার দৃষ্টিটা সূক্ষ্ম—আপত্তি করে উঠল—’এ নেহাৎ গাঁজাখুরি হয়ে গেল ঠাকুর্দা, বাঃ, যোদো তালগোল পাকিয়ে সেই ফায়ার ব্রিগেডের লোকটার সঙ্গে পড়ল…আবার বলছেন…’
ভদ্রলোকের হাসি থেমে গেল, আবার সেই রকম গম্ভীরভাবে সবার ওপর চোখ দুটো বুলিয়ে এনে আমায় সাক্ষী মেনে বললেন— “কে বললে?…শুনুন কথা মশাই!…যোদো বেচারী বারো সেরা একটা খাসী রামছাগল ওপরে নিয়ে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে দার্জিলিংয়ের শীতে সিন করবার জন্যে টাঙিয়ে রেখেছিল পাশের ঘরে—নেহাৎ ছাড়ে না দেখে কালো কম্বল মুড়ে-সুড়ে লোকটার পিঠে বেঁধে দিয়ে বেমালুম সরে পড়েছে—আর বলে কি না!…”
“ঠাকুর্দা যে!”
গাড়ি এসে চার নম্বর হলটে দাঁড়িয়েছে। “এই যে, তুমি কোত্থেকে?—এই গাড়িতেই নাকি?”—বলে ভদ্রলোক হাসতে হাসতে নেমে পড়লেন—ওদেরও দু’-একজন ছাড়া সবাই নেমে পড়ল—প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কি ভেবে একবার ঘুরে আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতেই বললেন— “আচ্ছা আসি, নমস্কার; কি করি? – ছেলেরা ছাড়ে না, সদ্য সদ্যই তোয়ের করে বলতে হয়, অনেক ভুল-ত্রুটি থেকে গেল—তা কিন্তু বিচার করে দেখতে যাবেন না…”
নমস্কার করে বললাম— “এ-গল্পের পরেও আবার বিচারের নাম করে লোকে!
হো-হো করে প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন, ওরাও যোগ দিলে, তারপর সদলবলে বেরিয়ে গেল।
.
এবার একটু বিচারের কথাতেই আসা যাক।
তোমার কি রকম লাগল গল্পটা? একটা কথা মনে রাখতে হবে, তোমরা যাকে সাহিত্যিক গল্প বল, এ তা নয়, এ হচ্ছে যাকে বলে একেবারে খোস গল্প। দুটোতে অন্তর আছে। সাহিত্যিক গল্পের শ্রোতা অন্য ধরণের, কিম্বা অন্যভাবে বলতে গেলে, এই শ্রোতাই যখন সাহিত্যিক গল্পের শ্রোতা হয়ে বসে, তখন অন্যরকম কান নিয়ে বসে; গল্পের স্থান, কাল, পাত্র, একটু এদিক-ওদিক হলেই গোল্পেকে চেপে ধরে। সমস্ত ঠিক রেখে, নিখুঁতভাবে সম্ভাবনার রাস্তা ধরে চলতে হবে, এতটুকু অসম্ভব বা অবান্তর এসে পড়লেই তার জাত গেল। মাঝপথে যদি আসেই অসম্ভব বা অবান্তর তো সেটা রস জমানোর জন্যেই, কথকের বা লেখকের অনেক সময় সেটা একটা ভাঁওতাও, পাঠককে একটু বিভ্রান্ত করে দেওয়া–বা খুঁৎ ধরেছি বলে পাঠক বা শ্রোতাকে একটা সাময়িক আত্মপ্রসাদ দেওয়া; যথাস্থানে—(সেটা একেবারে পরিমিতিতে এসেও হতে পারে), তাকে কিন্তু এক-এক করে নিখুঁতভাবে সব পরিষ্কার করে দিতে হবে।
আমি একেবারে Extreme Case নিয়েই বলছি, অর্থাৎ যেসব গল্পে বক্তা বা লেখক কতকটা অসাধারণ বা উদ্ভট কল্পনার আশ্রয় নিয়ে সেই ধরণের গল্পই ফেঁদেছেন। অন্য যেসব সাদামাটা গল্প, তাতে তাঁর কাজ ঢের সোজা, ঘটনা বা অনুভূতিটিকে ফুটিয়ে সামঞ্জস্য বজায় রেখে গেলেই তার কাজ যাবে মিটে, সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় রসটি তাঁর হাতে উঠবে ফুটে।
খোসগল্প কিন্তু একেবারে অন্য ধরণের জিনিস! সর্বপ্রথম, তাকে উদ্ভট হতে হবে, আর যত হয়, ততই তার বাহবা। এ কথাটা হোল বক্তা বা লেখকের দিক দিয়ে।
পাঠকের দিক দিয়েও আছে; খোসগল্পের পাঠক বা শ্রোতা বসবে একেবারে খোস মেজাজে; (পাঠকের চেয়ে শ্রোতা হওয়াই আরো ভালো, কেননা, সাহিত্যিক গল্প যেমন লিখতেই জমে, খোসগল্প জমে বলায়)। তাকে অনেক ক্ষ্যামা-ঘেন্না করতে হবে, কেননা ছোটখাটো খুঁৎখাত কোথায় কি থেকে যাচ্ছে, সেদিকে কান দিতে গেলে পদেপদে প্রশ্ন ভুলে সে-ই গল্পের মজলিসে হয়ে উঠবে অবান্তর। আসল কথা অসম্ভাব্যতাই হচ্ছে খোসগল্পের প্রাণবস্তু; তার অন্তর্নিহিত রস— হাস্যরস- গল্পটা আসলে বিস্ময়েরই হোক, করুণার হোক বা ভয়েরই হোক; নিছক হাসির গল্প হলে তো কথাই নেই, তবে সে-হাসি প্রধানত তার উদ্ভটতার মধ্যে দিয়েই। এ কথাগুলো মেনে নিয়েই যখন গল্প শুনতে বসেছি, তখন বস্তাকে তো একটা ঢালোয়া-লাইসেন্স দিয়ে বসেছি, ছোটখাটো ব্যাপারগুলো এড়িয়ে বা টপকে না গেলে কিম্বা বাস্তব বা শাস্ত্ৰসঙ্গত হোল কি না, অত দেখতে গেলে অল্প এগুবে কোথা থেকে?
এই চিঠির মধ্যে আমি তোমায় দুরকম গল্পেরই নমুনা দিয়েছি। গুপী-নারাণী-পালবৌয়ের গল্পটা ধরো; ওটা হাস্যরসের একটা সাহিত্যিক গল্প। ওতে আমায় কয়েকটা একটু অসাধারণ গোছের চরিত্র সৃষ্টি করে তাদের কতকটা অসাধারণ অবস্থার মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু যতই অসাধারণ হোক, না চরিত্র, না পরিস্থিতি—কোন কিছুর মধ্যে অসম্ভাব্যতার কিছু নেই। এ ধরণের গল্পে লেখক স্থান, কাল, পাত্র সব বিষয়েই তার জবাবদিহি নিয়ে তোয়ের আছে। তুমি চাও জবাবদিহি, পাবে, যদি না পাও তো যে পরিমাণে পাচ্ছ না, বুঝতে হবে, সেই পরিমাণে গল্পের মধ্যে গলদ আছে, গল্প রসোত্তীর্ণ হতে পারেনি।
অবশ্য আমি এমনই পাঠকেরই কথা বলছি, যার মাথায় কিছু বস্তু আছে। নৈলে প্রশ্ন করে দিতে তো পাগলেও পারে। বরং বেশি পারে।
এবার এই গল্পটার কথা ধরা যাক। এটা একটা ডাহা, অন্তত (typical) খোসগল্পের নমুনা। এর সবটাই অসম্ভব-অসঙ্গত, কোথায় আঙুল দিয়ে দেখাবে? আগুন নেই ফায়ার ব্রিগেড এল— সোজা না নামিয়ে বাঁকাপথে ওভাবে নামাতেই বা গেল কেন যোদো পাগলাকে? পড়ে থেঁতো হয়ে মরল, পোস্টমর্টেমে ঠিক হোল বিষপ্রয়োগ—আসামী চাই, যে কোনও একটা লোককে টেনে হাজতে পোর’—ক্লাইমেক্স হোল সেই যোদো পাগলকেই আসামী করে ধরা যে বিশিষ্ট ঘরের ছেলে হয়ে হত্যা হয়েছিল—বিশিষ্ট ঘরের ছেলে যে ঐ যোদো পাগলারই সংগ্রহ করা একটি বারোসেরী খাসী, এটুকু তো নিতান্তই ফাউ।
এত উদ্ভট উদ্ভট ব্যাপার গলাধঃকরণ করবার জন্যে যারা তোয়ের রয়েছে, তারা ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি কোথায় কি ঘটছে, তার জন্যে মাথা ঘামাবে না, তারা আপত্তি করবে না যে, ফায়ার ব্রিগেড ওরকম ছেলেমানুষী কাণ্ড নয়, সিভিল সার্জেন কথায় কথায় নিজের হাতে পোস্টমর্টেম করতে বসে না, কিম্বা পাবলিক হ্যাঙিংয়ের (Public hanging) যুগ আর নেই বা এত তুচ্ছ কথায় হয় না। অথচ সাহিত্যিক গল্প হলে এই সব কথা নিয়েও সমালোচক ফোঁস ফোঁস করে উঠত আরও অনেক খুঁটিনাটি যার কথা আর ধরলাম না।
তবুও, আবার সব কথা বলেও বলতে হয় খোসগল্পও শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিক গল্পই সাহিত্যের শেষতম কথা রস, যেমন ম্যুনিসিপ্যালিটির শেষতম কথা ট্যাক্স (সে-ও তো রসই)। এই ট্যাক্সের গন্ধ পেলেই মুনিসিপ্যালিটি যেমন শহরের প্রত্যন্ত ভাগেও একটা ল্যাম্প পোস্ট বসিয়ে নিজের সীমানা বাড়িয়ে নেয়, তেমনি রসের সন্ধান পেলেই ব্যাকরণ-অলঙ্কার শাস্ত্রের বিধিনিষেধ না মেনে সাহিত্য এগিয়ে তার ছোপ মেরে দেয় গায়ে, এই করে নিত্য-নিয়তই সে নিজের পরিধি বিস্তার করে যাচ্ছে।
অত কথা কি, খোসগল্প তো পদে আছে, তুমি একটা গাঁজাখুরি গল্পই লিখে পাঠাও না, পরীক্ষায় উৎরে গেলে তার জন্যেও সাহিত্য পরিষদের সার্টিফিকেট যোগাড় করে দেওয়া শক্ত হবে না।
কিন্তু এসব কথা এই পর্যন্তই থাক আপাতত। গল্পই শোন, অত জাতবিচার করে কি হবে?
সিরাকোলেই একটি যাত্রীর সঙ্গ পেয়েছিলাম, তার কথা বলা হয়নি। শরীরটা থলথলে মোটা, চেহারাটা মাকুন্দ-মাকুন্দ, গায়ে একটা পিরান, ডান ওপর-হাতে তামার তারে একটা বড় মাদুলি; বয়স বছর চল্লিশ হবে। বয়স বাদ দিয়ে লোকটা পিকউইক পেপারের (Pickwick paper) সেই জো’র কথা মনে করিয়ে দেয়। বসে বসেই ঘুমুচ্ছিল, আমি ওঠবার পরই জেগে উঠে এমনভাবে চারদিকে চাইতে লাগল, যেন ছ’মাস পরে ঘুম ভেঙেছে। বেশ বুঝতে পারা গেল, কোথায় আছে, কি ব্যাপার যেন ঠাহর করতে পারছে না, তার পরেই একটু চাঁক হতে ত্রস্ত হয়ে অনির্দিষ্টভাবে জিগ্যেস করতে লাগল— “এখানে কিছু পাওয়া যায় না? অ্যাঁ, এখানে পাওয়া যায় না কিছু?” তার পরে নজরটা প্ল্যাটফর্মের স্টলে গিয়ে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল— “এই যে, দোকানী! এক ঠোঙা ফুলুরি আর বেগুনি—এই যে ধরো আধুলি…শীগগির—গাড়ি ছেড়ে দিলে বলে…”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না, ইঞ্জিন এখানে জল নেবে…”
“তা নিক, তুমি নিয়ে এসো শীগগির—এই আট আনি বের করে রেখেছি—খুচরোটা হাতে করে নিয়ে এসো…একটু তরস্ত হও…যেন গা নেই যে হে, জল নিতে আর কত লাগে ইঞ্জিনের? ভাঁড়ে করে তো নিতে হচ্ছে না….”
দোকানী একবার চোখ তুলে চেয়ে দেখলে, প্রশ্ন করলে— “কতর?”
“তা…ঠোঙাটা একটু বড় হবে—বেশ মাপিকসই বড়…একটু শীগ্রী—গাট্সায়েব ঐ বেরুল ঘর থেকে…”
একটা ছোকরা ঠোঙাটা নিয়ে এসে একটা দো-আনী দিয়ে আধুলিটা নিয়ে গেল।
গাড়ি যেটুকু থামল, তারমধ্যেই ঠোঙাটা পরিষ্কার করে দিয়ে বাইরে ফেলে দিলে। শেষের দিকে চিবুবার ক্লান্তি বা আমেজেই চোখ দুটি ঢুলঢুল করে এসেছিল, একটা তালি দিয়ে হাত দুটো ঝেড়ে ফেলে আবার গাড়ির দেয়ালে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, সেই অবস্থাতেই পাশের একটা বুড়ির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে-মুচকে বসেছিল, কোলে একটি রোগাগোছের শিশু, বোধ হয় নাতি, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিয়ে বললে— “সেই কোন পৈলেন থেকে নিত্যি এই কাণ্ড–বসে বসে দেখেছি এখানে কিছু মেলেনি?’…তারপর ফুটি, কাঁকুড়, পেয়ারা, শসা, মুড়ি, ফুলুরি—যা পাওয়া গেল এইরকম গোগ্রাসে গিলে ঘুম—কিছু না পেলে তো একটা ডাবই শেষ করে তার শাঁসটা নিয়ে পড়ল। একটি ইস্টিসেন বাদ দিতে দেখলুম নি—পেট, না, বাকড় গো!… কুম্ভকৰ্ণ ও খেত, তেমনি ছ’মাস নিদ্রেও দিত—–এ যেন শাস্তোরকেও পিছুতে ফেলে এল বাবা!…সামনে একটা শিশু বসে রয়েছে…হ্যাঁ, দেবে!…তা, ও ঠাকুর! খাও, ঘুমোও, তা পরের গায়ে অমন ক’রে ঢুলে ঢুলে পড়লে চলবে কেন? সিদে হ’য়ে বোস—য্যাতো এগুচ্ছ, ওজন বাড়চে বই তো কমচে না—এই একটা আধমরা শিশু, চিঁড়ে-চ্যাপটা হয়ে যাবে নি?…কাকে বলা….হরিণডাঙা এলে যেন বাঁচি বাবা!…”
একটা ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে সামলে নিয়ে একটু ঘুরে বসল।
হরিণডাঙায় গাড়ি বদল করতে নেমেও দেখি সেই ব্যাপার, আমায় প্ল্যাটফর্মে দেখেই ব্যাকুলভাবে জিগ্যেস করলে— “এ ইস্টিশনে কিছু পাওয়া যায় না বাবু?”
বললাম— “আপনি সিরাকোলে তো অতগুলি ফুলুরি বেগুনি খেলেন…”
“যায় না পাওয়া বুঝি কিছু?”—বলে নিরাশভাবে বাইরের দিকে আবার নজর পড়তেই চোখ দুটো চকচক করে উঠল— “ঐ যে!…ও ঘুঘনি! এদিকে…এদিকে…এই নাও দো-আনি—কটা ঠোঙা দেবে?…”
ইন্টার ক্লাসে উঠেই আমি গল্পে গেলাম ডুবে, কটা ঠোঙা খালি হোল, আরও কিনলে কি না সেটা আর দেখা হোল না।
এরপর চার নম্বর হল্টে মজলিসের সবাই নেমে যেতে গাড়িটা গেল খালি হয়ে। অবকাশ পেয়ে আমার কৌতূহলটা আবার গিয়ে সেই লোকটাকে আশ্রয় করলে—খাচ্ছে, না, ঘুমুচ্ছে?
খালি গাড়ি ভালোও লাগছে না, নেমে আবার থার্ড ক্লাসেই ঢুকলাম—ওরই গাড়িতে। বেশ বোঝা গেল, গভীর নিদ্রা থেকে সদ্য জেগে উঠেছে, সামনে পেয়ে আমায়ই জিগ্যেস করলে— “এটা কোন জায়গা মশাই? কিছু পাওয়া যায় না?”
বললাম— “এটা একটা হণ্টচার নম্বর হল্ট—কিছুই পাবার নেই এখানে, আপনি নিশ্চিন্তি হয়ে ঘুমোন।”
সেই ব্যাকুল দৃষ্টি, খুঁজছে। প্রশ্ন করলাম— “যাবেন কোথায়?”
“সরারহাট।”
“বাড়ি?”—প্রশ্নটা করলাম কতক যেন এই ভেবেই যে, কৃষ্ণের জীব, যেমন আরম্ভ করেছে সু-ভালাভালি ঘরে গিয়ে পৌঁছুতে পারলে যেন আমাদেরই একটা অস্বস্তি কেটে যায়।
“আজ্ঞে না, বেহাই-বাড়ি।”
—আঁৎকে উঠতে হোল উত্তর শুনে।
“বেহাই-বাড়ি যাচ্ছেন!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ছোট মেয়েটিকে ঐখানেই পাত্রস্থ করলাম কি না, এই গত মাঘে।”
ঠায় চেয়ে রয়েছি, মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্চে না। একে এই কুটুম, তাতে আবার নতুন কুটুম, কী সর্বনাশটাই যে ঘটাতে চলেছে গেরস্তের বাড়িতে!
“এই প্রথম যাচ্ছেন কুটুম্বিতার পর?”
“না, একবার হয়ে এসেছি, এর আগে।”
চেয়েই আছি অবাক হয়ে। জেনেই জিগ্যেস করলাম, কিম্বা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল— “খবর দিয়ে যাচ্ছেন?”
—কার বিপদ, আর কার মাথা-ব্যথা!
আসল কথা, বেহাইয়ের ওপর মনটা মমতায় উঠছে ভরে, বোধহয় মগ্নচৈতন্যে এমন একটা শুভ সম্ভাবনার কথা উদয় হয়ে থাকবে যে, খবর দিয়ে গেলে সে-বেচারা তবুও বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে সপরিবারে কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করতে পারে।
মনে গলদ থাকার জন্যেই প্রশ্নটা করে নিজেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি; কিন্তু বাঁচোয়া, লোকটা ধরতে পারেনি,; অত খেলে বুদ্ধির ধার মোটা হয়ে যায়ই, জঠরের শক্তিও হবে আবার মাথার শক্তিও হবে, ভগবান অত দুহাতে দান করেন না।
বললে— “খবর দেওয়া আছে, বেহাই থাকবে ইস্টিশনে।”
আমার মাথায় এক চিন্তাই ঘুরে ঘুরে আসছে, আবার প্রশ্ন করে ফেললাম- কেমন গেরস্ত বেহাই?”
“আজ্ঞে তা, বলতে নেই, ভালোই। মেয়ে আমার আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ভালো ঘরেই পড়েছে, মোটা ভাত, মোটা কাপড়টার জন্যে কষ্ট পাবে না, ক্ষেত, খামার, পুকুর-বাগান- বাড়িতে চারটে গাই—দুটো দিচ্ছিলই দুধ, একটা আবার নতুন বিয়েছে, তাই বিশেষ করে লিখে পাঠিয়েছেন বেহাই—না, সেদিক দিয়ে মেয়ে আমার…
মেয়ের কথা ভাবিনি, যার কথা ভাবছিলাম, তার কথা ভেবেই মনটা বেশ হাল্কা হয়ে উঠল। আহা ভালোই, সম্পন্ন গেরস্ত, তার দুধের ওপর দুধ উছলে উঠছে, সে ভোজনবিলাসী নতুন কুটুমকে ডেকে এনে আমোদ-আহ্লাদ করছে—এযুগে একটা শোনবার কথা। বাঙলার একটা বিস্মৃত রূপ যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে—কুটুম এসেছে, পুকুরে পড়ল জাল, গোয়ালে চোচা শব্দের বিরাম নেই; খাইয়ে কুটুম, আহার দেখিয়ে সবার তাক লাগাচ্ছে, গেরস্ত ভাবছে লক্ষ্মীর আমার এতদিনে বেরুল জলুস…
এতক্ষণ কথায় যে একটা ব্যঙ্গের ভাব ছিল, সেটা কেটে গেছে, বেশ সহজ আনন্দেই প্রশ্ন করলাম— “তা অমন কুটুমবাড়ি যাচ্ছেন, অথচ খাওয়ার পাট রাস্তাতেই একরকম সেরে নিয়ে মানে, তাঁদের নিরাশ করা…”
অল্প হেসে পেটে হাতটা একবার বোলালে, বললে— “আজ্ঞে না, এতে ‘ক্ষেতি হবার কথা তো নয়—পাওয়া গেল কোথাও কিছু? দেখলেন না স্বচক্ষেই?”
তা দেখলাম বৈকি।
শুয়ে পড়ল! বাজে কথায় অনেক সময় নষ্টও হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল; আশ্চর্য ক্ষমতা দেখলাম। এখুনি না তোমায় লিখেছি, ভগবান দুহাতে দান করেন না? কথাটা যে খুব সত্যি, তা কি করে বলি?—এই দুঃখের দুনিয়ায় একটা লোক শুধু খেয়ে উঠে ঘুমোচ্ছে, আর ঘুমিয়ে উঠে খাচ্ছে, এ যাঁর বিধানে সম্ভব, তাঁর দানকে অমন সীমাবদ্ধ করাই বা যায় কি করে? এর ওপর আবার বেছে বেছে তাকে অমন বেহাই-বাড়িও দিয়েছে জুটিয়ে।
গায়ে পড়ে ঢুলছিল, বুড়ি নেমে যেতে একটু শুতে পেয়ে নাক ডাকতে আরম্ভ করেছে। বেশ লাগছে, কেননা, তৃপ্তি দেখেও তৃপ্তি যাওয়া যায়, সব সময় যে হিংসেই হতে হবে, এমন কি কথা আছে?
ফুটবল খেলা হচ্ছে। দূরে ওটা নিশ্চয় ইস্কুল; ওরই খানিকটা এদিকে একরকম চষা মাঠেই হচ্ছে খেলা। এ-জিনিসটা আমায় বড্ড টানে, এখনও। খেলা বা খেলা দেখার কথা দূরে থাক, এক সময় ফুটবলের চিন্তায়ই যে আনন্দ পেতাম, বোধ হয়—কি তুলনাটা দিই?—বিয়ের চিন্তাতেও সে আনন্দ পাইনি। এক সময়ের কথা বলছি, যখন বিয়ের কথা আতঙ্কের কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনকার কথা নয়। এখন খেলা গেছে, চিন্তারও অবসর নেই, তবে দেখার আনন্দ আর উত্তেজনাটা বজায় আছে, একেবারে ততটা না হোক। এক কথায় ঐ জিনিসটা আমার যৌবনকে ডেকে নিয়ে আসে এখনও। এ কথাটা এ চিঠিতেই তোমায় আরও দু-এক জায়গায় লিখেছি—অর্থাৎ আমাদের জীবনে সবই একসঙ্গে রয়েছে—শৈশব, কৈশোর, যৌবন—অর্থাৎ যা অতীত, তা তো বটেই, এমন কি, যা আগামী প্রৌঢ়তা বার্ধক্য, তা পর্যন্ত; সময়ের ডাক পড়লে, ঠিক সেই ভারে ঘা পড়লে, বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।…আমি বয়সকালেই মাকে হারিয়েছি—কিন্তু সেদিনের সেই অসহায়তা—সেই যেন বুক থেকে খসে পড়বার ভাবটা এতই সত্য আর এতই নিবিড় হয়ে ফুটে উঠেছিল, সে এখনও মনে পড়লে ঝিমিয়ে আসে মনটা। অথচ অবস্থা তখন কত উল্টে গেছে দেখো, যাঁর স্তন্য ছিল জীবনের সম্বল এক সময়, আমি তখন উপার্জন করে তাঁর মুখে অন্ন দিচ্ছি, সন্তানই তখন মাতা, সন্তান তখন পিতা।…বড় গোলমেলে ব্যবস্থা নয় ভগবানের অবশ্য ভগবানকে চটাবার ইচ্ছে নেই, গোলমেলে আমাদের বুদ্ধির খর্বতার জন্যেই; তবে এ রকম বিরাট জটিল বিশ্ববিধানের মধ্যে এ রকম খর্ব বুদ্ধি দিয়ে পাঠিয়ে অন্যায় করেছেন বললে যদি চটেন তো নারাজ।
ফুটবল আমায় এখনও টানে। মোহনবাগান হলে নিশ্চয়ই ভালো, অভাবে, কালীঘাট, কুমারটুলি, শিবপুর, কলেজ, স্কুল—কিছুতেই বিতৃষ্ণা নেই। খেলা জোর চলেছে—দূর থেকে যতটা বুঝতে পারছি। অবশ্য জোর মানে যে উঁচুদরের কম্বিনেশন শট্ ড্রিবলিং, সে সব কিছু নয়; এ অজ পাড়াগাঁয়ে আশাও করা যায় না; তবে জোর খেলার তো আরও লক্ষণ আছে, মাঠে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ছে সব ঘন ঘন—ধাক্কা, ল্যাং, চোরা গোঁত্তাও চোখে পড়ল হেন গোটা দুই, রেফারি সামলাতে পারছে না। শুধু তাই নয়, রেফারিকেই সামলানো একটা সমস্যা হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে,—একটা বেশ বলিষ্ঠ খেলোয়াড়কে বাইরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বের করে দিতে চেয়েছিল, কলকাতার স্টাইলে, সে হরিণডাঙা সরারহাটের স্টাইলে এগিয়ে এসে নাকের কাছাকাছি পর্যন্ত ঘুষিটা বাড়িয়ে এনে আবার খেলতে শুরু করে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে কি মন্ত্র ঝাড়লে অবশ্য এত দূরে কানে এসে পৌঁছল না। কয়েকটা ছেলে রেফারিকে লক্ষ্য করেই শটও হাঁকড়ালে, আইন বাঁচিয়ে ভদ্রভাবে পেড়ে ফেলতে চায় আর কি।
তুমি বলবে, খেলা কোথায় যে দেখতে যাবে?…ও-ও তো খেলাই, গা বাঁচিয়ে ডিঙিয়ে- ডিঙিয়েই যে খেলতে হবে, গায়ে আঁচড়টি লাগবে না, তার মানে কি? সে কথা বাদ দিলেও আমি এই ধরণের খেলাতে কতকটা অভ্যস্তও। আমাদের সময়ে আমাদের ছাপরা, আরা, দানাপুর, গয়া, মতিহারী খেলতে যেতে হত। মোতিহারীকে শুধু উগ্র তামাক পাতার জায়গাই বলে নিশ্চিন্ত থেকো না, সবই উগ্র ওখানকার। আমাদের টিংচার আয়োডিন আর হর্স এম্ব্রোকেশন (Horse embrokation) ছাড়া পটি বাঁধবার জন্যে যথেষ্ট ব্যান্ডেজও নিয়ে যেতে হত। পকেটে যে শ্মশানকালীর ফুল থাকত সেটা বাড়তির মধ্যে…ছাপরার মাঠের পাশেই আবার একটা মকাইয়ের ক্ষেত ছিল; ইচ্ছাকৃত কি মাত্র একটা যোগাযোগ তা বলতে পারি না তবে কম্পিটিশনের শেষ দিকটা ওরা ঠিক সেই সময়ে ফেলত যখন মকাইয়ের ডাঁটাগুনোও বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে।
সাধু সাজছি না, আমরাও নিরীহ ছিলাম না নিতান্ত, কি করব? যে যুগের আর যে জায়গার যা বিধি—ওর মধ্যে থেকেই কাপ-শীল্ড নিয়ে আসতে হবে, কেঁচো হয়ে তো কেউটের মাথার মণি ছিনিয়ে আনা যায় না। একবার মনে আছে, খেলোয়াড়দের সঙ্গে যা বোঝাপড়া হবার তা তো হোল, শেষকালে গোলের কাছে একটা ফ্রি কিক্ দিতে রেফারিকে ইতস্তত করতে দেখে সেন্টার ফরোয়ার্ড আমার সেজ ভাই এক হাতে বলটা তুলে নিলে, তারপর এক হাতে রেফারির কব্জিটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফাউলের জায়গাটিতে বলটি বসিয়ে তাকে বললে—ভালো চাও তো · হুইসিল দাও। নিজেদের মাঠ নয়, বাইরে খেলতে গেছি; মেরে তক্তা করে দেবারই কথা, কিন্তু এই চরম দুঃসাহসে দর্শক, শ্রোতা এমন তাক্ লেগে গেল যে, একটা আওয়াজ পর্যন্ত করলে না।
তা ভিন্ন ওরা পছন্দও যে করে এইসব; দুঃসাহসের অর্থটা আমাদের অভিধানে এক; ওদের অভিধানে আর। কেন, সে-যুগের ছাপরা-মোতিহারীই যে আদর্শ, তা অবশ্য বলছি না, তবু খেলায় এই যাকে বলে Hustling tactics অর্থাৎ গুঁতোগুতি ধস্তাধস্তি—ওটা বাইরেও সর্বত্রই রয়েছে। এই কলকাতার মাঠেই করিন্থিয়ানদের দেখেছি, স্ক্যান্ডেনিভিয়ান টিমও দেখলাম, চীনে টিমও দেখলাম — ক্রীড়ানৈপুণ্যও আছে, সঙ্গে সঙ্গে পেশী-নৈপুণ্যের অভাব নেই।
তোমরা বাপু অতিরিক্ত বুদ্ধিবাদী, অত চালাকিতে কাজ হয় না। এক সময় না এক সময় বুদ্ধিও যায় ফেল মেরে, অর্থাৎ মাসসের সামনে আটকে। আমার তো মনে হয় ঠিক এই জন্যেই বাঙালি একটা ভালো সেন্টার ফরওয়ার্ড বেরুল না। অর্থাৎ গোলের সামনে একেবারে চরম মুহূর্তে বিপক্ষ যখন মরিয়া হয়ে দাঁড়ায়, অতিরিক্ত বুদ্ধিবাদীর দৌর্বল্যটা প্রকাশ হয়ে পড়ে বাঙালি খেলোয়াড়ের। সব মা সজাগ করে নিয়ে মালের স্তূপে ঝাঁপিয়ে পড়বার সাহসটা আর থাকে না। খবরের কাগজগুনো মন্তব্য করে—He failed at the right moment. His shot lacked powder-
—মোক্ষম সময়টিতে জিভ বের করে ফেললে; গুলি দাগলে, কিন্তু বারুদের অভাব ছিল…
অবশ্য সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই; সে খেলোয়াড়ও নেই, সে ছাপরা-মোতিহারীও গেছে। এখন ওখানকার ছেলেরাও ফিনফিনে ধুতির কোঁচা দোলায়, ভাতের চালটা সরু না হলে সারাদিন ঢেঁকুর তুলে সোডার বোতল খুঁজে বেড়ায়, মাথায় টুপি কিম্বা টিকি থাকলে ওজনের ভারসাম্য হারায়, তেল-চুকচুকে মাথায় লম্বা টেরি তুলে ফুরফুরে হাওয়ায় রাস্তা করে দেয়। এখন বঢ়হদেও তেওয়াড়ীকে মনে হবে যেন তরুণ সেন।
ইচ্ছে হচ্ছে দেখে আসি নেমে, কিন্তু সাহস হচ্ছে না। গাড়িটা কি একটা কারণে হল্টে একটু আটকে গেছে, কিন্তু গলা বাড়িয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম এবার আর ইঞ্জিন বিগড়োবার জন্যে নয়, পয়েন্ট অর্থাৎ লাইনের জোড়ে কি একটা গোলমাল হয়েছে সামনের স্টেশন সরারহাটে। একটু সময় যাবে পাওয়া, কিন্তু বেলা পড়ে এসেছে, পেছনে আর গাড়িও নেই, সাহস হল না।
আহা, হোত আমাদের সে যুগের বি.এন.ডবলিউ.আর। সে স্বরাজের কল্পনাও করতে পারবে না। স্টেশন মাস্টারের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজা হচ্ছে, গার্ড, ড্রাইভার, ফায়ারম্যান নেমে গিয়ে হাত জোড় করে বসল—হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান—কেউ বাদ নয়,—কথকতা শুনলে, প্রসাদ নিলে, আবার ভক্তিমন্থর গতিতে এসে নিজের নিজের ডিউটিতে মোতায়েন হল। একবার রাস্তার ধারের একটা বড় পুকুরে ছিপে মাছ গেঁথে শিকারী হিমসিম খাচ্ছে দেখে, ড্রাইভার নেমে গিয়ে সামলে দিয়েছিল মনে আছে, নামটাও মনে আছে, আলি জান, নালিশ করব বলে রেগে-মেগে টুকে রেখেছিলাম। নালিশ অবশ্য করা হয় নি। আলি জান একটা প্রায় অর্ধমণের কাৎলা ডাঙ্গায় তুললে; একটা দুর্লভ দৃশ্য, তারই উল্লাসে মনটা কেমন উদার হয়ে গেল, ভাবলাম এরা মুক্ত জীব, নৈলে এরকম চাকরি কপালে জোটে না, থাক, ভোগ করুক।
নালিশ না করে একটা গল্পে আলি জানকে ট্রিবিউট্ দেওয়াই ঠিক করি; আমার ‘বি এন ডবলিউর ব্রাঞ্চ লাইনে’ গল্পটা পড়ো। পড়ে আলি জানের ওপর যদি রাগ পুষে রাখতে পার সেটাও জানিও।
খেলা দেখছিলাম স্টেশনের উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে, হঠাৎ প্লাটফর্মের দিকে দরজার খটখটানি আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রস্ত কণ্ঠস্বর— “দোরটা খুলে দিন—খুলে দিন না দোরটা—ছেড়ে গেল বুঝি গাড়িটা।….
ফিরে দেখি একটি বৃদ্ধ গোছের লোক, তার বুকে একটি শিশু, পাশেই একটি তরুণী বিহুলভাবে দাঁড়িয়ে। দরজাটা বেশ কড়াই, আমি এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলাম। লোকটি কাঁপছিল, বললাম— “ধীরে-সুস্থে উঠুন, গাড়ি ছাড়বার দেরি আছে এখনও।”
“মেয়েটাকে তুই ধর একটু—সাবধানে, আমি উঠি আগে।”
তরুণীর কোলে দিতে যাচ্ছিল, আমি বললাম— “বরং আমায় দিন।”
কাঁথায় জড়ানো মেয়েটিকে নিয়ে সরে দাঁড়ালাম, ওরা দুজনে উঠে এল। মেয়েটিকে দিয়ে দরজাটা লাগাতে যাব, একটু থেমে যেতে হল। একটা পালকি এসে হল্টের বাইরে নেমেছে, একটি যুবক আর একটি যুবতী বেরিয়ে এল, তারপর আমাদের গাড়িটা সামনে থাকার দরুণ বেয়ারাদের মালপত্র নিয়ে আসতে বলে হন হন করে এই দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল; এদের সঙ্গেও একটি শিশু ছেলে, তবে একটু বড়, বছর সাড়ে তিন-চারের হবে, আর বেশ সুস্থ; যুবকটি কোলে তুলে নিয়েছিল, জোর করেই নেমে হাঁটতে হাঁটতে ওদের আগেই এসে পড়ল। খোলা দোর দেখে উঠতেও যাচ্ছিল নিজে, আমি তুলে নিলাম। ওরা দুজনে উঠল, বেয়ারারাও জিনিসপত্র তুলে দিলে—একটা ভালো ট্রাঙ্ক, দুটো ভালো সুটকেস, জলের কুঁজো, হোল্ড-অলে বাঁধা বিছানা, একটা থার্মোফ্লাস্ক, একটা বন্দুক—ক্যাম্বিসের খাপের মধ্যে। তিনজনে বেশ সুসজ্জিতও, চেহারাতেও মনে হয় বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের। আমি দেখতে বেরিয়েছি—এও বোধ হয় বাঙলার একটি দ্রষ্টব্য রূপ বলেই দেখালেন ভগবান।
আমি যে দিকটায় বসেছিলাম, এরাও বোধ হয় আমার সাহায্যে ওঠার জন্যেই গাড়ির সেই দিকটাতেই বসল, মাঝের কামরায় বেয়ারারা মোটঘাটগুনো তুলে দিলে; তারই একটা বেঞ্চে সেই ভোজনবিলাসীটি ঘুমুচ্ছে, অত যে শব্দ হল, একটু চোখের পাতা নড়ল না। বোধ হয় আহারের সম্ভাবনা না থাকলে ওঠে না, অত গভীর নিদ্রার মধ্যে কি করে যে প্রশ্নটা জেগে থাকে ওর মধ্যে তা ওই জানে! যেন একটা ‘Freak of nature’— প্রকৃতিদেবীর সৃষ্টির মধ্যে একটি ব্যতিক্রম, শুধু কার্যে প্রকাশ পেয়েছে তাই, যদি আকারেও প্রকাশ পেত তো দেখতাম, একটি ধড়, দুটি মুণ্ড, তার মধ্যে একটি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে, একটি চোখ মেলে অবিরাম খেয়ে যাচ্ছে।
ছেলেটি বড় চমৎকার, চঞ্চল বলে সে চমৎকারিত্বের আরও খোলতাই হয়েছে। মা সাজিয়েছেও মনের মতন করে—অবশ্য তার মনের মতন করেই—পায়ে সাদা গোটানো মোজার ওপর নটি-বয় স্ট্র্যাপ জুতো, গায়ে সাদা আর নীল রঙের নেকার-ব্রোকার, মুখে পাউডার; এর ওপর আছে ঠোঁটে রং, কপালে টিপ, চোখে কাজল; বড় বড় চুলগুলি বেষ্টন করে একটি নীল রঙের ফিতে পর্যন্ত মাথায় ‘বো’ (Bow) ফুলিয়ে রয়েছে। বেশ বোঝা যায় এটি মায়ের প্রথম সন্তান। ছেলেয় – মেয়েয় দু’তিনটি না হওয়া পর্যন্ত বাঙালি মায়ের আশা মেটে না। তাই প্রথমটি যদি ছেলে হল তো তাকে টিপ-কাজল-ফিতেয় খানিকটা মেয়ে করে নেয়, যদি মেয়ে হল তো ইজেরের ওপর পেনির বদলে কামিজ-কোট পরিয়ে তোলে বাধ্যমতো ছেলে করে, এই করে ভগবান সদয় না হওয়া পর্যন্ত একের মধ্যে দুইয়ের সাধ মিটিয়ে চলে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবে।
আমরা যে মনে-প্রাণে দ্বৈতবাদী, এটাও তারই একটা ধারা। মেম-মায়েও তো মা, কিন্তু কৈ, এত জটিলতার ধার দিয়েও যেতে দেখেছ?—আদরের এরকম জগাখিচুড়ি করে তুলতে?
চমৎকার ছেলেটি, এই যুগলরূপে যেন আরও চমৎকার; রূপ আবার অনেকখানি ভাবের মধ্যেও তো। অবশ্য শৈশব বলেই; সখিভাবে গোঁফের ওপর নোলক ঝোলাতেও দেখেছি, ভাব বলেই কি তার সাত খুন মাফ?…তা’ ভিন্ন তাকে ভাবই বলবে, না, স্বভাব?
সুন্দর ছেলেটি, দুটি বেঞ্চের মাঝখানের জায়গাটা দখল করে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে; পরিচয় করে গেল— “টোমার নাম কি?”…ওর নিজের নাম “টোরুণ”।
কিন্তু সুন্দর সুস্থ, প্রাণের প্রাচুর্য্যে, চঞ্চল বলেই, এই গাড়ির মধ্যেই একটা দিক যেন আরও বিষাদ-ঘন করে তুলেছে। শিশু মেয়েটি একেবারে অন্য ধরণের।
অত কুৎসিত আর নির্জীব প্রায় চোখে পড়ে না। হয়তো আসলে কুৎসিত নয়, চোখ দুটি বড় বড়, নাকটি টিকলো, রঙও আছে, কিন্তু অদ্ভুত রকম শীর্ণ। এ ধরণের শীর্ণতা আমি এত ছোট শিশুর মধ্যে এর আগে দেখিনি; রগ দুটো বসা, গালের হাড় ঠেলে উঠেছে, মাংস পড়েছে ঝুলে, কপালের মাংসও কোঁচকানো, মাথার চুল পাতলা, সব মিলিয়ে ঠিক যেন একটি বুড়ির মুখ। চোখ দুটি যে বড় বড় দেখাচ্ছে তাও কতকটা মুখে মাংসর অভাবেই, নাকটুকুও সেই জন্যেই অতটা তীক্ষ্ম, রঙটাও ওরকম কটাশে।
মেয়েটিকে দেখলেই একটি বিস্মিত প্রশ্ন জেগে ওঠে মনে—কি করে বেঁচে আছে! একটা অদ্ভুত ধরণের আতঙ্ক আর অস্বস্তি ঠেলে ওঠে।
বসেছি আমরা, আমার বেঞ্চে দু’জন, আমি আর যুবকটি; সামনের বেঞ্চে তরুণী দুটি, এক কোণে বৃদ্ধ। মেয়েটা মায়ের কোলে নেতিয়ে পড়ে জুল জুল করে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, ছেলেটা করেছে দাপাদাপি। এর সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য ওর কদর্যতাকে আরও তুলেছে ফুটিয়ে। কোন্টাকে দেখি?—এ টানছে, ও ঠেলছে বলে যেন আরও বেশি করে টানছে।
তারপর এই অদ্ভুত সমাবেশে, এই বিচিত্র পাত্র-পাত্রী নিয়ে—নায়ক-নায়িকাই বলি—একটি অদ্ভুত একাঙ্কিকা অভিনীত হয়ে গেল—তার রসটা কৌতুক বলি, কি মধুর বলি, কি করুণ বলি বুঝে উঠতে পারছি না, সব মিলিয়ে অনির্বচনীয় বলাই ভালো।…
একটি স্বয়ম্পূর্ণ একাঙ্কিকা নাটকই বৈকি; দৃশ্যের শেষে বিচক্ষণ শিল্পী মঞ্চের আড়াল থেকে নিবিড়-কৃষ্ণ যবনিকাও দিলে যে টানে।
যে তরুণীটি পালকিতে করে পরে এল, সে প্রথমে কতকটা যেন শুচিতা বাঁচিয়েই একটু তফাৎ হয়ে বসেছিল, নিজের ছেলেটাকে সামলাচ্ছে, মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকেও একটু বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছে, তারপর দেখে দেখে কি মনে হল, একটু এগিয়ে গেল। কারণটা আমি আন্দাজেই বলছি, কিন্তু বোধ হয় ঠিকই,—অর্থাৎ নিজে মা বলে ওর বোধ হয় ভয় ঢুকে গেছে; জিগ্যেস করলে— “কি হয়েছে? এত রোগা যে?”
পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, গলাটা একটু চাপাই, একজন অপরিচিত পুরুষও রয়েছে।
ও-মেয়েটি উত্তর দিলে— “বলে তো পেঁচোয় পেয়েছে দিদি, সেই জন্মে ইস্তকই এইরকম, বাড় নেই মেয়ের।”
“চিকিচ্ছে?”
“জলপড়া, ঝাড়ফুঁক, ওঝা, বদ্যি—কতরকম তো করলুম দিদি; ওষুধও চলছে—ডাক্তারে বলে রিকেট না কি। কৈ হচ্ছে কিছু? এক ভাব, বরং খারাপের দিকেই যাচ্ছে দিন দিন; কী যে হবে….’
“কলকাতায় নিয়ে যাও না।”
তরুণী একটু ম্লান হাসি হাসলে, বললে— “কলকাতা দিদি…আমাদের পক্ষে!…বাবা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন—হোমিওপ্যাথির ডাক্তার—গোড়ায় দিন কতক করেছিলেন চিকিচ্ছে, আর একবার দেখবেন চেষ্টা!”…
যেন অসীম আশা আর আশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটির কপালে, মুখে, বুকে একবার হাতটা আস্তে আস্তে বুলিয়ে নিয়ে বললে— “বলছেন তো সেরে যাবে, দ্যাখো, আশা তো হয় না।”
ছেলেটি এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছিল, কতকটা বিফলমনোরথ হয়েই মার কাছে এসে দাঁড়াল।
প্রশ্ন হল— “কত বয়স হল ছেলের?”
উত্তর হল—”ছেলে নয় দিদি, মেয়ে।”
তারপর মুখটা আরও এগিয়ে এনে বললে— “তাই দুদিকেই ভয় দিদি, যায় তো গেলই, আর যদি বাঁচে তো এই রূপ নিয়ে…”
গলা ধরে এল, চোখ ডডবিয়ে মেয়েটার কপালেই বড় বড় দু’তিনটে ফোঁটা ঝরে পড়ল। দ্বিতীয়া তরুণী এখনও কতকটা আলাদা হয়েই ছিল, শুচিতা বাঁচিয়ে, এবার আঁচল দিয়ে সেটুকু আস্তে আস্তে মুছিয়ে বললে— “চুপ করো, সন্তানের গায়ে এরকম করে চোখের জল পড়তে নেই। …এই ছিরিই কি থাকবে? ভালোও হবে, ছিরিও খুলবে আবার মেয়ের।”
শরতের মেঘটা হঠাৎ কেটে গিয়ে খানিকটা আলো ঝলমলিয়ে উঠল; ছেলেটি এতক্ষণ মায়ের হাটু জড়িয়ে চুপ করেই দাঁড়িয়ে কতকটা যেন বিমূঢ়ভাবে দেখছিল, “মা, বউ?” বলে এক পা এগিয়ে গেল।
“এই রে সব্বনাশ!”—বলেই মা হাতটা ধরিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মুখটা ঘুরিয়ে খিল-খিল করে চাপা গলায় হেসে উঠল।
প্রশ্ন হল— “কি দিদি?”
“ও বউ নয়।”—বলে তরুণীটি ততক্ষণে টেনে নিয়েছে ছেলেটিকে, উত্তর করলে— “এ এক গেরো ভাই; ঐ যে শুনেছে মেয়ে…ছোট মেয়ে হলেই সে ওর বউ…এমন বউ-পাগলা ছেলে দেখো নি!…ঐ যা, ডাকছে।
বাপ ডাকছিলই, তার দিকে ঠেলে দিলে।
এক একটা ছেলে সত্যিই এইরকম জন্ম-নায়ক হয়ে জন্মায়। আমি আর একটিকে দেখেছিলাম মজঃফরপুরে একটা ছোটোখাটো বৈঠকী মজলিসে। বয়স প্রায় এইরকমই, সে আবার ছিল একনিষ্ঠ। আর আকর্ষণ ছিল এক প্রতিবেশী একটি কন্যা। ছেলেটি বেশ চুপচাপ করে বসে খেলছিল, মেয়েটিকে নিয়ে ওঁরা আসতেই সতর্ক হয়ে উঠল; মুখে কিছু বলা নয়, শুধু ধরবে মেয়েটিকে। বড় একটি ঘরের মধ্যে বৈঠক, মেয়েটি ছুটে বেড়াচ্ছে, অনেকটা ভীতভাবেই, এ তাড়া করে বেড়াচ্ছে, মুখে কোন কথা নেই, ভরা মজলিসের এতগুলো লোকের হাসি-মন্তব্যে দৃপাত নেই, আরও সব রঙচঙে পেনিপরা মাথায় বো লাগানো মেয়ে আছে, ভূক্ষেপ নেই, ওকে ধরবেই, আর ধরলেই বরের দাবী, একটি চুমো।
অত নিরীহতার স্তরে অমন একটা অভিনব দৃশ্য আমি আর দেখিনি। এ-বর সে রকম ‘Aggressive’ নয়, তবে নাছোড়বান্দাও কম নয়। বাপ ধরে রাখতে পারছে না— “বউ…আমাল বউ…বউ যাব…পাউডাল, চোনো, গয়না…!”
হার এনে ছেড়ে দিতে হল বাপকে। পাঁচজনের সামনে একটা যে অপ্রীতিকর অবস্থা দাঁড়িয়েছে—অনেকটা পুত্রবধূর স্বাস্থ্য আর কদর্যতার জন্যেই—তার অস্বস্তিটা কাটাবার জন্যে দোষটা স্ত্রীর ওপর চাপালে— “যেমন অব্যেস করানো হয়েছে!”
স্ত্রীও একটু আড়ে চড়ে নিয়ে চাপা গলায় জবাব দিলে— “নাঃ, আর কেউ তো করায় নি!”
পাঁচজন রয়েছে বলেই দাম্পত্য কলহটা আর এগুতে পেল না; ছেলে ইতিমধ্যে এগিয়ে গেছে।
খুকির মায়ের হাঁটুতে বুকটা চেপে ডিঙি মেরে তার মুখটার দিকে কৌতুক দৃষ্টিতে একটু চেয়ে রইল। আমি চোখ দুটির দিকে চেয়ে আছি; অপূর্ব এক শুভদৃষ্টি!—নিচে নিষ্প্রভ দুটি চোখ, তাতে বিদায়ের ছায়া ঘন হয়ে এসেছে, ওপরের দুটি চোখে অনন্ত বিস্ময় আর অনন্তই যে কি একটা, ঠিক ধরা যায় না। শিশুরও একটা সহজ বোধ আছে, একটা সৌন্দর্যজ্ঞান আছে,—অবস্থাটা যে স্বাভাবিক নয় এটা উপলব্ধি করে যেন হঠাৎ কি রকম হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সৌন্দর্যজ্ঞান থাকলেও, একটু নিরাশ হলেও, দৃষ্টিতে এতটুকু বিতৃষ্ণার রেখা ফুটল না; দাঁড়িয়েই রইল অপ্রতিভভাবে একটু—আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি, দেখিই না, গ্রহণ কি প্রত্যাখ্যান,—একসময় মেয়ের মার মুখে দৃষ্টি তুলে আস্তে আস্তে বললে— “বউ।”
তরুণী এক হাতে ওকে একটু জড়িয়ে ধরলে, আধ ঘোমটার মধ্যেই কথা বললে— “এ কী বউ বাবা? তোমার জন্যে রাজকন্যে আসবে ঘর আলো করে—কত বাজনাবাদ্যি, কত….
গলাটা ধরে গেল, চোখে আঁচল দিতেও হল—নিজের সাধের কথাও যে সমান্তরালে ওদিকে চলতে থাকে মায়ের মনে—মেয়েকেও আমার নিতে আসবে না রাজকুমার?—চারিদিকে আলো করে?—কত বাজনাবাদ্যি, কত….
সাহসের মুখেই এই অশ্রুর নদী দেখে ছেলেটি আবার অন্যভাবে অপ্রতিভ হয়ে মায়ের কাছে সরে এল, তারপরেই এই অপ্রতিভ ভাবটা অন্য পথ ধরলে—কতকটা যেন নিজের মান বাঁচাবার জন্যেই— “বউ-বউ”—বলেই বার দুই-তিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একেবারে কান্নায় ফেটে পড়ল। তারপরেই শিশুদের যা হয়ে থাকে—মাথা চালা, হাত-পা নাড়া, মাকে মার, আর কান্নার আওয়াজ যতটা সম্ভব ওপরে তোলা যায়।…নিজের পরাজয়, নিজের লজ্জা ঢাকছে।
“পাউডাল দাও—টিপ—পিঁতে—চোনো—বউ প’লবে…”
বাপ-মা দুজনেই বিরক্ত হয়ে গেছে, বাপ একটু বেশি, স্ত্রীকে পর্যন্ত দায়ী ক’রে নিয়েছে কিনা; একেবারে বাইরের দিকে ঘুরে বসেছে। বাড়ি হলে এতক্ষণ চড়ে-চাপড়ে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টা হ’ত, এখানেও সে চেষ্টার বিলম্ব হবে না আশঙ্কা ক’রে আমি ছেলেটিকে টেনে নিলাম।
পিঠে হাত দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করতে লাগলাম— “চুপ করো তো, লক্ষ্মী; বাঃ, খোকা আমাদের কি সুন্দর বর সেজেছে।—কেমন ইজের, কামিজ! মাথায় এই টোপর…”
ও-ও বেঁচেছে, একটু আদর হলেই মানটা থেকে যায় তো। কান্না থেমেছে, দুবার ফুঁপিয়ে বললে— “তোপোল না, পিঁতে।”
ভুলটা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিতে হ’ল, যেন একটু ঠাহর ক’রে দেখে নিয়ে বললাম— “ও তাই তো, দেখো আমার কি বোকামি! এটা তো ফিতেই দিখছি, চমৎকার ফিতে, খোকার জন্যে তাহলে টোপোর শীগগির আনাতে হবে যে—বাড়িতে গাড়িটা পৌঁছুলেই খোকা বে বিয়ে করতে যাবে! — রাঙা টুকটুকে বউ…”
মা একবার আড়চোখে ছেলের দিকে চাইলে, কতকটা ব্যঙ্গ, কতকটা গৌরব, ছেলেও চাইলে একবার ঠোঁট দুটো জড়ো ক’রে। তারপর বোধ হয়, আমার দুরভিসন্ধিটা বুঝতে পেরে ঠোঁটের ওপর ডান হাতের তর্জনীটা বেঁকিয়ে ধরে একটু সন্তর্পণেই বললে— “ঐ বউ”!
ওর মা মুখটা ঘুরিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল, আমিও উঠেছি হেসে, ওর বাপও অল্প একটু হেসে মুখটা একবার ঘুরিয়ে বললে— “ও সাত ত্যাঁদড়ের এক ত্যাঁদড়!”
আবার অপ্রতিভাবে দুজনের দিকে চাওয়াতে তাড়াতাড়ি বললাম— “হ্যাঁ, ঐ বউই তো। খোকা আমার তো বুঝতে পারে নি; এ বউ ছাড়া আবার কোন্ বউ! অসুখ করেছে, বউ বাড়ি গিয়ে ভালো হবে, রাঙা টুকটুকে হবে, খোকা গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসবে…”
“না; একুণি।”
বৃদ্ধ সেই একভাবে গাড়ির বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে, শুধু মাঝে এক একবার দেখে নিচ্ছে মেয়েটিকে—একটা নির্বিকার দৃষ্টি। আর একবার দেখে নিয়ে, মুখটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললে— “কখন যে ছাড়বে গাড়িটা!”
“এক্ষুণি” বলেই বর আবার মুখ ভার করেছে। বৃদ্ধের কথাতেই আমি গলা বাড়িয়ে বাইরে দেখে নিয়ে আবার ঠিক হয়ে বসতে বললে— “এক্ষুণি বউ যাব, ঐ বউ—পাউডাল–চোনো…
প্রবঞ্চনা বুঝতে পেরেছে, মুখ বেশ ভার, চোখের পেছনে জল ঠেলছে, আমি তরুণীকেই লক্ষ্য করে বললাম— “স্নো-পাউডার কিছু থাকে তো দাও একটু বের করে মা; এবার চটলে সামলানো যাবে না”
তরুণী খুকির মায়ের দিকে চেয়ে বললে— “রোগা মেয়ের গায়ে যে ওসব দিতে নেই।”
তাও তো বটে। নতুন কি বলে সাত ত্যাঁদড়ের এক ত্যাঁদড়কে সামলাব ভাবছি, খুকির মা-ই জবাব দিলে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে একদিকে একটু চেয়ে নিয়ে ম্লান হেসে বললে— “দিন, বায়না ধরছে। অ্যাঁ বাবা, দোষ আছে—তেমন?”
বৃদ্ধ আরও নির্বিকার দৃষ্টিতে চাইলে এবার মেয়েটির দিকে, কতকটা যেন অন্যমনস্কভাবেই টেনে টেনে বললে— “দো-ষ আর কি?…কখন যে গাড়িটা ছাড়বে।”
এরপরেই কোথা দিয়ে কি যে হল, সবার মনেই একটা যেন অদ্ভুত প্রসন্নতা এসে গেল। অদ্ভুত বললাম ঠিক প্রকাশ করতে পারছি না ব’লে, বোধ হয় বিষণ্ণতা বললে ঠিক হয়, একটা ‘আহা’র ভাবের সঙ্গে, এই ছুতোয় মেয়েটিকে যে একটু সাজাতে পারা যাচ্ছে তার জন্যে একটা তৃপ্তি। ছেলের মা উঠে ট্রাঙ্ক থেকে সব বের করে আনলে—পাউডার, স্নো, কাজললতা, আলতা, খানিকটা ফিতে, একটা এসেন্সের শিশি পর্যন্ত; দু-একটা কথাবার্তা হওয়ায় আমার কাছে সঙ্কোচটা একটু কেটে গেছে, ওদিকে তো বৃদ্ধই, সব সরঞ্জামগুলি সামনে জড়ো করে যেটুকু সঙ্কোচ বাকি আছে, তার মধ্যেই একটু মেয়ের মাকে উদ্দেশ করে চটুল হেসে বললে— “দাঁড়াও, এবার সাজাই আমার বউকে।”
তরুণীই তো; প্রথম সন্তানের মা, এই সেদিন পর্যন্ত খেলাঘরে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছে; তারই একটি দিন যেন কোন্ পথে হঠাৎ পড়েছে এসে।…চমৎকার লাগছে!
খুকির মা বিষণ্ণভাবে হেসে বললে— “কিন্তু কি জাত, কোথায় বাড়ি, কেমন ঘর তা তো জিগ্যেস করলে না দিদি!”
“ওমা, তাই তো! ছেলের মতন আমিও বউ দেখে ভুলে গেছি ভাই…”
প্রসন্ন মনে বললেও খচ্ ক’রে কথাটা যেন সবার কানে একটু বাজল, এক মুহূর্তের একটা ছায়া গেল যেন বিছিয়ে সবার মুখে, তখুনি কিন্তু সামলে নিলে তরুণী— “হ্যাঁ, তাও বলি—আজকাল নাকি আবার ওসব বিচার আছে? ছেলের বউ পছন্দ, ব্যস, বেয়ান আমার ধাঙড়নি হ’লেও আপত্তি নেই।”
—নতুন বেহানকে টাটকা-টাটকি ঠাট্টা ক’রে আবার মুখটা ঘুরিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল; বললে— “রোস, সাজাই এবার।’
স্নোর কৌটোটা খুলে আঙুলে একটু মাখিয়ে কিন্তু থেমে গেল, আবার একটু বিষণ্ণতা, একটু ভয়; বললে— “না ভাই, তুমিই মাখাও, সাজাও; বড্ড আলগা হাতে করতে হবে, আমি ঠিক বুঝতে পারব না বোধ হয়।”
চেয়ে আছি, মা মেয়েকে বিয়ের ক’নে সাজাচ্ছে—বেদনা ঠেলে একটা অপরূপ আনন্দ, আনন্দ ঠেলে একটা অপরূপ বেদনা, তেমন দৃশ্য আমি আর কোথাও দেখিনি। যা কখনও হবার আশা নেই, তাকেই যেন সার্থক ক’রে নেওয়া আজ; স্নো, গালে ঠোটে একটু রঙ, সমস্তর ওপর হালকা পাউডার, চোখে কাজল,—এক একটা লাগাচ্ছে আর একটু থেমে গিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে—কী যে তৃপ্তি, কী যে অতৃপ্তি, সে এক মায়ের দৃষ্টিতেই দিয়েছেন ভগবান।
আমায়ও আজ কী যে দেখালেন!…তাঁকে অসংখ্য প্রণাম।
বরও ব’সে নেই, অল্প দুলে দুলে দেখছিল, কতকটা যেন অনুমোদনের ভঙ্গীতে; শাশুড়ি প্রশ্ন করলে— “কি বাবা, হল পছন্দ?”
মা একটু মুখ ঘুরিয়ে ছেলের হয়ে হেসে বললে— “ওমা! সে আমার ছেলে আগে চুকিয়ে রেখেছে, পছন্দ বলেই তো এত হাঙ্গাম গো!”
ছেলে কিন্তু কথাটা দাঁড়াতে দিলে না, একটু ডিঙি মেরে দেখে নিয়ে নিজের কপালে তর্জনীর ডগাটা টিপে বললে— “তিপ?”
দুজনেই হেসে উঠল, আমাকেও যোগ দিতে হ’ল, ওর বাবাকেও; শাশুড়ি টিপ্পনী করলে “দ্যাখো! মা হয়ে ছেলে চেনো না দিদি, আমি শাশুড়ি হতে না হতেই কিন্তু জামাইকে চিনেছি…”
হাসির মধ্যেই উত্তর হ’ল— “আজকালকার ছেলে যে ভাই, মায়ের চেয়ে শাশুড়িই আপনার।”
ছলছল হাসির মধ্যে বৃদ্ধ একবার সেই নির্বিকার দৃষ্টিতে ফিরে চাইল; তার যেন একটিমাত্র চিন্তা—গাড়ি ছাড়ে না কেন!
ফরমাসী বলে মা টিপটি বসাতে মনের সমস্ত দরদ যেন ঢেলে দিলে; হেঁট হয়ে মাথার কাঁটার মুখে কাজল নিয়ে খুব যত্ন ক’রে ভুরু দুটির মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল, জিগ্যেস করলে— “এবার…হয়েছে তো?”
“পিঁতে।”
এবার একটু হাসি উঠল। মা কতকটা পুত্রগর্বে টিপ্পনী করলে— “নাও! ছেলেকে আমার ফাঁকি দেবে!”
আনন্দ যে মনে ঠেলাঠেলি ক’রে বেরুবার চেষ্টা করছে, তাইতেই ক্রমাগত ভুল, তরুণী সুধরে নেবার পথ খুঁজতেই যেন ঘাড় ফিরিয়ে একবার আকাশের দিকে চেয়ে বললে— “লগ্ন যে বয়ে যাচ্ছে ওদিকে—কোন্ দিকে সামলাই?”
এত সত্যি কথা বোধ হয় কোন মার মুখ দিয়ে কোন দিন বেরোয় নি
লগ্নই বটে—লগ্নের রাজা গোধূলি লগ্ন। আকাশ রাঙিয়ে সূর্যের প্রায় সমস্তটাই গেছে অস্ত, নেমে এসে পৃথিবীর অধরে প্রথম বাসর চুম্বনটি দিয়ে সে যেন রাঙা কিরণে কণ্টকিত হয়ে উঠেছে কুলায়ে-ফেরা পাখির ডাক—কাছে কোথায় একটি বধূ সন্ধ্যার শাঁখ বাজিয়ে দিলে, খানিকটা আগেই, বোধ হয় নিবিড় গাছপালায় ঢাকা গৃহপ্রাঙ্গণে সময়ের অত আন্দাজ না করতে পেরেই। একটা ভুল করিয়েই সেই অলক্ষ্য-শিল্পী যেন লগ্নের রূপটা আরও দিলে ফুটিয়ে।
তারপর…কিন্তু সেটা আমার ভুলও হতে পারে, কেননা জানলা বেয়ে তখন একটি রাঙা রশ্মি ভেতরে এসে পড়েছে…একটা রূপান্তর—ছেলেটির অমৃত দৃষ্টির নিচে—কোথা থেকে এল মেয়েটি!…এই ছিল নাকি এতক্ষণ?—চীনে সিল্কের মতন পাতলা চামড়া ভেদ করে তার অণুতে অণুতে ঐ রাঙা রশ্মির পথ ধ’রে যেন অন্য কোন্ লোকের আলো প্রবেশ করে সমস্ত মুখটা দিয়েছে ঝলমলিয়ে, আর…এও হয়তো আমার ভুলই—ছেলেটি যে মুগ্ধ নত দৃষ্টিতে রয়েছে দাঁড়িয়ে, তারই মুখে চোখ তুলে একটি অপরূপ হাসি—অতি ক্ষীণ, তবু অতি অপরূপ।…ভুলই বা কেন হবে?— সুন্দর খেলার জুটিও তো একজন…
সবাই দেখছে, বাপ মুখ ফিরিয়ে অল্প অল্প হাসছে, নতদৃষ্টি দুটি তরুণীর অধরের ম্লান মুগ্ধ হাসি, আলোর আভা পড়েছে সমস্ত গাড়িটার ভেতর; একখানি অপার্থিব ছবি; সেই কোন্ অদৃশ্য শিল্পী আঁকছেই তো…
বৃদ্ধ বাইরের দিকেই চেয়েছিল, মুখ ফেরাতে তার মুখেও এবার হাসি ফুটল।
“বাঃ! নাতনী যে দেখছি একেবারে পরীটি…”–এইটুকু বলেই কিন্তু সে থেমে গেল। আমার দৃষ্টি তার মুখে গিয়ে পড়েছে, দেখি ভুরু একটু কোঁচকানো, দৃষ্টি স্থির, তীক্ষ্ণ, যে ডাক্তার উঠেছে জেগে। ভেতরকার ভয়টা চাপা দেবার চেষ্টা ক’রেই বললে— “বিনু, মুখে একবার মাইটা দে তো মা, শীগগির…”
আঁচলের আড়াল ক’রে নিয়ে তরুণী স্তন্য দিতে লাগল—দেবার চেষ্টাই বলা ঠিক…অশোভন হ’লেও তীক্ষ্ণ উদ্বেগে চেয়ে আছি—শোভন অশোভনতার বাইরে একটা অবস্থা তো… চেষ্টা করছে মা—স্তনটিও যেন জীয়ন্ত হয়ে উঠেছে—কি করে বুকের একটু অমৃতবিন্দু ঢেলে দিতে পারে অধরের ফাঁকে…
একটু পরে মুখটা ঘুরিয়ে ক্ষীণ শুষ্ক কণ্ঠে বললে— “মাই তো ধরছে না বাবা!…কেন বাবা!…কেন!…”
–সে যা দৃষ্টি, সেও এক শুধু মায়ের চোখেই ফোটে। বৃদ্ধ মুখটা ফিরিয়ে নিলে।
এরপর যতটুকু ছিল একবার কাঁদলে না মেয়েটা। ভয়, লজ্জা—এ মেয়ে কোলে কবে কি ক’রে নামবে? একটুও কাঁদলে না, শুধু গলা শুকিয়ে যাবার জন্যে মাঝে মাঝে ঢোক গিলতে লাগল।…দু-একবার আবার চেষ্টা করলে মাই খাওয়াবার, তারপর বাবার ঘোরানো মুখের দিকে ঘুরে ঘুরে চাইতে লাগল—কেউ বলুক না কি হয়েছে মেয়ের ওর? মাই ধরে না কেন আর!…
ওরা এখানেই নেমে ফিরে গেল।
.
আমি ভাবছি, সেই অদৃশ্য শিল্পী অমন নিখুঁত ছবিটার ওপর হঠাৎ ওরকম করে ঢ্যারা কেটে দিলে কেন?
আর এই যোগাযোগ, এই coincidence—ওরা আসবে, এরা আসবে, কিছু একটা হবে যার জন্যে গাড়ি থাকবে থেমে—আমিও জুটব, যাতে তোমাকেও করে নিতে পারি ভাগী আমার চিঠির পাতার মধ্যে দিয়ে….আরও আশ্চর্য, এই অভিনয়টুকু সেরে যে যার জায়গায় যাবে ফিরে, বৃদ্ধ আর ঐ যুবা কার ফরমাসে সদলবলে যেন এইটুকু করতেই এসেছিল।
.