দুয়ার হ’তে অদূরে – ২

একলা পড়ে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে অনুভবও করলাম যে রোদটা এখনও দিব্যি কড়া রয়েছে। তা থাক, হাঁটতে কিন্তু বেশ ভালোই লাগছে। হয়তো নবাবজানের তত্ত্ববাদ কিছু প্রেরণা যুগিয়ে থাকবে, কিন্তু আসল কথা সামনে রয়েছে একটা নিশ্চিন্ততা—দু’পা এগিয়ে গেলেই স্টেশন, পেছন থেকে গাড়ি আসছে আমায় তুলে নিতে—এই দুটোর মাঝখানে একটু এই যে হাঁটা, গাড়ি থেকে যে জীবনটাকে আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম, তার সঙ্গে এই যে গলা জড়াজড়ি করে চলা এতে একটা নিবিড় আনন্দ পাচ্ছি; একটা ছেলেমানুষী উল্লাস। এই চিঠিতেই কোথায় এক জায়গায় তোমায় বোধ হয় বলেছি যে, একই সময়ে শৈশব থেকে আর যতটা এগিয়ে এসেছি, তার সমস্তটাই উপস্থিত থাকে আমাদের জীবনে। কথাটা খুব সত্যি। সেটাকে প্রকাশ হতে দেওয়া অসামাজিক, বেমানান, কিন্তু নিজের কাছে মনের নেপথ্যে সেটা সুযোগ পেলেই আত্মপ্রকাশ করছে।…একটা ছেলেমানুষী উল্লাস পাচ্ছি আমি, ছেলেমানুষী বলেই তার আকার নেই, তাকে বিশ্লেষণ করা যায় না। গাড়িতে যাচ্ছি- নামলাম, ঘুরলাম, দেখলাম, শুনলাম, আবার গাড়ি, ইচ্ছে করলেই ওঠা যাবে—একটা যেন খেলা, যা এই খেলাঘরের গাড়ি নিয়েই সম্ভব; এর যা আনন্দ, তার সামনে মাথার ওপর ছটাক খানেক বোশেখী রোদ কি পায়ের নীচে তপ্ত পিচ, এসব তো ‘তুশ্চু’। এইদিকে শোনাই একটা কথা ব্যবহার করা গেল।

পাঞ্জাব মেলের সেকেন্ড ক্লাসে নিশ্চিন্ত আরামে বসে আছ, স্টেশনের পর স্টেশন, দৃশ্যের পর দৃশ্য যাচ্ছে ছিটকে বেরিয়ে—সে আনন্দও (অবশ্য, যদি পেয়েই থাক) আমার এ আনন্দের কাছে পারে না দাঁড়াতে। তুমি ওটা করেছ উপভোগ, (আমারও হয়েছে কতক কতক) কিন্তু আমার এটা তো কর নি, করবেও না কখনও; সুতরাং কি করে করাই তোমায় বিশ্বাস?

একটু থাম, তোমার ও উপলব্ধির মধ্যেও যেটুকু আনন্দের অংশ সেটুকু শৈশবই। প্রমাণ দিই। একবার চ’ড়ে দেখো কোন একটা ওইরকম দ্রুতগামী গাড়ি—অত বড় আনন্দের খোরাক সামনে থাকতেও দেখবে চারিদিকে বুড়োর দল প্যাঁচার মতো মুখ করে আছে বসে; কেউ খবরের কাগজ হাতে, কেউ বই হাতে, কেউ খালি হাতে গাড়ির ছাদের দিকে চেয়ে, তবু বাইরে চাইবে না। ভুল বুঝো না, ‘বুড়োর’ অর্থ—–এদের সবাই পাকা চুল নয়। চব্বিশ বছরের যুবাও আছে তার মধ্যে। মন যেমন নেপথ্যে শৈশবের দিকে ছোটে তেমনি ছোটে বার্ধক্যের দিকেও, অবশ্য কৃত্রিম ক’রে কল্পনায়; যে- বার্ধক্য একদিন আসবে, কালো চুলেই তার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদা চুলে ছাঁদনাতলায় গিয়ে দাঁড়ানোর ঠিক উল্টো আর কি।

এ সব রোগের কি দাবাই বলো?

একটু কড়া হয়ে গেল, না?

হোক, এদের ওপর আমার একটু রাগ আছে। এদের সামনে বেমানান হবে বলে গাড়িতে রাত বারোটাতেই আমায় জানলা ছেড়ে বিছানা আশ্রয় করতে হয়। তার মানে, অত খরচ করে যে একটা টিকিট করলাম, তার পনের আনাই লোকসান আমার। এক আনা যা লাভ তা শুধু এইটুকু যে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াটা হোল।

শৈশবো জয়তু! তার সামনে যৌবনও—তুই তুষ্পু; তার পরের যা জীবন তার তো কথাই নেই। অবশ্য শৈশবের মধ্যে আমি কৈশোরকে ধরছি, আসল কথা কৈশোর শৈশবই, শতদলটি শুধু বিকশিত হয়ে উঠেছে।

…একটা মোটর গাড়ি, খুব দামী বলেই মনে হয়, তেমন পুরাতনও নয়, ধিকিয়ে ধিকিয়ে চলেছে আমার সামনে শ’ খানেক গজ দূরে। না, আমার মতো উদ্ভট ভ্রমণ-বিলাস নয়, বেচারা কোথায় জখম হয়েছে, চারটি গরুর-গাড়ির হেফাজতে। দূর থেকে দেখছি একজনকে (ড্রাইভারই নিশ্চয়) ইস্টিয়ারিংটা ধরে নির্লিপ্তভাবে বসে আছে।

করুণ দৃশ্য, একটা হাতি কাৎ হয়েছে। আমি কিন্তু সহানুভূতির ‘মুড’এ নেই তখন। ওর কৌতুকটাই আমার মনটাকে অভিভূত করে ফেলছে। কৌতুকের কি আছে ধরা শক্ত, চারখানা গাড়ির চার জোড়া বলদ গলা দুলিয়ে দুলিয়ে নির্বিকারভাবে চলেছে, মোটরটা সব পেছনের গাড়িটার সঙ্গে একটা মোটা কাছি দিয়ে বাঁধা, চিত্রটুকু এই, কিন্তু মনের কোথায় দিচ্ছেই একটু সুড়সুড়ি। আর এর সঙ্গেই একটা সকৌতুক আক্রোশও আছে যেন কোথায়—এরই সগোত্রীয়েরা এই খানিক আগে আমার গাড়ির দিকে বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে গিয়েছে বেরিয়ে?

হাঁটছিলাম একটু জোরেই, সেদিক দিয়ে নিজের অজ্ঞাতেই নবাবজানের সঙ্গে কখন একটা রফা হয়ে গিয়েছিল, একটু পরেই গাড়িটার পাশে এসে পড়লাম। সেডানবডি বেশ একখানি ভালো মোটর, ব্যবস্থার বাড়তির দিকে এই যে দুটো জানালাতেই কাচের পেছনে গোলাপী সিল্কের কোঁচকানো কোঁচকানো পর্দা টানা। কৌতুক গিয়ে কৌতূহল মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, কোনরকম এ্যাকসিডেন্ট নাকি মেয়েছেলে সুদ্ধ? সেই কথাই জিগ্যেস করলাম ড্রাইভারকে।…অবশ্য একটু ভেবেচিন্তে জিগ্যেস করা উচিত ছিল।

লোকটা একটু রাশভারী, অন্তত প্রথমটা তাই মনে হয়, নিচের ঠোঁট দিয়ে ওপরেরটা ঠেলে তুলে একটা বিড়ি টানছিল, প্রশ্ন করলে— “সেই রকম মনে হচ্ছে?”

একটু আমতা আমতা করে বললাম— “না, মোটরের কথা বলছি না—তাতে তো ধাক্কাধুক্কির কিছু দেখছি না—অবিশ্যি যদি ওদিকটায় থাকে কিছু…”

“ঘুরে এসে দেখুন”—চোখের কোণ দিয়ে আমায় আগাপাস্তলা দেখে নিলে একবার।

বেশ একটু অস্বস্তিতে ফেলেছে, বললাম— “না, পর্দাটানা রয়েছে তাই মনে হোল যদি মেয়েছেলে কেউ থাকেন—আহত অবস্থায়…আরে মশাই, আঘাত তো কতরকম ভাবে লাগতে পারে, আজকাল যা অবস্থা যাচ্ছে। না হয় ব্যাপারখানাই কি বলুন না, একটা মোটর চারখানা বলদ-গাড়িতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন,—কিছু একটা হয়েছে তো নিশ্চয়। এ তো একটা শখ হতে পারে না।”

বলতে বলতে শেষের দিকটা একটু উল্টো চাপই দিলাম, নৈলে দেখছি ধাতে আসবে না। ড্রাইভার হোলেও ভদ্রঘরেরই ছেলে, অথচ কথাবার্তা এমন বেয়াড়া!

টসকালো না। বললে, – “শখের আপনি কতরকম জানেন?”

আমি আর উত্তর না দিয়ে পা চালিয়ে দিলাম, স্থান ত্যাগেন দুর্জনঃ। মুখ খুলেই ভুল হয়েছিল।

গোরুরগাড়িগুলো প্রায় পেরিয়েছি, গলা বাড়িয়ে ডাকল— “শুনুন! হ্যাঁ, আপনাকেই ডাকছি।”

দাঁড়িয়ে পড়লাম।

“কি?”

“এই গাড়িটা সত্তর মাইল পর্যন্ত দৌড়তে পারে ঘণ্টায়। দেখুন না স্পীডোমিটারটা, এই যে। রাস্তায় ট্রাফিক বেশি, তবুও জায়গায় জায়গায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল তুলতাম; তার জায়গায় এই—চার জোড়া বলদের ন্যাজ ধরে এইভাবে চলেছি, দুপুর একটা থেকে।…এসেছি আড়াই মাইল। … উল্টে আমার ওপরই রাগ করছেন?”

“সামান্য একটা প্রশ্ন—একটা ভালো গাড়িকে এ অবস্থায় দেখলে করেই লোকে—ভদ্রলোক দেখেই করেছি—গাড়োয়ানগুলোকে তো করতে যাইনি…তা আপনি…”

—বেশি নরম হওয়ার দরকার দেখলাম না।

চোখের কোণ দিয়ে চেয়ে দেখছিল, একটু হাসির ভাব ফুটল ঠোঁটে, বললে,–”রাগটা এখনও যায়নি।…যাবেন কোথায়?”

“এই আমতলার-হাট, ট্রেন ধরব।”

“তা আসুন না, আপত্তি না থাকে তো। রোদে পুড়তে পুড়তে যাওয়ার চেয়ে…”

দোরের হ্যান্ডেলটায় মোচড় দিলে। বললাম— “থাক, এইটুকু তো।”

“একটু গল্প করতে করতে যেতাম, যতটুকু হয়। একলা এই দুর্দশা দেখুন না।”

একটু হেসে বললে,–”গল্প করবার নমুনা দেখে পেছিয়ে যাচ্ছেন?”

ড্রাইভার হিসাবে একটু বোধহয় বেশি ফ্রী মনে হচ্ছে, তোমার, নয় কি? একটু খাপছাড়া গোছের বটেই, তবে তুমি যে বেশি ফ্রী মনে করছ, সেটা একটা কথা ভুলে যাচ্ছ বলে- আমি অফিসারের পোশাকে নেই, এমনকি বাড়ির সাধারণ পোশাকেও নয়; কি পোশাকে রয়েছি তার তালিকাবদ্ধ বর্ণনা দোব না, তবে এমনই একটা হরবোলা পোশাক, যাতে ভদ্র পরিবেশে বসে যেমন নিতান্ত বেমানান হই না তেমনই বদনের বিড়ি অফার করতেও বাধে না।

ভাবান্তর দেখে আমিও ভাব বদলালাম, একটু হেসেই বললাম— “তা পেছুচ্ছি বইকি একটু।”

“বলেছি—শখের আপনি কতরকম জানেন?”—সেই রকম হাসির সঙ্গে বললে কথাটা, শুধু আর একটু স্পষ্ট। ক্রমেই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে লোকটাকে; আমিও হাসিটাকে আর একটু স্পষ্ট করে বললাম— “তা বলবেন বৈকি।”

“তা সত্যিই দেখেছেন কতরকম?—আসুন, উঠেই বসুন।”—বলে এবার দোরটা খুলেই ধরলে একেবারে!

রসিকতা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল, আর একটু হলে উল্টে রাস্তার ওপর আছড়ে পড়তাম, চাকার নিচেই যে শরীরের খানিকটা সেঁদিয়ে যেত না তা বা কে বলতে পারে?

…গাড়িটা খুব আস্তে চলেছে, তবু চলেছেই তো?—পাদানিতে উঠে যেই ভেতরে ঢুকতে যাব, “এ কী কাণ্ড!!”—ব’লে একেবারে টাল খেয়ে পড় পড় হোতেই ড্রাইভার খপ করে হাতটা ধরে ভেতরে টেনে নিলে; কয়েক সেকেন্ড আর কথাই কইতে পারলাম না, তারপর বললাম— “এই তো এ্যাকসিডেন্ট দেখছি—আর আপনি বলছিলেন…আর এইরকম একটা সিরিয়াস কেস নিয়ে এইভাবে ধিকুতে ধিকুতে যাওয়া…এত বাস যাচ্ছে, একটাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতেন তো।”

হাসিতে দুলতে আরম্ভ করেছে লোকটা; তার মধ্যেই সংক্ষেপে বললে— “শখ”।

“শখ!”—বলে আবার আমি পেছনের সীটের দিকে চাইলাম।

প্রায় বছর চল্লিশেক বয়স, থলথলে মোটা শরীর, টকটক করছে গায়ের রং, একটা লোক চিৎপটাং হয়ে পড়ে রয়েছে, কোমর থেকে ওপরটা গদির ওপর, বাকিটা নিচে; শৌখীন ধুতি-পাঞ্জাবি, কিন্তু প্রায় অসামাল। অতিরিক্ত বিস্ময়ে আবার ড্রাইভারের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলাম— “শখ কি মশায়! আঘাত-টাঘাত নয়?”

সমস্ত গল্পটা হাসির ভেতর থেকে খানিক খানিক করে যা উদ্ধার করা গেল তা এই-

উত্তর কলকাতার একজন নাম করা জমিদার ঘরের অপোগণ্ড। (নামটাও বললে, কিন্তু এক- কান থেকে আর দু’কান করব না, মাফ কোর)। আরও অনেক দূর এগিয়ে, ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপরই শ্বশুরের বাগান-বাড়ি, কিছুদিন থেকে সবার ‘শৈল-বাস’ চলেছে। জামাই সেইখানেই চলেছে। একটা ছোট সুটকেস নিয়ে উঠেছিল, গাড়ি খানিকটা এগুতেই সেটা ড্রাইভারের পাশে রেখে দিয়ে বললে ওটা একেবারে নামবার সময় আমার হাতে দেবে, তার আগে কোনমতেই নয়। ড্রাইভারের একটু খটকা লাগল, কিন্তু আর মাথা ঘামাতে গেল না ও নিয়ে, পাশেই পড়ে রইলো সুটকেসটা; শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত এল, কোন কথাবার্তা নেই। মনুমেন্টটা যখন পেরিয়ে গেছে, হুকুম হোল— “ড্রাইভার—ইউ!”

অদ্ভুত আওয়াজ শুনে ড্রাইভার ফিরে দেখে সে মানুষই নয়, মাথাটা একটু একটু দুলছে, চোখ দুটো গোলাপী, মুখটা থম থম করছে। অতটা আন্দাজ না করতে পেরে জিগ্যেস করলে—-”আপনার অসুখ হোল নাকি?”

“ইয়েস, সুটকেসে ওষুধ আছে, লে আও।”

ব্যাপারটা তখন বোঝা গেল। আপাতত কিন্তু ঐ পর্যন্তই রইল, কথাটা বলেই গদির পিঠে ঢলে পড়তে ড্রাইভার টানা মাঠের ওপর স্পীডটা বাড়িয়ে দিলে। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে, যখন মাঝেরহাটের পুলের ওপর, হঠাৎ পেছন থেকে জামার গলা ধরে এক টান, স্টিয়ারিং নড়ে গিয়ে একটা কাণ্ড হয় আর কি। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করলে— “কি বলছেন?”

“তোমায় না এক্ষুণি ওষুধটা এগিয়ে দিতে বললাম?”—কথা আরও এসেছে জড়িয়ে।

ড্রাইভার বললে— “আপনিই তো মানা করেছিলেন ওঠবার সময়?”

“ড্যাম ইউ; তখন অসুখ ছিল? লুক হিয়ার—একশ’ দশ ডিগ্রি!”

হাতটা বাড়িয়ে দিলে। ড্রাইভার বললে— “ওষুধ খেলে একশ’ পনের হয়ে যাবে যে।”

মুখের দিকে একটু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল, একটু হাসি ফুটল, মাতালের হাসি, তারপর তারপর গুড বয়, গুড বয়’ বলে আবার গদির গায়ে ঢলে পড়ল। এরপরের ঝোঁকটা উঠল বেহালার ট্রাম ডিপোর কাছে।

ড্রাইভার বলে— “মশাই এমন অদ্ভুত মাতাল দেখি নি, বাড়িতে বেরুবার আগেই কতখানি গিলে নিয়েছে, তা যত এগুচ্ছে তত কমে আসবে নেশাটা, না, ততই বে-এক-তিয়ার হয়ে পড়ছে। ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুর রাস্তায় লোক নেই, নইলে ভিড় জমে একটা কাণ্ড হয়ে যেত—ট্রাম ডিপোটার কাছে এসেছি, হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে উঠে বলে,–’এই স্টপ, দাঁড়াও, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমায়? হোয়ার?

না ঘুরে বললাম—শ্বশুরবাড়ি।’

‘কার?’

মনটা বেশ খিঁচিয়ে এসেছে, বললাম—’এ অবস্থায় অন্য কার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গিয়ে তুলব। নিজের শ্বশুরবাড়িতেই খাতিরটা কেমন হয় দেখুন না গিয়ে।’

‘আলবৎ হবে।’ “চলুন তাহলে।

‘কোথায়?’

‘শ্বশুরবাড়ি।’

‘কার?’

না ঘুরেই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি, স্পীডও দিয়েছি বাড়িয়ে, তাড়াতাড়ি গিয়ে ডেলিভারী দিয়ে দিতে পারলে বাঁচি পেয়ারের জামাইকে। ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুল পেরিয়ে গেলাম, বঁড়শের তেমাথা দেখা যাচ্ছে, আবার উলসে উঠল, এবার আরও সাংঘাতিক, বলে—’চেঁচাব, আমি।’

‘কেন মশাই—চেঁচাবার কি হয়েছে?’

‘আমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে, চুরি করে। ইয়েস কিডন্যাপ করে—চেঁচাব, আই উইল শাউট—নইলে মাল বের করো—আমায় শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে—আমি রায়বাড়ির জামাই—’

তেমাথায় দোকানপাট, শিখ ড্রাইভারদের আড্ডা, আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম মশাই, মাতালের কাণ্ড, চেঁচালেই হোল, তারপর মেরে আমার পস্তা উড়িয়ে দিয়ে পুলিশে হ্যান্ডওভার করে দিক সবাই জড়ো হয়ে। সুটকেসটা নিয়ে রেখে দিয়েছিলাম, তুলে দিয়ে দিলাম হাতে। মরগে যা।

একটা তোয়ালেতে জড়ানো দুটো বোতল ছিল, আরম্ভ করে দিলে। ভাসা ছাড়িয়ে খানিকটা এদিকে এসেছি, মোটরটাকে একবার থামাতে হোল। খানদশেক বিচুলির গরুরগাড়ি কোথাও মাল খালাস দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, কিভাবে তাদের একটা জট পাকিয়ে গেছে রাস্তার মাঝখানে।

তখন ওর একটা বোতল সাফ হয়ে গেছে; একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল, গাড়িটা থেমে যেতে আবার একটু সোজা হয়ে বসল, বললে—’চালাও, রোকা কাহে?”

বললাম—’গাড়িগুলো একপাশে করে নিচ্চে, তারপরেই আবার বেরিয়ে যাব।’

‘কোথায় যাবে? হোয়ার?’

‘আপনার শ্বশুরবাড়ি।’

শ্বশুরবাড়ি!’—ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে চোখ পিটপিটিয়ে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল, আবার জিগ্যেস করলে— শ্বশুরবাড়ি!’ তারপর গলা বাড়িয়ে একটু কি দেখে নিয়ে বললে— ‘শ্বশুরবাড়ি তো প্রোসেশন কোথায়?’

‘প্রোসেশন কি মশাই? মোটরে করে শ্বশুরবাড়ি যাবেন বল্লেন, ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি, প্রোসেশন কোথা থেকে আসবে? এ তো আর নতুন বিয়ে করতে যাচ্ছেন না!’

বেশ রাগ ধরে গেছে মশাই। গাড়িগুলো ততক্ষণে একপাশে করেছে। স্টার্ট দিয়ে দিলাম। তারই ঝাঁকানিতে বোধহয় গড়িয়ে পড়েছিল, গাড়িগুলোকে ছাড়িয়ে গেছি, টলতে টলতে উঠে আবার আমার জামার কলার চেপে ধরলে।

‘আলবাৎ প্রোসেশন, রায়বাড়ির মজাই, ব্যান্ড চাই, প্রোসেশন চাই।…তারা সেখানে শাঁখ নিয়ে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’

‘তা পাব কোথায় ব্যান্ড আর প্রসেশন, এ আঘাটা জায়গায়?—চাই না হয় বুঝলাম।’

থামিয়ে ফেলেছিলাম গাড়িটা, আবার স্টার্ট দিতেই গদি ছেড়ে উঠে পড়ল—ইউ! আই উইল শাউট—চেঁচাব, আমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছ। ঘড়িতে আংটিতে আমার গায়ে চার হাজার টাকার মাল…।’

ভয় পেয়েই গেলাম মশাই, অস্বীকার করব না। মাতাল হলেও ফিচলেমি জ্ঞানটা টনটনে, লোক দেখলেই ওই ভয় দেখাচ্ছে, যদি চেঁচিয়েই বসে তো তাদের বোঝাবার আগেই একটা কাণ্ড হয়ে যাবে। গরীবের ছেলে, পেটের দায়ে চাকরি করতে শেষে প্রাণটা বোঘোরে খোয়াব? গলার স্বর আরও জড়িয়ে এসেছে, তার ওপর ইংরেজি বুকনি, নয়তো এতক্ষণ বোধ হয় হয়েই যেত কিছু একটা। নরমই হয়ে গেলাম, বললাম—’তা তো বলছি না, রাজবাড়ির ছেলে, প্রোসেশন করে যান আপনি, সেইটিই তো মানানসই, কিন্তু এখানে তার ব্যবস্থা হয় কি করে।’

দ্যাটস্ গুড, আমি রায়বাড়ির জামাই বাবা! ইয়েস!’—একটু শাসিয়ে কথাটা বলেই কিন্তু ও-

ও নরম হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে—’কটা গাড়ি আছে?’

বললাম—’গাড়ি তো এই একটি।’

‘আবার ল্যাজে খেলছ বাবা?’

বললাম—’আজ্ঞে ও তো গোরুর গাড়ি সব। ওতে তো আর প্রসেশন হবে না।’

‘আলবাৎ হবে। লুক হিয়ার, সবগুলোকে বায়না দিয়ে দাও, বেহাত না হয়ে যায়।’

পকেট থেকে ব্যাগটা বের করে এদিকে ছুঁড়ে ফেললে…সেই রায়বাড়ির জামাইকে প্রোসেশন করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মশাই। সংক্ষেপে ইতিহাসটা বললাম।”

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, ফিরে দেখলাম জামাতারত্নের দেহটা আরও খানিকটা নিচে নেমে এসেছে; হতভম্ব হয়ে গেছি, কিছু একটা বলবার জন্যেই বললাম— “আমি মনে করেছিলাম বুঝি গাড়িটা জখম হয়েছে।”

উত্তর করলে— “সেই ভেবেই তো ব্যবস্থাটা করেছি মশাই, একটু বুদ্ধি যুগিয়ে গেল। আগে পাঁচটা পেছনে পাঁচটা গোরুরগাড়ির প্রোসেশন করে যদি এই চালু রাস্তা দিয়ে যাই, এইরকম একখানা মোটর নিয়ে তো পাগল ব’লে লোকে ঢিলিয়ে মারবে না? আর ওদেরই বা বলি কি করে? নেমে একটু সরে গিয়ে ডেকে বললাম—মোটরটা বিগড়ে গেছে হঠাৎ, টেনে নিয়ে যেতে হবে। এই চারখানা গাড়ি ঠিক হোল, তিন টাকা করে রফা হয়েছে। এসে দেখি ঐ রকম কুপোকাত হয়ে রয়েছে। পর্দাগুলো টেনে এই স্টিয়ারিং ধরে বসে আছি। গেরো আর কাকে বলে?’

জিজ্ঞেস করলাম— “আর তো সাড় নেই একেবারেই দেখছি; খুলে নিয়ে বেরিয়ে যান না তাড়াতাড়ি।”

“সাহস হয় না মশাই। ঐ যে মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছে—কিডন্যাপ করছি বলে চেঁচাবে—কে জানে ঝাঁকানির চোটে উঠে পড়ে যদি চেঁচিয়েই বসে…তাই ভাবছি এই ছকটা জায়গা পেরিয়েই যাক—একেবারে সেই সিরাকোল-শিবানিপুর পর্যন্ত, তারপর যা হয় একটা করা যাবে ভেবেচিন্তে।…ভদ্রলোকের ছেলে মশাই, ভাবলাম ভালো ঘরে পাওয়া গেল চাকরি, তা দেখুন না নিগ্রহ, প্রোসেশন নিয়ে যাচ্ছি।…একটু আগে থাকতেই নেমে যান আপনি। দয়া করে আর ফাঁস করবেন না কথাটা, ভিড় জমে যাবে বাজারের মাঝখানে।”

নামতে নামতে দুঃখিতভাবে হেসে বললাম— “ফাঁস করবার কথা এটা?”

“তবুও তো প্রোসেশানের গোড়ার দিকটা দেখেননি—গাড়োয়ানেরা যখন কোরাসে একটা মেঠো গান ধরেছিল…ফিরতির মুখে, হঠাৎ ফোকটে তিনটে করে টাকা এসে গেল ট্যাকে তো? আমিও এলে দিলাম, তখন মনটা আরও খিঁচড়ে রয়েছে তো, বললাম—তোর ব্যান্ড সুদ্যুই প্রোসেশান চলুক তাহলে, অঙ্গহানি হয় কেন?…আচ্ছা নমস্কার।”

.

মোটরটা কাটিয়েই দেখি—সর্বনাশ! গাড়ি এসে গেছে ওদিকে। পা চালিয়ে দিলাম, তাতে না কুলোতে ছুটলামও, কিন্তু ততক্ষণ গাড়ি আমায় ছাড়িয়ে স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, গিয়ে পৌঁছুবার আগেই ছেড়ে দিলে। স্পীডও দিয়ে দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে, তবু উঠতে যাচ্ছিলাম, স্টেশন মাস্টার মানা করলেন— “থাক, এর পরের গাড়িটাও এসে পড়ল বলে; এটা অতিরিক্ত লেট যাচ্ছে কিনা আজ।”

প্রশ্ন করলাম— “কতক্ষণে আসছে পরেরটা?”

“চারটে সতেরো মিনিটে টাইম।”

পাঞ্জাবির হাতটা গুটিয়ে দেখলাম প্রায় তিন কোয়ার্টার দেরি।

দেখছি জীবনটা এগিয়ে চলে কনট্রাস্ট-এর মধ্যে দিয়ে। একটু বেশি বাঙলা-বাঙলা বাই হয়েছে তোমাদের এই স্বাধীনতা পাবার মুখে, আমি কিন্তু কথাটার ঠিক প্রতিশব্দ হাতড়ে পাচ্ছি না আপাতত জীবন-শিল্পী যিনি তিনি এই কনট্রাস্টের মধ্যে দিয়ে অনুভূতিগুলোকে বেশি করে ফুটিয়ে তোলেন। অন্তত দেখছি আমার জীবনে এটা একটু বেশ—একটানা একভাব নেই; এই যে থিতিয়ে জিরিয়ে বলদ-গাড়ি-টানা-মোটরে নিঝুম প্রোসেশনের গল্প শুনতে শুনতে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিলাম, এরপর আমায় খানিকটা তড়িঘড়ির মধ্যে ফেলা চাই-ই তাঁর; এ গাড়িও ফেল করতে হোল, তার নিদারুণ লজ্জাটুকু তো বোঝার ওপর শাকের আঁটি।…ছোটা, নৈরাশ্য, লজ্জা সবটুকু মিলিয়ে বুকটা বেশ ধড়ফড় করছে। স্টেশনে গিয়ে বেঞ্চটায় বসলাম।

এখন একটার পিঠে একটি করে যে এই পঁয়তাল্লিশটি মিনিট, একে কাটানো যায় কি করে? আমাদের ওদিকে স্থানীয় হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে—যার গরম দুধে একবার ঠোঁট পুড়ে গেছে, সে ঘোলেও চুমুক দেয় ফুঁ দিয়ে দিয়েই। কতকটা সেইরকম অবস্থা দাঁড়িয়েছে;–বাজার দেখতে যাব কি, স্টেশনের বাইরে পা দিতে সাহস হচ্ছে না।

কিন্তু জীবন তা দোটানার খেলাই; কুষ্টিতে যে উগ্ররকম শনির যোগ চলেছে, নইলে এই বোশেখী রোদে বাড়ি থেকে টেনে আনে? মিনিট দুয়েক যেতে না যেতে পা সুড়সুড় করতে লাগল, তারপর পেট বললে আমার খিদে পেয়েছে, গাল বললে আমার তেষ্টা। আসল কথা কি জানো? মানুষের নিজের কাছেও একটা চক্ষুলজ্জা আছে, একটা অন্যায়, ভুল বা বেহায়াপনার কাজ করতে হলে মনের কাছে একটা জবাবদিহি দিয়ে ভদ্রতা রক্ষা করতে হয়। …মন বললে—সত্যি নাকি? খিদে তেষ্টা দুই-ই? আহা, পাবার কথাই তো! তাহলে ওঠ।

ছাড়পত্র আদায় হোল। বেরিয়ে পড়লাম স্টেশন থেকে।

বাঁ দিকে হাট, ডান দিকে টানা বাজার, বেশ অনেকগুলি দোকান, ছোটবড়, ভালোমন্দ মেশানো। রোদ একটু পড়ে আসার সঙ্গে চাঞ্চল্য জেগে উঠছে আস্তে আস্তে। একটা অদ্ভুত ধরণের কৌতুক জেগে উঠছে মনে—একেবারে ষোল আনা বাঙলাদেশের একটা বাজার, পানবিড়িওয়ালা থেকে নিয়ে একেবারে ওপর পর্যন্ত সব বাঙালি, এ দৃশ্যটা প্রায় চোখে পড়ে না। আমাদের দেশে যাওয়া মানে কলকাতায় কটা দিন কাটিয়ে আসা; সেখানে, বোধ হয় খাঁটি বিলেত আছে— চৌরঙ্গীতে; খাঁটি দিল্লি, যোধপুর আছে বড়বাজার-চিৎপুরে; এমনকি খাঁটি ক্যান্টনও আছে চীনেপটিতে; কিন্তু খাঁটি বাঙলা নেই কোনখানেই।

থাক, মেলা খাঁটি কথা বলাও নিরাপদ নয়। আসল ব্যাপার তা নয়। একটা জাত আস্তে আস্তে ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এ দৃশ্য কল্যাণকর নয়, কারুর চোখেই কল্যাণকর বলে প্রতিভাত হওয়া উচিত নয়। জাত না বলে উপজাতিই বলি, কেননা সমগ্র ভারতবাসীই একটা জাত এই ধারণাটাই বড় এবং বলিষ্ঠ; অতীত ইতিহাস যাই বলুক, ভবিষ্যৎ ইতিহাস গড়বার পক্ষে এই ধারণাটাই বেশি অনুকূল, বিশেষ করে বর্তমান জগতে। সুতরাং, বাঙালিকে উপজাতিই বলি; কিন্তু উপজাতি বলেই যে তার উবে গেলে ক্ষতি নেই একথাও তো বলা যায় না। বাঙালি সেই যেতে বসেছে। এ কথাটা ইংরিজীতে বলতে গেলে too true অর্থাৎ মর্মান্তিকভাবে সত্য এবং এর জন্যে যেমন বাঙালির তেমনি ভারতের অন্য সব উপজাতিরও চিন্তিত হওয়া উচিত। সেই চিন্তাটাই হচ্ছে আমাদের এক জাতিত্ববোধের নিরিখ, যে পরিমাণে অন্য সব উপজাতিদের মধ্যে সে চিন্তাটার অভাব আছে, সেই পরিমাণে ঐ গালভরা কথাটা ভুয়ো এবং সেই পরিমাণেই আমাদের ভবিষ্যৎ ইতিহাসের এমারৎ তোমার মধ্যে মেকি মাল ঢুকে বসে থাকবে।

এই ফাঁকিবাজি একচোট হয়ে গেছে। সুতরাং সাবধান হয়ে এগুনো ভালো। ধর্মের মতো পাকা মশলা—জাতির এমারৎ পড়তে ও পর্যন্ত আর কিছু হয় না; এক সময় এই মশলা দিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষকে এক করবার চেষ্টা হয়েছিল, একটা ভাষাও তাতে করেছিল সাহায্য যার মতন ব্যাপক ভাষা ইংরিজীর আগে জগতে আর হয় নি। ভারতের ভৌগোলিক সংস্থানও এমন—ঘেরাঘোরা, আঁটসাঁট, নিরেট যে ষোল আনার ওপর আঠার আনা সফল হওয়ার কথা। কিন্তু হোল না কিছুই? কেন?…ভেবে দেখতে হবে।

এবারে যা পরীক্ষা তা ধর্মের ওপর নয়। একদিকে দিয়ে ভালো, কেননা এবারকার পরীক্ষার যা Bed rock অর্থাৎ ভিত্তিপ্রস্তর সেটা বেশি প্রত্যক্ষ—অর্থাৎ সামষ্টিক স্বার্থ। ভালো কথা—দরকার কি ও মন্ত্র-তন্ত্রের হেঁয়ালির? কিন্তু একটা কথা মনে রাখা তো দরকার। এই বেড-রকটিকে খানিকটা করে আত্মত্যাগের আগুনে গলিয়ে গলিয়ে একটা তালে পরিণত করতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের Sedimentary rock না অগ্নিগালিত একপিণ্ড একটা Igneous Rock? Sediment অর্থাৎ স্তরের বালাই থাকলেই আমার সর্বনাশের গোড়া রয়ে গেল, চাপ পড়লেই ভেতরে চিড় খেয়ে যাবে। সে যে একের ছদ্মরূপে বহু-ই—খণ্ডিত, চূর্ণিত বহু-ই

আমার মনে হয়, ভেতরের গলদের জন্যে এক সময় বড় জিনিসটাই ফেল করে গেছে অর্থাৎ ধর্ম। সুতরাং হুঁশিয়ার হয়ে এগুনোই ভালো। ধর্মের একটা মস্ত বড় সুবিধা ছিল, তার নিজের ভিত্তিই ত্যাগের ওপর। স্বার্থের সেটা নেই—তা সেটাকে State (রাষ্ট্র), Society (সমাজ), Economy (অর্থনীতি), যে-নামেই অভিহিত করো না কেন।

যাক্ যা বলছিলাম,—তবু এখানে জাতটাকে সমষ্টিগতভাবে দেখা যায় একটু।

কিন্তু করুণ দৃশ্য!—দুর্বল কাঠামো, তার ওপর প্রায় বেশিরভাগই রোগজীর্ণ। কালো, কটা চামড়া তো প্রায় চোখেই পড়ে না, আর খর্ব। এইটে আমার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। এই খর্বতা, বিশেষ করে নিম্নশ্রেণীদের মধ্যে, যাদের গায়ে খেটে খেতে হয়। খানিকটা আরও দক্ষিণে পর্যন্ত যাওয়া আছে আমার, খর্বতা যেন ক্রমেই বেড়ে গেছে। যেন ক্রমেই মাটির লেভেলে নেমে আসছে সব, এদিককার মাটি যেমন আসছে ক্রমে জলের লেভেলে নেমে। আমার মনে এইটেই অস্বস্তি জাগায় বেশি, সর্বরোগহর স্বরাজ পাওয়ার সঙ্গে না হয় আর সব হবে—স্বাস্থ্য আসবে, শক্তি আসবে, কিন্তু মারাত্মক Specific Gravity অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণের হাত থেকে এদের বাঁচানো যাবে কি করে?

এটা একটা জাতিগত চিন্তার কথা। কিন্তু যা পাচ্ছি সেটুকুও লাগছে বেশ,—দোকানের সারির নিচেই যেখানে যেখানে ফাঁক হয়েছে দিন-বেসাতীদের দল বসে গেছে—মেয়ে-পুরুষ, ছোট-বড় এক জায়গায় মেয়ে, এক জায়গায় পুরুষ; আবার মেশামেশি করেও,—আম, জাম, শাক, এঁচোড়, বড়ি, দড়ি, চাল, মুড়ি, বিচি, পাঁপড়, ফুলুরি—রকমারি কাণ্ড, রাস্তার দু সারি চলে গেছে, খদ্দের উঠছে আস্তে আস্তে জমে।…’পয়সায় দুটো ক’রে…না, তার বেশি হবে নি। জামরুল কি রকম দেখতে হবে তো…তোমাদের গেরামে গোরুতেও খায় না?―তা যাও তাহলে; গোরুর চেয়ে খাটো হতে যাবে কেন গো?”—মেয়েছেলে; বেটাছেলেদের মুখে এত চাঁচাছোলা উত্তর যোগায় না টপ করে। লোকটা চলে যেতে আমি দু’পয়সার নিলাম, তেষ্টা পেয়েছে, আর দিব্যি টুলটুলে ফলগুলি, এক একটি বড় বড় মুক্ত যেন; তবে দর করতে সাহস হোল না আর।

মুখের দিকে একবার চাইলে, প্রশ্ন করলে— “বামুন?”

“হ্যাঁ।”

বেশ বড় দেখে বেছে বেছে পাঁচটি তুললে, কপালে ঠেকিয়ে বাড়িয়ে ধরে বললে— “গড় করি, বামুনের হাতে বৌনি, বিকবেই—তা তোরা যতই বৌনি ভেঙে যা না কেন? —যত সব অযাত্রা! বলুন কেন বাবাঠাকুর, এ জামরুল চারটে করে দেওয়া চলে?…ন্যাও, আর একটা বাবাঠাকুর—পায়ের ধুলো দিয়েছ গাদার সামনে …

“থাক, আর আমার দরকার হবে না, একটু তেষ্টা মেরে নেওয়া শুধু, একলা তো মানুষ।”

“তুমি ন্যাও, হাত তুলেচি বামুনের দিকে। না হয় গোরু-ছাগলের মুখে ফেলে দিও।”

হেসে বললাম— “নোকসান করব কেন? মনে করো, নিলামই, আবার আশীর্বাদ বলে ফিরিয়ে দিলাম।”

“তা যদি বলছ তো থাক। ও বাবা! বামুনের আশীর্বাদ—শিরোধার্য। শিরোধার্য।”

–কপালে ফলটি ঠেকিয়ে আলাদা করে রেখে দিলে। ক’পা গিয়ে কি মনে হতে ঘুরে দেখি দুটি খদ্দের এসে দাঁড়িয়েছে, এক আঁচলা ফল তুলে ধরেছে মেয়েলোকটি। চোখোচোখি হয়ে গেল, একটু কৃতজ্ঞতার হাসি, ব্রাহ্মণ এসে সদ্য ফল দিয়ে গেল কিনা।

যত ফাঁকিই থাক না, সদ্য সদ্য তখনকার জন্যে ঐটুকু যে তখন একটা পরম সত্য; ওর পক্ষে তো বটেই, আমার মনেও একটা অদ্ভুত ধরণের আত্মচেতনা জেগে উঠেছে,–কে জানে, আমি কলির ব্রাহ্মণ কিছুই না হই, কিন্তু গোত্রপিতা ভরদ্বাজ ঋষি তো কালজয়ীই।

অন্তত মনটি বেশ প্রসন্ন হয়ে উঠেছে। ছোট একটি ঘটনা, কিন্তু হঠাৎ দার্শনিক করে তুলেছে কেমন যেন; ভাবছি—যদি ঠিক এমনিটি হয়ে যেত বরাবর—ভবের হাটে শেষ বেচাকেনাটুকু সারার সঙ্গে এই প্রীতি, এই রকম একটি কৃতজ্ঞ হাসি নিয়ে যেতে পারতাম সাথে করে!…

ভগবান, অন্তত দেওয়ার সঙ্গে যেন থাকে এইরকম এটি প্রণাম, আর তা আশীর্বাদের সঙ্গেই ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়ার এই ক্ষমতাটুকু থাকে যেন অটুট।

জামরুল কটা বড় মিষ্টি, মনে পড়ে না এত মিষ্টি জামরুল খেয়েছি কখনও।

ডানদিকে “রয়াল সেলুনে” চুল ছাঁটা হচ্ছে। একটা লিকলিকে ঘাড়, কান থেকে নিয়ে কান পর্যন্ত নিচের দিকে সমস্তটা ক্ষুর বুলিয়ে দিয়েছে, এবার মিলুবে, কাঁচি হাতে দুলে দুলে তারই পাঁয়তাড়া ভাঁজছে, একবার এদিকে ঝুঁকে দেখে, একবার ওদিকে ঝুঁকে দেখে। মাথার স্বত্বাধিকারী অসীম ধৈর্যে সামনের দিকে মাথাটা হেঁট করে বসে আছে। একেবারে পনের আনা এক আনা ছাঁটের ব্যবস্থা। আশ্চর্য হই, কুৎসিত হবার জন্যেও মানুষের কি অনন্ত তপস্যা!

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম—হুঁশ নেই যে দাঁড়িয়ে পড়েছি, এক ছোকরা দোকানের ভেতর থেকে দরজায় এসে দাঁড়াল; হাতে কাঁচি, খচ খচ করে দু’বার হাওয়ায় চালিয়ে প্রশ্ন করলে- “ছাঁটাবেন? আসুন না ভেতরে।”

হঠাৎ অপ্রতিভ হয়ে পড়েছি,—বললাম— “না…এমনি দাঁড়িয়ে আছি।”

“আসুন, খালি আছে একটা চেয়ার।”

বললাম— “না, চুল ছাঁটাবার ইচ্ছে নেই।”

একটু হেসে বললে— “সন্দেহ হচ্ছে? একটা টেরায়েলই দিয়ে দেখুন না।”

কি মতিচ্ছন্ন ধরল, ফ্যাশানের ওপর আক্রোশবশেই মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল— “ট্রায়েল তো ঐ দেখছিই বাপু চোখের সামনে।”

ফিরে একবার চাঁচা ঘাড়টার দিকে চেয়ে নিয়ে চৌকাঠের এদিকে এসে দাঁড়াল, হাসি মুখেই; বললে— “আজ্ঞে, ও তো এই আরম্ভ হোল মোটে, ফিনিশটা দেখে আপনিই ত্যাখন সাট্রিফিটি দিয়ে দেবেন, নিজের হাতে; আসুন দয়া করে।…কাদারতাল চটকানো দেখে, পিতিমেটা কি দাঁড়াবে বলতে পারেন না তো।”—বিজ্ঞভাবে হাসল।

গুটিতিনেক লোক দাঁড়িয়ে গেছে।

বললাম— “না বাপু, ট্রায়েল—ও একটা কথার কথা বলছিলাম—সদরবাজারে দোকান ফেঁদেছ, খারাপ ছাঁটতে যাবে কেন? তবে আমার ছাঁটবার দরকার নেই, এমনি এসেছিলাম একটু বাজারে—অন্য একটা দরকারে।”

“তা একটা দরকারে এসে কি আর একটা কাজ করে না লোকে?…জুতো কিনতে এসে তো পাঁপড়টাও নিয়ে যাচ্ছে হাতে করে।…দিনই না পায়ের ধুলো। লতুন সেলুনটা খুললুম—আপনাদের পাঁচজনের ভরসায় …

উত্তর না দিয়ে ঘুরে পা বাড়াতে যাব, একটি লোকের সঙ্গে প্রায় ঠোকাঠুকি হবার দাখিল। বাঁ হাতে নিজের চিবুকটা ঘষতে ঘষতে হন্তদন্ত হয়ে আসছে, বললে— “নাও তো, একবার চেঁচে দাও তো দাড়িটুকুন, দোকান খুলে ছেলেটাকে বস্যে এসেছি, একটু চট করে…”

“একটু ঘুরে আসুন দাদা, হাতে খদ্দের, এই যে এই বাবু।”

লোকটা আমার মুখের দিকে চাইলে, তারপর আমার প্রায় সমান করে ছাঁটা বড় বড় চুলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে— “ও আপনি ছাঁটাবেন? তা যান। আমি ঘুরে আসচি গো, আর লোক নিউনি।”

আমি তাকেই বললাম— “না, তুমি কামিয়ে নাও, আমি চুল কাটাতে আসিনি।”

“খেউরি হবেন?”

“না।”

“তবে?”—আমার মুখের দিকেও চাইলে, ছোকরার মুখের দিকেও চাইলে। সে বললে- “আসছিলেন ছাঁটাতেই, কেমন করে সন্দো লেগে গেছে আমার ছাঁটাতে জানি না—আনাড়ি, তাই বলছি, একবার দেখুনই দয়া করে…”

লোকটা পাতলা ডিগডিগে, মুখটা সরু, আমসির মতো, আমার দিকে চেয়ে একহাত জিভ বের করে মাথাটা দুলিয়ে বললে— “আরে না না, ও কি কথা! এখেনকোর লোক নয় বুঝি আপনি? এস্পার্ট ছেলে—দুই ভাই-ই…নিভরসায় যান আপনি…আমরা জানি কিনা… দিন গেলে এমন বোধ হয় তিরিশখানা মাথা সাবড়ে দিচ্ছে দুই ভেয়ে, নিভরসায় সেঁদিয়ে যান।”

খড়ম পরে এসেছিল, খটখট করতে করতে চলে গেল।

কিছুই নয়, অথচ ব্যাপারটা এমন ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে কি করে যে পরিত্রাণ পাব যেন হদিস পাচ্ছি না। স্রোতের মুখে দুটো কুটো একত্র হলেই তার গায়ে আর পাঁচটা এসে লাগে; প্ৰায় সাত-আটজন লোক জমা হয়ে উঠেছে, প্রশ্ন-মন্তব্য আরম্ভ হয়েছে একটু একটু, বেশিরভাগই ওদের সপক্ষে। একজন তবু আমার হয়ে বললে— “তা ওঁর য্যাখন রয়েছে খুতখুঁতুনি ত্যাখন যেতে দেও না।”

ছোকরা চৌকাঠে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, খিঁচিয়ে উঠল তার দিকে চেয়ে–”আরে,—’যেতে দেও না’! ওঁকে ধরে রেখেছেটা কে?…তবে, সচোক্ষে তো দেখলেন একটা খদ্দের হাতছাড়া করলুম ওঁনার খাতিরে…বলে ‘যেতে দাও না!’~কে যেন পাকড়ে রেখেছে!”

তুমি ভাবছ বোধহয় বেরিয়েই এলাম না কেন, সত্যিই তো কেউ পাকড়ে রাখে নি। এখন আমিও তাই ভাবি, কিন্তু তখন সত্যিই যেন কিম্ভুতকিমাকার হয়ে গিয়েছিলাম—ঠিক এ ধরণের অবস্থায় তো পড়া অভ্যেস নেই, তায় বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, যে ব্যাপারটা অযথাই একটা জটিল হয়ে উঠল, সেটা আরও কতটা হয়ে যেতে পারে কে জানে?—এখন তো একটা কেসও খাড়া করে ফেলেছে, নিজের স্বপক্ষে–ঢুকছিলাম—সন্দেহের বশে দাঁড়িয়ে গেছি—ওর খদ্দেরও লোকসান করেছি একটা।

আর একটা গেল। চুল ছাঁটাবার খদ্দের, ওই ভাগিয়ে দিলে—বললে— “না, এখানে চুল ছাঁটা হয় না, দুটো আনাড়ি জোচ্চোরে সেলুন ফেঁদে বসেচে। যাও।”—মুখটা থমথমে হয়ে এসেছে।

সেলুনটা লম্বালম্বি ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে খানিকটা। যে চুল ছাঁটছিল, সে এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি, এমন কি ফিরেও দেখেনি, নিজের মনে কাজ করে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য হয়তো সেলুনের আভিজাত্য রক্ষা করা—কাজের সময় কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে খেয়াল করে না, কিম্বা হয়তো ফিনিস করেই একটা নমুনা আমার সামনে দাঁড় করাবে; দ্বিতীয় খদ্দেরটা চলে যেতে কিন্তু কাঁচিটা আঙুলে করেই বেরিয়ে এল। এই বড়, মুখটা খুব গম্ভীর, তার মানে প্রত্যেকটি কথা শুনেছে, যখন আর ধৈর্য রাখা সম্ভব হোল না, বেরিয়ে এসেছে।

কিন্তু অন্যরকম ভাব, অন্তত বাইরে বাইরে তো নিশ্চয়। কাঁচিসুদ্ধ হাত তুলে একটা প্রণাম করলে আমায়, প্রশ্ন করলে— “কি দরকার স্যার, বলুন দয়া করে।”

ভাই-ই উত্তর দিলে— “চুল ছাঁটাবেন, তা হঠাৎ সন্দো হতে,…

ক’ষে এক ধমক— “তুই চুপ দে রাস্কেল। খদ্দেরের সঙ্গে কথা কইতে জানিস না। ভদ্র ইতর চেনবার খ্যামতা নেই, হাটের মাঝে দোকান ফেঁদেছে। তুই যা ভেতরে ফিনিস দিয়ে দিগে; গেলি?”

একেবারে খাদে গলা নামিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললে— “কি বলুন?”

বিপদ একেবারে নবমূর্তিতে, বললাম – “বলবার তো কিছুই নেই ভাই, এই দিক দিয়ে যেতে যেতে একটু দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, তোমার ভাই ভাবলে…’

শেষ করতে না দিয়েই বিনীতভাবে হেসে বললে— “ওটার কথা বাদ দিন।…কি জানেন? রেধো-মেধো তারা যায় যাক, একজন ভদ্দরলোক যদি এগিয়ে এসে সন্দোর বশে আবার ফিরে যান তো দোকান উটে দিতে হয়। একটা বদনামের কথা হয়ে গেল কিনা। আপনারা হচ্ছেন এ্যাডভারটাইজমেন্ট আমাদের—এই তো দেখছেন কি ধরণের খদ্দের সব, পাই কটা আপনাদের মতন কন্ না—হপ্তায় দুটো কি তিনটে মাথা… আসুন দয়া করে। আমি নিজে ধরছি—ওকে ওদিকে দিয়ে দিলাম, দেখতেই পেলেন।”

এ লোকটিকে আরও ত্যাঁদড় বলে মনে হচ্ছে; বেশ গরম মেজাজটাকে ঠাণ্ডা করে নিয়ে যে রকম গোড়া বেঁধে কাজ করছে। মনে হোল ঢুকেই পড়ি। কেমন একটা বিরক্তিও ধরে এসেছে, আর ভালোও লাগে না পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই জটলা। না হয় বললেই হবে একটু ভদ্রভাবে ছেঁটে দাও।

ঢুকেই পড়তাম, বিঘোরে পড়ে উজবুক সেজে ফিরতেই হোত বাড়ি (ও ক্যারদানি ছাড়ত না কোনমতেই, এ্যাডভারটাইজমেন্ট যে!), কিন্তু এইসময় ভেতরে হঠাৎ একটা গোলমাল উঠল—

“তার মানে? সে কখনও হতে দেব না।”

“আলবৎ দেবে; তোমার কাজ নিয়ে কাজ, ফিনিস খারাপ হয় ত্যাখন বোলো।”

“ত্যাখন বোলো’— আবদার!”

—উঠে এগিয়ে এসেছে খদ্দেরটা; মাথায় পেছনটা খানিকটা মেলানো, খানিকটা আভাঙ্গা সামনেটা একেবারে কাঁচি ছোঁয়ানো হয়নি, চুলগুলো কপাল কান সব ঢেকে ফেলেছে, ঝাড়নটা বুক পিঠ ঢেকে গলায় আটকানো, কোমর পর্যন্ত এসেছে নেমে। রোগামানুষ, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বড়টাকে উদ্দেশ্য করে বললে— “আবদার পেয়েছ? এক ভাই ক্ষুর চালাবে, এক ভাই কাঁচি— নেউকিদের সম্পত্তি ভাগ—খুড়ো নিলে দুধেল গাই, ভাইপো নিলে বাছুর—চলবেনি এ ব্যাবোস্তা যার সঙ্গে ফুরণ হয়েচে, যে মোয়াড়া ধরেচে তাকেই ফিনিস করে দিতে হবে—ও চলবেনি, যে খদ্দেরের সঙ্গে সখ করে বিতণ্ডা নাগাতে গেছে সে নিজে এসে রফা করুক; তুমি এস, ফিনিস করে দিতে হবে—ঘাড়ে সুড়সুড়ি লেগে ঢুল এয়েচে একটু মশাই! হঠাৎ খালি কেন?—ওমা, চোখ মেলে দেখি আলাদা এক মূর্তি কাঁচি নে ধিনিকাত্তিকের মতন দাঁইড়ে রয়েচেন, নাও..এস—ফিনিস করো ভালো মানুষটির মতন…”

ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম, বড়টা ওপরেই অমনি, ভেতরে রগচটা। শান্ত দৃষ্টিতে একঠায় চেয়ে চেয়ে শুনছিল, হঠাৎ লাফিয়ে ছুটে গিয়ে খদ্দেরের ঘাড়টা ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল—

“নেকালো!—আভি নেকালো আমার সেলুন থেকে—আরাম করে ঢোলবার জায়গা পেয়েছ? এক রদ্দায় সাতপুরুষ পজ্জন্ত ঘুম ছাড়িয়ে দোব—ফুরন দেখাতে এয়েচে!—নেই ফিনিস করেঙ্গা—নেকালো এখান থেকে!”

বেশ ভিড় জমে গেছে। ব্যাপারটা একটু অতর্কিতে বলে খদ্দেরটা বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো, ঠেলে নামিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু থমকে ঘুরে দাঁড়াল, তারপরেই একটা লাফ দিয়েই উঠে পড়ে এক ছুটে গিয়ে হাতল ধরে চেয়ারটায় চেপে বসল।

একটা তুমুল হট্টগোল পড়ে গেল—দুই ভাইয়ে ভেতরে সেঁদিয়ে গেছে— “নেকালো!”

“…কোভি নেহি…নেই মাংতা…আলবৎ ফিনিস করতে হবে।…”

শ্রাদ্ধটা কতদূর গড়ালো জানি না। দরজার মুখে চাপ ভিড়, হাঙ্গামাটায় গোড়াপত্তনে যারা ছিল, আমায় দেখেছিল, তারা সব ওদিকেই; আমি আর দেরি না করে ছাতাটা আড়াল দিয়ে পা চালিয়ে দিলাম। পাশেই মেছোহাটার গলিটা; আর সদর রাস্তার দিকে না গিয়ে তার মধ্যেই ঢুকে পড়লাম। মনে হোল একটু দেখে নি; কিন্তু আর লোভ করলাম না। একটা সরু রাস্তা ধরে, কারুর ডোবার ধার দিয়ে, কারুর উঠোনের ওপর দিয়ে, সব শেষে একটা বাঁশের নড়বড়ে পুল পেরিয়ে একেবারে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। আর স্টেশনের দিকেও না, একটা বাস আসছিল ডায়মন্ডহারবারের দিকেয়, তাইতে উঠে পড়লাম।

সামান্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়ানো—তাইতেই কোথা থেকে কি হয়ে গেল। বিচিত্র এই জগতে আত্মসমাহিত আর সাবধান হয়ে থাকতে পারেই বা কতক্ষণ লোকে? মনটা খিঁচড়ে রয়েছে। বেশ খিদেও পেয়েছে ঘোরাঘুরি করে। যাবার সময় তেমাথার ওপরই ময়রার দোকানে রসগোল্লা তয়ের হচ্ছিল—বড় একটা কড়ায় সাঞ্চা দিয়ে রসের মধ্যে চেপে ধরছে, থাকে কখনও — চারিদিক দিয়ে ঠেলে ঠেলে দুলে দুলে ভেসে উঠছে মাল — সাদা ধবধবে, নধরকান্তি—লোভ সংবরণ করে ঠিক করেছিলাম একটু দেখেশুনে বেড়িয়ে আরও খিদেটা চনমনে করে নিয়ে আসি।

আশাতীত চনমনে হয়েছে খিদে—আশাতীত ঘোরাঘুরিও হোল তো?—তার ওপর উৎকণ্ঠা; কিন্তু হা রসগোল্লা! তুমি কোথায়?

আসল কথা কি জান?—লোভ সংবরণ করাটাও একটা পাপ অনেক সময়। সেই শেয়ালটার গল্প মনে আছে? মানুষের লাস, হরিণ, শুয়োর, নিদেন মড়া সাপটাই না হয় খেয়ে ফেল; হতভাগা হঠাৎ মিতাচারী আর সংযমী হয়ে ঠিক করলে—অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্গুণ। বিঘোরে প্রাণটা দিলে; পাপের প্রায়শ্চিত্ত হাতে হাতে।

নাড়ি জ্বলছে অনুশোচনা আরও বেশি করেই,—ধনুকের ছিলেও যদি পাওয়া যায় খানিকটা।

কিন্তু চলা পথে মলা জমতে পায় না। বসে বসে রোমন্থন করলেই আইডিয়াগুলো মনের গাঁটে গাঁটে জমা হয়ে ‘রিউম্যাটিজম্’ ঘটায় (আমি সে ভদ্রলোকের কথাটা ভুলতে পারছি না)। আমতলাটা পেরিয়ে যেতে রয়াল সেলুনও ঘাড় থেকে আস্তে আস্তে নেমে গেল। আগেই বলেছি বাসটা ছিল ডায়মন্ডহারবারমুখো, (অবশ্য কলকাতামুখো হলেও আপত্তি ছিল না) এগিয়েই চলেছি। আবার সেই মিষ্টি পথ, দু’দিকের নিঃসীম শ্যামলতার গা চিরে। অভদ্র রকমের ভিড় নেই, জানলার ধারে একটি ভালো জায়গা পেয়েছি, পূব দিকটাতেই। আমার সেই কনট্রাস্ট,—বিধাতা একটা উৎকট ঝাঁকানি দিয়ে গায়ে আবার মিষ্টি করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন….রোদের তাত কমে এসেছে, সেই অনুপাতে হাওয়াটাও হয়ে এসেছে মোলায়েম, পালিস করা রাস্তার ওপর দিয়ে বাসটা ছুটে চলেছে, একটু দোলা লাগে না গায়ে। আর কিছু দরকার নেই আমার; শুধু এইরকম করে এগিয়ে যেতে দাও—দাও এইরকম একটা যতিহীন সচলতা, তাইতেই সব গ্লানি ধুয়ে মুছে যাবে’খন।

কন্ডাক্টার এসে দাঁড়াল। আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেছি, এবার একটি নিশ্চিন্ত তৃপ্তির মধ্যে, জিগ্যেস করলাম— “কি চাই?”

অর্থাৎ ‘বরং ব্রুহি।’…আমি যে চাওয়ার বেশি পেয়েছি, তাই মনটা দেওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

পাশের দুটি লোক ফিরে তাকালে আমার মুখের দিকে, ততক্ষণে হুঁশও হয়েছে, জিগ্যেস করলাম— “ও কন্ডাক্টার বুঝি? – “

—শুধু একটু সামলে নেবার চেষ্টা, কেননা লোকটার কন্ডাক্টারত্ব সম্বন্ধে এতটুকু কোথাও সন্দেহের অবকাশ নেই।

পকেটে হাতটা দেওয়াই ছিল, একটা আটা আনি বের করে বললাম— “সিরাকোল।”

সেটা কতদূর স্পষ্ট ধারণা নেই। মাঝেরহাটে টাইম টেবিলে চোখ বুলিয়ে যাবার সময় পৈলানের পর ওই নামটাই নতুন ঠেকেছিল—কয়েকবার জড়িয়ে গিয়েছিল জিভে, খপ করে মনে পড়ে গেল।

বিধি এখন সদয়। সিরাকোল সেই স্টেশন যার পরেই ফলতা লাইন ডায়মন্ডহারবার রোড ডিঙ্গিয়ে একেবারে পশ্চিমমুখো হোল, তার মানে এরাস্তার সঙ্গে আর যতটুকু সম্বন্ধ প্রায় ততটুকুই টিকিট নিয়েছি, স্টেশনের কাছে গিয়ে নেমে পড়লাম।

একটা কথা ছেড়ে গেল, আমতলা হাট থেকে খানিকটা এসেই রায়বাড়ির জামাইয়ের প্রসেশনটা রাস্তায় পড়ল—সেই চারটি নিরুদ্বেগ গরুর গাড়ি, শফার নির্লিপ্তভাবে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে। বাস আমাদের সসম্ভ্রমে পাশ কাটিয়ে গেল। ঘুরে একটু গলা বাড়িয়ে দেখলাম—জামাইবাবু গদি থেকে আরও যেন খানিকটা ঝুলে পড়েছেন। এক ধরণের তুরীয় অবস্থা।

বড় স্টেশন সিরাকোল, ঘোলসাপুরের পরেই। বেশ খানিকটা ইয়ার্ড, লাইনটাও রাস্তা ছেড়ে খানিকটা ভেতর দিকে চলে গেছে; ইঞ্জিন জল নেবে তার জন্যে একটা জলস্তম্ভ। একটা স্বাতন্ত্র্য্য আছে, স্টেশন বলে শ্রদ্ধা হয়।

ঘরের মধ্যে গিয়ে মাস্টারমশাইকে প্রশ্ন করলাম, গাড়িটার আর কত দেরি। একটা লম্বা খাতায় টাকা-আনা-পাইয়ের ঠিক দিচ্ছিলেন–বহর দেখে মনে হোল ষাণ্মাসিক বা সালতামামি। তর্জনীটা একটা সংখ্যার সামনে টিপে রেখে, ঘুরে একটু অন্যমনস্কভাবে বললেন— “বেরিয়ে গেল যে।”

“বেরিয়ে গেছে! কতক্ষণ?”

“এ-ই আপনার গিয়ে…”

ঘড়ির দিকে চেয়ে শেষ করলেন— “মিনিট দশ; ঠিক দশ মিনিট হোল।”

“এর পরেরটা?”

না ফিরে বাঁহাতটা একটু উঁচু করে অপেক্ষা করতে ইশারা করলেন; তর্জনীটা আবার ওপরে উঠে গেছে, আঁকে যেমন চটপটে, নেমে আসতে দেরি হবে। যদি গুলিয়ে যান তো চটতেও পারেন। আমতলা হাটের পর আর অযথা কথা কাটাকাটি করার উৎসাহ নেই; বেরিয়ে এলাম।

এত দ’মে গেছি হিসেব করে দেখবারও অবকাশ হোল না, আস্তে আস্তে গিয়ে বাইরের বেঞ্চটায় বসে পড়লাম। এ যে দেখছি, গাড়ি ফেল করবার মরশুম পড়ে গেছে। এখন করা যায় কি? করার মধ্যে এটা ঠিক যে, ফলতা আজকের মতো বাতিল করতে হোল। দু ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টা অন্তর গাড়ি, পরেরটা এখানে এসে পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

ফেরাই সাব্যস্ত। নিরুদ্দেশের যাত্রা, টিকিট কিনেছি বলেই যে ফলতার হাতে মাথা বিকিয়ে দিয়েছি এমন কথা নয়। বাসে ডায়মন্ডহারবারের দিকেও খানিকটা চলে যাওয়া যায়, কিন্তু কেমন যেন উৎসাহ পাচ্ছি না। রেলের লাইনটা যেখানে রাস্তার ওপর যুগ্ম রেখা টেনে ডাইনের দিকে ঘুরে গেছে, সেইখানেই আমার আজকের গতিপথেরও পূর্ণচ্ছেদ টানা হয়ে গেছে যেন।

এও এক অদ্ভুত খেয়াল মনের। আগে এক জায়গায় তোমায় বলে থাকব, আমার এই অভিযানের যে মুক্তি তা অন্য ধরণের—বাধা হয়ে যা মনে উদয় হবে, তাকে যে সব সময় কাটিয়েই ওঠবার জন্যে প্রাণপণ করব তা নয়। যখন খুশি তখন করব প্রাণপণ, যখন খুশি, তখন করব না— এই যেমন খুশি তেমনি করার মুক্তিই তো আসল মুক্তি; একটু যদি নিয়মেই বেঁধে ফেললাম যে না ভয়, না মোহ—কোন কোনটার হাতেই আত্মসমর্পণ করব না তো সে নিয়মই তো একটা নিগড়।

আর বৈচিত্র্যও তো এই মুক্তিতেই—যে বৈচিত্র্যের অপর নাম জীবন — variety is life…মাঝে মাঝে কখনও রাঙা চোখ কষায়িত ক’রে বধূর অশ্রু বের করে আনতে হবে, আবার নিজের অশ্রু দিয়েও শ্রীচরণের রাঙা আলতা দিতে হবে ধুয়ে।

বাধার সঙ্গে আমার এই সম্বন্ধ।

বলবে, তুলনাটা ঠিক হোল না,—বধু তো বাধা নয়।…নয় কেমন করে? —

বন্ধনই তো।

ঐ পূর্ণচ্ছেদটা রূপান্তরে একটা মায়া। মায়া পড়ে গেছে আজ আমার ফলতা রেলের ঐ এক জোড়া লাইনের ওপর। আজ আমার ওর সঙ্গে মন বাঁধা হয়ে গেছে কেমন ক’রে, ও মুখটা ঘুরিয়ে চলে যাবে ডাইনে, আমি ওকেই অতিক্রম করে বেরিয়ে যাব সোজা, এ চলবে না। এ যেন হবে এক ধরণের—যায় পরঘর আমারই আঙিনা দিয়া…বড় নিষ্করুণ।

আজ ফিরি, আবার একদিন আসা যাবে।

ফিরতে কিন্তু বাস, আর রেল নয়। রেলের বোধ হয় বিলম্ব আছে, তা ভিন্ন রেলে বিলম্বও। বাড়ি ফেরাটা বেড়ানো নয়, সেটা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, সুতরাং তাতে সময়েরও করা চাই সঙ্কোচ; বেড়ানো হচ্ছে নিজেকে প্রসারিত করে দেওয়া, তার সামনে রয়েছে অনন্ত, সুতরাং সময়েও একটা অন্ত বেঁধে নিয়ে এগুলে চলে না।

কিন্তু বাসেই যদি ফিরি তো তাড়াতাড়িটা কিসের এখন? ঘুরে ফিরে জায়গাটা একটু দেখে আসা যাক না। একটা কিছু ঠিক করে ফেলার পর এখন আর সে অবসাদটা নেই।

উঠে বারান্দার ধারে এসে একবার চোখ তুলে চারিদিকটা দেখে নিলাম। জায়গাটা একটু নতুন ধরণের—যা এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি। রাস্তার উল্টো দিকটায় স্টেশন থেকে পোটাক তফাতে একটা নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। একেবারে নতুন বলে গাছপালার ভিড় লাগেনি—বড় বা আগাছা, কোনরকমেরই। সখের বাজার ঠাকুরপুকুর থেকে আলাদা তো বটেই, উদয়রামপুর—আমতলার হাট থেকেও অন্য ধরণের। অনেকটা আমাদের ওদিককার মতো—খোলা, খটখটে, একটু এগুতে না এগুতেই দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে হচ্ছে না, এখান থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত সমস্তটুকু স্বচ্ছ আকাশের নিচে ঝলমল করছে। আকাশের গায়ে একখানি যেন ছবি টাঙানো রয়েছে।

আবার টানছে আমায়, নেমে পড়লাম। আমতলার হাটের ‘রয়াল সেলুন’ ভুলে গেছি; সারা দুনিয়া কি ‘রয়াল সেলুনেই’ থাকবে ভয়াল হয়ে? উজিয়ে যেতে হোল খানিকটা; তার পরেই ডাইনে রাস্তাটা গেছে বেরিয়ে।

বেশ চওড়া নতুন রাস্তা, পাকা; বড় রাস্তার মতো পিচ নেই, তবে বেশ ভালো করে রোল করা। খানিকটা গিয়েই দুধারে যে দোকানের সারি আরম্ভ হয়েছে, সেটা অনেক দূর পর্যন্ত গেছে চলে, আর রাস্তাটা গেছে সেসব ছাড়িয়ে টানা ওদিক পানে বেরিয়ে, দেখলেই মনে হয়, বহু দূরের পাল্লা।

কেমন একটু নতুন-নতুন ভাব এসেছে জায়গাটার মধ্যে, একটা freshness, যার জন্যে একটু অভিভূত হয়ে পড়েছি। নবজন্মের একটা বিস্ময় আছে, নতুন একটা শিল্পই হোক, নতুন ছবি বা নতুন একটা নগরীই। তার নতুন রূপ নিয়ে ধরাপৃষ্ঠে সে যে একটা রূপান্তর ঘটালে শুধু তাই নয়, তার হয়ে-ওঠা এখনও পূর্ণ হয়নি, সুতরাং তার চারিদিকে কল্পনার থাকে পূর্ণ অবকাশ। দেখতে দেখতে আর সেই দেখার ওপর গ’ড়তে গড়তে এগিয়ে চললাম। আমার অবসরও প্রচুর এখন, এমন নয় যে, উদয়রামপুরের মতো ফলতা মেল হুইসিল মারলেই ছুটতে হবে, কি আমতলার হাটের মতো সেই ফলতা মেল পেছনে আসছে ছুটে—তাড়াতাড়ি গিয়ে হাজির হতে হবে। আধঘণ্টা অন্তর বাস, অন্তত দুটো আধ ঘণ্টা তো অনায়াসেই হাতে রাখা যায়।

যেখানে নতুন রাস্তাটা ডায়মন্ডহারবার রোড থেকে বেরিয়েছে, সেখানে বাঁদিকে ছোট একটি পুল আর তার পাশেই গুটি তিন-চার দোকান, প্রথমটি মুদিখানা। এখানে এসে আমার গতিটা একটু মন্থর করতে হোল। হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত হচ্ছে, সেও আবার এ জায়গার পক্ষে একটু নতুন ধরণের : ‘খর বায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে…। রাস্তাটা যে ভেঙে বেরিয়েছে, ঠিক তার বাঁ কোণটিতে একটা ছোট্ট ঘর, দোতলা ঘরও বলতে হোল, দোতলাও বলতে হোল, কিন্তু নিয়মমতো ধরতে গেলে তার কিছুই নয়। নীচের ঘরের সামনের দিকটা রাস্তার সমতলে, বাকি মেঝেটা পিল্পের আর খুঁটির ওপর বসানো, রাস্তাটা যে আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে গেছে, সেইখান থেকে তোলা, মেঝের নিচে ফাঁকা জায়গাটায় আগাছার জঙ্গল। সমস্ত ঘরটিই ওপর পর্যন্ত ইট আর কাঠ- কাঠরা দিয়ে তৈরি।—লম্বে প্রস্থে চার-পাঁচ হাত হবে। একটা যেন খেলাঘরই। ওপর-নিচে মিলিয়েও একটা মাপিকসই একতলার মতন উঁচু নয়।

নিচেটা বিড়ির দোকান, পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে কাঠের, তাই দিয়ে মাথা নিচু করে দোতলায় গিয়ে পৌঁছুতে হবে।

সেই দোতলা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বেরিয়ে আসছে।

নতুন ধরণের এইজন্যে বলছি যে, ঠিক এক গলায় একটানা সঙ্গীত নয়, সঙ্গীতের শিক্ষকতা, একজন বেটাছেলে—গলাটা দিব্যি চাঁচা, ভরাট—একটি ছোট মেয়েকে শেখাচ্ছে।

জিগ্যেস করতে দোকানী বললে— “গানের ইস্কুল, কেন সাইনবোর্ড তো টাঙানো রয়েছে, একটু উদিকপানে গেলেই ঠাওর হবে।”

কাছের গ্রামেরই একটি ছেলে, বাইরে থেকে শিখে এসে স্কুলটি ফেঁদেছে।

বড় অদ্ভুত লাগছে; এখানে মিউজিক স্কুল! সিরাকোল জন্মাল তো একেবারেই আধুনিক হয়ে জন্মাল! আরও একটা কথা, যে জন্যে আমি হয়ে পড়েছি বেশি অভিভূত—এইখানে রাস্তার এই কোণটিতে দুটি বাংলা একটি গানের সেতুতে যেন এক হয়ে গেছে—নোবেল-লরিয়েট রবীন্দ্রনাথের বাংলা কালচারের উত্তুঙ্গ শীর্ষে অধিষ্ঠিত, আর পল্লী মায়ের অঞ্চলাশ্রিত মেঠো বাংলা। এ সমন্বয় স্বপ্নেই আছে, সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিকের একটা pious hope— নিয়তই জাতির কাব্যে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রচারে হচ্ছে রূপায়িত—একে যে এমনভাবে, এমন একটা জায়গায়, এমন একটা সমাবেশের মধ্যে উপলব্ধি করবার সৌভাগ্য হবে আমার, তা কখনও কি ভাবতে পেরেছি?

গান শুনছি বলেই ‘রয়াল সেলুনে’র পদ্ধতিতে সাকরেদ করে নেবার জন্য টানা হিঁচড়া লাগাব এমন ভয় নেই, সুতরাং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষ করা গেল। তারপর এগিয়ে চললাম আবার।

আগে জঠরাগ্নিকে শান্ত করা যাক। একটা ঘর বা জায়গা বনেদী কি ভুঁইফোড় তা টের পাওয়া যায়, সে খায় কিরকম, এই থেকে। সেদিক দিয়ে আমতলার হাটের কাছে সিরাকোলকে মাথা নোয়াতে হয়। জানি না এখন কি রকম হয়েছে, কিন্তু আমার যেদিন শুভাগমন হয়,—সেই প্রায় আজ থেকে বছর সাত আগে, সেদিন সমস্ত বাজারটা ঘুরে এসেও একটা ভালো দোকান পাইনি। শেষে হার মেনে, যেটার দিকে নাক সিঁটকে চলে গিয়েছিলাম সেটারই দ্বারস্থ হতে হোল।

মুড়ি আর মেঠাই—দুটো ডিপার্টমেন্ট। মুড়িটায় মা-লক্ষ্মী যেন উছলে পড়ছেন—মুড়ি, চিড়ে, মুড়কি; মুড়ি আর চিড়ের মোয়া, কাঠিভাজা, ফুলুড়ি, বেগুনি—কি খাবে কত চাই?

এইটেই বড়রাস্তার ওপর, বাহার দিয়ে।

দোকানের বাঁদিক দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে, তাই দিয়ে মিঠাই বিভাগে ঢুকতে হয়, কতকটা যেন আত্মগোপন করে আছে।

“টাট্‌কা কিছু পাওয়া যাবে?”— প্রশ্নটা করবার সময় চক্ষুলজ্জার খাতিরেও উনুনটা থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না, কবে যে আগুন পড়েছিল, ভিয়ান চড়েছিল সেটা গবেষণার বিষয়।

ডান হাতে পাখা, বাঁহাতে হুঁকো নিয়ে দোকানী চৌকির ওপর বসেছিল, নেমে উঠে দাঁড়াল খাতির করে, একটু সঙ্কোচের সঙ্গে হেসে বললে-”আজ্ঞে, একেবারে যে সদ্য তৈরি, টাকা তা বলতে পারব না, তবে পানতুয়াটা আপনি দেখতে পারেন, বোধহয় চলতে পারে…বলেন তো…”

আমতলা হাটের সদ্যজাত রসগোল্লাগুলো রসের কড়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে…একটু বিমর্ষ কণ্ঠে বললাম – “দেখি।”

আলমারিটা বড়, পুরনোও, সেটা খুলে একটা শালপাতায় করে দুটি বের করে নিয়ে এসে সামনে ধরলে। বললাম— “রসগোল্লা?”

“আজ্ঞে, সেটা আর দেখালুম না…”

একটু ম্লান হেসে ফরমাস মতো গোটা আষ্টেক পানতুয়া একটা পদ্মপাতায় করে বের করতে করতে দুঃখের কাহিনী বলতে লাগল—নতুন একটা জায়গা পত্তন হোল দেখে গ্রাম থেকে উঠে এসে ফেঁদেছে দোকানটুকু—মিলিটারীরাই রাস্তাটা বের করলে কিনা—একটু ফলাও করে টেবিল-বেঞ্চিও পেতেছে এই, কিন্তু কৈ?—ছানার মালের বিক্রী নেই, ঐ মুড়ি-মোয়া, কাঠিভাজা…

লোকটি ভালো। শেষের দুটো পানতুয়া যে গলার নিচে নামাতে পারলাম না তার জন্যে আরও কুণ্ঠিত হয়ে উঠল। দামটা নেবার সময় কাঁচুমাচু করে বললে— “না হয় অর্ধেক দামই দিলেন—অবিশ্যি বলতে ভরসা পাচ্ছি নে…”

বড় মিষ্টি লাগল। একটা খারাপ হবে, তবে তো আর একটা হবে ভালো এই করেই তো জীবনের ভারসাম্য রক্ষা হয়ে চলে; পানতুয়ার রস একটু টকে না গেলে, মনের রসটুকু এত মধুর হয়ে কি বেরিয়ে আসতে পারত?…অবশ্য থাকবে আর ক’দিন?-সদর বাজারে দোকান ফেঁদেছে, নানা স্বার্থের সংঘাতে ও রসটুকু হয়তো যাবেই উবে, তবে আমি যে তার আগেই একদিন পৌঁছে গিয়ে পেলাম আস্বাদ এইটুকুতো, আমার কাছে তো সেইটিই বড় কথা।

বললাম— “না সে কি কথা, তুমি তো তঞ্চকতা করো নি…রসগোল্লা তো বের করলে না- পাতে দেবার মতন নয় বলেই তো?”

জিভ কামড়ালো।

“আজ্ঞে তা কখনও পারি বের করতে?…আবার দেখুন, ঐগুলি তো বিক্রীও করব, দরের দরেই করব বিক্রি—ফেলে দোব না তো।…তাহলেই দেখুন, গলদটা কত দূরে। গ্রামের মধ্যে এসব চলত না, সমাজ রয়েছে যে; কিন্তু পেট আর চলে না গ্রামে—অমন গ্রাম…শ্মশান হয়ে গেছে আজ্ঞে, দিনের বেলা বাঘ ডাকে… চৌধুরীদের, রায়েদের, চাটুজ্জেদের, পালেদের, এক একখানা যে বাড়ি পড়ে আছে—তাইতে যোগান দিয়েই এক-একটা ময়রার দোকান দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো—জেলও তাই, ময়রা-পাড়ারই এপারে শাঁখ বাজালে ওপারে আওয়াজ পৌঁছতো না! এখন দুটি ঘরে দাঁড়িয়েছে, আজ্ঞে…..বলুন।”

কি আর বলব? কণ্ঠও হয়ে আসে রুদ্ধ।

“ব্রাহ্মণ?”

“হ্যাঁ।”

“পাতঃ পেন্নাম হই। তামাক…?”

“তা একটু হলে মন্দ হোত না।”

সামনে যে ছেলেটি খদ্দের সামলাচ্ছিল, তাকে ডেকে তামাকটা সেজে দিতে আদেশ করে বললে— “তা ভেবেছেন আমি আর বেশিদিন এর মধ্যে জড়িয়ে থাকব? রামোচন্দ্র! ঐটি নাতি। ওর বাপকে সেখানকার দোকানে বসিয়ে এসে একটু ট্রেনিং দিচ্চি উটিকে; একটু সড়গড় হয়ে এলেই তাকে সুদ্দু এনে বাপ-বেটাকে এইখেনে বসিয়ে আমি আমার সাবেক আস্তানায় গিয়ে উঠবো আবার।…আমার সোজা কথা আজ্ঞে—তোরা এই অখদ্যে কালে জন্মেছিস—দুটো মিথ্যে কথা না বললে, তঞ্চকতা না করলে যে-কালে পেট চলে না; তা তোরা ঐ পাঠশালায় গিয়ে পড়—আমায় নিয়ে টানাটানি করা কেন?

আজ্ঞে এই বেলা পড়ে এল তো?—এর পরেই সন্দ্যে—এদানি নয়, ঐ ওর মতন যখনটা- চাটুজ্জেদের শিবতলায় নিত্যি আড়াই সের করে বাতাসা আর পো তিনেক সন্দেশ সের বাটখারা সুদ্দু নিয়ে গিয়ে তৌল করে উঠোনা দিয়ে আসতে হোত। বহুকালের কথা…এখন বাতাসা খাবার মতন একটি শিবই আছেন, বাণেশ্বর, বাকি চারটি ইটের গাদার মধ্যে—কোন ব্যবস্থা নেই—চাটুজ্জেরাই লোপাট হয়ে গেল তো তার ব্যবস্থা—তবুও স্বভাবের দোষেই আধপোটাক করে বাতাসা — পুরুত মশাইয়ের নেংটো নাতিটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাবার মাথায় চইড়ে না দিয়ে এলে সোয়াস্তি হোত না আজ্ঞে।…সেটুকুও গেছে…এখন কি রকম করে পচা রসগোল্লা আর বাসি মুড়ি খদ্দেরের হাতে গচিয়ে দিতে হবে—তার হক্কের কড়ি আদায় করে নিয়ে, তার টেনিং দিচ্চি। তা দিচ্চিই, উপায় কি? তবে সন্দেটুকু এগিয়ে আসার সঙ্গে মনটা যে আইঢাই করে উঠতে থাকে—হিসেবে ভুল হয়— কেবলই মনে হয় ছোঁড়াটা বনের মধ্যে গিয়ে, পোড়ো মন্দিরে পিদিমটুকু জ্বেলে, সেই ছটাকখানেক বাতাসা বাবার সামনে ধরে দিয়ে এলো কি না…”

বেশ বলছিল, হঠাৎ– “ও কর্তাবাবু, একি সাজা দিলেন তিনি আমায় বুড়ো বয়সে।”—বলে খাটো কোঁচার খুঁটটা চোখে চেপে হুহু করে কেঁদে উঠল।

কিছু না বললে চলে না, মানুষকে ফাঁকা সান্ত্বনা দিতেই তো মানুষের জন্ম, বললাম – “তা আর করছ কি কর্তা? আড়াই সের করে বাতাসাটা হচ্ছিল—তা তাঁরই যখন ইচ্ছে এই রকমটা হোক, ঐ আধপোটুকুও বন্ধ পড়ুক—তো তুমি আমি করতে পারি কি?

খানিকটা নীরবে কাটল; আমাকেও ছোঁয়াচ লেগেছে, আর বলতে গেলে সামলাতে পারব না নিজেকে মনটা হালকা হ’লে চোখ দুটো মুছে নিয়ে দোকানী বললে— “আজ্ঞে, আম্মো সেই কথাই বলি—বলি, তারই যখন ইচ্ছে, তখন তুই কি করবি বল মোদকের পো?…তবে উপলক্ষিটা আবার আমাকেই করেছেন কিনা, তাই…বামুন, কড়ি-বাঁধাটা।”

ছেলেটি তামাক সেজে এনেছিল, আদেশ মতন হুঁকোটা পালটে নিয়ে এসে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটা স্পর্শ ক’রে এগিয়ে ধরলে। এতক্ষণ ঐদিকে ছিল, ভালো করে দেখা হয় নি, সামনে এসে দাঁড়াতে চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। একেবারে এই রকম ষোল আনা একটি বাঙালির ছেলে কতদিন যে দেখা হয়নি!—চোখ যেন ফেরাতে পারা যাচ্ছে না। বছর পনের-ষোল বয়স, এদিককার হিসেবে একটু লম্বা, কালো, নধর-কান্তি; চোখ দুটি ঢুল-ঢুলে, বুদ্ধির দীপ্তিতে একটা অন্য ধরণের বাহার এসে পড়েছে তারই মধ্যে; এদিকে একটু সলজ্জ। মাথায় একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল। এই রূপটা কেমন করে যেন আমার বাঙলাদেশের ধ্যানমূর্তির সঙ্গে বহুদিন থেকে রয়েছে জড়িয়ে। প্রতিপদেই এর ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু আমার মনে হয় এই যেন আদর্শ, এই যেন হওয়া উচিত, এই মায়ের এ-ই যেন সন্তান।

‘ষোল আনা’ বলেছি অন্য কারণে। বাঙলার বাইরে কোথায় কি ফ্যাশান উঠেছে—কেশে, বেশে, তার একটি আঁচড় এসে লাগেনি গায়ে। একটি লালপেড়ে আধময়লা ধুতি, আলগা কোমর বেঁধে পরা, কাঁধে একটা রাঙা গামছা, হাত মোছবার জন্যে, ডান ওপর হাতে সোনার তারে একটা তাবিজ বাঁধা; ব্যাস, শেষ; গায়ে একটা গেঞ্জি পর্যন্ত নেই যে ষোল আনা থেকে এক পাই পয়সাও কম পড়বে!

চুলে এতটুকু ইতর-বিশেষ নেই ঘাড় আর কপালের মধ্যে। বুঝেছি, তুমি সন্তুষ্ট হতে পারছ না, এই অর্ধনগ্ন প্রকৃতি-শাবকটিকে জগৎসভায় কি করে দাঁড় করাবে? তার জন্যে আমার কিন্তু কোন মাথাব্যথাই নেই; আপাতত এইটুকুই মনে হচ্ছে যে জগৎ একবার উঠে এসে তার নয়ন দুটো সার্থক করে যাক।

আমরা তো এর কাঁধেই একটা পীত-ধড়া তুলে দিয়ে রূপের চরমোৎকর্ষ—একেবারে মদনমোহন রূপের স্বপ্ন দেখে এসেছি।

দোকানী চুপ করে কি একটা যেন লক্ষ্য করছিল, হঠাৎ একটু উষ্ণ হয়ে উঠল— “ঐ দেখুন, সাধ করে কি বলছিলাম একাল আর সেকাল?…শুনলি বামুন, তা পায়ের ধুলো নিতে হবে না?— সেটুকুও বলে দিতে হবে?”

.

কাল প্রবাসী-অফিসে যথেচ্ছা তর্কের যে এলোমেলো ঝড়টা উঠেছিল তাতে এটাও ছিল—এই জাতপাত, ব্রাহ্মণ-হরিজন। আমিই ছিলাম বলতে গেলে বিপক্ষের নেতা। মলিন শতগ্রন্থি একগাছা পৈতা শরীরের কোথায় পড়ে আছে—টোড়াসাপ—সে নিয়ে আর দাপট কেন? …বিষ থাকলেও যে এক সময় করেছিলাম দাপট তারই তো পরিণতি—বিশেষ অক্ষরে ঐ লেখা রয়েছে পূর্ববঙ্গে, মাদ্রাজে, কোথায়ই বা নয়?—হাজার বছরের গ্লানির ইতিহাসের পাতায় পাতায় একেবারে…

আমার তর্ক; chapter verse উদ্ধার করে করে দেখিয়ে গিয়েছে কাল; শুধু মুখের কথা নয়, অন্তরের বিশ্বাসও। তবু আজ কি হয়েছে—কোন্ প্রবাস থেকে যেন ঘরে ফিরে এসেছি, সেখানে তর্ক নেই, নেই দ্বন্দ্ব। সহজ অধিকারে আমি ব্রাহ্মণ, আমার প্রতি কারুর নেই ঈর্ষা, কারুর প্রতি আমার নেই অবজ্ঞা…আমার ডাক পড়েছে গরিব মেয়েটির জামরুলের দোকানের শুভযাত্রা করে দিতে হবে, এখানে বৃদ্ধের নাতির জীবনেরও জয়যাত্রার দুটো মন্ত্র চাই।..কী সে সৌভাগ্য! কী করে সে হারাল! কেন যে!…নতুন যুগের নতুন তথ্য—প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আত্ম-জিজ্ঞাসার। ব্রাহ্মণ বলেই আমি যেন সবচেয়ে বড় ত্যাগ করে যেতে পারি, সবচেয়ে বড় স্বার্থটাকে জগতের কল্যাণ যজ্ঞে আহুতি দিয়ে যেতে পারি হে ভগবান…

আবার গিয়ে তর্কে মাতব, কাগজে লিখব, সাহিত্যে করব প্রচার,—কেন আর এই তিন গাছা সুতো নিয়ে এত মাতামাতি!

তার আগে কিন্তু আজকের এই দিনটাকে পেয়ে নিই ভালো করে। কবেকার একটি হারানো দিন আচম্বিতে পথ তুলে এসে যখন পড়েছেই।

আর পায়ের ধুলো কাউকে নিতে দিই না, ধুলোই তো, অপমানই তো। আজ কিন্তু আর ছন্দপতন হতে দিলাম না, পা দুটো বের করে নিয়ে জুতোর ওপর রাখলাম। মাথায় হাতটা চেপে ব্রাহ্মণেরই ভাষায় ব্রাহ্মণের সৃষ্ট মন্ত্রের আশীর্বাদ করলাম— ‘কল্যাণমস্ত’।

আশা রইল শক্তিতে না কাজ হোক, অপচয়িত শক্তির যে অনুতাপ তাতেও যদি ফল হয় একটু।

পারছ পড়ে যেতে?—আমার অভিযানে সৌধ নেই, শিখর নেই, ঝরণা নেই, সমাধি নেই, স্মৃতিস্তম্ভ নেই। কি করব? এই খুঁটে খুঁটে বেড়াই, রোদে বর্ষায়, সকালে সন্ধ্যায়; চিঠিতেও তাই এই দিচ্ছি, ধরেছে কি মনে তোমার?

Eureka! প্রাপ্তোস্মি! সেই কথাই এবার বলি তোমায় :—

দোকানের বাঁয়েই কাঁচা রাস্তা, তারপরেই একটা খাল, আগে বলেছি তোমায় সেকথা।

খালটা হাতচারেক চওড়া, আশপাশের সমতল থেকে বেশি নিচেও নয় যে বেশ খানিকটা নেমে গিয়ে তবে জল পাওয়া যাবে। বেশ একটি খেলাঘর-খেলাঘর ভাব আছে, যা—বোধ হয় আগেই বলেছি—এ প্রান্তের অনেক জিনিসের মধ্যেই পাওয়া যায়, আর যার জন্যে মনে হয় ফলতা মেলে চড়ে ঠিক এই রকমই একটি দেশে এসে পড়বার কথা। এই খেলাঘরের খালে দিব্যি নৌকা চলাচলও আছে। নৌকোগুলিও নতুন ধরণের কতকটা, এদিককার নৌকো যেমন মোচার খোলার আকারে গড়া তেমন নয়।

বোধহয় হাত দুয়েক চওড়া হবে, তাও কেঁদে-কঁকিয়ে; বরাবর একরকমই, লম্বায় শুধু বোধহয় একটু বেশি কিম্বা হয়তো সরু আর একভাব বলে মনে হয় বেশি লম্বা।

একটা বড় যানবাহন এদিককার; মানুষও যাচ্ছে, মালও যাচ্ছে; বিচালির আমদানি রপ্তানি দেখেছি বেশি।

আমি যখন আসি একটিতে জন দুয়েক লোক চুপটি করে বসে ছিল, নৌকো বোধ হয় আরও লোক নিয়ে ছাড়বে। একজন তার মধ্যে ছোকরা, বেশ ফিটফাট, শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে কল্পনা করতে করতে আমি দোকানে ঢুকেছিলাম মনে আছে। দোকান থেকে যায় দেখা খালটা, তবে অতটা খেয়াল করি নি, একবার ঘুরে দেখি নৌকোটা নেই, কখন ছেড়ে দিয়েছে।

তবে আমাদের দেখেই আর একটা নৌকো এসে ঘাটে লাগল ওদিক থেকে। তামাকটা শেষ করে এনেছি, দুজনে হাত ফের করে; উঠতে যাব, দোকানী বললে— “আজ্ঞে আর একটু বসে যান—ক্ষেতি হবে?”

“ক্ষেতি…মানে, যেতে হবে অনেকটা, সেই হাওড়া-শিবপুর, জানো কিনা বলতে পারি না…”

ততক্ষণে নৌকোর যাত্রী দুজন উঠে এসেছে—দোকানের দিকেই পা, দুজনের মধ্যে একজন আবার স্ত্রীলোক, তায় যুবতীই দেখে আমি উঠে পড়ে বললাম— “তোমারই খদ্দের, মেয়েছেলে রয়েছে আমি উঠিই না হয়।”

দোকানীর হাতেই হুঁকোটা, মুখে লাগিয়ে একটু চোখ টিপে গোঁফ আর ধুঁয়ার মাঝে অল্প একটু হেসে বললে— “একটু বসেই যান না, রহস্য আছে।”

পুরুষটির বয়স…পঞ্চাশ হলেও, আশ্চর্য হব না; তবে দিব্যি বলিষ্ঠ আর muscular। দুজনের বয়সের তারতম্য দেখে দোকানীর মুখে ‘রহস্য’ কথাটা বড় খাপছাড়া লাগল। কানে; বেশ একটু কটুও—এখনি যার মুখে অমনি একটি পবিত্র, ভক্তি-অশ্রু-পূত কাহিনী শুনে আমার নিজের চোখও সজল হয়ে আসছিল।

তা যাই বলুক ও, দুজনের মুখে বেশ একটি সরলতা আছে কিন্তু। সময় থাকলে ঐ ছাপটুকুই মনে নিয়ে উঠে পড়তাম দোকানের মিষ্টি অভিজ্ঞতাটুকুকে আর তেতো হতে না দিয়ে, কিন্তু তার আগেই দুজনে রাস্তায় এসে উঠেছে। পুরুষটির হাতে একটা মোটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ; নৌকোর ছইয়ের মধ্যে ছিল, কড়া রোদের জন্যেই বোধ হয় দুজনে মাথাটা একটু নিচু করে আসছিল, দোকানের ছেঁচের নিচে এসে মুখ তুলতেই আমায় দেখে যেন একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল দুজনেই। দোকানী বললে— “চলে এসো ভেতরে; উনি আমাদের মুখুজ্জে মশাই—তোমার গিয়ে ঘরের মানুষই এক রকম বলতে গেলে।”

পাড়াগাঁয়ে এই রকম পরিচয়েই চলে; একজনের ঘরের মানুষ তো সবারই ঘরের মানুষ; এক রকম সামাজিক জ্যামিতির নিয়মেই; বেশ সপ্রতিভভাবেই উঠে এল দুজনে। মেয়েটিই বেশি যেন একটু। এসে দাঁড়িয়েছে, আড়ে পুরুষটির পানে অল্প একটু তিরস্কারের দৃষ্টি হেনে খুব সূক্ষ্মভাবে আমার পায়ের দিকে চেয়ে ভ্রু দুটো একটু চেপে দিলে; সে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা ছুঁয়ে রেখে একটু সলজ্জভাবে হেসে বলল— “মুখুজ্জে মশাই?—বামুন—তাহলে তো পায়ের ধুলো পাব একটু।”

ওর হয়ে গেলে মেয়েটি ধীরে সুস্থে বেশ করে গলায় আঁচল জড়িয়ে হাতটা পায়ের নিচে পর্যন্ত চালিয়ে যা পাওয়া গেল সত্যি ধুলোই নিলে একটু।

কেমন যেন গুরু-চণ্ডালি দোষ হয়ে যাচ্ছে, প্রণামের মধ্যে ঘটা রয়েছে, কিন্তু দোকানী ঐ যে পোড়া এক ‘রহস্য’র কথা গেয়ে রেখেছে, তেমন অন্তর ঢেলে আশীর্বাদটুকু বের হোল না মুখ দিয়ে এবার।

টেবিলের দুদিকেই বেঞ্চ, দোকানী বললে— “তা বোস’ গুপী ওদিকপানটায়, দাঁড়িয়ে কতক্ষণ থাকবে?…গাঁয়ের খবর বলো, আমাদের গাঁয়েরও।”

গুপী বেঞ্চটায় বসল, আমার জন্যে বোধ হয় একটু সঙ্কুচিতভাবেই; বললে— “গেঁয়ের খবর…তা এক রকম ভালোই…তোমাদের উদিকেও হয়েছেল যাবার বরাৎ একটু—ছেলের সঙ্গে চণ্ডীতলায় দেখা…ভালোই সব।”

“ভালো হলেই ভালো—যা করে কাটচে মানুষের।…তা, নাতনীও বোস্।…এই দেখো।”

মেয়েটি একটি খুঁটি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, নিচের ঠোঁট দিয়ে ওপরেরটা একটু ঠেলে অস্পষ্টস্বরে বললে— “বেশ আচি।”

“তা থাকবিনি কেন? আমি বলছিলাম পাশাপাশি বসলে পরে একটু যুগলরূপটুকু দেখতুম কদ্দিন পরে,—এই আর কি।”

—আমার পানে চেয়ে একটু হেসে টীকা করলে— “আজ্ঞে, নাতনী।”

মেয়েটি আবার ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট তুলে দৃষ্টিতে একটু হাসি আর রাগ ফুটিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিলে।

ঠোঁট থেকেই করি বর্ণনা : একটু পুরু, কপালটি একটু উঁচু, নাকটি একটু চাপা; তাহলেও বেশ একটা শ্রী আছে, তার অনেকখানিই অবশ্য বয়স আর অনবদ্য স্বাস্থ্যের জন্যেই। পুরুষটির কথা বলেছি। পরিচ্ছদটা দুজনেরই সাদামাটা, বেশ সম্পন্ন কৃষক পরিবার বলে মনে হয়।

আমার বুকের কোথায় যেন একটা চাপা নিঃশ্বাস আটকে ছিল, দোকানীর ঠাট্টাটুকুতে আর নাতনী বলে পরিচয়ে সেটা বেরিয়ে বুকটাকে হালকা আর পরিষ্কার করে দিলে।

অসমবিবাহ সমাজের একটা উৎকট ব্যাধি। পাণিগ্রহণ,—কিন্তু পঞ্চাশ আর আঠার-বয়সের

এই দীর্ঘ ব্যবধান ডিঙিয়ে কি করে ধরবে হাত? কি করে হবে মিল?

আজ কিন্তু আমি ক্ষমা করতে পারছি গুপীকে।

আসল কথা ওই দৃষ্টিকোণ, যা অনেকখানিই নির্ভর করে অবস্থা আর পরিবেশের ওপর।

যদি মনস্তত্ত্বের দিক দিয়েও এগোও তো বলতে হয় ঐ যে ‘রহস্য’র একটা কুৎসিত ইঙ্গিত ছিল—তাই হ’তে চিত্তের একটা গ্লানি, সেটা থেকে মুক্ত হয়ে আমার মনটা একটা স্বস্তির দৃষ্টিতে সমস্তটুকুকে পাচ্ছে দেখতে—ইংরাজিতে যাকে বলা হবে একটা রিলিফ।

বেশ সহজমনেই ক্ষমা করতে পারছি আমি গুপীকে…সুস্থ সবল পুরুষ সে যদি কাম্যা এক কামিনীকে চায় তো এর মধ্যে দোষটাই বা কোথায়, অশোভনটাই বা কি? বিকৃতি তো বয়সের জন্যে নয় সব সময়, বিকৃতি অযোগ্যতায় আর বিকৃতি ব্যভিচারে। আমার বেশ লাগছে এই অসম-দম্পতি, এর মধ্যে চমৎকার একটা কাব্য আছে—শাকীর পাশে জীবন্ত ওমরখৈয়াম—শ্বেত শ্মশ্রুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভ্রমরকৃষ্ণ কুঞ্চিত কুন্তল।…আমরা যে ভুল করি দেখবারই—কেনই বা জোর দেব শুধু কামনার দিকটাই—এর মধ্যে যে রয়েছে নারী-সুষমার একটা মস্ত বড় অভিনন্দন অসুন্দর পুরুষের দিক থেকে—পুরুষ বলেই যে অসুন্দর।

দোহাই, তুমি আর তর্ক এনে ফেলো না এর মধ্যে। সিরাকোলের এই মধুর অপরাহু। এই দোকান, এই দোকানী, এই করায়ত্তভর্তৃ ষোড়শী, এই মুগ্ধবিমূঢ় প্রৌঢ়ভর্তা—এসব থেকে যখন দূরে—তোমার ড্রয়িংরুমে—তখন আবার নিজমূর্তি ধরব—আজ গুপীকেষ্টকে ক্ষমা করলাম বলে উগ্রমূর্তিই ধরব’খন তখন পৃথিবীর যত গুপীকৃষ্টদের ওপর।

এখন কিন্তু করই ক্ষমা আমাকে। কি করব?—হঠাৎ কে কি অঞ্জন বুলিয়ে দিলে চোখে, শরমে-পরিহাসে, শোভনে অশোভনে, বেদনায়-তৃপ্তিতে—সবই যে এখন আমার কাছে মধুরং মধুরং মধুরে মধুরং…

ঘরের লোক হয়ে গেছি। একটি ক্ষণরচিত পরিবার, একজন দোকানে বিকিকিনি করতে করতে একটু মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে, একজন কি করে সুদূর বেহার থেকে এসে জুটে গেছে, দুজন কোথা থেকে নৌকো বেয়ে এল উঠে। এখনই আবার যাবে সংসার ভেঙে, যতটুকু পারি টেনে নিই রস।

নাতি তামাক দিয়ে গেল সেজে আবার। চেনা-লোক, এক গ্রামের, এক বয়সী, হয়তো সাথীও অনেক খেলার,—মেয়েটি সরে গেল ছেলেটার হাত ধরে বড় আলমারিটার একটু ওধারে। জমে উঠল গল্প— “অনেকদিন যাস্ নি গাঁয়ে—কেন র‍্যা?…হ্যাঁঃ দোকান! তাই ব’লে গাঁ ছেড়ে বসে থাকবে লোকে!…আর এই তো দোকানের ছিরি!…হ্যাঁ, তাও বুঝতুম শরীলে-দেহে ভালো আছিস…আর আমায় দেখ…ওমা, হই নি মোটা! কী যে বলে!… বিয়ের জল…তা তুইও না হয় করগে যানা বিয়ে একটা, হিংসে কিসের?…বলগে না ঠাকুদ্দাকে…

খিল্‌ -খিল-খিল-খিল্‌”—সবকথা হাসিতে তরল হয়ে উঠল। নিচু গলায়ই গল্প, কিন্তু যথেষ্ট নিচু হচ্ছে কিনা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বিশেষ।

এদিকে আমাদেরও জমে উঠেছে; কলকেটা তিনটে হুঁকোর মাথায় টহল দিয়ে ফিরছে।

“তা এবার আবার কোথায়, হ্যাঁ সামন্ত?…কাঁচপোকাটি যে আরসুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে…তা যাচ্ছেটা কোথায় শুনতে বাধা আছে নাকি?”

রহস্যটার একটু একটু যেন পাচ্ছি আঁচ, বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা। …প্রশ্ন করে পরিষ্কার করে নোব নাকি? কি ভেবে লোভটা সংবরণ করে হুঁকোই টানতে লাগলাম ফুড়ুক ফুড়ুক করে; তবে আঁচ যে পাচ্ছি তার একটু চটুল হাসি লেগেই রয়েছে ঠোঁটে।

“যাচ্চি—তোমার গিয়ে…

একটা টান দিয়ে না শেষ করেই সামন্ত দোকানীর মুখের ওপর চোখ তুলে একটু সলজ্জভাবে হাসলে।

“বায়স্কোপ, না, ঠিয়েটার এবার?…কোন্ দিক পানের দৌড়—কলকাতা, না, দক্ষিণে?”

“ন্যাও! বাস্কোপ-ঠিয়েটারই দেখছে লোকে রোজ রোজ!

“বলেই ফেলো না, নজ্জাটা কিসের? মুকুজ্জে মশাইয়ের কাছে?…তাহলে, যার আসল নজ্জার কথা তার কাছ থেকেই যে আদায় করতে পারি আমি…হুঁকোটা একটু কাৎ করবেন মুকুজ্জে মশাই?”

কি একটু চাপা কথার পর ওদিকে একটা হাসি উঠল…সেই খিল্‌-খিল-খিল-খিল…

দোকানীর ultimatum-এ সামন্ত হেসে একটু নড়েচড়ে বসল—আর যখন উপায়ই নেই। বললে— “উঃ, নজ্জায় তো কুলোকামিনী নাতনী তোমার, ঐ শোন না।…তা মুকুজ্জে মশাইয়ের কাছে বলব তা ভয়টাই বা কি আর ইয়েটাই বা কি?—কন্ কেন মুকুজ্জে মশাই?…বুড়ো বয়সে য্যাখন ঘাড়ে চেপে বসেইচে ত্যাখন ভোগাবেনি একটু?”

ওদিকে গল্পটা হঠাৎ থেমে গেছে, তারপরেই শিউরে ওঠা চাপা গলায়— “শোন্ কথা! শুনলি?—নাকি ঘাড়ে চেপে বসেচি!…”

হাসিটা আরও কলকলিয়ে উঠে আলমারির ও কোণটায় সরে গেল।

নেমে পড়লাম, ডেকেই যখন নামালে তখন আর দোষটা কি? আর…দোষ বলে একটা জিনিসও আছে নাকি সিরাকোলের ওদিকে কোথাও?…বললাম…”না, সায় দিতে পারলাম না তো সামন্ত, চেপে বসা কি বলচ গো?—ঘাড়ে তুলে নেবার জিনিস যে আমাদের নাতনী…আর ভোগান্তি—তা মোদক মশাইয়ের বুড়ো বয়সেও যদি অমনধারা ভোগান্তি হোত তো বর্তে যেতেন…আর তুমি সে জায়গায় তো…”

তিনজনের প্রাণখোলা হাসিতে দোকানটা গমগম করে উঠল। ওদিক থেকে অর্ধস্ফুট বিস্মিত মন্তব্য— “দেখ, দেখলি? কেউ কসুর নয়।…কে র‍্যা উনি?”

সামন্ত কলকেটা তুলে নিয়ে বললে— “না, ওসব নয়। ছেরকালই কি ওসবের থাকে শখ? কেটেচে। এবার তোমরা গিয়ে গঙ্গাস্তান—ঝোঁক হয়েচে।”

ওদিকে আবার একটা হাসি উঠে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। দোকানী গলা তুলে প্ৰশ্ন করলে— “নাতনী হঠাৎ হেসে উঠলি কেন গো কথাটার ওপর? খটকা নাগিয়ে দিলি যে!…বলি হ্যাঁ সামন্ত, আবার সেইরকম গঙ্গাস্তান নয়তো—নাতনী যেবারে প্রেথম গেল—সেই গঙ্গাস্তান,— কালীঘাট—তারপর…ওঃ, পালগিন্নির মুখে যে শোনাতে পারলাম না গল্পটা মুকুজ্জে মশাইকে….!”

দোকানী হেসে লুটিয়ে পড়ল, কিন্তু কতকটা একাই এবার। সামন্ত যোগ দিলে, কিন্তু একটু অপ্রতিভভাবেই। আলমারির ওদিকটায় শুধু খিক্-খিক্ করে চাপা আওয়াজ একটু, আর— “করে দিলে বুঝি ফাঁস্ রে বুড়ো!”

—আমি একটু কাছে, আছিও কান পেতে, এরা অনেকটা এদিকে; শুনতে বোধহয় আমি একলাই পেলাম।

দোকানী বললে— “তা বড় নাতনী এল না যে? আর সবাইও তো আসে অন্য অন্য বার।”

“তার বাত।”

“নাও! বড় গিন্নির বাত, ছোট দিন্নীর তিথি—দুজনে মিলে এবার সামন্তের যৈবনটাকে দিলে না বজায় থাকতে।”

সামন্ত আবার উল্সে উঠল— “সে কি কও! তেমন দেখি তো তার—ছোট গিন্নি কাড়ব না তাহলে আমি আবার!”

আবার তিনজনের হাসি উচ্চকিত হয়ে উঠল।

ওদিক থেকে একটু হাসির শেষেই আবার চাপা মন্তব্য— “শুনে রাখিস, বুকের পাটাটা একবার দেখে থো!…বলে আর একটা গিন্নি কাড়বে,—আমি ইদিকে জলজ্যান্ত বেঁচে!”

উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছে না; কিন্তু ফিরতেই যখন হবে তখন তো সময়ের সীমানা বাঁধা, হাওড়া স্টেশনের শেষ ট্রাম সাড়ে দশটায়, শেষ বাস এগারোটায়।

বললাম— “এবার আমায় যে উঠতে হয় মোদক মশাই।”

হঠাৎ রসভঙ্গে দোকানী বলে উঠল— “সেকি! ইরি মধ্যেই?”

“তোমায় তো বললামই, অনেক দূর এখান থেকে….”

“তাও তো বটে। তা একটু অপেক্ষা করতে হবেই।…আমার ঘরে আজ নাতনী- নাতজামাই…যদি পেলাম আপনা হেন একজন মানুষকে…কেউ তো ডেকেও সুদোয় না একবার অমন গিন্নিবান্নি নাতনী আমার আর আপনি কিনা…বলি ও নারাণ, ভাই-বোনের মস্করাই চলবে?—আর ইদিকে মুকুজ্জে মশাই যে গোটাকতক পচা পানতুয়া পেটে পুরে শাপমন্যি দিতে দিতে….”

তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে হাতটা চেপে বললাম— “এই তো নয় মোদক মশাই—সব ঠিক রেখে শেষরক্ষাটুকু করতে পারছ না।…তা বসছি, আমারই লোভ নেই নাতনীর হাতে সেবার? তবে তাড়াতাড়ি—যত শীগগির পার ছেড়ে দিতে।”

নাতনীর হাতের অমৃত হালুয়া খেয়ে যখন বেরুলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। প্রায় মিনিট চল্লিশেক কাটলো; এও অমৃত চল্লিশটি মিনিট, আমার জীবনে এর মৃত্যু নেই।

কাজের মেয়ে নারাণী। আলমারির ওদিক থেকে বেরিয়ে এসে কাজের মধ্যে ওর পূর্ণ সত্তাটি বিকশিত হয়ে উঠল। দাদু, স্বামী, সাথী—কারুর কাছেই সঙ্কোচের বালাই নেই, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি আমিও মুকুজ্জে-দাদু। আয়োজনের মধ্যে সাবলীল চলা-ফেরা কথাবার্তা—একটা জিনিস তো ভালো করেই বুঝিয়ে দিলে নারাণী—ওরাই জীবনের কেন্দ্র—ওরাই চৈতন্য…

“আমাদের ওখানে একবার আসতে হবে মুকুজ্জে-দাদু, নিশ্চয়ই…তুমি একবার বল না গো- ছেরকালই হাঁদা রয়ে গেলেন!—মিথ্যে বলচি ময়রা-দাদু?”

একটা হাসি ওঠে উৎকট; সামন্ত বলে— “তা তোরা আর হতে দিলি কই চালাক? কামেখ্যার ডাইন সব…ভেড়া করে রাখবার মন্ত্রই তো খালি শিকেচিস!”

আবার ওঠে হাসি।

বিদায়ে সেই রকম ঘটা করে প্রণাম। “সত্যি আবার আসতে হবে মুকুজ্জে-দাদু…আমরা গরিব চাষা-ভূষো বলে…

চোখ দুটি ছলছলিয়ে উঠেছে। একটু রহস্য করে না বললে আমিও আর সামলাতে পারি না নিজেকে। বললাম— “আসব না!…যা হালুয়ার লোভ লাগিয়ে দিলি তুই (তুই-ই বেরুল, বড় মিষ্টি) …আর গরিব হোক শত্রুতে—ওই হালুয়ারই হাত যা তুই দেখালি…’

সামন্ত হেসে বললে— “তা হলেই আর এসেচেন দা’ঠাকুর—ও যা হালুয়া, তা পরের ধনে পোদ্দারি বলেই…”

হাসিমুখে বিদায় দেবার যশটুকু সামন্তই নিলে। হোক ম্লান, তবু সবার মুখেই একটু হাসি দেখে বেরুলাম, নারাণীর হাসি তার জলটুকু দিয়েছে ঝরিয়ে।

.

পিছুটান, পা উঠতে চাইছে না যেন; সেইজন্যেই জোর করে পা দুটোকে তাড়াতাড়ি চালিয়ে মায়ার এলাকাটুকু খানিকটা ছাড়িয়ে এসে গতি মন্থর করে দিয়েছি, হঠাৎ ডান দিকে টানা হুইসিল-এর শব্দ। খান-চার দোকানের আড়াল কাটিয়ে এসে দেখি সত্যিই একখানা গাড়ি। অনেকটা দূরে, মালগাড়িও তো হতে পারে, তারপর খেয়াল হোল এ লাইনে সবকিছুই তো সম্ভব; তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলাম।

না, প্যাসেঞ্জার গাড়িই, আমি স্টেশনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সেও গেল পৌঁছে। জানতে পারা গেল আমতলার হাটে আমার যে গাড়িটা ধরবার কথা সেটাই এটা। হিসাব করে দেখা গেল, তাই ত হবে। রয়াল সেলুনের কাঁচির ভয়ে আমি অন্তত মিনিট পঁচিশ আগে ওখান থেকে সরে পড়েছি, তারপর দ্রুত বাস পনর মিনিটের বেশিই বরং বাঁচিয়েছে একটা স্টেশনে আসতে এই প্ৰায় চল্লিশ মিনিট। স্টেশন মাস্টার যদি তখন আঁকে ডুবে না থাকে অমন করে, কিম্বা আমি তখন যদি একটু স্থির হয়ে ভেবে জিগ্যেস করি—বেরিয়ে যে গেল সেটা কোন্ গাড়ি, তাহলে আর এ নিগ্রহটুকু হয় না-

কিন্তু নিগ্রহই কি?—–তাও আবার ভাবি, আর বঞ্চনার মধ্যে দিয়েও যাঁর দান নামে সহস্ৰ ধারায় তাঁকে মনে মনে করি প্রণাম। একটু যে বিরক্তি, একটু যে ভুল, যার জন্যে হল না ভালো করে জিগ্যেস করা, ওইটুকু যে নৈরাশ্য, ওর মধ্যে দিয়েই তো আমার আজকের পরম প্রাপ্তিটুকুর পথ হচ্ছিল রচিত

আবার ঐ নগদ যা পেলাম তার অতিরিক্তও গেছি পেয়ে। তাই তখন বলছিলাম—ইউরেকা! প্রাপ্তোস্মি!

—একটি চমৎকার গল্পের প্লট যা আরম্ভ হয়েছিল ‘পৈলান’ নামটা থেকে, পালবৌ যার মধ্যে আবছা-আবছা এসে দাঁড়িয়েছিল, গোপী-নারায়ণী যেন সেটাকে পূর্ণ করে তুলেছে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছি—সৃষ্টির আনন্দে আমার অন্তর উঠছে কেঁপে কেঁপে—দোকানী যেটুকু রহস্যে ঢেকে ছেড়েছিল আমি সেইটুকুই নিই তুলে—বেশ স্কোপ আছে… সেই যে বললে— “সেইরকম গঙ্গাস্তান নয়তো? – নাতনী যেবার প্রথম গেল—সেই গঙ্গাস্তান কালীঘাট—তারপর…”

তারপর কি?…কোন্ পালগিন্নি?—তা যে পালগিন্নিই হোক, আমার পাল বৌই সে; সিরাকোলও তো ‘পৈলান’ নয়।

টিকেট নিয়েছি থার্ড ক্লাসেরই, কিন্তু দেখছি ভুল হয়ে গেছে। গাড়িতে বেশ ভিড়, তাতে মোটামুটি খসড়াটা একরকম দাঁড়ালেও প্লট আমার সংলাপে—পরিস্থিতিতে বেশ দানা বাঁধতে পাচ্ছে না। একটু নিরিবিলি হলেই ভালো হোত, কিন্তু শেষ গাড়ি, নেমে আর টিকিট বদলাতে যেতে সাহস হচ্ছে না।—বিশেষ করে স্টেশন মাস্টারের যা লম্বা হিসেবের নমুনা পেয়েছি। যাক, বিধি অনুকূল, টিকিট চেকার এসে উপস্থিত। আর ইন্টারও নয়, যতটা নিরবিলি যাওয়া যায়, থার্ডটা একেবারেই সেকেন্ডে বদলি করে নিয়ে নেমে গেলাম।

সিরাকোলে ইঞ্জিন জল নেয়, আমার গল্প আরম্ভ হয়ে গেছে এদিকে—সম্বন্ধটুকু যা দাঁড়িয়েছিল তার সঙ্গে খাপ খাইয়েই চলেছে গল্প, নাতনী-আমার নাকে দড়ি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গুপীকে। শুনেই যাও না—এই রকম দাঁড়াল—

লড়াইয়ের বাজারে গুপী সামন্ত, যাকে বলে ফেঁপে উঠেছে। উপরোউপরি কটা বছর যেমন ধান হোল, তেমনই পাট, বিক্রিও হোল সোনার দরে, চলতি বলে ফেঁপে ওঠা কথাটাই ব্যবহার করছি, আসলে গুপী নিরেট হয়ে ফুলে উঠল।

একটা পুকুর খোঁড়ালে, গ্রামের দুটো পুকুর নিজের টাকায় ঝালিয়ে দিলে, বারোয়ারিতলায় একটা নলকূপ গলিয়ে দিলে, আটচালাটার ওপরেও টিন বসিয়ে দিলে। এইভাবে আগে খানিকটা পুণ্য সঞ্চয় করে নিয়ে কাশীনাথের ছোটমেয়ে নারাণীকে বিয়ে করে ঘরে তুললে।

কাশীনাথের মেয়েগুলি হয় ভালো। গুপীর ইচ্ছে ছিল বড়টিকেই নেয়। সেটি গেলে মেজটির ওপর নজর পড়ে, কিন্তু তখন টানাটানির সময়, কাশীনাথের খাঁইও বেশি, কথাটা যে তুলবে সে হেম্মৎ পর্যন্ত হয়ে ওঠে নি। অনেক দিন থেকে ওই একটা সাধ—চারশ টাকা নগদ গুণে দিয়ে নারায়ণীকেই ঘরে আনলে গুপী। ডাগোর-ডোগরটি আছে, কাশী বলে বয়স কিছু কম, আঠার বছর। গুপীর আন্দাজ, কিছু বেশিই হবে।

গুপীর নিজের বয়স এখন আড়াই কুড়ি হয়ে এক বছর চলছে।

এই নারাণী এখন আবদার ধরেছে তাকে কলকাতা শহর দেখাতে হবে। গুপী বলেছে— “তা দেখবি, এ আর বড় কথা কি?”

কলকাতার ফ্যাসাদটা আসলে ভুল করে গুপীই তুলেছে। ভুল করে বলাও চলে আবার শখ করে বলাও চলে। কলকাতা শহর যে কি বস্তু, গুপী এই সেদিন পর্যন্ত নিজেও জানত না। তারপর দাঁয়েদের কাছ থেকে পনর বিঘে বন্ধকী চাকলাটা উদ্ধার করতে যেয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত যে দৌড়ুতে হোল, তাইতেই কলকাতার অভিজ্ঞতা গুপীর। এই মামলাটা জেতার পরই নারায়ণীকে ঘরে নিয়ে এল। বয়সকালে সাবেক বৌ রতনের মার সঙ্গে যে সব আলাপ হোত, সে সব ঠিক যোগায় না মুখে, মানায়ও না, গুপী কলকাতার গল্প দিয়েই নূতন বৌয়ের মন আকর্ষণ করতে লাগল—

“দাঁয়েদের বালাখানা দেখেছিস?—একা হাইকোর্টের মধ্যে তার লাখোখানা এঁটে গিয়ে একটা গোটা ধান-মাড়াইয়ের উঠোন থাকবে পড়ে। এইরকম এইরকম কোটা অলিতে গলিতে। রাস্তা দেখলে তোর মনে হবে বিছানা ছেড়ে আঁচল বিছিয়ে রাস্তাতেই পড়ে থাকি—যেমন কালো পাথরের মতন রঙ তেমনই পালিশ। দেখলে যা মনে হবে তাই বললুম, ইদিকে আবার যে একটু পা দেবে নোকে তার জো নেই—যেমন মোটর, তেমনই বাস, তেমনই টেরাম, টেরাম বুঝলি?”

নারাণী বললে— “কই না তো।”

“ইঞ্জিন নেই, দুখানা রেল গাড়ি, রাস্তার মধ্যি দিয়ে বন বন করে ছুটেচে, সরো, চাই, কাটা পড়ো।”

বধূর বিস্ময়-বিমূঢ় মুখের দিকে চেয়ে অল্প হাসির সঙ্গে মাথা দোলাতে লাগল। নারাণী প্ৰশ্ন করলে— “তবে চলে কি করে—হ্যাঁ গা?”

গুপীর হাসি একটু স্তিমিত হয়ে গেল, কেননা চলার রহস্যটা তার আয়ত্ত নেই, বললে — “চলে…এত বড় রাজত্বটা চলচে কি করে সরকার বাহাদুরের?…তারপর গঙ্গার পুল দেখ, চিড়িয়াখানা দেখ, মরা সোসাইটি দেখ—দেখে কি মানুষ কুলুতে পারে? আজব শহর কলকাতা—কথাটা যে চলে আসছে সেই মান্ধাতার আমল থেকে তা কি মিথ্যে?…একবার লয়, কবার দেখলুম, লোকে একবার দেখলেই বলে জীবন সাথক হোল—তা একবার লয়, কবার দেখলুম।”

ছেলেমানুষ, গল্প শুনে শুনে ঔৎসুক্যটা বেড়েই চলেছে; এদিকে আবার আদর পেয়ে পেয়ে আবদারেরও অন্ত নেই, নারাণী একদিন ধরে বসল তাকেও দেখাতে হবে কলকাতা। গল্প করে নিজের গুরুত্বটাই বাড়ানো উদ্দেশ্য ছিল গুপীর, মেয়েছেলে হয়ে এমন অসম্ভব আবদারটা যে করে বসবে নারাণী, বিশেষ করে কনে-বৌ হয়ে এটা ভাবতে পারে নি। উল্ট গাইতে আরম্ভ করে দিলে দুদিন—জায়গা অবশ্য বড়ই কলকাতা, তবে সেখানে কি ভদ্রলোকের মেয়েছেলেরা থাকে? যারা আছে কোন রকমে নাক-কান বুজে আছে; বাড়ি থেকে এক পা বার হবার জো নেই, হলেই হয় ট্রামে চাপা পড়ো, না হয় গুণ্ডার হাতে, না হয় মিলিটারী। মেয়েদের মধ্যে খালি মেমসায়েব, না ঘোমটার বালাই, না কাপড়ের বালাই, ঠ্যাং-ঠেঙে ঘাঘরা পরে ধিঙ্গি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

‘ধিঙ্গি’ কথাটার ওপর একটু জোর দিয়েই বললে গুপী, ফিরে ফিরে কয়েকবার ঐ কথাটার ওপরই এসে পড়ল, যদিই একটু সাড় হয় নারাণীর। কি হোল বোঝা গেল না, তবে নারাণীর কথা হঠাৎ ৎ অল্প হয়ে গেল, পরদিন আরও অল্প, তার পরদিন একেবারে চুপচাপ।

গুপী মুশকিলে পড়ল। একা নারাণী নয়তো, তার জ্বলজ্বলে সংসার, সাবেক বৌ রতনের-যা, চার ছেলে, তিন পুত্রবধূ, তিনটি নাতি, চারটি নাতনী। বড় মেয়েটিও শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে, সঙ্গে দুটি ছেলে। এদের মধ্যে থেকে একা নারাণীকে নিয়ে গেলে তো চলবে না। রতনের-মা ওপরে ওপরে কিছু বলে না, নতুন বৌয়ের আদরযত্নেরও কোন ঘাটতি নেই তার কাছে, তবু মেয়েছেলেরই মন তো, বরং ওপরে ওপরে নারাণীর চেয়ে তাকেই খাতির দেখাতে হয় বেশি আজকাল গুপীকে। ছেলে, পুত্রবধূ, মেয়ে—এদের মুখও একটু ভারই থাকে; চলে এ অবস্থায় শুধু নতুন বৌটিকে নিয়ে কলকাতা দেখাতে যাওয়া?

চলে না তো, কিন্তু তার চেয়েও অচল অবস্থা যে এদিকে। অবশ্য কলকাতা যাবার কথা থেকেই যে এভাব নারাণী তা বলে না, কাজের অছিলায় গা-ঝাড়া দেয়, ঘুমের অছিলায় মুখ ফিরিয়ে নেয়; কিছু না বলেও মনের কথাটা বেশ স্পষ্ট করে দেয়।

তৃতীয় দিন গুপী বললে— “কই তুই কলকাতা যাবি বলছিলি, আর শুনি না যে সে-কথা?”

“আমি তো মেমসায়েব লয়।”

“ন্যাও ঠ্যালা। মেমসায়ের ভেন্ন কেউ আর কলকাতা যাবে না?”

“গেরস্তর বৌয়েরা তো সবাই মটোর-টেরাম চাপা যাচ্ছে, গুণ্ডোর হাতে পড়ছে।”

“না পড়চে যে এমন লয়, তা তুই থাকবি আমার সেথে। গুপী সামন্ত পাশে আর গুণ্ডো এসে গুণ্ডোমি করবে, এমন গুণ্ডোকে একবার দেখতে পেলে হোত যে”!

“একলা তো যাওয়া যায় না গো, আক্কেল আছে তো মানষের? দিদি আচে, ছেলেরা আচে, বোয়েরা আচে, মেয়ে এলো শ্বশুরবাড়ি থেকে, এক-কাঁড়ি টাকা…”

“তুই আমায় টাকার খোঁটা দিসনে নারাণী, করকরে চারটিশো ট্যাকা গুণে দিয়ে তোকে ঘরে নেলুম। তুই যখন বের করেচিস মুখ দিয়ে—যাবে সবাই। তার খরচের ভয়টা কি দেখাস গুপী সামন্তকে?”

পরের দিন সাবেক বৌ রতনের-মাকে বললে— “কালীঘাট কালীঘাট করিস, একবার না হয় চল সবাই, এখন একটু ফুরসৎ রয়েচে…

ঘাঘি মেয়েছেলে, সবই খোঁজ রাখে, সবই বোঝে, ঠোটের কোণে হাসি চেপে রেখে মুখটা ঘুরিয়ে রতনের-মা বললে— “তা চলো না নিয়ে, আর তো বুড়োও হয়ে এনু, মানষের কত সাধ মেটে, আমার না হয় একটাও মিটুক জীবনে।”

ঠিক হোল পাল-বৌকেও যেতে অনুরোধ করা হবে। পাল-বৌ বিধবা, নেড়া, বয়স প্রায় সামন্তেরই মতন! এদিকে খুব ডাঁটো, অনেক দেখেছে, অনেক ঘুরেছে, মেয়েদের অথরিটি, পুরুষদের তোয়াক্কা রাখে না।

.

কি রকম লাগছে? তেরস্পর্শ তো ঘটানো গেল—গুপী, নারাণী, আর পাল-বৌকে নিয়ে।

ইঞ্জিনের জল নেওয়া হয়ে গেছে; ছেড়েও দিয়েছে। হন্টন আর মোটর বাসের পর পরিবর্তনটুকু আরও লাগছে ভালো। রাস্তার ধারেই ডান দিকে একটি ঝুরিনামা মাঝারি গোছের বটগাছের নিচে গ্রাম্য দেবতা—মনে হোল যেন শীতলা। গাড়ি এগিয়ে গেলেও মনটা রইল আটকে! এই ঠাকুরটিকে দেখলেই আমার মন কাছ-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ে একটু। কারণ আছে—ইনিই আমাদের চাতরার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কিন্তু কারণটা শুধু তাই নয়, শীতলা আমার ছেলেবেলার একটা অংশের সঙ্গে আছেন ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে—আমার তখন মাত্র এক ঠাকুরমার অভিভাবকত্বে মুক্ত জীবন—কোথায়ও শীতলামূর্তি দেখলেই সেইসব দিনগুলি ভিড় করে এসে পড়ে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে—পূজা, বলিদান, রাস্তায় কে দণ্ডী কাটতে কাটতে গঙ্গা থেকে নেয়ে আসছে—কে অজাত বলে থামের আড়াল থেকে মূর্তির দিকে করুণ নয়নে আছে চেয়ে। যাত্রা হবে, আসর সাজাতে রঙিন কাগজের শেকল তুলে ধরছি—শেষ রাত্রে ভাড়াটে বৌয়েদের জনশূন্য ভূতুড়ে বাড়িটার পাশ দিয়ে একা শিশু যাত্রা দেখে ফিরছি বাড়ি…আমি জীবনে বাঙলাকে নিবিড়ভাবে পেয়েছি সেই একবার; এই যে আজ ঘর ছেড়ে বেড়াচ্ছি ঘুরে—সে তাকেই আবার পাবার জন্যে; কিন্তু মনের সে মুক্তি কোথায়? কোথায় দৃষ্টির সে স্বপ্ন?

যাক, দুঃখ করে হবে কি?…যা করছিলাম করা যাক।

তিন নম্বর হল্ট গেল বেরিয়ে, তারপর গাড়ি এখন শিবানীপুরে। গল্প বোনা একটু স্থগিত রইল; এ নামটিও বেশ, নয়? জায়গাটা একটু যেন পুরনো বলে বোধ হচ্ছে; অনেকগুলি যাত্ৰী নামল এখানে। স্টেশনের পরেই একটু নিচু জমি, শুকনো খালই বোধ হয়, তার মধ্যে নেমে আবার উঠে লোকেরা চলেছে, জনস্রোতে একটা ঢেউয়ের দোলা। জায়গাটার একদিকে ডায়মন্ডহারবার রোড, একদিকে এই রেলের লাইন, সেই জন্যে বেশ জমজমাট মনে হচ্ছে; অন্তত এখন মনে হচ্ছে, যখন ওদিকেও ছুটে চলেছে লরি-বাস, এদিকেও স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর তাই থেকে সদ্য নেমেছে যাত্রীর স্রোত। ছোট জায়গা হলেও অনেকগুলি ভালো ভালো বাড়ি স্টেশন থেকে চোখে পড়ে বাঁদিকে একটানা লম্বা ওটা বোধ হয় ইস্কুল। তিন নম্বর হল্ট থেকে খানিকটা বেরিয়ে একটু এসেই একটা অর্ধচন্দ্রাকার বাঁকের মধ্যে গাড়িটা ডায়মন্ডহারবার রোড পার হয়ে এল, তারপর একটু ফাঁকা মাঠ ভেঙেই এই শিবানীপুর। এপাড়া ওপাড়া, শিবানীপুরে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়লে তিন নম্বর হল্ট থেকে উত্তর পাওয়া যায়। এ লাইনে এটাও বেশ লাগে। লাইনের যা দৌড়—মোট মাইল পঁচিশেক, তার সঙ্গে বেশ মানানসই করে স্টেশনগুলি কাছে কাছে বসানো। খেলাঘরই তো।

একটা শাখা-রাস্তা বেরুল আবার ডায়মন্ডহারবার রোড থেকে; নতুন হয়েছে মনে হয়, সম্ভবত ফলতা পর্যন্তই গেছে কিম্বা যাবে। চলেছে রেলের সমান্তরালেই, তবে খানিকটা তফাতে থেকে। এরপর একদিন ওর ওপর দিয়েও বাস যাবে, লরি যাবে; তার মানে ফলতা রেলের শনিগ্রহ এদিকেও নতুন পথ কেটে ঢুকল।

গাড়ি ছাড়ল, ভগবানকে ধন্যবাদ; কেউ লোক ওঠে নি, আমি একটু নিরিবিলিই চাই। অথ পুনঃ ‘গুপী-নারাণী-পালবধূ কথাঃ’।

রাত তিনটের সময় গোরুর গাড়িতে চেপে বেলা দশটার সময় সবাই ফলতা কালীঘাট রেলের পৈলান স্টেশনে পৌঁছাল। প্রায় সকলেই এসেছে, বাড়িতে আছে বড় ছেলে, মেজ ছেলে, বড় বৌ আর নিতান্ত যে কয়টি কুঁচোকাচা ছেলেমেয়ে। ওরা তিনজন এরপরে একদিন আসবে। ছেলেদুটির কলকাতা দেখা আছে, আরও কম বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে। বড় বৌয়ের বাড়ি ডায়মন্ডহারবারের কাছে, কলকাতা না দেখুক, শহর কাকে বলে জানা আছে বলে একটু দেমাক আছে, এবারে বাড়ি আগলাবার জন্যে রইল।

গুপী আর পাল-বৌয়ের কথা বাদ দিলে এক শুধু রতনের মা রেলগাড়ি কি তা জানে, একবার এমনি দেখেছে, দুবার চেপেছেও; বাকি সবাই একেবারে খাজা : কৌতূহলে, উল্লাসে, মন্তব্যে, আবার কতকটা ভয়েও নিজেদের কামরাটা সরগরম করে তুললে। চাষা-ভুষো মানুষ, চাপা গলায় কথা কইবার শিক্ষা কারও নেই, অল্প সময়ের মধ্যেই একটা তামাসার ব্যাপার হয়ে উঠল। সবাইকে তোলবার মধ্যেই গাড়িটা ছেড়ে দেওয়ায় গুপীকে কামরাটার শেষ দিকে উঠতে হোল; সেখান থেকেই প্রশ্ন-মন্তব্য চলতে লাগল— “সবাই উঠল? গুনে মিলিয়ে?—বলি ও রতনের মা?

ছোট ছেলে জবাব দিলে— “উঠল সব। ছোট মা জিগুচ্চে তাঁর বোঁচকাটা হাতে ঠিক আচে তো তোমার?…মা জিগোচ্চে, নাগলো নাকি তোমার তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে?”

পাল-বৌ বাইরের দিকে মুখ করে বসেছিল, কি ভেবে একটু মুচকে হাসলে।

.