প্রীতিভাজনেষু,
জীবনে সবচেয়ে কিসে বেশি আনন্দ পেয়েছি জানতে চেয়েছ। বড় শক্ত প্রশ্ন। এই অর্ধশতাব্দী ধরে একটা জীবন, মহাকালের দিকে একবার চোখ তুলে দেখলে যেমন কিছুই নয়, একটা বুদ্বুদ মাত্র, যা এইবার ফেটে মিলিয়ে যাবে, মানুষের সীমাবদ্ধ আয়ুষ্কালের তুলনায় আবার তেমনি অনেকখানিই তো? এতে, এরই মধ্যে কতভাবে কত আনন্দের আলো ফুটল, কত দুঃখের ছায়াপাত হোল, গভীরতার অনুপাতে তাদের ওপর নম্বর বসিয়ে হিসাব করে বলা কি সহজ?
উত্তরটা দেবার চেষ্টাই করতাম না, “একরকম আছি সর্বাঙ্গীণ কুশল তো?” বলেই সেরে ফেলতাম চিঠিটা, হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা জিনিসে খুব আনন্দ পেয়েছি এক সময়। সবচেয়ে বেশি কিনা—তোমার এই সবচেয়ে শক্ত প্রশ্নটার উত্তর দেবার চেষ্টা না করে কথাটাই সোজাসুজি বলে যাই, লিপির দীর্ঘতা দিয়ে যদি আনন্দের গভীরতা মাপবার চেষ্টা কর, আমার আপত্তি নেই।
ঘোরা বাই ছিল খুব বেশি। ভুল বুঝতে পার তাই বলে দিই, এ-ঘোরার মধ্যে কোন আভিজাত্য ছিল না। হোল্ড-অল-সুটকেস-ব্র্যাডশ-বিবর্জিত এই ঘোরা, এর একদিকে যেমন ছিল না সিমলা-শিলং-উটি, অন্যদিকে তেমনি ছিল না—কাশী-কাঞ্চী-রামেশ্বরম্। বড় কাজের পর বড় অবসরে একটু বড় করে হাঁপ ছেড়ে আসা নয়, নিত্যকর্মের মধ্যে সামান্য একটু পলাতকবৃত্তি—এই ছিল আমার ঘোরার মূল কথা। এত সামান্য কথা যে লিখতে কুণ্ঠা আসে।
কিন্তু কি করব? ঐতেই পেতাম আনন্দ হয়তো সবচেয়ে বেশিই। যদি বলি, ঐ একটুখানি ঘুরে আসার নেশা আমায় ঘটা করে ঘোরার উল্লাস থেকে বঞ্চিত করেছে তো মিথ্যে বলা হবে না। নিতান্ত কেজো ভ্রমণের মধ্যে ফাঁকি দিয়ে আমি দিল্লি, আগ্রা, প্রয়াগ এদের টুরিস্টদের ফাঁকির নজরে যা একটু দেখে নিয়েছি এককালে; তাই—লিখতে লজ্জিত হচ্ছি—পাঁচজন জানিয়ে-দেখিয়ের মধ্যে বসলে একটু মাথা হেঁট করেই বসতে হয় আমায়।…”না মশাই, কাশ্মীরটা দেখি নি; দার্জিলিংটা হব- হব করেও হয়ে ওঠে নি এখনও…না, যাব-যাব করেও চন্দ্রনাথটা কৈ আর হয়ে উঠল?”…এত ‘না’-এর সঙ্কোচের মধ্যে সোজা হয়ে থাকা যায় কেমন করে?
বিপদ এইখানে যে বাঙলাদেশ আমার প্রবাসী মনটাকে অষ্টপ্রহর রাখত টেনে—এর নদী-নালা, ডোবা-জঙ্গলের অদ্ভুত মোহ দিয়ে, এর ভাঙা অট্টালিকা, পুরনো দেউল, জটিল বট-অশ্বত্থের মৌন স্বপ্ন দিয়ে মৃত্যুর কোলে এর জীবনের যতটুকু বেঁচে আছে—এখানে-সেখানে—তার হাসি-অশ্রুর অপূর্ব মাধুর্য দিয়ে। ত্বর সইত না; কাজ নিয়ে গেলে ক্রমাগতই মনটা ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়বার অবসর খুঁজত, আর যখন শুধু অবসর বিনোদনের জন্যেই যেতাম দেশে, তখন তো কথাই নেই, নাকে-মুখে তাড়াতাড়ি দুটি গুঁজে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় পা না বাড়ালে চলতই না আমার।
কি করব?—ঘরের মোহ কুণো করে রাখত আমায়। কবিগুরু যার জন্যে আপসোস করে গেছেন-
‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের ওপর একটি
শিশির বিন্দু–-’
—তারই সাতরঙা আলো থেকে যদি আমি চোখ ফিরিয়ে দূরের দিকে চাইতে পেরে থাকি তো
আমায় দুষবে কেমন করে?
মনকে একেবারে মুক্তি দিয়ে বেরুতাম, বয়স ভুলে, অবস্থা ভুলে, পদবী ভুলে। পাছে এই মুক্তির মধ্যে একটুও বাধা এসে পড়ে এই জন্যে আমার এ ধরনের পর্যটনে কখনও সাথী নিতাম না। যেখানে খুশি যাব, যা খুশি দেখব, যখন যেখানে যেভাবে খুশি বসব, যতক্ষণ খুশি মূঢ় বিস্ময়ে হাঁ করে থাকব চেয়ে—এত নিজেকে এলে দেওয়া ভ্যাগাবন্ডিজমের সাথী পাওয়া দুষ্কর; আর সত্যি কথাই বলছি, এই ভূতে পাওয়া মানুষটাকে বুঝবে এত অন্তরঙ্গ বন্ধু বা আত্মীয় আমি পাই নি এখনও। আমার সত্তার এখানটা অনাত্মীয়ই থেকে গেল।
ধরো, গ্রীষ্মের দুপুর ঝাঁ ঝাঁ করছে, আমি চুপ করে বসে আছি ফলতা-কালীঘাট রেলওয়ের মাঝেরহাট স্টেশনে; এই লাইন ধরে যেতে হবে। কোথায় যাওয়া তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারি নি। পৌনে দুটো হয়েছে, দুটো সাতচল্লিশে গাড়ি ছাড়বে, ততক্ষণ বসে আছি টিকিটঘরের সংলগ্ন বারান্দার বেঞ্চটাতে। আমার একদিকে নিচে একটি বুড়ি, একটি চাঙারিতে মুড়ি নিয়ে বসে আছে, এ—বর্ধমানের এই সীতাভোগ-মিহিদানা। কিনেছিলাম চার পয়সার, শেষ হয়ে গেছে। আমার বাঁয়ে বেঞ্চির ওপর বসে আছে বদন, জাতিতে ধীবর; একটি ধূলি-ধূসর পা (আমার দিকেরটাই) বেঞ্চির ওপর মুড়ে তোলা একটা উবুড় করা মাঝারি সাইজের ঝুড়ির ওপর। পরিচয় হয়েছে; বদনের বাড়ি বড়-জাউলে, সরারহাট স্টেশন থেকে চার ক্রোশ! ঝুড়িটা মাছের, বদন বলছে— “আর কন কেন, সেই কোন্ রাত তিনটেয় বেইরেছিলাম মাছ নে, গলদাচিংড়ি, উদিককোর ওটা নামী কিনা, ধাপার চিংড়ি ফেলে খেতে হবে—কালীঘাটের বাজারে ফোড়েকে ডিলিবারি দিয়ে আসচি।”
“রোজ আস?”
“আজ্ঞে না, একদিন অন্তর দে।”
“কত থাকো ফি খেপে—মোটা রকম বাঁচে কিছু?”
“থাকার কথা আর কইবেন না; তবে হ্যাঁ জিনিসটোর ডিম্যান্ড আচে।…ঐ শুনি, তা মেড়ো ফোড়ে ব্যাটারা আর আমাদের দেয় কোথায়?”
“তা বাঙালি ফোড়ের সঙ্গে ব্যবস্থা কর না কেন?”
একটা ঘরোয়া গাল দিয়ে বললে— “ও…রা আরও বেইমান। নিজের জাত কিনা।…মাচিস্ আচে?”
ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী একত্র করে বাঁ হাতের মুঠোর ওপর ঘষলে।
বললাম— “নেই, রাখি না।”
একটা বিড়ি দাঁতে চেপে ধরেছে, সেইভাবেই মুখটা ঘুরিয়ে চারিদিকে চাইলে,—কাকে ধরে? দুপুরের গাড়ির যাত্রীও কম, এখনও জোটেও নি সব। উঠে গেল।
কি রকম মনে হচ্ছে তোমার? রুচিতে আঘাত দিচ্ছি, না? কিন্তু আমার যে চমৎকার লাগছিল। তুমি ঐটুকুতেই ঘাবড়াচ্ছ?…আমি অরুচির ব্যাপারটুকু আরও রুচিকর করে নেবার চেষ্টা করলাম এর পাশে গতকাল আর পরশুকে এনে ফেলে, অর্থাৎ by contrast আজকের এই রুচিহীন দুপুরটিকে আরও ফুটিয়ে তুলে।…পরশু আমি আমার আপিসে, এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে আমার ম্যানেজারীর আসনে বসে আছি। দৈনিক ইংরেজি কাগজের ম্যানেজারী। কদিনের জন্যে কলকাতায় যাব, সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে, ডিউটি সম্বন্ধে তাগিদ করে দিতে হবে। অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার বসে আছে টেবিলের পাশে, বাকি সব ডিপার্টমেন্টের ইন্চার্জরা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় সবাই; রিভলভিং চেয়ারে নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে তাদের সঙ্গে কথা কইছি। পরিধানে স্যুট, নেকটাই, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, কথার ফাঁকে অ্যাশ-ট্রেতে ছাই ঝাড়ছি মাঝে মাঝে।
কাল ছিলাম ‘প্রবাসী’ অফিসে, ব্রজেনবাবু, শৈলেনবাবু, আরও সবাই; কবি অপূর্ববাবু এলেন। জমাট আড্ডা–সাহিত্য, রাজনীতি, খোস গল্পও—যার যে রকম পুঁজি বা যখন যেদিক ঢল নামছে। ব্রজেনবাবু রাঁচির অভিজ্ঞতা শুনিয়ে চলেছেন—কলকাতা থেকে আগত ‘ড্যম-চি’ বাবুদের কথা; সস্তা বাজার দেখে দরদস্তুর না করে যা দেখছে তাই কিনে যাচ্ছে বাবুরা, যা বলছে সেই দরে।… “ডিম? ডজন কতয়?”… “দু’আনা!”
“ওঃ, ড্যাম্ চীপ! দে তিন ডজন। তোর কপি?…তিন পয়সা? ড্যাম চীপ!” ভ্যাবাচাকা মেরে গেছে, ডিমের মতন তো ডজন-ডজন নেওয়া চলবে না!
স্থানীয় খদ্দের থৈ পায় না; দর গেছে অসম্ভব চড়ে, একটু নামাবার চেষ্টা করলে শোনে— “যা কেনে, তুদের সাদ্যি নয়, ড্যামচি বাবুরা লিবে।”
—জমাট গল্পের মধ্যে মাঝে মাঝে হাসির হররা উঠছে।”
আজ এই মাঝেরহাট স্টেশনে। খনখনে রোদ চারিদিকে ঠিকরে পড়ছে। ওপরে টিনের ছাত, সামনে প্যাসেঞ্জার গাড়িখানা নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সময় হলে এইটেই আমাদের নিয়ে যাবে। শকটশিল্পের মূর্তিমান প্রত্নতত্ত্ব। তা হোক, লাগছে ভালো। এই দুপুরে আজ আমায় বর্তমান থেকে বহু দূরে নিয়ে গেছে, সে-দূরের বাসিন্দা হল বদনেরা। সে এক চিরঅতীতের দেশ, মানুষ সেখানে কোন এক যুগে খানিকটা এগিয়ে সেই যে এক সময় থেমে গেছে, আজ পর্যন্ত থেমেই আছে। বদন যে এ- যুগের অতি-আধুনিক ডিজেল-ইঞ্জিন-চালিত আট চাকার বগি গাড়িতে চড়ে আসন্ন স্বাধীনতার আলোচনা করতে করতে তার সেই স্বপ্নের দেশ থেকে যাওয়া আসা করে না, পরন্তু এই চাকার বাক্সগুলিই তার বাহন—এই ব্যাপারটা আজকের এই দুপুরটির সঙ্গে যেন বড় মানানসই
স্টেশন প্রাঙ্গণের ওদিকেই বি এন আর-এর (এখন ই আর) বড় লাইন; ফিক্ড়ি বের করতে করতে চলে গেছে ক্যানিং ডায়মন্ডহারবার বজবজ। ওদের মাঝেরহাটে খালের পুলটার ওদিকেই। একখানি গাড়ি বালিগঞ্জের দিক থেকে বিপুল গতিতে এসে বেরিয়ে গেল—তর্জনগর্জন, গতি, অঙ্গক্ষেপ সব তাতেই যেন বিদ্রূপ ঠাসা ফলতা লাইনের বেচারী এই প্রত্নতত্ত্বটিকে নিয়ে।…আগেই বলেছি, গতি-শ্রুতি-দৃষ্টির মতো মনটাকেও একেবারে মুক্তি দিয়ে বেরুই, সে বয়সের মতো যত ইচ্ছে যা খুশি ভাবি, সেই জন্যে শৈশবের একটি অবুঝ আক্রোশ এসে গেছে মনে বড় গাড়ির এই অহংকেরে ঠাট্টায়। মনে মনে বললাম— “ঢের দেখেছি, বাপের ব্যাটা হোস তো আমাদের ওদিককার তুফানমেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি।”
অর্থাৎ শৈশব হলে যা মুখ ফুটে বলতাম—হাঁক পেড়ে—সেটা যেন একলা পেয়ে কি করে আপনি এসে মনের দুয়ারে ধাক্কা দিলে।
কেমন যেন সব জড়িয়ে যাচ্ছে, না—প্রেসের ম্যানেজার, সাহিত্যিক, বদনের বন্ধু; চুরুট নেভিকাটের সঙ্গে বিড়ি, প্রৌঢ়ের সঙ্গে শিশু, নিশ্চল অতীতের সঙ্গে শ্রান্তিহীন বর্তমান। কি করব, এই জট-পাকানো আবর্তই আমার আনন্দ; এই নেশাতেই কাশ্মীর হল না, রামেশ্বরম্ হল না, আরও কত কী যেন হল না, তার কি হিসেব রেখেছি?
বদন ধরানো বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে নিজের জায়গায় এসে বসল, এবার দুটো পা-ই তুলে। গড়গড়ায় তাকিয়ার মতো বিড়ির পক্ষে এইটেই বোধহয় রাজাসন, তোয়াজ জমে ভালো। একটু কি যেন ভাবলে, তারপর ফতুয়ার পকেটে হাতটা সাদ করিয়ে কতকটা কুণ্ঠিতভাবে একটা বিড়ি বের করে বললে—’ইচ্ছে করেন?”
চকিতে ম্যানেজারের গদি-আঁটা রিভলভিং চেয়ারটা মনে পড়ে গেল একবার; কিন্তু নিতান্ত ক্ষণিকের জন্য, কাটিয়ে উঠে বললাম, “করি বৈকি, দাও, ভালো জিনিস?”
কিছু না বলে জ্বলন্ত বিড়িটা বাড়িয়ে দিলে, ভাবটা, আমার মুখ থেকেই উত্তরটা বেরুক না। ধরিয়ে নিয়ে দুটো টান দিয়ে তার প্রত্যাশী দৃষ্টির দিকে চেয়ে বললাম— “নিন্দের নয় তো, বাঃ।”
কেমন একটা সাধ হচ্ছে জানাই, এ-ব্যাপারে আমি নিতান্ত আনাড়ী নই; অর্থাৎ মিশে যাওয়ার আর কিছু ব্যবধান রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে না; বললাম— “কি মার্কা?—মোহিনী, না মোহন, না দরবারী, না রাজারাম?”
বদন একটু গোড়া থেকেই আরম্ভ করলে; প্রশ্ন করলে— “আপনারা?”
উত্তর করলাম— “ ব্ৰাহ্মণ।”
“পাতঃ পেন্নাম হই। এই এক বিঞ্চিতে বসে আচি, ইদিকে হাতে আগুন, মিথ্যে কইলে রনন্ত নরক—মদ নেই, তাড়ি নেই, গ্যাজা-চণ্ডু কিছু নেই, নেশার মধ্যে এই এক বিড়ি আর তামুক, তাও সে কদিচ-কখনও (একটু বাদ-সাদ দিলাম, বদন কামিনী-কাঞ্চনের নেশার কথাটাও তার নগ্ন মেঠো ভাষায় জুড়ে দিয়েছিল); তা এতে কেফায়েৎ করিনে মশাই। কি হবে ক’ন মহাপ্পেরাণীকে কষ্ট দিয়ে? সঙ্গে করে কিছু বেঁধে নিয়ে যেতে পারব?”
বিড়িটা নিভে গিয়েছিল, হাত বাড়ালো। আমি নিজেরটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম— “কে আর কবে পেরেচে?”
বিড়িটা ধরে এসেছে, কিন্তু হঠাৎ কি মনে হওয়ায় তাচ্ছিল্যভাবে বদন সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে—বোধ হয় কেফায়েৎ না করার একটা সদ্য উদাহরণ হিসেবে। পকেট থেকে নতুন একটা বের করে ধরিয়ে আমারটা ফেরৎ দিয়ে গোটাকতক টান দিলে। তারপর বললে—মার্কাও খেয়েছি এককালে, খাই নি বললে খেলাপ বলা হবে, তবে এ-জিনিস খেয়ে মার্কায় এখন আর মন ওঠে না, তা আপনার গিয়ে যত বড় বড় নামকরা মার্কাই হক। এ আমার যা দেখছেন, একেবারে ইসপিসেল; আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“স্প্যাসালটা বুঝলাম না তো।”
“বড়জাউলি ঢুকতে প্রেথমেই আপনার পড়বে চণ্ডীতলার হাট—সোম, বেস্পতি আর শনি। সোম বাদ দিয়ে, বেস্পতি বাদ দিয়ে শনিবারের যে হাট, তাইতে দেখবেন একধারে একখানি চট বিছিয়ে বুড়ো রমজান মিয়া বসে আচে। সামনে, বেশি নয়, মেরে কেটে এই পঁচিশ-তিরিশ বাণ্ডিল বিড়ি, পুরো এক হপ্তায় বুড়ো যা বাঁধতে পারে, নিজের হাতে। হাটে নিন না কত রকমের মার্কাওয়ালা বিড়ি নেবেন, উদিকে হাওয়াগাড়ি আচে, রামরাম আচে—সিগ্রেট, কিন্তু…”
পাশে খট্ করে আওয়াজ হল, টিকিটবাবু জানালা খুলেছেন। টিকিট নেবার পর বদনকে আর দেখতে পেলাম না; খুঁজলামও না, আমার এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় এও একটা বিশেষত্ব রেখেছি। এক এক সময় যখন ইচ্ছে হয়, ছবি কিম্বা কাহিনী একেবারে যতটুকু চোখে পড়ল বা কানে গেল, সেইটুকুই করি গ্রহণ; একেবারেই যখন মুক্ত রাখছি মনটাকে তখন সম্পূর্ণতার পেছনেও ছুটি না, সেও তো বাঁধন একটা। আর ওটা একটা আমাদের মনের রোগও—এই ‘শেষকালে কি হল’ খুঁজে বেড়ানো, একটা পূর্ণচ্ছেদ না বসিয়ে নিস্তার না পাওয়া। সৃষ্টিতে তো ওটা নিয়ম করে নেই, না সময়ের দিক দিয়ে, না স্থানের দিক দিয়ে; খণ্ডের মালা অখণ্ড স্থান আর কালের সূত্রে গেঁথে চলেছে—সেই খানিকটা সৌন্দর্যই তো মনকে রাখে মাতিয়ে। চলতি গাড়ি থেকে দেখা ছবির মতো ছবি আমি জন্মে দেখলাম না। এই অসমাপিকার সুরেই মনটাকে বেঁধে রাখতে চাই—শেষ খুঁজতে গিয়ে একটা নিয়ে পড়ে থাকতে গেলে একমেবাদ্বিতীয়মের মরুভূমিতেই যে দিন কেটে যাবে।
কিন্তু আবার বলি, এও তো একটা নিয়মই; শেষ খুঁজব না বলেই বা অশেষের পায়ে দস্তখৎ লিখে দিই কেন?…তাই এমনও হয়,—পূর্ণতাকে না পাওয়ার যে অশান্তি, তাকে তৃপ্ত করবার জন্যে হয়ে উঠি ব্যস্ত এক-এক সময়, সেটুকু যার অভিজ্ঞতার আড়ালে পড়ে, মনের রং দিয়ে সেটা পূর্ণ করে নিই।
কথাটা হচ্ছে জীবনে সবচেয়ে বড় মুক্তি খেয়ালের দাসত্ব করা, কেননা, খেয়ালের চেয়ে মুক্ত আর কিছুই নেই যে চরাচরে।
গাড়ি ছাড়ল। বিক্রম আছে, ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্পীড। অবশ্য স্পীডের একটা ফুটনোট আছে—গাড়ি যে সাঁ-সাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে তা নয়, শুধু ইঞ্জিনের প্রচণ্ড গর্জন আর গাড়ির উৎকট ঝাঁকানি; আড়ম্বর দেখলে মনে হয় এখন পঁচিশ-ত্রিশ মাইলের জন্যে হাত-পা গুটিয়ে বসা চলে।
একটা মোড়, তারপর গোটা দুই তিন ছোটখাটো বাঁক, তারপরই ঘোলসাহাপুর এসে পড়ল, আধ মাইলের কয়েক গজ বেশি। ইঞ্জিন হাঁপাচ্ছে, গাড়ির ক্যাচক্যাচানি থামতে চায় না।
দেখছি এইটেই এ লাইনের জামালপুর; একাধারে হাওড়া-জামালপুর বললেই ঠিক হয়। গোটা তিনেক বাড়তি ইঞ্জিন, একটা উঁচু জলের ট্যাঙ্ক, একটা ওয়ার্কশপ। একটা ইঞ্জিনের চিকিৎসাও চলছে দেখলাম—অস্ত্রোপচার;—টেন্ডার আলাদা, বয়লার আলাদা, চাকা আলাদা। জনচারেক লোক হাতুড়ি-সাঁড়াশি নিয়ে খুব ঠোকাঠুকি করছে, নীল নেকার-ব্রোকার পরা ওরই মধ্যে ভারিক্কে গোছের একজন দেখলাম আমাদের গাড়ি পৌঁছুবার সঙ্গে সঙ্গে একটা খোলা চাকার ওপর একটা পা তুলে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতে আরম্ভ করলে। মাঝে মাঝে ওদের কি নির্দেশ দিচ্ছে, মাঝে মাঝে আমাদের গাড়িটার দিকে চাইছে। সাধারণের মধ্যে নিজেকে বিশিষ্ট করে তোলবার আর্টটা দেখছি চমৎকার আয়ত্ত করা আছে লোকটার, মনে হতেই হবে, নেহাৎ লোকো সুপারিন্টেন্ডেন্ট না হোক, ফোরম্যান তো না হয়ে যায় না। অথচ বোধ হয় না। অথচ বোধ হয় আমাদের স্কুলের জোখন মড়রও হতে পারে।
জোখন ছিল আমাদের স্কুলের পিয়ন। কিন্তু এমন ঠাটবাট করে থাকত সে, ছেলেদের কাছে একটা রোয়াব তো ছিলই, বাইরের লোকেরাও অনেক সময় মাস্টার বলে ভুল করে বসত। চেহারাটা নিন্দের ছিল না; স্কুলের আবহাওয়ায় থেকে গোটাকতক ইংরিজীর বুকনিও আয়ত্ত ছিল, তার ওপর হেড মাস্টারের পুরানো কোট, থার্ড মাস্টারের কামিজ, ড্রিলটিচারের হাফপ্যান্ট, কারুর বা জুতো — এইরকম গোছের দু-তিন সেট সংগ্রহ করা ছিল, স্কুলের পালপার্বণে কোনটা—–বা তেমন তেমন বুঝলে পুরো একটা সেটই পরে আসত। একবার ইনস্পেক্টারকে শেকহ্যান্ড করে নামিয়ে নিয়ে এল।…আসতে দেরি হচ্ছে দেখে হেড মাস্টার ক্লাসগুলো ঠিক গোছগাছ আছে কিনা একবার দেখে আসতে গিয়েছিলেন, জোখন মড়র ফটকের কাছে অপেক্ষা করছিল। ঠিক এই অবসরে ইনস্পেক্টারের মোটর এসে হাজির। হাতটা অবশ্য জোখন আগে বাড়ায় নি, তবে ইনস্পেক্টার বাড়ালে বেশ সহজভাবেই, বোধহয় একটা ইংরিজী বুকনি দিয়েই তাঁকে অভ্যর্থনা করে নিয়েছিল…রহস্য ভেদ হলে ইনস্পেক্টার জোখনকে ডিসমিস করবার হুকুম দেন; হাতে ধরে নিয়ে এসেছিল, পায়ে ধরে সেযাত্রা রক্ষা পায়।
ঘোলসাহাপুর বেহালার স্টেশন। দুদিকে ঘর, মাঝখানটায় খোলা একটা বারান্দা, টি স্টল আছে, আরও দু-তিনটা দোকান আছে, প্যাসেঞ্জারের আমদানিও মন্দ নয়, কয়েকখানা গাড়ি-রিক্সাও থাকে বাইরে। এক কথায় বেহালা যে পরিমাণে কলকাতা, ফলতা লাইন যে পরিমাণে ই আই আর, ঘোলসাহাপুরও সেই পরিমাণে হাওড়া; বেহালা এখানে দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে নিচ্ছে।
.
সানুষ্ঠানে গাড়ি ছাড়ল; ঘণ্টি, হুইসিল, গার্ডের বাঁশি, গলা বাড়িয়ে ড্রাইভার-গার্ডে মুখ দেখাদেখি। স্টেশন না ছাড়তে ছাড়তে সেই স্পীড, অঙ্গক্ষেপ, ফলতা মেল তাঁর পঁচিশ মাইল রানের যাত্রা শুরু করলেন।…ভুল বুঝো না, ঘণ্টায় পঁচিশ মাইল নয়, মাঝেরহাট থেকে ফলতা— এই সমস্ত পঁচিশ মাইলের দৌড়টুকু কিঞ্চিদধিক দু-ঘণ্টায়।
হাত তিন-চার পরেই দু-ধারে তারের বেড়া, তারপরেই ঘনবসতি – গ্রাম বা শহর যা-ই বলে বেহালা এখানে নিজের পরিচয় দেয়।
একটি ডোবা, ওদিকে দুটি বাড়ির দুটি ঘাট খিড়কি থেকে এসেছে নেমে, আম-জাম- নারকেলের ঘন ছায়া বেয়ে। একটি ঘাটে জন পাঁচেক মেয়ে—সব বয়সের, বাসন মাজার দোলার মধ্যে থেমে গিয়ে গল্প হচ্ছে। গাড়ি এসে পড়তে একজন হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে মাথার কাপড়টা টেনে দিলে, একজন একটি কিশোরী বধূকে বললে টেনে নিতে। বধূটি নিজের ঘোমটা কিন্তু টানলে না, হয়তো বধূ নয়, ঝিউড়ি মেয়ে, গাড়ির কু-দৃষ্টিকে আমল দেয় না। অন্য ঘাটের মাথায় একটি ছোট মেয়ে, কোমরে ডুরে শাড়ি, আসন-পিঁড়ি হয়ে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে একটা বেড়াল ছানাকে আদর করছে। মা (বোধ হয় মা-ই হবে) বাসনের গোছা নিয়ে উঠতে, নিজেও বেড়াল ঘাড়ে করে উঠল।…বাড়ির গায়ে বাড়ি—ছোট, বড়, মাঝারি; গাড়ির বেগে একটি আর একটিকে আড়াল করে ঘুরে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ঐ ছোট ছোট ছবিগুলোও। গাছে গাছে ছয়লাপ, মাঝেরহাট স্টেশনের সে রোদ সবুজের স্পর্শে যেন জাত হারিয়ে ফেলেছে—তাপসের তেজ যেন বনবালিকার হাতে গেছে নষ্ট হয়ে। সময় নিয়ে একটু সন্দেহ হতে হাত উল্টে দেখি, তিনটে দশ।… পাশের লোকটি বড়ই উৎপেতে দেখছি; অপরাধের মধ্যে লড়াইয়ের পরিণাম সম্বন্ধে দু-একটা আলগা মন্তব্য করছিলাম, সেই থেকে ও আমায় একজন প্রচ্ছন্ন চার্চিল বা স্টেলিন ঠাউরে প্রশ্নে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।…”তাহলে আপনার মতে শেষ পর্যন্ত মিত্র-শক্তিকেই নাকে খৎ দিতে হবে?”
বানিয়ে বলছি না, “নাকে খৎটা ওরই ভাষা, আমি নাকে খৎ দিলে যদি থামে তো না হয় তাই দিই। সবুজের স্রোতে ছবির পর ছবি যাচ্ছে ভেসে, দৃষ্টি অপলক রেখেও দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায়, এর ওপর কানের কাছে এই উপদ্রব। বললাম— “তাই তো মনে হয়।”
—বেশ যে সন্তুষ্ট হয়ে বলছি না, গা-ঝাড়া দেবারই ইচ্ছে, এটা নুকুবার কোন চেষ্টাই করলাম না।
“কেন, এই তো রাশিয়া প্রায় বাপের নাম ভুলিয়ে দিলে, মিত্রশক্তিই তো?”
বেশ ইডিয়াম দিয়ে কথা বলতে পারে, তাইতে আরও যেন গায়ে বিষ ছড়িয়ে দেয়।
বললাম— “একটু ভেবে দেখলে নিজেই বুঝতে পারবেন।”
না ভেবেই বললে— “কৈ, ভেবে তো কুল পাচ্ছি না মশাই।”
“রাশিয়া নিজের শক্তির কথা টের পেলে আর এদের সঙ্গে থাকবে মিত্রটা? ভেবে দেখুন না।”
চুপ করলে।
বড়শে-বেহালার খিড়কি দিয়ে চলেছে গাড়ি।
পাকা আমটির মতো এক বুড়ো, ঘরের দরজা খুলে সামনের রকটিতে মাদুর পাতলে একটা, ওপরে জামরুল গাছ, থোবা থোবা মুক্ত ফলে রয়েছে। বৃদ্ধের সঙ্গে ফ্রক পরা ফুটফুটে মেয়ে একটি, নিশ্চয় নাতনী; পুকুরের ওপারে তবু মনে হয় হাতে ওটা দাবার ছকই।…নিদ্রাপর্ব শেষ হোল, এবার ব্যসনপর্ব, সাথীরা জুটবে। মুখের পানে একবার চোখ তুলে চেয়ে নিয়ে নাতনী যেমন ঘটা করে ছক পেতে বসল, মনে হয় খেলা ততক্ষণ ওর সঙ্গেই চলবে।…হাঁসের সার পুকুরের ধার বেয়ে উঠচে। ওপরের গুটিকতক হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল; একটা রোমন্থনরত গোরু তার পিঠে একটা কাক—এই সামান্য একটা দৃশ্যের মধ্যে হাঁসের দল ‘কাকতালীয়’ গোছের কোন ন্যায়-সুত্রের খুট ধরতে পেরেছে নাকি?…এই জাতটার ওপর কেমন একটা শ্ৰদ্ধা আছে আমার—স্কুল বয়সে পঞ্চতন্ত্রে ‘হংসৈর্যথা ক্ষীরমি বায়ুমধ্যাৎ’ পড়া ইস্তক। ওরা যে জলের মধ্যে থেকে ক্রমাগত পাঁকই বেছে নিচ্ছে এতে আমার শ্রদ্ধা এতটুকুও পঙ্কিল হয়নি। তারপর মনুষ্যত্বের উৎকর্ষেরও একদিকের সার্টিফিকেটে ওদেরই ছাপ,— পরমহংস; শৌর্যের দিকটা যেমন সিংহ অধিকার করে বসেছে। এটা আমার চিরদিনই একটা রহস্য বলে মনে হয়েছে—ওরা যেমন জলের মধ্যে থেকে দুধ বেছে নেয় বলে, তেমনি সমস্ত পাখির মধ্যে থেকে ওদের বেছে নিয়ে কে এই মহা গৌরবের আসনে বসিয়েছে? আর কেনই বা? দিনকতক একটা সমাধান করে নিশ্চিন্ত ছিলাম যে এই সাধুবাদ বোধ হয় ওরা নির্বিচারে ডিম দিয়ে যায় ব’লে—নিঃস্বার্থভাবে বুকে চেপে তা দিয়ে রাঁধবার উপযোগী ক’রে। একেবারে ছেলেবেলাকার সমাধান, যে-বয়সে মনকে যাহোক একটা উত্তর দিতে না পারলে ঘুম হোত না। এ সমাধান অবশ্য বেশিদিন টেকল না, তারপর এখন পর্যন্ত কিছু পাইও নি।
শুধু তো এক রকম নয়, মরাল-গমন ওদের নিয়েই; একেবারে এরা না হোক, এদেরই জাতভাই তো? তারপর সোনার ডিম প্রসব করতেও ওরাই; মানুষ যেন ওদের পেয়ে বসেছে।
আর কিরকম মানুষের মতো দেখেছ? একটা কিছু হোক, কাছে পিঠে যদি গোটাকতক হাঁস থাকে, কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে এসে দাঁড়াবেই। আর একটু পাশ পাশ থেকে দেখো, ঠোঁটে একটা মুরুব্বিয়ানার হাসি লেগেই আছে অষ্টপ্রহর।
এইখানেই শেষ নয়। ত্রিলোকজয়ী,—জল স্থল আর আকাশকে এমন ক’রে কে দখল করে বসতে পেরেছে?
জাতটার থৈ পেলাম না।
সবুজের নিজের এলাকায় এসে পড়েছি। বাড়িঘর গেছে কমে, গাছপালার নিবিড়তা সেই পরিমাণে গেছে বেড়ে, এক এক জায়গায় এত লাইন-ঘেঁষা যে ডালপালাগুলো ছপ ছপ করে গাড়ির গায়ে এসে পড়ছে, ফলতা মেলের মানসম্ভ্রম আর থাকতে দিলে না এই অর্বাচীনের দল। আমরা সবুজের মধ্যে একেবারে গেছি ডুবে, গাছপালা ভেদ করে রোদের যে একটা আভা প্রবেশ করছে গাড়ির মধ্যে, সেটাও খুব হাল্কা সবুজে রঙের; অনুভব করছি সেটা মনের মধ্যেও করছে প্রবেশ, সমস্তটুকুর সঙ্গে তপ্ত বনভূমির একটা মিশ্র গন্ধ মিশে গিয়ে যেন একটা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে।
হ্যাঁ, নেশা জিনিসটাও সবুজই, স্বীকার কর তো? সত্যই সবুজের এলাকায় আমরা।
“আসুন, সিগারেট খান তো?”
সেই ভদ্রলোক; বেঞ্চির পিঠে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, আবার উঠে পড়েছে। এসব লোকের মরণ হয় না, তবু যদি একটানা খানিকক্ষণ ঘুমোয় তাহলেও লোকে বাঁচে, তাও নয়। বললাম— “আজ্ঞে না, অব্যেস নেই।”
ও মাঝেরহাট স্টেশনে আমায় যদি বদনের হাত থেকে বেড়ি নিয়ে ফুঁকতেও দেখে থাকে তো এই উত্তরই দিতাম। লোকটা এত বোঝে, শুধু এইটুকু কেন বুঝছে না যে আমি বিরক্ত হচ্ছি?
“আমেরিকার মিলিটারি সিগারেট, এ মাল বাজারে পাবেন না; এক বেটার সঙ্গে ভাব হয়েছে, মাঝে মাঝে দেয়, মিলিটারি সাপ্লাইয়ে কাজ করছি কিনা।”
এতগুলো কথার উত্তরে শুধু বললাম— “ও!”
“চলবে একটা?”
দুধার একটু ফাঁকা হয়ে গিয়ে দৃশ্যপট গেছে বদলে, এতটুকু যদি হারাই তো মনে হচ্ছে আপসোসের সীমা থাকবে না।
উত্তর করলাম— “বললাম তো অব্যেস নেই; অব্যেস না থাকলে, মোটরমার্কাই বা কি, আমেরিকান মিলিটারিই বা কি। বলুন না?”
—দেখি, বাড়িয়ে বললেও যদি নিষ্কৃতি দেয়, কিন্তু কার ব’য়ে গেছে?
“শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে জগন্নাথকে তো আর দিয়ে আসেন নি।…অব্যেস নাই-বা রইল।” নিজের রসিকতায় হেসে উঠল, আমি একেবারেই যোগ না দিয়ে বললাম— “ও পার্টই নেই।”
“তাহলে থাক। আমেরিকান বলেই যে সদ্য সদ্য হাতেখড়ি করতে হবে….আর, একটা বদ্- অব্যেসও মশাই, নিজের বদ্অব্যেস বলেই যে রেখেঢেকে বলতে হবে এমন তো নয়।… তবে ঐ একটি, তাও শুধু সিগারেট, তার ওপরে নয়।”
একটা আধ-শুকনো বেলগাছকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কি একটা চেনা-চেনা লতা হলদে ফুলে বোঝাই করে উঠেছে। হরগৌরী। কিন্তু একটু দুচোখ ভরে’ দেখতে দেবে তবে তো…
উত্তর করলাম— “নেশা বাদে অন্য বদঅব্যেসও তো থাকতে পারে মানুষের।”
“আমার কথা বলছেন?”
একটু সামলে নিতে হোল, তবুও হাতে রাখলাম খানিকটা। বললাম— “না, বিশেষ করে, আপনার কথাই নয়, সাধারণভাবে মানুষের দুর্বলতার কথা বলছি, নিজেদের দোষ আমরা তো দেখতে পাই না সব সময়, খুঁজে-পেতে দেখবার চেষ্টাও করি না।”
খোলা কেসের মধ্যে থেকে একটি সিগারেট বের করে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে ডালাটা কয়েকবার খুট খুট করে বন্ধ করলে, কয়েকবার খুললে; আমার কথাটা ভাবছে। একটু পরে সেটা পকেটে রেখে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ ক’রে এমন নির্লিপ্তভাবে টানতে লাগল, মনে হোল নিরাশ হয়ে ওদিকটা ছেড়েই দিয়েছে। থাকে চুপ ক’রে, ভালোই, নয়তো যেমন মাথামোটা দেখছি, এবার মুখ খুললে সোজা ধমক দিয়েই চুপ করাতে হবে বোধ হয়।
‘সখের বাজার’ খানিকক্ষণ আগে ছাড়িয়ে এসেছি, গাড়ি এসে দাঁড়াল ‘ঠাকুরপুকুর’ স্টেশনে। সেই এক ছাঁদ; একদিকে ছোট একটি বুকিং আফিস, বাকিটা খালি, ওপরে টিনের চাল, তার মধ্যে দিয়েই বাইরে যাবার ব্যবস্থা। কাছে-পিঠে আর বাড়ি নেই, তাতে এইটুকুই যেন বেশি করে নজরে পড়ে।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটি রাস্তা, তার দুদিকে নারকেল আর সুপারির সারি, মাঝামাঝি একটা পুল। গাছগুলোর বেশি বয়স নয়, সবে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। এই আগাছার জঙ্গলের মাঝখানে এইটুকু যেন অদ্ভুত একটা কৌতুক জাগায় মনে। স্টেশনে আসবার জন্যে এমন একটি বীথিপথ রচনা করেছে, কে সে শৌখিন মানুষ? এক সময় ছিল অবশ্য এইরকম প্রাচুর্যের অতি শৌখিনী খেয়াল; প্রাচুর্য মানে প্রাণের প্রাচুর্য; খরচ করবার লোকে পথ পেত না, তাই পথেঘাটেই খরচ করে হালকা হ’ত। কিন্তু সে কি এই বিশ-পঁচিশ বছর আগেকার কথা? — নারকেল-সুপুরি গাছগুলোর বয়স দেখে বরং একটু বাড়িয়েই বলছি। কিন্তু মন যখন রোমান্স রচনা করবেই, তখন অত করে ইতিহাসের তারিখ ঘেঁটে বের করতে চায় না। রেলগাড়ি তখন স্বপ্নেরও অতীত। রাস্তাটা বেঁকে যেখানে ঘন গাছপালার মধ্যে গেছে মিলিয়ে সেইখানে—সেই সুদূর অতীতেই একটি সৌধ রচনা করলাম—ঠাকুরপুকুরের ডাকসাইটে ঠাকুরদের জমিদার বাড়ি। কে তারা জানি না, ছিল কি না কখনও তাও জানি না—তবে রাজধানীর পাশে তাদের এই নিজের রাজধানীতে তাদের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ আর তাদেরই সাতমহল বাড়ির সিংদরজা থেকে এই পথ বেরিয়ে এদিক দিয়ে কোথায় গিয়েছিল চলে—হয়তো রুদ্রদেব ঠাকুরের (ধরে নিচ্ছি নামটা) প্রমোদভবনে।…কিংবা রূপসায়রের ধারে বাণলিঙ্গ শিবের মন্দিরে (এ দুটোও ধরে নেওয়া নাম) যাওয়ার পথ—পুরাঙ্গনাদের জন্যে— সিংদরজা থেকে মোটেই বেরোয়নি—একেবারেই উল্টো দিকে অন্দরমহলের একটি সঙ্কীর্ণ দ্বার থেকে এসেছে চলে—ষোল বেয়ারার পাল্কি এসে লাগত, প্রতিদিনই বা ক্বচিৎ কখনও কোনও পর্বদিনে — আগে-পিছে পাইক-বরকন্দাজ—রাণীমা চলেছেন দেবার্চনায়—
সেসব আর কিছুই নেই, কিছুই ঘটে না আর। বনের মাঝখানে অতি যত্ন করে রচিত রাস্তার খানিকটা আছে পড়ে—তার একদিকের মহাল আর অন্য দিকের দীঘিদেউল গেছে মুছে—নারকেল- সুপুরির দোলাতে মনে হচ্ছে যেন একটা রোম্যান্সের গোটাকতক পাতা ছেঁড়া বইয়ের মাঝখানে কি করে আছে আটকে—কোন্ অতীত বসন্ত দিনে রচা, আজকের এই নিদাঘ বায়ুতে ফর ফর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
তুমি হাসছ নাকি?
তাহলে কোনও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুরে আমার মতো এখানে এসে দাঁড়িও। চারিদিকের শ্যামলিমার ঠিক ওদিকে যে চোখঝলসানো রূপালী পর্দাটা দুলছে, তার গায়ে এই রকম ছায়াচিত্র উঠবে জেগে—একদিন যা হয়েছিল বা হতে পারত। যা একেবারে প্রত্যক্ষ, নিতান্ত কাছের, নিতান্তই আজকের—এই স্টেশন, যাত্রী, রেল, সব কিছু দুপুরের দাহনে হয়ে গেছে মুর্ছিত; জেগে রয়েছ শুধু দুটিতে—তুমি আর অতীতের এমনি একটি ছবি। কিন্তু অসম্ভব বলে মনে হয় না। দুপুর রাতের গায়ে অশরীরীদের আবির্ভাব যেমন অসম্ভব বলে মনে হয় না। এদিক দিয়ে রাতদুপুরের সঙ্গে দিনদুপুরের একটা আত্মীয়তা আছে চমৎকার, বিশেষ করে খর গ্রীষ্মের দুপুরের সঙ্গে। খানিকটা সময় নিয়ে দিনটা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, নিরালা, মাঝ রাতের মতোই অবয়বহীন, তখন তুমি যাই চাও না কেন, তাই দিয়ে দিব্যি করে তার শূন্যতাটুকু পূর্ণ করে দিতে পার
হয়তো মিছেই বকে গেলাম খানিকটা—এ সমস্তটা নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত; আর সব সময় বাদ দিয়ে বৈশাখের দুপুরে ফলতার গাড়িতে চড়ে বেড়াবার শখ, বদনের অফার করা রমজান মিয়ার ‘ইসপিসেল’ বিড়ির ওপর ভক্তি, আরও যা সব উদ্ভট ব্যাপার, যা হয়তো তোমাদের পরিচিত (? ) এই জীবটিতেই সম্ভব, আর ভগবান যাদের এই ছাঁচে গড়ে ধরাতলে দিয়েছেন নামিয়ে।
ব্যক্তিগত আর একটা কথা তাহলে বলে দিই এইখানে। কলকাতার দক্ষিণের সমস্ত জায়গাটাই আমার চোখে বড় রোমান্টিক বলে মনে হয়। কলকাতার উত্তরে যে-জায়গাটা, সেখানে কোম্পানি আর রাজা মিলে ইংরেজি আমল যেন চেপে বসে আছে—রাজশক্তির প্রত্যক্ষ তদারকের নীচে রোম্যান্স সেখানে বিকশিত হবারই অবকাশ পায়নি—বিশেষ করে গঙ্গার দুধারে—নদীবাহিত বাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে বণিকরাজের দৃষ্টি যেখানে বরাবরই ছিল সজাগ। আমার একটা মত বা ধারণার কথা বলছি, একে তর্কের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে ডিসেকশন করবার দরকার নেই। দোহাই তোমার, আজকের দিনের সবকিছুই তোমার ঐ তর্ক থেকে বাদ দাও—শাস্ত্রের তর্ক, সম্ভাবনার তর্ক, সামঞ্জস্য আর উচিতানুচিতের তর্ক। নিয়ম আর সুসঙ্গতির বাইরে এক ধরণের out-law করে রাখো আমার এই একটি দিনকে।
আমার ধারণা দক্ষিণ যেন এখনও একটা অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ড; অলঙ্কারের সাহায্য নিয়ে একটা গ্রন্থই বলি, যার অর্ধেকটা সুন্দরবনের ঘন মসিলেপে চিরতরেই অবলুপ্ত হয়ে আছে।
মতে না মিললেও দক্ষিণে এসে বেড়িয়ে যেও মাঝে মাঝে।…তবে আর কতদিনই বা? দক্ষিণ হয়ে উঠছে উত্তর—বেহালা গেছে বড়শে গেছে, কলকাতা উপচে ঠাকুরপুকুরকেও করলে বুঝি গ্রাস।
.
“একটা কথা…কিন্তু আপনি আবার কিছু জিজ্ঞেস করলেই যা বিরক্ত হয়ে উঠছেন!”
—সেই ভদ্রলোকটি। বিরক্ত যে হচ্ছি, সেটা টের পেয়েছে এতক্ষণে। ভরসা হোল একটু, বললাম – “বলুন।”
“বলছিলাম, কবি নয়তো?—মানে, বাইরের দিকে যেমন চুপ করে চেয়ে বসেছিলেন…”
ভাবের ঘোরে ধরা পড়ে গিয়ে একটু অপ্রতিভভাবেই হেসে বললাম— “না…এটা কি কবিতা করবার সময়?”
“তাই তো ভাবছিলাম—একটুকরো মেঘও নেই কোনখানে যে…দুটোর মধ্যে একটা তো দরকারই, কি বলেন?”
“দুটো কি?”
“হয় মেঘ, নয় কোকিল—সেই কালিদাসের আমল থেকে যা চলে আসছে… ইস্তক আমাদের রবিঠাকুর পর্যন্ত।”
এর পরে আর কইতে ইচ্ছে করে না, শুধু মূর্খতার বহর দেখে নয়, অসভ্যতার জন্য। কিছু বলতে গেলেই খুব বেশি কড়া হয়ে পড়বে; চুপ করেই রইলাম।
ঠাকুরপুকুর থেকে বেরিয়ে খানিকটা এসে লাইনটা ডাইনে বেঁকেছে। ঝোপঝাড়ও এসেছে কমে। বাঁ দিকের একটা টানা মাঠের মাঝখানে খানিকটা দূরে একটা অদ্ভুত ধরণের বাড়ি; টানা দোতলা, কিন্তু নীচের তলাটা নেই, গোটা কতক খুঁটি ধরে রয়েছে ওপরটাকে। কাঠের বাড়ি বলেই মনে হয়। একেবারে মেঠো জায়গা, বাড়িটাতে লোকজন কেউ নেই, কাছেপিঠে আর কোন বাড়িও নেই; এর আবার কি ইতিহাস, কে জানে। ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলে বোধহয় টের পাওয়া যায় কিছু, এই পথে যাওয়া-আসা আছে, জানতে পারে। কিন্তু প্রবৃত্তি হয় না, নিজে ওপর-পড়া হয়ে যা বলছে, তাই বরদাস্ত করা শক্ত, কিছু জিগ্যেস করতে গেলে তো আরও মাথায় উঠে বসবে। বাঁকের মুখে আড়ালেও পড়ে গেল বাড়িটা…আমার কৌতূহলী কল্পনা ওর শূন্য গহ্বরে কি যেন খোঁজাখুঁজি করছে,—কারা ছিল এমন আজগুবী জায়গায়, আজগুবী বাড়িতে? কি কাজ নিয়ে? গেল কোথায়?
ডাইনে বনের মধ্যে থেকে খানিকটা লাইন বেরিয়ে এসে এই লাইনটাতে মিলেছে। হয়তো আগে এইটেই ছিল রাস্তা, ডায়মন্ডহারবার রোডের ধারে ধারে, এখন যেমন এইখান থেকে হোল আরম্ভ।
হ্যাঁ, এইবার বাঁদিকে একটু ঘুরে গাড়িটা উঠে পড়ল ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর। কিনারায় আমাদের লাইনটা পাতা, ডান দিকেই পিচঢালা সড়ক, এখানটা নাকের সোজা চলে গেছে একেবারে। মাল-বোঝাই গাড়ি, মানুষ-বোঝাই বাস, গলা পিচের ওপর দিয়ে চচ-চর শব্দ করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে—কোন্ মায়ার প্রদীপ জ্বালতেই যেন একটা শতাব্দী ডিঙিয়ে কোথায় পড়লাম এসে—বিংশ শতাব্দীর একেবারে মধ্যাহ্নে— ১৯৪৫—কলকাতার সভ্যতাক্লিষ্ট তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ যায় শোনা এখান থেকে। মাঝখানে ঐটুকু যে কি করে এখনও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সবুজ স্বপ্ন দেখছে, বুঝে উঠতে পারা যায় না—ঐ ঘোলসাহাপুর থেকে ঠাকুরপুকুর, তাও সমস্তটা নয়—ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘আন্দি অকৃত্রিম’ রেলপথ সদর বেহালা আর বড়শে থেকে আত্মগোপন করে যেখান দিয়ে সন্তর্পণে এসেছে বেরিয়ে।
পরিবেশটা গেছে একেবারে বদলে। আগাছার নাম মাত্র আর নেই। রাস্তা, তারপরেই দুদিকে টানা মাঠ, সেটা শেষ হয়েছে গিয়ে একেবারে গ্রামের কোলে। অনেক দূরে দূরে বাড়িঘর ক্বচিৎ পড়ে চোখে; গাছপালার একটা নীল রেখা, নিশ্চল, শুধু নারিকেল গাছের মাথাগুলো একটু একটু দুলছে। রেখাটা যেখানে যেখানে এগিয়ে এসেছে, গাছগুলোও একটু স্পষ্ট, সেখানে দু’একখানা বাড়ি চোখে পড়ে। কৃষকপল্লীর প্রান্ত, গোয়াল গাদা, দু’একখানা গোরুর গাড়ি মাথা নীচু করে আছে দাঁড়িয়ে, ধরিত্রীকে প্রণাম করার ভঙ্গিতে, পাশেই ঘরে উঁচু দাওয়ার ওপর গোয়ালপাতার চাল এসেছে নেমে, কোনটায় আবার রাঙা রাণীগঞ্জের টালি, কালো মেয়েদের মাঝখানে হঠাৎ একটি যেন টুকটুকে।…পুকুরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তার রেখা, নির্জন, যেখানটায় গাছের ছায়া পড়েনি, দুপুরের রোদে চিকচিক করছে।…চক্রবালের নীল রেখাটা আবার দূরে সরে গেল।
ডায়মন্ডহারবার রোডটা আমার বড় প্রিয়; কয়েকবার বলে থাকব তোমায়। ওর আলোচনা উঠলে (আমিই তোলার পথ খুঁজতে থাকি তেমন শ্রোতা পেলে।) আমি একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। পাহাড়ের কথা বাদ দিলে, টানা সমতলভূমির ওপর এমন চমৎকার রাস্তা আমি আর মাত্র একটি দেখেছি—রাজগীরের রাস্তা, যেখান থেকে সেটা বতিয়ারপুর পেরিয়ে ই আই আর-এর লাইন টপকে দক্ষিণমুখো হোল। অবশ্য দুটোর সৌন্দর্য দু’ধরণের—ওটাতে আছে একটা এপিক গ্র্যান্জার (পরিভাষা সমিতি কি বলেন দেখো), আর ডায়মন্ডহারবার রোডে আছে একটা লিরিক বিউটি। এ দুটির আবার নিজের নিজের ঋতু আছে। রাজগীর রোডের খোলতাই হয় ভরা বর্ষায়। দুদিকে দিগন্ত- বিস্তৃত জলরাশি–যতদূর দৃষ্টি যায়, একেবারেই আকাশের কোল পর্যন্ত। পুনপুন্ নদী, পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে, গঙ্গার সঙ্গে মাঝে মাঝে হয়েছে ভেট-মোলাকাৎ, গতির উল্লাস গেছে বেড়ে। টানা হাওয়ায় বড় বড় ঢেউ, ফেনায় চুরমার হয়ে রাস্তার গোড়ায় পড়ছে আছড়ে; রাজগীর রোড নিঃশঙ্কভাবে মাথা তুলে গেছে সোজা এগিয়ে, পাশ দিয়েই এই রকম লাইনের একটি পাড়–বিহার- বতিয়ারপুর লাইট রেলওয়ের, মাঝে মাঝে দীর্ঘ শাঁকো, পুনপুনের সঙ্গে আপোস, রাস্তা না ছেড়ে দিলে সে প্রলয় ঘটাবে, ছোট্ট নদী বলেই তার মর্যাদাবোধ আরও বেশি; আর, তার না গঙ্গার সঙ্গে কুটুম্বিতা!
ডায়মন্ডহারবার রোডের রূপ খোলে শরতে। মাঝখানটিতে পিচের কালো রেখাটুকু, পুরু দূর্বাঘাসের চাপ দু’দিক থেকে ঠেলে এসেছে, এতটুকু খালি জায়গা নজরে পড়ে না। তদারকের কড়া দৃষ্টি সত্ত্বেও মাঝে মাঝে দু’একটা অজানা লতাগুল্ম, (বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় নাম বলতে পারতেন)— কোনটার সবুজ ফুলের গুচ্ছ, ট্যাপারির মতো ঢাকনা-দেওয়া ফল; কোনটায় বা রঙীন ফল। এর পরে রাস্তার গোড়া থেকে গ্রামের সেই নীল রেখা পর্যন্ত ধান, ধান, আর ধান। সমস্তর ওপর শরতের আকাশ ঝলমল করছে। মন্থর, সাদা মেঘের স্তূপ; শুধুই সবুজ, আর নীলের একঘেয়েমিটা নষ্ট করবার জন্যে শিল্পী ঐ সাদার ছোপছাপগুলো মাঝে মাঝে দিয়েছে বসিয়ে। তৃপ্ত পরিপূর্ণতার এমন চোখ জুড়ানো রূপ আমি আর কোথাও দেখিনি।
রাজগীর রোড যেন পৌরুষে সমুজ্জ্বল—সিধা, সমুন্নত, একক, কতকটা রুক্ষই; ডায়মন্ডহারবার রোডের সু-বঙ্কিম ঠাম, অঙ্গে জড়ানো সবুজ শাড়ি, তার সঙ্গে সচল পরিপূর্ণ জীবনের কত দিকই যে রেখেছে জড়িয়ে তার যেন হিসাব হয় না। সে যেন সত্যিই একটি নারী, স্মিতাননা, কল্যাণময়ী। পুরুষের মতো একক নয়, বহুকে আশ্রয় দিয়েই তার পূর্ণতা।
রাজগীর রোড যদি হয় একটি চৌতালের ধ্রুপদ তো ডায়মন্ডহারবার রোডকে বলতে হয় মনোহরসাহী কীর্তন।
‘নীলাঙ্গুরীয় টা পড়েছ? মীরা আর শৈলেন যেদিন সবচেয়ে কাছাকাছি হয়েছিল সেদিন তাদের এনে বসিয়েছিলাম এই ডায়মন্ডহারবার রোডের পাশে খানিকটা সবুজ ঘাসের ওপর—দুটি পরিপূর্ণ চিত্ত আর চারিদিকের এই পরিপূর্ণতা—সময়টা ছিল সন্ধ্যা, সূর্যাস্ত হয়ে গিয়ে চাঁদ আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ওটার সিনেমা-রূপ তুমি দেখোনি নিশ্চয়, তোমার পুণ্যের জোর আছে, বেঁচে গেছ। ওরা সেই মিলনটুকু ঘটিয়েছে একটা ডোবার ধারে, নারকেল-গুঁড়ির ঘাটের রাণার ওপর বসিয়ে। বোধ হয় এই ত্রুটিটুকুর সংশোধন হিসেবেই একেবারে শেষে দুজনের হাতে মালা জড়িয়ে দিয়ে ভেবেছে শেষরক্ষা হোলো। হায় শৈলেন-মীরা, হায় আর্ট, হায় সিনেমা।
ওটা বোধ হয় আমার কুষ্টি-ঠিকুজী-গত ব্যাপার একটা, ভগবান বেছে বেছে একজন বেরসিককে আমার সঙ্গে গেঁথে দেবেনই। ওপরে ঐ উদাহরণ দিলাম একটা। নিমন্ত্রণে গেলে প্রায়ই আমার পাশে এমন একটি লোক আসন নিয়ে বসে, যার ভয়ে পরিবেশকেরা সেদিকটাই মাড়াতে চায় না পারতপক্ষে, মাড়ালেও এমন নিঃসম্বল হয়ে ওঠে যে তাদের কিছু ফরমাস করতে পারা যায় না, করলেও কিছু ফলের আশা থাকে না। সিনেমা থিয়েটারে গেলে যে-লোকটা সবচেয়ে কম বোঝে, সে না জানি কি করে আমার পাশটিতে, পেছনে বা সামনে জায়গা পেয়ে যায়, থাকেও প্রায় সদলবলে। একবার হিন্দি মেঘদূত দেখতে গিয়ে একদল গাড়োয়ালী সেপাইয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম মনে আছে। কখনও ভুলব না। তুমি এটা জান কিনা বলতে পারি না—মৃত্যুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে জীবন কাটাতে হয় বলে একরকম জাতিগতভাবেই সেপাইরা স্বভাবতই বড় স্ফুর্তি প্রবণ হয়ে থাকে— কতকটা সবচেয়ে মারাত্মক জিনিসটা কণ্ঠস্থ করে নিয়ে সদাতুষ্ট নীলকণ্ঠ হয়ে থাকার মতো।… ওদের ধারণা ওরা একটা হাসির ‘খেল্’ দেখতে এসেছে। কি করে হয়েছিল জানি না, তবে আমার ডান পাশে যেটি বসেছিল, আমায় একবার বললে— “বাবুজী, এর যেখানে যেখানে হাসি আমাদের একটু বলে বলে দেবেন কি?”
অদ্ভুত প্রশ্নের একটা উত্তর যোগাতেই দেরি হলো একটু, তারপর বললাম— “সে কি সর্দারজী, এই খেল্টার তো আগাগোড়াই…”
ঠিক এই সময় আরম্ভ হয়ে গেল সিনেমা…এবং তারপরেই আমার শেষ কথাটা একেবারে চাপা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই হাসি। সর্দারজী শুধু একবার হাসির মধ্যে সবাইকে জানিয়ে দিলে এর আগাগোড়াই হাসি, তারপর সেই যে আরম্ভ হোল, শেষ হবার আগে থেমেছিল কিনা, আমার জানা নেই, কেননা আমি নিজেই শেষ পর্যন্ত থাকতে পারিনি।…জিগ্যেস করবে থামিয়ে দিলে না কেন, উঠিয়েই বা দিলে না কেন। ওঠাবার কথাই আসে না। সেটা আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, বিলাতী আর আমেরিকান সেপাইরা দু’একটা সিনেমায় মদ খেয়ে হুজ্জতও করেছে। তবু থামাবার চেষ্টা হয়েছিল। গোড়াতেই যখন ডজন দুয়েক লড়াইয়ে মুক্তকণ্ঠে হাসিটা ওঠে, একটা আপত্তির রবও উঠেছিল— “থামো, থামো। … থামুন!…খামোশ।…বত্তি! বত্তি বার দেও!!” বত্তি কিন্তু যখন বার হোল, ঘর একেবারে ঠাণ্ডা—হাসির উৎসমুখগুলির দিকে চেয়ে কারুর আর হেম্মৎ হোল না যে, দাঁড়িয়ে উঠে মনের ভাবটা ব্যক্ত করে। আমি তিনটা প্রচেষ্টা পর্যন্ত দেখেছিলাম—প্রায় মিনিট পনের। তৃতীয়বারে ম্যানেজার দাঁড়িয়ে দলটির দিকে চেয়ে হাতজোড় করে “খামোশীকে সাথ” দেখবার অনুরোধ করলে।—লোকটা ছিল থলথলে মোটা, নিতান্ত দৈবাৎই, তার ওপর প্রথম শ্রেণীর দূরত্ব থেকে তার হাত-পা নাড়া ছাড়া বিশেষ কিছু বোঝাও যাচ্ছিল না; এটা হাসির ‘খেলের’ একটা নবতর অভিব্যক্তি ভেবে যে প্রচণ্ডতর হাসিটা উঠল, আমি আর আশা না দেখে তার মধ্যেই উঠে আসি।
কুষ্টি-ঠিকুজীর কথা কেন বলছি? একবার নিতান্তই গল্পপ্রসঙ্গে আমার এই সব দুর্ভাগ্যের কথাটা বলি পাঁচ-সাতজন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে। তার মধ্যে ঠিক বান্ধবের স্তরে না পড়লেও একজন আমার শুভানুধ্যায়ী এদেশী পণ্ডিত ছিলেন। তিনিই বলেন—ওটা হয়, আর তার খণ্ডনও আছে শাস্ত্রে—এতখানি ওজনের লোহার বাসন, তিল, রাই-সর্যপ মাষকলাই (সব বিশেষ বিশেষ ওজনে প্রভৃতি দান করতে হয় অমাবস্যায়, মন্ত্রানুষ্ঠানও আছে। কতকটা ভূত ছাড়ানো আর কতকটা রাহুমুক্ত হবার মতো বিধান।
অতটা বিশ্বাস করা শক্ত, নিশ্চয় উচিতও নয় এ-যুগে, তাই কান দিইনি। এবার ভাবছি অমাবস্যার অন্ধকারে, একদিন এ-যুগকে লুকিয়ে ওটা সেরেই নোব।
আবার সেই লোকটি। টের পেয়েছি, ক’বারই সিগারেট টানার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে দেখছে; একটু হেসে বললে— “একটা কিছু আছে, ‘না’ বললে শুনবে কে? একবার নোটবুকটাও বের করতে যাচ্ছিলেন। কবি না তো লেখক তো নিশ্চয়।”
হাসিও পায়। বোধ হয় তাই থেকেই আমার রাগটা পড়ে গিয়ে একটু দুষ্টুমির কথা মনে পড়ে গেল, কতকটা সেই ‘সিংহির মামা ভোম্বলদাস’-এর গল্পের মতো—অনেকগুলো বাঘ মেরেছে আর একটা হলেই পুরো হয়, তারই জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে।
চতুর একটু হাসি নিয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে, আমি হেসেই উত্তর দিলাম—না, এবার আর সত্যিই কোন গেল না। আছে একটু একটু বাতিক; কিন্তু আপনি টের পেলেন কি ক’রে?”
“ঐ যে বললাম, নোট বইটি বের করতে যাচ্ছিলেন, তার ওপর হুমহুমে ভাব…এসব জিনিস নজরকে এড়িয়ে যেতে পারে না মশাই। শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখলেই টের পাওয়া যায়—
—হাসিটা আর একটু স্পষ্ট করলে।
বললাম— “গোঁফ মুড়িয়েও যখন নিষ্কৃতি নেই, তখন মেনে নেওয়াই ভালো। আছে বাতিক একটু, তবে কবিতা নয় মশাই। তিথিটা তৃতীয়া, তাই আকাশের চাঁদটা ঐরকম তেরছা হয়ে উঠেছে; কথাটা সোজা না ব’লে যদি আমায় বলতে হয় আকাশ-সমুদ্রে একটা রূপোর নৌকো ভেসে যাচ্ছে তো তাতে আমি রাজি নই।”
“উচিতও নয় রাজি হওয়া। না এটা সমুদ্র, না ওটা নৌকো। অথচ সেই আমিই আবার ছেলেকে বলছি— ‘সদা সত্য কথা বলিবে।’…নিন, একটা ধরান।”
নিলাম একটা অ্যামেরিকান সিগারেট, যেন এ-সম্বন্ধে আগে কোন কথাই হয়নি। ধরিয়ে বললাম— “আজ্ঞে হ্যাঁ, যে কলম দিয়ে ঐসব মিথ্যের ডাঁই লিখছেন, সেই কলম দিয়েই আবার তার
‘সত্যবাদিতা’র এসেও (Essay) দিচ্ছেন করে (corrcect) ক’রে। সে-ছেলে যুধিষ্ঠির হয়ে দাঁড়াবে এটা তো আশা করতে পারেন না? দেশ উচ্ছন্নও যাচ্ছে।”
“যাবেই, বৃথা চেষ্টা।…কিন্তু একটা কথা রেখে কথা বলব? এসে করেক্ট (Essay correct) করবার কথায় মনে পড়ে গেল—একটি ভালো মাস্টার সন্ধানে আছে?”
আমার সেই ভোম্বলদাসের ফন্দিতে বাধা পড়ে যাচ্ছে, যেন এক কথা থেকে অন্য কথায় গিয়ে পড়ছে লোকটা; তবু প্রশ্ন করলাম— “কোন্ ক্লাসের ছাত্র?”
“নাইথ্ ক্লাসের, আমার ছেলেই। আছে মাস্টার একজন, কিন্তু তাকে আর রাখা চলবে না।”
হাতের সিগারেটটা একবার কষে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললে বাইরে, মাস্টারকে রাখা চলবে না এটা জোরালো করবার জন্যই বোধ হয়, কেননা বেশি পোড়েনি সেটা তখনও।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মুখের পানে চাইলাম।
“আজ্ঞে না, চলবে না রাখা। বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি, কানে গেল ছেলেটাকে শেখাচ্ছে রিউম্যাটিজ্ম (Rheumatism) মানে রোমন্থন। বুঝুন, একটাতে পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা, আর একটাতে ক্রমাগতই চোয়াল নাড়ছে!…বেরুচ্ছি, তখন আর কিছু বললাম না, মনে মনে ঠিক করলাম—’দাঁড়াও, এসেই তোমায় বিল্পপত্র শোঁকাচ্ছি, বাড়ি গিয়ে যত খুশি রিউম্যটিজম করোগে বসে বসে।…আর আন্ডার ম্যাট্রিক রাখব না, কান মলেছি। আই-এ হলেই ভালো, অন্তত ম্যাট্রিক; খাওয়া, থাকা, কুড়ি থেকে পঁচিশ টাকা মাইনে। পান তো এই ঠিকানা আমার, পাঠিয়ে দেবেন।”
মিলিটারী কন্ট্যাক্টারের একটা ছাপানো কার্ড বের করে আমার হাতে দিলে।
“হ্যাঁ, কবিতার দিক মাড়ান না বলছিলেন, তাহলে!”
“এই গল্প, উপন্যাস…”
“কিন্তু আবার তো সেই মিথ্যেই এসে পড়ল ঘুরে?”
“ঠিক চাঁদকে নৌকো বলার মতন নয়তো। তারপরেও যে মিথ্যেটুকু ছিল, তাও কেটে এসেছে ক্রমে ক্রমে—আজকাল আবার রিয়েলিজমের (Realism) দিকে ঝোঁক কিনা পাঠকদের, আমাদেরও তাই যোগাতে হচ্ছে।”
“শুনি বটে। আদার ব্যাপারী, বুঝি না অত ব্যাপারখানা কি। Real তো হোল আসল; Ism আজকাল গার্ডের গাড়ির মতন গুড্স্, এক্সপ্রেস, পার্সেল, প্যাসেঞ্জার—সবেতেই দিচ্ছে জুড়ে…”
এবার বেশ আস্তে আস্তে এসে গেছি, আবার নতুন ফিকড়ি না বের করে বসে। বললাম- “ঠিকই ধরেছেন—Real হোল আসল, বাস্তব, Ism-টা হোল যাকে বলে বাদ। বাস্তববাদ, মানে দেখো আর লেখো।”
“বুঝেছি, আর অত মাথা ঘামাবার দরকার রইল না; আসান্ ক’রে এনেছে বলুন না এক কথায়।”
একটু চুপ করে থেকে কুণ্ঠিতভাবে চোখ তুলে হাসলাম— “হয়েছে কি আসান? একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন। এই আমার কথাই ধরুন না—কোথায় ইলেট্রিক পাখার নীচে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকলেই চলে যেত—একরকম বলতে গেলে আকাশ থেকে উপন্যাস দুয়ে নেওয়া—তার জায়গায় দুপুর রোদ্দুরে ছেলেধরার মতন ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে…পকেটে নোট বুক নিয়ে…”
“মানে?”—রহস্যভরে হেসেই জিগ্যেস করলে।
“ঐ Realism. খসড়া একরকম ঠিক; আর সব চরিত্র পেয়ে গেছি, শুধু একটা ধরা দিতে চাইছে না। ঠিক ভিড়ের মধ্যে তখন তো পাবার নয়, তাই এই দুপুর রোদ্দুর মাথায় ক’রে শহরের বাইরে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। নিগ্রহ নয়?”
“একশ’ বার। তা, কিরকম লোক এখন দরকার আপনার? লোক চরিয়ে খাচ্ছি, বোধ হয় দিতেও পারি সন্ধান।”
“এই ধরুন, কাজ থাক আর না থাক, আপনার ঘাড়ে প’ড়ে একথা সেকথা তুলে উদ্ব্যস্ত ক’রে মারবে আপনাকে আর সব-জান্তা…”
—স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে, মুখটা হয়ে গেছে ফ্যাকাশে, একটু হাসবার চেষ্টা করে শুষ্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করলে— “তাই নোট নিয়ে রাখছেন?”
“চেহারা, প্রত্যেকটি কথা, অবশ্য যতদূর সম্ভব। মানে Realistic হওয়া চাই তো। সমালোচকদের তো চেনেন না। আজকালকার পাঠকও তেমনি—খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে—যদি ভূমিকায় জানিয়ে দিতে পারেন অমুক চরিত্রটাকে অমুক ঠিকানায় দেখেছি তো আরও ভালো, একশ’ মার্কস পেয়ে গেলেন।”
“পেয়েছেন দেখা?” মুখটা একেবারেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম উঠেছে জমে। স্টেশন এসে যেতে লোকজনের ওঠা-নামায় যে একটা বিরতি হোল, তাইতে আমাদের আলাপ গেল একটু থেমে। গাড়িটা এখানে একটু থামবে, ওদিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। দেরি হচ্ছে দেখে একটু উঠে গিয়ে, প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে মুখ বাড়িয়ে দেখি, অনেক দূরে ইঞ্জিনের ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছে। সরে এসে নিজের জায়গায় বসতে যাব, দেখি সে-লোকটি নেই।
গাড়িটা আসতে দেরি করছে; হয়তো মালগাড়ি। এসব কথা ভুলে, নিতান্ত গাড়ির গরমের জন্যেই নেমে গিয়ে স্টেশনে চালাটুকুর মধ্যে দাঁড়ালাম একটু। ট্রেনটা এসে যেতে আবার গাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ নজর পড়ল ইঞ্জিনের পরের গাড়িটার মধ্যে একেবারে ও-কোণে একটি লোক তীব্র ঔৎসুক্যে আর আমার পানে একটু ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে আছে। গাড়িতে একটু অন্ধকার ছিল, কিন্তু চিনতে দেরি হোল না। তারপর কখন্ কোন্ স্টেশনে নেমে গেছে খোঁজ রাখিনি।
এক ধরণের আত্ম-আবিষ্কার হোল সেদিন,—আমরাও তাহলে একেবারে নিরস্ত্র নই!
আপদ কেটে গেলে আমার নজর গিয়ে পড়ল স্টেশনের গায়ে স্টেশনের নামটার ওপর— ‘পৈলান’। নজরটা যেন আটকেই পড়ল। অদ্ভুত নামটা, কিন্তু বেশ মিষ্টি, কেমন যেন এদিককার সুরটা লেগে রয়েছে গায়ে। নামের ব্যাপারে দেখেছি, এক এক সময় ব্যাকরণ অভিধান দেখে রাখা হয়েছে, ওত্ত্বায় নি, অথচ অমনি হ্যালাফ্যালা করে রাখা গোটা কতক অক্ষরের নিরর্থক সমন্বয় হঠাৎ কেমন সার্থক হয়ে উঠেছে।…আমি প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেলেছি পৈলানকে। অবশ্য ভালোবাসার মতো তার কোনও অবয়ব নেই। গ্রাম তো নয়ই, ছোট্ট একটি স্টেশন, আর গুনেগেঁথে গুটি পাঁচ-ছয় ছাড়া ছাড়া ঘর, তার পরেই চারিদিকে মাঠ। তা কেউ নামেই মজে, কেউ কুন্তলে, কেউ গঠনে, কেউ নয়নে; আমি মজেছি মানটিতে। আর কিছু না পারি অন্তত একটা গল্পেই, পৈলান নামটাকে আমার লেখার মধ্যে ধরে রাখব। কি করব?—কবিতা তো আসে না, ঐ হবে আমার ভালোবাসার ট্রিবিউট।
ইঞ্জিনের কি একটা দোষ হয়ে আরও একটু দেরি হয়ে গেল; রোদ পড়ে এসেছে একটু। ডায়মন্ডহারবার রোডে ওঠবার পর থেকেই রাস্তার দুধারের দৃশ্যে আরও একটা পরিবর্তন এসে পড়েছে। মাঝে মাঝে বেশ খানিকটা করে জায়গা নিয়ে একটা বাগান, মাঝখানে একটা পুকুর, জায়গা হিসেবে ছোট, বড় বা মাঝারি গোছের, চারিদিকে ছোট ছোট সুপুরি আর নারকেল গাছ; এই সব ফলন আরম্ভ হয়েছে, নতুন বয়স, তার সঙ্গে নতুন মাটির রসটানা, বেশ নধরকান্তি সুপুষ্ট; কলার ঝাড়ও আছে, কিছু কিছু ফুলও। বাগানের মাঝখানে একটা করে বাড়ি, কোঠা বা রাণীগঞ্জ টালির। এক একটি ছবির মতন; মুক্ত, প্রশস্ত জায়গার মধ্যে বলে আরও মানিয়েছে। একখানি ওরই মধ্যে বেশ আভিজাত্যসম্পন্ন, নামে পর্যন্ত একটা রুচি আর আভিজাত্যের ছাপ আছে—’চিরন্তনী’। আগেই এসেছি ছাড়িয়ে।
কিন্তু ভাবছি—কি ‘চিরন্তনী’?—এই অবিরাম চলার পথে মানুষের একটু নীড় বাঁধার ইচ্ছাটুকু? ধরে নেওয়া যাক, তাই; কিন্তু তাও কত মধুর, কত তরুণ,—দুর্বার গতির কাছে দুর্বল স্থিতির এই দুটি ব্যাকুল চোখ তুলে চেয়ে থাকা…
রেল চলেছে ছুটে। রেল নয়তো, যেন রেল-রেল খেলা। সেই জন্যেই লাগছে আরও ভালো—ছোটার সময় বোধ হয় যেন ইচ্ছেমতো নেমে পড়া যায়, এ স্টেশনের ছোট ঘর থেকে ও স্টেশনের ছোট্ট ঘরটি যায় দেখা। ‘ভাসা’ এসে পড়ল, বোধ হয় মাইল দুয়েকও নয়। বেশ মিষ্টি নয় এ নামটাও?
মাঝে মাঝে রাস্তার একেবারে ধারে গ্রামও এসে পড়ছে এক একটা। একটির পাশ দিয়েই চলেছি। রাস্তার পাশেই খাল, তার ওদিকেই। জেলেদের ঘরই বেশি মনে হলো; গায়ে গায়ে বাড়ি, এর উঠানের মাঝখান দিয়ে, ওর ঘরের পেছন দিয়ে রাস্তা; বড় রাস্তার সঙ্গে সংযোগ কোথাও একটা পাকা পুলের ওপর দিয়ে, কোথাও বা শুধু বাঁশ—গোটা দুই বাঁশের ঢ্যারা মাঝখানে, তার ওপর গোটা দুই তিন বাঁশ লম্বালম্বি করে ফেলা, ধরে যাবে তার জন্যে খানিকটা উঁচুতে লম্বালম্বি আর একখানা বাঁশ; আদমের যুগের জিনিস। বেশি নয়, এর মাইল দশ-বারোর মধ্যেই হাওড়ার পুল, আধুনিক পূর্তশিল্পের জয়জয়কার। তা বলে যেন ভেব না বাঁশের ঢ্যাড়াপুলের বংশলোপ চাইছি আমি; আহা, ওরাও থাক, যেমন সবটা কলকাতা না হয়ে গিয়ে ভাসা-পৈলানও থাক বেঁচে। বংশবৃদ্ধিও হোক। আসল কথা, ছোটয়-বড়য় কল্যাণ; শুধু রাঘব-বোয়ালের রাজত্বটা রামরাজত্ব নয়।
সমস্ত গ্রামখানি নিবিড় ছায়ায় ঢাকা। রোদের তাপে যেন ঝিমিয়ে রয়েছে, হদ্দ ঘরের আড়ালে দুটো বলদের অলস রোমন্থন, দুটি নগ্ন শিশুর খেলাঘর পাতা; একটি চাষা বৌয়ের হেঁসেল তুলতে দেরি হয়েছে, বাসনপত্র মেজে এই পাট সারা হোল। বাসনের গোছা হাতে নিয়ে আধ-ঘোমটা টেনে নারকেল-গুঁড়ির পৈঠায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে।….এরা দেখছি এখনও নথ পরে! আমার ভয় ছিল আধুনিকতা বুঝি জিনিসটাকে একেবারেই দেশছাড়া করে দিয়েছে। তবে, আর কতদিনই বা? ওরই পাশ করা ছেলের বৌ বোধহয় শাশুড়ির সেকেলেপনা দেখে ন্যাড়া নাক সিঁটকুবে; একেবারেই ন্যাড়া নাক, আর তো নাকছাবিও তুলে দিলে দেখছি। যাক, After me the Deluge; আমি তো আর দেখতে আসছি না। এর পর এরা আধুনিক বলে নাকটাকেই চেঁচে ফেলে মুখ থেকে তো ফেলুক। কার বয়ে গেছে?
না, নিতান্ত যে ঝিমিয়েই রয়েছে গ্রামটা তাই বা কি করে বলি?—পার্লামেন্ট ইন্সেসন্! অবশ্য তাও শুনেছি ঝিমোবারই ব্যাপার, এ কিন্তু তা নয়। গোটা দুই বড় বড় কি গাছ মিলে ঘন ছায়ার একখানি কম্বল দিয়েছে বিছিয়ে, গ্রাম-পঞ্চায়েতের বৈঠক চলেছে তারই ওপর বসে। হাত নাড়ানাড়ি যেমন প্রায় হাতাহাতিতে দাঁড়াবার গোত্র দেখছি, তাতে মনে হয় আলোচ্য বিষয়টি খুবই গুরুতর। দল থেকে একটু দূরে এখানে ওখানে উপদল, কোথাও দুই, কোথাও তিন, কোথাও হুঁকো আছে কোথাও নেই; লবি টক্ (Lobby talk) বোধ হয়। ওরা মাথা ফাটাফাটি করে মরুক, ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত যা হবার তা হয়ে যাচ্ছে এইখানে গোপন পরামর্শে।
ভাসার পর, ইঞ্জিনটাও চলেছে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আমার আপত্তি নেই, সময় পেয়ে দেখতে পাচ্ছি ওরই মধ্যে একটু গুছিয়ে।
একেবারেই সরে একটা ডোবার ধারে একটি যুবা বসে আছে, সাবান দিয়ে কাচা ফরসা কাপড়, গায়ে একটা নীল কামিজ, পায়ে কালো বার্নিশ জুতো, বোধ হয় সস্তা রবারের, যা বাজারের ফুটপাথে দেখা যায়। বসে আছে মাথা হেঁট করে। মাঝে মাঝে জমায়েটার পানে ঘুরে চাইছে, হেঁট মুখেই
ওর এই একাকীত্ব একটা যেন কাহিনীর আভাস এনে দিয়ে অস্বস্তি জাগিয়েছে মনে। আজকের অধিবেশন যে ওকে নিয়েই, তা বেশ বোঝা যায়, কিন্তু কথাটা কি?…বেশ দেখতে দেখতে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে, মাঝখানে তুমি এসেই যে গোলমাল বাধালে হে লবকান্ত; এই আধা-খ্যাচড়া গল্প নিয়ে আধ-কপালে ধরতে আমার আর কতক্ষণ?
গাড়িট একটু এগুতেই পট পরিবর্তন, একটি যেন রিভলভিং স্টেজই (Revolving stage) গেল ঘুরে। খানকতক বড় বড় ধানের মরাই আর একটা আলোকলতায় বোঝাই কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে সমস্তটা গেল পড়ে—হাতাহাতি, লবি টক, মায় সেই লবকান্তটি পর্যন্ত; প্রায়, শুধু তার জুতোপরা পায়ের খানিকটা খানিকটা যাচ্ছে দেখা। মরাইয়ের এদিকে সম্পূর্ণ অন্য দৃশ্য। দশ-বারোজন মেয়ে, নানা বয়সের, উলঙ্গ শিশু থেকে লোলচর্ম বুড়ি পর্যন্ত, মাঝখানে ষোল-সতের বছরের একটি মেয়ে মাটি কামড়ে পড়ে বুকের কাপড়টা চেপে ধরে মাথা চালছে—না—না—না…কি একটা জিনিস কোনমতেই করতে রাজি নয়।
বোঝাচ্ছে পাঁচ-সাতজন, অবাক্ হয়ে চেয়ে আছে পাঁচ-সাতজন। জন তিনেক একটু আলাদা হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা দোলাচ্ছে, একজনের গালে তর্জনীটা টেপা…খুবই জটিল আর দুর্ভাবনার কথা। “হ্যাঁগো, কালে কালে এ হোল কি …”
আমি কিন্তু বাঁচলাম, আধ-কপালের ভাবটা কেটে গেছে। আমার কাহিনী পুরো হয়ে উঠেছে।
হুড়কো মেয়ে। শ্বশুরবাড়ি থাকতে চায় না।…নানা, কোন মতেই ফিরে যেতে রাজি নয় সে।
আমার কাহিনীর ডায়লগ গড়ে উঠেছে বেশ। ঐ যে বুড়ি, মাথায় শনের নুড়ি, পিঠে হাত বুলুচ্ছে-
“নে দিদি, ওঠ, নিতে যখন এয়েচে, আর কি? মান খুইয়ে মান ভাঙাতে এয়েচে; হোল তো।”
“না, আমি যাবুনি—যাবুনি আমি, ও ড্যাকরা আমায় মেরে…”
“ছেরকালই কি মারবে গা? ছেলেপিলে হবে, ঐ মানুষই আবার সমীহ করতে শিখবে…যা হয়, যা হয়ে আসচে ছেরকালটা…আমরা খাই নি মার? তোর মা মার খায় নি তোর বাপের হাতে?…জিগুগে যা…”
—অন্য একজন বলে।
আর একজন মেয়ে যোগান দেয়— “বিয়ে করা মাগ, অথচ দু’ঘা খেতে হয় নি বরের হাতে এমন অনাছিষ্টি হয় নি পিরথিমিতে এখনও…তুই যেগে, নে ওঠ।”
“আমি যাবুনি, বলুনি আমায়,—আমি মাকে ছেড়ে থাকতে পারবুনি গো পারবুনি।”
“যাবি নি! অমন বর, পড়ে থাকবে? এখন আদিখ্যেতার মাথা-কোটা, তখন মাথাকোটা কাকে বলে দেখবি।”
“এই আমিই চললুম দখল করে নিতে। তুই তবে থাকগে আমার বুড়োকে নিয়ে…গেরাম ও ছাড়তে হবে নি, ঘরও ছাড়তে হবে নি। হুড়কো মেয়ে কি হয় না?―হয়—তা বাপের কালে তোর মতন হুড়কো দেখলুম নি বাছা!…উৎপরিক্ষে।”
সত্যি কি আমার মুখের কথাই বললে নাকি বুড়ি?…যেমন মেয়েটার পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসল।
শেষ যা দেখলাম—অনেক দূর থেকে—মেয়েটি বুকে কাপড় চেপে উঠে পড়েছে। হয়তো ক্লান্তি, একটু দম নিয়ে আবার পড়বে কামড়ে। আমার কাহিনী কিন্তু ঐখানেই শেষ করে দিলাম। যাবে বৈকি, যাবে।…বেশ ছেলেটি, গোলগাল, বউ নিয়ে যেতে ভালো করে চুল ছাঁটিয়ে তেল-চুকচুকে হয়ে এসেছে। আজ বিকেলেই কিম্বা কাল, বউয়ের তাত রোদের তাতের মতো যখন বেশ পড়ে এসেছে—চাকা ডুবতে ডুবতে যাতে বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায় এই রকম আন্দাজ করে বেরুবে দুটিতে।…এই গ্রাম থেকে নেমে ঐ মাঠ, চওড়া। আলের ওপর দিয়ে রাস্তা, কোনরকমে দুজনে যাওয়া যায় পাশাপাশি। চলেছে দুটিতে, ছেলেটা আগে, বউ পেছনে… ছেলেটা হন হন করে চলেছে বলে মেয়েটা পড়েছে পেছিয়ে…কি মতলবখানা—আবার পালাবে নাকি?…দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা।…বার দুয়েক এরকম হবার পর দুজনে পাশাপাশি হয়ে গেল। তখন অনেকটা দূর। দূর বলেই তো হয়েছে পাশাপাশি, মেয়েটা একবার ঘুরে দেখলে এত তাড়াতাড়ি যে ভাব হয়ে গেল এরা কেউ দেখছে নাকি?
আমার গল্পটি ফুরাল।
রেলে আর রাস্তায় হাত ধরাধরি করে চলেছে। অদ্ভুত লাগছে। রেল জিনিসটা বরাবরই আভিজাত্য-গর্বিত। খানিকটা উঁচু, অনেকটা আলাদা, খানাখন্দর, আগাছার জঙ্গল, তারের বেড়া এই সব দিয়ে আর সব কিছু থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য বাঁচিয়ে চলে নিঃসঙ্গ, নিরালা; নিষ্ঠুরও; ওর সঙ্গে মিতালি করতে গেলে কখন কী যে ঘটাবে কেউ বলতে পারে না। রাস্তা যদি কোন একটা এসেই পড়ল পাশে তো, একটি স-সম্ভ্রম দূরত্ব রক্ষা করে সেলাম ঠুকতে ঠুকতে চলে, একটা গুমটির মুখে যদি নেহাৎ গা-ঠেকাঠেকি হয়ে গেল একবার, তো তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে আবার নিজের সাবেক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়।… প্রচণ্ড বেগে মেল যাচ্ছে বেরিয়ে, ধূলি-ঝঞ্ঝার ভর্ৎসনা তুলে, দুদিকে লোহার গেট চেপে মূক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে যত সব পথচারী—বাস, লরি, মোটর সাইকেল, গোরুর গাড়ি; পদচারী ও ছাগলের পাল, রাখালের দল।
এখানে সেই সড়ক যেন শোধ নিচ্ছে। এক এক করে গোটা তিন লরি পেছন থেকে এসে আমাদের ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল, হাত-চারেকের তফাৎ রেখেই—গরম পিচের সঙ্গে নরম চাকার সংঘর্ষে একটা কর্কশ ব্যঙ্গের মতো শব্দ উঠেছে। একটায় ইঁটের গাদা, তার ওপর জনতিনেক কুলি বসে কানে হাত দিয়ে গান ধরেছে (ওরা এ অবস্থাতেও পারে), সুদূরস্থিতা কোনও ‘দুলারিয়া’র উদ্দেশে, যে সঙ্কোচবশেই দয়িতের সঙ্গে পা ফেলে চলে আসতে পারলে না বলে ঘরের কোণেই রইল পড়ে।…কার কবেকার দুলারিয়া জানি না, তবে আপাতত গানটা যে আমাদের ফলতা মেলকেই উদ্দেশ করে তাতে ওরা সন্দেহের কোন অবকাশই রাখে না।…অনেকখানি বেরিয়ে গেল ওরা, ইঞ্জিনের কাছে গিয়ে খানিকটা ঝুঁকে গানটাকে আরও জোর করে দিয়ে তিনটে হাত দিলে বাড়িয়ে “দুলারিয়া গে!—দুলারিয়া! — দুলারিয়া — দুলারিয়া!!…”
বোধ হয় আবক্ষ শ্মশ্রু ড্রাইভার রহমৎ শেখই। পোড়া কপাল বেচারীর!
দুটো বাসও গেল বেরিয়ে। একটা সাইকেলও চেষ্টা করলে; অবশ্য এতটা কি হয়? এখনও চন্দ্ৰসূর্য আকাশে উঠছে।…কিন্তু আমি বলছি ওর অশ্রদ্ধার বহরটার কথা। একটা বিচালির গাড়ির গাড়োয়ান পর্যন্ত বলদের লেজ মলে কি মন্ত্র ঝেড়ে দিলে…অ্যাং যায়, ব্যাঙা যায়, খলসে পুঁটিরও কি একটু সাধ হতে নেই?
ফলতা মেল যাই মনে করে করুক, আমার কিন্তু লাগছে বড় ভালো—দুটি দ্রুত স্রোতে জীবনের ওই গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বয়ে যাওয়া—পরস্পরকে সঙ্গ-দান করে, তা যতই হোক না কেন হাসি বিদ্রূপ, জয়-পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে।
এক নম্বর হল্ট। স্টেশন ঘর বলে কিছু নেই; পাশে হাট বসেছে, তারই খাতিরে গাড়িটা একটু বেশি করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিজের খেয়াল নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাটের কেনাবেচা দেখছি, হঠাৎ একটা সোরগোলে সচকিত হয়ে উঠলাম।
আমার পাশেই যে কামরাটা, দুখান্না বেঞ্চি নিয়ে, তাইতে একটি ছোট পরিবার উঠেছে; কর্তা একজন প্রৌঢ়, বৃদ্ধ বললেও ভুল হয় না। রোগাই, একটু কুঁজো, মাথার চুলগুলি পেকে এসেছে, গায়ের রংটা বেশ মাজা, একটু লালচে।
আরও লালচে হয়ে উঠেছে রেগে টং রয়েছেন বলে। সঙ্গে যে একটি মহিলা রয়েছেন, তাকে স্ত্রী বলেই মনে হোল, তবে যেন দ্বিতীয়পক্ষের; আধা-ঘোমটা দেওয়া পাড়াগেঁয়ে গিন্নিবান্নি গোছের মানুষটি; মুখটি ভার-ভার; রা নেই তাতে। একটি তের-চৌদ্দ বছরের মেয়ে, আর একটি বছর দশেকের ছেলে। দুটিই ফুটফুটে, বিশেষ এ সব পাড়াগাঁ অঞ্চলে অমন একটি চোখে না পড়বারই কথা।
কর্তা যে একটা বকুনি মুখে করে উঠেছেন তারই জের টেনে বলছেন— “আমি বলিনি তখুনি যে খরচ করে, মেহনৎ করে যাওয়াই সার হচ্ছে, ঠিক এখেনে এসে আটকাবে; ফলল কি ফলল না? সে বনহাটির বাচস্পতিদের বংশ, আজ ইংরিজী ঢুকেছে বলে শাস্ত্র জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার মেয়ের চেহারা দেখেই সে হামড়ে পড়বে এ তো হয় না। অপদস্তই হোতে হোল তো? আর সেটা হোল তোমার কথা শুনে ছুটে গেলাম বলেই তো?…স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী, সে কি আর সাধ করে বলেছে? বলেছে অনেক দেখেশুনে, অনেক ভেবেচিন্তে, এই রকম অনেক ঘা খেয়ে।”
গৃহিণী নিরুত্তর, যেন এ ধরণের ব্যাপার সয়ে সয়ে ঘাটা পড়ে গেছে। চেহারার কথায় মেয়েটির চোখ দুটি অবাধ্যভাবেই কয়েকটি মুখের ওপর গিয়ে পড়ল, রেঙে উঠল বেচারী। কর্তা বলেই চলেছেন— “বিয়ে আর হোতে হবে না, থুবড়ি হয়েই থাকবে, এই লিখে রাখো, বলে দিচ্ছি। আর যা-তা একটা ঠিকুজী গড়ে আমি তঞ্চকতা করতে যাব, এই যদি তোমার বিশ্বাস থাকে মনে তো তোমার বিশ্বাস নিয়ে তুমি থাকো। আমার ঠিক লগ্নটি চাই—একেবারে ঘণ্টা মিনিট পল অনুপল বিপল ধরে—মনে করে দিতে পার, সঙ্গে সঙ্গে তোয়ের করে দিচ্ছি ঠিকুজী, না পার, থাক্, রইল তোমার মেয়ে। একটু সময়ের এদিক ওদিক হোলে কী আকাশ পাতাল তফাৎ হয়ে যায় জানো? শেষকালে ভুল ঠিকুজী খাড়া করে একটা অঘটন ঘটাই আর কি!
“কেউ সাধছে?”
—এতক্ষণ পরে এইটুকু মন্তব্য। কর্তা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
“সাধছে না কেউ! কেন সাধতে যাবে? গরজটা আর কারুর নয়তো, তাই এই ঘাড়ে ক’রে ক’রে টাঙিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি—কে দয়া করে নেবে গো আমার মেয়ে, কে দয়া করে নেবে? গরজ যদি থাকত কারুর তো একটা হিসেব রাখত! এ রকম বেহিসেবীপনা করে আবার মুখনাড়া দিতে তোমরা মেয়েরাই পার! কই, আমি যার যার বেলায় ছিলাম, এ রকমটি হয় নি তো।..’কেউ সাধছে’?—আটকাল না মুখে কথাটা! কেউ সাধে নি, কিন্তু ভোগান্তিটাও কেউ যে কমাবে সে মুরোদ নেই তো!”…
অনেকটা বুঝতে পারছি, এ ধরণের পারিবারিক আলোচনার মধ্যে বসে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠছে উত্তরোত্তর, কিন্তু উপায় নেই বলেই সয়েও আসছে দেখছি। তবু এরই মধ্যে আরও একটু নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে ভালো করে ঘুরে হাটে মনোনিবেশ করতে যাব আবার, এমন সময় একটা সুরাহা হোল।
আগেকার মতোই আচম্বিতে আমাদের গাড়িরই পেছন থেকে একটা বাজখেয়ে গলা উঠল— “রাঙা দিদি যে গো!…শুননু ভেয়ের বাড়ি গেছলে, বাচপোতদের ঘরে মেয়ে দেখাতে, তা হোল পছন্দ তেনাদের?”
ঘুরে দেখি গাড়ির একেবারে শেষ কামরায় কখন জনপাঁচেক নিম্নশ্রেণীর স্ত্রীলোক উঠে পড়েছে। যার গলা, তার চেহারা দেখেও সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেরানো গেল না। যেমন লম্বা তেমনি আড়ে, তবে ঢিলেঢালা নয়, বেশ আঁটোসাঁটো; মাথায় কদমছাঁট কাঁচাপাকা চুল; তুলসী কাঠির দু’ছড়া কণ্ঠিমালা গলায় এঁটে বসে রয়েছে, এদিকে প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে ওদিকেও আরম্ভ করে দিয়েছে একদফা দুটি যে পুরুষযাত্রী বসে রয়েছে তাদের সঙ্গে— “তোমাদের এবার উদিকপানে গিয়ে বসলেই হয় না, হ্যাঁগা? …..কাকে যেন বলচি।..
উত্তর হোল— “কেন, দোষটা কি হয়েচে? জায়গা তো কম নেই।”
ছোট ছোট পুঁটুলিগুলো ঠিক করে রাখছিল, দুটো কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল— “অ!…রস! তাই তো গা, পাঁচটি মেয়েলোক একত্তর হয়েচে, একটু লবনারী হয়ে মাঝখানটিতে বসব না?—তাতে দোষটা হয়েচে কি এমন! না, না, উঠতে হবে না, ঐ রকম লটবর হয়ে থাকো বসে— দু’লয়ান ভরে দেখি একটু…ওকি, পোঁটলা নিয়ে উঠলে যে, ও শ্যামরায় ….
ততক্ষণে দুজনে বেঞ্চি টপকে এদিকে এসে মুখ ঘুরিয়ে বসেছে।
গিন্নি বললেন— “পালবউ যাচ্ছে, আমি যাই ওদিকে গিয়ে বসিগে, অ তুই যাবি তো আয়।”
মেয়েটি তো নিষ্কৃতি পায় তাহলে। দুজনে নেমে আবার ও-কামরায় বসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছেড়ে দিলে। ছেলেটি রইল বাপের সঙ্গে।
কর্তা একটু কলহপ্রিয়, অন্তত বকারোগ আছেই, একলা পড়ে গিয়ে একটু যেন অস্বস্তির মধ্যে চুপ করে রইলেন, তারপর ঘুরে গলা তুলে বললেন— “পালবউ যে! চলেছ কমনে সবাইকে নিয়ে?…কি যেন মেয়ে দেখাতে নিয়ে যাবার কথা জিগ্যেস করছিলে। তা গিয়ে বসেছে তো ঘেঁষে, দেখো না কি উত্তরটা পাও।”
পালবউ গিন্নির মুখের পানে চাইতে তিনি মাথাটা নেড়ে অস্ফুট কণ্ঠেই জানালেন—হোল না।
কর্তা এদিক থেকে বললেন— “ঐ নাও, শুনলে তো?—এক কাঁড়ি টাকা রাহা খরচ, সব মেহনৎ—জলে। এখন একবার জিগ্যেস করো না। হোল নাটা কিসের জন্যে। ওঁর মুখেই শোন, আমি বললেই তো গায়ে বিষ ছড়াবে, মুখ বুজেই থাকতে চাই।”
ওদিকে নিম্ন কণ্ঠে কি একটু কথা হোল, গাড়ি ফুল স্পীডে, ঝরঝরানির মধ্যে শুনতে পাওয়া গেল না। তারপর পালবউ সবাইকে ডিঙিয়ে সেই সাবেক গলায় প্রশ্ন করলে— “বলি হ্যাঁ চাটুজ্যেমশাই, একি শুনি আজগুবী কথা, নাকি মেয়ে খুব চোখে নেগেছিল, সুদু ঠিকুজীর জন্যে সব ভেস্তে গেল!”
“কথাটা আজগুবী?”—কর্তার গলা গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে পৌঁছুল ওদিকে।
“নেও! তাহলে আর আজগুবী কাকে বলে?…বলি লোকে যে সংসার-ধম্মো করবে, তা ঠিকুজীর সঙ্গে না মানুষটোর সঙ্গে?…এই যে সোনার চাঁদের মতন মেয়ে, এই কার্তিকের মতন ছেলে—বলি, এসব তোমার ঠিকুজী দিয়েচে, না এই লক্ষ্মী-প্রিতিমে?”
আমি বেশ ভালো করে ঘুরে বসলাম, পালবউয়ের কথার একটাও বাদ গেলে আফসোসের অন্ত থাকবে না। তর্কটা নবদ্বীপের ন্যায়ের টোলে নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আপাতত চুপ করিয়ে দিয়েছে কর্তাকে। অবশ্য যেমন দেখছি, কথাবার্তায় কিছু পর্দা থাকবে না। তা না থাক,
যেখানকার যা রীত, আমিই বা কেন কানে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকি? আর অতিপর্দাটা কি একটা রোগ নয়?—অতি-সভ্যতার একটা ন্যাকামি নয়?
থাবা খেয়ে কর্তা একটু অপ্রতিভও হয়ে পড়েছেন, আমার দিকে চেয়ে নিম্নকণ্ঠে বললেন- ‘মেয়েছেলের সঙ্গে তর্ক…নিন, কি করে বুঝবেন, বোঝান।”
অবশ্য চুপ করেই রইলেন না, উত্তরটাতে একটু দেরি হোল, এই যা—
“তা বলে ঠিকুজী চাইবে না? এ যে নতুন ধরণের কথা বলছ তুমি। আবার অতবড় পণ্ডিতের বংশ।”
“তা ভালোই তো, পণ্ডিতের বংশ তো গড়ে নিক ঠিকুজী। কলুর বাড়িতেও তেল পেড়ে দিয়ে এসতে হবে?”
গিন্নির ঠোঁট দুটি ব্যঙ্গের হাসিতে কুঁচকে উঠেছে, লজ্জার মধ্যে মেয়েটিও ফিক্ করে হেসে মুখটা ফিরিয়ে নিলে।
কর্তা আমায় সাক্ষী মানলেন— “দেখলেন তো?”
দুবার সাক্ষী মানলে একটা লোক, কতকটা সে জন্যেই আবার কতকটা তর্কটুকু চালু রাখবার জন্যেও, আমি মুখটা আড়াল করে নিয়ে চাপা গলায় বললাম— “তেল পেড়ে না হয় নিলে, কিন্তু সরষে যুগিয়ে দিতে হবে তো? সেইখানেই যে হয়েছ গলদ, জিগ্যেস করো না। সন্তান যে জন্মাল একটা তিথিক্ষণের হিসেব রাখবে তবে তো?”
গিন্নি পালবউকে নিম্নকণ্ঠে কি বললেন, পালবউ বললে— “কেন তার হিসেব তো রয়েছে, রাঙা দিদি বললে ঐ।”
“শুধু সন আর তারিখ—তাতে ঠিকুজী হয়? একে ঘড়ি ধরে কটার সময় হোল–কত মিনিট, কত সেকেন্ড তা না ধরে দিলে ঠিকুজী করা চলে?—এক পল কি অনুপলের এদিক ওদিক হোলে যে অসমান জমির তফাৎ হয়ে যাবে গণনায়। ফিস ফিস করে তো পাশে বসে যোগান দিচ্ছে, জিগ্যেস করো, তো, তার একটা হিসেব রেখেছে?”
পালবউ হাঁ করে শুনছিল, যেন অমন উদ্ভট কথা সে বাপের জন্মে শোনে নি; শেষ হোলে গালে আঙুলের চারটে ডগা চেপে বললে— “হ্যাঁগা, চাটুজ্যে মশাই, আপনি বলতে পারলে কথাটা?লোকে বলে গৰ্ভযন্ত্রণা, একটা পুনজ্জন্ম, জগৎ তার কাছে তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, কোন রকম খালাস হলে বাঁচে, আর সে কিনা চৌধুরীদের নতুন বউয়ের মতন কব্জিতে ঘড়ি বেঁধে হিসেব করবে কটা বেজে ক’ মিনিট হোল…আবার বলচ কত পল, কত হ্যাঁকো কত ট্যাকো…”
কানে তোমার নিশ্চয় লাগছে একটু। আমার কিন্তু একেবারেই লাগে নি। সমস্তই তো আপেক্ষিক, ষোল আনাই নির্ভর করে কি পরিবেশের মধ্যে কথাটা পড়ল বা ঘটনাটা ঘটল। তুমি চিঠিটা পড়ছ হয়তো তোমার বৈঠকখানায় বসে সভ্যতা আর সুরুচির নিদর্শন মেঝে থেকে নিয়ে ছাত পর্যন্ত, দেওয়ালে একটা বিলিতী নগ্ন চিত্র থাকলেও তা আর্টের রক্ষাকবচে আঁটা। এ হেন জায়গায় বসে নীরবে পড়ে গেলেও তোমার কানে লাগবে। অথচ শুনেও আমার কানে এতটুকু লাগে নি শোনাও কেমন, না, একেবারে সাক্ষাৎ, শোনা কথা, শোনা নয়; একেবারে শ্রীমুখ থেকে নির্গত; ‘হিজ্ মাস্টার ভয়েস্’ নয় যে একটা আড়াল আছে, স্বয়ং হিজ্ মাস্টার। শুধু কি তাই? যাকে উপলক্ষ্য করে বলা সেও হাত কয়েকের মধ্যে, খান কয়েক খর্ব বেঞ্চে এতটুকুও আড়াল সৃষ্টি করতে পারে নি। ঐ একটি মানুষই মুখটা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছিল—যদিও ওকালতিটা লেগেছিল নিশ্চয় খুবই মিষ্টি— বাকি সবাই নির্বিকার—যেন এতবড় সোজা আর ঘরোয়া কথা আর হয় না, পালবউ যা বললে, তা যেন একটা নিত্য দিনের সমস্যার চরম মীমাংসা।…এ বেদ-সূক্তের ছন্দ বদলানো চলবে না, আর শুদ্ধ সংস্কৃত নয় বলে যদি এর ভাষা সংস্কার করতে যাও, তো সমস্ত জিনিসটুকুর মর্যাদাই করা হবে নষ্ট।
গাড়ি এসে উদয়রামপুরে দাঁড়াল।
এইখানেই একটা কথা বলে রাখি। ‘পৈলান’ নিয়ে সেই গল্পটার কথা। সেটা আর একটু এগুল; তার নায়িকা পেয়ে গেছি, ঐ পালবউ।
উদয়রামপুরকে ফলতা লাইনের এলাহাবাদ বলতে পার; এ পর্যন্ত যতগুলো জায়গা পার হওয়া গেল, তার মধ্যে সবচেয়ে জমকাল। স্টেশনের ধারেই চমৎকার একটি বাগান, মাঝখানে লম্বালম্বি একটা পুকুর, বাঁধানো ঘাট, একটি বেশ শৌখীন বাড়ি, বড় চমৎকার লাগল। একটা দুঃখের কথা তোমায় বলি—বাঙলা দেশে এলে আমি একটা জিনিসের অভাব বোধ করি বড্ড বেশি করে—ফুলের বাগান। যেখানে জায়গার অভাব, সেখানে দুটো ভালো ফুলের গাছই থাক না হয়, তাই বা কৈ? অথচ গাছ পোতে বাঙালি, বরং বাতিকই আছে গাছ পোতার, কিন্তু শুধু আম-জাম- কাঁঠাল-জামরুল, সুপারি-নারকেল; প্রায় সব বাড়িতে ঢুকেই আলো, রোদ অবাধ হাওয়ার অভাবে আমাদের ওদিককার লোকের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। ফুল কৈ?—ক্বচিৎ এক-আধটা মল্লিকা কি গন্ধরাজ, কাজের গাছের আওতায় যেন কুঁকড়ে-মুকড়ে আছে—অনেক অভিভাবকের বাড়িতে নূতন বধূর শঙ্কিত গীতের মতো; কোথায় একটু নিরিবিলি কোন্ জানলার ধারটিতে বসে গুনগুন করে গাওয়ায় সাধ মেটাচ্ছে।
বলবে—শখ যে করবে, তার জন্যে মানুষ হওয়া চাই তো, আঘাতে-অভাবে যে, সে স্তর থেকে নেমেই আসছে বাঙালি।…পুরোপুরি সায় দিতে পারলাম না। শখ আছে বৈকি, তবে ধারা গেছে বদলে—রাস্তায় দুর্ভিক্ষের মড়ার ভিড় ঠেলে যে বাঙালি সিনেমায় ভিড় জমাতে পেরেছে, তার শখ নেই বললে তার প্রতি অবিচার করা হয়। একটা মিটিং হোলে আর্টের ঘটায় আসল জিনিস চাপা পড়বার উপক্রম হয়। আর্ট অর্থে অবশ্য আধুনিক সঙ্গীত আর ডাগর মেয়েদের ওরিয়েন্টাল ডান্স; বরং বললে দোষ হবে না, এই আর্টের জন্যেই মিটিং অনেক ক্ষেত্রে, সাহিত্য সংস্কৃতি একটা উপলক্ষ্য।…এতেও কেমন করে বলি শখ নেই? আসলে ঐ যা বললাম—ধারা গেছে বদলে। এত জায়গায় যাই, কোথাও একটু ফুলের বাহুল্য দেখলাম না, ফুলের উচ্ছ্বসিত আলোচনা একটু কানে গেল না। অথচ আমি আশা করেছিলাম, জাতিগত হিসাবেই আমাদের স্থানটা এ বিষয়ে ভারতবর্ষে সবার ওপরেই হবে। ফুল আমাদের শখ না, প্রয়োজন। ভাগ্যিস গোটা কতক ঠাকুর এখনও ভয় দেখিয়ে, চোখ রাঙিয়ে বেঁচে আছে, ভাগ্যিস বিয়ে ফুলশয্যাটা হচ্ছে এখনও, ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, ভাগ্যিস বছরে দু’একটা সভাপতি কি প্রধান অতিথি হবার নিমন্ত্রণ জোটে কপালে, তাই ফুল দেখতে পাই একটু, নইলে এও বন্ধ হোত। জাতিচরিত্র প্রকাশ পাবে সব জায়গায়ই। আর একটু উঁচুতে উঠে দেখো না,—ইডেন গার্ডেনের মতো একটা সত্যিকারই নন্দনকানন বাঙালির হাতে পড়ে মারা গেল, এ হত্যাকাণ্ড অন্য কোন জাতের দ্বারা সম্ভব হোত? কার্জন পার্কটা দেখেছ?— লালদীঘি?—একটা আটতলা বাড়িই হাঁকড়ে ফেললে। অন্য কোন জাত হোলে নিজের বুক পেতে দিত, লালদীঘির ইজ্জত নষ্ট করতে দিত না এভাবে—এক ছটাক জায়গা দিয়ে নয়। শুধু হেদো- গোলদীঘির তেমন কিছু ইতর-বিশেষ হয় নি, ও দুটো তখনও ছিল বাঙালির, এখনো তো আছেই, শুধু স্বাধীনতার পর এখন বেশি করে আছে বলে বেশি করেই গেছে।
ইঞ্জিনটা বোধ হয় একটু বেশি রকম জখম হয়ে পড়েছে। গাড়ি ছাড়ে না দেখে গলা বাড়িয়ে দেখি ড্রাইভার-খালাসী নেমে যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব ঠোকাঠুকি লাগিয়েছে, গার্ড, স্টেশন মাস্টারও জুটেছে, বেশ একটু মোচ্ছব গোছের ব্যাপার পড়ে গেছে। নামলাম। রোদটা অনেকখানি নরম হয়ে এসেছে, একটা লোভ হচ্ছে; দেখি যদি সম্ভব হয়।
গিয়ে উপস্থিত হলাম।
“কি মশাই, বিলম্ব হবে নাকি?
স্টেশন মাস্টার একবার মুখের পানে চেয়ে দেখলেন, তারপর প্রশ্নটা এগিয়ে দিলেন— “কি ড্রাইভার সায়েব, কি রকম বুঝছেন?”
পূর্ববঙ্গের মুসলমান, বড় বেঞ্চিটা খুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে— “হালার ইবলিস্ সেঁদিয়েচে, হয়রান করবে একটু।”
“কতক্ষণ—বিশ মিনিট—আধ ঘণ্টা?”—আমিই সোজা প্রশ্নটা করলাম।
“বিশ মিনিট কি আধ ঘণ্টা…?”
প্রশ্নটার শুধু পুনরুক্তি করে যেখানটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, সেইখানটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, পকেট থেকে একটা দোআনি বের করলে, খালাসীটার হাতে দিয়ে বললে — “এক বান্ডিল বিড়ি নে আয়। হালার ইবলিস্ সেঁদিয়েচে, হয়রান করবে একটু।”
বোঝা গেল। ইবলিসকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরে দেখা যাক না জায়গাটা, একটু বলেও রাখলাম স্টেশন মাস্টারকে— “কাছেই একটু দরকার আছে, মিনিট দশেকের মধ্যে আসছি।”
বললেন— “কাছেপিঠে হয়তো যান, হুইসিল শুনলেই যাতে পৌঁছে যেতে পারেন।” গার্ডসাহেব একটু বেরিয়ে এসে ঠোঁট কুঁচকে বললেন— “যান আপনি। ইবলিস্ তাড়াবার জন্যে যেরকম ধোঁয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, আমার তো ভয়, খোলসাপুর থেকে অন্য ইঞ্জিন আনতে না হয়।”
জায়গাটি বড় স্নিগ্ধ, ঐ কামারের কারখানার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আমার যেন আরও ভালো লাগছিল। একটু উজিয়ে গেলাম। থানা, পোস্ট অফিস, একটু এগিয়ে এসে সেই বাগানটা; খবর নিয়ে জানলাম, এখানকার যে জমিদার, তাঁর কাছারি বাড়ি। সমস্ত জায়গাটি বড় বড় গাছের ছায়ায় সমাচ্ছন্ন; রোদ আছে, কিন্তু মুক্ত হাওয়াটা বড় মিষ্ট। বাঁ দিকে রাস্তা থেকে একটা মেঠো পথ নেমে গেছে, কতকগুলো গাছপালার মধ্যে, বোধ হয় গ্রামের পূর্বসূচনা। একটি চমৎকার রংকরা দোতলা বাড়িও তার মধ্যে আধ-ঢাকা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এইতেই উদয়রামপুর প্রায় ফুরিয়ে গেল। আরও গোটাকতক ঘর এদিক ওদিকে ছড়ানো, তারপর জমিদারি কাছারির পরে স্টেশনটা। এদিকে গোটাকতক দোকান। ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর যে সব গ্রাম, তাদের দৈর্ঘ্য যদিই-বা একটু আছে, বিস্তার নেই। ডায়মন্ডহারবার রোড যেন এক ধরণের লতা, একটানা চলে গেছে, মাঝে মাঝে শুধু পল্লব-পুষ্প-কিশলয়ে পরিধিটা গেছে বেড়ে।
স্টেশনের কাছাকাছি আসতে ডান দিকের একটা জায়গায় দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। ইঞ্জিনের মেরামত চলছেই তখনও, তবে সবাই ওদিকে; একটা মানুষ যে কাজের নাম করে, বোশেখের রোদে অযথাই টো-টো-কোম্পানির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা লক্ষ্য করবার মতো কেউ এদিকে নেই। এগিয়ে চললাম। দুটো থাম-বসানো একটা গেট, তার ভেতর খুব বিস্তীর্ণ একটা জমির ওপর দুরে দূরে কয়েকটা বাড়ি, একটা পুকুর, টানা মাঠ, তকতকে ঝকঝকে; হঠাৎ এরকম জায়গায় এ ধরণের জিনিস দেখব আশা করি নি। মাঠে গোলপোস্ট দেখে এটা বোঝা গেল যে স্কুল একটা, তবে সাধারণ পাড়াগেঁয়ে স্কুল নয়; সমস্ত ছবিখানির মধ্যে দিয়ে যে সঙ্গতি আর রুচির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হোল কোন মিশন স্কুল, রামকৃষ্ণ মিশনের কথাই আগে উঠল মনে। কিন্তু লোক নেই একেবারেই, কাকে জিগ্যেস করা যায়।
আমার সারথি আবার ওদিকে কখন হুইসিল দিয়ে বসেন। ঘুরে দেখলাম, না, ভিড় জমে রয়েছে, ইবলিস বাগ মানে নি এখনও।
দেখি, ভেতরে গেলে যদি কিছু সন্ধান পাই। গেটের ভেতর প্রথমেই একটা পরিখা গোছের, তার ওপর দিয়ে ছোট একটি পুল, বাঁদিকে একটা আউট্ হাউস্।
কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা; লোক নেই একটাও।
তারপর একটু দূরে ডান দিকে একটা বাড়ির সামনে নজর পড়ল। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে একটা গাছের নিচে কতকগুলি ছোট ছোট মেয়ে, একটু নূতন ধরণের আগন্তুক দেখে তারাও বিস্মিত হয়ে গেছে, বিহ্বল দৃষ্টিতে আমার পানে ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে আছে যেন একপাল হরিণ শিশু। এগিয়ে যেতে শঙ্কিত হয়ে পড়ল, কিন্তু পালাবে, কি দেখবেই দাঁড়িয়ে, সেটা ঠিক করে ফেলবার আগেই আমি গিয়ে পড়লাম।
ফ্রক-পরা, ফিটফাট, সবচেয়ে যেটি বড় সেটির বয়স বোধ হয় বছর নয়েকের বেশি হবে না, সব ছোটটি তার বোনের কোলে, বব-করা চুলে একটা নীল ফিতে বাঁধা, ভাসা-ভাসা শঙ্কিত চোখে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে, নূতন দুটি দাঁত নিচের ঠোঁটের ওপর চিকচিক করছে।
এ অবস্থায় হাতটা আপনি গিয়ে পকেটে সেঁদোয়—দুটো লেবেঞ্চুস কি কিছু।—হায়রে পোড়াকপাল! শখেরবাজারে গোটাকতক পেয়ারাও যদি কিনে রাখি!
শুকনো ভাবই করতে হোল। ব্যাধের ভয়ে সম্মোহিত হয়ে হরিণশিশুর পাল আটকে গেছে, আবার বাজারের দিকে পা বাড়ালে কি ফিরে পাওয়া যাবে?
“তোমরা কি এখানেই থাক?”
আধ মিনিটটাক সেই রকমই কাটল—নতুন মানুষ দেখে ভয়ই বল বা সঙ্কোচই বল। বেশি নয়, আধ মিনিট, তারপর সেটা গেল কেটে। সঙ্গেসঙ্গেই উল্টো স্রোত, প্রথমে একটি মেয়ের মুখে হাসি ফুটল, বড় একটির, তার ছোঁয়াচে দুটির, তারপরে পাঁচ-ছ’টির, তারপরেই সবার মুখ ঘুরিয়ে, এ ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে, সরে গিয়ে, হেলে পড়ে হাসি—শুধুই হাসি, থামতেই চায় না।
গুমটের পর আচমকা হাওয়া উঠে একটা পুষ্পিত করবীর ঝাড়কে যেন দুলিয়ে দিলে।
নির্জন জায়গায় নতুন মানুষকে শিশুরা ভূত বলে ধরে নেয়, তা যদি না হোল তো একেবারেই সং, সত্যিকার, সহজ মানুষে দাঁড়াতে আরও খানিকটা পরিচয়ের দরকার হয়। ওদের মনটা একেবারেই বিরুদ্ধধর্মী, তাকে মাঝামাঝি অবস্থায় এনে ফেলতে সময় লাগে।
একটু অপ্রতিভই করে তুলেছে। প্রশ্নটাই বেখাপ্পা হয়ে গেছে নাকি?—যারা এখানেই রয়েছে তাদের জিগ্যেস করা—’এখানে থাকো?’—কাঁধে গামছা, বুকে তেল ঘষতে ঘষতে পুকুরের দিকে যাচ্ছে দেখেও আমাদের মধ্যে প্রশ্ন করা চলে—’এই যে স্নান করতে নাকি?’—ওদের নতুন কান, ভাষার একটুও অসঙ্গতি ওদের মনে খুব বেশি করে সুড়সুড়ি লাগিয়ে দেয়।
প্রশ্নটা পালটে দিলাম— “এটা ইস্কুল?”
“হ্যাঁ ইস্কুল।” বড় মেয়েটি, আরও দুতিনটি মেয়ে একসঙ্গে উত্তর দিলে। একটু দৃষ্টি বিনিময় ও হোল কয়েকজনে, একটু হাসি উঠল ছলকে।
“কি ইস্কুল?”
চুপচাপ। তবে খুকখুক্ করে এখানে ওখানে হাসিটা আছে ঠিক। এখন আমি হয়ত আর সং নই; কিন্তু না হাসা যে আবার বোকার লক্ষণ, ভেবেছে ওরা কেউ তাই নাকি?
বরং বেশি চালাক, বোকা বানাতে জানে। ঠাট্টা করতে জানে, মেয়ে বলেই সে-শক্তিটা এখন থেকেই ওদের মধ্যে অঙ্কুরিত হচ্ছে। একটি আর একটির ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললে— “কি ইস্কুল আবার? পড়বার স্কুল।”
আবার এক ঝলক হাসি, কিন্তু গিন্নিপনাও হচ্ছে অঙ্কুরিত পাশে পাশেই, বড়টি ভারিক্কে হয়ে উঠল— “অত হাসি কিসের? বাঃ!”
চোখে বেশ শাসন। আমার দিকে চেয়ে বললে— “না গো, আমাদের এটা মিশন ইস্কুল।”
সবার উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে—আর যেন হাসি না ওঠে, ও কি ছ্যাবলামি!
প্রোটেকশন পেয়ে স্বস্তি বোধ হোল। প্রোটেকশনই বৈকি, দিব্যি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল, অত বড় একটা প্রেসের ম্যানেজার, তাকে হাসির পাখনায় উড়িয়েই নিয়ে গিয়েছিল একটু হোলে। আশ্বস্ত হলাম, সেই সঙ্গে সাহস এল ফিরে, নিজের বয়সের গুরুত্বটা অনুভব করলাম, যেমন বলা উচিত, বললাম— “আহা, হাসুক না, হাসবে না? তোমরা সবাই ছেলেমানুষ এখন, খুব হাসবে।”
“আমি তা ব’লে ছেলেমানুষ নয়”—বড়টি আপত্তি জানিয়ে আরও গম্ভীর হয়ে ঠোটদুটো চেপে রইল।
“আমারও জন্মতিথি হয়েছিল কাল—আট বছরের।”
—গম্ভীর; অথচ এইটিই ছিল এতক্ষণ হাসির পাণ্ডা। এইটির কোলেই সেই খুকিটি, তার মাথাটা কাঁধে চেপে মস্ত বড় দিদির মতো ডাইনে বাঁয়ে আস্তে আস্তে দুলতে লাগল। ওপাশ থেকে একজন সাক্ষী দিলে— “হ্যাঁ, কেক হয়েছিল, পুডিং হয়েছিল।”
ভয় গিয়েছিল, চপলতাও গেল; বড়র দল যে! ভেতর থেকে একজন এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, এক লহমার একটু সঙ্কোচ, তারপরেই সোজা মুখটা তুলে বললে— “আল্ আমাল বাবা আমাকে বলে বুলি।”
একটু চুপচাপ, সেও মাত্র এক লহমার। বড় হওয়ায় ওই বুঝি বাজিমাৎ করে নিলে। তারপর সবার বড়টি ঘাড় বেঁকিয়ে একবার করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে নিয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে হেসে উঠল, বললে— “বুড়ি বলে তাই বুড়ি হয়ে গেল। ঠাট্টা বোঝে না।”
কাছে টেনে নিলাম। সাবান দেওয়া নরম চুলে একটি রাঙা ফিতের ফুল, ফুরন্ত তুলতুলে গাল, স্পর্শে আমার সমস্ত দিনটি যেন মোলায়েম করে দিলে—বুকে তুলে নিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বুড়ো মানুষকে হঠাৎ অতটা খেলো করা ঠিক হবে কি?—ওদের মন আবার বড় ঠুনকো বুঝুক না বুঝুক, এই ঠাট্টার টিপ্পনীটাতে গম্ভীর হয়ে গেছে—কে জানে কি ব্যাপার? কোলে নিতে গেলে বোধ হয় উল্টো উৎপত্তি হয়ে পড়বে; ঠোঁট উঠবে থরথরিয়ে কেঁপে, তারপরেই চোখদুটি ভেসে উঠবে জলে। সামলাবার চেষ্টা করেই বললাম— “বাঃ, বুড়ি না? তোমাদের কারুর আট, কারুর নয়, ওর বয়সের তো হিসেবেই নেই, না গা বুড়িমা?”
জোরে মাথা দুলে উঠল, বললে— “হ্যাঁ, তাল বচোল!”
চারিদিকে একেবারে ছলছলিয়ে উঠল হাসি— “চার।…চার!…ওমা চার বছরের বুড়ি…
তাড়াতাড়ি তুলেই নিতে হোল কোলে। কিন্তু না, সুরেই সুর মিশেছে; মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠল— “তাল বচোলের বুলি!”
জাতে উঠে গেলাম। কোলে উঠেও না-কাঁদা মানে আমি আর অপাঙক্তেয় নই, আমার বয়সের জঞ্জাল থেকে “শুদ্ধি” ক’রে আমায় আপন ক’রে নেওয়া হোল। এসব ব্যাপারে সব ছোটই হোল সমাজপতি, তার হাতেই জাতপাতের ফেণি-বাতাসা।
এইবার আনন্দভোজে অবাক মেলামেশা। কিন্তু ফলতা মেল বাধ সাধলে, বাঁশি উঠল বেজে।
পাটা আপনা হতেই এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল, থমকে দাঁড়িয়ে বললাম— “এবার যাই।”
‘তাল বচোলের বুলি’-কেও কোল থেকে নামাতে যাব, সে জড়িয়ে ধরে মুখের পানে চেয়ে বললে— “থাকো।”
রবটা সবাই তুলে নিলে— “থাকুন—থাকুন—না, যেতে পাবেন না, থাকুন।…দোবই না যেতে—কক্ষণই না…
ঘিরে দাঁড়াল। ওদের দখল অপ্রতিদ্বন্দ্ব, তার মাঝখানে কেউ এসে দাঁড়াবে না, কিছু এসে দাঁড়াবে না।…আর একটা ডাক, সঙ্গেই আরও তিনটে। এগিয়েই বললাম— “না, আমায় যেতেই হবে ঐ গাড়িতে, শুনছ না—হুইসিল দিচ্ছে?”
গড়া হ’তে না হতেই ভাঙন, সবার মুখে একটা ছায়া নেমে এসেছে—পরস্পরের পানে চাইছে, এবার সত্যিই বড়র মতো কেউ কিছু একটা বলুক না বা করুক না গা, যাতে লোকটা যায় আটকে।…না হয় থেকেই যাই? বেড়াতেই তো আসা—যেখানে যা পাই দুটি মুঠায় ভরতে ভরতে এগিয়ে যাওয়া, তা এর চেয়ে বড় কিছু পাব কি? এ যেন একটি স্বপ্নলোক, চলার পথের পাশেই একটু আড়াল ক’রে রচা,—হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়ে কি করে এসে গেছি, ঘুম ভাঙার মুখে মনটা যেন টনটন করে উঠছে।
আবার বাঁশি, কর্কশ। চলে গেলেই তো পারে, আমিও মনকে একটা জবাবদিহি দিয়ে নিশ্চিন্ত হই, কী এমন অমূল্য সম্পদ আমি, যে ফেলে যেতে চাইছে না?
শেষকালে একটা রফা হোল, ওরাও গেট পর্যন্ত চলুক সবাই। যেতেই যেতেই পরিচয় পাওয়া গেল আরও খানিকটা। ক্রিশ্চানদের মিশন স্কুল, যা জন্মতিথিতে কেক-পুডিঙের ব্যবস্থায় অনেকটা আন্দাজ করেই নিয়েছিলাম। স্কুলে ছেলে পড়ে সব জাতিরই, ছেলেও আবার মেয়েও। না, মাস্টার মশাইরাও সবাই ক্রিশ্চান নয়—এই তো সন্ধ্যা, ওরা হিন্দু, রমা, ওরা হিন্দু—ওর নাম জবা—ওর নাম মালা,—’ওগো, আমার নাম দলি’, কোলেরটি আমার মুখটা ঘুরিয়ে নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বললে।
স্কুলে এখন গরমের ছুটি। হেডমাস্টার মশাই এখানেই আছেন আর আছে এরা সবাই। সন্ধ্যারা চলে যাবে—ওর মাসি রাঁচিতে খুব বড় লোক—সেইখানে যাবে।
“তাই নাকি?”—ফিরে প্রশ্ন করতে সন্ধ্যা ঠোট দুটি জড়ো করে একটু গম্ভীর হয়ে উঠল, বড়মানুষের বোনঝির যেমনটি হওয়া উচিত। ফ্রকের কোমরের কাছটায় একটু ছেঁড়া, সেইটে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে বললে— “দুখানা মটোর আছে।”
সবার মুখের ওপর থেকে কতকটা সভয় দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে এল,–কোনও হিংসুটি আবার ফ্রকের ছেঁড়ার কথাটা ফাঁস করে দেবে না তো?
গেটের কাছে এসে ফিরে দাঁড়ালাম।
“এবার যাই, কি বল?”
বিহ্বল কতকগুলি চোখ, ঠিক একরকম দৃষ্টি নিয়ে, মুখের পানে চেয়ে রইল। একি টনটনানি মনের মধ্যে! না এলেই যে ভালো ছিল, অথচ কতটুকুই বা ছিলাম? সব মিলিয়ে হদ্দ মিনিট পনের।
পেছনে বিদ্যায়তন, প্রশস্ত খেলার মাঠ, তারপর পুকুর, তাকে ঘিরে বাড়ি, বাগান; পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন, পড়ন্ত রোদে একটু বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। না, আমারই মনের ছায়া পড়ল?
বড়টি বললে— “আবার আসবেন।”
তারপরেই— “আবার আসবেন…আবার আসবেন…আসবেন আবার…নিশ্চয় আসবেন…”
—ভাষা খুঁজে পেয়ে যেন বাঁচল সবাই, আবার হাসিও ফুটল একটু একটু। ছোটটিকে একটি চুমু খেয়ে নামিয়ে দিলাম; কোল হালকা হয়ে কখনও মনটা এত ভারী করে দেয়নি। অর একটি চুমু খেলাম,—বললে— “আবাল আছবেন।”
গলাটা টনটন করছে, কথা কইয়ে জবাব দেবার ভরসা হচ্ছে না, আসতে আসতে একবার যে ফিরে দেখব, তারও নয়।
ইঞ্জিনের সে-দোষটা সেরেছে—ড্রাইভার তাই বললে—ইবলিস এখন বাঁশিটা করেছে আশ্রয়। অতগুলো যে শব্দ ওটা আমার ডাক নয়, “সে হালার পো” কোথায় ঢুকে বসে আছে, তারই অনুসন্ধান চলছিল।
প্রশ্ন করলাম— “দেরি হবে?”
“হালাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিমু।”
গার্ড আর স্টেশন মাস্টার ওদিক থেকে এলেন। স্টেশন মাস্টার বললেন- “ঘোলসাপুরের বলেই দিয়ে এলাম মশাই, পাঠিয়ে দিতে একটা ইঞ্জিন। পুরো এক বান্ডিল বিড়ির ধোঁয়া, তাতেই বড় গেল ওর, ইবলিস তো ফুঁয়ে যাবে।”
জিগ্যেস করলম – “কতটা দেরি হবে মনে করেন?”
“এই কোয়ার্টার তিনেক; এক ঘণ্টার মধ্যেই যাবে ছেড়ে।”
পুরো এক ঘণ্টা সময় নিয়ে উদয়রামপুরে কি করতে পারে লোকে, মাথায় আসছে না; দেড় গজের শহর, সে তো এমুড়ো ওমুড়ো দেখা হয়ে গেল। মিশন স্কুল। না মায়ার কাঠি হাতে ক’রে রয়েছে সবাই, পনের মিনিটেই যা অবস্থায় বিদায় হতে হয়েছে, একঘণ্টা দিতে সাহস হয় না।…. টানছে বৈকি—তবে জীবনে মাঝে মাঝে ‘মোহমুদ্গরটা’ ভেঁজে নেওয়াই নিরাপদ।
‘আমতলার হাট’টা কতদূর হবে এখান থেকে?—যদি এক কাজ করা যায়, হেঁটে চলে গেলাম, তারপর ওখানে গিয়ে আবার ফলতা মেলে। রোদ্দুর এসেছে নরম হয়ে, ডায়মন্ডহারবার রোডকে খানিকটা এইভাবেই পাওয়া যাক না।
বেরিয়ে পড়লাম। মিশন স্কুলের সামনে দিয়েই রাস্তা। না, কেউ নেই। নতুন অভিজ্ঞতাটা বাড়ি বাড়ি পৌঁছুতে গেছে।…”জবা বললে—ভূত। আমি বললাম–কক্ষণও নয়। আর ভূতের কি গা আছে যে, কোলে করবে?—তারা তো শুধু ছায়া, ধোঁয়ার মতন, না গা?”
কিম্বা ছায়ার মতোই মিলিয়ে গেছি মন থেকে। ওদের মন কি ধরে রাখতে জানে?—একটাকে মুছে একটা এসে দাঁড়াচ্ছে, এই করে চলেছে নিত্যনূতনের মিছিল।
মিশন স্কুলের গেট দিয়েই একটা লোক বেরিয়ে এল রাস্তার ওপর। কালো, রোগা, খর্ব; চলছে ডান দিকটা ঝুঁকে, একটু খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে যেন; বাঁ কাঁধে বোষ্টমের ঝুলির মতো একটা ঝুলি; বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে; এর চেয়ে বেশি ঠিক ক’রে বলা শক্ত। মাথায় একটা জীর্ণ ছাতা; তালি- আঁটা, একটা সাদা, একটা লাল তালি। এই জিন্ আর সেই পরীর দল—মিশন স্কুলটা কি ক’রে যেন আমার কাছে আরব্য রজনীর বোগদাদ হয়ে পড়েছে। তারপর ঘোরটুকু কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাশাপাশি হলাম, প্রশ্ন করলাম- “আমতলার হাট কতটা হবে?”
“আজ্ঞে, পোটাক। উই তো দেখা যায়।”
“সত্যি নাকি,—ওটাই? এত কাছে?”
“একই জায়গা তো, উদয়রামপুর হোল থানা, পোস্ট আপিস, আপনার গিয়ে জমিদারী কাচারি নিয়ে; ওটা হোল হাট। জায়গাটা একই।”
“তোমার বাড়ি কোথায়?”
কি একটা নাম বললে, মনে পড়ছে না।
“আমতলার হাট থেকে কতটা দূর?”
“আমতলার হাট ছেড়ে খানিকটে গিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে পড়লেন, তারপর মাঠটুকু পেরিয়েই…”
“একটু আস্তে চলো না; এক দিকেই যাচ্ছি, গল্প করতে করতে যেতাম এটুকু। আমার অত পা চলে না।”
“রুত্তম কথা, এই যো—আর, আপনাদের ছিচরণ তো চলবার জন্যে নয়, তা কেন যাবে চলতে? আর, এই যে দেখছেন এক জোড়া খুঁটি, ওপরের চালাটাকে টাঙ্যেনে রয়েচে, এই দুটোকে ডাইনে চেলে ছেড়ে দিয়েছে কিনা, থামবে একেবারে কবরের সামনে গিয়ে।”
“হাটাহাঁটির কাজ বুঝি?”
“রুদয়রস্ত। উপস্তিন এই; আর সমস্ত শরীলটা ঘুমুতেও তো পায় না আজ্ঞে।”
“বুঝলাম না।”
“কাল রেতের কথা। আরফানের মা তাগাদা দিচ্ছে—নাও, ওঠো, বেরুতে হবে নি? মাল সব যে তোয়ের হয়ে গেল। বলচি—দাঁড়া, আগে পা দুটো ফিরে আসুক।… ঘুমুচ্চি, তাও মাজাটুকুন পজ্জন্ত, পা দুটো ঝুলি কাঁদে ক’রে ফিরি করতে বেইরে গেছে—হালসা—গোবিন্দপুর—টিমটিমে ভাসা-
ফিরে চেয়ে একটু হাসলে। রহস্যটা বেশ পরিষ্কার হয়নি দেখে বললে— “স্বপ্ন, আজ্ঞে। পা দুটো দেখেছে হেঁটে বেড়াবার স্বপ্ন, মাজার ওপরটা দেখছে আরাম করে নিদ্রে দেবার স্বপ্ন। যার যে রকম অব্যেস আর কি, আর যেটা যে রকম কপাল ক’রে এয়েচে।”
ফিরে একটু হাসলে। জমিয়েছে ভালো, আলাপটা চালাবার জন্যেই আমিও একটু হেসেই বললাম— “কিন্তু কোমরের ওপরটাই বা সর্বদা ঘুমিয়ে কাটাতে পারছে কৈ বলো। তাকেও তো ঘুরে ঘুরেই বেড়াতে হচ্ছে।”
“হুক্ কথা। কিন্তু সে তো চতুদ্দোলায় চড়ে, সেটাও হিসেব করে দেখতে হবে তো। পা দুটোকে উদিকে নাগিয়ে দিয়েচে—মর হালারা হেঁটে—নিজে লবাব খাঞ্জাখাঁ হয়ে—এই দেখুন না, আবার তার ওপরে ছত্র।”
আরও একটু স্পষ্ট করেই হাসতে যাচ্ছিল, পেছনে মোটর বাসের হর্ন বেজে ওঠায় একটু সম্ভ্রান্ত হয়েই সরে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়াল, আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাসটা উগ্র বেগেই বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাবার পরও একটু দাঁড়িয়ে রইল, যেন ভেতরে ভেতরে হাঁপাচ্ছে। একটু উৎসুকভাবেই প্রশ্ন করলাম— “হোল কি?”
মুখের প্রসন্ন ভাবটা ফিরে এসেছে, একটু হেসেই বললে— “আজ্ঞে হতে আর পেলে বৈ— কথাটা হচ্ছে, সেই রুদয়রস্ত ঝুলি কাঁধে টহল দেওয়া। সারা শরীলটা টাল খেতে থাকে অষ্ট পহর। তাই শড়ক দিয়ে চলিও না তো, ওই মিশন ইস্কুল থেকে আমতলার হাট, স্রেফ এইটুকু, তাইতেও মটোর যদি এল তো, গড় করে একেবারে রাস্তার কেনারে গিয়ে দাঁড়াই। উপস্তিন আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে একটু আনমনা হয়ে গেলাম না?—অতটা খেয়াল করতে পারিনি, আচমকা এসে একটু ইয়ে করে দিলে আর কি।”
বললাম— “রাস্তা থেকে সরেই চলো বরং ঘাসের ওপর, দিব্যি নরম ঘাসও।
নিজে নেমে গেলাম। এল সরে, কিন্তু সে-ভাবটা একেবারেই গেছে। হেসে বললে— “তা চলুন, কিন্তু ভয় যা করছেন, তার কিছু নেই আজ্ঞে। হাজীসায়েব বলেন যেটুকু দেনা করে এয়েচ, পিরথিমিতে সেটুকু আদা না করে তো যাবার উপায় নেই। আমায় এখন কাগজের পাকিটে করে এতগুলি চানাচুর ঘরে ঘরে আদা করে ফিরতে হবে—ধরুন গিয়ে সব মিলিয়ে এত মণ এত সের পোয়া এত ছটাক—খোদাতালা সেটা বেঁধে দিয়েছে। দুরকম পার্কিট, এক ছটাক আর আধ ছটাক তা সবটুকু আদা না হয়ে গেলে তো ছাড় নেই—তা মটোর বাসই বলুন, রেলই বলুন, ও আপনার গিয়ে মা শেতলাই বলুন, কি ওলাবিবিই বলুন,—কারুর আঁচড়ই দেবার উপায় নেই তো গায়ে একটু।”
হেসে চেয়ে রইল মুখের পানে, সমস্তটুকুর মাত্রা হিসেবে বললে— “আজ্ঞে হ্যাঁ, এই হলো সার কথা। হিন্দুর বেদ বলুন, মোছলমানের কোরাণ বলুন, কেরেস্তানদের যীশু বলুন।”
“তা হলে তুমি চানাচুর ফিরি করে বাড়ি ফিরছ? মেহনৎ তো বেশ দেখছি! থাকে কি রকম?”
“খোদাতালার যেদিন যেরকম মর্জি; তিন টাকাও থাকে, চারটে টাকাও হয়েছে, আবার গণ্ডা কয় পয়সা নিয়েও খালি হাতে ফিরে এসেচি।”
“মাস গেলে গড়পড়তা?
“আজ্ঞে তা গোটা তিরিশেক থেকে যায়।”
“মোটে?”
“তার হেতু রয়েচে, টান এলে তো বেরুতে পারি না, তা এরকম টান মাসে কোন্ না দশটা দিন আসচে? তাহলেই হিসেব করে দেখুন না।”
“টান?…হাঁপানি আছে নাকি?”
“ঐ যে বললুম—গড়ে দশটা দিন, বেশিরটা ভালোই থাকি তানার মর্জিতে
“চলে কি করে? সংসার কি?”
“সংসার আরফানের মা, আরফান, ছোট মেয়েটা আর এই অধীন।… চলবার কথা নয়, তবে খোদাতালা কষ্ট বলে জিনিসটা আর হতে দেয় না।…টানের কথাটা বাদ দিতে হবে আজ্ঞে, কর্তার ছেলো, হাওয়ালের হবে এনিয়ম তো বাবা আদমের সময় থেকে চলে আসচে, কেয়ামত পজ্জন্ত থাকবে, এতে খোদাতালাই বা কি করবে, আর পীর-পয়গম্বরই বা কি করবে। তবে যাকে কষ্ট বলে সেটা হতে দেন না। যেটি ইদিক দিয়ে কুলুল না, সেটা আরফানের মা পাঁচ বাড়িতে গতরে খেটে পুষিয়ে নেয়। অতিরিক্ত খাটুনি, কিন্তু সেদিক দিয়ে খোদাতালার মেহেরবানি আছে। আরফানের মা যদি কাৎ হোল তো আমি ঠিক আছি, আমি যদি বুক চেপে পড়লুম, আরফানের মা ঠিক আছে।…দুজনেও পড়েচি—এমনটা যে না হয়েচে তা নয়, কিন্তু চালিয়ে দিয়েচেন—পাড়ার কেউ না কেউ এসে সামলে দিয়েচে। খোদাতালা কষ্ট দিলেন এমন অধম্মের কথা বলে যে গুনোগার হব এটুকু কখনও হতে দেননি। আপনি যাবেন কতদূর?”
“ফলতা।”
“আচ্ছা, সেলাম আলেকম। আমি এই অশত্থতলাটায় নেমাজ সেরে নিই রোজ। তারপর বাজার হয়ে বাড়ি ফিরি। এই সময় বাজারটা বসে কিনা। আচ্ছা আমি রয়ে গেলাম একটু।”
“তোমার নামটা জিজ্ঞেস করা হোল না তো।”
“আজ্ঞে নবাবজান। ঠিক খাটে না বুঝি, তবে বাপমায়ের দেওয়া নাম…”
“খুব খাটে নবাবজান। জানটা নবাব হোলেই তো হোল, তার মানে দিলটা আর কি!”
“আজ্ঞে, তাও বলি খোদাতালাকে,—বলি, পা দুটোর জন্যে ভাবি না, খ্যাতো খাটাবে খাটাও, কিন্তু ওপরটাকে সাচ্চা রেখে যেও!”
.