দু’নম্বর চাবি – ৯

০৯.

হালদারমশাই এসে পৌঁছেছিলেন রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। আমাদের ঘরেই একটা ক্যাম্প খাটে ওঁর বিছানার ব্যবস্থা করে রেখেছিল কালীপদ। তিনি খেয়ে এসেছিলেন। শুধু এক কাপ কফি খেতে চাইলেন। কালীপদ শিগগির কফি দিয়ে গেল।

কফি খেতে খেতে উনি যা বললেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই…

আইভি চিত্তরঞ্জন টাউনশিপে গিয়ে জেমস বিশ্বাসকে বিয়ে করার পর গোপনে বাছুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখেছিল। সে সুযোগ পেলেই বাবার বাংলোতে চলে আসত। বাচ্চু সেখানে যেত। আইভির বন্ধু যোশেফ ছিল বাঙুরও বন্ধু। আইভি গেলে যোশেফকে দিয়ে খবর পাঠাত। কালীপুজোর রাতেও তা-ই করেছিল সে। বাচ্চু রাত দশটা নাগাদ বাংলোতে গিয়েছিল। সে সঙ্গে হুইস্কি আর ওয়াইন নিয়ে গিয়েছিল অন্য রাতের মত! বাচ্চু সে রাত্রে খুব মাতাল হয়ে পড়েছিল। তার গলার লকেটটা অনেকে বরাবর দেখেছে। বাচ্চুকে উপহার হিসেবে চেয়েছে। বাচ্চু দেয়নি। সে রাত্রে আইভি লোভ সামলাতে পারেনি। মাতাল বাচ্চুর গলা থেকে খুলে নিয়ে নিজের গলায় পরেছিল। রাত একটা নাগাদ হঠাৎ সেখানে কেউ বাচ্চুকে ডাকাডাকি করে। বাংলোতে বিদ্যুৎ নেই। আইভি বাচ্চুকে ঘুম থেকে জোর করে ওঠায়। লোকটা গেটের কাছে ক্রমাগত ডাকছিল। বাচ্চু শোনামাত্র কেন কে জানে রেগে যায় এবং গাল দিতে দিতে বেরিয়ে লোকটাকে তাড়া করে। স্বভাবত আইভি ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাচ্চু আর ফিরে আসেনি। আইভি পরদিন বেলা ন’টা অব্দি অপেক্ষা করে শর্টকাটে হাঁটতে হাঁটতে বিজয়গড়ের মোড়ে যায়। তারপর বাসে চেপে ফিরে যায় চিত্তরঞ্জন টাউনশিপে। কয়েকদিন পরে সন্ধ্যাবেলায় সে একটা বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে আসছে, আচমকা একটা লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে বলে, কথা আছে। বলেই সে তার গলার দিকে হাত বাড়ায়। আইভি চেঁচিয়ে ওঠে এবং ছুটে পালায়। লোকটাকে সে বিজয়গড়ে থাকার সময় দেখেছিল। তার পরিচয় জানে না। এ ঘটনা শুধু একবার নয়, পরপর তিনবার ঘটেছিল। ভয়ে সে লকেটটা লুকিয়ে ফেলেছিল। ইতিমধ্যে একদিন যোশেফ গিয়ে তাকে খবর দেয়, বাচ্চু নিখোঁজ হয়েছে। পুলিশ আইভিকেও অ্যারেস্ট করতে পারে। আইভি দাদার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তার কিছুদিন পরে জেমস অফিসের ক্যাশ হাতিয়েছিল। সে আইভিকে গোপনে ডেকে কলকাতা পালানোর প্ল্যান করে। তারপর যা ঘটেছে, আমাদের জানা। লোকটা—’দ্যাট স্কাউন্ট্রেল’ কী করে যে আইভি আর জেমসের কলকাতা পালানো টের পেয়েছিল, এটাই আশ্চর্য!

সব কথার শোনার পর কর্নেল বললেন, এমন হতে পারে লোকটাও কলকাতা যাচ্ছিল একই ট্রেনে। দৈবাৎ আইভিদের দেখতে পেয়ে ফলো করেছিল।

বললুম, দৈবাৎ, নাকি সে চরের সাহায্যে নজর রেখেছিল ওদের ওপর?

হালদারমশাই নস্যি নিয়ে বললেন, বুঝি না।

কর্নেল বললেন, আমার অঙ্ক কষা হয়ে গেছে। লোকটা নিজেই চিত্তরঞ্জনে গিয়ে ওত পেতে ছিল। পরেরটুকু দৈবাৎ।

বললুম, দৈবাৎ ব্যাপারটা আকস্মিকতা। অঙ্কে আকস্মিকতার প্রশ্ন ওঠে না।

কর্নেল হাসলেন। আকস্মিকতার পেছনেও গণিতের সূত্র কাজ করে জয়ন্ত! ধরো, গাছ থেকে একটা ফল পড়ল তোমার সামনে। আপাতদৃষ্টে এটা আকস্মিক। কিন্তু ফলটা খসে পড়ার পেছনে প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করছে। ফলটার বোঁটা সেই নিয়মে একটু একটু করে শুকিয়েছে। ওদিকে তুমিও সেখানে উপস্থিত হয়েছ জীবনেরই অলঙঘনীয় নিয়মে। তুমি কোথাও কোনও কাজে যাচ্ছিলে। অথবা সেখানে গিয়ে কোনও উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছিলে। তোমার কোথাও উপস্থিতির পেছনে জীবনেরই নিয়ম কাজ করে। আকস্মিকতার হাত থেকে ত্রাণ নেই।

এতক্ষণে কালীপদ এসে বলল, চলুন স্যার। খাওয়া রেডি। রানীমা আজ সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। রান্না হয়ে গেছে কখন। আমারই আসতে একটু দেরি হল। কর্নেল বললেন, রানীমার শরীর খারাপ নাকি?

আজ্ঞে না। কোনও-কোনওদিন দশটার আগেই শুয়ে পড়েন।

 তোমার আসতে দেরি হল কেন?

আর বলবেন না। ঠাকুরমশাইয়ের আবার পেটের গণ্ডগোল। খিড়কির দরজা খুলে পাহারা দিতে হল। তা না হলে আবার আমার সিডবেড নষ্ট করে দিতেন।

 খেয়ে আসার পর কর্নেল বলেছিলেন, আজ রাত্রে আর কোনও আলোচনা নয়। হালদারমশাইয়ের খুব ধকল গেছে। শুয়ে পড়ুন। আমিও শুয়ে পড়তে চাই।….

পরদিন ঘুম ভাঙার পর দেখলুম, হালদারমশাই লনে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে রাজবাড়ি দর্শন করছেন। কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। সাড়ে সাতটা বাজে। কিন্তু তখনও কুয়াশার পর্দা দুলছে ইতস্তত। কালীপদর স্ত্রী জবা আমার। জন্য চা আনল। সে মৃদুস্বরে বলল, টুকুনের বাবা বাজারে গেছে। গত রাত্তিরে এক কাণ্ড। রানীমা আপনাদের জাগাতে বারণ করেছিলেন!

জিজ্ঞেস করলুম কী কাণ্ড?

জবা ঘোমটার ভেতর বলল, কে রানীমার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। উনি সুইচ টিপে বেল বাজিয়েছিলেন। টুকুনের বাবা জেগে গিয়েছিল। বল্লম আর টর্চ নিয়ে সারা বাড়ি খুঁজে কাউকে সে দেখতে পায়নি। শত্রুরদের সাহস কত বেড়ে গেছে দেখুন। আপনারা থাকতেও গেরাহ্যি করছে না।

হালদারমশাই কান খাড়া করে শুনছিলেন। মাথায় হনুমান টুপিটি নেই। বললেন, আমাগো ডাকলেন না ক্যান? খুলি উড়াইয়া দিতাম হালার!

জবা চুপচাপ চলে গেল। বললুম, রানীমাকে দেখেছেন হালদারমশাই?

দেখছি। মন্দিরে পূজারতি হয়। ঘণ্টা শুনছিলাম। তারপর দেখলাম এক বৃদ্ধা ছড়ি হাতে, আইতাছেন। কালীপদ কইল, উনি রানীমা। বয়স নাকি আশি বৎসর। বিশ্বাস হয় না।

কালীপদ এল ঘণ্টাখানেক পরে। আমাকে দেখে সে বলল, কাল রাত্তিরে এক কাণ্ড।

তার কথার ওপর বললুম, শুনেছি। জবা বলছিল।

 কালীপদ চাপাস্বরে বলল, আজও উড়ো চিঠি। এটাই শেষ চিঠি বলে লিখেছে।

বলেই সে ফুলবাগানের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এই! এই ঠাকুরমশাই! আবার?

দেখলুম, ভটচাযমশাই গাড়ু হাতে বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে হন্তদন্ত চলে যাচ্ছেন। কালীপদ চ্যাঁচামেচি করছিল। রানীমার ধমকে সে থেমে গেল।

হালদারমশাই জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

তাঁকে ভটচাযমশাইয়ের আমাশার কথা সবিস্তারে বলতে হল। তিনি নস্যি নিয়ে খিক খিক করে হেসে অস্থির হলেন।

কর্নেল ফিরে এলেন এতক্ষণে। কিন্তু উনি ঘরে না ঢুকে সোজা এগিয়ে গেলেন। বুঝলুম রানীমার কাছে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরে কালীপদ আমাদের ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকে নিয়ে গেল। ডাইনিং রুমে রানীমা ও কর্নেল বসেছিলেন। হালদারমশাইয়ের সঙ্গে তিনি রানীমার আলাপ করিয়ে দিলেন। হালদারমশাই ঢ্যাঙা মানুষ। কুঁজো হয়ে নমস্কার করে বললেন, আমার বড় সৌভাইগ্য! যদি আপনার কাজে লাগতে পারি, আরও সৌভাইগ্য!

ব্রেকফাস্টের পর রানীমা একটু দ্বিধার সঙ্গে কর্নেলকে বললেন, আপনার কথামতো কাজ করতে আপত্তি নেই। কিন্তু শেষরক্ষা হবে তো?

কর্নেল বললেন, হবে। জানোয়ার ফাঁদে পা দিতে বাধ্য। সে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

তা হলে আপনি আমার ঘরে আসুন। জয়ন্ত আর মিঃ হালদার তাদের ঘরে গিয়ে গল্প করুন ততক্ষণ।

আমি ও হালদারমশাই কর্নেলের ইঙ্গিতে চলে এলুম। আমাদের ঘরের সামনে এসে গোয়েন্দাপ্রবর চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল স্যার ফান্দ কইলেন ক্যান?

বললুম, আমি এ বিষয়ে একেবারে অন্ধকারে আছি হালদারমশাই!

 হালদারমশাই গম্ভীর মুখে বসে নস্যি নিলেন।..

এদিন দুপুরে খাওয়ার পর কর্নেল বেরিয়েছিলেন। হালদারমশাই কালীপদকে ডেকে রাজবাড়ি পরিদর্শনে বেরুলেন। আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। চারটে নাগাদ কালীপদ যথারীতি চায়ের কাপ এনে আমার ঘুম ভাঙল। বললুম, হালদারমশাই কোথায় গেলেন?

কালীপদ হাসল। ওঁকে রাজবাড়ির সব ঘর দেখালুম। শুধু নীচের তলার একটা ঘর দেখানো হল না। ওই ঘরে অনেক ছবি আর নানারকম মূর্তি আছে। ঘরটার চাবি রানীমার কাছে আছে। হালদারসায়েব ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে মন্দিরে সিংহবাহিনী দর্শন করলেন। এখন রোধ করি রাজবাড়ির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

কথা বলতে বলতে হালদারমশাই এসে গেলেন। কালীপদ তার জন্য চা আনতে গেল। গোয়েন্দামশাই বললেন, ভাবা যায় না কী ঐশ্বর্য ছিল এই বাড়িতে। এখনও যেটুকু দ্যাখলাম, তাতেই মনে হইল জাদুঘরে ঢুকছিলাম।

কথাটা বলে উনি হঠাৎ ফিস ফিস করলেন, কালীপদ ট্যার পায় নাই। একখান ঘরের চাবি রানীমার কাছে থাকে। সেই ঘরের তালা ভাঙা। একটু টান দিছি আর বুঝছি। কালীপদরে কই নাই। কর্নেল স্যারেরে জানানো দরকার। আমার চোখ জয়ন্তবাবু। চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি।

চমকে উঠে বললুম, হয়তো ওটাই কর্নেলের ফাঁদ।

গোয়েন্দাপ্রবর গম্ভীর মুখে বললেন, হঃ। ফান্দ হইতেও পারে।

কর্নেল ফিরলেন সন্ধ্যার পর। হালদারমশাইয়ের মুখে কথাটা শুনে তিনি শুধু বললেন, জানি।

কালীপদ একটু পরে তিনজনের জন্য ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স রেখে চলে গেল। কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলুম, বোসসায়েব তো এলেন না?

কর্নেল বললেন, এসে গেছেন। যথাসময়ে দিদার বাড়ি আসবেন।

এ রাতে আমরা খেতে গিয়ে রানীমাকে দেখতে পেলুম না। উনি আজ রাতেও সকাল-সকাল শুয়ে পড়েছেন। বাড়িটা আজ যেন বড় বেশি স্তব্ধ। খেয়ে আসার পর কর্নেল বললেন, শুয়ে পড়া যাক।

বললুম, ফাঁদের কথা বলছিলেন। কী হল?

ওয়েট অ্যান্ড সি। বলে কর্নেল বিছানায় শুয়ে মশারির বাইরে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলেন।

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে টেবিল ল্যাম্পটা নিভে গেল। অমনি কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, জয়ন্ত! হালদারমশাই! সময় হয়েছে। উঠে পড়ুন। আর্মস সঙ্গে রাখতে। হবে। টর্চ নিন। কিন্তু জ্বালবেন না।

কর্নেল বারান্দার দিকের দরজা খুললেন না। পাশের ঘরের দরজা নিঃশব্দে খুলে সেই ঘরে ঢুকলেন। উনি পায়ের কাছে টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলেন। তার পরের ঘরের ছিটকিনিও খুলে সন্তর্পণে এগোলেন। বুঝতে পারলুম, বাইরে বারান্দার দিকে তালা আঁটা থাকলেও এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে অসুবিধে নেই। আর একটা ঘরের পর সেই হলঘরে গেলুম। হলঘরের পরের ঘর পেরিয়ে আসবাবপত্র ভরা একটা ঘর। সেখানে ঢুকেই সামনে কোথাও চাপা ঘষ ঘষ শব্দ শুনতে পেলুম। কর্নেলের চর্ট নিভে গেল। একটু পরে কর্নেল ফিস ফিস করে বললেন, আমাকে ছুঁয়ে আসুন আপনারা। ওয়ান বাই ওয়ান।

কর্নেলকে ছুঁয়ে হালদারমশাই এবং তাকে ছুঁয়ে আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলুম। আশ্চর্য! সামনের ঘরের দরজা খোলা। বারান্দার দিকের দরজাও খোলা। অন্ধকার গাঢ় হলেও ক্রমশ দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ একটা জায়গায় আলোর আভাস দেখলুম। ঘরের কোণে মেঝের একটা অংশ থেকে আলোর ছটা কাঁপছে। একটু এগিয়ে বুঝতে পারলুম, বেসমেন্ট বা পাতালঘরে নামবার মুখ ওটা। পাতালঘরে কেউ আলো জ্বেলেছে। তিনজনে গুঁড়ি মেরে উঁকি দিলুম। নীচে একটা মোমবাতি জ্বলছে। অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। কর্নেল ফিস ফিস করে বললেন, ফলো মি।

তারপর উনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েই টর্চ জ্বেলে চেঁচিয়ে উঠলেন, গুলি করতে বাধ্য হব। ওটা ফেলে দাও।

হালদারমশাই কর্নেলের পাশ দিয়ে ঝাঁপ দিলেন। ততক্ষণে আমিও নেমে গেছি। এক জটাজুটধারী দাড়িগোঁফওয়ালা লাল কাপড় পরা সাধুর হাতে একটা ধারালো খাঁড়া এবং একটা কারুকার্যখচিত কালো সিন্দুকের ডালা খোলা। নীচে একটা বস্তা পড়ে আছে। হালদারমশাই খাঁড়ার কোপ এড়িয়ে যেভাবে সাধুকে পেছন থেকে জাপটে ধরলেন, তা শুধু সিনেমায় দেখা যায়। সাধু মুখ থুবড়ে পড়ল। খাঁড়াটা সিন্দুকের ওপর সশব্দে ছিটকে গেল। হালদারমশাই সাধুর পিঠে হাঁটুর চাপ দিতেই ককিয়ে উঠল। কর্নেল গিয়ে তার জটাজুট সমেত দাড়িগোঁফে টান দিলেন। সেগুলো উপড়ে গেল। অমনি হতবাক হয়ে দেখলুম, সাধু আর কেউ নয়, স্বয়ং ভটচাযমশাই!

কর্নেল বললেন, হরেকেষ্টকে দাঁড় করান হালদারমশাই।

 সিঁড়ির ওপর থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে কেউ বলল, ওকে ওই অবস্থায় রাখুন আপনারা। দিদাকে ডেকে আনি।

বুঝলুম, ডি আই জি অরবিন্দ বোস এসে গেছেন।

ইত্যবসরে দু’জন পুলিশ অফিসার নেমে এলেন। কর্নেল সিন্দুকের ডালা দ্রুত এঁটে দিয়েছেন ততক্ষণে। দুটো চাবি একটা গোল রুপোলি চাকার দু’দিকে ঢোকানো ছিল। পরপর ঘুরিয়ে প্রথমে একটা এবং পরে আর একটা চাবি টেনে বের করে পকেটে রাখলেন কর্নেল। খাড়াটা আমি কুড়িয়ে নিলুম। সাংঘাতিক ধারালো খাড়া।

তারপর রানীমার কান্নাজড়ানো কণ্ঠস্বর ওপরে শোনা গেল। ওরে হরেকেষ্ট! তোর পেটে এত ছিল? দুধ দিয়ে কালসাপ পুষেছিলুম রে!

অরবিন্দ বোস তাঁর হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নিয়ে এলেন। কর্নেল চাবি দুটো রানীমার হাতে দিয়ে বললেন, আমার দায়িত্ব শেষ মিঃ বোস! বাচ্চুর খুনীকে এবার যথাস্থানে পাঠান। তারপর আপনার দিদার ঘরে বসে কফি খেতে খেতে সব কথা বলব। জয়ন্ত! তুমি খাঁড়াটা অফিসারদের দাও। ওই খাঁড়া দিয়ে বাচ্চুকে খুন করেছিল হরেকেষ্ট।…

.

বারান্দায় কালীপদ আর তার বউ জবা দাঁড়িয়েছিল। তারা দুজনেই হতবাক। এখন রাজবাড়িতে আবার আলো জ্বলছে। মেন সুইচ অফ করা ছিল। কর্নেল অন করে দিয়েছেন। পাতালঘর আগের মতো বন্ধ করা হয়েছে। রানীমার ঘরে বসে কফি খেতে খেতে কর্নেল তার রহস্য উন্মোচনের বিবরণ দিচ্ছিলেন। আমি আগাগোড়া সবটাই জানি বলে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে কিছু যুক্ত করতে চাইনে।

কর্নেল বললেন, কালীপদর একটা কথা প্রথমে হরেকেষ্টর দিকে আমার দৃষ্টি ফেরায়। কালীপদ বলেছিল, বুধবার বিকেলে হরেকেষ্ট কলকাতা রওনা হয়। অথচ সে আমার কাছে যায় শুক্রবার সকালে। তারপর সে আমাশা নিয়ে ফিরল শনিবার বিকেলে। আমাশা মিথ্যা, তার প্রমাণ পেলুম রবিবার সকালে। শনিবার রাত্রে মেন সুইচ অফ করে সে ফুলবাগানের ওখানে আসলে কী করছিল, তা রবিবার সকালে ক্যাকটাস দেখার ছলে গিয়ে জানতে পারলুম। একিনো-ক্যাকটাস গ্রুসোনাই কালীপদর ভাষায় ‘কুমড়োপটাশ’-এর টবের তলায় কী ঝিকমিক করছিল। টব সরিয়ে দেখি, চেনছেঁড়া একটা মোটা চৌকো লকেট। আইভির গলা থেকে সে কলকাতায় এটা ছিনতাই করে এনে এখানে লুকিয়ে রেখেছিল। কারণ শনিবার সকালে তার ঘরের তালা ভেঙে তার হাতের লেখা খুঁজেছিলুম। একটা পঞ্জিকাতে লাল ডটপেনে তার নামসই ছিল। মিলিয়ে দেখেছিলুম, রানীমাকে লেখা উড়ো চিঠির হস্তাক্ষরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তালা ভাঙা লক্ষ করেই হরেকেষ্ট লকেটটা আর ঘরে রাখতে সাহস পায়নি। আঁচ করেছিল, আমি তাকে সন্দেহ করছি। তাই ক্রমশ সে মরিয়া হয়ে উঠছিল।

রানীমা জিজ্ঞেস করলেন, লকেট টমসায়েবের মেয়ের গলায় গেল কীভাবে?

কর্নেল বলেন, সেটা হালদারমশাই বলবেন। তবে লকেটে সিন্দুকের এক নম্বর চাবি লুকনো আছে কি না তখনও জানতুম না। আপনার কাছে পরে জানতে পারলুম। অমনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই চিঠির নির্দেশমতো মন্দিরের পেছনে লালপাথরের ওপর আমি আপনার দ্বিতীয় চাবিটা রেখে এসেছিলুম। আমার তো ছলের অভাব হয় না। পাখি বা প্রজাপতি দেখতে ওদিকে যেতেই পারি। এবার স্মরণ করুন, হরেকেষ্ট সকালে আবার আমাশার ছলে লকেটটা আনতে ফুলবাগানের দিকে গিয়েছিল। কালীপদ বাজার থেকে এসে দেখতে পেয়ে চাচামেচি করছিল। আর একটা কথা। এই পরচুলটা। হালদারমশাই বলবেন এটা কীভাবে আমার হাতে এল। কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে পরচুলাটা বের করে ভেতরটা দেখালেন। লক্ষ করুন এখানে লাল ছোপ। কিসের ছোপ? শুক্রবার সকালে যখন হরেকেষ্ট আমার কাছে যায়, তখন তার কপালে সিঁদুরের তিলক ঘষে একাকার হয়ে গিয়েছিল। পরচুলা পরার সময় কপালে ঘষা খেয়ে ওই অবস্থা হয়েছিল। যাই হোক, হরেকেষ্ট ক্রমে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এবার হালদারমশাই বলুন। তার কথার সঙ্গে আমার কথা মিলিয়ে দেখলে সব স্পষ্ট হবে।

 হালদারমশাই স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় ইংরেজি মিশিয়ে তার বিবরণ দিলেন।

অরবিন্দ বোস বললেন, হরেকেষ্ট বাংলোর কাছে সম্ভবত খাঁড়ার আঘাতে বাচ্চুকে লকেটের লোভেই খুন করেছিল। কিন্তু লকেট পায়নি। এখন কথা হল, বাচ্চুর বডি সে মুসলমানদের কবরখানা পর্যন্ত একা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল এটা বিশ্বাস হয় না। জেরার চোটে তার পেট থেকে কথা বের করে নেব।

 কর্নেল বললেন, তবে হরেকেষ্টর শরীর শক্ত-সমর্থ। বাচ্চুর রোগা ছিপছিপে। সেই কবরটা খুঁড়লে অন্তত এটুকু বোঝা যাবে, পথে কোথাও রক্ত পড়েনি কেন? আমি বাজারে কয়েকটা দোকানে খবর নিয়ে জেনেছি, হরেকেষ্ট একটা দোকান থেকে কালীপুজোর দিন পাঁচ মিটার পলিথিন কিনেছিল। নাইলনের দড়িও কিনেছিল। এবার বুঝতে চেষ্টা করুন, কী অসাধারণ তার বুদ্ধি! হ্যাঁ বলা দরকার। খ্রিস্টান পাড়ার যোশেফ আইভির চিঠি দিতে আসছিল বাচ্চুকে। পথেই হরেকেষ্টকে দেখতে পেয়ে সে চিঠিটা তাকে দিয়েছিল। বাচ্চু কালীপদকে বিশ্বাস করত না সম্ভবত। কারণ কালীপদ রানীমার কাছের লোক। তাই আইভির চিঠি সে তার বন্ধু যোশেফকে হরেকেষ্টর হাত দিয়ে পাঠাতে বলত। হরেকেষ্ট এই অবৈধ প্রণয়ের কথা জানত বলেই বাচ্চুর সঙ্গে রসিকতা করত। বাচ্চু বাড়াবাড়ি দেখলে রেগে যেত তার ওপর। জবা কালীপুজোর বিকেলে এই ঘটনা দেখেছিল। তাই না জবা?

জবা বাইরে থেকে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি বললুম, কবরের কাছে বাচ্চুর একপাটি চপ্পল কুড়িয়ে পাওয়ার কথাটা বলুন কর্নেল!

কর্নেল বললেন, এত রাত্রে আমি কাকেও জুতো দেখাতে রাজি নই।

ডি আই জি বোসসায়েব গম্ভীর মুখে বললেন, যে কবরের কাছে জুতোটা পেয়েছেন, সেই কবরে বাচ্চুর ডেডবডি যদি না থাকে?

আছে। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, টাটকা কবরটার একটা দিক যে আবার খোঁড়া হয়েছিল, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। এমন কি, নাইলনের দড়ির একটুখানি মাটির ফাঁকে বেরিয়ে আছে, তা আমার চোখে পড়েছে।

এবার রানীমা বলে উঠলেন, কালীপুজোর দিন বিকেলে মেলাকমিটির সেক্রেটারি চাঁদুবাবু এসেছিলেন হরেকেষ্টর কাছে। এতক্ষণে মনে হল কথাটা। আমি মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ কানে এল, মুসলমানপাড়ায় কে মারা গেছে আর তার কবর হচ্ছে। সেই নিয়ে দু’জনে কথা হচ্ছে। আমার অবাক লেগেছিল।

বোসসায়েব কথাটা শোনামাত্র সেলুলার ফোন বের করে বললেন, চাঁদতারণ মুখুয্যেরই চক্রান্ত। তাকে এখনই অ্যারেস্ট করতে বলছি। তার উদ্দেশ্য ছিল একঢিলে দুই পাখি বধ। পিসিমার এই রাজবাড়ি দখল আর পিসেমশাইয়ের অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ আত্মসাৎ। হরেকেষ্টকে সে-ই লোভ দেখিয়েছিল।

কর্নেল সায় দিলেন, ঠিক ধরেছেন মিঃ বোস…