০৫.
কালীপদ কফির সঙ্গে গরম-গরম পকৌড়া এনেছিল। সে চলে গেলে জিজ্ঞেস করলুম, জনসায়েব কি জানে তার বোন কোথায় আছে?
কর্নেল বললেন, বোনের খবর রাখে না জন। কথায় কথায় জেনে নিয়েছি, জেমস বিশ্বাস বাঙালি খ্রিস্টান। চিত্তরঞ্জনে এক কন্ট্রাক্টরের অফিসে চাকরি করত। টাকা চুরি করে পালিয়েছে।
একটু পরে সিংহবাহিনীর মন্দিরের সন্ধ্যারতির ঘণ্টা বেজে উঠল। তরপরই রাজবাড়িতে আলো জ্বলল। কালীপদ আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বারান্দায় আমাদের। কাছে এল। বারান্দার এবং আমাদের ঘরের সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিয়ে সে মুচকি হেসে বলল, ভটচাযমশাইয়ের নাকি আমাশা হয়েছে। আরতি দায়সারা হবে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, উনি থাকার সময় পুজো-আরতি এসব কী ভাবে হত?
কালীপদ বলল, আজ হল গে শনিবার। ভটচাযমশাই কলকাতা গিয়েছিলেন বুধবার বিকেলে। এই ক’দিন সকাল-সন্ধ্যা আরতি দিতে ডেকে আনতুম পাঁচু ঠাকুরকে। আজ আসার পথে ভটচাযমশাই পাঁচু ঠাকুরকে নিষেধ করে এসেছেন।
কর্নেল তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আচ্ছা কালীপদ, রানীমার পিসতুতো ভাইয়ের ছেলে অরবিন্দ বোস–মানে পুলিশের ডি আই জি সায়েবকে কীভাবে খবর দেওয়া যায় বলতে পারো?
কোনও অসুবিধে নেই স্যার! বিজয়গড় থানার বড়বাবু মেজবাবু বা ছোটবাবুকে, রানীমার নাম করে বললেই টেলিফোন করে দেবেন। শুধু রানীমার একখানা চিঠি দরকার।
রানীমা এখন কি মন্দিরে?
আজ্ঞে। মন্দির থেকে ফিরে এলেই বলব কথাটা।
ঠিক আছে কথাটা আমিই ওঁকে বলব। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
কালীপদ ট্রে গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। তারপর বললুম, হালদারমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত কর্নেল! আইভির পেছনে কে লেগেছে বা কেন লেগেছে–
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, যে কন্ট্রাক্টরের টাকা চুরি করে জেমস্ পালিয়েছে, সে ওদের পেছনে গুণ্ডা লেলিয়ে দিতেই পারে। গুণ্ডাটার ভয়েই দু’জনে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে সম্ভবত।
কিন্তু আইভি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করবে কেন?
চুরুট ধরিয়ে কর্নেল বললেন, যত ভাববে তত মাথা গুলিয়ে যাবে।
না কর্নেল! ব্যাপারটা গোলমেলে। আইভি পুলিশের কাছে জানাতে পারত।
ওহ্ জয়ন্ত! এটা কেন বুঝতে পারছ না, টাকা চুরি করলে সেই কন্ট্রাক্টার জেমসের নামে পুলিশের কাছে এফ আই আর করবে কি না? পুলিশও জেমসের নামে হুলিয়া জারি করবে কি না?
হু। তা করবে বটে।
তাছাড়া আইভি পুলিশের কাছে যাবে কোন মুখে? তার নামেও তো হুলিয়া জারি হয়েছে! গেলেই তার স্বামী ধরা পড়ে যাবে এবং সে-ও বাচ্চুর কেসে অ্যারেস্ট হয়ে যাবে।
বলে কর্নেল ঘরে ঢুকলেন। টেবিলে কিটব্যাগ, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা রেখে বাথরুম গেলেন। বারান্দায় শীত করছিল। তাই ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। কর্নেলের যুক্তিগুলো মনঃপুত হল না। আইভি প্রাইভেট ডিটেকটিভের শরণাপন্ন কেন হল এই প্রশ্নটা মাথার ভেতর মাছির মতো ভনভন করতে থাকল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে কর্নেল বললেন, বসো! আসছি।
উনি চলে যাওয়ার পর পশ্চিম ও উত্তরের লম্বাটে খড়খড়িওয়ালা জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিলুম। এ ঘরে পুরনো আমলের ভারি এবং নকশাদার পদ। কোথাও-কোথাও একটু ফেটে আছে। তবে সহজে চোখে পড়ে না। শুধু এটাই আশ্চর্য, মশার উৎপাত নেই।
কেন নেই তা অভিজ্ঞতার সূত্রে বুঝতে পারলুম। অনেকদিন এ ঘর বন্ধ ছিল। মশারা মানুষের রক্তপানের সুযোগ না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কাল নিশ্চয় ওরা ক্রমে ক্রমে জেনে যাবে মানুষ এসেছে। তখন দলে দলে বেরিয়ে পড়বে গুপ্ত স্থান থেকে। হুঁ। খাটের সঙ্গে মশারি খাটানোর ব্যবস্থা আছে। মশারি খাটালেই ওরা সবুজ সঙ্কেত পাবে।
আরতির ঘণ্টা এতক্ষণে থামল। তারপর দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক শুনতে পেলুম। সামনাসামনি দক্ষিণে বটগাছের দিকে হঠাৎ পেঁচা ডেকে উঠল ক্রাও! ক্রাও! তারপর চুপ করে গেল। আবার গাঢ় স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল। এই বাড়িটা সত্যি যক্ষপুরী। কেন যেন অস্বস্তি হতে থাকল। ফায়ার আর্মসটা বের করে বিছানায় বালিশের তলায় রেখে দিলুম।
এই সময় মনে পড়ে গেল অলকের কথা। সে যাই-ই হোক না কেন, এ বাড়িতে থাকার সময় বাড়িটাকে সে প্রাণবন্ত করে রাখত। এমন সব রাতে তার হইচই, গান-বাজনার রেকর্ড খণ্ডহর অধ্যষিত এই যক্ষপুরীকে প্রাণচাঞ্চল্যে পূর্ণ রাখত না কি? হয়তো রানীমা এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ওর প্রতি তত। কঠোর হতে পারেননি। তার ঘর এখনও যে তেমনি সাজানো আছে, তা নিশ্চয় তার ফিরে আসার প্রতীক্ষার কারণে।
কথাটা ভাবতে ভাবতে আচমকা সব আলো নিভে গেল। দ্রুত টর্চ বের করে বারান্দায় গিয়ে ডাকলুম, কালীপদ কালীপদ!
কালীপদ সাড়া দিয়ে বলল, টেবিলে লণ্ঠন আর দেশলাই আছে স্যার! লোডশেডিং। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। আলো এসে যাবে।
সে বারান্দায় টর্চ জ্বেলে উল্টোদিকে চলে গেল। ঘরের একটা টেবিলে দেখলুম, চিনা লণ্ঠন আর দেশলাই রাখা আছে। আলো জ্বেলে দিলুম। কিন্তু বাইরের অন্ধকার বড় বেশি গাঢ় দেখাল। বারান্দায় গিয়ে গেটের দিকে এবং ফোয়ারার দিকে বার বার টর্চের আলো ফেলছিলুম। দু’ব্যাটারি টর্চের আলো ফোয়ারা অব্দি গিয়েই অন্ধকারের গায়ে নেতিয়ে পড়ছে। হলঘরের সামনে বারান্দায় কালীপদ একটা লণ্ঠন জ্বেলে দিল। কে জানে কেন–হয়তো রানীমাকে লেখা উড়ো চিঠিগুলোর কথা মনে পড়েই ভয় পাচ্ছিলুম। তাই নিজেকে সাহস যোগাতে ঘরে ঢুকে ফায়ার আর্মসটা নিয়ে ডান হাতে রেখে চাদর ঢাকা দিলুম। গেটের দিকে টর্চের আলো ফেলেছি, চোখের ভুল কি না জানি না, যেন দেখলুম, ফুলবাগানের দিকে কেউ বসেছিল। এইমাত্র গুঁড়ি মেরে বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে সরে গেল।
আরও কয়েক পা এগিয়ে টর্চের আলো ফেললুম। কালীপদ চেঁচিয়ে বলল, কী দেখছেন স্যার?
চেঁচিয়ে বললুম, ফুলবাগানের ওদিকে কে যেন বসেছিল।
কালীপদ তার টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেল। তারপর টর্চ নিভিয়ে হাসতে হাসতে বলল, দেখো কাণ্ড!
রানীমার কথা শোনা গেল, কী হয়েছে রে কালী?
আজ্ঞে কিছু হয়নি। বলে কালী বারান্দার নীচের লন দিয়ে আমার কাছে চলে এল। চাপাস্বরে বলল, রানীমা শুনলে খেপে যাবেন। আমি ঠাকুর-টাকুর মানি না। ভোরবেলা নিজের হাতে নিজের আমাশা তুলে ফেলে দিয়ে আসতে বলব। জল দিয়ে ধুইয়ে তবে ছাড়ব। হুঁ! আমাশা বলে যেখানে-সেখানে বসতে হবে? খিড়কির দোর খুলে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলেই পারতেন। এদিকে ভূতের ভয়। আবার মুখে
তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, ভটচাযমশাই নাকি?
কালীপদ হাসল। আবার কে? ক্যাক্টির বাগানের ওপাশে মাটিটুকু সিডবেড় করার জন্য খুঁজে রেখেছিলুম। হয়তো সেখানেই অপকম্ম করে গেলেন। হাতে গাড়ু নিতে পেরেছেন। আর পুকুরের দিকে যাবার কী দরকার? নোংরা মানুষ। বরাবর নোংরা।
কালীপদ থুথু ফেলল। বললুম, আহা! আমাশা হলে মানুষের জ্ঞানগম্যি থাকে না।
কালীপদ হাসতে হাসতে গেটের দিকে গিয়ে গেট ঠিকমতো বন্ধ আছে কি না দেখে এল। তারপরই আলো জ্বলে উঠল। ভটচাযমশাইকে কোথাও দেখতে পেলুম না।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন, লোডশেডিং সবখানেই হচ্ছে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে?
একটু হেসে বললুম, না। ভটচাযমশাইয়ের কাণ্ড! আমি আবছা দেখে চোর ভেবেছিলুম।
কর্নেল হাসলেন। আহা! বেচারার বড্ড আমাশা! বলে তিনি ঘরে ঢুকলেন। চিনে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আমি নিজে গেলে ভাল হত। তবে এতে থানার বাবুদের মনে সন্দেহ হত। তাই কালীপদই যাক রানীমার চিঠি নিয়ে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক দেখাবে।
এই রাস্তায় কালীপদ একা যাবে? রাস্তায় তো আলো নেই।
কালীপদকে তুমি চেনো না। বলে কর্নেল বারান্দায় গেলেন।
কালীপদ এগিয়ে আসছিল সাইকেল নিয়ে। সে এসে বলল, রানীমা বললেন, বোসসায়েবকে থানায় গিয়ে ফোন করতে হবে। চিঠি দিলেন। আমি যাব আর আসব। জবাকে বলে এলুম, আপনাকে কফি দিয়ে যাবে।
থানা কতদূরে?
বিজয়গড়ে ঢোকার মুখেই বড় রাস্তার ধারে। থানার বাবুদের কাউকে চিঠিটা দিয়েই চলে আসব। ওঁরা সায়েবকে টেলিফোন করে দেবেন। স্যার! দয়া করে যদি গেটটা একটু
কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে নামে বললেন, নিশ্চয়। ভটচাযমশাইয়ের আমাশা। তোমার বউ রান্নাঘরে। গেট ভেতর থেকে বন্ধ তো রাখতেই হবে।
কালীপদ সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে গেট খুলে বেরিয়ে গেল। কর্নেল গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে এলেন। বললেন, মিসেস সিংহ–মানে, রানীমা বলছিলেন, একটু দুরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। তাই এখানে লোডশেডিং কদাচিৎ হয়। বিশেষ করে শীতকালে তো হয়ই না। আজ হঠাৎ কেন যে হল!
উনি ঘরে ঢুকলে বললুম, বাচ্চুবাবুর ঘরের কোনও কথা হয়নি ওঁর সঙ্গে?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, তুমি এ প্রশ্ন করবে তা জানতুম। বাচ্চুর সেলার দেখার পর এই শীত সন্ধ্যায় তোমার একটু ইচ্ছে-টিচ্ছে জেগেছে।
ভ্যাট! বলে হেসে ফেললুম। তবে হ্যাঁ। বাচ্চুবাবু থাকলে এবং অফার করলে অন্তত দু-তিন পেগ হুইস্কি খাওয়া যেত। আপনি তো বিয়ার বা একটু-আধটু ব্রান্ডিতে সন্তুষ্ট। আপনিও বঞ্চিত হতেন না।
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, রানীমা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা তখন বলেননি। বললেন, যে, বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। কালীপুজোর পরদিন সকালে কালীপদ বাচ্চুকে ঘুম থেকে ওঠাতে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল, অন্যান্য রাতের মতো সে কাঠের বেড়া ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকেছে। হলঘরের দরজা সে না ফেরা অব্দি ভেজানো থাকত। বাচ্চু এসে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিত। তো কালীপদ দেখেছিল, সদর দরজা ভেজানো আছে। তা থাকতেই পারে। মাতাল। বাচ্চু দরজা বন্ধ করেনি। এই ভেবে কালীপদ ওপরে তার ঘরে যায়। তার ঘরের দরজাও ভেজানো ছিল। দরজা ঠেলতেই খুলে যায়। তারপর কালীপদ অবাক হয়ে দেখে, ঘরের বিছানাপত্র তচনচ হয়ে আছে। তাছাড়া টেবিলের ড্রয়ারগুলো বেরিয়ে আছে। ম্যাগাজিনগুলো মেঝেয় পড়ে আছে। আলমারি, ওয়াড্রোব আর সেলারের তালা ভাঙা। ছুটে গিয়ে সে রানীমাকে জানায়। রানীমা অনেক কষ্টে ওপরে উঠে নিজের চোখে সব দেখতে পান। এই ব্যাপারটা তিনি পুলিশকে, এমন কি বোসসায়েবকেও জানাননি। কারণ বিলিতি মদের সেলার থাকায় দত্তকপুত্র বাচ্চুর প্রতি প্রশ্রয় দেওয়াটা প্রকট হবে। লজ্জায় পড়ে তো যাবেনই। আসলে তখনও তাঁর মনে বাচ্চু সম্পর্কে কিছুটা স্নেহ ছিল। তিনি গোপনে মিস্ত্রি ডাকিয়ে নতুন তালার ব্যবস্থা করেন। তার আগে বাচ্চুর ঘর আগেরমতো সাজানো হয়েছিল। তাছাড়া সিন্দুকের চাবিটা বাচ্চু কোথায় রেখেছে, তা তন্ন তন্ন নিজে খুঁজেছিলেন। কালীপদকে সিন্দুক রহস্য ফাঁস না করে শুধু একটা অদ্ভুত গড়নের চাবির কথা বলেছিলেন। কাপীপদও ঘরে তেমন কোনও চাবি খুঁজে পায়নি। যাই হোক, এরপর তিনি নতুন তালা এঁটে দেন ঘরে।
পুরনো তালাটা কী অবস্থায় ছিল?
তালাটা চোর ভাঙা অবস্থায় বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিল। পরদিনও যখন বাচ্চু এল না, তখন কালীপদ বিজয়গড়ে গিয়ে তার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়েছিল। তারা বলেছিল, বাচ্চুকে তারা দেখেনি। এরপর রানীমা পুলিশে খবর দেন। বোসসায়েবকে চিঠি লিখে ডেকে পাঠান।
ব্যাপারটা তা হলে বোসোয়েবের খবরের সত্যতা প্রমাণ করছে! বাচ্চুকে খুন করে পুঁতে ফেলা হয়েছে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, বাচ্চুর পচাগলা লাশ যতক্ষণ না কোথাও পাওয়া যাচ্ছে, কিংবা লাশ পাওয়া না গেলেও যে তাকে সত্যি খুন করা হয়েছে, তার প্রমাণ না পাচ্ছি, ততক্ষণ সে জীবিত ধরে নিয়েই পা বাড়াতে হবে। যাই হোক, তুমি কৌতূহলী বলেই কথাগুলো জানালুম।
এতক্ষণে চাদরের ভেতর থেকে ফায়ার আর্মসটা বের করে বালিশের তলায় রাখলুম। কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর একটু হেসে বললেন, লোডেড ফায়ার আর্মস ওভাবে রাখতে নেই। তোমার বড় ব্যাগের চেন খুলে ঢুকিয়ে রাখো। ব্যাগে সাবধানে হাত দেবে। ওহ জয়ন্ত! তুমি মাঝে মাঝে অকারণে বড্ড বেশি ভয় পাও। ভাগ্যিস, আমাশা-আক্রান্ত ভটচাযমশাইয়ের দিকে গুলি ছোড়নি। হালদারমশাই হলে সত্যি অন্তত দু’রাউন্ড ফায়ার করে বসতেন।
কিছুক্ষণ পরে কালীপদর বউ জবা মাথায় ঘোমটা টেনে কফির ট্রে রেখে চলে যাচ্ছিল। কর্নেল বললেন, জবা, রানীমা এখন কী করছেন?
জবা মৃদুস্বরে বলল, ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। ঠাকুরমশাই কিছুতেই ডাক্তারের ওষুধ খেতে চাইছেন না। রানীমার কাছে আমাশার ট্যাবলেট আছে।
তোমার বাচ্চা কি এখনই ঘুমিয়ে পড়ল?
আজ্ঞে না। দোলনায় শুইয়ে রেখেছি। রানীমা একটা চাকা লাগানো ভাল দোলনা কিনে দিয়েছেন। ওপরে লাল বল ঝুলনো আছে।
তুমি অমন করে একা বাচ্চাটাকে ঘরে রেখো না!
না। রানীমা আমার টুকুনকে খুব ভালেবাসেন। নিজের ঘরের মেঝেয় দোলনা ঠেলে নিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে খেলা করেন।
বাহ। তা রানীমা তোমার বাচ্চাকে ভালবাসবেন বৈ কি। তোমার মা সুরবালা রানীমার কত সেবাযত্ন করত। আমি নিজে দেখেছি। তখন তুমি তো ফ্ৰকপরা মেয়ে।
কন্নেলসায়েবকে আমার মনে আছে। আমাকে লজেন্স চকোলেট কত কিছু দিতেন।
কর্নেল হাসলেন। তোমার মনে আছে তা হলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ কন্নেলসায়েব! রানীমা আমাকে আপনার কত গল্প শুনিয়েছেন। তবে দেখুন, উনি জাত-বিচার করেন না। রান্নার ঠাকুর ছিল। খুব চুরি করত। তাকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, জবা। তুই রান্না কর। আমি তোর হাতে খাব। আমি তো ভয়ে সারা। রাজবাড়ির রান্না আমি পারি? শেষে উনি কী করে কী রান্না করতে হয়, সব দিনে দিনে শিখিয়ে দিলেন।
বাচ্চুবাবু তোমার রান্না খেত তো?
খেত। বাচ্চুবাবুও খুব ভালমানুষ ছিল। নেশাটেশা করত বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি।
তুমি কালীপদর মতো লেখাপড়া একটু-আধটু শিখেছ, না শেখোনি?
রানীমা দুপুরবেলা আমাকে পড়া শেখান। নাম সই করা শিখেছি।
বাচ্চুবাবুর সঙ্গে টমসায়েবের মেয়ে আইভির আলাপ ছিল তুমি জানো?
জবা এই আকস্মিক প্রশ্নে একটু বিব্রত বোধ করছিল। আস্তে বলল, ওই মেমসায়েবই তো সর্বনাশের মূলে।
জবা! তুমি আমার মেয়ের মতো। লজ্জা কোরো না। বাচ্চুবাবুকে খুঁজে বের করতে আমি তোমারও সাহায্য চাই। আমি যা জিজ্ঞেস করব, ঠিক-ঠিক উত্তর দেবে তো?
আজ্ঞে কন্নেলসায়েব! যা জানি তা বলব বৈ কি।
কালীপুজোর রাতে নাকি বাচ্চুবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই দিনের কথা জানতে চাই। বাচ্চুবাবুর কাছে সেদিন কি তার কোনও বন্ধু এসেছিল? সকালে বা দুপুরে বা বিকেলে। কিছু মনে পড়ছে?
জবা আবার একটু ইতস্তত করার পর বলল, কাকেও আসতে দেখিনি। এলে মনে থাকত।
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, মেমসায়েব কি কখনও রানীমার অজান্তে এ বাড়ি এসেছে?
জবা মাথা নেড়ে বলল, না। এলে আমার চোখে পড়ত।
আচ্ছা, সেইদিনের কথায় আসছি। বাচ্চুবাবু কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল?
সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে আরতি হল। তারপর ঠাকুরমশাই এসে বাচ্চুবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চু, কালীপুজো দেখতে যাবে না? বাচ্চুবাবু রাগ করে বলল, আপনি যাবেন তো যান না! আমি যখন ইচ্ছে যাব। বাচ্চুবাবু দোতলায় তার ঘরের বারান্দায় ছিল। ঠাকুরমশাই নীচে। ঠাকুরমশাই বাচ্চুবাবুকে রাগিয়ে দিয়ে মজা পেতেন। যখন তখন মেমসায়েবের কথা বলে ঠাট্টা করতেন। বাচ্চুবাবু আরও খেপে যেত। কথাটা মনে আছে। ঠাকুরমশাই বললেন, তোমার মেমসায়েব কালীপুজো দেখতে এসেছে। জনসায়েব কোন মুল্লুকে বেড়াতে গেছে। দুপুরবেলা বাংলোয় যেতে দেখেছি মেমসায়েবকে। অমনি বাচ্চুবাবু খেপে গিয়ে বলল, তবে রে বিটলে বামুন! দেখাচ্ছি মজা! জবা হেসে ফেলল। ঠাকুরমশাই দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে পালিয়ে গেলেন। বাচ্চুবাবুও নেমে এসে দৌডুল। রানীমা ঘর থেকে বললেন, কী হয়েছে বাচ্চু? কাকে বকাবকি করছিস? বাচ্চুবাবু গেরাহ্যি করল না। তবে এমন প্রায়ই হত। ঠাকুরমশাই ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিতেন। সে এক রগুড়ে কাণ্ড। ঠাকুরমশাই যা মজার…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, আমি জিজ্ঞেস করছি বাচ্চুবাবু কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল?
জবা বলল, হ্যাঁ। রানীমার ঘরে টিভিতে একটা বই হচ্ছিল। রাত আটটার পরে। বাচ্চুবাবু বলে গেল কালীপুজো দেখতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে জবা। তুমি নিজের কাজ করো গে।