দু’নম্বর চাবি – ৩

০৩.

কর্নেলের সঙ্গী হয়ে এমন অনেক রাজবাড়িতে থেকেছি। কিন্তু এ যেন এক ‘যক্ষপুরী’। নীচের তলায় পশ্চিম প্রান্তে একটা বড় ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্নেলকে ‘যক্ষপুরী’ কথাটা বলায় উনি হাসলেন। বললেন হ্যাঁ। এই ফিলিংটা আমারও হচ্ছে। তবে আট বছর আগে কুমার বাহাদুর বেঁচে থাকার সময় বাড়ির অবস্থা এমন ছিল না। সারাদিন জমজমাট হয়ে থাকত। এ ধরনের ফ্যামিলিতে অনেক পরগাছা এসে জোটে। মিসেস সিংহ দেখছি সব নির্মূল করে ফেলেছেন। তারাও শত্রুতা করতে পারে। যাই হোক, আগে কফি খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক।

কালীপদ ট্রেতে কফির পট, কাপ-প্লেট আর বিস্কুট আনল। সে বলল, সেবার আপনি এর ওপরতলায় ছিলেন। ওই ঘরটা বাচ্চুবাবুর খুব পছন্দ। তাই ঘরটা উনি বেছে নিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন, বাচ্চুবাবু কে?

আজ্ঞে, ছোট কুমার বাহাদুরের ছেলে অলকেন্দুবাবু। ছোট কুমার বাহাদুর নিজের অংশ দাদাকে বেচে দিয়েছিলেন। উনি, রাঁচিতে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। শ্বশুরমশাইয়ের সব সম্পত্তি ভোগ করছেন। ওঁর দুই ছেলে। পুলকে আর অলকেন্দু। পুলকেন্দুবাবু ইঞ্জিনিয়ার। অলকেন্দুবাবু কলেজে ফেল করে বাউন্ডুলে হয়ে পড়েছিলেন। রানীমার কী খেয়াল হল, তাকে দত্তক নিলেন।

ভটচাযমশাইয়ের কাছে শুনলুম, বাবাবু গত মাসে নাকি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছেন?

কালীপদ গম্ভীর মুখে বলল, হ্যাঁ। কালীপুজোর রাতে পুজো দেখতে গিয়েছিলেন। তারপর আর পাত্তা নেই। তবে বলতে নেই স্যার, রানীমা মুখে যাই বলুন, তাঁর হাড় জুড়িয়েছে। হাবভাবে তো বুঝতে পারি। বাচ্চুবাবু তার ঘরে সারারাত বন্ধু বান্ধব নিয়ে মদ খেতেন আর গান বাজাতেন। কান ঝালাপালা হয়ে যেত। রানীমার সাধ্য ছিল না তাকে সামলান।

রানীমা তো তাকে খুঁজে বের করার জন্য যথাসাধ্য করেছেন শুনেছি।

তা করেছেন। একটা দায়িত্ব তো বটে। পুলিশ সায়েব–মানে ডি আই জি রানীমার পিসতুতো ভাইয়ের ছেলে। অরবিন্দ বোস নাম। বর্ধমানে তার অফিস। গত সপ্তাহে তিনি এসে বলে গেছেন, তাঁর হাতে খবর আছে বাচ্চুবাবুকে খুন করে লাশ কোথাও পুঁতে ফেলেছে খুনীরা। সেই খুনীদের তিনি শিগগির অ্যারেস্ট করবেন।

তা শুনে রানীমা নিশ্চয় খুব কান্নাকাটি করলেন?

কালীপদ চাপাস্বরে বলল, আজ্ঞে না। আপনি তো দেখেছেন। উনি খুব ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে। একেবারে পাষাণ-পাথর। বোসসায়েবের কথা শুনে শুধু একটা কথা বললেন। খুনীদের ধরার আগে আমাকে বাচ্চুর লাশটা এনে দেখাও। এ কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝিনি স্যার।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি উড়ো চিঠির কথা বলছিলে?

কালীপদ আগের মতো চাপাস্বরে বলল, গেটের ফাঁক দিয়ে কে ফেলে গিয়েছিল। আমি স্যার একটু-আধটু লেখাপড়া জানি। লাল ডটপেনে লেখা চিঠি। বাচ্চুবাবু নিখোঁজ হওয়ার পর গত তিন সপ্তায় তিনটে চিঠি। একই কথা লেখা।

এই সময় রানীমার সাড়া পাওয়া গেল। কালী। কর্নেলসায়েবদের জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করতে হবে না? তুই গিয়ে জবাকে সাহায্য কর।

কথা বলতে বলতে পর্দা তুলে ঘরে ঢুকলেন। কালী বলল, ট্রে গুছিয়ে নিচ্ছি। রানীমা! সায়েবদের কফি খাওয়া হয়ে গেছে।

সে ট্রে গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। রানীমা একটা চেয়ারে বসে ছড়িটা পাশে ঠেকা দিয়ে রাখলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, কালীটা বড় কথা বলে। আসলে ওর ব্যাপারটা বুঝতে পারি। কথা বলার লোক এ বাড়িতে আর পায় না। এক ওই হরেকেষ্ট। তবে হরেকেষ্ট ওকে পাত্তা দেয় না। কালী নিজের সঙ্গে বকবক করে।

কর্নেল বললেন, আগে আপনার দত্তক পুত্রের কথা বলুন। তারপর অন্য কথা।

 রানীমা আস্তে বললেন, কালীর কাছে কী শুনেছেন জানি না। তবে

কর্নেল দ্রুত বললেন, প্রথমে শুনেছি ভটচাযমশাইয়ের কাছে।

রানীমা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আমার ডিসিশনে ভুল হয়েছিল। বাচ্চুর জন্যই আমি বিপন্ন।

বিপদটা কী?

আপনি এ বাড়ির পাতালঘর দেখেছিলেন। সেই ঘরে একটা সিন্দুক আছে।

হ্যাঁ। কুমার বাহাদুর আমাকে দেখিয়েছিলেন। সিন্দুকের তালা দুটো চাবি ছাড়া খোলা যায় না।

আমি একটা চাবি বাচ্চুকে দিয়ে রেখেছিলুম। কারণ আমার বয়স হয়েছে। হঠাৎ মৃত্যু হলেই হল। বাচ্চু নিখোঁজ হওয়ার পর ওর ঘর তন্ন তন্ন খুঁজে সেই চাবিটা পাইনি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চাবিটা বাচ্চু সব সময় তার কাছে রাখত। যদি কেউ তাকে খুন করে থাকে, তা হলে চাবিটার লোভেই করেছে। এবার। আপনাকে তিনটে চিঠি দেখাচ্ছি। গত তিন সপ্তাহে গেটের ভেতর কুড়িয়ে পেয়ে কালী আমাকে দিয়েছে। কালী চিঠিগুলো পড়েছে। কারণ ভাজকরা খোলা চিঠি।

পেটের কাছে কাপড়ের ভেতর থেকে রানীমা একটা খুদে হ্যান্ড ব্যাগ বের করলেন। হ্যান্ড ব্যাগটা চেন দিয়ে কোমরের সঙ্গে আটকানো আছে দেখলুম। সেটা খুলে কর্নেলকে তিনি ভাজকরা তিনটে চিঠি দিলেন। চিঠিগুলো ছোট্ট। কর্নেলের পাশে বসেছিলুম বলে আমারও পড়া হয়ে গেল। তিনটে চিঠিতে একই কথা লাল ডটপেনে লেখা আছে।

‘রানীমা

দু’নম্বর চাবিটা চাই। মন্দিরের পেছনে চৌকো লাল পাথরের ওপর রেখে দিলে আমরা পাব। চাবি না পেলে প্রাণ যাবে। পুলিশকে জানিয়ে লাভ হবে না।‘

কর্নেল বললেন, ভটচাযমশাইয়ের কাছে শুনেছি, এলাকার পুলিশের ডি আই জি আপনার আত্মীয়। তাকে চিঠিগুলো কি দেখিয়েছেন?

অরবিন্দের ওপর আমার ভরসা নেই। তাই ওকে জানাইনি।

 কালীপদ জানিয়ে থাকতে পারে!

রানীমা শক্ত মুখে বললেন, জানিয়েছিল। অরবিন্দের কাছে আমি কথাটা গুজব বলে অস্বীকার করেছি।

কর্নেল চিঠিগুলো তাসের মতো ধরে বললেন, অরবিন্দবাবুর ওপর ভরসা না থাকার কি বিশেষ কোনও কারণ আছে?

নিশ্চয় আছে। সে তো কিছু করতে পারবে না। তার ডিপার্টমেন্টের লোকেদের সাহায্য নেবে। তাতে পাতালঘরের সিন্দুকের কথাটা অনেকে জেনে ফেলবে। তার চেয়ে বড় কথা, সরকারের উঁচু মহলে কথাটা পাচার হলে সরকার সিন্দুক বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। আমার স্বামী বলেছিলেন, সরকার এইসব জিনিস বাজেয়াপ্ত করার জন্য আইন করেছেন। সিন্দুকে কী আছে, তা তো আপনি দেখেছিলেন।

দেখেছিলুম। মোগল বাদশাহের ফরমান। বংশের প্রথম রাজা আদিত্যকান্তি সিংহের রাজমুকুট আর পোশাক। অনেক স্বর্ণমুদ্রাও দেখেছিলুম। সবই মোগল যুগের মোহর।

আমি বললুম, কালীপদ বা ভটচাযমশাই কি এ কথা জানেন?

 রানীমা আস্তে বললেন, না। কালী জিজ্ঞেস করেছিল কিসের চাবি? আমি জবাব দিইনি।

কর্নেল বললেন, বাচ্চুকে কি সিন্দুক খুলে দেখিয়েছিলেন আপনি?

সিন্দুক খুলে দেখাইনি। তবে ওকে পাতালঘরে নামবার জায়গা এবং কী কৌশলে সেখানে নামা যায় তা শিখিয়ে দিয়েছিলুম। আর বলেছিলুম, আমার মৃত্যু হলে দু’নম্বর চাবি আমার এই খুদে ব্যাগে থাকবে। ব্যাগটা সব সময় তামার সঙ্গে থাকে।

কর্নেল বললেন, চাবিটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন না। কোথাও গোপনে রেখে দেবেন।

 রানীমা দ্বিধার সঙ্গে বললেন, কিন্তু কোথায় রাখব?

এমন কোথাও রাখুন, যেখানে চাবি থাকার সম্ভাবনা কারও মাথায় আসবে না।

আপনি ঠিকই বলেছেন।

 আচ্ছা মিসেস সিংহ। এই চিঠির হাতের লেখা আপনার চেনা মনে হয়েছে কি?

রানীমা কর্নেলের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টে তাকালেন। একটু পরে বললেন, না তো। কেন ও কথা জিজ্ঞেস করছেন?

এমনি। বলে কর্নেল চিঠি তিনটে ভাঁজ করলেন। এগুলো আমি আপাতত রাখছি।

রাখুন। আপনার ওপর আমার আস্থা আছে। আমার স্বামী মৃত্যুর আগে বলে। গেছেন, কোনও বিপদে পড়লে যেন আপনার সাহায্য নিই। আপনার কীর্তি কলাপের কথা তার মুখে তো কম শুনিনি।

এবার একটা জিনিস চাইব।

বলুন?

বাচ্চুবাবুর ঘরে নিশ্চয় তালা আটা আছে। সেই ঘরের চাবিটা আমার দরকার।

পাবেন। ওপরে আমি উঠতে পারি না। তাই দোতলার সব ঘরে তালা দেওয়া আছে।

রানীমা খুদে ব্যাগটা পেটের কাছে কাপড়ের ভেতর চালান করে দিয়ে বললেন, এখন আর কথা নয়। আপনারা রাত্রি জেগে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট করে বিশ্রাম করুন।

কর্নেল হাসলেন। বিশ্রাম করব না। আপনার ক্যাকটাসের বাগানে ঢুকব।

রানীমা উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন, আমার নয়। কালীর। কালীকে এখন বাড়ির সব কাজ করতে হয়। ওর সঙ্গে জবার বিয়ে দিয়েছি। জবার মা সুরবালা মারা গেছে। জবা আমার সব সময়ের সঙ্গিনী। ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে। আশ্চর্য! বাচ্চাটা এত শান্ত! আমার ঘরের পাশের একটা ঘরে এখন ওরা থাকে। জবার হাতের রান্না খাই বলে হরেকেষ্ট আড়ালে ছি-ঘেন্না করে। করুক! ও তো শুচিবায়ুগ্রস্ত আকাট বামুন!

কর্নেল তার প্রসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বললেন, অসাধারণ বলেছেন! আকাট বামুন।

হ্যাঁ। যাকে বলে আষ্টেপিষ্টে সাত্ত্বিক বামুন। মাঝে মাঝে আমাকে শুনিয়ে বলে, সন্ন্যাস-ধর্ম নিয়ে হিমালয়ে চলে যাব। আমি বলি, ওরে হরেকেষ্ট! তুই তো এমনিতেই সন্ন্যাসী! হিমালয়ে চড়ে ঠ্যাং ভাঙবি কেন? মা সিংহবাহিনীর পায়ের তলায় পড়ে থাক গে। তাতেই তোর মোক্ষ ঠেকায় কে?

রানীমা মোটা ছড়িটা মুঠোয় ধরে চলে গেলেন। কর্নেল পশ্চিমের জানালায় বাইনোকুলারে কিছু দেখতে থাকলেন। আমি বললুম, ভদ্রমহিলার অসাধারণ মনোবল! সত্যি কর্নেল! আপনার সঙ্গী হয়ে এ যাবৎ অনেক রানীমা বা মহারানীও দেখেছি। কিন্তু এই বয়সে এমন ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা বিরল।

কর্নেল বললেন, আমিও একটা বিরল প্রজাতির সারস দেখতে পাচ্ছি জয়ন্ত। কী অদ্ভুত! টমসায়েন্ত্রে বাংলোর উত্তরে সরকারবাহাদুর একটা ওয়াটার ড্যাম তৈরি করে ফেলেছেন দেখছি।

ক্যাকটাস ফেলে সারসের পেছনে দৌড়বেন নাকি?

 দেখা যাক। মাই গুডনেস।

কী ব্যাপার?

নলপাহাড়ি টিলার মাথায় অশ্বত্থ গাছের ডালে একটা সেক্রেটারি বার্ড!

কালীপদ এসে বলল, রানীমা আপনাদের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট খেতে ডাকলেন স্যার!

কর্নেল বাইনোকুলার রেখে বললেন, কালীপদ! একিনোক্যাকটাস–মানে তুমি যেটাকে কুমড়োপটাশ বলতে, সেটার বংশ রক্ষা করেছ তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কুমড়োপটাশ বলতেন আসলে রাজবাড়ির দেওয়ানজি। তার মুখে। শুনে–তবে স্যার, হাইব্রিডিংয়ের শিক্ষা কুমার বাহাদুরের হাতে। আমি ক্যাকটির কয়েকটা জোড়কলম করেছি। আপনাকে দেখাব। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না স্যার!

কথা বলতে বলতে কালীপদ আমাদের একটা বড় হলঘরের ভিতর নিয়ে গেল। ঘরটা নানারকম স্টাফকরা বুনো জন্তু দিয়ে সাজানো। ভেতর থেকে দোতলায় জীর্ণ বিবর্ণ কার্পেটে মোড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে। তারপর দুটো ঘর পেরিয়ে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে ডাইনিং রুম। সেকেলে আসবাবে সাজানো। বিশাল ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজানো খাদ্যের প্লেট। রানীমা দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, কর্নেলের যোগ্য ব্রেকফাস্ট হল না। দিশি খাদ্যই খেতে হবে। লুচি, আলুর দম, সন্দেশ। অবশ্য এগপোচ আছে। এ বেলা একটু কষ্ট করে খান।

কর্নেল বললেন, কষ্ট কিসের? আমি তো আর বিলিতি সায়েব নই। ডালভাত পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

কুমার বাহাদুর বেঁচে থাকতে বাড়িতে গেস্ট এলে বাবুর্চি নিয়ে আসতেন। আপনার মনে পড়বে। টমসায়েবের এক ভাই ছিল চিত্তরঞ্জনে। মরিসসায়েব।

হ্যাঁ। ভদ্রলোক দুর্দান্ত শিকারি ছিলেন।

মরিসসায়েব এলে সঙ্গে মুসলমান বাবুর্চি আনতেন। তার জন্য আলাদা কিচেন তৈরি করা হত বটতলায়। আপনাকে লুকোব না। গোপনে তার রান্নাকরা খাবার খেয়েছিলুম।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কুমার বাহাদুর বলেছিলেন আমাকে। আপনি নাকি

 রানীমা হাসি চেপে দ্রুত বললেন, নাকি আবার কী? বললুম তো!

 মরিসসায়েব কি বেঁচে আছেন?

না। অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। কী সব দিন ছিল তখন!

টমসায়েবও তো মারা গেছেন?

 হ্যাঁ। ওর ছেলে জন চিত্তরঞ্জনে চাকরি করে।

টমসায়েবের একটি মেয়ে ছিল মনে পড়ছে?

লক্ষ্য করলুম রানীমার মুখ নিমেষে গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, বাবা জয়ন্ত। তুমি কিন্তু কিছু খাচ্ছ না! লজ্জা কোরো না।

বললুম, না না। আমি অনেক বেশি করে খাচ্ছি।

কর্নেল প্রশ্নটা চেপে গেলেন। খাওয়ার পর তার সঙ্গে কালীপদর ক্যাকটাস পরিচর্যা দেখতে গেলুম। সে ক্যাকটাসের কয়েকটা জোড়কলম দেখিয়ে দিয়ে রানীমার তাড়ায় সাইকেলে চেপে বাজার চলে গেল। এতক্ষণে বাড়ির চৌহদ্দি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেলুম। বাড়ির পূর্ব ও দক্ষিণের বাউন্ডারি ওয়াল উঁচু। কিন্তু জরাজীর্ণ অবস্থা। জায়গায়-জায়গায় ফাটলের মধ্যে কাঠের বেড়া আছে। পশ্চিমের পাঁচিল কবে ধসে গেছে বলে কাঠের বেড়া দেওয়া আছে। ওদিক দিয়েই আমরা রাজবাড়িতে ঢুকেছিলুম। কর্নেল ক্যাকটাসগুলো দেখতে দেখতে কী সব নাম উচ্চারণ করছিলেন। এক সময় তিনি বললেন, এপ্রিলের শেষাশেষি এগুলোর ফুলের কুঁড়ি দেখা দেবে। গ্রীষ্মে তো রঙবেরঙের ফুলের আগুন জ্বলে উঠবে। তখন যদি আসবার সুযোগ পাই, ছবি তুলে নিয়ে যাব। চলো! এবার মন্দিরের দিকটা দেখে আসি।

মন্দিরটা বিশাল। কিন্তু এদিকে কোনও দরজা নেই। মন্দিরের পাশে পুবের পাঁচিলে একটা দরজা দেখলুম। কর্নেল দরজার হুড়কো খুলে বললেন, পুকুরটার অবস্থা শোচনীয় দেখছি। আর পদ্মফুলও ফোটে না।

জিজ্ঞেস করলুম, মন্দিরের দরজা কোনদিকে?

কর্নেল পুকুরপাড়ে গিয়ে বললেন, মন্দিরটা এক সময় ছিল পাঁচিলঘেরা। উত্তরের ওই যে জমিটা দেখছ, ওখানে মেলা বসে। দরজা পরে দেখাচ্ছি। আগে সেই চৌকো লাল পাথরটা খুঁজে দেখি, যেখানে সিন্দুকের দু’নম্বর চাবি রাখতে বলা হয়েছে।

একটু পরেই মন্দিরের পেছনে পুকুরপাড়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে অনেক পাথরের চাঙড় দেখতে পেলুম। তারপর লাল পাথরটা চোখে পড়ল। কর্নেল বললেন, উপযুক্ত জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে। এখানে চাবি রাখলে সেই চাবি হাতিয়ে নিয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ আছে।

বলে তিনি বাইনোকুলারে এলাকাটা খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। তারপর আবার রাজবাড়িতে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। রাজবাড়ির দোতলা দালান এবং মন্দিরের মধ্যে প্রায় দশ মিটার চওড়া জায়গা। পুরোটা পাথরের ইটে বাঁধানো। কয়েক পা এগিয়ে ডানদিকে মন্দিরের দরজা দেখা গেল। দরজায় তালা আঁটা। উল্টোদিকে অর্থাৎ পশ্চিমে দালানের বারান্দা। দু’দিকে দুটো প্রকাণ্ড থাম। এই অংশটা একতলা। একটা তালাআঁটা ঘর দেখিয়ে কর্নেল বললেন, এই ঘরটায় ভটচাযমশাই থাকেন।

পাথরের ইটে বাঁধানো চত্বরের উত্তরে পাঁচিলটা মেরামত করা হয়েছে। সেখানে একটা প্রকাণ্ড দরজা এবং সেই দরজার কপাট লোহার। লাল রঙ করা হয়েছে কপাটে। কর্নেল বললেন, পুজোর সময় ওটা খোলা থাকে। মেলার লোকেরা দেবীকে দর্শন করতে আসে।

পাথুরে চত্বরে একটা সিঁদুর-মাখানো হাড়িকাঠ দেখে বললুম, পাঁঠাবলির ব্যবস্থা দেখছি!

কর্নেল হঠাৎ বারান্দায় উঠে গিয়ে ভটচাযমশাইয়ের ঘরের তালাটা আতস কাঁচ দিয়ে দেখতে থাকলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, একটু লক্ষ্য রাখো জয়ন্ত! রানীমা এসে পড়তে পারেন।

হতবাক হয়ে দেখলুম, কর্নেল পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে তালাটা খোলার চেষ্টা করছেন। তালাটা সাধারণ। একটু চেষ্টার পর খুলে গেল। উনি সটান ঘরে ঢুকে গেলেন। যেটুকু চোখে পড়ল, ঘরে একটা খাঁটিয়ায় বিছানা গুটানো আছে। কর্নেলের ইশারায় সরে আসতে হল।

কিছুক্ষণ পরে দেখি, রানীমা দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছেন। অমনি চাপাস্বরে ডাকলুম, কর্নেল! রানীমা!

অমনি কর্নেল বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করলেন। তালাটা আগের মতো এঁটে দিয়ে চত্বরে নেমে এলেন। গলা চড়িয়ে বললেন, রাঢ় অঞ্চলে শাক্তদেরই প্রাধান্য। এক সময় নাকি মোষবলি হত। এখন পাঁঠাবলি হয়। আগে রাজবাড়িরই কেনা ১০৮টা পাঁঠাবলি হত। আজকাল কতগুলো বলি হয় জানি না। চত্বরটা রক্তে ভেসে যেত।

রানীমা এসে বললেন, বলিদান বন্ধ হয়নি কর্নেলসায়েব! মেলা কমিটি রাজবাড়ির প্রথা বন্ধ করেনি। তবে আমি রক্ত দেখতে পারি না। ছাদে বসে মেলা দেখি। শুধু সন্ধিপুজোর দিন মন্দিরের বারান্দায় উপস্থিত থাকতে হয়। এই চত্বরটা পেরুনোর সময় চোখ বুজে থাকি। কেউ আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। আপনারা দেবী দর্শন করতে চাইলে মন্দিরের তালা খুলে দেব।

কর্নেল বললেন, এখন থাক। আমি মন্দিরের পেছনে সেই চৌকো লাল পাথরটা দেখে এলুম।

রানীমা বললেন, আমিও দেখেছি।

আপনার পক্ষে আর ওখানে না যাওয়াই ভাল। এতদিন খুব রিস্ক নিয়ে ঘুরেছেন।

রানীমা হাসলেন। বজ্জাতরা জানে, রাজবাড়ি থেকে বেরলে আমার হাতে কী থাকে!

ফায়ার আর্মস?

 রানীমার মুখে দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল। বললেন, আমার স্বামীর রিভলভারটা আমার নামে লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছি। অরবন্দিই কাজটা করে দিয়েছিল। তখন সে ছিল এস পি। আর আপনি জানেন, আমার স্বামী এক সময় আমাকে রাইফেল চালানো শিখিয়েছিলেন। চল্লিশ বছর আগের কথা। রাইফেল আর নেই। কিন্তু এ বয়সেও আমার হাতের টিপ ঠিকই আছে। সাধে কি বজ্জাতগুলো শুধু চিঠি দিয়েই চুপ করে আছে? তারা জানে, সামনে এলেই কী হবে।…