০১.
ভদ্রলোকের পরনে ফতুয়া এবং ধুতি। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। লম্বা নাক। চোখ দুটো টানা-টানা। কঁচাপাকা চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। কপালে ঘষা খাওয়া রক্ততিলক। গায়ের রং তামাটে। শক্ত-সমর্থ শরীর। ঘরে ঢুকে করজোড়ে নমস্কার করার সময় তার গিটবাঁধা ছোট্ট টিকি চোখে পড়ল। বিনীতভাবে বললেন, আমি বিজয়গড় থেকে আসছি। রানীমা আপনার কাছে একখানা পত্র পাঠিয়েছেন।
বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর হাতে একটা সচিত্র ক্যাকটাসের বই ছিল। মুখে চুরুট। সাদা দাড়িতে যথারীতি একটুকরো ছাই আটকে ছিল। চওড়া টাকে ঝলমল করছিল প্রতিফলিত সকালের রোদ। বইটা টেবিলে রেখে তিনি সহাস্যে বললেন, কী আশ্চর্য! ভটচাযমশাই না?
প্রৌঢ় ভদ্রলোককে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আজ্ঞে। আমার সৌভাগ্য কর্নেলসায়েব আমাকে এত বছর পরেও চিনতে পেরেছেন।
মোটে তো বছর আষ্টেক হবে। তাছাড়া আপনার চেহারা তেমনি আছে। তো চিঠিটা দিন।
আগন্তুক ভটচাযমশাই ফতুয়ার পকেট থেকে একটা সাদা মুখ আঁটা খাম বের করে কর্নেলের হাতে দিয়ে বললেন, রানীমা আপনাকে চিঠিটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর লিখে দিতে বলেছেন।
খামের মুখ ছিঁড়ে কর্নেল চিঠিটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, কুমার বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ গতবছর খবরের কাগজে দেখেছিলুম। ইচ্ছে ছিল আপনাদের রানীমাকে একটা চিঠি দিই। কিন্তু কেন যেন চিঠিটা আর লেখা হয়ে ওঠেনি। জয়ন্ত! আলাপ করিয়ে দিই। ইনি বর্ধমান জেলার বিজয়গড় রাজবাড়ির পুরোহিত শ্রীহরেকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ভটচাযমশাই! আমার এই তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
আমরা নমস্কার বিনিময় করলুম। ভটচাযমশাই জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আর সে রাজত্ব নেই। তবে রাজবাড়ি আছে। লোকেরা এখনও শ্রদ্ধাভক্তি করে। সিংহবাহিনী মায়ের নামে মেলাটাও বসে। ওই সময় যা ধুমধাম হয়। বছরের বাকি সময় খণ্ডহর পুরী। রানীমা একা বুকে আগলে রেখেছেন। তা বয়স প্রায় আশি বছর হতে চলল।
কর্নেল বললেন, ওঁর হাতের লেখা দেখে কিন্তু বয়স বোঝা যায় না। উনি এখন চলাফেরা করতে পারেন তো?
ভটচাযমশাই বললেন, ছড়ি হাতে সারা বাড়ি চক্কর দিয়ে বেড়ান। আর মায়ের আশীর্বাদে এখনও খালি চোখে দেখতে পান। শুধু লেখাপড়ার সময় চশমা দরকার হয়।
রাজবাড়ির সেই ফুলবাগান, ক্যাকটাস এসব টিকে আছে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সেদিকে রানীমার খুব দৃষ্টি আছে। মালী সেই কালীপদ এখনও আছে। কালীর বয়সও কম হল না। বছর পাঁচেক হল, রানীমা জোর করে তার, বিয়ে দিয়েছেন। সুরবালাকে আপনার মনে পড়বে কর্নেলসায়েব। তারই মেয়ে জবার সঙ্গে কালীর বিয়ে হয়েছিল। একটা বাচ্চা হয়েছে। মায়ের লীলা বোঝা কঠিন।
ভটচাযমশাই আবার হাসবার চেষ্টা করলেন। কর্নেল বললেন, আর আপনি?
আজ্ঞে না। বেশ আছি। মায়ের চরণে পড়ে আছি। সংসার বড় ঝামেলার জিনিস। কর্নেল চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।
আমি রানীমাকে পইপই করে নিষেধ করেছিলুম কর্নেলসায়েব। বিষয়-সম্পত্তি যা আছে, তা মেলা কমিটির নামে উইল করে রাখুন। রানীমা শুনলেন না। দত্তক নিলেন। তো নিলেন ওঁর দেওরমশাইয়ের সবচেয়ে নচ্ছার ছেলেটাকে। গত মাসে। সে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। আমার সন্দেহ, অলকেন্দু আর বেঁচে নেই। কেউ তাকে গুম করে ফেলেছে।
অলকেন্দুর বয়স কত ছিল?
কর্নেল শান্তভাবে এই প্রশ্নটা করলেন দেখে আমি অবাক।
ভটচাযমশাই বললেন, তা বছর পঁচিশ হবে। কলেজে ফেল করে নেশাভাঙ করে বেড়াচ্ছিল। আপনার কাছে রানীমা লুকোছাপা করতে পারেন। আমি করব না। মেয়েঘটিত ব্যাপার। ভটচাযমশাই চাপাস্বরে ফের বললেন, আপনার মনে পড়তে পারে। নদীর ধারে সেই টিলাটানলপাহাড়ি?
হ্যাঁ। টিলার গায়ে একটা বাংলো ছিল। টমসায়েবের বাংলো। সায়েব কি বেঁচে আছেন?
না। তার ছেলে জন চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভে অফিসার। আর মেয়ে আইভি বিজয়গড় মিশনারি স্কুলে টিচার ছিল। আইভির সঙ্গে অলকেন্দুর মেলামেশা ছিল। আইভির চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছিল। তারপর গত মাসে আইভি চাকরি ছেড়ে চিত্তরঞ্জনে চলে গেল। শুনেছি, সেখানে গিয়ে বিয়ে করেছে স্বজাতির ছেলেকে। এদিকে অলকে নিখোঁজ।
বাংলোয় এখন কে থাকে?
একজন চৌকিদার থাকে। মাঝে মাঝে জনসায়েব বউ-ছেলেদের নিয়ে ছুটি কাটিয়ে যায়। আইভিকে আর দেখতে পাই না।
কর্নেল বললেন, আপনি বলতে চাইছেন অলকেন্দু
তার কথার ওপর ভটচাযমশাই বললেন, জনসায়েব সাংঘাতিক লোক। তার অসাধ্য কিছু নেই।
আপনি রানীমাকে এ ব্যাপারে আভাসে কিছু বলেননি?
বলে ধমক খেয়েছিলুম। অলকের বাবা রাঁচি থেকে এসে পুলিশকে বলে ছেলেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। রানীমা তো যথাসাধ্য করেছেন। আপনি জানেন কি না জনি না, রানীমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় পুলিসের ডি আই জি। কিন্তু অলকের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।
ভটচাযমশাই দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দয়া করে একে যা লেখার লিখে দিন। আমি সাড়ে এগারোটার ট্রেন ধরব। বর্ধমান থেকে লি জংশন। সেখান থেকে গৌরাঙ্গডিহি। তারপর তিন মাইল সাইকেল রিকশা বা বাস, যা পাই। পৌঁছুতে রাত দুপুর। তা-ও যদি পর-পর ট্রেন পাই। নইলে কাল ভোর।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে তার প্যাড টেনে বের করলেন। তারপর চিঠি লিখে একটা খামে ঢুকিয়ে আঠা দিয়ে মুখ এঁটে নামঠিকানা লিখলেন। আমার চোখে পড়ল :
মিসেস বনশোভা সিংহ, রাজবাড়ি, বিজয়গড়, বর্ধমান…
ভটচাযমশাই চিঠিটা ফতুয়ার পকেটে ভরে নমস্কার করে উঠলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন।
বললুম, ভদ্রলোককে চা কফি কিছু খেতে বললেন না যে?
কর্নেল হাসলেন। উনি স্বপাক ছাড়া কিছু স্পর্শ করেন না। তাছাড়া চা-কফি তো বিষ গণ্য করেন। এই যে আমার ঘরে সোফায় বসেছিলেন। বাড়ি ফিরে স্নান করে পোশাক ছেড়ে তবে ঘরে ঢুকবেন।
বিজয়গড়ের রানীমা কী লিখেছেন দেখাতে আপত্তি আছে?
নাহ্। বলে কর্নেল চিঠিটা আমাকে দিলেন। পড়ে দেখলুম :
‘শ্রীযুক্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সমীপেষু…
মহাশয়,
আশা করি পরম করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদে আপনি কুশলে আছেন। আমার স্বর্গত স্বামীর কাগজপত্রের মধ্যে দৈবক্রমে আপনার নাম-ঠিকানা লেখা একখানি কার্ড পাইয়া আপনার কথা মনে পড়িল। তিনি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আমাকে বলিয়াছিলেন যে, বিপদে পড়িলে যেন আপনার সাহায্য প্রার্থনা করি। আমি বর্তমানে বিপদের মধ্যে আছি। সাক্ষাতে বলিব।
তবে সাক্ষাতের পূর্বে যদি অঘটন ঘটিয়া যায়, তাহা হইলেও আপনি যেন পশ্চাৎপদ হইবেন না।
ইতি–
বনশোভা সিংহ
রাজবাড়ি, বিজয়গড়’
চিঠিটা কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললুম, ভটচাযমশাইয়ের কথার সঙ্গে তার রানীমার কথার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না।
কর্নেল দাড়ির ছাই ঝেড়ে বললেন, মেলানো যায়। দত্তকপুত্র নিখোঁজ। তারপর এখন রানীমা সম্ভবত এমন কোনও আভাস পেয়েছেন যে, এবার তাকেও নিখোঁজ করে দেওয়া হবে। বিষয়-সম্পত্তি থাকার অনেক ঝামেলা।
তাহলে আপনার যাওয়া উচিত।
তোমারও।
আমি গিয়ে কী করব?
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য চমকপ্রদ স্টোরি পাবে। আজকাল পাঠকরা কাগজে ক্রাইম-স্টেনি খুব খাচ্ছে। সব কাগজে ক্রাইমের খবরের ছড়াছড়ি।
আপত্তি করে বললুম, ক্রাইম বেড়ে যাচ্ছে বলেই না কাগজে তার খবর বাড়ছে? খবরের কাগজ সমাজের দর্পণ। তাছাড়া মানুষকে সচেতন করার দায়িত্বও তো আছে।
এত যদি বোঝো, তাহলে তৈরি থেকো।
আপনি কবে যাচ্ছেন লিখলেন?
যত শিগগির যাওয়া যায়।
জায়গাটা ঠিক কোথায়?
বাংলা-বিহার সীমানায় একটা নদীর এপারে বিজয়গড়, ওপারে দুমকা জেলার সারংডি। ওই যে জানালার ধারে ক্যাকটাসটা দেখছ, ওটাকে অর্কিডও বলতে পারো। এপ্রিলে প্রকাণ্ড লাল ফুল ফুটবে। ওটার ফ্যামিলিনেম ফিলোক্যাকটাস। কিন্তু পার্সোনাল নেম ‘এপিফাইলাম হাইব্রিডাম’। এটা এনেছিলুম সারংডির জঙ্গল থেকে। প্রকৃতি কী রহস্যময়ী ডার্লিং! কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। ক্যাকটাস! অথচ জঙ্গলের গাছে ওর বাসা। কাজেই অর্কিড ভেবেছিলুম। কুমারবাহাদুর অমলকান্তি সিংহ আমার ভুল শুধরেছিলেন। প্রায় আট বছর ধরে ওর বংশ জিইয়ে রেখেছি। হাইব্রিড পদ্ধতিতে এপিফাইলামকে নাকি দশ বছর ধরে বংশানুক্রমিক রাখা যায়। আট বছর তো রাখতে পেরেছি।
বেগতিক দেখে হাই তুলে উঠে দাঁড়ালুম। প্রকৃতিবিদ ক্যাকটাস নিয়ে বক্তৃতা শুরু করেছেন। এরপর অর্কিড আসবে। তারপর প্রজাপতি। পাখি। ক্রমে ওঁর সামরিক জীবন। বললুম, আসি কর্নেল! একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। বাড়ি ফেরার পথে সেরে যাব।
এই সময় আবার ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী।
একটু পরে পর্দা ঠেলে সবেগে প্রবেশ করলেন প্রাইভেট ডিকেটটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই। তিনি সোফায় বসে প্রথমে একটিপ নস্যি। নিলেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন। আরে! জয়ন্তবাবুও আছেন দেখছি। খাড়াইয়া ক্যান? বয়েন! বয়েন!
বললুম, আপনাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে হালদারমশাই?
প্লিজ টেক ইয়োর সিট। বলে রুমালে নাক মুছে গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। কর্নেল স্যারের লগে কনসাল্ট করতে আইলাম।
কর্নেল বললেন, আগে কফি খেয়ে ধাতস্থ হোন। ষষ্ঠী আপনাকে যখন দেখেছে, তখন আর এক দফা কফি আসছে। জয়ন্ত! বসে পড়ো।
অগত্যা বসতে হল। কে কে হালদারের পুরো নাম কৃতান্তকুমার হালদার। এক সময় উনি পুঁদে পুলিশ অফিসার ছিলেন। রিটায়ার করার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলেন। ঢ্যাঙা শক্তসমর্থ মানুষ। ছদ্মবেশ ধরতে পটু। তাই মাথার চুলে পালোয়ানি ছট আছে। লম্বাটে মুখের গড়ন। কিন্তু চোখ দুটি তুলনায় ছোট। পাতলা গোফের ডগা সুচলো। উত্তেজনা বেশি হলে ডগাদুটো তিরতির করে কঁপে। ওঁকে কর্নেলের দেখাদেখি আমিও ‘হালদারমশাই’ বলি। এর পেছনে একটা পুরনো ঘটনা আছে। কলকাতার এক ধনী ব্যক্তির মেয়ের বিয়ের সময় ডাকাতি হওয়ার আশংকা ছিল। পুলিশের ওপর তত ভরসা না করতে পেরে ভদ্রলোক কর্নেলের শরণাপন্ন হন। অবশ্য সাদা পোশাকে পুলিশও মোতায়েন ছিল। কর্নেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারকে কনের মামা সাজিয়ে নিয়ে যান। কর্নেল কোনও সূত্রে টের পেয়েছিলেন, ডাকাতরা বরযাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবে এবং হিরে-মুক্তো-সোনার জড়োয়া গয়না পরে কনে বিয়ের আসরে এলেই। তারা হানা দেবে। তাই বিন্দুমাত্র আভাস পেলেই কর্নেল বলে উঠবেন, ‘হালদারমশাই! হালদারমশাই! আপনার ভাগনির চোখে পোকা ঢুকেছে!’ এটাই ছিল সঙ্কেত। হালদারমশাই কনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কথাটা শুনেই তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে রিভলভার বের করে চেঁচিয়ে ওঠেন, কোন কোন হালায় ডাকাত, আমারে দেখাইয়া দ্যান। গুলি করিয়্যা খুলি উড়াইয়া দিমু! অমনি হইচই শুরু হয়ে যায়। তিনজন ডাকাত ছিল বরযাত্রীদের ভিড়ে। তারা বেগতিক দেখে কেটে পড়ার তালে ছিল। তারা ধরা পড়ে যায়। তবে কে কে হালদার যে কর্নেলের সঙ্কেত বাক্য শুনে সত্যি রিভলভার বের করে ফেলবেন, কর্নেল তা কল্পনাও করেননি। প্ল্যানটা ছিল অন্যরকম। যাই হোক, সেই থেকে কে কে হালদার ‘হালদারমশাই’ হয়ে ওঠেন কর্নেলের কাছে। তবে আমি এই ঘটনা শুনেই বুঝতে পেরেছিলুম, এই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক বেজায় হঠকারী, বেপরোয়া এবং একরোখা মানুষ। ইংরেজিতে যাকে বলে সিন ক্রিয়েট করা, তা তাঁর মজ্জাগত। পরবর্তীকালে অনেক ঘটনায় তার এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। তিনি নিজেও প্রাক্তন পুলিশ জীবনের যেসব ঘটনা শুনিয়েছেন, তার মধ্যেও তার একই স্বভাব এবং প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে।
ষষ্ঠীচরণ কফি আনার পর হালদারমশাই বললেন, ভেরি ভেরি মিসটিরিয়াস কেস কর্নেল স্যার! ক্লায়েন্টের অ্যাডভান্স পাইলাম। বাট শি হ্যাজ বিন ভ্যানিশড়!
বললুম, কোনও মহিলা ক্লায়েন্ট?
হালদারমশাই কফি খেতে খেতে বললেন, মেমসায়েব। মিসেস আই জে নিউসন।
কর্নেল যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, নিউসন?
গোয়েন্দামশাই আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনি চেনেন?
নাহ্। তবে নিউসন নামটা কবে যেন শুনেছিলুম। কোথায় তা মনে নেই।
হালদারমশাই কফিতে ফুঁ দিয়ে প্লেটে ঢেলে খেতে শুরু করলেন। তারপর তিনি যে ঘটনা বললেন, তা সংক্ষেপে এই :
সম্প্রতি তিনি কলকাতার সব দৈনিকে তাঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপন দিলেই দু-একটা কেস তার হাতে আসে। গতকাল দুপুরে হোটেল এশিয়া থেকে মিসেস আই জে নিউসন নামে এক মেমসায়েব ফোন করে তার ফি জানতে চান। হালদারমশাই বলেন, কেস অনুযায়ী তিনি ফি নেন। তবে অগ্রিম পাঁচশো টাকা না দিলে তিনি কেস নেন না। মেমসায়েব তাঁকে বিকেল চারটে নাগাদ হোটেলের সাততলায় ৭০৭ নম্বর স্যুইটে দেখা করতে বলেন। হালদারমশাই গতকাল চারটেয় গিয়ে রিসেপশনিস্টকে মেমসায়েবের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানান। মহিলা রিসেপশনিস্ট তার নাম জানতে চান। নাম বলার পর মহিলা তাকে একটা মুখটা খাম দিয়ে বলেন, মিসেস নিউসন আধ ঘণ্টা আগে তাঁর স্বামীর সঙ্গে হোটেল থেকে চেক-আউট করেছেন।
হালদারমশাই হোটেলের বাইরে এসে খামের মুখ ছিঁড়ে দেখেন, তাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট এবং একটা চিঠি আছে। চিঠিতে লেখা আছে : একস্ট্রিমলি সরি। দা স্কাউন্ড্রেল হ্যাজ ট্রেসড মি। সো উই আর গোয়িং টু অ্যানাদার প্লেস। আই উইল কন্ট্যাক্ট উইদ ইউ ইন টাইম। চিঠির তলায় নামসই। সবটাই সবুজ কালিতে সিগনেচার পেনে লেখা।
যাই হোক, হালদারমশাই ধাঁধায় পড়েছেন। গণেশ অ্যাভেনিউতে তার এজেন্সি অফিসে যাওয়ার পথে তিনি কর্নেল স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছেন।
কর্নেল তাঁর কথা শোনার পর বললেন, নিউসন দম্পতি কোনও বদমাস লোকের হাত থেকে বাঁচতে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছেন না। আপনার সাহায্যে লোকটাকে জব্দ করার উদ্দেশ্য আছে বলেও মনে হচ্ছে না। কলকাতায় গুণ্ডা মস্তানের অভাব নেই। তাদের ভাড়া করলেই হত।
ঠিক। হালদারমশাই মাথা নাড়লেন। ঠিক কইছেন কর্নেল স্যার! দিস ইজ দা মিস্ট্রি।
বেশ তো। আপনি অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করুন। মেমসায়েব তো লিখেছেন, যথাসময়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
করব। কিন্তু তার হাজব্যান্ডই বা কেমন? ওয়াইফেরে বাঁচাইতে পারেন না ক্যান?
যথাসময়ে নিশ্চয় তা জানতে পারবেন। অগ্রিম ফি যখন পেয়ে গেছেন।
ঘড়ি দেখে গোয়েন্দাপ্রবর উঠলেন। তারপর অভ্যাসমতো যাই গিয়া বলৈ। সবেগে বেরিয়ে গেলেন।
দেখলুম, কর্নেল ড্রয়ার থেকে কাগজপত্র হাতড়ে একটা খুদে জীর্ণ নোটবই বের করলেন। তারপর সেটার পাতা ওলটাতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি মুখ। তুলে বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত! আশ্চর্য!
কী আশ্চর্য?
কোইনসিডেন্স। কিংবা আকস্মিকতা। নিউসন নামটা শুনেই আমার একটু চমক জেগেছিল। এখন দেখছি, আমার স্মৃতি ভুল করেনি। টমাস নিউসন! জয়ন্ত! বিজয়গড়ের কাছে নলপাহাড়ি টিলার সেই বাংলোটা টমাস নিউসনের। লোকে তাকে বলত টমসায়েব। এখন কথা হল, হালদারমশাইয়ের মক্কেলের নামের পদবি নিউসন। টমসায়েবের সঙ্গে কি এই মহিলার কোনও সম্পর্ক আছে?
নড়ে বসলুম। কর্নেল! ভটচাযমশাই আইভি নামে একটি মেয়ের কথা বলছিলেন। আইভির আদ্যক্ষর আই। অলকেন্দুবাবু নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে তার নাকি সম্পর্ক আছে।
হুঁ। টমসায়েবের মেয়ে। জয়ন্ত! এক মিনিট। হোটেল এশিয়ার ম্যানেজার আমার পরিচিত। তাঁকে রিং করা যাক। বলে কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, প্লিজ পুট মি টু ম্যানেজার মিঃ রাঘবন।… আই অ্যাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।…ইয়েস। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এন ফর নাইট..ওকে! ওকে!..মি রাঘবন। মর্নিং! প্লিজ লেট মি নো অ্যাবাউট মিসেস আই জে নিউসন। সেভেন্থ ফ্লোর। সুইট নাম্বার সেভেন ও সেভেন। শি হ্যাজ বিন চেকড আউট।..ইয়েস। দ্যাট আই নো। বাট আই ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট হার হ্যাজব্যান্ড। ওয়াজ হি এ হোয়াইটম্যান?..ইউ আর শিওর?…থ্যাঙ্কস মি রাঘবন!… ও নো নো। নাথিং টু বি ওয়ারিড। থ্যাঙ্কস এগেন।…
ফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বসলেন, মেমসায়েবের স্বামী দিশি সায়েব। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি! জয়ন্ত! রহস্য ঘনীভূত হল দেখছি। বলে তিনি চুরুট ধরালেন।…