দুজনার ঘর
তৃতীয় মানুষ এলে দুজনার ঘর টেকে না।
অনেক, অনেক মূল্য দিয়ে তবে এই সার জেনেছে কাজললতা।
.
বিস্ময়ের তাড়নায় তার ভয় উবে যাবার দাখিল। অনেকক্ষণ সঙ্গোপনে দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে। জমজমাট মনে হয়েছে দোকানটা। জলুস বেড়েছে, লোকজন বেড়েছে, খদ্দের বেড়েছে। দেখছিল আর বুকের তলায় কাটা-ছেঁড়ার ওপর যেন এক ধরনের খুশির প্রলেপ পড়ছিল।
কিন্তু নিভৃতের রোমাঞ্চ মিলিয়ে আসতে চোখের নজর বাড়ছিল। কাজললতার খটকা লাগছে কেমন। অত দূর থেকে ভালো ঠাওর করতে পারছে না। যদিও ওখানকার। ভিতরের আলো দিনের আলোর মত সাদা। তবু কি যেন এক ব্যতিক্রম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। একটাও চেনা মুখ চোখে পড়ছে না। পায়ে পায়ে এগোলো আরো একটু। জনা দুই অল্প বয়সের ছেলে কাজ করছে, আর তিনটি মেয়ে। আঠেরো থেকে বাইশ চব্বিশের মধ্যে হবে মেয়েগুলোর বয়েস। কাজললতা আরো একটু এগিয়ে তাদের দেখছে ভালো করে। চোখের দৃষ্টিটা খরখরে হয়ে উঠছে। এ আবার কি? এ কি দেখছে। কাজললতা?
নিজের জীবন-যাত্রা যেমনই হোক, সকল সংশয়ের উর্ধ্বের কোনো উগ্র শুচিশুদ্ধ মানুষকে জীবনের জটিল রাস্তায় চলতে দেখলে মন হঠাৎ যেমন ধাক্কা খায়, ওই মেয়েগুলোকে দেখে প্রায় তেমনিই একটা ধাক্কা খেয়ে উঠল, কাজললতা।
নিজের অগোচরে পায়ে পায়ে আরো একটু এগলো সে।
সুন্দর দূরে থাক, তেমন সুশ্রীও নয় একটা মেয়েও। তবে সাজগোজে শ্রী বাড়াবার চটক আছে। যে চটকে শ্ৰী আসলে নিষ্প্রভ হয়, কিন্তু চোখ টানে। পরনে উগ্র রঙের শাড়ি, গায়ে গলা ঘেঁষা টেপ ব্লাউস, হাতে এক এক বোঝা রঙবেরঙের কাঁচের চুড়ি, গালে ঠোঁটে রঙ।
এই বৈচিত্র্যের বুদ্ধি একদিন কাজললতাই দিয়েছিল। জীবিকার্জনের সেই যুগ্ম আসরে সে-ই প্রথম এবং একমাত্র নায়িকা ছিল। কিন্তু এ আবার কি? লোকটা কি এতদিনে তাহলে এই জটিল যুগে তাল ঠকে চলার সহজ রাস্তাটা চিনে ফেলেছে? কাজললতা যখন ওই আসরের নায়িকা ছিল, তখনো হয়ত লক্ষ্যের তফাৎ ছিল না খুব। কিন্তু এ যেন রাতের নিভৃতে প্রত্যাশার তাগিদে ঘরের স্ত্রীর কাছে আসা আর গণিকালয়ে যাওয়ার মধ্যে যেটুকু তফাৎ, অনেকটা সেই রকম। রুচির তফাৎ, শালীনতার তফাৎ।
নিজের অজ্ঞাতে আরো কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কাজললতা। প্রায় দোকানের সামনেই।
তারপর দ্বিতীয় ধাক্কা। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ওধারের ক্যাশবাক্সের সামনে মালিকের নির্দিষ্ট আসনটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে জাঁকিয়ে বসে আছে সম্পূর্ণ একজন অচেনা লোক।…বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে বয়স, রোগা, ঢ্যাঙা, পরিপাটি সাজ। উঠছে, তদারক করছে, আবার গিয়ে বসছে, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে নজর রাখছে, ক্যাশবাক্সে টাকা তুলছে।
দোকানের প্রায় দরজায় দাঁড়িয়েই নির্বাক বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকে দেখছে কাজললতা। মাথার মধ্যে সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেমন। সচকিত হয়ে খানিকটা পিছনে সরে এলো। মাথা উঁচিয়ে দুচোখ টান করে সাইনবোর্ডটা দেখল আবার।
দুজনার ঘর। সেই সাইনবোর্ড। লাল রক্তের অক্ষরে সেই লেখা। দুদিকে সেই দুটি নারী-পুরুষের মূর্তি। সেই ঘর।
কিন্তু এ কি দেখছে কাজললতা? আবার এগিয়ে একেবারে দরজার মুখে এসে দাঁড়াল। আবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখতে লাগল। বিশেষ করে মালিকের আসনের সেই লোকটাকে।
দুজনার ঘর জমজমাট বটে। যেমন তারা আশা করেছিল একদিন, প্রায় তেমনি। সে আর রাধাকান্ত। কাজললতা, আর রাধাকান্ত দুজনার ঘরের ওই বাইরের দিকটা বহুলোকের সমাবেশের প্রত্যাশাতেই খোলা ছিল। না, দুজনার ঘর বলতে সত্যিই দুজনের বাসের ঘর এটা নয়। কোনো কাব্যের ব্যাপারও নয়। এটা একটা সাইনবোর্ড। ওই সাইনবোর্ডে বড় বড় জ্বলজ্বলে রক্তের হরগে ওই কথাকটি লেখা। লেখার দুপাশে নিপুণ রঙের প্রলেপে একটি পুরুষমূর্তি আর একটি রমণীমূর্তি, আঁকা। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে আছে। এই চাওনিটুকু বড় জীবন্ত।
দুজনার ঘর বলতে দুজনার ঘর গড়ার উপকরণ যোগানোর দোকান এটা। বিজ্ঞাপনের চটকে বস্তুজগতে ভাগ্য বদলের অনেক বিস্ময়কর নজির আছে। কখন কোন্টা যে জনতার মনে দাগ কেটে বসবে বা চোখে ঘোর লাগাবে, তার স্থিরতা কিছু নেই। দাগ পড়ল কি ঘোর লাগল, অমনি কপাল ফিরল।
দুজনার ঘরের এখন অন্তত সেই কপাল। দলে দলে মেয়ে পুরুষ আসছে, জিনিস কিনছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। যে-কোনো বয়সের স্বামী-স্ত্রী অথবা যুগ্ম দয়িতা এই পথে। চললে ওই সাইনবোর্ডটা তাদের চোখ টানবে। পরস্পরের দিকে চেয়ে তারা মুখ টিপে হাসবে। কিছু কেনার থাকলে তারা এই দোকানেই ঢুকে পড়বে।
দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তারপর নিজের অগোচরে একটু একটু করে কাছে এসে এসেও এই দৃশ্যই দেখছিল কাজললতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কিন্তু সত্যিই এ কি দেখছে সে? মালিকের আসনে ওই লোকটা কেন? চোখে। পলক পড়ে না কাজললতার। দোকান-ঘেঁষা ফুটপাথে যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে আছে, কত লোক যে তাকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছে হুশ নেই। লক্ষ্য দোকানের মালিকও করল এক সময়। ভিতরের ভিড় কমেছে, তাই দেখছে। তারপর অনেকবারই চোখ গেল সেদিকে। উঠে এলো এক সময়। সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কিছু নেবেন? ভিতরে আসুন না–
কাজললতা থতমত খেল একপ্রস্থ। তারপর লোকটাকে আবার দেখল একটু। ভিতরে এসে দাঁড়াল সে। মহিলাটির হাবভাব দেখে দোকানের মালিক নন্দ ঘোষ বিস্মিত। উৎসাহিত হবার মত খদ্দের নয় কিছু, আটপৌরে বেশবাস, মোটসোটা গড়ন, কপালে নয়া পয়সার থেকে বড় জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ। দেখলেই বোঝা যায় তেমন অবস্থাপন্ন নয়, তেমন আধুনিকা তো নয়ই। তবু তার ঈষৎ-বিমূঢ় চাউনির মধ্যে কি যেন ছিল যা নন্দ ঘোষের খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি।
জিজ্ঞাসা করল, কি চাই বলুন?
কাজললতা আত্মস্থ হল এবার। কিছু বলতে হবে। অস্ফুটস্বরে বলল, মালিককে…
নন্দ ঘোষ এ রকম চাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না খুব।–আমিই মালিক, বলুন কি বলবেন?
তার মুখের ওপর কাজললতার চাওনিটা বদলাতে লাগল আবার। শূন্য দৃষ্টি লোকটার মুখের ওপর ঘুরল বারকয়েক। কি বলবে বা কিছু না বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসবে কিনা ভেবে পেল না।
আর নন্দ ঘোষের মনে হল, যা বলতে চায় এই অপরিচিতা, তা বোধহয় এত লোকজনের সামনে বলতে পারছে না। এখন ভিড় আরো পাতলা হওয়ায় ওই ছোঁড়া হুঁড়িগুলো এদিকেই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। এই অজ্ঞাত রমণীর প্রতি তার একটু কৌতূহল হল কেন কে জানে?…কিছু বলতে চায় নিশ্চয়, নইলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ও-ভাবে অতক্ষণ ধরে দোকানের দিকে চেয়ে ছিল কেন? আর ভিতরে এসেই বা। মালিকের খোঁজ করল কেন?
আচ্ছা, এদিকে আসুন
মালিকের আসনের পিছনে ছোট একটা খুপরি ঘর। এটা নিজস্ব বিশ্রামের ঘর নন্দ ঘোষের। সেখানেই নিয়ে এলো কাজললতাকে। তাকে বসতে বলল, তারপর। আবার জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?
কি বলবে কাজললতা? এ পর্যন্ত আসবে তা তো ভেবে আসেনি। একবারে ভিতরে ঢুকবে তা তো কল্পনাও করেনি। এই আসা, এই বসা, সব নিজের অজ্ঞাতসারেই ঘটেছে। কিন্তু জবাব কিছু দিতে হবে। লোকটা চেয়ে আছে। সে-ই নাকি মালিক এই দুজনার ঘরের। তার ব্যবহারেই হয়ত লোকটার চাউনি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে কেমন!
জবাব মাথায় এলো চকিতে। উদ্ভট কিছু নয়, নিতান্ত প্রয়োজনের জবাব। বাস্তব জবাব। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা উদগত অনুভূতি দমন করে নিতে হল আগে। এই পরিবেশ, এখানকার বাতাসই হঠাৎ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইল তাকে। ….এই চেষ্টাই আগে করবে বই কি কাজললতা। দরকারও তো। …যদি হয়, তারপর সবই জানতে পারবে।
নন্দ ঘোষের মুখের ওপর তার ডাগর দুই চোখ আটকালেন্সবার। বলল, একটা চাকরির জন্য এসেছিলাম।…খুব দরকার। দেবেন?
না, এবারে আর নন্দ ঘোষ খুব বিস্মিত হয়নি। এই রকমই কিছু যেন মনে হয়েছিল তার। শোনামাত্র তার ঘাড় নাড়ার কথা। এযাবৎ আগে দুপাঁচটা মেয়ে তার কাছে চাকরির জন্য এসেছে। তাদের হাবভাব অবশ্য এরকম ছিল না। তারা এসেছে, সবিনয়ে চেষ্টা করেছে, তারপর চলে গেছে।
কিন্তু এর বেলায় নন্দ ঘোষ কেন যে মাথা নাড়তে পারল না তক্ষুণি জানে না। রমণীটির প্রতি গোড়াতেই তার চোখ পড়েছিল কেন, মুখের দিকে চেয়ে সেটাই আগে বুঝে নিতে চেষ্টা করল। সামনের চেয়ারটায় বসল এতক্ষণে। পকেট থেকে সস্তাদামের সিগারেট বার করে ধরালো। ব্যবসায়ীর তির্যক দৃষ্টি।
কাজললতা প্রতীক্ষা করবে। ব্যগ্র প্রত্যাশা। লোকটার একটা হাঁ বা নার ওপর যেন জীবনমরণ নির্ভর। এই ব্যাকুলতাই যে তার স্বপক্ষে কাজ করছে জানে না। শোনার অপেক্ষায় ফর্সা মুখ ঘেমে উঠেছে তার।
নন্দ ঘোষ ভাবছে যেন। ভাবছে ঠিকই, আর আড়ে আড়ে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে কেন চোখে পড়েছিল তার! …ওই অতবড় জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপটার জন্যই বোধহয়। মুখখানা বড়সড়, চওড়া, আর বেশ ফর্সা–তাই বোধহয় মানিয়েছে ভালো। তাকালেই দু চোখ আগে ওই সিঁদুরের ধাক্কা খায়।
–থাকা হয় কোথায়? আপনি তুমি বর্জন করে একটা নির্লিপ্ত প্রশ্ন নিক্ষেপ করল নন্দ ঘোষ।
এই কাছেই। …বস্তিবাড়ির একখানা ঘরে।
আর কে আছে?
কাজললতাকে চেষ্টা করতে হয়নি, মুখ দিয়ে আপনিই নির্গত হয়েছে।
–মা।
খুব মিথ্যে বলেনি কাজললতা, সাত দিনের চেনা ওই বুড়ী যদি মা না হয় তো মা আর কে?
স্বামী কোথায়? কি করে?
প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে ভেবে নিচ্ছে নন্দ ঘোষ। সম্মুখবর্তিনীর সচকিত বিবর্ণ মূর্তিটা তাই ভালো করে চোখে পড়েও পড়ল না নিলে কেমন হয় তাই ভাবছে সে। বৈচিত্র্যের দিকটা ভাবছে।…যে মেয়েগুলো আছে দোকানে, তারা অতি আধুনিকা। ওই কেমন হাওয়া আজকাল, নইলে তাকালে তো গা রি-রি করে নন্দ ঘোষের। কিন্তু খদ্দের। তো কত রকমেরই আছে, অনেকের হয়ত তারই মত গা রি-রি করে। সে-স্থলে এই বৈচিত্র্য দেখলে হয়ত চোখ জুড়োবে। মুখশ্রী বেশ কমনীয়, মিষ্টি, তার ওপর ওই জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ চোখ টানেই। তার যখন টেনেছে, কত খদ্দেরের টানবে ঠিক কি! গেরস্থঘরের মেয়ে-পুরুষদের ভালো যে লাগবে তাতে সন্দেহ নেই। আসল কথা, অতি আধুনিকা আর সিঁদুরপরা গেরস্থঘরের বউ–দু-রকমই কাজ করছে দোকানে–এই বৈচিত্র্যটাই বড় বলে মনে হতে লাগল নন্দ ঘোষের।
তার প্রশ্নের জবাবে বিড়বিড় করে কি বলল, নন্দ ঘোষের ঠিক যেন কানে ঢুকল না। মুখভাব একটু অন্যরকম দেখছে কেন, তাও বুঝল না। আবার জিজ্ঞাসা করল, স্বামী এখানে থাকে না?
কাজললতার মুখে ঘাম দেখা দিয়েছে আবার। মাথা নাড়ল– থাকে না।
নন্দ ঘোষের খটকা লাগল কেমন। স্বামীর কথায় মুখখানা অমন হয়ে গেল কেন? জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বরাবরই এখানে থাকেন?
এবারও মাথা নাড়ল কাজললতা–অর্থাৎ এখানে থাকত না। কিন্তু মুখ বুজে থাকলে হবে না জানে। ঢোক গিলে মৃদু জবাব দিল, পাকিস্তানে থাকতুম, অদিন হল এসেছি।
অস্বস্তি…মিথ্যে বলার অস্বস্তি। কিন্তু খুব মিথ্যে নয় বোধহয়। পাকিস্তান বর্ডরেই তো নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। আর কদিন থাকলে কি হত কে জানে!..অদিন হল এসেছে, তাও সত্যি।
নন্দ ঘোষ যেটুকু বুঝবার নিজের মত করে বুঝে নিল। যে জায়গা থেকে আসছে। বলল তাতেই যেন সব বোঝা হয়ে গেছে। সর্বস্ব খুইয়ে এ-রকম তো কতই আসছে। বুক বেঁধে যত বড় করেই সিঁদুরের টিপ পরুক, সত্যিকারের আশাভরসা যে কতটুকু তা এই মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
নাম কি?
কাজল…
মুখের ওপর লোকটার যাচাইয়ের দৃষ্টি এই যেন প্রথম অনুভব করল কাজললতা। সম্পূর্ণ নাম আর বলা হল না।
সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ এখানে, রবিবারে শুধু ছুটি–সুবিধে হবে?
কাজললতা তক্ষুনি মাথা নাড়ল, হবে। আরো বেশি সময় থাকতে হলেও আপত্তি ছিল না। থাকতে না পারাটাই যেন যাতনা।
মাইনে কত চাই?
যা দেবেন।
আশায় আনন্দে দুচোখ চকচক করছে কাজললতার। মাইনের কথা সে একবারও ভাবেনি। দুজনার ঘরে তার জায়গা হবে কি হবে না, সেটাই একমাত্র ভাবনা।
হবে মনে হয়…।
হল। পরদিন থেকেই তাকে আসতে বলে দিল নন্দ ঘোষ। তারও মনে মনে হিসেব কষা শেষ হয়েছে। চার-চারটে মেয়ে সে দোকানে রাখতে পারবে না। আগামী সপ্তাহে মাস শেষ হলে ওই কেতকী মেয়েটাকে বিদায় করবে। যেমন চেহারা তেমনি মুখের ওপর কটকট করে কথা বলে। কালই ছাড়িয়ে দেবে তাকে।
কাজললতা বাইরে এসে দাঁড়াল। কিন্তু পা নড়তে চায় না। বিকেলে যখন আসে, ভাগ্যের এই যোগাযোগ কল্পনাও করেনি। দূর থেকে খুব সঙ্গোপনে একবার চোখের দেখা দেখে যাবে বলে এসেছিল। কিন্তু সব ওলট-পালট হয়ে গেল কেমন। কাজললতা যেন এখনো নিঃসংশয় নয়, একটু আগের ওই অধ্যায়টা সত্যি কিনা। যা দেখেছে আর দেখে এলো, তাই ঠিক কিনা!
এ কার বদলে কাকে দেখল সে? দুজনার ঘরের আসল মালিক গেল কোথায়?
.
..দুটি জিনিসের সুনাম আর দুর্নাম ছিল রাধাকান্তর। তার মগজে বুদ্ধি ছিল আর স্নায়ুতে রাগ ছিল।
কিন্তু এ দুটি জিনিসের সহঅবস্থান রীতি নয়। একের প্রকোপে অন্যটিকে নিষ্প্রভ। মনে হত। মাথা যখন খেলত, উৎসাহ আর উদ্দীপনায় তখন কারো বড় দোষও চোখে পড়ত না। আবার স্নায়ু যখন চড়ত তখন মনগড়া ত্রুটি আবিষ্কার করে ত্রাসের কারণ হয়ে উঠতেও দেরি হত না।
কিন্তু অবস্থার ফেরে স্নায়ুর উপর যত হাত পড়েছে মগজের উপর ততো নয়। স্টুডিওতে চাকরি করত। সিনসিনারি আঁকার কাজ। সে আর বটুক একসঙ্গেই কাজে কেছিল। ঠিক একসঙ্গে নয়– বটুক কদিন আগে ঢুকে তাকে ঢুকিয়েছিল। বটুকের মুখ ভালো চলে। গুছিয়ে কর্তাদের মনের মত ব্যবস্থাপত্র করা, সাজ-সরঞ্জাম জোগানো –এসব ব্যাপারে তার মাথা ভালো খেলত। কিছুকাল চাকরি করার পর কাঁচা টাকা রোজগারের পথটাও ভালই চিনেছিল। গণ্ডায় গণ্ডায় দশ টাকা রেটের এক্সট্রা আর্টিস্ট জুগিয়ে মাথা পিছু দুতিন টাকা বখরা আদায় করাটা আদৌ গর্হিত কাজ ভাবত না টুক! তাছাড়া পার্টির বিশ্বাসভাজন হয়ে খুচরো কেনা-কাটার ফাঁক দিয়েও মন্দ রোগার হত না তার। রোজগার যেমন করত, ওড়াতও তেমনি।
মনে মনে ওই লোকটাকেই রাধাকান্তর থেকে অনেক বেশি চৌকস ভাবত কাজললতা। বহু ব্যাপারে যোগ্য ভাবত। কিন্তু মনে মনে সে ভয়ই করত রাধাকান্তকে। এমন চণ্ডাল রাগ আর বুঝি দেখেনি। কত জায়গায় চাকরি করেছে ঠিক নেই। ওই মেজাজ নিয়ে কোথাও টিকে থাকে নি। স্টুডিওর চাকরিও কতবার যায়-যায় হয়েছিল, ঠিক নেই; প্রতিবারই ওই বটুকই বাঁচিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দোষটা পুরাপুরি রাধকান্তই ধরে নিয়েছিল কাজললতা। পয়সাওলা মালিকের যদি স্বভাবচরিত্রের বালাই না থাকে তো তার কি? আর ঈষং মত্ত অবস্থায় রাধাকান্তর আঁকা সিন অপছন্দ হওয়ার ফলে ঘরের বউকে টেনে একটা নিম্নস্তরের রসিকতা করে ফেলেই থাকে যদি তো সেইজন্য গায়ে ওরকম ফোস্কা পড়তে গেল কেন? আর রাগ হয়েছে বলে কি একেবারে মালিকের গলা টিপে ধরতে হবে?
কি হয়েছিল না হয়েছিল, বটুকের মুখে সবই শুনেছিল কাজললতা।
রাগ তো বলতে গেলে বিয়ের পর থেকে তারও।
কোন সাধ-আহ্লাদ মিটেছে তার? ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। অথচ কতরকম স্বপ্নই না, ছিল বিয়ের আগে। যে ঘরের মেয়ে কাজললতা, বিয়ের আগে তার রীতিমত প্রতিপত্তি ছিল বলা চলে পাঁচজনের কাছে। ওর মত সুন্দরী গোটা ব্যারাকের মধ্যে আর একজনও ছিল কিনা সন্দেহ। তার বাবা ছিল পুলিশ ব্যারাকের বাজার-সরকার। তাই স্বামীর থেকেও বটুকের কাজটা অনেক বেশি পছন্দ হত তার। তাছাড়া বটুক তার শিক্ষাদীক্ষার কদরও করতে জানত। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছিল কাজললতা। সেটা ওদের পরিবারে কম কথা নয়। এই লেখাপড়া আর এই চেহারা দেখেই পড়ন্ত মানীবংশের ছেলে হয়েও তাকে মনের আনন্দে নিজের ঘরে। নিয়ে গিয়ে তুলেছিল রাধাকান্ত। কিন্তু দুদিন না যেতে রূপের কদর, শিক্ষার কদর সব যেন ঘষা পয়সা।
তার উপর উঠতে বসতে শাসন। কাজললতার একটু সাজতেগুজতে ভাল লাগে, বিকেলে একটু রাস্তায় এসে দাঁড়াতে ভালো লাগে, আর সিনেমা দেখতে আর সিনেমার গল্প শুনতে কত যে ভালো লাগে তার ঠিক নেই। এই জন্যেই কি লোকটা কম। গঞ্জনা দিয়েছে তাকে?
এটে উঠতে পারে না শুধু বটুকের সঙ্গে। দুজনার ঝগড়া হয়, রাগারাগি হয়। কিন্তু বটুকের স্বভাব উল্টো বলে আবার ভাবও হয়। তাছাড়া উপকার তো কম করে না, ভাব না করে যাবে কোথায়? বটুক যখন সিনেমার গল্প করে বা কখনো জোর করে সিনেমায় নিয়ে যেতে চায়, অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও লোকটা বাধা দিতে পারে না।
চাকরি যাবার পর দিনে দিনে মেজাজের উন্নতি হতে লাগল রাধাকান্তর। মুখের দিকে তাকাতে ভয় করত কাজললতার। এদিকে দিন চলে না এমন অবস্থা। সেই দুঃসময়ে বটুক একটা মস্ত লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল কাজললতাকে। দিন পিছু দশটাকা হারে ছবিতে মুখ দেখাতে আপত্তি কি কাজললতার? কোথাও একটু কাঁদতে হবে, কোথাও একটু হাসতে হবে–কোথাও বা কিছুই করতে হবে না। সপ্রতিভভাবে একটু কাজ করতে পারলে উন্নতিও অবধারিত। দশটাকাটা বিশ পঁচিশ পঞ্চাশেও গিয়ে ঠেকতে পারে একদিন…বটুকেরই হাত, সে অনায়াসেই ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
রাধাকান্ত বাড়ি ছিল না। কাজললতা তার জন্য অপেক্ষা করছিল আর বাতাসে সাঁতার কাটছিল। তারপর রাধাকান্ত বাড়ি আসতেই বটুকের প্রস্তাবটা, আরো পবিত করে তার চোখের সামনে তুলে ধরেছিল।
রাধাকান্তর বুঝতে সময় লেগেছিল একটু। শেষ পর্যন্ত বুঝেছিল ঠিকই। সেই মুখের দিকে আর সেই চোখের দিকে চেয়ে কাজললতা সভয়ে পায়ে পায়ে সরে দাঁড়িয়েছিল। ভয়ে কাঠ সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বটুকের একদিনের গল্প মনে পড়ে গেল তার। কবে নাকি এক পরিচিত জ্যোতিষ দুই বন্ধুর হাত দেখে রাধাকান্তকে বলেছিল, রাগ-টাগগুলো সামলাও একটু, কবে না খুন করে ফাঁসীকাঠে ঝুলতে হয়!
..হঠাৎ মনে হল, সেই বীভৎস খুন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে লোকটার চোখে-মুখে। সেই কটা ত্রাসের মুহূর্ত কাজললতা ভুলবে না বোধহয়।
এর পরেই দিন ফেরাবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল রাধাকান্ত। দেশে কিছু জমিজমা ছিল, চেষ্টাচরিত্র করে তাই বিক্রি করে এলো। হাসিমুখতার হাতে সাড়ে তিন হাজার টাকা। কাজললতার কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা।
রাধাকান্তর মন স্থির। চাকরি আর নয়, গোলামী আর নয়। বরাতজোরে ভালো ঘর পেল একটা। অবশ্য তার জন্য সেলামী গুনতে হল হাজার টাকার ওপর। তারপর দিনকতক নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিজের হাতে সাইনবোর্ড না করতে বসল। দোকানের নাম শুনে তখন হেসে বাঁচেনি কাজললতা, দুজনার ঘর–মাথায় আসেও!
সেই সাইনবোর্ড শেষ হতে চোখে পলক পড়ে না কাজললতার। মাঝখানে বড় বড় লাল আগুনের হরপে দোকানের নাম–আর দুমাথায় দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে একজন মেয়ে আর একজন পুরুষ। মুচকি হেসে রাধাকান্ত মেয়েটাকে দেখিয়ে বলেছিল, তোমার মুখের আদল এনে দিলাম।
শোনার পর কাজললতার মনে হচ্ছিল সেই রকমই যেন। খুশিতে আনন্দে তাগিদ দিয়েছিল, ওই লোকটার মুখও বদলাও। রাধাকান্ত বলেছে, দোকানে কেউ ঢুকবে না তাহলে!
দোকান হয়েছে। স্টেশনারি আর ছোটখাট হোসিয়ারী মিলিয়ে একসঙ্গে দোকান। এই সঙ্গে নৈমিত্তিক ঘরকন্নার সামগ্রীও কিছু রেখেছে। দোকান করতে বসে রাধাকান্তর নেশা চেপে গেল যেন। কম করে আরো হাজার দেড়েক টাকা চাই চাই-ই। এবার স্ত্রীকেই পরামর্শ দিল, টাকাটা বটুকের কাছ থেকে ধার পাবার চেষ্টা করতে। নিজে চাইলে দেবে কিনা সন্দেহ, কিন্তু কাজললতা চাইলে নিরাশ করবে না হয়ত। যেমন করে হোক যোগাড় করে দেবে।
দিল। ধার করেই এনে দিন নাকি। বলা মাত্র এত টাকা ধার পায় যে, তার ওপর কাজললতার একটু শ্রদ্ধা বাড়াও স্বাভাবিক। দোকান চলতে লাগল। কাজললতাও যখন দোকানে কাজ করার প্রস্তাব দিল, রাধাকান্তর খুশি ধরে না। লোক তাহলে আর একজনের বেশি রাখতেই হবে না–আর স্বামী-স্ত্রী দুজনে দোকান চালাচ্ছে, এই বৈচিত্র্য যে লোক টানবে তাতে তার একটুও সন্দেহ ছিল না।
ছটা মাস এই এক নেশার মধ্যেই কেটে গেল। কিন্তু টাকায় টান পড়ছেই। দোকানের টাকা ভেঙেই খেতে হচ্ছে। দোকান বড় করতে হলে আরো টাকা চাই। ওদিকে বটুকের কাছ থেকে আর টাকাপয়সা দূরের কথা, আভাসে ইঙ্গিতে আগের টাকাই ফেরত চাইছে সে। যার কাছ থেকে টাকা এনে দিয়েছিল সে তাগিদ দিচ্ছে।
ইদানীং বটুককে একটু খাতির করেই চলছে রাধাকান্ত। কাজললতাও। লোকটা উপকার তো কম করে না। ফঁক পেলে দোকানে এসে দাঁড়ায়, সাহায্য করে। সেই লোক টাকার কথা বলতে রাধাকান্ত বিপদ গনল। আবারও স্ত্রীকেই পরামর্শ দিল, ওকে একটু বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে।
বোঝাতে গিয়ে তাকে চোখই রাঙাল কাজললতা, এখন টাকা চাইছেন মানে! টাকা দেব কোত্থেকে? উল্টে আরো টাকার যোগাড় দেখুন। বটুক হেসেছে একগাল। বলেছে, তুমি বললে তাও পারি না এমন নয়!
এদিকে দোকান করার নেশা কাজললতার অন্তত কমে আসছিল একটু একটু করে। আর সেটা যে ঠাট্টা-ঠিসারায় কমিয়ে আনছিল বটুকই, সেটা তখন অন্তত মনে হয়নি। এই দোকান করার ফাঁকে লোকটা আপন মনের মত আরো অনেক কাছে এসে গেছে। রাধাকান্ত মাল সংগ্রহের কাজে বেরোয়, দোকান চালায় তখন বটুক আর কাজললতা। বটুক নিজের কাজ কামাই করে প্রায়ই! তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসি-আনন্দের মধ্যে দোকান চালাতে ভালই লাগে কাজললতার। ফাঁক পেলে বটুক সিনেমার মজার মজার গল্প শোনায় তাকে। বিশেষ করে আর্টিস্টদের গল্প। কাঁচা নোট কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে সেখানে, সেই গল্প। একস্ট্রা আর্টিস্টকে ইচ্ছে করলেই সে নাকি এখন দিন পিছু দশ টাকার জায়গায় কুড়ি টাকাও পাইয়ে দিতে পারে।
শুনে কাজললতার বুকের ভিতরে দোলা লাগে। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে।
এদিকে রাধাকান্তর ওপর টাকার চাপটা শিথিল করল না সে। অপর দিকে সমর বুঝে কাজললতাকে জানিয়ে রাখল, অবুঝ লোকটাকে বশে আনার জন্যেই তার এই কারসাজি। চাপে পড়ে কাজললতাকে একটু স্বাধীন হতে দিলে সে-ই কাড়ি কাড়ি টাক এনে দিতে পারে। স্বাধীন হতে দিলে! কথাটা কোথায় গিয়ে যে স্পর্শ করেছিল, কাজললতা জানে না। তার মনে হতে লাগল, বিয়ের পর থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে সে এক অবুঝ শাসনের শিকলে বাঁধা।
সেই থেকে মন্ত্রণা শুরু। বটুক আরো বেশি করে ধার শোধের চাপ দিলেও তার আপত্তি নেই। তাকে স্বাধীন হতে দিলে টাকা রোজগার করে সে তো এই দোকানেই ঢালবে–দোকান ফাঁপিয়ে তুলবে। তাছাড়া যে স্বাধীনতার স্বপ্ন সে দেখছে, তার কাছে। এই দোকানও একটা পিঞ্জরের মত।
তার এই স্বপ্নের ঘোরে কতখানি এগিয়ে এসেছিল বটুক, কাজললতা দেখেও দেখতে চায়নি। তার হাতে কাঁধে হাত রাখলে কাজললতার মুখ লাল হয়েছে। বটুক অমনি টিপ্পনী কেটেছে, থাক, আর ছবিতে নেমে কাজ নেই!
তারপর সেই একদিন…।
শনিবার। দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ হবে। রাধাকান্ত দেশে গিয়েছিল যদি আর কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারে। দেশে তখনো তার দখলে মজা পুকুর ছিল একটা। সেদিন ফিরতেও পারে, না-ও পারে। ফেরে যদি অনেক রাতে ফিরবে।
কিন্তু আসলে রাধাকান্ত যে কোথাও যায়নি, সেটা এরা কেউ জানত না। যথাসময়ে দোকানের লোহার দরজা টেনে দেওয়া হয়েছে। কালো ভারী ক্যানভাসের পরদাটাও। দুজনে ঘেঁষাঘেঁষি দুটো টুলে মুখোমুখি বসে তন্ময় হয়ে জল্পনা-কল্পনা করছে। কেমন। করে ঘরের অবুঝ লোকটাকে বোঝানো যায়? কি কৌশলে কাজললতা এটুকু স্বাধীনতা আদায় করতে পারে? তার একটা হাত বটুকের হাতের মুঠোয়। সন্ধ্যা কখন পেরিয়ে গেছে খেয়াল নেই।
কখন লোহার গেট সরেছে, কখন পুরু ভারী পরদাটা নড়েছে তারা টেরও পায়নি। পাবে কি করে, উঁচু কাউন্টারের ওধারে ওদিক ফিরে দুটো নিচু টুলে বসে দুজনে।
..তবু ষষ্ঠ চেতনা বলে আছে কিছু বোধহয়।
কাজললতা মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে একসময়।
পরক্ষণে ভয়ে বিবর্ণ পাণ্ডুর একেবারে। দুজনেই। কাউন্টারের ওধারে রাধাকান্ত দাঁড়িয়ে।
কিন্তু কাজললতা কি দেখেছিল সেই চোখে? আর সঙ্গে সঙ্গে কি মনে পড়েছিল তার?
মৃত্যুর আঘাতে স্তব্ধ পশুর শেষ অব্যক্ত যাতনা আর অব্যক্ত হিংসা যেন গলে গলে পড়তে দেখেছে ওই দুটো চোখে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছে সেই জ্যোতিষীর কথা-খুন করে ফাঁসীকাঠে ঝোলার কথা।
কেমন করে দোকান থেকে তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কাজললতা জানে না। আর কি করবে এখন, তাও জানে না।
চমকে ফিরল।…বটুক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসেছে।
তারপর…
হ্যাঁ, তারপর দূরে অনেক দূরে পালিয়ে আসার পর, পরপুরুষের লোলুপ হিংস্র বীভৎসতা, আর নির্দয় নগ্ন অত্যাচারই দেখেছে সে। গা-ঢাকা দিয়ে থাকা দরকার বুঝিয়ে বটুক পাকিস্তান বর্ডারে এনে ফেলেছিল তাকে। সময় আর সুযোগ বুঝে তাদের ফেরার কথা।
কিন্তু ফিরেছিল কাজললতা একাই। খুব সঙ্গোপনে। বটুকের চোখে ধূলো দিয়ে। …বটুকের নেশা কেটেছে। কুৎসিতদর্শন লুঙ্গিপরা লোকের সঙ্গে গোপনে সলাপরামর্শ করতে দেখেছিল তাকে কাজললতা। তার মতলব বুঝেছিল। সেই দিনই পালিয়েছিল।
সাত দিন হয় কলকাতায় ফিরেছে। তাকে আশ্রয় দিয়েছে প্রায় অন্ধ এক বুড়ী। ট্রেনে যোগাযোগ তার সঙ্গে। সে তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, কলকাতায় কোনো বাড়িতে কাজ জুটিয়ে দেবে একটা। বুড়ীর কোথাও কেউ নেই তেমন–বোনপোর কাছে এসেছিল। কলকাতায় দুতিনটে বস্তি-ঘর ভাড়া খাটায় সে।
কলকাতায় এসে কাজললতা জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ কপালে পরতে শুরু করেছে। শুধু পুরুষের কবল থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে, তাদের কৌতূহলের তাড়না থেকে নিজেকে বাঁচানোর দায়ে। কপালের এই জ্বলজ্বলে সিঁদুর একটা জোরালো নিষেধের কাজ করছে শুধু। সত্যমিথ্যেয় বুড়ীমাকে কি বুঝিয়েছে সে ভালো মনে নেই। কপালে অমন টকটকে সিঁদুর দেখে সে বলেছিল, আহা, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, বেঁচে থাক মা। এই সিঁদুরের টানেই মরদটা একদিন ফিরে আসবে দেখিস।
দিনে দিনে খুশি উপচে উঠছে নন্দ ঘোষের। সে যে এমন একজনকে দোকানে। লাগিয়েছে, ভাবতেও পারেনি। দোকানটাকে নিজের বলে ভাবতে পারে বটে মেয়েটা। সকালে সকলের আগে এসে নিজের হাতে ঝটপাট দেয়, তারপর খুঁটিনাটি যাবতীয় কিছু ঝেড়ে মুছে তকতকে করে তোলে।
অন্য মেয়েদের কারো গাফিলতি দেখলে সত্যি সত্যি রেগে যায়, বকাবকিও করে। কাউকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেও যেন তার চোখ টাটায়।
চারটে মাস না যেতে দোকানের আসল মালিক যে কে, এই ভুল হবার দাখিল অন্য কর্মচারী আর কর্মচারীণীদের। তাছাড়া নন্দ ঘোষকে সে পরামর্শও দেয়, এই করুন, এইসব জিনিস দোকানে এনে রাখুন। নন্দ ঘোষ তার প্ল্যান কাজ করে। দেখেছে, লাভ বই লোকসান হচ্ছে না। দোকানের এতটুকু ভালোর জন্যে এত উদবেগ। আর এমন উদ্দীপনা দেখে নন্দ ঘোষ যথার্থ অবাক হয়েছে এক এক সময়। পরীক্ষা করার জন্য ক্যাশের ভারও ছেড়ে দিয়ে দেখেছে এক-একদিন। দিয়েছে বটে, কিন্তু চোখ ঠিকই রয়েছে। একটা নয়াপয়সাও গরমিল হয়নি। নিজের জিনিস নিজের চুরি করার যেমন কথা ওঠে না, এ যেন তেমনি। ওদিকে খদ্দেরও বাড়ছেই।
তিন মাসের মধ্যেই নন্দ ঘোষের ভালো লাগতে শুরু করেছে। এই ভালো লাগাটা দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। কাজললতা তা ভালো করেই টের পেল। কিন্তু কিছু যায় আসে না যেন। কাজললতা শুধু এই দোকানটাকেই বড় করে তুলতে চায় আর সব কিছু ভুলতে চায়। দিনকে-দিন এই শুধু এক নেশার মত পেয়ে বসছে তাকে। লোকটা দুর্বল হলে যদি তার কর্তৃত্ব বাড়ে, আর আরো বেশি নিজের বলে ভাবতে পারে দোকানাটাকে–তার একটুও আপত্তি নেই। দোকান বড় করে তুলে কাজললতা যেন অদৃশ্য কারো ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে আর প্রায়শ্চিত্ত করছে।…আর পরপুরুষকে প্রশ্রয় দেওয়া? এখনো কপালের সিঁদুর তেমন করে লোকটাকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি বটে, কিন্তু পর বলে সত্যিই কিছু আছে নাকি এখনো?
কাজললতা শুধু দোকানটাকে আকাশছোঁয়া বড় করে তুলতে চায়, আর কিছুই চায় না। একটু প্রশ্রয় না পেলে লোকটা সে সুযোগ দেবেই বা কেন তাকে? এক একসময় চমকে ওঠে কাজললতা, তার কি মাথাখারাপ হল? নইলে মালিকের আসনের ওই লোকটাকেসুষ্ঠু সময় সময় রাধাকান্ত বলে ভাবতে চেষ্টা করে কেন? কেন ভাবতে ইচ্ছে করে, যা ঘটে গেছে তার সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়?
ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে নন্দ ঘোষ। দোকানের উন্নতি প্রসঙ্গে আলোচনার হলে, দোকানের নানা সমস্যা নিয়ে আলাপের ছলে। এই আলাপ চলে দোকানে যখন আর তৃতীয় কেউ থাকে না, তখন। দোকান বন্ধ হবার পরেও দোকান নিয়ে মাথা ঘামায় দুজনে বসে।
নন্দ ঘোষের মাথা গরম হতে থাকে, হৃৎপিণ্ড লাফালাফি করতে থাকে, চোখের দৃষ্টি বদলাতে থাকে।
সেদিন শুক্রবার। একটা মেয়ের চাকরি চলে গেল। ঠারেঠোরে মেয়েগুলো প্রায়ই হাসাহাসি করত। সেই মেয়েটা সেদিন মুখে মুখে তর্কই করল কাজলল তার সঙ্গে। বলল, তুমি দোকানের কে যে কথায় কথায় চোখ রাঙাও?
কে সেটা তক্ষুনি তাকে বুঝিয়ে দিল নন্দ ঘোষ। পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করল তাকে।
পরদিন শনিবার।
তিনটেয় দোকান বন্ধ। বন্ধ হল। কাজললতা আর নন্দ ঘোষ ছাড়া আর সকলে চলে গেল। লোহার গেট প্রায় সবটাই টেনে দেওয়া হল, ভারী কালো পর্দা পড়ল।
একটু বাদে নন্দ ঘোষ বেরিয়ে খাবার নিয়ে এলো দুজনের জন্য। প্রতি শনিবারে দোকান বন্ধ হলে কম করে ঘণ্টা দুই ধরে দোকানের জিনিসপত্র নতুন করে সাজায় কাজললতা, গোছগাছ করে। নন্দ ঘোষ ততক্ষণ অপেক্ষা করে আর দেখে চেয়ে চেয়ে। তারপর একসঙ্গে খায় দুজনে বসে।
খাওয়া শেষ হল। কাউন্টারের ওধারে ছোট টুলে মুখোমুখি বসে একসঙ্গে গোটাপাঁচেক সমস্যার ফিরিস্তি দিল কাজললতা। নিজেই আবার সমাধানের রাস্তা খুঁজতে লাগল। কারণ নন্দ ঘোষ বেশির ভাগই চুপ। চেয়ে আছে। দৃষ্টিটা ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
কাজললতার হঠাৎ খেয়াল হল, তার একখানা হাত লোকটার হাতের মুঠোয় চলে গেছে কখন। ওদিকে সন্ধ্যাও কখন পার হয়ে গেছে।
কাজললতার দুচোখ তার মুখের ওপর থমকালো।
তুমি অত বড় সিঁদুরের টিপ পরো কেন? অস্বস্তি বোধ করে বলেই বোধহয় কথা কটা বেরুল নন্দ ঘোষের মুখ দিয়ে।
কাজললতা জিজ্ঞাসা করল, ছোট করতে হবে?
নল ঘোষের মুখের দিকে চেয়ে আছে শুধু। জবাব দিয়ে উঠতে পারল না। করলে খদ্দেরদের কাছে দোকানের বৈচিত্র্য নষ্ট হবে কিনা ভেবে পেল না।
চেয়ে আছে কাজললতাও।
সচকিত হয়ে হঠাৎ বিষম চমকে উঠল দুজনেই। কাউন্টারের ওধারে দাঁড়িয়ে আছে কে।
কে- কাজললতা চিনল না। একটি বউ…কপালে সিঁথিতে সিঁদুর, কোলে একটি ফুটফুটে ছেলে। কিন্তু এ কি দেখছে কাজললতা? এরকম আর কবে দেখেছিল?
..মৃত্যুর আঘাতে স্তব্ধ পশুর সেই শেষ অব্যক্ত যাতনা আর সেই অব্যক্ত ক্রুর হিংসা যেন গলে গলে পড়ছে। এই দুই চোখেও। ঠিক যেমন দেখেছিল রাধাকান্তর চোখে।
বিমূঢ় মুখে নন্দ ঘোষের দিকে ফিরতেই কাজললতা বুঝতে পেরেছে ছেলে কোলে বউটি কে। সঙ্গে সঙ্গে নির্বাক পাথর যেন কাজললতা।
সামলে নিয়ে নন্দ ঘোষ রূঢ় কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল প্রায়, তুমি এখানে। কেন? ও-যাও বলছি, এখুনি যাও এখান থেকে!
কেলের ছেলেটা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। বউটির দুই চোখের গলিত ঘৃণা একটা কাপটা মারল নন্দ ঘোষের মুখের ওপর। তারপর সেই অব্যক্ত যাতনায় কাজললতার সর্বাঙ্গ আর একবার ঝলসে দিয়ে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি চলে গেল সে।
নন্দ ঘোষ শুকনো গলায় জোর এনে আস্ফালন করল, বাড়ি গিয়ে আমি দেখাচ্ছি। ওকে মজা! নিশ্চয় চাকরি গেছে বলে দোকানের ওই নচ্ছার মেয়েটা গিয়ে লাগিয়েছে!
কাজললতা কাঠ।
.
পরদিন থেকে কেউ আর তাকে দেখেনি। আবারও সার জেনেছে কাজললতা, তৃতীয় মানুষ এলে দুজনার ঘর টেঁকে না।