দুই বন্ধু

এক ছিল মহাজন, আর এক ছিল সওদাগর। দুজনে ভারি ভাব। একদিন মহাজন এক থলি মোহর নিয়ে তার বন্ধুকে বলল, “ভাই, ক’দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি; আমার কিছু টাকা তোমার কাছে রাখতে পারবে?” সওদাগর বলল, “পারব না কেন? তবে কি জানো, পরের টাকা হাতে রাখা আমি পছন্দ করি না। তুমি বন্ধু মানুষ, তোমাকে আর বলবার কী আছে, আমার ঐ সিন্দুকটি খুলে তুমি নিজেই তার মধ্যে তোমার টাকাটা রেখে দাও— আমি ও টাকা ছোঁব না।” তখন মহাজন তার থলে ভরা মোহর সেই সওদাগরের সিন্দুকের মধ্যে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি গেল।
এদিকে হয়েছে কি, বন্ধু যাবার পরেই সওদাগরের মনটা কেমন উস্‌খুস্‌ করছে। সে কেবলই ঐ টাকার কথা ভাবছে আর তার মনে হচ্ছে যে বন্ধু না জানি কত কী রেখে গেছে! একবার খুলে দেখতে দোষ কি? এই ভেবে সে সিন্দুকের ভীতর উঁকি মেরে থলিটা খুলে দেখল— থলি ভরা চক্‌চকে মোহর! এতগুলো মোহর দেখে সওদাগরের ভয়ানক লোভ হল— সে তাড়াতাড়ি মোহরগুলো সরিয়ে তার জায়গায় কতগুলো পয়সা ভরে থলিটাকে বন্ধ ক’রে রাখল।
দশ দিন পরে তার বন্ধু যখন ফিরে এল, তখন সওদাগর খুব হাসিমুখে তার সঙ্গে গল্প-সল্প করল, কিন্তু তার মনটা কেবলই বলতে লাগল, “কাজটা ভালো হয়নি। বন্ধু এসে বিশ্বাস করে টাকাটা রাখল, তাকে ঠকানো উচিত হয়নি।” একথা সেকথার পর মহাজন বলল, “তাহলে বন্ধু, আজকে টাকাটা নিয়ে উঠি— সেটা কোথায় আছে?” সওদাগর বললে, “হ্যাঁ বন্ধু, সেটা নিয়ে যাও। তুমি যেখানে রেখেছিলে সেইখানেই পাবে— আমি থলিটা আর সরাইনি।” বন্ধু তখন সিন্দুক খুলে তার থলিটা বের ক’রে নিল। কিন্তু, কি সর্বনাশ! থলিভরা মোহর ছিল, সব গেল কোথায়? সব যে কেবল পয়সা! মহাজন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল!
সওদাগর বলল, “ওকি বন্ধু! মাটিতে বসলে কেন?” বন্ধু বলল, “ভাই, সর্বনাশ হয়েছে! আমার থলিভরা মোহর ছিল— এখন দেখছি একটাও মোহর নাই, কেবল কতগুলো পয়সা!” সওদাগর বলল, “তাও কি হয়? মোহর কখনও পয়সা হয়ে যায়?” সওদাগর চেষ্টা করছে এরকম ভাব দেখাতে যেন সে কতই আশ্চর্য হয়েছে; কিন্তু তার বন্ধু দেখল তার মুখখানা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে তার আর বাকি রইল না— তবু সে কোনো রকম রাগ না দেখিয়ে হেসে বলল, “আমি তো মোহর মনে করেই রেখেছিলাম— এখন দেখছি কোথাও কোনো গোল হয়ে থাকবে। যাক যা গেছে তা গেছেই— সে ভাবনায় আর কাজ নেই।” এই বলে সে সওদাগরের কাছে বিদায় নিয়ে পয়সার থলি বাড়িতে নিয়ে গেল। সওদাগর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
দু’মাস পরে হঠাৎ একদিন মহাজন তার বন্ধুর বাড়িতে এসে বলল, “বন্ধু, আজ আমার বাড়িতে পিঠে হচ্ছে— বিকেলে তোমার ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিও!” বিকালবেলা সওদাগর তার ছেলেকে নিকে মহাজনের বাড়িতে রেখে এল, আর বলল, “সন্ধ্যার সময় এসে নিয়ে যাব।” মহাজন করল কি, ছেলেটার পোশাক বদলিয়ে তাকে কোথায় লুকিয়ে রাখল— আর একটা বাঁদরকে সেই ছেলের পোশাক পরিয়ে ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিল।
সন্ধ্যার সময় সওদাগর আসতেই তার বন্ধু এসে মুখখানা হাঁড়ির মতো করে বলল, “ভাই! একটা বড় মুশকিলে পড়েছি। তোমার ছেলেটিকে তুমি যখন দিয়ে গেলে, তখন দেখলাম দিব্যি কেমন নাদুস-নুদুস ফুটফুটে চেহারা— কিন্তু এখন দেখছি কি রকম হয়ে গেছে— ঠিক যেন বাঁদরের মতো দেখাচ্ছে! কি করা যায় বলত বন্ধু!” ব্যাপার দেখে সওদাগরের তো চক্ষুস্থির! সে বলল, “কি পাগলের মতো বক্‌ছ? মানুষ কখনও বাঁদর হয়ে যায়?” মহাজন অত্যন্ত ভালো মানুষের মতো বলল, “কি জানি ভাই! আজকাল কি সব ভূতের কাণ্ড হচ্ছে, কিছু বুঝবার যো নেই। এই দেখ না সেদিন আমার সোনার মোহরগুলো খামখা বদলে সব তামার পয়সা হয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার!”
তখন সওদাগর রেগে বন্ধুকে গালাগালি দিয়ে কাজির কাছে দৌড়ে গেল নালিশ করতে। কাজির হুকুমে চার-চার প্যায়দা এসে মহাজনকে পাকড়াও ক’রে কাজির সামনে হাজির করল। কাজি বললেন, “তুমি এর ছেলেকে নিয়ে কী করেছ?” শুনে চোখ দুটো গোল ক’রে মস্ত বড় হাঁ ক’রে মহাজন বলল, “আমি? আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, আমি কি অত সব বুঝতে পারি? হুজুর! ওর বাড়িতে মোহর রাখলাম, দশদিনে সব পয়সা হয়ে গেল। আবার দেখুন ওর ছেলেটা আমার বাড়িতে আসতে না আসতেই ল্যাজ্‌-ট্যাজ্‌ গজিয়ে দস্তুরমতো বাঁদর হয়ে উঠেছে। কি রকম যে হচ্ছে— আমার বোধ হয় সব ভূতুড়ে কাণ্ড।” এই ব’লে সে কাজিকে লম্বা সেলাম করতে লাগল।
কাজিও চালাক লোক, ব্যাপার বুঝতে তাঁর বাকি রইল না। তিনি বললেন, “আচ্ছা, তোমারা ঘরে যাও। আমি দৈবজ্ঞ ফকির ডাকিয়ে মন্ত্র পড়ে ভূত ঝাড়িয়ে সব সায়েস্তা করছি। তোমার পয়সার থলি ওর কাছে দাও— আর তোমার বাঁদর ছেলেকে এর কাছেই রাখ। কাল সকালের মধ্যে সব যদি ঠিক না হয় তবে বুঝব এতে তোমাদের কারুর শয়তানি আছে। সাবধান! তাহলে তোমার পয়সাও পাবে না, মোহরও পাবে না— আর তোমার ছেলে তো মরবেই, ছেলের বাপ মা খুড়ো জ্যাঠা সবসুদ্ধ মেরে সাবাড় করব।”
সওদাগর পয়সার থলি সঙ্গে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘরে চলল। মহাজন বাঁদর নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল। ভোর না হতেই সওদাগর থলির মধ্যে আবার মোহর ভ’রে মহাজনের বাড়ি গিয়ে বলছে, “বন্ধু! বন্ধু! কি আশ্চর্য দেখে যাও! তোমার পয়সাগুলো আবার মোহর হয়েছে।” মহাজন বলল, “তাই নাকি? কি আশ্চর্য এদিকে সে বাঁদরটাও আবার তোমার খোকা হয়ে গেছে।” তারপর মোহরের থালি নিয়ে সওদাগরের ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে মহাজন বলল, “দেখ্‌ জোচ্চোর! ফের আমায় ‘বন্ধু’ ‘বন্ধু’ বলবি তো মেরে তোর থোঁতামুখ ভোঁতা ক’রে দেব।”