উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

দুই । প্রথম রক্তের স্বাদ

দুই । প্রথম রক্তের স্বাদ

পনেরো কি ষোলো বছর বয়সে নেপোলিয়ন পেলেন দ্বিতীয় লেফটেন্যান্টের পদ। অর্থাৎ সামরিক জীবনের প্রথম ধাপে পা দিয়েই তিনি হলেন একটি ছোটখাটো কর্তা।

এই পদলাভের জন্যে পরীক্ষায় তিনি সুখ্যাতির সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং পরীক্ষকরা তাঁর সম্বন্ধে যে মতপ্রকাশ করেছিলেন তা হচ্ছে এই : ‘সংযতবাক, উদ্যমশীল। গল্পগুজবের চেয়ে বই পড়তে ভালোবাসে। নির্জনতাপ্রিয়, উদ্ধত, অত্যন্ত অহঙ্কারী। কথাবার্তা কম কয় বটে, কিন্তু অল্প যে কথা বলে তা খুব চোখা চোখা ও অতিশয় যুক্তিপূর্ণ। যথেষ্ট আত্মনুরাগ ও প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা।’

ভ্যালেন্স শহরে গিয়ে নেপোলিয়ন নিজের পল্টনে যোগদান করলেন।

তাঁর ধনী সহতীর্থরা এখানে এসে নাচে-গানে ও আমোদপ্রমোদে কাল কাটাতে লাগল। কিন্তু দারিদ্র্যের জন্যে নেপোলিয়নের পক্ষে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া সম্ভবপর ছিল না এবং তিনিও ছিলেন বাজে আমোদ-আহ্লাদের অত্যন্ত বিরোধী।

এখানেও তাঁর প্রধান বন্ধু হল পুস্তক। কোন কোন শ্রেণির বই তিনি পড়তেন? গ্রিস, পারস্য, রোম, চিন, ভারতবর্ষ, মিশর ও প্রাচীন আমেরিকা প্রভৃতি দেশের ইতিহাস ও শাসন-পদ্ধতির বিবরণ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, আবহবিদ্যা ও যুদ্ধবিদ্যা। বড় বড় বীরের জীবনচরিত। শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিকদের রচনা প্রভৃতি।

এ-সময়েও ফরাসিজাতির উপরে ছিল তাঁর বিজাতীয় ঘৃণা। কর্সিকাকেই তিনি স্বদেশ মনে করতেন এবং ভালোবাসতেন কেবল কর্সিকাকেই। এবং সর্বদাই ভাবতেন, ফরাসিদের অধীনতা-শৃঙ্খল ছিঁড়ে কেমন করে কর্সিকাকে স্বাধীন করা যায়!

নেপোলিয়ন যখন পড়তে বসতেন, তখন কেতাবের পাতার উপরে কেবল চোখ বুলিয়ে যেতেন না। যা পড়তেন তার ভিতর থেকে দরকারি অংশগুলি ‘কপি-বুকে’ টুকে রাখতেন। এইসব ‘কপি-বুক’ সযত্নে ছাপিয়ে রক্ষা করা হয়েছে। তাদের মোট মুদ্রিত পত্রসংখ্যা চারিশত। সর্বশেষ ‘কপি-বুকে’র সর্বশেষে তরুণ যুবক নেপোলিয়ন স্বহস্তে এই কথাগুলি লিখে রেখেছিলেন। ‘সেন্ট হেলেনা, আটলান্টিক মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। ইংরেজদের উপনিবেশ।’

নিজের শেষ-জীবনের শোচনীয় পরিণামের নিষ্ঠুর ইঙ্গিত সেই বয়সেই কি নেপোলিয়নের মনে জেগে উঠেছিল? না নেপোলিয়নের অজ্ঞাতসারে, তাঁরই হাত দিয়ে, নিয়তি নিজে লিখে রেখেছিল ওই কথাগুলি?

নেপোলিয়নের উপার্জন এত সামান্য ছিল যে, ভালো করে খাওয়া-পরাও তাঁর ভাগ্যে জুটত না। মনের মধ্যে দুর্দমনীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা—দিবাস্বপ্নে সর্বদাই নিজেকে মনে করেন মানবদের মধ্যে প্রধান এবং এটাও অনুভব করেন যে, সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার শক্তিও তাঁর আছে—অথচ সামনে দেখেন নিরন্ধ্র অন্ধকার! মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে তাঁর আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা হয়!

এমনি দুঃসময়ে তাঁর পিতার মৃত্যু হল (১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছুটি নিয়ে দেশে গেলেন। একবৎসর দেশে থেকে আবার যখন কার্যক্ষেত্রে ফিরে এলেন, তখন তাঁর মন আরও ভেঙে পড়েছে। দরিদ্র পরিবার, পোষ্য অনেক—সকলেরই মুখে অভাবের হাহাকার। দাদা জোসেফ বয়সেই বড়, নেপোলিয়নকেই কর্তা বলে মনে করেন। অথচ তাঁর মাহিনা এত কম যে, নিজেরই হাতখরচ পোষায় না। আত্মহত্যার ইচ্ছা আবার প্রবল হয়ে ওঠে।

এমনি নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ নই দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে আরও কিছুকাল কেটে যায়। তারপরেই এল ভাগ্য-পরিবর্তনের যুগ! ফ্রান্সে বেজে উঠল বিপ্লবের তূর্য! জনতার কবলে পড়ে ধুলায় গড়াগড়ি দিলে বাস্তিলের দুর্গ-কারাগার, প্যারির রাজপথ দিয়ে রক্তাক্ত অস্ত্র হাতে করে ছুটতে লাগল উন্মত্ত নর-নারী, রাজা ও রানি তখনও বন্দি হলেন না বটে, কিন্তু লুপ্ত হল তাঁদের রাজমর্যাদা!

নেপোলিয়ন ভাবলেন কর্সিকাকে স্বাধীন করবার মস্ত সুযোগ এসেছে। আবার তিনি ছুটি না নিয়েই স্বদেশে গিয়ে হাজির। একদল বিদ্রোহী তাঁর চারিপাশে এসে জড়ো হল। যৌবনের উত্তেজনায় চিন্তাশীল ব্যক্তিও আপনাকে ভুলে যায়। ফ্রান্সের বিপুল রাজশক্তির বিরুদ্ধে একদল বিদ্রোহী যে মাতঙ্গের সামনে পতঙ্গের মতোই তুচ্ছ, নেপোলিয়ন সেটা বোঝবারও চেষ্টা করলেন না। বিদ্রোহীদের সঙ্গে তিনি একটি দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে খুব সহজেই পরাজিত হলেন।

ফ্রান্সে রাজবিদ্রোহী বলে নেপোলিয়নের নামে অভিযোগ এল। তাঁর চারিদিকে অন্ধকার আরও নিবিড় হয়ে উঠল। এখন তাঁর টাকাও নেই, পদমর্যাদাও নেই। যে-কোনও মুহূর্তে তিনি কারাগারে বন্ধ হতে পারেন। তিনি ফ্রান্সের বিপ্লববাদী রবেসপিয়েরের দলে গিয়ে ভিড়লেন। রাজশক্তির পতন না হলে আর তাঁর রক্ষা নেই।

মাহিনা বন্ধ, পেট চলে না। ঘড়ি বাঁধা পড়ল। গরিব হলেও এতদিন তিনি ধার করেননি, প্রাণ বাঁচাবার জন্যে এইবার তাঁকে ধার করতেও হল।

তারপর রাজশক্তির পতন। রাজা ও রানি বন্দি, ফ্রান্সের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হলেন বিপ্লববাদীরা। সঙ্গে সঙ্গে নেপোলিয়নের পদোন্নতি। তিনি এখন কাপ্তেন।

কিন্তু তখনও ফরাসি ফৌজের জন্যে নেপোলিয়নের এতটুকু মাথাব্যাথা ছিল না। ইউরোপের রাজা-রাজড়ারা ফরাসি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন, সেজন্যে তিনি বিচলিত হলেন না। ফরাসিরা আমার কে? আমার স্বদেশ কর্সিকা।

কর্সিকাবাসীদের প্রধান নেতা তখন পাওলি। তিনি ফরাসিদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার চেষ্টা করলেন। ফরাসি প্রজাতন্ত্রের পক্ষ থেকে কাপ্তেন নেপোলিয়ন গেলেন পাওলিকে বাধা দিতে। কিন্তু রণক্ষেত্রে তাঁর দ্বিতীয় অভিযানও সফল হল না।

কর্সিকার সমস্ত বাসিন্দা নেপোলিয়ন ও তাঁর পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠল। স্বদেশে দেশদ্রোহী নাম কিনে মা-ভাই-বোনকে নিয়ে নেপোলিয়নকে পালিয়ে আসতে হল ফ্রান্সে। তাঁর বয়স তখন পঁচিশ বৎসর।

ফরাসিরা তাঁকে ভাবে বিদেশি। কর্সিকার লোকরা তাঁকে ঘৃণা করে ফরাসি বলে। তিনি মনে করেন, আমার স্বদেশ নেই। দুই-দুইবার রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর ভবিষ্যৎ এখনও অন্ধকার।

কেবল তাঁর ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয়, ফ্রান্সের ভাগ্যাকাশেও তখন পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল অন্ধকার। বেলজিয়ামে ফ্রান্সের প্রভুত্ব বিলুপ্ত; স্পানিয়ার্ডরা ফ্রান্সকে আক্রমণ করতে আসছে; রাজতন্ত্রের পক্ষপাতীরা ধীরে ধীরে আবার প্রবল হয়ে উঠছে—এমনকি তারা ফ্রান্সের বিখ্যাত নগর ও বন্দর টুলনকেও ইংরেজ ও স্পানিয়ার্ডদের হাতে তুলে দিয়েছে!

প্রজাতন্ত্রের পক্ষ থেকে টুলনকে পুনরুদ্ধার করবার জন্যে প্রথমে একজন শৌখিন সেনাপতিকে নিযুক্ত করা হল—আগে ছিলেন তিনি চিত্রকর। যুদ্ধবিদ্যার কোনওই ধার ধারতেন না, এমন জায়গায় কামান বসান, যার গোলা টুলন শহর পর্যন্ত পৌঁছোয় না।

কাপ্তেন নেপোলিয়ন সেনাপতিকে তাঁর ভুল দেখিয়ে দিলেন এবং এ-ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতিতে আক্রমণ করা উচিত, তাও বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তবু সেনাপতির টনক নড়ল না।

নেপোলিয়ন প্যারিতে প্রজাতন্ত্রের কর্ণধারদের কাছে অভিযোগ করলেন। তখন ফ্রান্সের উপরে ম্যাক্সিমিলিয়েন রবেসপিয়েরের অবাধ প্রভুত্ব এবং তাঁর ছোট ভাই ছিলেন নেপোলিয়নের বন্ধু। কাজেই নেপোলিয়নের অভিযোগ ব্যর্থ হল না।

নতুন এক সেনাপতি এলেন। ইনিও শৌখিন যোদ্ধা, আগে করতেন ডাক্তারি। এঁকে পেয়েও নেপোলিয়নের সুবিধা হল না। যথাস্থানে আবার অভিযোগ গেল এবং আবার হল সেনাপতি বদল। এবারে যিনি বড়কর্তা হয়ে এলেন তাঁর নাম দুগোমিয়ার, তিনি হচ্ছেন সত্যিকার যুদ্ধব্যবসায়ী। তিনি নেপোলিয়নের যুক্তি শুনে তাঁর গুণ বুঝলেন এবং সায় দিলেন তাঁর মতেই।

কার্যক্ষেত্রে স্বাধীনতা পেয়ে নেপোলিয়ন নিজের ইচ্ছা অনুসারেই কামান সাজাতে লাগলেন এবং সর্বপ্রথমে বন্দি করলেন একজন ইংরেজ জেনারেলকে। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পদোন্নতি। তিনি এখন কর্নেল।

নেপোলিয়ন বুঝলেন, এতদিন পরে তাঁর যুদ্ধপ্রতিভার পরিচয় দেওয়ার মস্ত সুযোগ এসেছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যতের সমস্ত অনিশ্চয়তা দূর হয়ে যাবে। রীতিমতো মাথা খাটিয়ে তিনি আক্রমণের ফন্দি আঁটতে লাগলেন।

টুলন নগর অবরুদ্ধ হয়েও বিশেষ বিপদে পড়েনি—কারণ টুলনের অনতিদূরে সমুদ্রে নোঙর ফেলেছিল ইংরেজ নৌবহর, সেখান থেকে শহরের মধ্যে এসে থানা পেতেছিল ইংরেজ ও স্পানিয়ার্ডরা। ফরাসিরা গোলাবৃষ্টি করেও তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।

নেপোলিয়ন বুঝলেন সরাসরি হানা দিয়ে নগর দখল করা সহজ কাজ নয়। তিনি তখন এমন একটি জায়গা বেছে নিলেন, যেখান থেকে ইংরেজ নৌবহরের উপরে সহজেই গোলাবৃষ্টি করা যায়। সাধারণ ‘প্ল্যান’, কিন্তু তার কার্যকারিতা অসাধারণ। কারণ ইংরেজ নৌবহর স্থল থেকে আক্রান্ত হলে পলায়ন করবেই এবং তাহলেই দুর্গ থেকে কেবল ইংরেজ ও স্পানিয়ার্ড সৈন্যদের পলায়নের পথই রুদ্ধ হবে না, বাহির থেকেও দুর্গে সৈন্যসাহায্য এবং রসদ প্রভৃতির জোগান দেওয়ার পথ বন্ধ হবে। তখন নগর দখল করা হবে অত্যন্ত সহজসাধ্য।

আটঘাট বেঁধে নেপোলিয়ন কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। তিনি যে-জায়গাটি বেছে নিলেন, তা আক্রমণ ও দখল করা হল। তারপর ইংরেজ নৌবহরের উপরে ক্রমাগত পড়তে লাগল ফরাসি কামানের আগুন-রাঙা গোলা!

ব্যাপার দেখে টুলনে অবরুদ্ধ ইংরেজ ও স্পানিয়ার্ডদের চক্ষু স্থির আর কি! নগর থেকে বেরুবার পথ বন্ধ হলেই তো সর্বনাশ! ফরাসিরা তারপর কলেপড়া ইঁদুরের মতন তাঁদের ধরবে আর টিপে মারবে! তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে তাঁরা দিলেন শহর ছেড়ে লম্বা। ইংরেজ জাহাজগুলোও পাল খাটিয়ে সরে পড়তে দেরি করলে না! টুলনের পতন হল! নেপোলিয়ন যা ভেবেছিলেন, তাই (১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ)!

এই যুদ্ধে ইংরেজ-নিক্ষিপ্ত বর্শায় নেপোলিয়ন প্রথম আহত হলেন।

আঘাত গুরুতর নয়। চিরজীবন যুদ্ধক্ষেত্রবাসী হয়েও তিনি কোনওদিন গুরুতর আঘাত পাননি। এর পরে তিনি আর একবার মাত্র সামান্য ভাবে আহত হয়েছিলেন।

ডিসেম্বর মাসের কনকনে রাত্রির হিমেল অন্ধকার, নগর থেকে পলায়নপর ইংরেজ, স্পানিয়ার্ড ও ফরাসি রাজপক্ষীয়দের ভীত কোলাহল, চতুর্দিকে রক্তরাঙা মৃতের স্তূপ, আহতদের কাতর আর্তনাদে বিদীর্ণ আকাশ-বাতাস, কামানের পর কামানের গুরু গুরু গর্জন এবং লুণ্ঠনরত বিজয়ী ফরাসিদের ঘন ঘন হুঙ্কার! মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ড ও আগ্নেয়াস্ত্রের পুঞ্জ পুঞ্জ ধূম্ররাশির মধ্য দিয়ে ইউরোপের ভাগ্যগগনে আজ প্রথম আত্মপ্রকাশ করলে নতুন ও বিচিত্র এক ধূমকেতু!

নেপোলিয়ন যদিও এ যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি ছিলেন না তবু আসল জয়গৌরব তাঁরই প্রাপ্য। সকলের মুখে মুখে ফিরতে লাগল তাঁর নাম। তিনি হলেন ব্রিগাডিয়ার জেনারেল এবং পেলেন ইতালি-অভিযানের গোলন্দাজ সৈন্যদের ভার।

এই সময়ে নেপোলিয়নের যশোগৌরবে আকৃষ্ট হয়ে মার্মন্ট ও জুনট নামে দুজন যুবক সেনানী এসে তাঁর সঙ্গে থাকতে চাইলেন। তিনিও তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন সহকারী সেনানী রূপে।

কিন্তু হঠাৎ আবার ভাগ্যচক্রের গতি হল নিম্নমুখী। নেপোলিয়ন এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, এ যেন বিনামেঘে বজ্রপাত!

বিপ্লবী নেতা বড় রবেসপিয়ের তখন ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রের সর্বেসর্বা ছিলেন। দেশের রাজা, রানি, রাজবংশীয় অধিকাংশের এবং বড় বড় অভিজাতদের দেহ হয়েছে মুণ্ডহীন! কারণে-অকারণে হাজার হাজার সাধারণ লোকেরও প্রাণদণ্ড হয়েছে। এমন দিন যায় না যেদিন ফ্রান্সের মুণ্ডপাতযন্ত্র বা ‘গিলোটিন’ অলস হয়ে থাকে। খেতাবি অভিজাতদের হত্যা করে বা দেশ থেকে তাড়িয়ে বিপ্লবীরা সিংহাসন লুপ্ত করে নিজেদের হাতে নিয়েছিল দেশশাসনের ভার। কিন্তু রক্তসাগরে যে প্রজাশক্তির জন্ম বিনা রক্তে সে তৃপ্ত হতে পারেনি। বিপ্লবীদের বড় বড় কর্তাদেরও সেই রক্তসাগরে ডুবে তলিয়ে যেতে হল। বাকি ছিলেন রবেসপিয়ের, হঠাৎ ‘গিলোটিন’ তাঁকেও গ্রহণ করলে।

প্রজাতন্ত্রের ভারগ্রহণ করলেন নতুন একদল লোক। রবেসপিয়েরের দলের লোকদের তাঁরা হত্যা বা গ্রেপ্তার বা বিতাড়িত করলেন। নেপোলিয়নও বন্দি হলেন।

তাঁর বয়স তখন পঁচিশ বৎসর মাত্র। সৌভাগ্যের প্রথম আস্বাদ ভালো করে ভোগ করতে না করতেই তাঁর মাথার উপরে এসে পড়ল কল্পনাতীত দুর্ভাগ্যের বোঝা। তাঁর স্বদেশ নেই। ফ্রান্সও তাঁকে শত্রু বলে মনে করে। আগামী সপ্তাহের যে-কোনও দিন হয়তো সামরিক বিচারের ফলে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।

বন্ধুরা বললেন, ‘পালিয়ে প্রাণ বাঁচাও। আমরা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

নেপোলিয়ন ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না। আমি নির্দোষ। যদি ওরা আমার মৃতদেহ দেখতে চায়, আমি প্রস্তুত। সৈনিক হয়ে মরণকে ভয় করব না।’

পরের সপ্তাহে নেপোলিয়ন পেলেন মুক্তি।

কারণ? ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সারা ইউরোপ। ফ্রান্সকে এখন আত্মরক্ষা করতে হবে রণক্ষেত্রে গিয়ে কিন্তু ফরাসি ফৌজে নেপোলিয়নের মতন ভালো সেনাপতির অভাব। অতএব তাঁর বাঁচা দরকার!

নিরবচ্ছিন্ন সৌভাগ্যকে নেপোলিয়ন কখনও লাভ করেননি। চিরজীবনই পরম সৌভাগ্যের সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চরম দুর্ভাগ্য!