দুই । নায়কের মঞ্চে প্রবেশ
উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ। তারই উত্তরে আছে সাতশো আশি মাইল লম্বা বাহামা দ্বীপপুঞ্জ—তাদেরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্তর্গত বলে মনে করা হয়। আমেরিকার দিকে যাত্রা করবার পর কলম্বাসের চোখে পড়ে সর্বপ্রথমে বাহামা দ্বীপই।
বাহামার অন্যতম দ্বীপ নিউ প্রভিডেন্স এবং সেখানে ছিল বোম্বাটেদের জাহাজ ভিড়োবার এক মস্ত আড্ডা। আমাদের কাহিনির সূত্রপাত সেখানেই।
বোম্বেটেদের নিজস্ব এক কালো পতাকার নাম ছিল ‘জলি রোজার’—তার উপরে সাদা রঙে আঁকা থাকত কোনাকুনি ভাবে রক্ষিত দুটো অস্থিখন্ডের উপরে একটা মড়ার মাথা। সাগরপথের যাত্রীরা এই কৃষ্ণপতাকা বা ‘জলি রোজার’কে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতো ভয় করত। সৌভাগ্যের বিষয়, ‘জলি রোজারে’র অস্তিত্ব আজ লুপ্ত।
নিউ প্রভিডেন্স দ্বীপের বোম্বেটে-বহরের জাহাজ-ঘাটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন কাপ্তেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড। লোকের চোখ ভোলাবার জন্যে তাঁর জাহাজের উপরে উড়ছে এখন ইংল্যান্ডের রাজপতাকা বা ‘ইউনিয়ন জ্যাক’। কিন্তু সমুদ্রে পাড়ি দিলেই সেখানে ‘ইউনিয়ন জ্যাকে’র জায়গা জুড়ে বসবে সর্বনেশে ‘জলি রোজার’—কারণ তিনি হচ্ছেন একজন নামজাদা জলদস্যু!
হর্নিগোল্ড আজ কয়েকদিন জাহাজঘাটায় অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন একজন সহকারী অধ্যক্ষের জন্যে। সহকারী অধ্যক্ষের অভাবে জাহাজের কার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়। কিন্তু শহরের বিভিন্ন শুঁড়িখানা ও গুন্ডাপাড়ায় ঘুরেও তিনি মনের মতো সহকারী খুঁজে পাননি এবং সেই অভাবের জন্যে তাঁর জাহাজ বন্দরের মধ্যেই বন্দি হয়ে আছে।
নিজের মনেই গজ গজ করে তিনি বললেন, ‘এমন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এক বেটা মনের মতো পাষণ্ড গুন্ডার পাত্তা পাওয়া গেল না! আমার জাহাজের খুনে বদমাইশগুলোকে শায়েস্তা করতে হলে যে খোদ শয়তানের মতো ধড়িবাজ লোক দরকার!’
আচম্বিতে কাছ থেকেই কে পাগলের মতো হো হো করে অট্টহাসি হেসে উঠল—দস্তুরমতো শয়তানি হাসি!
চমকে উঠে নিজের পিস্তলের উপরে হাত রেখে হর্নিগোল্ড রুখে ফিরে দাঁড়ালেন—সত্যসত্যই কি তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করতে এখানে এসে আবির্ভূত হয়েছে স্বয়ং শয়তান?
কিন্তু কিমাশ্চর্যমতঃ পরম! এ যে কবির ভাষায়—’পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ!’
জাহাজ-ঘাটার অন্যান্য লোকদের মাথা ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বে জেগে উঠেছে দৈত্যের মতো এক অসম্ভব মনুষ্যদেহ—যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া! যেন বামনদের মাঝখানে এক বিরাট পুরুষ! তার মহাবলিষ্ঠ বিপুল বপুর সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে লৌহকঠিন পেশির পর পেশির তরঙ্গায়িত গতি। সেই রুক্ষ কেশকণ্টকিত মুখে আগুনের ফিনকির মতো জ্বলছে দুটো কুচুটে কুতকুতে চক্ষু। মাথায় পুরু কালো চুল—এবং চোখ-নাকের পাশে ও তলায় সে কী কৃষ্ণ ও ঘন শ্মশ্রুর ঘটা! কয়েকটা যত্নরচিত বেণিতে বিভক্ত হয়ে সেই প্রকাণ্ড চাপদাড়ি ঝুলে পড়েছে একেবারে কোমর পর্যন্ত। কেবল বিউনি বেঁধেই দাড়ির পরিচর্যা শেষ করা হয়নি—তার উপরে তাকে আবার অলংকৃত করা হয়েছে রংচঙে সব রেশমি ফিতে দিয়ে! তার বক্ষ-বন্ধনীতে ঝুলছে তিনজোড়া পিস্তল এবং গলায় আছে সোনা ও রুপোয় গড়া হার!
তারপর বিস্ময়ের উপরে বিস্ময়! মাথার টুপির তলা থেকে ঝুলে পড়ে কয়েকটা মৃদু-জ্বলনশীল পলিতা সেই ভীষণ মুখখানা অধিকতর ভয়াল ও বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে গন্ধকের উগ্র গন্ধে!
যেন অপচ্ছায়ামূর্তি! থতোমতো খেয়ে দুই পা পিছিয়ে পড়লেন হর্নিগোল্ড! এমন ধারণাতীত দৃশ্য তিনি জীবনে আর দেখেননি।
পরমুহূর্তেই তাঁর সন্দেহ হল যে, মূর্তি তাঁকে দেখেই হাসছে যেন বিশ্রী ব্যঙ্গের হাসি!
এই কথা মনে হতেই কাপ্তেন হর্নিগোল্ড খেপে গিয়ে পিস্তল বাগিয়ে ধরে কুপিত কণ্ঠে বললেন, ‘ওরে কালোদেড় শয়তান, আমাকে দেখে ঠাট্টা? মজাটা দেখবি নাকি?’
কিন্তু কোনও মজাই দেখানো হল না—ধাঁ করে তাঁর মনে পড়ে গেল একটা কথা। তাড়াতাড়ি গলার স্বর নামিয়ে তিনি বললেন, ‘টিচ? তুমি কি এডওয়ার্ড টিচ?’
‘সঠিক আন্দাজ! আমি এডওয়ার্ড টিচই বটে, দেশ আমার ব্রিস্টলে।’
‘সবাই তোমাকে কালোদেড়ে বলে ডাকে তো?’
পলিতার আগুন তখন দাড়ির উপরে নেমে এসেছে এবং চারিদিক ভরে উঠেছে গন্ধকের গন্ধের সঙ্গে চুল-পোড়া দুর্গন্ধে! কালোদেড় তার শ্মশ্রুর বেণিগুলো তাড়াতাড়ি কাঁধের উপরে তুলে দিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, আমি কালোদেড়েই বটে! একটু আগেই আপনি যা বলেছিলেন আমি শুনতে পেয়েছি। জাহাজের বেয়াড়া বেহেড লোকগুলোকে শায়েস্তা করবার জন্যে আপনার বেপরোয়া সহকারী দরকার?’
কালোদেড় কথা কইতে কইতে মিটমিট করে আড়চোখে তার দিকে চেয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে দেখে তপ্ত হয়ে উঠল হর্নিগোন্ডের বুকের রক্ত! এমন দুঃসহ বেয়াদপি দেখলে যে-কোনও বোম্বেটে-জাহাজের মালিক তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু এই শ্রেণির একজন দুষ্ট ও ধৃষ্ট সহকারীর অভাবে তাঁর জাহাজ অচল হয়ে পড়েছে বলে মনের রাগ মনেই চেপে তিনি বললেন, ‘তাহলে আমার জাহাজের অবাধ্য লোকগুলোর ভার আমি তোমার হাতেই সমর্পণ করলুম! কিন্তু তোমার ওই যাচ্ছেতাই জ্বলন্ত পলতেগুলো আর আমি সইতে পারছি না, ওগুলো নিবিয়ে ফ্যালো!’