পাঁচ
ফিয়ার মিটারটির কাছ থেকে পিছিয়ে এসে অমঙ্গলের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল মিল্টন। ওভারলের স্ট্র্যাপ ঠিকঠাক করার সময় আমাদের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে।
‘আপনি আমাদেরকে ঠকালেন কেন?’ ইমন চেঁচাল দীর্ঘদেহী হররটিকে লক্ষ্য করে।
‘আমরা ভেবেছিলাম আপনি আমাদের সাহায্য করছেন!’ চিৎকার ছাড়ল ডেমি মুর। ‘ভেবেছিলাম আপনি আমাদের বন্ধু!’
‘ভুল ভেবেছিলে,’ জবাবে বলল মিল্টন।
‘কেউ কিছুই বোঝনি তোমরা?’ অমঙ্গল প্রশ্ন করল। ‘সত্যিই ভেবেছিলে মিল্টন তোমাদের লোক?’
‘ও-ও কেটি আর রবসনের মত মিথ্যে বলেছে আমাদের, কঠোর গলায় বলল ইমন। মিল্টনের উদ্দেশে ছুঁড়ল রাবারের মাথাটা। হররটার প্রকাণ্ড বুকে আঘাত করে থপ করে মেঝেতে পড়ল ওটা।
এসময় সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। মুসা ঘুরে . চাইল আমার দিকে।
‘খাইছে, ওরা আসলেই মিল্টনকে বন্ধু ভেবেছিল,’ বলল।
‘ও ওদেরকে বোকা বানিয়েছে,’ বললাম। ‘আর এখন আমরা সবাই ওর ফাঁদে পড়েছি।’
‘শান্ত হও তোমরা, শান্ত হও!’ হাত নেড়ে আমাদেরকে থামাতে চাইল অমঙ্গল। ‘মিল্টন শুধু তোমাদেরকেই ধোঁকা দেয়নি। হররল্যাণ্ডের সব কটা হররকেও বুদ্ধু বানিয়েছে। ওরা ভেবেছিল ও ওদের সাথে মিলে কাজ করছে তোমাদের রক্ষার জন্যে। কিন্তু আসলে ও ছিল আমার চর, সেই প্রথম থেকেই।’
মাথা নাড়ল রায়ান।
‘আপনাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, মিল্টন,’ বিড়বিড় করে বলল। ‘আপনি আমাকে প্যানিক পার্কের ওই কি কার্ডটা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে চাইছেন।’
‘ওই কি কার্ডটার জন্যেই তোমরা প্যানিক পার্কের প্রতি আগ্রহী হও,’ বলল মিল্টন। ‘এবং এখানে আসতে রাজি হও।’
‘তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত। আমার বন্ধু মিল্টন যেহেতু তোমাদেরকে বাছাই করেছে,’ ঘোষণা করল অমঙ্গল।
‘কেন?’ কৈফিয়ত ঢাইল কিশোর। ‘আমাদেরকে কেন?’
বুকের ওপর রোমশ বেগুনী বাহুজোড়া ভাঁজ করল মিল্টন। ‘কারণ আমার ধারণা তোমরা প্রত্যেকে সাহসী,’ জানাল। ‘এখন অমঙ্গলের সাথে পাল্লা দিয়ে সাহসিকতার প্রমাণ দিতে হবে তোমাদের।’
‘অন্য ছেলে-মেয়েদের ওপরেও ফিয়ার মিটার ট্রাই করেছি আমরা,’ বলল অমঙ্গল। ‘কিন্তু… যাকগে, অত কথায় কাজ কী? শুধু এটুকু বলি, ব্যাপারটা সুখকর হয়নি!’
‘কেন সাহসের প্রমাণ দিতে হবে আমাদের?’ কিশোর জবাব চাইল।
‘আমাদেরকে নিয়ে কী ফন্দি এঁটেছেন আপনারা?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘কেন ভয় দেখাতে চান আমাদের?’ মিহি কণ্ঠে প্রশ্ন করল রিনা।
পোডিয়ামে দস্তানামোড়া দু’হাতে একইসঙ্গে দুম করে কিল মারল অমঙ্গল।
‘ভাল প্রশ্ন,’ বলল ও। ‘ভাবতে থাকো। জীবনের সবচাইতে ভয়ঙ্কর মুহূর্তের কথা ভাবো, ধরে নাও ওখান থেকেই এর শুরু।
এবার পোডিয়ামের ওপর দিয়ে ঝুঁকল, মুখ এখনও ঢাকা ছায়ার আড়ালে।
তোমাদের মধ্যে যারা বেশি বুদ্ধিমান তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ এই পার্কটা ১৯৭৪ সালে আটকে আছে,’ বলল। ‘সেসময় পার্কটায় অনেক বড় ধরনের ভয় ছিল। এতটাই বেশি যে, এটা আমাদেরকে ভিন্ন এক বাস্তবতায় নিয়ে গেছে। সময়চক্রে আটকে পড়েছি আমরা।
মুসা ফিসফিস করল আমার কানে।
‘ ‘খাইছে, ও কি সত্যি কথা বলছে?’
‘তোমাদের আতঙ্ক আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে আনবে,’ কথার খেই ধরল অমঙ্গল। ‘তোমাদের ভয় থেকে শক্তি নিয়ে প্যানিক পার্কটা আবার বাস্তব জগতে ফিরবে।’
‘বু-বুঝলাম না,’ তোতলাচ্ছি। ‘আমাদেরকে কতদিন এখানে আটকে রাখবেন?’
‘যতদিন লাগে,’ জবাব দিল অমঙ্গল। ফিয়ার মিটারের উদ্দেশে চাইল। ‘অন্য ছেলে-মেয়েগুলো আতঙ্কের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেনি। মিল্টন তো বলে তোমরা সবাই নাকি সাহসের প্রমাণ রেখেছ। দেখা যাবে।’
মিল্টনের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
‘তোমরা ভয় পাও, হ্যাঁ?’ বলল। ‘ভয়ানক ভয় পাও?’
আচমকা হ্যাটের কানা চেপে ধরল অমঙ্গল এবং মাথা থেকে তুলে ফেলল।
গলায় শ্বাস আটকাল আমার। ওর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এই প্রথমবারের মত।
কালি পড়া শীতল, কালো একজোড়া চোখ। চোখা নাকটার নিচে পেন্সিল সরু গোঁফ। গালজোড়ায় গভীর ভাঁজ। ঠোঁটে ঠাণ্ডা বিদ্রূপ।
‘আমাদেরকে কীভাবে ভয় দেখাতে চান?’ চিৎকার ছাড়ল কিশোর। ‘বলে ফেলুন!ত
‘অ্যাই, ছেলে, এখানে প্রশ্ন তোমরা নয়,’ গমগমে কণ্ঠে বলে উঠল অমঙ্গল। ‘আমি করব।’
‘না-আমি!’ চড়া, শাণিত এক কণ্ঠস্বর চেঁচিয়ে উঠল। ‘শুধু আমি করব।’
হঠাৎই অমঙ্গলের মাথাটা লাটিমের মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল-
-এবং আর্তনাদ ছাড়লাম আমি।
আমার সঙ্গে গলা মেলাল সবাই।
মাথার পেছনে অমঙ্গলের আরেকটা মুখ রয়েছে!
ছয়
উঁচু দেয়ালগুলোয় প্রতিধ্বনিত হলো আমার আর্তচিৎকার।
আর নিতে পারছি না আমি। দৌড়নোর জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু ছায়ামানুষেরা দরজা আগলে বন্ধ করে দিয়েছে পালাবার পথ।
আমাদের আর্তনাদ থেমে গেলে, অমঙ্গলের অন্য মুখটা কথা বলে উঠল।
‘চালিয়ে যাও! কী মধুর শব্দ! হ্যাঁ! হ্যাঁ! আতঙ্কের চিৎকার কানে মধু ঢালে আমার! মরণচিৎকার শোনার মজাই আলাদা!’
মুখটার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ আর খোনা। জ্বলজ্বলে লাল চামড়া দেখলে মনে হবে আগুনে ঝলসানো বুঝি! বড়-বড় চোখজোড়ায় উন্মাদের খুনে দৃষ্টি, ক্রমাগত বনবন করে ঘুরছে ও দুটো। মোটা নাকটার নিচে, এবড়োখেবড়ো দাঁতগুলোকে ঢেকে রেখেছে পুরু একজোড়া ঠোঁট
অমঙ্গলের একটা মুখ কুচকুচে কালো এবং অপরটার রঙ আগুনে লাল।
‘দারুণ! দারুণ! চেঁচাতে থাকো!’ লাল মুখটা গলা ছেড়ে চিৎকার করল।
এবার অমঙ্গল ঘুরে দাঁড়াল আবারও, এবং প্রথম মুখটা নিচু, থমথমে কণ্ঠে কথা বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছ, আমি ভীতু লোক নই। যে কোন কিছু করতে তৈরি আছি আমি। আমার হারানোর কিছু নেই-পাওয়ার আছে সবই।’
‘থাক, আর বড়াই করতে হবে না! ওরা বুঝতে পেরেছে!’ খেঁকিয়ে উঠল দ্বিতীয় মুখটা।
‘বড়াই করছি না, প্রথম মুখটা দৃঢ়কণ্ঠে বলল। ‘ওদেরকে জানানো দরকার, তাই জানাচ্ছি।’ দুটো আঙুল তুলল ও। ‘দেখতেই পাচ্ছ, বাচ্চারা, তোমরা সংখ্যায় কম, দু’জনের বিরুদ্ধে একজন।
‘এবং একটার চাইতে দুটো মাথা অনেক বেশি শক্তিশালী!’ লাল মুখটা ঘোষণা করল।
‘তোমরা আমার পার্কটাকে বাস্তব দুনিয়ায় ফেরত আনবে,’ কালো মুখটা বলল। ‘তোমাদের ভয়ার্ত আর্তনাদের শক্তি দিয়ে।’
মিল্টনের উদ্দেশে চাইল ও, লম্বা কাঠের আসবাবটির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও কাঠপুতুলের মত।
‘ফিয়ার মিটার চালু করো,’ আদেশ ঝাড়ল।
বাক্সটার পেছনদিকে হাত নিয়ে গেল মিল্টন। পরক্ষণে টিক
করে এক শব্দ। এবার মৃদু গুঞ্জন তুলল যন্ত্রটা।
মিল্টন ওটা ঘুরিয়ে দিতেই সামনের চিকন নলটা দেখলাম আমরা। অনেকটা থার্মোমিটারের মত দেখতে জিনিসটা।
ফিয়ার মিটার কিছুক্ষণ গুঞ্জন করল। গুনগুন ধ্বনিটা ক্রমেই জোরদার হলো। নিচ থেকে লাল এক দাগ উঠে আসছে।
হ্যাঁ। ওটা ঠিক যেন এক থার্মোমিটার। পাশে নম্বর খোদাই করা-১ থেকে ১০০।
নিঃশব্দে লাল দাগটাকে ক্রমশ হড়কে উঠে যেতে দেখছি আমরা…২০-এ গিয়ে থামল।
‘নাহ,’ হতাশা ঝরল অমঙ্গলের কণ্ঠে। ‘চলবে না। বাছারা, বাছারা এরচাইতে অনেকই ভাল করতে হবে তোমাদের। তোমরা কিন্তু মোটেও চেষ্টা করছ না। তোমাদের ভীতি একশোতে তুলতে হবে!’
পাই করে ঘুরে গেল মাথাটা এবং কথা বলল লাল মুখটা। ‘আতঙ্কের মাত্রা চড়ানোর কোন না কোন কায়দা ঠিকই বের করে ফেলব আমরা!’
অমঙ্গল দস্তানামোড়া এক হাত নাড়ল। ওর আবছায়ারা নড়াচড়া শুরু করল। নিঃশব্দে কামরার ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এসে ঘিরে ধরল আমাদের।
ওদের ছায়াশরীর থেকে কনকনে হিম বাতাস ভেসে আসছে টের পাচ্ছি। শিউরে উঠলাম।
দেখতে পাচ্ছি না। কালো মেঘের মত আমাদের ওপর ভাসছে ওরা।
শীতল এক ঝাপ্টা, তেজী বাতাসের মতন, আমাকে এপাশ- ওপাশ ঠেলছে।
‘মুসা?’ ছায়ামানুষদের ভারী কম্বলের নিচে রুদ্ধ শোনাল আমার কণ্ঠ। ‘মুসা? মুসা? তুমি ঠিক আছ তো?’
মুখ!
সাড়া নেই।
অসুস্থ বোধ করছি। তলপেট কেমন শক্ত আর ভারী ঠেকছে। কল্পনায় ভাসছে শুধু দু’মুখো অমঙ্গলের ছবি। এক মাথায় দুই
কাজটা কীভাবে করল ও? আমাদের ভয় দেখানোর ষড়যন্ত্রের কোন অংশ এটা?
সহসাই ছায়াগুলো উঠে গেল। আলো ঠিকরে এসে পড়ল আমার ওপরে। অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ঠায় দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপছি। মুসা আমার পাশেই, দাঁতে দাঁত খটাখট বাড়ি খাচ্ছে ওর।
মঞ্চের দিকে চোখ তুলে চাইলাম। ফিয়ার মিটারের লাল দাগটা সবে ২৫-এ উঠেছে।
পঁচিশেই যদি এ দশা হয়, তাহলে পঞ্চাশে পৌঁছলে টিকব কীভাবে? কিংবা একশোতে?
অমঙ্গলের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়ালাম।
‘আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘কেন বলছেন না আমাদের নিয়ে কী মতলব আপনার?’
ও কাজল হরিণ চোখজোড়া পিটপিটিয়ে চাইল আমার দিকে। ‘তোমরা আটকে পড়া প্যানিক পার্ককে ১৯৭৪ সাল থেকে বেরোতে সাহায্য করবে,’ বলল। ‘তোমরা—’
ওর অন্য মুখটা বোঁ করে ঘুরে সামনে চলে এল।
‘ওদেরকে বোলো না!’ চিৎকার ছাড়ল। ‘স্রেফ দেখাও!’ পোডিয়ামের এক বোতাম দাবাল ও।
পায়ের নিচ থেকে মেঝে হড়কে সরে যেতেই পিলে চমকানো
চিৎকার ছাড়লাম।
দ্রুতগতিতে পতন হলো আমার।
দেখলাম আমার দু’পাশে অন্যরাও পড়ে যাচ্ছে।
সোজা নিচে পড়ছি, হাতজোড়া শূন্যে উঠে গেল … প্রাণভয়ে আর্তনাদ করছি…এভাবে সারাটা পথই চেঁচিয়ে চললাম।
সাত
‘আআআআইইইহ!’
কনুই আর হাঁটুর ওপর সজোরে পড়লাম। সারা শরীরে বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ল যন্ত্রণা।
আরেকজন কে যেন আমার গায়ের ওপর পড়তেই আবারও আর্তচিৎকার ছাড়লাম। পুরু এক গালিচায় ডুবে গেল আমার মুখ।
গুঙিয়ে উঠে, মাথাটা তুলে চারপাশে চোখ বোলালাম।
গাদাগাদি করে পড়েছি সবাই। হাত-পা আর শরীরের জট লেগে গেছে রীতিমত।
‘উহ’ শব্দ করে হাঁচড়েপাঁচড়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। ঘাড়টা টাটাচ্ছে। পিঠে ব্যথা। হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করছে। লম্বা দম নিয়ে ধরে রাখলাম।
তুমি ঠিক আছ, রবিন। ঠিক আছ।
কপাল ভাল, আমরা নরম, পুরু এক গালিচার ওপর জড়ামড়ি করে পড়েছি। কে যেন আমার হাত চেপে ধরল। কিশোর। টেনে দাঁড় করাল আমাকে।
মুসাকে দেখলাম এখনও হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে, হতচকিত।
ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। তারপর দু’জন মিলে অন্য ছেলে-মেয়েদেরকে।
কারও মুখে রা নেই। নিচের তলায় পড়েছি আমরা। তবে কেউই মারাত্মক কোন আঘাত পায়নি।
বিশাল কামরাটার চারদিকে চাইলাম। কালো আসনের কয়েকটা সারি দেখলাম। ঘরের সামনের ধূসর পর্দাটা এসময় হড়কে সরে যেতে লাগল। ওটার পেছনে এক সিনেমার পর্দা।
স্ক্রিনিং রুম।
‘সবাই বসে পড়ো!’ স্ক্রিনের পাশের এক লাউডস্পিকার থেকে গমগম করে উঠল অমঙ্গলের কণ্ঠস্বর। ‘বসো। এখুনি ছবি শুরু হবে।’
এবার অমঙ্গলের চড়া, তীক্ষ্ণ গলার স্বর শুনলাম।
‘পপকর্ন খাওয়াতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে মনে হয় না তোমরা তাতে কিছু মনে করবে। ছবিটা দেখার পর খিদের কথা মনেই থাকবে না তোমাদের! হাহাহাহা!’
কী কুৎসিত হাসিটা!
পাজোড়া দুর্বল লাগছে আমার। পেটের ভেতরটা কেমন শক্ত ঠেকছে, মনে হচ্ছে যেন কোন পাথর গিলেছি।
মুসা আর আমি একসঙ্গে হেঁটে গিয়ে, দ্বিতীয় সারির দুটো
আসনে বসলাম।
চেয়ারে গা ডুবিয়ে দিলাম। উষ্ণ আর কোমল অনুভূতি। রোমশ!
চেয়ারের হাতলে হাতজোড়া রাখতে যেতেই ওদুটো নড়ে উঠল!
চেয়ারের হাতলজোড়া উঠে গেল-এবং জড়িয়ে ধরল আমার কোমর।
ছটফট করতে লাগলাম-কিন্তু কীসে যেন থামিয়ে দিল আমাকে।
অসাড় হয়ে গিয়ে কান খাড়া করলাম। হ্যাঁ! চেয়ারটার শ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। আমাকে ঘিরে ফোঁস ফোঁস করছে ওটা।
চেয়ারটা জ্যান্ত!
জিনিসটা উষ্ণ, শ্বাস নেয় এবং জীবন্ত, ওটার বাহুজোড়া
আমাকে চেপে ধরে রাখল।
ভেজা-ভেজা পশমে ডুবে গেলাম আমি। স্নান করানোর প্রয়োজন হলে বাঘার গায়ে এমন গন্ধ পাওয়া যায়।
‘খাইছে, এটা জ্যান্ত!’ ফিসফিস করে বলল মুসা। ‘কী ভয়ানক!’
‘মুভিটা উপভোগ করো তোমরা,’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল অমঙ্গল। ‘সামান্য ইতিহাসের শিক্ষা…এবং…তোমাদের জন্যে আমি যেসব ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা করে রেখেছি তার সম্পর্কে একটা ধারণা!’
লালমুখো কথা বলল: ‘আর দয়া করে ভয়ের জায়গাগুলোয় চোখ বুজে রেখো না। ফিয়ার মিটার চলছে। এর অর্থ জানো তোমরা। আমরা চাই তোমরা প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কগ্রস্ত হও। পারবে, আমি জানি তোমরা পারবে!’
সিলিঙের বাতিগুলো ক্ষীণ হয়ে এল। মৃদু গোঙানির শব্দ করে উঠল আমার চেয়ারটা। ওটার হৃৎপিণ্ডের অবিরাম স্পন্দন টের পাচ্ছি।
গুঙিয়ে উঠল আরেকটি চেয়ার। মুসার দিকে ঘাড় কাত করে চাইলাম। আঁধারেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মুখের চেহারা পাণ্ডুর বর্ণ ধরেছে ওর।
ডেমি মুর আর রিনা আমাদের সামনে বসা। ডেমির চেয়ারটা ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে দু’বাহু দিয়ে। নড়তে পারছে না ও।
ছায়াছবি, আরম্ভ হলো। সাদা-কালো, প্যানিক পার্কের আর সব কিছুর মতই।
ধীরে-ধীরে ফোকাস্ড্ হলো ওটা। এক রোলার কোস্টার দেখলাম। এবার শব্দ যোগ হলো। বাচ্চারা রোলার কোস্টারে চেপে তুমুল হৈ-হল্লা, হাসাহাসি করছে।
এক রোলার কোস্টার কারে ক্যামেরা সেট করা। বগিটা সগর্জনে উঠে যাচ্ছে খাড়াই বেয়ে, ক্রমেই গতি তুলছে।
আমি দৃশ্যটা দেখছি, এসময় উড়ে উঠল আমার চেয়ারটা। মেঝে থেকে যেন ছিটকে উঠল। মৃদু গোঙাচ্ছে, আরও ওপরে ভেসে উঠল ওটা, গতি বেড়ে চলেছে। এবার আরও উঁচুতে, থিয়েটারের কালচে ছাদ লক্ষ্য করে।
এটা কি ভুয়া কোন রাইড? যেখানে চেয়ার ঝাঁকি খায় আর তুমি ভান কর উড়ছ?
না।
আমরা সত্যি-সত্যিই বাতাসে ভাসছি। ওই তো, অনেক নিচে মেঝেটা।
চেয়ারটা এপাশ-ওপাশ দুলতেই আর্তচিৎকার ছাড়লাম। কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। মুভির কোস্টারে চড়া ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমাদের চেয়ারগুলোও দুলছে।
পেছনদিকে ঢলে পড়লাম। শক্ত করে আমাকে ঠেসে ধরল বাহুজোড়া। নট নড়ন চড়ন। শ্বাসও নিতে পারছি না।
সব কটা চেয়ার দ্রুতগতিতে পড়ে যাচ্ছে। ছায়াছবির বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সমস্বরে আর্তনাদ জুড়েছি আমরাও।
আমার চেয়ারটা একপাশে, তারপর আরেক পাশে, কাত করে দিল আমাকে। এবং তারপর হুশ করে তুলে ফেলল আবারও।
শূন্যে উড়ে গেলাম, এবার গোঁ-গোঁ শব্দে পতন হলো, তারস্বরে চেঁচাতে-চেঁচাতে পড়ে যাচ্ছি সাঁ-সাঁ করে।
ঠেলা-গুঁতো খাচ্ছি, অনুভব করছি চেয়ারটার হৃৎপিণ্ড আমারটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধড়াস ধড়াস করছে। রোমশ বাহু দুটো আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। কানে আসছে ওটার অস্ফুট গোঙানি।
পর্দার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি, চলচ্চিত্রের কোস্টার বগিটিকে উড়ে যেতে দেখলাম ট্র্যাক থেকে।
পর্দার ছেলে-মেয়েগুলো এখন পিলে চমকানো চিৎকার করছে।
আতঙ্কের হাহাকার করতে যেই মুখ খুলেছি অমনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থিয়েটারের ওপাশে উড়ে গেল আমার চেয়ারটা।
আট
ওহ, না…ওহ, নাআআআ!
ছায়াছবির ভেতর ভীতিকর এক শব্দ শুনলাম।
আমার উড়ন্ত চেয়ারটা উল্টোদিকে ঘুরে গেছে। সিনেমার পর্দাটা দেখতে পাচ্ছি না আমি। কিন্তু কল্পনায় দেখছি ওই অসহায় বাচ্চাগুলোকে…মনের পর্দায় ওদেরকে মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখছি।
এবং এসময় ঘুরতে লাগল আমার চেয়ারটা। পাক খাচ্ছে বনবন করে। চোখ বুজলাম।
চোখের পাতা মেললাম যখন, আমার চেয়ারটা তখন আবার মেঝের ওপর স্থির। ডেমি মুর আর রিনার পেছনে, দ্বিতীয় সারিটিতে। ঝাড়া মেরে মাথা থেকে ঝিমঝিম ভাবটা তাড়াতে চাইলাম। দেখলাম ওই মেয়ে দুটোও থরথর করে কাঁপছে।
ছায়াছবির পর্দা এখন ধূসর।
এমনিসময়, লাউডস্পিকার ভেদ করে গমগমিয়ে উঠল অমঙ্গলের কণ্ঠস্বর।
‘হুম, আমরা হঠাৎই ট্র্যাক থেকে সরে গেছিলাম। অমনটা হলে ভয়ানক অসন্তুষ্ট হই আমি-তোমরা হওনি?’ হেসে উঠল ঠা- ঠা করে।
পরক্ষণে ওর লাল মুখটা সুরেলা গলায় বলে উঠল: ‘সব কিছুর গোড়া ওটাই। ১৯৭৪ সাল। পার্কে ওসময়টাতেই সব গড়বড় হতে শুরু করে। ওদিন আমরা কয়েকটা ছেলে-মেয়েকে হারাই। অনেক বড় ঘটনা-তাই না? কিছু জেতা, কিছু হারা! সিনেমায় জনপ্রিয় সংলাপ আছে না, কখনও-কখনও জেতার জন্যে কিছু হারতেও হয়?’
ছবি আরম্ভ হলো আবারও। সরু, উঁচু এক পাথুরে দুর্গ দেখাচ্ছে। পার্কের ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ওটা।
সামনে এক সাইনে লেখা: গন্তব্য অজানা
দুর্গের ভেতরে ক্যামেরা ঘোরাফেরা করছে। পাথুরে ধাপ বেয়ে উঠে যাচ্ছে মানুষজন। পাক খেয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি।
ওদেরকে সিঁড়ি ভাঙতে দেখছি, এদিকে থিয়েটারের ভেতরে বাতাস ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে।
ওঠার সময় ওরা সামনে ঝুঁকে পড়ছে। ক্রমশ খাড়া হচ্ছে ধাপগুলো। ছোট-ছোট দল পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে লোকজন। দুর্গটা যেন এমুহূর্তে আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাতাস উত্তাপ ছড়াচ্ছে। তপ্ত আর সেঁতসেঁতে। এতটাই গরম আমার নাকের ফুটোজোড়া অবধি পুড়ে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে টপ- টপ করে ঘাম ঝরছে।
‘খাইছে, কেমন…দম…আটকে…আসছে,’
ফিসফিসিয়ে বলল মুসা।
হ্যাঁ। বাতাস গুমট!
পাশ থেকে উত্তপ্ত বাতাস পুড়িয়ে দিচ্ছে আমার মুখটাকে। শ্বাস নিতে লাগলাম হাঁ করে। গভীর দম নেয়ার সময় বুকটাও পুড়ে যাচ্ছে।
ওদিকে, ছায়াছবিতে, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার বিরাম নেই ওদের। একসঙ্গে গাদাগাদি করে, মানুষগুলো পাক খেয়ে-খেয়ে উঠে যাচ্ছে দুর্গে, হাঁসফাঁস করছে রীতিমত।
হঠাৎই পর্দাটা আবারও বিবর্ণ হয়ে গেল। পর্দার একপাশে ঝলসাচ্ছে এক স্পটলাইট।
ছোট্ট এক পোডিয়ামের পেছনে দাঁড়িয়ে অমঙ্গল। পোডিয়ামের তাকে ওর হ্যাটটা রাখা। ব্যাটার অশুভ, কালো মুখটা চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।
ওবছর প্যানিক পার্কে সমস্যা লেগেই ছিল,’ বলল ও। ‘গন্তব্য অজানা দুর্গের মাথায় যারা উঠেছিল-তারা আর ফেরেনি।
আমাদের সেজন্যে খানিকটা ঝামেলাও পোহাতে হয়েছিল অবশ্য।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।
‘কেউ আমাকে বোঝেনি। মাত্রাতিরিক্ত ভয় নিয়ে করা আমার গবেষণাগুলো দিনকে দিন অসাধারণ হয়ে উঠছিল। কিন্তু কেউ আমার কোন প্রশংসা করেনি, দাম দেয়নি।’
মাথাটা বন করে ঘুরে যেতেই, ওর দ্বিতীয় মুখটা ঝামটে উঠল।
‘তোমার ধারণা তুমি একটা জিনিয়াস, তাই না? অথচ তোমার বুদ্ধি একটা ষাঁড়ের সমান! আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম না গন্তব্য অজানা দুর্গের ধারণাটা ভয়ঙ্কর? তুমি শুনেছিলে আমার কথা?’
দ্বিতীয় মুখটা পাঁই করে ঘুরল।
‘চোপরাও!’ কালো মুখটা খেঁকিয়ে উঠল। ‘চোপরাও! চোপরাও! তোমার মতামত চেয়েছি আমি?’
‘অই, কথা বলতে তোমার অনুমতি লাগবে নাকি?’ তেড়িয়া জবাব লালমুখোর। ‘চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব!’
‘তুমি? দোহাই লাগে, হাসিয়ো না। আমার ঠোঁট এমনিতেই ফাটা! চ্যাপস্টিক লাগাতে হবে!’
‘কষে এমন একখান চড় দেব যে মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকবে!’
‘তাই নাকি? এসো তবে, হয়ে যাক এক হাত!’
চেয়ারে বন্দি, মুখ দুটোর তুমুল তর্কাতর্কি দেখছি। নড়তে পারছি না। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
অমঙ্গল লোকটা আস্ত এক শয়তান, নিজেকে বললাম।
কাণ্ড দেখো দানবটার, নিজেরই আরেক মুখের সঙ্গে কেমন কথার লড়াই বাধিয়েছে।
কাজটা কি ও নিজেই করেছে? ভয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে কি দ্বিতীয় মুখটা গজিয়েছে ওর?
ও যে কোন কিছুই করতে পারে। যে কোন কিছু করতে বুক কাঁপবে না ওর…এরকম এক দানবের কবল থেকে বাঁচব কীভাবে আমরা এতগুলো ছেলে-মেয়ে?
সহসাই স্পটলাইট নিভে গেল। ছবি শুরু হলো আবারও। সাদা এক দালান দেখলাম। প্রবেশপথের ওপরে এক সাইনে লেখা: ঘূর্ণিঝড় রাইড।
ক্যামেরা ভেতরে গেল। প্রথমটায় আঁধার। এবার ছবি উজ্জ্বল হতেই, দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গে মানুষজন দেখলাম। তারা গর্জনশীল বাতাসের দাপটে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, উড়ে যাচ্ছে।
এসময়, পর্দায় আড়াআড়ি ভেসে গেল একটি ছেলে। শার্টটা উড়ে উঠেছে মাথার ওপরে ওর। বাতাস সুড়ঙ্গ দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় এক মেয়ে ছেলেটির পা চেপে ধরল। ঝড়ো বাতাসে চুল উড়ছে মেয়েটির। নিখাদ আতঙ্কে ত্রাহি চিৎকার জুড়েছে দু’জনেই, শক্তিশালী ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে অসহায়।
ঠিক এমনিসময় শীতল বাতাস পরশ বোলাল আমার মুখে। বাতাসের আরেকটি দমক চুল উড়িয়ে নিল।
ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল মুভি থিয়েটার ভেদ করে। জ্যান্ত আসনগুলোয় জোরাল বাতাস আমাদেরকে ঠেসে ধরতেই কয়েকজন ককিয়ে উঠল… হাওয়া এমনভাবে ধাক্কাচ্ছে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
‘শ্বাস…নিতে…পারছি না…’ কোনমতে আওড়ালাম। এবার চারপাশ থেকে আর্তচিৎকার উঠল।
‘দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!’
‘থামান! প্লিজ-থামান! ‘
‘বন্ধ করুন! বন্ধ করুন!’
‘ঘূর্ণিঝড় কেমন লাগছে?’ পর্দার পাশ থেকে রক্ত হিম করা হুঙ্কার ছাড়ল অমঙ্গল।
ছবিতে লোকজন আহাজারি করছে, চেঁচাচ্ছে-শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসের ঝাপ্টা সামলাতে চোখ বোজা আমার।
‘ঘূর্ণিঝড়ের ঠেলা সামলাও!’ অমঙ্গল আবারও হেঁকে বলল। নিষ্প্রাণ, শীতল অট্টহাসিটা হেসে উঠল। জান উড়ে গেল আমার। ‘বাঁচো! বাঁচো!’ চেঁচাচ্ছে।
বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার জোগাড় আমার। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ প্রায়। শোঁ-শোঁ তেজী বাতাস অসম্ভব শক্তিশালী ঠেকছে। এবার অমঙ্গলের দ্বিতীয় মুখটাকে গর্জাতে শুনলাম।
‘কী করছ এসব?! থামো, গর্দভের দল! অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে! ওদেরকে মারতে চাও নাকি?!’
নয়
বাতাস থামল।
শ্বাসের জন্য আঁকুপাঁকু করছি, হিমশীতল গালজোড়া দু’হাতে চেপে ধরলাম। এবার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে মসৃণ করলাম।
অ্যাম্বুলেন্সের বিলাপধ্বনির মত দমকা বাতাসের উথাল- পাতাল হাহাকার এখনও কানে লেগে রয়েছে। লম্বা দম নিয়ে আস্তে-আস্তে ছাড়লাম।
‘সিনেমাটা দেখেছিলে?’ অমঙ্গল জবাব চাইল। ‘ঝড়ো বাতাসে মানুষগুলোর কী করুণ হাল হয়েছিল দেখনি? ওরা ভয়ে একদম কাবু হয়ে গিয়েছিল! কী অপূর্ব দৃশ্য! আহা!’
চেয়ারটা স্পন্দিত হচ্ছে আমাকে ঘিরে। পিঠে ওটার হৃৎকম্পন টের পাচ্ছি। শিউরে উঠলাম।
‘ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় কাহিল মানুষগুলো,’ বলে চলেছে অমঙ্গল, ‘খানিকটা বিচারবুদ্ধিও হারিয়ে ফেলেছিল।’ ব্যঙ্গ করল। ‘দারুণ না?’
মাথাটা ঘুরে গেল ওর, এবং টকটকে লাল মুখখানা কথা বলল।
‘তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলে। ওদের মগজগুলোকে স্রেফ জাউ বানিয়ে দিয়েছিলে।’
‘কী বলতে চাও?’ কালো মুখটা খ্যাক করে উঠল। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ভয় আর বাস্তবতা নিয়ে আমার গবেষণাটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। কোথাও কিছু একটা গুবলেট হয়ে যায়। পার্কে আতঙ্কের মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, আমরা যেজন্যে অন্য এক জগতে চলে যাই।’
দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর।
‘হ্যাঁ, প্যানিক পার্ক আমি বন্ধ করে দিই। এবং তার পরপরই আমার এমন সাধের পার্কটা ঘুরপাক খেতে-খেতে দূরে সরে যায়…এটা সমান্তরাল পৃথিবীতে চলে যায় ঘুরতে-ঘুরতে। দুনিয়া ঘুরে চলেছে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা সেই ১৯৭৪ সালেই আটকে রয়েছি।’
হ্যাটটা তুলে নিয়ে মাথায় ঘোরাল ও।
‘প্রথম-প্রথম ভাল লাগত,’ বলল। ‘ভয় নিয়ে আরও পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালানোর সময়-সুযোগ পেয়েছিলাম কিনা। আমার গবেষণাগুলো দুর্দান্ত ছিল। আতঙ্কের সত্যিকারের রাস্তাটা চিনতে পেরেছিলাম আমি।
পাঁই করে ঘুরে গেল মাথাটা।
তোমার কারণে অনেক মানুষ উধাও হয়ে যায়,’ লালমুখো বলল। ‘আর অনেক মানুষ আবছায়া হয়ে গেছে।’
এবার প্রথম মুখটা ফিরে এল পাক খেয়ে।
‘মুরগি জবাই না করলে মুরগির সুপ রাঁধবে কীভাবে!’ গমগমে কণ্ঠে বলল। ‘ভয়ের গবেষণাটায় রোমাঞ্চ ছিল। কিন্তু একসময় আমি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠি। ঠিক করি আসল দুনিয়ায় ফিরব।’
দস্তানামোড়া হাতজোড়া দিয়ে চওড়া কানাওয়ালা হ্যাটটা ঘোরাচ্ছে অবিরাম।
‘কিন্তু ফিরব কী করে? সমস্যাটা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। আর কী পেলাম জানো? আবিষ্কার করলাম এখনকার হররল্যাণ্ড পার্কটা বানানো হয়েছে আগে যেখানে প্যানিক পার্ক ছিল ঠিক সে জায়গাটাতে।
‘আরও আবিষ্কার করি আয়না ব্যবহার করে প্যানিক পার্ক আর হররল্যাণ্ডের সামনে-পেছনে চলাচল করা যায়। খুব ছোট আয়না দিয়েও হররল্যাণ্ডে চলে যেতে পারি আমি। আবিষ্কারটা অসাধারণ। কিন্তু ততদিনে…একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটে যায় আমার।’
‘কী? আমার কথা বলছ?’ লালচান রেগে কাঁই। ‘আমি দুর্ঘটনা?’
‘চোপরাও! চোপরাও!’ কালাচান চেঁচিয়ে উঠল। ও আমাদের উদ্দেশে ফিরল। ‘দু’মুখো এক আয়না নিয়ে গবেষণা করছিলাম। ওটা ব্যর্থ হয়। ফলে আমার মাথার সাথে ওই কুৎসিত মুখটা জুড়ে যায়।’
‘আমি কুৎসিত? আর তুমি? হুঁহ, নিজেকে সিনেমার নায়ক ভাব, তাই না?!’ অন্য মুখটা বলল। ‘দেখো, বাছারা, আমার নীল চোখজোড়া কত সুন্দর, সোনালী ভ্রূ দুটো দেখলে যে কোন মেয়ে পাগল হয়ে যাবে। ভোটাভুটি হয়ে যাক্, দেখা যাবে সুদর্শন হিসেবে কে বেশি ভোট পায়!’
ছেলে-মেয়েদের সারির পেছনে চাইলাম। কেউ নড়ছে না। জীবন্ত, দপদপানো চেয়ারগুলো বন্দি করে রেখেছে আমাদের। নিঃশব্দে দু’মুখো, উন্মাদ দানবটার দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সবাই।
‘আমি তোমাদের সাহায্য চাই,’ অমঙ্গল মুখ খুলল। ‘ভয়ের মাত্রা এতটাই চড়তে হবে তোমাদের, প্যানিক পার্কটা যেন বাস্তব জগতে নিজের জায়গাটা খুঁজে পায়। আতঙ্ক আমাদেরকে এখানে এনেছে, আর এই আতঙ্কই আমাদের যথাস্থানে ফিরিয়ে নেবে।’
আমার সারির শেষ প্রান্তে বসা রায়ান। ওর চোখজোড়া চরম ক্রোধে জ্বলছে। শেষমেশ কথা বলল ও।
‘কক্ষনো না!’ ধমকে উঠল, মুঠো পাকিয়ে ঘুষি ঝাড়ল অমঙ্গলের উদ্দেশে। ‘আমরা কখনওই আপনাকে সাহায্য করব না!’
আমরা একসঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচাতে লাগলাম।
‘কক্ষনো না!’ কিশোর চিৎকার করে উঠল। ‘কক্ষনো না!’
‘খাইছে, চলো, এখান থেকে ভাগি আমরা,’ মুসা চিল চিৎকার ছাড়ল।
বাতাসে এক হাত দোলাল অমঙ্গল। সঙ্গে-সঙ্গে কোমরে চেপে বসল আমার চেয়ারটার বাহুজোড়া। এবার উঠে এসে গলা টিপে ধরল।
বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছি, চেয়ারের বাহু দুটো আঁকড়ে ধরে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ছটফটাতে লাগলাম।
আবারও হাত দোলাল অমঙ্গল-এবং চেয়ারের দু’বাহু দেবে গেল আমার দু’পাশে।
‘আর্তনাদ করার জন্যে গলা তৈরি রেখো, বাছারা!’ চেঁচিয়ে উঠল অমঙ্গল। মঞ্চের একপাশের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল। মিল্টন উদয় হয়েছে, লম্বা ফিয়ার মিটারটা সামনে ঠেলছে।
‘মিটার মাত্র পঁচিশে উঠেছে,’ জানাল অমঙ্গল। ‘তোমরা কিন্তু ঠিকমত চেষ্টা করছ না!’
মাত্র পঁচিশ, ভাবলাম। এতেই যে দশা, একশোতে উঠলে কী হবে?!
‘ভয়! আরও ভয়!’ লালচান গর্জাল। ‘ভাবলেই কেমন গা ছমছম করে!’
ওর কথাগুলো কামরাময় শীতল আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিল। ফিয়ার মিটারের কাঁটা একটুখানি লাফিয়ে উঠল। আমরা সবাই ভয়ার্ত, কারণ আমরা জানি ও ঠাট্টা করছে না। এবং ব্যাটা বদ্ধ উন্মাদ একটা।
‘তোমরা ফিয়ার মিটারে চোখ রাখো,’ মিল্টন বলে উঠল।
প্রকাণ্ড থাবা দিয়ে চাপড়াল ওটার একপাশ। ‘লাল কাঁটাটাকে একদম ওপরে তুলতে হবে আমাদের!’