দুঃস্বপ্নভূমি – ২৫

পঁচিশ

‘আপনাদের শেষ অধ্যায়!’ হুঙ্কার ছাড়ল কিশোর, সাহস হারায়নি। ‘আমাদের নয়। আমরা এখনও ফুরিয়ে যাইনি!’

স্কেলিটনের বাহু জড়িয়ে থাকা ড. স্নেকি মাথা তুলল।

‘মুখ সসসসামলে কথা বলো!’ হিসিয়ে উঠল।

বা স্কেলিটন প্রকাণ্ড সাপটাকে পেভমেন্টে নামিয়ে দিতে ঝুঁকল।

আপনার ওজন দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে, সেকি,’ বলল। ‘আজকে কটা ইঁদুর সাবড়েছেন?’ জান

শি’কামড়াব কিন্তু!’ খেঁকিয়ে উঠল অপমানিত সাপটা।

‘এই যে, হারু পার্টি, ভালমত দেখো,’ বলল হ্যালি, এপাশ- ওপাশ ঘুরছে চোখজোড়া ওর। ‘কোন সুযোগ নেই তোমাদের। অর্ধেক তো এরমধ্যেই আবছায়া আর অদ্ভুতুড়ে মানুষ হয়ে গেছ!’

আজ পুতুল হওয়ার চেয়ে সে-ও ভাল!’ চিৎকার ছাড়ল ইমন। – হেসে উঠতেই মৃদু ঝাঁকি খেল হ্যালির দেহ।

‘তুমি আমাদের সবাইকে হার মানিয়েছ, ইমন। তুমি এক অদৃশ্য অদ্ভুতুড়ে! হাহাহা। তোমার সামনে এই হাস্যকর সঙটাও নস্যি!’ ড. ক্রেজির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল।

‘কী! আমি সঙ?!’ হুঙ্কার ছাড়ল ড. ক্রেজি। ‘দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।’ চরকির মত ঘুরল হ্যালির উদ্দেশে। ‘তোকে ভেঙে টুকরো- টুকরো করে ফেলব, কেঠো ফালতু পুতুল কোথাকার!’

‘হয়েছে, হয়েছে, চোপরাও, সাগর কুত্তারা!’ গমগমে গলায় বলে উঠল ক্যাপ্টেন সিলভার, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ক্রাচ দোলাচ্ছে। আমার সাথে সাগরযাত্রা করলে দলবদ্ধ থাকতে হবে! সবার জন্যে এক আর একের জন্যে সবাই। সাত সাগরের আইন এটাই!’

এবার শয়তানবাহিনী একসঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। ড. স্নেকি ক্যাপ্টেন সিলভারের কাঠের পায়ে কামড় বসাল। ক্যাপ্টেন ধাঁই করে ক্রাচের এক মোক্ষম বাড়ি মারল সাপটার শরীরের মাঝ বরাবর।

ভি সবাই চুপ!’ গবেষক স্কেলিটন চেঁচাল, মাথার ওপরে দু’হাত নাড়াল।

আমরা কেউই এক চুল নড়লাম না। বাড়ির দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সবাই।

ঘটনাটা কী? বদমাশগুলো এত উত্তেজিত কেন? একে অন্যের সঙ্গে বিবাদের কারণটাই বা কী? চা

শেষমেশ, স্কেলিটন শান্ত করতে পারল ওদেরকে। এবার আমাদের উদ্দেশে উল্টো ঘুরল।

‘যা বলছিলাম, এটাই শেষ অধ্যায়। আমাদের সবার জন্যেই!’

‘মানে?’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘বু-বুঝলাম না। আপনাদের জন্যে শেষ চ্যাপ্টার কেন?’

‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল মুসা। ‘আপনারা অমঙ্গলের হয়ে কাজ করছেন না?’

মাথা ঝাঁকাল স্কেলিটন।

‘হ্যাঁ, আমরা অমঙ্গলের হয়ে কাজ করতে এসেছিলাম। মিল্টন আমাদেরকে বাছাই করেছিল। ভাল প্রস্তাব দিয়েছিল।’

খটখটিয়ে উঠল ভৌতিক কেঠো পুতুর হ্যালির চোয়াল।

‘অমঙ্গল বলেছিল আমরা এক দল ছেলে-মেয়েকে ইচ্ছেমত ভয় দেখাতে পারব,’ রুক্ষ কণ্ঠে বলল। ‘প্রস্তাবটা মনে ধরে আমাদের, সবাই লুফে নিই। জানই তো, বাচ্চাদের ভয় দেখানো কেমন মজা।

সাপটা শরীর উঁচাল।

‘ও আমাদের বলেছিল সসসময়টা ভাল কাটবে। আমাদের কাজ শুশুশুশুধু তোমাদেরকে ভয় দেখিয়ে হররল্যাণ্ড থেকে তাড়ানো। তোমাদের বোঝানো হররল্যাণ্ড নিরাপদ নয়।’

‘আই, কাজটা আমরা ভালভাবেই পেরেছি,’ সগর্বে ঘোষণা করল ক্যাপ্টেন সিলভার।

‘আমরা তোমাদেরকে বিশ্বাস করাই হররল্যাণ্ড সবচাইতে ভয়ঙ্কর জায়গা,’ বলল গবেষক স্কেলিটন। ‘তাই তোমরা ভেগে প্যানিক পার্কে আসতে মরিয়া হয়ে ওঠো।’

স্কেলিটন আমার দিকে চাইল।

‘এতে কাজও হয়েছে,’ বলল।

‘অবশ্য আরেকটু হলেই সব কেঁচে যেত ওই গর্দভ হরর ম্যাকনামারাটার কারণে-ব্যাটা তোমাকে, কিশোর আর মুসাকে এর মধ্যে টেনে এনে সমস্ত কিছু ভণ্ডুল করে দিচ্ছিল।’

‘কী বলছেন এসব?’ বললাম। ‘এই ম্যাকনামারাটা আবার কে?’

ছাগুলে দাড়িতে হাত বোলাল ও।

‘দানব এক্স কে জানো না?’ জবাব চাইল স্কেলিটন। ‘তোমাদেরকে হররল্যাণ্ড নিয়ে তথ্য জোগাচ্ছিল ম্যাকনামারাই তো। দানব এক্সই তো ম্যাকনামারা!’

‘ম্যাকনামারা আমাদের উপকার করতে চাইছিল বলছেন?’ কিশোর প্রশ্ন ছুঁড়ল।

‘ওটা যে ম্যাকনামারা আপনি জানলেন কীভাবে?’ জবাব দাবি করলাম।

শ্রাগ করল স্কেলিটন।

‘আমি সবই জানি। সবখানে আমার চর আছে। আমার কাছে কোন কিছু গোপন রাখা এত সহজ নয়!’

‘হা-হা! স্কেলিটনও উন্মাদ!’ চিৎকার ছাড়ল ড. ক্রেজি। ‘উন্মাদের শাসন! পাগলের পৃথিবী!’ এক পাক পাগলাটে নাচ নেচে নিল। কিন্তু থামতে হলো আলখিল্লায় পা বেধে যেতেই।

‘আমাদের কাজটাই ছিল তোমাদেরকে হররল্যাণ্ড থেকে ভয় দেখিয়ে খেদানো,’ স্কেলিটন জানাল। ‘আর প্যানিক পার্কে আনার পর তোমাদের আতঙ্কের মাত্রা চরমে তুলে দেয়া। অমঙ্গল ভয়ানক চালাক। জেনেবুঝেই আমাদেরকে জড় করেছে তোমাদের ভয় দেখাতে।’

‘আমাদেরকে এসব কথা বলছেন কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘চুপ! হিসিয়ে উঠল স্নেকি।

‘অন্যের মন পড়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে আমার,’ বলল স্কেলিটন। ‘কারও সাধ্যি নেই আমার কাছে কিছু গোপন করে। এমনকী অমঙ্গলেরও না। আমি এইমাত্র ওর মন পড়ে জেনেছি। এইমাত্র। এবং যা জেনেছি তাতে খুশি হতে পারিনি।’

‘কী জেনেছেন?’ আমার প্রশ্ন।

চোখ সরু করল স্কেলিটন।

‘ফিয়ার মিটার যেই একশোতে উঠবে এবং প্যানিক পার্ক পৃথিবীতে ফিরবে, অমনি ও তোমাদেরকে পার্কে বন্দি করে রাখবে-চিরতরে। এবং সঙ্গে আমাদেরকেও!’

‘সবাইকে?’ আঁতকে উঠলাম রীতিমত।

‘হ্যাঁ, আমাদের সবাইকেই,’ জানাল স্কেলিটন। ‘কাজ সারা হয়ে গেলে কেউ আর ঘরে ফিরতে পারবে না।’

‘আমি…তারপরও বুঝতে পারছি না আপনি আমাদেরকে এসব কথা কেন বলছেন,’ বললাম।

‘কারণ আমরা তোমাদের সাহায্য চাই!’ আর্তনাদ ছাড়ল ড. ক্রেজি।

‘কী?!’ বিস্ময়ের সীমা রইল না আমাদের।

মাথা ঝাঁকাল হ্যালি।

‘যা বলব তা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না,’ বলল। ‘কিন্তু আমাদেরকে তোমাদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে হবে, হারু পার্টি।’

‘একমাত্র এভাবেই আমরা ওকে হারাতে পারি,’ বলল স্কেলিটন। ‘ওকে ধ্বংস করতে পারি।

‘হাঁ হয়ে গেছে কিশোর। স্কেলিটন আর হ্যালির দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।  

‘আপনারা ঠাট্টা করছেন, তাই না?

‘একটু বুঝে নিই। আপনারা চান অমঙ্গলকে ধ্বংস করতে আমরা আপনাদের সাথে হাত মেলাই?’ ভিভ ভেবেচিন্তে প্রশ্ন করল।

‘তোমাদেরকে ওর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে!’ জানাল স্কেলিটন।

হেসে উঠল কিশোর।

‘হুম, বুঝেছি।’ আমাদের দিকে ফিরল। বুঝেছ তো? এটা একটা ফাঁদ। কৌশল। এটাই শেষ ভয়। শেষ দফার আতঙ্কে ফিয়ার মিটারের মাত্রা সর্বোচ্চ সীমায় চড়বে। আর তাতে লাভ হবে এদের, এরাই জিতবে।’

না! খলনায়কদের দলটিকে উদ্দেশ্য করে গর্জে উঠল রায়ান। ‘আমরা কিছুতেই আপনাদের সাহায্য করব না! কিছুতেই না!’

চোদ আমরা সুর মেলালাম: ‘কিছুতেই না! কিছুতেই না!’ অন্যদের সঙ্গে উচ্চারণ করে যাচ্ছি, দেখলাম নিমেষে পাল্টে গেল ভিলেনদের মুখের চেহারার অভিব্যক্তি। শয়তানী, কুটিল চাউনি ভর করেছে ওদের চোখে। থমথম করছে কুৎসিত মুখগুলো।

ভয় জেঁকে বসল বুকে আমার।

শয়তানের দল ক্রমশ কাছিয়ে আসতেই টের পেলাম আতঙ্কে জমে গেছে দেহের প্রতিটা মাংসপেশী….শেষ অধ্যায়টির জন্য এগিয়ে আসছে ওরা…এটাই ওদের সর্বশেষ হামলা। চূড়ান্ত আঘাত। ‘

ছাব্বিশ

পালাব কোথায়?

ওরা দ্রুত এগোচ্ছে। দালানের দেয়ালে কোণঠাসা করে ফেলল আমাদের।

হ্যালির চোখজোড়া উত্তেজনায় ঘুরপাক খেতে দেখলাম, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে যখন ধরতে এল আমাকে।

আমি মাথা নোয়াতে পারার আগেই, কাঠের মুখটা চেপে বসল আমার গালে। এবার কর্কশ স্বরে আমার কানে আওড়াল: ‘আমরা তোমাদের পছন্দ করি না-আর তোমরা আমাদের। কিন্তু তোমরা উদ্ভট, কিম্ভূতকিমাকার জীবগুলোই একমাত্র ওর মোকাবেলা করার শক্তি রাখো।’

‘মানে?’ প্রশ্ন করলাম। ‘কীভাবে ওর মোকাবেলা করব আমরা? অমঙ্গলের সাথে আমরা পারি?’

ওকে দেখাবে তোমরা ভয় পাও না,’ জবাবটা দিল স্কেলিটন। ‘ওর পার্কটাকে জীবন্ত রাখতে হলে তোমাদের ভয়ের শক্তি ওর দরকার। তোমাদের আতঙ্কমাত্রা নেমে গেলেই, দুর্বল হয়ে পড়বে অমঙ্গল।’

‘ওর মুখোমুখি হও। ওর সামনে দাঁড়িয়ে মুখের ওপর হাসো!’ ঘোষণা দিল ড. ক্রেজি। মাথাটা পেছনে ঝাড়া মেরে ঘোড়ার মত চিঁহিঁহি ডাক ছাড়ল। ‘এরকম কিছু।’

‘বলেছি তো, আমি ওর মন পড়েছি। কী জেনেছি শোনো। ওর সামনে যদি বুক চিতিয়ে দাঁড়াও, ভয় না পাও,’ বলে চলল স্কেলিটন, ‘অমঙ্গল স্রেফ উধাও হয়ে যাবে, আর সে সঙ্গে ওর প্যানিক পার্কও। ওর দিকে ছোট নজরে চাইলে, ওর জগৎ কুঁকড়ে যেতে শুরু করবে। অমঙ্গল আর পার্কটা ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাবে-যতক্ষণ না নিছক ঝাপসা স্মৃতিতে পরিণত হয়।’

‘খাইছে, এতই যদি সোজা তো আপনারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন?’ মুসা বলে উঠল।

‘এটা নির্ভীক কোন ক্যাপ্টেনের কাজ নয়,’ জলদস্যুসর্দার সিলভার জবাবে বলল। ‘আমি হলাম সতেরো সাগরের আতঙ্ক!’

‘তোমার পা কাঠের তৈরি, না মাথাটা?’ সিলভারের উদ্দেশে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল হ্যালি। ‘সাগর তো মাত্র সাতটা, তুমি সতেরো পেলে কোথায়?!’

‘আমি এমন সব জায়গায় গেছি তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ভুয়া কেঠো পুতুল,’ ভ্রূকুটি করে বলল জলদস্যু। ‘দুঃসাহসী ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে আরেকটা কথা বললে তোমার মাথা দিয়ে নোঙর বানাব!’

‘আর আমি তোমার অন্য পা-টা কামড়ে দেব!’ চিৎকার ছাড়ল হ্যালি, জলদস্যুটির উদ্দেশে সশব্দে চোয়ালজোড়া লাগাল।

‘শান্তি! শান্তি!’ ক্রেজি গর্জন ছাড়ল।

স্কেলিটন ঘুরে দাঁড়াল আমাদের উদ্দেশে।

‘অমঙ্গলকে আমরা হারাতে পারব না,’ জানাল। ‘ও আমাদের আতঙ্ক মাপছে না। তোমাদেরটা মাপছে। তোমরা মানুষ, আমরা নই।’

আমার কবজি পাকড়ে ব্রেসলেটে হাত বোলাল।

‘পুড়ে যাচ্ছে। ভয়ের মাত্রা অনেক উঁচুতে আছে। অমঙ্গল তোমাদের সবার আতঙ্ক মেপে যাচ্ছে।’

‘কাজেই, হারু পার্টি, কাজটা তোমাদেরই করতে হবে,’ বলল হ্যালি। ‘তোমরা ওর ম্যানশনে ফিরে যাও। ওকে খুঁজে বের করো। দেখাও তোমরা একটুও ভয় পাওনি। ব্রেসলেটগুলোকে ঠাণ্ডা করো।’

‘ওকে নিচু নজরে দেখো,’ বলল স্কেলিটন। ‘তোমাদের আতঙ্কমাত্রা পড়ে গেলেই ছোট হয়ে যাবে ও। সাথে ওর পার্কটাও। ও একবার খুদে আর দুর্বল হয়ে গেলেই হলো, এখান থেকে কীভাবে পালাতে হবে জানি আমরা।’

‘যাও-এক্ষুণি!’ হুঙ্কার ছাড়ল ক্রেজি। কিশোর আমাদের দিকে ফিরল।

তোমরা কী বলো?’ শুধাল। ‘এটা কোন ফাঁদ নয় তো? ওদেরকে বিশ্বাস করা যায়?’

‘না,’ জবাবে বলল রায়ান। ‘বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু উপায় কী?’

পাঁই করে ঘুরে সামনে চলে এল ওর দু’নম্বর মুখটা।

‘বাহ্, বাহ্, বাহ্,’ বলে উঠল ওটা। কালো, দীর্ঘ, চেরা জিভটা বের করে দেখাল।

চকিতে ফিরে এল রায়ানের আসল মুখ।

‘আমার কথা বুঝতে পেরেছ? নিজেদের অবস্থা দেখো। আমরা শেষ হয়ে গেছি। একদম খতম! আমার মনে হয় চেষ্টা করে দেখা উচিত। এরচাইতে খারাপ আর কী হবে তাই না?’

বিখ্যাত সেই শেষের শব্দগুলোই আওড়াল ও।

গবেষক স্কেলিটন আর ড. ক্রেজির নেতৃত্বে পার্কের ওপ্রান্তে চললাম আমরা, অমঙ্গলভবন অভিমুখে। অন্যান্য খলনায়করা ছড়িয়ে পড়ল।

আমরা নিঃশব্দে রাইড, গেম্‌স্‌ আর ফাঁকা রেস্তোরাঁগুলোর পাশ কাটাচ্ছি, সবই রঙহীন আর ধূসর।

আমি কি নার্ভাস?

নিজেও জানি না।

গলা এতটাই শুকনো ঠেকছে, ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরে এমনভাবে কাঁপছে যেন এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাপ্টাচ্ছে।

আমরা কি কোন ফাঁদে পড়তে চলেছি?

আমরা কি সত্যিই সাহস করে অমঙ্গলের সামনে দাঁড়াতে পারব? ওকে অগ্রাহ্য করতে পারব?

উঁচু এক সার গাছের কাছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দল হরর। ওরা কথা থামিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে যেতে দেখল।

‘ভেবেছিলাম হররল্যাণ্ডের হররগুলো আমাদের দলে, ‘ স্কেলিটনকে বলল কিশোর। ‘মনে করেছিলাম ম্যাকনামারা আমাদের দেখভালের আদেশ দিয়েছে ওদেরকে। প্যানিক পার্কে কী করছে ওরা?’

‘এই হররগুলো মিল্টনের লোক,’ জবাবে বলল স্কেলিটন। ‘ও-ই ওদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে।’

‘এরা বিপজ্জনক,’ বলল ক্রেজি। ‘মানুষ নয়। যে কোন কিছু করে বসতে পারে। ঠিক আমার মত। হাহাহা!’

আর কেউ হাসল না।

উঁচু অট্টালিকাটির ছায়ায় পা রাখলাম আমরা। কাকেরা কর্কশস্বরে কা-কা করে উঠল, দুর্গের ছাদ ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। সামনের সিঁড়ির মাথায় চার ছায়ামানুষ সতর্ক পাহারায় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।

‘এসো,’ অনুসরণ করতে বলল স্কেলিটন। ‘পাশে দরজা আছে। পাহারা নেই। ওখান দিয়ে ঢুকে পড়ো। হল-এর শেষ মাথায় অমঙ্গলের স্টাডি।’

আমার ব্রেসলেটটা কাঁটা বেঁধাচ্ছে। কবজি পুড়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড তাপে।

মিটারের সর্বোচ্চ মাত্রা ছুঁয়েছে প্রায় আমার ভয়। অন্যরাও কি আমার মতই সমান আতঙ্কিত?

যদি তা-ই হয়, তবে নির্ঘাত ব্যর্থ হব আমরা।

সবাই যখন পাতার মত কাঁপছি, তখন অমঙ্গলকে দেখাব কীভাবে ওকে আমরা ডরাই না একরত্তি?

পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে, পা টিপে-টিপে পার্শ্ব দরজার দিকে চললাম প্রত্যেকে। নিচু এক খিলানের আড়ালে ঢাকা পড়েছে কালচে এক দরজা। কোন হাতল কিংবা নব নেই ওটায়।

‘খুলব কীভাবে?’ ফিসফিস করে বলল ডেমি।

‘কি কার্ডটা দিয়ে চেষ্টা করে দেখি, বলল কিশোর। হাত ঢোকাল জিন্সের পকেটে। সব কটা পকেট হাতড়াল। ‘আরি, গেল কই? মনে হয় এলিভেটরে ফেলে এসেছি।’

‘সমস্যা নেই,’ আশ্বাস দিল স্কেলিটন। ‘আমি ব্রেইন পাওয়ার খাটাচ্ছি।’

দরজাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল গভীর মনোযোগে। ক’মুহূর্ত পরে, ধীরে-ধীরে খুলে গেল ওটা।

‘জলদি, জলদি!’ স্কেলিটন হাতছানি দিয়ে আমাদের ভেতরে ডাকল।

‘আপনি যাবেন না আমাদের সাথে?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করলাম।

‘না,’ জবাবে বলল স্কেলিটন। ‘ও আমাদেরকে দেখলেই বুঝে যাবে, সন্দেহ করবে কোন গোলমাল আছে। যা করার তোমাদেরকেই করতে হবে।’

‘সুযোগটা হেলায় হারিয়ো না!’ চেঁচিয়ে উঠল ক্রেজি।

‘মনে রেখো-ভয় নয়,’ নিচুস্বরে বলল স্কেলিটন। ‘ওকে একটুও পাত্তা দিয়ো না। খেয়াল রেখো ফিয়ার মিটার যেন একদম নিচে নেমে আসে।’

পথ করে নিয়ে বাড়িটায় ঢুকলাম। চারদিকে চাইলাম। লম্বা, অন্ধকার এক হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আমরা। দেয়ালগুলো নির্ভেজাল কালো। ছাদটা নিচু।

হল বরাবর কটা সরু দোরগোড়া দেখলাম। সব কটা দরজাই বন্ধ।

হাঁটছি আমরা। পায়ের নিচে পুরু গালিচা। চুপিসারে চলেছি সবাই।

কিশোর সবার সামনে। হাতজোড়া শক্ত মুঠো পাকিয়ে রেখেছে।

রায়ান ওর ঠিক পেছনে হাঁটছে, চোখজোড়া সরু, গোটা দেহ টানটান ওর। মাথার পেছনে, দানবমুখটা লালা ঝরাচ্ছে শার্টে।

অ্যাণ্ডিনা আর নেলী পরস্পরের কোমর জড়িয়ে ধরে হেঁটে চলেছে, কাঁপুনি থামাতে চাইছে এভাবে। দুই ছায়ামানুষ, ডেমি আর রয় ভাসছে ওদের পেছন পেছন।

আমরা বাদবাকিরা অনুগমন করছি, হাঁটছি নিঃশব্দে, আমাদের চোখ সতর্ক, বুক ঢিবঢিব করছে।

একটা কোনা ঘুরলাম। পরের হলটাও শূন্য। দেয়ালে টাঙানো প্রকাণ্ড সব সাদা-কালো পোর্ট্রেট। অমঙ্গলের ছবি। কয়েক ডজন।

ওদের চোখ যেন অনুসরণ করছে আমাদের, পা টিপে-টিপে যখন পাশ কাটাচ্ছি আমরা।

কিশোর এসময় এক হাত তুলে আমাদের থামতে ইশারা করল। কোনায় একটা খোলা দরজা দেখলাম। প্রথম কোন দরজা খোলা পেলাম। ভেতরে আলো জ্বলছে। দরজার ওপাশে কে যেন রয়েছে…

আরেকটু কাছিয়ে গেলাম সবাই।

শ্বাস চাপলাম যখন দেখলাম চেয়ে রয়েছি অমঙ্গলের দিকে। মুসার হাত চেপে ধরলাম।

সবাই জমে গেছে। কবজিতে পোড়া যন্ত্রণার এক বলয় তৈরি করেছে আমার ব্রেসলেটটা।

মস্ত, কালো এক ডেস্কের পেছনে বসা অমঙ্গল। এটি ওর পড়ার ঘর!

মেলে রাখা এক বইয়ের ওপর ঝুঁকে রয়েছে ও। মন দিয়ে পড়ছে, কালো চুলের গোছা কপাল বেয়ে নেমে এসেছে।

অতিকষ্টে শ্বাস টানলাম। পা কাঁপছে।

সাহসী হব কীভাবে?

অন্য কেউই বা এমন অশুভ শক্তির সামনে সাহস দেখাবে

কেমন করে?

কিশোর হাত নেড়ে ডাকল আমাদের। ঘরটির দরজা লক্ষ্য করে ধীর পায়ে এগোলাম আমরা।

মোক্ষম সময় এসেছে। শেষ সুযোগ আমাদের। আমরা কি অসফল হব? বাঁচব তো?

একসঙ্গে হেঁটে, দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা।

এবং পরক্ষণে, পাঠকক্ষ থেকে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে, দরজার কাছে ছুটে চলে এল মিল্টন। দু’বাহু ছড়িয়ে পথ আগলে দাঁড়াল আমাদের।

‘সরি, বাছারা,’ বলল। ‘ভিজিটিং আওয়ার মঙ্গলবার!’

সাতাশ

মিল্টনের বুকে সজোরে ধাক্কা দিল কিশোর। আর ওর পাঁজরে মাথা দিয়ে ঢু মারল রায়ান।

টলে উঠে পিছিয়ে গেল মিল্টন।

পথ করে নিয়ে পাঠকক্ষে ঢুকলাম আমরা। জড় হলাম

অমঙ্গলের ডেস্কের সামনে।

ওর পেছনে এক সার উঁচু-উঁচু বুকশেলফ। কোনায় দাঁড়িয়ে এক ফিয়ার মিটার। লাল দাগটা এখন লাফাচ্ছে ৯৫-এ।

‘ভয় করি না!’ চিৎকার ছাড়লাম। কিন্তু এতটাই ঠকঠকিয়ে কাঁপছি, মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না।

অ্যাণ্ডিনা আর নেলী শব্দ তিনটে লুফে নিল।

‘ভয় করি না!’ বলে উঠল। এবং অন্য সবাই পুনরাবৃত্তি করল।

বই থেকে সময় নিয়ে মাথা তুলল অমঙ্গল। কালো চোখজোড়া আমাদের সারির ওপর বুলিয়ে আনল, প্রত্যেকের ওপর ওর দৃষ্টি স্থির হলো ক’মুহূর্তের জন্য।

পাল্টা চেয়ে রইলাম আমরা। চোখের পাতা ফেলছি না। চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

‘ভয় করি না! ভয় করি না! ভয় করি না!’

আমরা সবাই সবার হাত চেপে ধরেছি এবং মন্ত্রপাঠের মত করে আওড়ে চলেছি শব্দগুলো।

‘ভয় করি না! ভয় করি না!’

মন্ত্রোচ্চারণ করছি, টের পেলাম ক্রমেই ভীতি কেটে যাচ্ছে। নিজেকে শক্তিশালী ভাবছি। কাজ হচ্ছে বুঝলাম।

‘ভয় করি না! ভয় করি না! ভয় করি না!’

পারব আমরা! ভাবলাম।

ওকে ছোট করতে পারব। পারব পরাজিত করতে। ফিয়ার মিটারের লাল দাগটা একটুও নড়েনি, ৯৫-এ স্থির। অমঙ্গল ধীরেসুস্থে বন্ধ করল বইটা। ডেস্কের ওপরে হাতজোড়া রাখল। খানিকক্ষণ পাল্টা চেয়ে রইল আমাদের দিকে। মুখের চেহারা ভাবলেশহীন ওর। কালো চোখে কোন অভিব্যক্তি নেই।

‘ভয় করি না! ভয় করি না!’

এবং তারপর…ডেস্কটা চাপড়াল অমঙ্গল। মাথাটা পেছনে ঝটকা মেরে হেলিয়ে অট্টহাসি হাসল।

তোমরা এত বোকা কেন?’ গর্জাল।

মন্ত্রপাঠ থেমে গেল চোখের পলকে। দু’পাশ থেকে আমার

হাত ছেড়ে দিল মুসা আর টিনা।

এক লাফে উঠে দাঁড়াল অমঙ্গল। ওর চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিতেই বইয়ের শেলফে সশব্দে বাড়ি খেলা

‘ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলেই আমাকে হারাতে পারবে ভেবেছ?’ গমগমে গলায় বলে উঠল।

‘কিংবা আমাকে?’ দ্বিতীয় মুখটা হুঙ্কার ছাড়ল।

ফিয়ার মিটারের লাল দাগটা এক লাফে ৯৭-এ চড়ল। অমঙ্গল ডেস্কের ওপর ঝুঁকল, ওর সামনে এক কম্পিউটার কিবোর্ড দেখলাম। কটা কি দাবাল ও। আর বিশা

‘দেখা যাক…. দেখা যাক কী করা যায়, আনমনে আওড়াল।

একটু পরে, জোরাল এক গুঞ্জন শুনলাম। গোটা কামরাটা কেঁপে উঠল থরথরিয়ে।

বোর্ডের আরও কয়েকটা কি চাপল অমঙ্গল।

‘দেখা যাক…’ শীতল হাসি ছড়াল ওর সারা মুখে।

‘শয়তান কোথাকার!’ লালচান খেঁকাল। ‘কী করছ এটা? বাচ্চাগুলোকে মারতে চাও নাকি??

মাথা ঝাঁকাল অমঙ্গল। কিছু কি টিপল।

‘ভয় পাও না, তাই না?’ বলল। ‘এটাই তোমাদের স্লোগান তো? বেশ…আমার স্লোগান হচ্ছে বেশি ভয় পাও!’

কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল কামরাটিতে। পায়ের তলায় নড়ছে মেঝে।

কান চুলকাচ্ছে আমার। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সহসাই টের পেলাম কানে ভালমত শুনতে পাচ্ছি না।

কান চুলকাতে হাত ওঠালাম…এবং অনুভব করলাম ওটার ভেতরে উষ্ণ আর ভেজা কোন কিছুর উপস্থিতি…

‘ইইই!’ কান থেকে ওটা বের করতেই গলা দিয়ে আর্তনাদ বেরোল।

কেঁচো!

মোটা, বাদামী এক কেঁচো।

সামনে তুলে ধরলাম ওটাকে। ছেলে-মেয়েরা চারপাশে আর্তচিৎকার জুড়েছে শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার মাথায় শুধুই কেঁচোটার চিন্তা, জীবন্ত, আমার আঙুলের মাঝে কিলবিল করছে।

এবার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল-হাত দিলাম মুখের ভেতরে। জিভের নিচ থেকে আরেকটা পুরুষ্টু, আঠাল কেঁচো টেনে বের করলাম।

ঘাড় কাত করতেই দেখি ভিভ ওর নাক থেকে কেঁচো টেনে বের করছে। ওর নাকের দুটো ফুটো থেকেই ঝুলছে কেঁচো

রিনার চুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে গা ঘিনঘিনে, কিলবিলে কেঁচো। ও প্রাণপণে টানছে ওগুলোকে মাথা থেকে খসাতে, গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।

আমার পাশে টিনা মুখ থেকে লম্বা এক কেঁচো টেনে বের করছে। যতই টানছে আকারে ততই যেন বাড়ছে ওটা। থুথু ফেলছে…ফেলেই যাচ্ছে…আরেকটা কেঁচো উঁকি মারল ওর ঠোঁটের ফাঁকে।

ছেলে-মেয়েরা সাহায্যের জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। আমরা মরিয়ার মত লড়ছি। শরীর মোচড়াচ্ছি, দমের জন্য হাঁসফাঁস করছি-একের পর এক কেঁচো টেনে-টেনে বের করছি মুখ, কান আর নাক থেকে।

‘কী হলো?!’ বাজখাঁই কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল অমঙ্গল। ‘আমার দিকে তাকাবে না? কই, তাকাও! তোমরা না দুঃসাহসী সব ছেলে- মেয়ে?’

‘খাইছে!’ মুসার তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে ঝট করে চাইলাম। দেখলাম ফিয়ার মিটারে দৃষ্টি সেঁটে রয়েছে ওর।

একদম মাথায়! লাল দাগ এখন ৯৯-এ উঠেছে!

‘ওই শয়তানগুলোর কথা শোনা উচিত হয়নি আমাদের!’ চিৎকার করে বলল কিশোর। ‘ওরা আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে! এটা একটা ফাঁদ! ভয়ঙ্কর ফাঁদ!’

চুলের ভেতর থেকে একটা কেঁচো টেনে বের করে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললাম। আমাদের জুতো ঘিরে কিলবিল করছে ওগুলো। নাক থেকে একটাকে টেনে বের করল রিনা।

ঠোঁটে জিভ বোলাচ্ছি বারবার। মুখ থেকে কেঁচোর জঘন্য স্বাদটা যাচ্ছে না কিছুতেই।

একের পর এক চিন্তা ভর করছে মাথায়। কিছু একটা

করতেই হবে আমাদের। নইলে নির্ঘাত মরণ।

হঠাৎই একটা কৌতুক মনে পড়ল। মুসা বলেছিল।

ওর দিকে ফিরলাম।

‘আপেলে পোকা পাওয়ার চেয়ে খারাপ আর কী আছে?’ প্রশ্ন করলাম। ‘পোকাটা যদি ছোট হয়!’ নিজেই জবাব দিলাম।

ও আমার দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে ফেলল এ অবস্থাতেও।

আঁতকে উঠলাম। ঘরটা কি দুলে উঠল? সব কিছু কি খানিকটা ছোট হয়ে এল?

‘মুসা-হাসতে থাকো!’ বললাম।

ফিয়ার মিটারের দিকে তাকালাম। লাল লাইনটা এখন ৯৮-এ নেমেছে।

‘রবিন,’ বলল মুসা, ‘কোন পোকা গাড়ির উইণ্ডশিল্ডে বাড়ি খেলে শেষ মুহূর্তে কী ভাবে জানো?

শ্রাগ করলাম।

‘মরলে মরি কিন্তু চোখ তো বাঁচুক!’ বলল মুসা। হেসে উঠলাম দু’জনেই।

আবারও নাড়া খেল কামরাটা। এবার আর কোন সন্দেহ রইল না। সত্যিই সব কিছু কুঁকড়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।

টিনা আর রিনা শব্দ করে হাসল।

‘অন্যদেরকেও বলো,’ বলল রিনা।

মুসা কৌতুকটা আবারও বলল। হাসল সবাই। ফিয়ার মিটার এখন ধপ করে ৯০-এ নেমেছে।

‘থামো!’ চিৎকার ছাড়ল অমঙ্গল। ‘থামো! আমরা ছোট হয়ে যাচ্ছি!’

হেসেই চললাম আমরা।

জোরে পা ঝেড়ে জুতো থেকে কেঁচো খসালাম, মাথাটা পেছনে হেলিয়ে হেসে উঠলাম।

‘কোন কেঁচোকে কেটে দু’ভাগ করলে কী পাও?’ হেঁকে বলল মুসা। ‘অমঙ্গল!’

কৌতুকটার কোন মানে খুঁজে না পেলেও, হাসলাম আমরা। হাসছি তো হাসছিই।

‘থামো! থামো বলছি-এক্ষুণি!’ লালচান আর কালাচান সমস্বরে চেঁচানি জুড়েছে। ‘তোমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছি! আমরা কিন্তু ছোট হয়ে যাচ্ছি! ছোট হয়ে যাচ্ছি!’

হাসির চোটে কোথায় উড়ে গেল আমাদের ভয়-ভীতি। এবং আতঙ্ক কমে যেতেই, মিটারের লাল দাগটা নেমে যেতে লাগল নিচে। ৮০… ৭০…

‘কী হলো, থামোহ্!’ শাণিতকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল অমঙ্গল। ‘চোখ নেই তোমাদের? দেখতে পাচ্ছ না কী হচ্ছে?’

পরমুহূর্তে, ওর উচ্চারিত কথাগুলো ভয়াল স্রোত বইয়ে দিল গোটা কামরায়-এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলাম সবাই।

‘বোকার দল, কী করছ দেখতে পাচ্ছ না? বুঝতে পারছ না প্যানিক পার্ক না থাকলে তোমাদের কী অবস্থা হবে? প্যানিক পার্ক নেই তো তোমরাও নেই!’

আটাশ

‘মিথ্যে কথা!’ গর্জাল রায়ান। ‘ও জানে হেরে যাচ্ছে আমাদের কাছে, তাই মিথ্যে বলছে!’

‘কেউ হাসি থামিয়ো না!’ চেঁচাল টিনা। ‘ওকে কুঁকড়ে ছোট বানিয়ে ফেলো! মিটার পড়ে যাক!’

‘না-দাঁড়াও!’ ভিভ বলে উঠল। ‘ও হয়তো সত্যিটাই বলছে। প্যানিক পার্ক উধাও হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব?’

‘হয়তো আমরাও অদৃশ্য হয়ে যাব,’ বললাম।

‘আর কখনও বাড়ি ফিরতে পারব না,’ বিড়বিড়িয়ে বলল রিনা।

‘তারমানে ও সত্যি কথাই বলছে,’ বললাম। ‘হ্যাঁ, সব কিছুই একইরকম লাগছে। এর অর্থ সব কিছুর সাথে আমরাও ছোট হচ্ছি!’

পরমুহূর্তে, ফিয়ার মিটারের লাল দাগটা লাফিয়ে ফিরে গেল ৮০-তে।

‘এই তো!’ সোল্লাসে চেঁচিয়ে উৎসাহ জোগাল অমঙ্গল।

‘এখনও অনেক বাকি!’ লালচানের চিৎকার। ‘ভয় পাও! সাঙ্ঘাতিক ভয় পাও!’

কিশোর আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আতঙ্কে খেপাটে দেখাচ্ছে ওর চোখের কালো মণিজোড়া।

‘আমাদের সামনে কোন্ পথ খোলা? অমঙ্গলকে যদি হারিয়ে দিই…ও আর ওর পার্ক

ওর পার্ক যদি ছোট হতে-হতে মিলিয়ে যায়…হয়তো আমরাও রক্ষে পাব না!’

‘কিন্তু মিটার পুরোটা চড়ে গেলেও আমরা শেষ,’ ডেমি মুর বলল।

খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল অমঙ্গলের।

‘চালিয়ে যাও! চালিয়ে যাও! কতটা ভয় পেয়েছ তা নিয়ে কথা বলো! এ-ই তো চাই! এ-ই তো চাই!’

একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। দুটো মুখই দাঁত কেলাচ্ছে, আমাদেরকে তাগাদা দিচ্ছে।

ফিয়ার মিটারের লাল দাগটা ফের চড়চড় করে উঠে যাচ্ছে চুড়োয়।

এসময় আমাদের পেছন থেকে মিল্টন গর্জে উঠল। ঘুরে চাইতেই দেখি ড. ক্রেজির সঙ্গে জোর ধস্তাধস্তি হচ্ছে ওর।

দুটোয় খানিক কোস্তাকুস্তি করল। এবার ক্রেজি ওর আলখিল্লাটা ছুঁড়ে দিল মিল্টনের দিকে। হররটা যতই যুঝছে, ওটা ততই পেঁচিয়ে যাচ্ছে শরীরে। এবার ঝটিতি আলখিল্লাটা খুলে দিতেই মিল্টন ঘুরপাক খেতে-খেতে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।

হ্যালি, বাহু পেঁচিয়ে রাখা ড. স্নেকিকে নিয়ে গবেষক স্কেলিটন, টালমাটাল মমিটা আর ক্যাপ্টেন সিলভার গটগটিয়ে কামরায় প্রবেশ করল ড. ক্রেজিকে অনুসরণ করে। কুৎসিত ভৌতিক মুখোশটা ভেসে চলে এল দোরগোড়ায়, নিঃশব্দে ওঠা- নামা করছে ঠোঁটজোড়া ওটার।

‘এর মানে কী?’ ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল অমঙ্গল। ‘তোমাদের ডেকেছি আমি, কিম্ভূতকিমাকার চিড়িয়া কোথাকার?!’

ডেস্কের কাছে হেঁটে গেল হ্যালি। চোখে-চোখে চাইল অমঙ্গলের। অশুভ হাসিতে পরস্পর চেপে রয়েছে রঙ করা ঠোঁটজোড়া ওর।

‘এক মাথার চেয়ে দুই মাথা ভাল, এটা কে, কবে বলেছে?’ চিল চিৎকার ছাড়ল। ‘তোমাকে কুৎসিত বললেও কম বলা হয়! তুমি কুৎসিতের কুৎসিত!’

অন্য খলনায়করা হো-হো করে হেসে উঠল ওটা।

কামরাটা প্রবল ঝাঁকুনি খেল। টের পাচ্ছি সঙ্কুচিত হচ্ছে

‘তোমার জন্মের পর ডাক্তার ভুল দিকে চাপড় মারে!’ অমঙ্গলের উদ্দেশে বলল হ্যালি।

ওর কথায় হেসে উঠলাম আমরা সবাই।

মিটারে ধাঁ করে ৫০-এ নেমে এল লাল দাগ।

অমঙ্গলের দিকে ঝুঁকল হ্যালি।

‘তোমার মা যখন তোমার বাবাকে আবর্জনা বাইরে ফেলে আসতে বলে, সে আসলে তোমার কথাই বুঝিয়েছিল!’

হাসির বেগ আরও বাড়ল।

‘তোমার কোন্ মুখটা আজ নাশ্তার টেবিলে বমি করেছে? কালোটা না লালটা?’

‘হাসো! সবাই হাসো!’ চিৎকার করে উৎসাহ জোগাল গবেষক স্কেলিটন। অমঙ্গলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাতাসে ঘুষি ছুঁড়ল। ‘আমরা তোমাকে আর ভয় পাই না!’

পাল্টা দু’মুঠো ঝাঁকিয়ে জান্তব গর্জন ছাড়ল অমঙ্গল। ওর কণ্ঠস্বর মিহি এখন। ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে ও।

‘থামো! থামো! পাগল হলে নাকি?’ চিঁ-চিঁ করে বলল।

ওর দ্বিতীয় মুখটা পাল্টে যেতে শুরু করতেই সভয়ে শ্বাস চাপলাম আমি। চোখ বুজে গেল ওটার। চোয়াল ঝুলে পড়ল। প্রলম্বিত, নিচু গোঙানির স্বর বেরোল গলা চিরে।

আতঙ্ক মাখা দৃষ্টিতে দেখছি, লাল রঙটা ধূসর হলো…গলে গেল নাকটা…ঠিক মোমের মত…টপ-টপ করে কুঁকড়ে যাওয়া, গলিত ঠোঁটের ওপর পড়ছে ফোঁটাগুলো।

‘খাইছে, দেখো, দেখো!’ চিৎকার ছেড়ে আঙুল তুলল মুসা।

অপার বিস্ময়ে আমরা অমঙ্গলের দ্বিতীয় মুখটাকে গলে যেতে দেখলাম। নিজের ওপরই ভাঁজ হলো ওটা-যেন পাত্র থেকে ঢালা হচ্ছে কেকবাটার-এবং অমঙ্গলের কালো জ্যাকেটের পেছনদিক দিয়ে ধীর গতিতে চোয়াতে লাগল।

‘পাগল নাকি তোমরা? পাগল নাকি?’ ক্ষীণ স্বরে বলে চলেছে অমঙ্গল। ‘কী করেছ দেখো! ও ছিল আমার একমাত্র বন্ধু! তোমাদেরকে এর শাস্তি পেতে হবে! এর ফল তোমরা সবাই পাবে!’

ছাদের দিকে মুখ তুলে খলখলিয়ে হাসছে হ্যালি। ড. স্নেকি হিসহিস শব্দ করে কটাস-কটাস চোয়াল লাগাচ্ছে। সব কটা খলনায়ক হর্ষধ্বনি করে উদ্‌যাপন করছে তাদের বিজয়

ফিয়ার মিটারের লাল দাগটার কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না। ভীতি আঁকড়ে ধরছে আমার গলা।

‘থামো!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘অমঙ্গল ছোট হয়ে যাচ্ছে। ঘরটাও। কিন্তু আমাদের কী হবে? সব কিছুই যদি অদৃশ্য হয়ে যায়…

‘আমরা কি উবে যাব?’ কিশোর চিৎকার ছাড়ল।

কামরাটা এখন পিন পতন নীরব

চোয়াল ঝুলে পড়ল ড. ক্রেজির।

‘তাই তো!’ বিড়বিড় করে বলল।

‘এটা তোমার আইডিয়া!’ ক্রেজির উদ্দেশে খসখসে কণ্ঠে বলল হ্যালি।

মাথা নাড়ল ক্রেজি।

‘চিন্তার কথা। চিন্তার কথা। সমস্যায় পড়া গেল দেখছি। বিকল্প কোন প্ল্যান আছে কারও?’

.

স্কেলিটন দরজার উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল।

‘জলদি করো,’ জরুরী কণ্ঠে বলল।

‘সসসসব ছোট হয়ে যাচ্ছে,’ হিসহিসাল ড. স্নেকি। ‘টের পাচ্ছি। অমঙ্গলের পুরো দুনিয়া…ছোট হয়ে যাচ্ছে।’

‘দৌড়াও-দেরি কোরো না!’ কর্কশকণ্ঠে বলল হ্যালি।

‘রবার্ট ডাউনিংকে হারানো এতই সোজা? চাইলেই কি যার খুশি অমঙ্গলকে হারাতে পারে?’ কালো দস্তানামোড়া হাতজোড়া দিয়ে খুদে ডেস্কটায় একসঙ্গে কিল মারল অমঙ্গল।

‘আমি বেরনোর রাস্তা চিনি। এসো আমার সাথে!’ আদেশ করল স্কেলিটন। ‘হয়তো সময়মত পালাতে পারব আমরা!’

সবাই উল্টো ঘুরে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে এলাম অফিস ঘরটি থেকে।

লম্বা হলটি ধরে দুপদাপ পা ফেলে ছুটছি, অমঙ্গলের চিৎকার কানে বাজল।

‘খাইছে, আমরা যাচ্ছি কোথায়?’ প্রশ্ন করল মুসা, আমার পাশে-পাশে ছুটছে। এরা জানে ভাবছি কেন?’

‘অন্য কোন উপায় আছে?’ পাল্টা বললাম।

মুসা বেচারা আতঙ্ক লুকোতে পারল না। কিন্তু আসলে তো আমরা সবাই-ই ভীত-সন্ত্রস্ত।

আস্ত প্যানিক পার্কটা উবে যাওয়ার আগে কতক্ষণ সময় পাচ্ছি আমরা?

ঘূর্ণিঝড় রাইড

নিচু, সাদা বাড়িটার কাছে দৌড়ে এসে, প্রবেশপথের ওপরে লাগানো সাইনটা পড়লাম।

‘এসে গেছি,’ ড. ক্রেজি হেঁকে বলল, সাইনটা দেখাল তর্জনী দিয়ে। ‘ঢুকে পড়ো সবাই!’

‘দাঁড়ান!’ ওর বাহু চেপে ধরল কিশোর। ‘আমাদেরকে নিয়ে আপনার মতলবটা কী?’

‘হ্যাঁ, রায়ান বলল। ‘অমঙ্গল আমাদেরকে ঘূর্ণিঝড়ের রাইডের কথা বলেছিল। আমাদেরকে ভয় দেখিয়েছিল।’

‘অমঙ্গল মিথ্যে বলেছিল,’ কর্কশস্বরে বলল হ্যালি। ‘তোমাদেরকে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে দূরে রাখতে।’

‘আমরা সবাই ঘূর্ণিঝড় রাইডের মাধ্যমে হররল্যাণ্ডে আসা- যাওয়া করেছি,’ জানাল স্কেলিটন। জেরি আর এমাও একবার এটা ব্যবহার করেছিল। এটা আয়নার চাইতে অনেক বেশি দ্রুতগামী।’

জেরির দিকে চাইলাম।

‘কথাটা কি সত্যি? এই বাড়িটা থেকেই কি তোমরা হররল্যাণ্ডে ফিরেছিলে?’

জেরি ভাবনামগ্ন হলো।

‘হয়তো…’ বলল। ‘আমার…আমার প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসের কথা মনে পড়ে।’

প্রবেশদ্বারের দিকে এগোলাম সবাই। ভেতরে শোঁ-শোঁ বাতাস, বজ্রপাতের মত সগর্জনে আছড়ে পড়ছে দেয়ালে-দেয়ালে, শিসের শব্দ তুলে বইছে।

মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের হিম স্রোত নামল। সাইক্লোনের ভেতর পা রাখার মত অভিজ্ঞতা হবে নাকি?

এসময় পেছনে কার যেন চিৎকার শুনলাম। উল্টো ঘুরতেই দেখলাম অমঙ্গল আর মিল্টন পার্কের ভেতর দিয়ে পড়িমরি দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে। ওদেরকে গা ঘেঁষে অনুসরণ করছে ছায়ামানুষদের বড়সড় এক দল। –

‘ওদের দিকে তাকিয়ো না!’ নির্দেশ দিল হ্যালি। ‘জলদি করো, আহাম্মকের দল! দরজাটা খোলো। ঘূর্ণিঝড়ের ভেতর লাফ দিলেই-আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাব!’

কিন্তু অমঙ্গল আর অন্যদের ওপর থেকে নজর ফেরাতে পারছি না, ক্রমেই কাছিয়ে আসছে ওরা ছুটতে-ছুটতে…ওদিকে, পার্কটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। সব কটা রাইড, ফুড কার্ট, বাড়িঘর, গাছগাছালি সব-হ্রাস পাচ্ছে… ছোট হচ্ছে…যে কোন মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যাবে, বহু বছর আগেই যেটা হওয়ার কথা ছিল!

প্রবেশদ্বারের হাতলটা চেপে ধরল কিশোর

‘তালা মারা!’ গর্জাল। ‘বন্ধ!’

চকিতে পেছনে চাইলাম-এবং চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কেটি আর রবসনকে দেখতে পেলাম! সেই দুই বিশ্বাসঘাতক।

অমঙ্গলের গুপ্তচর।

ধেয়ে আসছে ওরা আমাদের দিকে, অন্য সবাইকে পেছনে ফেলে। ওদের মুখের চেহারায় কঠোর অভিব্যক্তি।

ওরা আমাদের ঠেকাতে চায়!’ চিৎকার ছাড়লাম। ‘আমাদেরকে ঘূর্ণিঝড় রাইডের কাছে যেতে দেবে না!’

‘জলদি!’ কিশোরের উদ্দেশে হুঙ্কার ছাড়ল হ্যালি।

তালা ধরে টানাটানি করে চলেছে কিশোর। জোরে টানছে, সর্বশক্তিতে।

‘নাহ,’ চেঁচিয়ে উঠল। ‘ঢোকার পথ বন্ধ!’

ঊনত্রিশ

কেটি আর রবসন ঝড়ের বেগে চলে এল দরজার কাছে।

‘দূর হও তোমরা!’ চিৎকার করে উঠল ডেমি মুর। ‘আমাকে দেখো! আমি একটা ছায়ামানুষ! আমাদের সবাইকে দেখো! তোমাদের কারণে কী দুর্দশা সবার!’

চট করে পেছনে চাইলাম। প্যানিক পার্ক এইটুকু হয়ে গেছে। তুষারের ভূ-গোলকের ভেতরে ঠিক যেন এক পৃথিবী।

অমঙ্গল আর মিন্টনকে নেংটি ইঁদুরের মত দেখাচ্ছে, হাঁচড়েপাঁচড়ে আমাদের দিকে আসছে ওরা।

‘আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখো!’ চেঁচাল কেটি। ‘রবসন আর আমি জানতাম না আমরা অমঙ্গলের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়েছি! জানতাম না ও আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে!’

‘স্কেলিটন আমাদের কানে হেডফোন লাগায়। বলে ওটা নাকি ব্রেইন টেস্ট!’ রবসন গলা ছাড়ল। ‘কিন্তু তখনই আমাদের কব্জা করে নেয় অমঙ্গল!’

‘আমরা ওর হয়ে কাজ করতে চাইনি!’ বলল কেটি। ‘ও আমাদের বাধ্য করে। কিন্তু ওর এখন আর আমাদের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ওর ক্ষমতাও ওর সঙ্গে কমে গেছে!’

‘প্রমাণ করে দেব আমরা তোমাদের দলে!’ বলল রবসন। ‘দরজাটা খুলতে পারব আমি।’

‘আমিও আছি তোমার সাথে!’ চিৎকার ছাড়ল স্কেলিটন, ভিড় ঠেলে পথ করে নিয়ে রবসনের পাশে এসে দাঁড়াল।

তালাটার ওপর মনোযোগ স্থির করল দু’জনে…এবং আশ্চর্য! তালাটা খুট করে খুলে গেল!

দরজাটা হাট হয়ে খুলে যেতেই আর্তনাদ ছাড়লাম। শীতল বাতাসের জোর ঝাপ্টায় দরজার পাল্লাটা দড়াম করে বাড়ি খেল সামনের দেয়ালের বিপরীতে।

বাড়িটা থেকে সগর্জনে দমকা বাতাস আছড়ে পড়ছে বাইরে। কিশোর চিৎকার করে কীসব যেন বলছে অন্য সবার উদ্দেশে,

কিন্তু বাতাসের হুহুঙ্কার ছাপিয়ে শুনতে পাচ্ছি না।

মাথা নোয়াল কিশোর এবং ঝাঁপাল বাতাসের ভেতর।

শ্বাস নিতে পারছি না। মহাসাগরের ঢেউয়ের মত ধাক্কা মারছে আমাকে হিম বাতাস। চিতিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, মুসা ধরে ফেলল।

এবার ঝড়ো বাতাস আমাদের দু’জনকেই মাটি থেকে যেই শূন্যে তুলে ফেলল, বুক ফাটা আর্তনাদ ছাড়লাম। বাতাসের আরেকটি ঘূর্ণি পাক খাচ্ছে আমাদের ঘিরে-এবং দালানটার দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।

ঘূর্ণি বাতাসে ভেসে যাচ্ছি, পেছনে চাইলাম এক ঝলক। প্যানিক পার্কের দিকে শেষবার চাওয়া।

এতটাই খুদে ওটা এখন…কিছুই বাকি নেই…ছাইরঙা আকাশে ভাসছে একরত্তি চকচকে এক বুদ্বুদ।

এবং পরমুহূর্তে ফট করে ফেটে গেল বুদ্বুদটা।

পাঁই করে ঘুরে গেলাম-এবং পাক খেতে লাগলাম ঘূর্ণিবায়ুতে।

শক্তিশালী বাতাসের তোড়ে ভেসে চলেছি কোথায় কে জানে। উড়ছি নাকি? ভাবলাম। উড়ে চলে যাচ্ছি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কোথায় চলেছি?

সাঁ করে উড়ে উঠলাম এক লম্বা, নীল সুড়ঙ্গে, এবার নেমে এলাম নিচে।

সামনে অন্য ছেলে-মেয়েদেরকে দেখছি। এবার জোয়ারের ঢেউয়ের মত তেজী বাতাস এসে ঝেঁটিয়ে নিয়ে চলল আমাকে, অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছি, সবাই এবার আমার পেছনে পড়ল।

কানে হাত চাপা দিয়ে গর্জনটা থামাতে চাইলাম। চোখ বুজে বাতাসে শরীর ছেড়ে দিলাম…কোথায় নেবে নিয়ে যাক…দীর্ঘ, নীল সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে চলেছি।

এবার প্রবল এক টান, এবং পাক খেতে লাগলাম। জোরে….আরও জোরে…এমনভাবে ঘুরছি, ঘূর্ণিঝড়ের পাল্লায় পড়ে গেছি যেন।

এবার ঝড়ো বাতাস থেমে গেল।

নিস্তব্ধতা। আকস্মিক অটুট, ভীতিকর নীরবতা।

বাতাস ঝিমিয়ে গিয়ে মুক্তি দিল আমাকে-

-এবং নিচে পড়তে লাগলাম আমি।

একদম নিচে। পড়ছি তো পড়ছিই… সারাটা পথ ত্রাহিস্বরে চেঁচিয়ে গেলাম।