দুঃস্বপ্নভূমি – ১০

দশ

মিল্টন আমাদেরকে পেছনে নিয়ে দীর্ঘ এক সার সিঁড়ি ভেঙে, নেমে এল বাঁকানো, অন্ধকার এক হল-এ, এবং তারপর উপরে উঠতে লাগল খাড়া এক সিঁড়ি বেয়ে। ধুলো-মাটির পুরু আস্তরণ জানালাগুলোয়। আলোর বালাই নেই প্ৰায়।

কালো গালিচায় এমব্রয়ডার করা এক সার মড়ার খুলি বিকট হাসি হাসছে আমাদের উদ্দেশে। ছাদ থেকে ঝুলছে জট পাকানো মাকড়সার জাল, মুখে ঘষা খাচ্ছে আমাদের।

মৃদু গোঙানির শব্দ পেলাম এক হলওয়েতে। মানুষ করছে অমন আওয়াজ?

শিউরে উঠে মুসার কাছ ঘেঁষে চলতে লাগলাম।

নীরবে হাঁটছি আমরা। সবার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে জানি: প্রাচীন, ভুতুড়ে এই দুর্গ থেকে কি আদৌ জীবন্ত বেরোতে পারব আমরা?

দরজার পর দরজা পেরোলাম, চোখে পড়ল শুধুই অন্ধকার। একটা দেয়াল আগাগোড়া ভর্তি নানা ধরনের বীভৎস, দাঁত খিঁচানো জীব-জন্তুর মাথা দিয়ে। আরেকটি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পেরেক দিয়ে ‘আটকানো সরু, রাবারের মত সব জিনিস। ওঁগুলোকে মানুষের জিভের মত দেখাচ্ছে!

তলপেট গুলিয়ে উঠল। কুৎসিত দৃশ্যটা থেকে চোখ ফেরালাম।

আরেকটি অন্তহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠে চললাম আমরা। এবার মিল্টন আমাদেরকে নিয়ে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সুপ্রশস্ত এক কামরায় ঢুকল।

ক্রমেই চোখ সয়ে এল আমার। একটু পরে, কাঠের চেয়ার- টেবিল দেখলাম। এক দেয়াল লাগোয়া কয়েক সারি বাঙ্ক বেড। একটা বাথরুম। সরু, ধূলিধূসরিত জানালার নিচে দুটো কাঠের লম্বা-লম্বা টেবিল।

এক দেয়াল জুড়ে ইঁটের এক ফায়ারপ্লেস। চোখ পিটপিটিয়ে চাইলাম। ফায়ারপ্লেসের মেঝেতে ডাঁই করে রাখা ওগুলো কি হাড়গোড়?

ফায়ারপ্লেসের ওপরে নকশাদার রুপোলী ফ্রেমে বাঁধানো অমঙ্গলের প্রকাণ্ড এক ছবি ঝুলছে। আমাদের দিকে ও চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। হ্যাট টেনে নামিয়ে এক চোখ ঢেকেছে। অপর চোখটা শীতল, নিস্পৃহ দৃষ্টিতে মাপছে আমাদের। মুখের বাকি অংশ ঢাকা পড়েছে ছায়ার আড়ালে।

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। বাঙ্ক বেডগুলোর ডান পাশের দেয়াল ঘেঁষে এক ফিয়ার মিটার দাঁড় করিয়ে রাখা।

‘এটা তোমাদের ঘর,’ মিল্টন বলল। ‘মানিয়ে নাও নিজেদের।’

‘রুম সার্ভিস আছে তো?’ কিশোর মজা করল। সাহস হারায়নি।

‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল মিল্টন। ‘আর এক মেইড এসে রাতে তোমাদের বালিশের তলে চকোলেট রেখে যাবে।’ হেসে উঠল ও। ‘কী হলো? তোমরা হাসছ না যে? অবশ্য সেজন্যে তোমাদের দোষ দেয়া যায় না।’

‘মিল্টন, আপনি অমন…অমন একটা দানবের হয়ে কেন কাজ করছেন?’ ডেমি মুর জবাব চাইল।

শ্রাগ করল মিল্টন।

‘কাজটা মন্দ নয়,’ বলল। ‘বিশেষ করে বাচ্চাদের আর্তনাদ শুনতে আর ভীত-সন্ত্রস্ত মুখগুলো দেখতে যদি ভাল লাগে কারও। আর প্যানিক পার্ক বাস্তব দুনিয়ায় ফিরলে আমার ক্ষমতা কতটা বাড়বে ভেবে দেখো!’

এবার মাথা ঝাঁকাল।

‘অনেক শুভ কামনা রইল, বাছারা। তোমাদের বিশেষভাবে এর প্রয়োজন পড়বে!’

একটু পরে, দরজা দিয়ে অদৃশ্য হলো ও।

দু’মুহূর্ত পরে ফের উদয় হলো। গটগট করে এগিয়ে এল রায়ানের দিকে, হাত বাড়ানো।

‘দিয়ে দাও,’ বলল।

রায়ান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

‘কী দেব?’

‘তোমরা প্রথম যখন হররল্যাণ্ডে এলে তখন তোমাকে একটা কি কার্ড দিয়েছিলাম। যে কার্ডটার কল্যাণে তোমরা বন্ধ জায়গাগুলোতে ঢুকতে পেরেছ।

‘ওটা আমার কাছে, বলল কিশোর। রায়ান দলের নেতা মেনে আগেই ওটা কিশোরকে দিয়েছে।

‘তাই?’ ধেয়ে এল মিল্টন। ‘দিয়ে দাও।’

‘দেব না,’ বলল কিশোর। এক পা পিছিয়ে গেল। ‘তখন দিয়েছিলেন কেন রায়ানকে?’

হররটার রোমশ মুখে হাসি ছড়াল।

‘কেন? বলেছিলাম না? প্যানিক পার্ক নিয়ে তোমরা যাতে ভাবনা-চিন্তা শুরু কর সেজন্যে,’ বলল মিল্টন। ‘বোঝই তো। ওটা ছিল ছোট্ট এক সূত্র। তোমাদেরকে আগ্রহী করতে।’

কিশোরের মুখের সামনে মস্ত এক থাবা নাড়ল মিল্টন। ‘দাও বলছি। এক্ষুণি।’

কিশোর তীব্র তাচ্ছিল্য ঝরাল কণ্ঠে।

‘প্রশ্নই ওঠে না, লোমের পাহাড় কোথাকার।’

কুৎসিত গর্জন বেরোল মিল্টনের গলা দিয়ে।

‘তবে রে, বড়-বড় কথা বের করছি,’ ঘাউ-ঘাউ করে বলল। রক্তবর্ণ ধরল ওর চোখ। মস্ত থাবা দুটো মুঠো পাকিয়ে ফেলল।

‘তোমাকে ছিঁড়ে ফেলতে পারি তা জানো?’

কিশোর শরীর দুলিয়ে সরে যেতে চাইল ওর পথ থেকে। কিন্তু দশাসই হররটা সামনে ঝাঁপাল। চেপে ধরল কিশোরের টি-শার্টের সামনেটা।

‘কার্ডটা দিয়ে দাও বলছি,’ খেঁকিয়ে উঠল হিংস্র ভঙ্গিতে। মিল্টনের থাবাটা ঠেলে সরাল কিশোর।

‘ওটা…হারিয়ে গেছে,’ বলল। ‘নেই আমার কাছে।’

কিশোরের ওপর নিবদ্ধ হলো মিল্টনের জ্বলন্ত চোখজোড়া।

‘ও, তাই?’ আবারও চেপে ধরল কিশোরকে-ওর কোমর ধরে তুলে ফেলল মেঝে থেকে। ‘দেখি সত্যিই হারিয়েছে কিনা,’ রুক্ষ স্বরে বলল, ‘আশা করি মিথ্যে বলছ না, কিশোর ছেলে।’

‘সত্যি বলছি!’ গর্জাল কিশোর। তবে কেঁপে গেল গলা। ‘হারিয়ে ফেলেছি! বিশ্বাস করুন!’

‘দেখি তোমার পকেট থেকে কী পড়ে,’ বলল মিল্টন। এবার লাঠির মত ধরে এক পাক ঘুরিয়ে দিল ওকে।

‘কী করছেন! ছাড়ন—’ তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়ল কিশোর। মিল্টন ওর গোড়ালী দুটো চেপে ধরেছে। এখন ওপরে-নিচে ঝাঁকাচ্ছে।

কিশোরের মুখের চেহারা লাল হয়ে গেছে। চোখ বিস্ফারিত। আরও জোরে ঝাঁকুনি দিল ওকে মিল্টন, লবণদানি থেকে যেন

লবণ ঢালছে পাতে।

‘দেখি কী আছে তোমার কাছে, কিশোর ছেলে,’ বলল দানবটা। ‘জিন্সের পকেটগুলো থেকে কী খসে পড়ে দেখি।’ প্রবল ঝাঁকুনি দিল।

‘ওহহহ…’ দীর্ঘ, নিচু গোঙানীর শব্দ বেরোল কিশোরের গলা চিরে।

ওকে ছেড়ে দিন!’ এসময় ডেমি মুর চেঁচিয়ে উঠল। মিল্টনের গোদা এক থাবা আঁকড়ে ধরে ছোটাতে চাইল কিশোরের গোড়ালী থেকে। কিন্তু অমন একটা দানবের কাছে ও তো নস্যি, এক চুলও নড়াতে পারল না। হঠাৎই রায়ান আর মুসা ঝাঁপাল মিল্টনের উদ্দেশে। ওর কোমর পাকড়ে কুস্তির প্যাচে মাটিতে ফেলে দিতে চাইল।

কিন্তু মিল্টন জোরে একবার শরীর ঝাঁকাতেই—দু’জনই ছিটকে পড়ল মেঝেতে।

আবারও কাতরে উঠল কিশোর। মিল্টনের প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে গলার স্বর কেঁপে গেল ওর।

চোখ বুজে ফেলেছে ও।

‘ওটা কই? কই?’ জবাব চাইল মিল্টন। ‘এমন রাম ঝাঁকুনি দেব, মগজ আলগা হয়ে যাবে। এটা তামাশা না। কার্ডটা কোথায়?’

ডেমি মুর ঝুঁকল কিশোরের দিকে।

‘দিয়ে দাও ওকে!’ চিঁ-চিঁ করে

চিঁ-চিঁ করে চেঁচিয়ে উঠল ‘কিশোর-আমার কথা শোনো! দোহাই লাগে! কার্ডটা দিয়ে দাও! নইলে তোমাকে মেরে ফেলবে!’

টমেটোর মত লাল এখন কিশোরের মুখের চেহারা। চোখ বোজা। জিভ আধহাত বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে।

মিল্টন ঝাঁকাচ্ছে ওকে, জোরে, আরও জোরে। আতঙ্কে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল আমার।

‘থামুন! থামুন!’ কোনমতে শব্দ দুটো ওগরালাম।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিশালদেহী হররটা মেঝেতে ঠুকে দিল কিশোরের মাথা।

চোখজোড়া বনবন করে ঘুরছে এখন কিশোরের।

আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচি-কাকুতি-মিনতি অগ্রাহ্য করে আরও ক’বার ওকে জোর ঝাঁকুনি দিল মিল্টন।

এগারো

‘ওহহহ।’ দীর্ঘ গোঙানীর শব্দ করল কিশোর। চোখ মেলল। ‘ঠিক আছে।’ ফিসফিসে স্বরে বলল। ‘ঠিক আছে। আপনিই জিতলেন।’ শেষ ঝাঁকিটা দিন ওকে মিল্টন। এবার কিশোরকে চিত করে শুইয়ে গোড়ালীজোড়া ছেড়ে দিল।

দীর্ঘ দু’মুহূর্ত মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে চিতপাত হয়ে পড়ে রইল কিশোর। শেষমেশ, বাহুজোড়া টানটান করল, তারপর পিঠটা। ধীরে-ধীরে মাথা তুলল, চোখ পিটপিট করে চাইছে।

‘মাথাটা কেমন জানি করছে…’ আওড়াল। দু’হাতে কপাল চেপে ধরল। ‘ওহ, ব্যথা করছে।’

অ্যাণ্ডিনা আর নেলী ধপ করে হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসল। ‘দাঁড়াতে পারবে?’ নেলী জিজ্ঞেস করল।

‘সময় নষ্ট কোরো না,’ খেঁকিয়ে উঠল মিল্টন। লাথি মারল কিশোরের গোড়ালীতে। ‘ওঠোহ্!’

ওরা দু’জন কিশোরকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। তখনও চোখজোড়া ঘুরছে কিশোরের। অ্যাণ্ডিনার ওপর দেহের ভর দিয়ে জিন্সের পকেটে হাত ঢোকাল।

‘এই যে,’ বলল। পকেট থেকে বের করল ধূসর কার্ডটা।

ছোঁ মেরে কেড়ে নিল ওটা মিল্টন। তারপর ছিঁড়ে দু’টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।

এবার দাঁত কেলিয়ে হাসল কিশোরের উদ্দেশে।

‘ছেলে, খুব সহজেই হার মেনেছ তুমি!’ বলল। ‘ভেবেছিলাম আরও কঠিন লড়াই দেবে। এক কাজ করো, তোমার নাম পাল্টে কাঁদুনি রাখো!’

মাথা ডলল কিশোর।

‘বাজে কথা রাখুন,’ রাগতস্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল। হেসে উঠল মিল্টন।

‘বাছারা, প্যানিক পার্কে টিকতে হলে আরও সাহসী হতে হবে তোমাদের!’

তারপর আপনমনে চাপা হেসে, গটগটিয়ে কামরা ছেড়ে বেরনোর সময় সপাটে দরজাটা লাগিয়ে গেল।

টলমল পায়ে লম্বা বেঞ্চিগুলোর একটার কাছে গিয়ে বসে পড়ল কিশোর। মাথা ডলল আরও কিছুক্ষণ। আমরা সবাই ওর সামনে জড় হলাম।

‘এই লোককে কিনা বিশ্বাস করেছিলে তোমরা?’ আওড়াল কিশোর। ‘ওকে যদি আচ্ছাসে ঝাঁকাতে পারতাম…ওর গায়ের লোমগুলো সব ছিঁড়তে পারতাম!’

রয় আমার পাশে সরে এল। ওকে দেখতেই পাচ্ছি না বলতে গেলে। ওর শরীর ধোঁয়াটে। ও নড়তেই ঢেউয়ের মত বইল ওটা। ছায়ার ভেতর থেকে উঁকি মারছে চোখজোড়া বেচারীর।

‘আমার শরীর খারাপ লাগছে,’ ওর বোন, টিনাকে বলল। ছেলেটার কণ্ঠস্বর কোমল আর দূরাগত। ‘ভীষণ…ঠাণ্ডা লাগছে, টিনা। মনে হচ্ছে যেন হাত-পা নেই আমার।’

‘আমরা তোমাকে আবার আগের মত করে দেব,’ টিনা বলল ওকে। চোখ সরিয়ে নিল। ‘পারব আশা করি।’

‘আমরা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি,’ বলল নেলী, নিজের চুল টানল। ‘আমরা…আমরা হররল্যাণ্ড থেকে পালিয়ে প্যানিক পার্কে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু এটা আসলে একটা ফাঁদ ছিল।’

রায়ান কিশোরের বেঞ্চের পাশে হেঁটে গেল এবং ঘুরে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াল। চরম ক্রুদ্ধ ওর মুখের চেহারা। হাপরের মত ওঠা-নামা করছে বুক।

‘হ্যাঁ, তো আমরা এখন কেটি আর রবসনের ব্যাপারটা জানি,’ বলল। ‘এবং মিল্টনেরটাও। এখানে আর কে আছ অমঙ্গলের গুপ্তচর?’

সবার মুখের ওপর একে-একে চোখ বোলাচ্ছে ও।

‘আমরা ওই তিনজনকে বিশ্বাস করেছিলাম,’ বলল, ‘কিন্তু দেখা গেল ওরা বেঈমান। আর কে আছে গাদ্দার? অমঙ্গলের হয়ে আর কে-কে কাজ করছ?’

এক মুঠো উঁচাল।

‘আর কে?’

ও এবার আমার সামনে এসে বুক দিয়ে ধাক্কা মেরে আমাকে দু’পা হটিয়ে দিল।

‘গুপ্তচর আর কে-কে?’ রাগান্বিত কণ্ঠে গর্জাল।

‘রায়ান, থামো—’ মিনতি করলাম আমি।

বুক দিয়ে আবারও ঠেলা মেরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল আমাকে।

‘আর কে, রবিন? আর কে? তুমি আর মুসা? তোমরা দু’জন নও তো?’

বারো

‘না-’ চেঁচিয়ে উঠলাম।

রায়ান আবারও ধাক্কাল আমাকে।

‘ওকে ছেড়ে দাও!’ গর্জন ছাড়ল মুসা। ‘আমরা গুপ্তচর নই!’ রায়ান চরকির মতন ঘুরে ঝুঁকে পড়ল মুসার ওপরে।

‘আমরা তোমাদের চিনি না,’ হুঙ্কার ছাড়ল। ‘তোমরা বিশেষ অতিথি নও, তোমরা একদম ঠিক সময়ে হাজির হয়ে আমাদেরকে ফলো করে প্যানিক পার্কে এসেছ।’

‘তুমি কি আমাকেও সন্দেহ কর?’ বলে উঠল কিশোর। ‘ওরা আমার বন্ধু। ওরা গুপ্তচর হলে তো আমিও গুপ্তচর।’

কথাটা শুনেও শুনল না রায়ান। এসময় ভিভ এসে দাঁড়াল ওর পাশে। আমার উদ্দেশে ভ্রূকুটি করল ও।

‘রায়ান ঠিকই বলেছে। তোমরা এখানে কী করছ? তোমরা অমঙ্গলের চর—তাই না?’

‘ভুল কথা!’ চিৎকার করে বললাম। রায়ানকে ঠেলে সরালাম। ‘আমাদেরকে ভুল বুঝছ তোমরা। কিশোর, আমি আর মুসা তোমাদেরকে সাবধান করতে চেষ্টা করেছিলাম মনে নেই?’

ওরা একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার দিকে। মুঠোজোড়া নামাল রায়ান।

‘কিশোর যেভাবে অমঙ্গল আর মিল্টনকে রুখে দাঁড়িয়েছে তাতে ওকে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু তোমাদের…’

‘আমি তোমাদেরকে প্যানিক পার্ক সম্পর্কে সতর্ক করিনি?’ বললাম। ‘বলিনি আমাদের হররল্যাণ্ডেই থাকা উচিত? কিন্তু তারপর কেটি আমার মন পড়ার ভান করল, মনে নেই? বলল আমি নাকি মিথ্যে বলছি।’

আমার সঙ্গে গলা মেলাল মুসা।

‘খাইছে, এখন সবাই জানে কে মিথ্যে বলেছে। কেটি। কাজেই আমার বন্ধুকে ছেড়ে দাও।’

অগ্নিদৃষ্টিতে পুরো কামরায় চোখ বোলাল রায়ান।

‘আর কে গুপ্তচর? আর কে বিশ্বাসঘাতক?’

কিশোর উঠে এসে কাঁধ চেপে ধরল রায়ানের।

‘রায়ান, শোনো,’ মৃদু, শান্তস্বরে বলল। ‘আমরা সাঙ্ঘাতিক বিপদের মধ্যে আছি। আমাদের এখন বিবাদ না করে সবার সবাইকে বিশ্বাস করা উচিত।’

‘ঠিক,’ বলল রিনা। ‘আমরা এখানে ঝগড়াঝাঁটি করলে কোন ফায়দা নেই। আমাদেরকে যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে!’

আপনমনে গজগজ করতে লাগল রায়ান। এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে বসে পড়ল বেঞ্চিতে।

‘উভয় সঙ্কটে পড়েছি আমরা,’ বলল ডেমি মুর। ‘আমরা অমঙ্গলের ভয়কে জয় করে টিকে থাকলে ও জিতে যাবে। প্যানিক পার্ক ফিরবে বাস্তব জগতে। ও তখন কী সব ভয়ানক কাজ- কারবার করবে ভাবো একবার!’

‘কিন্তু আমাদের আর কী-ই বা করার আছে?’ ইমন প্রশ্ন করল। ‘ভয়ের কাছে হার মানব?’

‘আমরা টিকে গেলে ওকে সাহায্য করা হবে,’ বললাম। ‘আর হারলে…মারা পড়ব।’

‘আরেকটা সুযোগ আছে,’ বলল কিশোর। ‘এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া। আমরা প্যানিক পার্ক থেকে পালালে অমঙ্গল হারবে!’ বলল ও। দেয়াল লাগোয়া ফিয়ার মিটারটা দেখাল তর্জনী দিয়ে। ‘মিটার একশোতে ওঠার আগেই আমরা যদি হররল্যাণ্ডে ফিরতে পারি তো হেরে ভূত হবে অমঙ্গল। ওর পার্ক ওই উনিশশো চুয়াত্তর সালেই আটকে থাকবে।’

‘কিন্তু কীভাবে?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল টিনা। ‘আমরা পালাব কেমন করে? আমার ভাই রয়কে দেখো। ও ছায়ামানুষ হয়ে গেছে। অমঙ্গল যদি আমাদের এ দশা করতে পারে, তবে আমরা পালাবার আশা করি কী করে?’

‘কিশোর ঠিকই বলেছে,’ বলে, লাফিয়ে উঠল রায়ান। ‘তো অমঙ্গল হচ্ছে শক্তিশালী। আর শয়তান। এবং উন্মাদ। তার মানে এই নয় যে আমরা এখানে বসে-বসে ওর ভয়ে কাঁপব। আমাদের কিছু একটা করতেই হবে!’

দরজার দিকে দৌড়ে গেল কিশোর।

‘চলে এসো।’

‘ওটা মনে হয় বন্ধ,’ ডেমি মুর বলল। ‘আর অমঙ্গল সম্ভবত আমাদের প্রতিটা কথাই শুনছে।’

‘চেষ্টা তো অন্তত করতে হবে,’ বলল কিশোর।

আমরা দুলকি চালে ছুটলাম ওর পেছন-পেছন। দরজার পিতলের হাতলটা চেপে ধরল ও। মোচড় মেরে টানল।

সবাইকে অবাক করে দরজাটা খুলে গেল হাট হয়ে।

‘তালা মারা নয়!’ ডেমি মুর চেঁচিয়ে উঠল। ‘মিল্টন ভুলে খুলে রেখে গেছে নাকি?’

‘নাকি এটাও একটা ফাঁদ?’ নেলী বলে উঠল।

ওর কথা শুনে মেরুদণ্ড বেয়ে হিমশীতল স্রোত নামল আমার। কিন্তু আমাদের তো চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

হল-এ পা রাখল কিশোর। বুক ভরে দম নিলাম আমি-এবং অনুসরণ করলাম ওকে।

তেরো

দীর্ঘ, আঁধার হলটা দু’দিকেই বিস্তার পেয়েছে। গালিচায় সেলাই করা মড়ার খুলিগুলো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। ধুলোমলিন জানালাগুলো দিয়ে চুইয়ে ঢুকছে ধূসর, ঘোলাটে আলো। তপ্ত বাতাসে কেমন এক ছাতাপড়া, টক গন্ধ।

আমরা হাঁটলাম না-ঝেড়ে দৌড় দিলাম।

পুরু গালিচায় ধুপধাপ শব্দ করছে আমাদের পায়ের পাতা। লম্বা এক হল ধরে তীরবেগে ছুটছি সবাই, এবার ঘুরে অন্য আরেকটা ধরে দৌড়তে লাগলাম।

‘আমরা ওপরে আছি,’ শ্বাসের ফাঁকে বলল রায়ান। ‘নিচতলায় নামার সিঁড়ি খুঁজতে হবে।’

আরেকটি কোনা ঘুরলাম আমরা। সিঁড়ির দেখা নেই। মাঝ বরাবর ফাটা লম্বা এক আয়নার পাশ দিয়ে দৌড়চ্ছি।

কাঁচে চাপ দিলাম হাত দিয়ে। শক্ত। পালাবার পথ নয়। ‘ওহ,’ সামনে থেকে অস্ফুটে বলে উঠল ডেমি। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইলাম।

ছাদ থেকে এক টিভি মনিটর ঝুলছে। ফিয়ার মিটার শো করছে ওটা। লাল দাগটা ৪০-এ উঠেছে।

আমার কবজির ব্রেসলেটটা হুল ফোটাচ্ছে। চামড়ায় গরম অনুভূতি।

‘আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে,’ বললাম। ‘ভয়ের মাত্রা কিছুতেই বাড়তে দেয়া যাবে না।’

‘মাথা ঠাণ্ডা রাখব কীভাবে?’ অ্যাণ্ডিনা চেঁচিয়ে উঠল। ‘পাগল নাকি তুমি?’

ওকে মৃদু ধাক্কা দিল কিশোর।

‘এগোতে থাকো,’ বলল। ‘টিভি মনিটরগুলোর দিকে চেয়ো না। মিটারটার দিকেও না। স্রেফ চোখ-কান বুজে দৌড়তে থাকো।’

কিশোর আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা আবারও দুলকি চালে ছুটতে লাগলাম। আরেকটি দীর্ঘ, সোজা হল ধরে।

গালিচার মাঝখানে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল এক কালো বিড়াল।

না, কালো বিড়াল নয়। কাছাকাছি হতেই দেখলাম, ওটা এক ছায়াবিড়াল। গালিচার ঠিক ওপরে ভেসে রয়েছে, ধূসর, করুণ চোখজোড়া আমাদের দিকে মেলে।

আমরা পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতেই বেদনাতুর মিয়াও ডাক ছাড়ল ওটা।

হল-এর শেষ মাথায়, দুটো চকচকে দরজা।

‘ডেড এণ্ড,’ আঁতকে উঠে বলল ডেমি। ‘ফিরে যেতে হবে।’

‘না, দাঁড়াও, বলল কিশোর। ‘আগে চেক করে দেখি জোড়া দরজার পাশে এক বাটন দেখাল। ‘এটা এলিভেটর।’

‘এটা নিচে নিয়ে যাবে আমাদের, বলল ভিভ। টি-শার্টের হাতা দিয়ে মুছল কপালের ঘাম। ‘হয়তো বেসমেন্টে নামব, ওখান থেকে পালাবার একটা পথ পেয়ে যাব।’

ঝাঁ চকচকে জোড়া দরজার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমরা।

কিশোর বোতামটা একবার দাবাল। দু’বার।

আস্তে-আস্তে হড়কে খুলে গেল দরজা। এলিভেটর কারের দিকে চেয়ে রয়েছি আমরা। সরু আর গভীর ওটা। দেয়ালগুলো নিকষ কালো। নিচু ছাদ থেকে ম্লান, তিনকোনা আলো দিচ্ছে একমাত্র বাতিটা।

আমরা চেপেচুপে ঢুকলাম ওটার ভেতরে। সতেরোজনই। আমাদের ভারে সামান্য দুলে উঠল কারটা। সবাই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কথা বলার সাহস নেই, এতটাই নার্ভাস।

এসময় ককিয়ে উঠে হড়কে লেগে গেল যমজ দরজা। পরক্ষণে, নিভে গেল বাতিটা।

‘খাইছে!’ অস্ফুটে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

আমার হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠল

ছেলে-মেয়েরা গুঙিয়ে উঠে সভয়ে শ্বাস চাপল। কালিগোলা অন্ধকার।

‘এখানে বাতাস কম,’ আমার পেছন থেকে বলে উঠল নেলী। ‘এরমধ্যেই গরম হয়ে উঠেছে!’

‘রবিন, তুমি সামনে আছ,’ বলল অ্যাণ্ডিনা। ‘বাটনটা টেপো।’ হাতটা সামনে বাড়িয়ে দেয়ালে ঠেকালাম। দরজার পাশে হাত ওঠালাম-নামালাম।

‘চাপ দাও,’ চেঁচিয়ে উঠল ভিভ। ‘শ্বা…শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’

‘খুঁ… খুঁজে পাচ্ছি না তো,’ বললাম। এলিভেটরের দেয়াল বরাবর হাতের তালু বোলালাম। এবার দরজার উল্টোদিকের দেয়াল হাতড়াতে লাগলাম পাগলের মতন।

‘পাচ্ছি না। পাচ্ছি না!’

‘নিচে নামার বোতাম নিশ্চয়ই থাকবে,’ বলল অ্যাণ্ডিনা। ‘বদ্ধ…জায়গায়…দম আটকে আসে আমার। প্লিজ…কিছু একটা…করো।’

‘দরজা খোলো!’ চেঁচাল টিনা। ‘এখান থেকে বেরোতে হবে!’

‘প্লিজ, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি,’ গুঙিয়ে উঠল অ্যাণ্ডিনা।

মুসা আমার গা ঘেঁষে ছিল। আঁধারে দেয়ালে হাত বুলিয়ে বোতাম খুঁজতে লাগল।

দরজাজোড়ার ওপরে হাত বোলালাম। সবখানে খুঁজলাম। ‘কোন বোতাম নেই,’ বললাম। ‘নড়ার উপায় নেই। বেরোবার পথ নেই। ‘

‘আমরা কি এখানে আটকা পড়েছি?’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল অ্যাণ্ডিনা। আমার ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দু’হাতে দুমাদুম কিল মারতে লাগল দরজায়। ‘না! আমাদের বেরোতে দিন! কে আছেন-বাঁচান!’

চোদ্দ

পাগলের মত চেঁচাচ্ছে অ্যাণ্ডিনা আর কিল মেরে চলেছে দরজায়।

এলিভেটরটা ঝাঁকি খেতেই পিলে চমকে গেল আমার-এবার নামতে লাগল ওটা।

পরমুহূর্তে, তারস্বরে চিৎকার ছাড়লাম পায়ের তলা থেকে মেঝেটা সরে যেতেই।

পেছনে দাঁড়ানো ডেমি আর রিনার ওপরে টলে পড়লাম। সবাই আর্তস্বরে চেঁচাচ্ছে। এপাশ-ওপাশ দুলছি আমরা।

এলিভেটরটা দ্রুতগতিতে পড়ে যাওয়ার সময় শোঁ-শোঁ শব্দ উঠল…ক্রমেই বাড়ছে পতনের গতি…

কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।

আমরা পড়ে যাচ্ছি…ভারী পাথরের মত…অসম্ভব জোরে। এখন শুধু প্রচণ্ড সংঘর্ষের অপেক্ষা…

‘আমরা মারা যাচ্ছি!’ আমার কানের কাছে চিল চিৎকার ছাড়ল রিনা।

মুসার কাঁধ চেপে ধরলাম। আর্তচিৎকার করছে যে ছেলেটা, সেটা কি আমি?

চোখ বুজে ফেলেছি। কান ভোঁ-ভোঁ করছে। হাঁটুজোড়া ভাঁজ- হয়ে গেল আমার। শ্বাস আটকে রেখেছি-পতন-যন্ত্রণা সইবার প্রস্তুতি নিচ্ছি মনে-মনে।

কানে তালা লাগানো শব্দে আছড়ে পড়ল এলিভেটরটা। বগিটা প্রবলভাবে দুলে উঠল। পরক্ষণে, লাফিয়ে উঠল ঝাঁকি খেয়ে। তারপর আবার পড়ে গেল সশব্দে।

পতনের ধাক্কায় হাঁটু ভাঁজ হয়ে যেতেই আর্তনাদ ছাড়লাম আমি। অন্যরাও চেঁচাচ্ছে, কোঁকাচ্ছে।

‘ওহ!’ কার যেন কনুই গুঁতো মারল আমার পিঠে। হুমড়ি

খেলাম সামনে।

আচমকা বাতিটা জ্বলে উঠল।

‘যাক, বাবা, বেঁচে তো আছি,’ বগির পেছন থেকে গুঙিয়ে উঠল ইমন।

ঝটপট উঠে দাঁড়ালাম আমরা। পিঠ টাটাচ্ছে আমার। দস্তুরমত হাঁফাচ্ছি।

‘দরজা খোলো,’ অ্যাণ্ডিনা বলল। ‘প্লিজ…জলদি করো। বমি আসছে আমার।’

দু’হাতে ধাক্কালাম দরজাটা। ক্ষীণ আলোয় এলিভেটরের বাটনটা খুঁজলাম আবারও।

কিছুই পেলাম না।

‘দেখি!’ বলে ভিড় ঠেলে সামনে চলে এল রায়ান। মুঠোজোড়া পাকিয়ে দানবীয় শক্তিতে দুমদাম কিল মারছে।

দরজাটা যে কে সেই রইল।

‘ভীষণ গরম লাগছে এখানে,’ বলল ভিভ। ‘মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে…জ্ঞান হারাব।

রয় কথা বলে উঠল।

‘আমি তো ছায়া। হয়তো কোন ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়ে খুলতে পারব বাইরে থেকে।’

মেঘের মত ভেসে চলে এল সামনে। রায়ান পথ থেকে সরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে রিনার ঘাড়ে পড়ল।

রয় ভেসে দরজার ওপরদিকে উঠে গেল, তারপর শ্লথ গতিতে নেমে এল নিচে।

‘কোন ফাঁক পেলাম না,’ মৃদুস্বরে বলল। ‘গলে বেরনোর মত কোন জায়গা নেই। ‘

এসময় কিশোর এক হাত তুলে সবার মনোযোগ চাইল। ‘আমার ব্রেসলেটটা কাঁপছে,’ জানাল। ‘আমাদের এখন শান্ত থাকতে হবে। ফিয়ার মিটার চড়তে দেয়া যাবে না।’

‘শান্ত? শান্ত থাকব কীভাবে?’ চেঁচিয়ে উঠল নেলী।

‘আমরা এখানে কতক্ষণ আটকা থাকব?!’ গর্জাল রায়ান। প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল দেয়ালে।

দেয়াল থেকে খসে পড়ল এক ধাতব প্যানেল। বেরিয়ে পড়ল গোপন এক স্লট।

‘কি কার্ডের স্লট!’ চিৎকার করে উঠল কিশোর। ‘সরো, রবিন। কার্ডটা ঢুকিয়ে দেখি।’

সভয়ে ঢোক গিললাম।

‘কিন্তু…তুমি তো ওটা মিল্টনকে দিয়ে দিয়েছিলে। সরাই দেখেছে!’

‘হুঁ, কোন সন্দেহ নেই তাতে,’ বলে, চোখ ঘোরাল কিশোর। ‘আমি কি অতই বোকা? ওকে আমার লাইব্রেরি কার্ডটা দিয়েছিলাম। গর্দভ দানবটা একবার দেখেওনি পর্যন্ত!’

জিন্সের পকেট থেকে কি কার্ডটা বের করল ও। স্লটের উদ্দেশে তুলে-ঢুকিয়ে দিল।

কিছুই ঘটল না।