তৃতীয় অধ্যায়
—আচ্ছা, মিস্টার লেজুন, আমি বুঝতে পারছি না এর বেশি আর আপনাকে আমি কি বলতে পারি। এর আগে আপনার সার্জেন্টের কাছে তো আমি সব কথাই বলেছি। এই মিসেস ডেভিস যে কে কিংবা কোথা থেকে এসেছিলো তা আমি জানি না। মহিলা প্রায় মাস ছয়েক আমার এখানে ছিলো। নিয়মিত ভাড়া মিটিয়ে দিতো, এবং তাকে ঠান্ডা মেজাজের শ্রদ্ধেয় মহিলা মনে হয়েছিল। আর এর বেশি আপনি আমার কাছে যে কি জানতে চাইছেন তা আমি বুঝতে পারছি না। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু হাঁফ নেওয়ার জন্যে থামলো মিসেস কপিস। তারপর অখুশি দৃষ্টিতে তাকালো ইনসপেক্টর লেজুনের মুখের দিকে।
গোয়েন্দা ইনসপেক্টর এবার মহিলার দিকে চোখ রেখে শান্ত বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। এদের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন যে তাঁর এই মৃদু হাসি বিফল হবে না।
মহিলা যেন নিজের আগে বলা কথাগুলো সংশোধন করার ইচ্ছায় বললেন—এমন নয়, যে জানা থাকা সত্ত্বেও আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি না…
—ধন্যবাদ। এই সাহায্যটুকুই আমাদের প্রয়োজন। পুরুষের চেয়ে মহিলারা অনেক বেশি জানতে, বুঝতে পারেন—পারেন সহজাত শক্তির অনেক বেশি অনুভব করতে।
এটা একটা দারুণই ভালো চাল দেওয়া হল—আর তাতে কাজও হলো। মিসেস কপিস বললেন—আমার ধারণা কপিনস্ আপনার কথার জবাব দিতে পারতো। যত আজব ব্যাপার নিয়ে সে মাথা ঘামাতো এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার জানার জন্য সব সময় চেষ্টা করতো। বলতো হাতে কাজ না থাকলে সব কিছু জানার জন্য মাথা ঘামাতো আর নাক ঝারতো। দশ-বারের মধ্যে ন-বার সে ঠিক কথা বলতো।
—আর ঠিক সে জন্যই তো মিসেস ডেভিস সম্পর্কে আপনার ধারণা জানতে চাইছি। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় মহিলা অসুখী ছিলেন?
—এখন এ ব্যাপারে, না আমি বলতে পারছি না। তাকে সব সময় ব্যরসায়ীসুলভ মহিলা বলে মনে হতো। তার ছিলো সুবিন্যস্ত আচরণ। মনে হতো তার জীবন সে পরিকল্পনা মাফিক গড়ে তুলেছিলো আর সেই মতো কাজ করতো। সে কাজ করতো একটা খরিদ্দার সমিতিতে : তার কাজ ছিলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে খবর সংগ্রহ করা—কার সংসারে কত সাবানের গুঁড়ো কিংবা ময়দা খরচ হয় এবং সপ্তাহে তার জন্য তারা কত খরচ করতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের খোঁজ নেওয়ার ব্যবস্থা আমার বিশ্রী লাগতো—মনে হতো এ ধরনের আচরণ আজকের দিনে পাগলামি। কিন্তু আমার মনে হতো মিস ডেভিস বেশ ভালোভাবে তার কাজ করতো। তার আচার আচরণ ছিলো খুবই আনন্দদায়ক, এলোমেলো নয়, ছিলো ব্যবসায়ী সুলভ এবং সুবিন্যস্ত।
—মহিলা যে সংস্থায় কাজ করতেন তার আসল নামটা কি আপনি জানেন না?
—না। আমি জানি না।
—তিনি কি কোনোদিন আপনাকে তাঁর আত্মীয় স্বজনদের কথা বলেছিলেন?
—না। শুনেছিলাম, সে বিধবা। অনেকদিন আগেই তার স্বামী কিছুটা পঙ্গু ছিলো, কিন্তু সে কোনোদিন স্বামীর কথা নিয়ে বেশি আলোচনা করতো না
—কখনো কি বলতেন বা কোথা থেকে তিনি এসেছেন—দেশের কোনো অঞ্চল থেকে?
—আমার মনে হয় না সে লণ্ডনের বাসিন্দা ছিলো। বোধ হয় উত্তরের কোনো অঞ্চল থেকে এসেছিল।
—আচ্ছা, তার জীবন যে রহস্যে ঘেরা ছিল তা কি কোনোদিন আপনার মনে হয়নি? কথা বলার সময় ইনসপেক্টর লেজুনের মনে একটা সন্দেহ দেখা দিলো- মহিলার মুখ থেকে কোনো খবর কি বার করা যাবে…। কিন্তু মিসেস কপিস তাকে দেওয়া এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন না।
তাই বলতে লাগলেন—মনে হয় তেমন ধরনের কোনো অনুভব আমার মনে ছিলো না। নিশ্চয় তার কোনো কথা শুনেও আমার তেমন মনেও হয়নি। কেবল তার ঐ স্যুটকেসটার চেহারা দেখেই আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। কাল চামড়ার স্যুটকেস হলেও একেবারে আনকোরা নতুন নয়। তার উপর রঙ দিয়ে লেখা দুটো অক্ষর—জেঃ ডিঃ—অর্থাৎ জেসি ডেভিস। বাজারে পুরানো স্যুটকেস ভালো অবস্থায় কিনতে পাওয়া যায়। এবং স্বাভাবিক ভাবেই ঐ স্যুটকেসটা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। ইনসপেক্টর তা জানতেন মৃতা মহিলার ব্যক্তিগত জিনিসপত্তর খুবই কম ছিলো—এটা একটা রীতিমতন তাজ্জব ব্যাপার। ঘরে না পাওয়া গেছে চিঠি, না একখানা ফোটো। স্পষ্টতঃ মহিলার কোনো বীমাকার্ড ছিলো না, ছিলো না ব্যাঙ্কের পাস বই এবং চেক বই। তাঁর পোশাক-আশাকগুলো সবই কেতাদুরস্ত আর উন্নত জাতের পরিধানের যোগ্য—প্রায় প্রত্যেকটি পোশাকই আনকোরা নতুন।
—তাকে খুবই সুখী মনে হতো কি? শুধালেন ইনসপেক্টর।—আমার তাই মনে হয়েছে। মহিলার কণ্ঠে অনিশ্চয়তার সুর ইনসপেক্টরের কানে বাজলো। তাই আবার শুধালেন – আপনি কেবল মনে করেছেন?
—আচ্ছা, আপনি যা মনে করেছেন ঘটনাটা কিন্তু তাই নয়, তাই তো? বলতে পারি, মোটা বেতনের চাকরি করার জন্য মহিলা মার্জিত রুচির জীবন যাপন করতো আর তার জীবনও ছিলো পরিতৃপ্ত। অনুযোগ করার মনোবৃত্তি তার ছিলো না। তবে অসুস্থ হয়ে পড়লে…।
কথা যেন মহিলার মুখে জুগিয়ে দিতে চাইলেন ইনসপেক্টর–হাঁ, যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন কি?
—প্রথমে হয়ে পড়েছিলো খিট্খিটে। তখন সে ফ্লু-তে ভুগছিলো। বলেও ছিল, এখন তার সব কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। দেখাসাক্ষাৎও বন্ধ। কিন্তু ফ্লু রোগটার যখন বাড়াবাড়ি হয় তখন আর কেউ রোগটাকে অবহেলা করতে পারে না। তখন তাকে শয্যাশায়ী হতে হলো। মাঝে মাঝে গ্যাসের উনুনে চা বানিয়ে চুমুক দিয়েছে। মাথায় যন্ত্রণা বাড়লে খেতে হয়েছে এ্যাসপিরিনের বড়ি। বলেছিলাম, ডাক্তার ডাকাচ্ছো না কেন এবং জবাব দিয়েছিলো, তার প্রয়োজন দেখছি না। ফ্লু হলে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে দেহ গরম রাখা ছাড়া আর কোনো ওষুধ নেই। আর ছোঁয়াচে রোগ বলে আমাকে তার ধারে কাছে যেতে বারণ করেছিলো। তার শরীর সুস্থ হলে তাকে কিছু কিছু রান্নাবান্না করে দিয়েছিলাম। গরম ঝোল আর স্যাঁকারুটি। আর মাঝে মাঝে দু-একখানা আসকে পিঠে। তার শরীর কিন্তু ভেঙে পড়লো—অবশ্য ফ্লু হলে এমনটা হয়। মনে হতাশা দেখা দেয়। আরো অনেকের মতো [__?] তার দেহ মনও গভীর হতাশায় ভেঙে পড়লো। মনে পড়ছে গ্যাসের উনুনের পাশে বসে সে একদিন আমায় বলেছিলো—কারো বেশি ভাবনা চিন্তা করা উচিত নয়। আমি সেটাই চাই। চিন্তাই আমাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। শেষ করে ফেলছে।
ইনসপেক্টর লেজুন গভীর মন দিয়ে মিসেস কপিসের দিকে তাকিয়ে তার বলা কাহিনী শুনছিলো—খানকয়েক পত্রপত্রিকা তাকে ধার দিলাম পড়বার জন্য। কিন্তু মনে হলো, পড়াশুনো করবার মতন তার মন নেই। একবার বলেছিলো যে ঘটনাগুলো যেমনভাবে ঘটা উচিৎ ছিল ঠিক যদি তেমনভাবে ঘটে। তবে সব ঘটনার বৃত্তান্ত না জানাই ভালো। তাকি তুমিও বলো না? এবং আমি জবাব দিয়েছিলাম এটাই ঠিক কথা গো। আর সে বলেছিলো—জানি না। সত্যিই এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই বলেছিলাম তখন, তাহলে তোমার কথাই ঠিক। এবং আবার সে বলেছিলো, যখন যা কিছু করেছি তা পুরোপুরি সরল মনেই করেছি। লুকোচুরি কিছু তার মধ্যে ছিল না। তাই আমার মনে কোনো অনুশোচনা নেই। কিন্তু মুখে এই কথা বললেও মনে মনে আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম। যে সংস্থায় সে কাজ করে সেখানে ব্যবসাঘটিত হিসেবপত্তর গোলমাল এবং গরমিলের জন্য হয়তো কিছু ঘটে থাকতে পারে—এবং সে তা জানতে পেরেছিলো। কিন্তু এমন কাজ সে করতে পারে না।
—তা অসম্ভব। লেজুন স্বীকার করলেন।
—যা হোক সে ভালো হয়ে উঠে কাজ করতে শুরু করলো। তাকে বলেছিলাম খাটাখাটনি খুব তাড়াতাড়ি শুরু করলে। আরো দু-চার দিন বিশ্রাম নেওয়া ভালো। এবং আমি যে সত্যি কথাই তাকে বলেছিলাম তার প্রমাণও হাতে হাতে ফললো। দু দিনের দিন সন্ধ্যেবেলা সে ঘরে ফিরে আসলো। জ্বরে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে সে দারুণ হাঁপাচ্ছে। বললাম তোমার জন্য এক্ষুনি ডাক্তার ডাকতে পাঠাচ্ছি। কিন্তু সে রাজী হলো না। সারাদিন ধরে তার অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল। চোখ দুটো হয়ে উঠলো ঘষা কাঁচের মতন। গাল দুটো জ্বরের তাপে জ্বলছিলো। শ্বাসকষ্টও দেখা দিলো। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় সে আর কথা বলতে পারছিলো না। তবু অতিকষ্টে আমাকে বললো—একজন পাদরী, আমাকে একজন পাদরীর সাথে কথা বলতেই হবে। এবং দেখা করতে হবে এক্ষুনি, তাড়াতাড়ি…নইলে বড় দেরী হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের গীর্জার পাদরীর সঙ্গে সে দেখা করতে চাইলো না। তার চাই একজন রোমান ক্যাথলিক পাদরী। জানতাম না, সে রোমান ক্যাথলিক, তার ক্রশচিহ্ন বা অন্য কিছু কোনোদিন তো দেখিনি। কিন্তু তার স্যুটকেসের ভিতরে একটা কোণে একখানা ক্রশচিহ্ন আটকানো ছিলো। পুলিশ তো পেয়েছে। কিন্তু লেজুন কথাটা ভাঙলেন না। তিনি শুধু বসে মহিলার কথা শুনছিলেন।
—পথের ওপর মাইক ছোকরাকে দেখতে পেলাম। তাকে পাঠিয়ে দিলাম সেন্ট দোমিনিকের গীর্জার ফাদার গোরম্যানের কাছে। এবং ফোনে ডাক্তারকে কল দিয়ে নিজের বুদ্ধি মতন হাসপাতালে একটা খবর দিলাম। তাকে অবশ্য এ সব কথা জানাইনি।
—ফাদার পৌঁছলে আপনি কি ফাদারকে মহিলার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন?
—হ্যাঁ আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। এবং তাদের দুজনকে ঘরের মধ্যে রেখে চলে এসেছিলাম।
—তাদের মধ্যে কেউ একজনও কি কোনো কথা বলেছিলো?
—এখন ঠিক সে কথা মনে করতে পারছি না। আপন মনে বলে উঠলেন।