একবিংশ অধ্যায়
পরের কয়েক দিনের ঘটনা যে কোনো দিন আমি ভুলতে পারবো মনে হয় না।
জিনজারকে তার ফ্লাট থেকে একটা নার্সিংহোমে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া আমাকেও তার সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। জিনজারের ডাক্তার তার রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেননি। ওর মধ্যে অস্বাভাবিক রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তার ব্রঙ্কো নিমোনিয়া হয়েছে। সব সময় এ রোগ হলেও এমন বিশেষ উপসর্গ দেখা যায় না।
পুলিশ দপ্তরের মনঃবিশ্লেষকের সঙ্গে দেখা করলাম। কিন্তু জিনজারকে অনেকবার সম্মোহিত করেও ডাক্তার কিছুই জানতে পারেননি। বোধ হয় কিছু বলবার মতন কথা তিনি জানতে পারেননি তাই বললেন না। অবশেষে দারুণ হতাশ হয়ে পপিকে তার ফুলের দোকানে ফোন করে তাকে আজ আমার সঙ্গে ডিনার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালাম। পপি এ ধরনের আমন্ত্রণ পেলে দারুণ খুশি হয়।
ওকে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ঢুকলাম।
আমিই জানতে চাইলাম যে, সে আমার বান্ধবী জিনজারকে মনে রেখেছে কি না।
পপি শুধালো—নিশ্চয়, জিনজার আজকাল কি করছে?
—জিনজার দারুণ অসুস্থ। কোনো একটা কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। সে তো তোমার সাথেও কথা বলেছিলো। পেল হর্সের লোকজন। এর জন্যে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। চোখ বড়ো করে তাকিয়ে পপি বললো-ওহো তুমিই সেই লোক।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ওর কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না। শেষে বুঝলাম যে লোকটির পঙ্গু স্ত্রীর জন্য জিনজারের সুখের পথে কাঁটা পড়ছে— পপি আমাকে সেই লোক বলে ধরে নিয়েছে। চিনতে পেরেছে—আর তাই দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো পপি।
সজোরে নিঃশ্বাস ফেলে শুধালো—তাহলে কি কাজ হয়েছে?
—যে ভাবেই হোক উল্টো কাজ হচ্ছে। যার মরার কথা নয় সেই মরছে।
কি বলছো তুমি?
জিনজারের ওপরই উল্টো ফল হয়েছে। এর আগে কি এমন ঘটনা ঘটতে শুনেছো? না, পপি কখনও শোনেনি।
শুধালাম—অবশ্য সূচ ডিপিঙে পেল হর্স কুঠিতে যে সব লোকজন এসব কাজ করে তাদের তুমি জানো, তাই না?
—জায়গাটা যে কোথায় তাই আমি জানি না। কোনো গ্রামে টামে হবে বোধ হয়। বললো পপি।
—আচ্ছা, আমি জিনজারের মুখ থেকে কিছুই জানতে পারলাম না।
—এটা জিনজারের জীবন বিপদাপন্ন করেছে। তাকে বাঁচাবার জন্য কার কাছে যাবো বলতে পারেন। এই নীল ব্রানডনের নাম একেবারেই নতুন শুনলাম, তাই শুনেই চমকে উঠলাম।
শুধালাম—এই লীন ব্রানডন কে?
পপি বললো—সে আমার সাথে স্কুলে পড়তো।
—আচ্ছা, পেল হর্সের সাথে তার কি সম্পর্ক?
—সত্যিকারের কিছু নেই। তবে একটা খবর জানার পর সে ছেড়ে দেয়।
আমি হতভম্ব হয়ে শুধালাম—কি ছেড়ে দেন?
—ক্রেতা বিশ্লেষণের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলো।
—এই ক্রেতা বিশ্লেষণের ব্যাপারটা কি?
—আমি সঠিক জানি না। ক্রেতাদের সম্পর্কে সমীক্ষা বা বিশ্লেষণ করাই ওদের হয়ে কি কাজ করতো? তাকে কি কাজ করতে হতো?
—কেবল ঘুরে ঘুরে জানতে হতো—কোনো ক্রেতা কি টুথপেস্ট বা গ্যাস স্টোভ এবং কি ধরনের স্পঞ্জ ব্যবহার করে। বড় বাজে একঘেয়ে কাজ।
—কেন মহিলা কাজ ছেড়ে দিয়েছিলো? একঘেয়েমি লাগছিলো বলে কি?
—আমার তা মনে হয় না। তারা ভালো বেতন দিতো। এই কাজটা সম্বন্ধে তার একটা ধারণা—কাজটা যা মনে হয়েছিলো আসলে কাজটা তা নয়।
—মহিলা ভেবেছিলো এই কাজের সঙ্গে যে কোনোভাবেই হোক পেল হর্সের যোগ আছে, তাই না?
পপি জবাব দিলো — ঠিক জানি না। তবে এই ধরনের একটা কিছু ঘটনা হবে…এই লীন এখন কাজ করছে টটেনহাম রোডের একটা কফি বারে।
—তার ঠিকাটানা দাও তো।
সে মেয়ে কিন্তু তোমার মন পছন্দ হবে না।
আমি নিষ্ঠুরের মতো জবাব দিলাম—তার সাথে আমি যৌন সংসর্গ করতে যাচ্ছি না। যাব এই সংস্থা সম্পর্কে কিছু খবর জানতে। তুমি ঠিকাটানা দাও।
পপির কাছ থেকে আর বেশি কিছু জানার সম্ভাবনা ছিলো না।
তাই এই লীনের ঠিকানা নিয়ে ফিরে এলাম।
—তাহলে একটা কিছু তো করতেই হবে।
—কি করতে চাও?
ঘরে ঢুকেই শুধালাম—ঠিক সময়ে আমরা এসেছি তো? বাঁচবে তো জিনজার?
—আমরা সব রকম চেষ্টা করছি। তবে ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখছে এটা থেলিয়াম বিষ।
—তাহলে পেল হর্সের আসল কথাটাই হচ্ছে বিষ প্রয়োগ। ডাইনী-বিদ্যা নয়। সম্মোহন নয়। নয় বৈজ্ঞানিক মৃত্যুরশ্মি। সরল একটি বিষ। স্ত্রীলোকটি সারাক্ষণ হাসিমুখে থেকেছে আর সেই বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে আমার মুখে।
—কার কথা বলছো মার্ক?
—মিস থিরজা গ্রের কথা বলছি। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আমাদের প্রথম দেখা। সেদিন সে বলছিলো দুর্লভ এবং অচেনা নানা ধরনের বিষের কথা। সবই সাধারণ আর্সেনিক বিষ। তাই ও সম্মোহন প্রক্রিয়া সাদা মোরগ এবং জ্বলন্ত অঙ্গারের পাত্র, জাদু এবং উল্টো করে রাখা ক্রশ চিহ্ন আর এই বিখ্যাত ব্যবসাটা—এসবই মিথ্যা। পেল হর্স হচ্ছে একটা ঘোড়ার ছবি যার আড়ালে আসল শিকারী ওৎ পেতে থাকে। আমাদের দৃষ্টি থাকবে ছবির দিকে—আর অন্য দিকে তখন কি ঘটছে সেদিকে নজর থাকবে না। থিরজা গ্রে তার যাদু বিদ্যা সম্বন্ধে বড় গলায় যত খুশি বললেও তার জন্য তাকে আদালতে তোলা যাবে না।
—তোমার কি ধারণা ওরা তিনজনেই এ ব্যাপারে জড়িত? ইনসপেক্টর জানতে চাইলো। বেল্লা ডাইনী বিদ্যা নিয়েই থাকে। নিজের ক্ষমতার উপর তার যথেষ্ট বিশ্বাস রয়েছে। আর এ জন্যে সে খুব খুশি। সিবিল উপযুক্ত মাধ্যম। তার উপর আত্মার ভর হয়। থিরজা যা বলে তাই সে বিশ্বাস করে।
—তাহলে আসল নায়িকা হচ্ছে থিরজা গ্রে।
—পেল হর্সের ব্যাপার বলতে হলে এটাই সঠিক। এই সব ঘটনা ঘটানোর মস্তিষ্ক থিরজা গ্রে নয়। মস্তিষ্ক থাকে পর্দার আড়ালে। এদের সকলেরই নিজের কাজ আছে। সে নিজের কাজটুকু করে। একজনের সঙ্গে আর একজনের কোনো যোগ থাকে না। ব্রাডলি ওদের আর্থিক দিকটা নিয়ে মাথা ঘামায়।
লেজুন শুধালো—মনে হচ্ছে, এদের সব কথা তুমি জানতে পেরেছো?
—এখনও সব কিছু জানতে না পারলেও মূল রহস্যটা জেনেছি। এ সেই বহু প্রাচীন বিষ প্রয়োগের রহস্য।
—তোমার মাথায় থেলিয়াম বিষের কথা এলো কেন?
আকস্মিকভাবে একাধিক ঘটনা একসঙ্গে ঘটেছিলো। সেদিন রাতে চেলসিয়ার কফি বারে একটি মেয়ে আর একটি মেয়ের মাথা থেকে এক মুঠো চুল গোড়া থেকে উপড়ে নিয়েছিলো। মেয়েটি বলেছিলো, আমার একটুও লাগেনি। ঘটনার সেই শুরু। আমেরিকায় থাকার সময় থেলিয়াম বিষ প্রয়োগ সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম।
একটা কারখানায় অনেক শ্রমিক পরপর মারা যায়। কেউ প্যারাটাইফয়েড? কেউ বা এপিলেক্সি বা গ্যাস্ট্রো এন্ট্রাইটিসে মারা যায়। একটি স্ত্রীলোক সাত জনকে বিষপ্রয়োগ করেছিলো। তবে যে রোগেই তারা মারা যাক একটা ব্যাপারে মিল ছিল। তাদের সকলের মাথা থেকে চুল পড়ে গিয়েছিলো। আগে দাদের ওষুধ হিসাবে থেলিয়াম ব্যবহার করা হতো। এখন কেবল ইঁদুর মারার জন্য এই বিষ ব্যবহার করা হয়। পেল হর্সের বাসিন্দারাও এই বিষ ব্যবহার করেছিলো। যাকে খুন করা হবে তার কাছ থেকে খুনী থাকে দূরে—যাতে খুনীকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে, খুনী নিজের হাতে কিছুই করে না। পরিণাম না জেনে অন্য লোকে তার হুকুমে কাজ করে। যে কাজ করে তার সাথে নিহত ব্যক্তির কোনো সম্পর্ক থাকে না। আমার ধারণা যে বিষ প্রয়োগের ব্যবস্থা করে, সে মাত্র একবার অকুস্থলে যায়।