দ্বিতীয় অধ্যায়
নিজের স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ ছোঁ মারার ভঙ্গিতে মিসেস জেরহাটি গীর্জার আচার্যের বাড়ির সদর দরজার খিল খুললো।
সামান্য ঘণ্টাধ্বনির আওয়াজ হলেও তার আচরণ প্রকাশ করছে যেন এবার তোমাকে ধরতে পেরেছি। এমন একটা বিজয়ী মনোভাব।
আচ্ছা এখন কি চাইছিস তুই? মিসেস জেরহাটি কলহ করার ভঙ্গিতে জানতে চাইলো। সহজে নজর পড়ে না আবার ভাবাও যায় না আসলে আরও পাঁচটা ছোকরার মতন সেও একজন। মাথায় ঠান্ডা বসেছিলো বলে ছোকরা হাঁচছিলো।
—এটা কি পাদরির বাড়ি?
—তুই কি ফাদার গোরম্যানকে চাইছিস?
তাকে খুঁজছে, বলল ছোকরা, কে খুঁজছে, কোথায় আর কিসের জন্য। বেন্থাল স্ট্রিট, তেইশ নম্বর, একটা মেয়েমানুষ বলে উঠল সে তো মরছে। মিসেস কপিস আমাকে পাঠাল। এটা ক্যাথলিকদের গীর্জা, তাই না। মেয়েমানুষটা বলছে পল্লীর পাদরি না এলে হবে না।
এ ব্যাপারে মিসেস জেরহাটি ছোকরাকে কথা দিলো, ছোকরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ওকে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে সে নিজে গীর্জার মধ্যে ঢুকে পড়ল। তিনমিনিট পরে একজন বয়স্ক পাদরি বাইরে এলেন। তার হাতে ছিল একটা ছোটোখাটো চামড়ার কেস।
আমি ফাদার গোরম্যান। তিনি বললেন বেহাল স্ট্রিট। রেলের ইয়ার্ড ঘুরে ওখানে যেতে হয়, তাই না? এক্কেবারে সোজা। এক পাও বেশি নয় তাই না।
একই সঙ্গে তারা যাত্রা করলেন। ফাদার দ্রুত পদক্ষেপে হাঁটছিলেন। তুই মিসেস কপিনস বললি না, তাই নাম তো। সেই তো বাড়ির মালকিন। ঘর ভাড়া দেয়।
তোমাকে খুঁজছে ও বাড়ির একজন ভাড়াটে। মনে পড়েছে লোকটার নাম ডেভিস।
ডেভিস নামটা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। তার নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। সে মনে হয় তোমাদেরই লোক। বলছি, সে ক্যাথলিক। বলেছে, পল্লীর পাদরি চলবে না। ফাদার মাথা নাড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁরা বেন্থাল স্ট্রিটে হাজির হলেন। সারি সারি উঁচু হয়ে আছে কাল রংয়ের বাড়ি।
ঐ বাড়িগুলোর মধ্যে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিল ছেলেটি।
ওই ওটা, কিন্তু তুই বাড়ির মধ্যে যাবি না।
না—আমি তো ওখানে থাকি না। খবর বলতে যাওয়ার জন্য মিসেস কপিনস আমাকে শিলিঙ দিয়েছে।
বুঝেছি। তোর নাম কি রে?
মাইক পটার।
ধন্যবাদ মাইক। শিস্ দিতে দিতে চলে গেল মাইক। মরণাপন্ন লোকটার জন্য তার মনে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। তেইশ নম্বর ঘরের দরজা খুলে বাইরে এল মিসেস কপিস। তার মুখমণ্ডল টকটকে লাল এবং বড়।
মিসেস কপিনস সাদর আহ্বান জানালো ফাদারকে। আসুন, ভিতরে আসুন, ওঁর অবস্থা খুব সঙ্গীন ওকে হাসপাতালে পাঠানো উচিত। ফোন করেছি কি জানি কে কখন সাহায্য করতে আসবে ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না। আমার বোনের পা ভাঙার পর দু-ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এটাকে আমি বলি ন্যাক্কারজনক ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্যই সেবা। তোমার কাছ থেকে অর্থ নেবো কিন্তু তোমার প্রয়োজনে কেউ নেই। কথা বলতে বলতে মহিলা ফাদারকে সরু সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
কি হয়েছে মহিলার?
প্রথম হয়েছিল ফ্লু। মনে হয় সেরে গেছে। আমার কথায় একটু তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ছিলো কাজে। ফিরে এলো প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায়। বিছানা নিল। কিছুই খাচ্ছে না। কোনো ডাক্তারকে সে দেখাতে চায় না। আজ সকাল বেলা জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে। ফুসফুসও ধরে নিয়েছে। মনে হয় নিউমোনিয়া হয়েছে। মিসেস কপিন্স এখন হাঁফাতে শুরু করেছে—বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মত সজোরে শ্বাস ছাড়ছে। বোঝা যাচ্ছে তারা এখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। একটা ঘরের দরজা ফাঁকা করে ফাদারকে ঘরের মধ্যে ঢোকার পথ দেওয়ার জন্যই একপাশে সরে দাড়ালো মিসেস কপিনস্। এবং খুশী ভরা গলায় বললো—এই দেখো গো ফাদার এসেছেন। এবার তুমি ভালো হয়ে যাবে। তারপর মিসেস কপিস চলে গেলো। ফাদার গোরম্যান ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। ভিক্টোরিয়া যুগের আসবাবপত্রে সাজানো গোছানো ঘরখানা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জানলার কাছে বিছানায় এক রমণী শুয়ে ধীরে ধীরে মাথা ঘোরালো। ফাদার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন যে রমণীটি অসুস্থ।
আপনি এসেছেন…সময় আর বেশি নেই। শ্বাস টানতে টানতে আওড়ালো রমণী। .নষ্টামি…এমনি ধরনের নষ্টামি…আমি অবশ্যই…অবশ্যই…এমনিভাবে মরতে পারি না।…স্বীকার করবো…সব স্বীকার করে যাবো…আমার পাপ…লোভ…লোভ…। বিহ্বল দুটি চোখের দৃষ্টি ঘুরছে…আধবোজা, এলোমেলো একঘেয়ে শব্দগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। ফাদার গোরম্যান বিছানার কাছে এগিয়ে এলেন। যে কথা প্রায়ই তাঁকে বলে থাকেন…প্রায়ই বলেন ঠিক সেই কথাগুলো এখন বলতে লাগলেন। নিশ্চয়তা দানকারী প্রভুত্বধর্মী শব্দগুলো…তাঁর আহ্বান এবং তাঁর বিশ্বাসধর্মী শব্দগুলো। ঘরের মধ্যে নেমে এলো শান্তি, ক্লিষ্ট দু’চোখের থেকে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি গেলো মিলিয়ে…। তারপর ফাদার তাঁকে অভয় দান শেষ করলেন। মরণাপন্ন রমণী আবার বললো…থামাও…থামাতেই হবে… আপনি থামুন।
নিশ্চয়তা দানকারী প্রভুত্বধর্মী কথাগুলোই বললেন – যা প্রয়োজন তা আমি করবই। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো… একটু পরে চিকিৎসক এবং এ্যাম্বুলেন্স একসাথেই হাজির হলো। বিষণ্ণ বিজয়ীর মতন মিসেস কপিনস্ তাদের সম্ভাষণ করে জানালো : …স্বভাব মতনই বড় দেরি হলো আসতে। রোগিণী মারা গেছে…।
****
গোধূলির আলো ছড়ানো চারধারে। ফাদার গোরম্যান ফিরছেন গীর্জায়। জমাট বাঁধছে হাওয়ায় ভাসমান জলকণা—আজকের রাত কুয়াশায় ঢাকা পড়বে। মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে ফাদার ভুরু কোঁচকালেন। এমন একটা আজগুবি অস্বাভাবিক কাহিনী…এর কতখানি যে প্রলাপ আর জ্বরের ঘোরে সৃষ্টি হয়েছে? অবশ্য এর কিছু কিছু সত্যি কিন্তু কতটা? যা হোক মনের পটে যতক্ষণ লেখা জ্বলজ্বল করছে তারই মধ্যে এর কিছু কিছু নাম লিখে রাখা খুবই জরুরি প্রয়োজন। হঠাৎ তিনি এক কফি হাউসে ঢুকে পড়ে এক পেয়ালা কফি আনতে বললেন। বসলেন, আলখাল্লা জামার পকেটে খুচরো পয়সা খুঁজলেন। আহা মিসেস জেরহাটি কতবার তাকে সেলাইয়ের ছেঁড়া ধারগুলো সারাতে বলেছেন। কিন্তু সে সেলাই করেনি এটা তার স্বভাব। ফলে তার নোটবুক পেন্সিল আর খুচরো পয়সাগুলো সেলাইয়ের খোপে ঢুকে গেছে। তিনি কোনোরকমে হাত ঢুকিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে কয়েকটা খুচরো পয়সা আর পেন্সিলটা বার করতে পারলেও নোটবুকটা রয়ে গেল। বার করতেই পারলেন না। কফির পেয়ালাটা টেবিলে দিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এক টুকরো কাগজ দিতে পারবে কিনা। এতে কি হবে। একটা ছেঁড়া কাগজের ঠোঙা। ফাদার গোরম্যান কাগজের টুকরো হাত বাড়িয়ে নিলেন। নামগুলো লিখতে শুরু করলেন। ভুলে যাওয়া আগের নামগুলো লেখা জরুরি প্রয়োজন। কারণ নাম এমন ধরনের বস্তু যে তিনি তা ভুলে যান। সহসা কাফের দরজা খুলে গেল। এডওয়ার্ডের সময়কার প্রচলিত পোশাক পরা তিন যুবক ভিতরে ঢুকলো এবং বেশ সাড়াশব্দ জাগিয়ে চেয়ারে বসলো। ফাদার গোরম্যানের নাম টুকে রাখার কাজ শেষ হতেই কাগজের টুকরোটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে গিয়ে হাত বার করে নিলেন। মনে পড়লো পকেটটা ছেঁড়া। কাজেই তিনি প্রায়ই যা করে থাকেন তাই এখনও করলেন- ভাঁজ করা কাগজের টুকরোটা নিচু হয়ে জুতোর মধ্যে রাখলেন গুঁজে। আর একজন লোক কফি হাউসের মধ্যে ঢুকলেন। এবং এক কোণে চেয়ারে বসলেন। কফিটা বাজে। তবু ভদ্রতার খাতিরে ফাদার পেয়ালার কফিটায় চুমুক দিলেন। বিল চাইলেন। এবং কফির দাম মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হঠাৎ আসা লোকটার মন বদলালো। হাতঘড়িটা পরীক্ষা করলো—যদিও ঠিক সময় দেখতে সে ভুল করে বসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে এলো। কুয়াশা এখন ঘন হয়ে তড়িৎগতিতে নেমে আসছে। দ্রুত পদক্ষেপে হাঁটছেন ফাদার গোরম্যান। তাঁর এই অঞ্চলটা ভালোভাবেই জানা। রাস্তা সংক্ষেপ করার জন্য তাই তিনি বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট গলিপথ ধরে হাঁটছেন। রেললাইন বরাবর টানাগলিপথ সে সম্বন্ধে তিনি সচেতন, – কিন্তু পায়ের আওয়াজ সম্বন্ধে তিনি মাথা ঘামালেন না। আর মাথা ঘামাবেন কেন? পিছন থেকে আঘাত পড়লো সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায়। তিনি সামনে ছিটকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন…।
****
ডাক্তার করিগ্যান শিস্ দিতে দিতে আঞ্চলিক গোয়েন্দা দপ্তরের ইনসপেক্টরের ঘরে ঢুকলেন এবং বেশ রসিকতার সঙ্গে আঞ্চলিক গোয়েন্দা ইনসপেক্টর লেজুনকে সম্ভাষণ জানালেন।
বললেন—তোমার হয়ে তোমার পাদরীকে শেষ করে এলাম।
—ফলাফল কি?
—করোনারের প্রায়োগিক শব্দগুলো ব্যবহার করার কষ্টটুকু বাঁচিয়ে দিয়েছি। সত্যই একদম থেঁতলে গেছে। যাই ঘটুক এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, প্রথম আঘাতেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছে, বড় জঘন্য কাণ্ড।
—তা ঠিক, বললেন ইনসপেক্টর।
শক্ত সমর্থ দেহ, একমাথা কালো চুল এবং চোখ দুটি কটা। উপর উপর তাঁকে খুব শান্ত সিষ্ট মনে হলেও মাঝে মাঝে তিনি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। পূর্বপুরুষদের রক্তধারা যেন তার দেহে বিশ্বাসঘাতকতা করে। চিন্তিতভাবে ইনসপেক্টর বললেন—ডাকাতি করার প্রয়োজনের চেয়েও কি জঘন্য কাজ করা হয়নি?
ডাক্তার শুধালেন—এটা কি ডাকাতি?
—লোকে তাই মনে করছে। তাঁর পোষাকের পকেটগুলো উল্টে হাতড়ানো হয়েছে, আর পাদরীর আলখাল্লাটার সেলাই কেটে তল্লাসি চালিয়েছে।
—তারা বেশি কিছু পাবে বলে আশা করেনি। গীর্জার এই সব ফাদাররা ইঁদুরের চেয়েও হাঘরে।
—তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই পাদরীর মাথাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, আওড়ালেন গোয়েন্দা ইনসপেক্টর লেজুন—কিন্তু লোক জানতে চাইছে কেন তারা এ কাজ করলো।
—এর দুটো সম্ভাব্য কারণ আছে, বললেন ডাক্তার করিগ্যান—প্রথম কোনো হিংস্র মনের যুবা ঠগী এ কাজ করেছে। তারা ভয়ঙ্করতার জন্য ভয়ঙ্কর কাজ করে বেড়ায়। দুঃখের কথা এ ধরনের ছোকরা আজকাল অজস্র ঘুরছে।
—আর অন্য জবাবটা কি?
ডাক্তার বারেক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন—কেউ তোমাদের গোরম্যানকে খুন করার জন্যই এ কাজ করেছে। এ জবাবটাই কি সম্ভাব্য?
লেজুন মাথা নাড়লেন—একেবারেই অসম্ভব। লোকজনের কাছে তিনি দারুণ জনপ্রিয়, এ অঞ্চলের সবাই তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর শত্রু আছে এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি। আর ডাকাতিও একেবারে অসম্ভব ঘটনা। যদি না…।
—যদি না কি? শুধালেন ডাক্তার-পুলিশ সূত্র পেয়েছে! আমি ঠিক বলছি, তাই না?
—তাঁর কাছে একটা জিনিস ছিলো, আর সেটা নিয়ে যেতে পারেনি ওরা। আসলে ওটা ছিলো তাঁর জুতোর মধ্যে ঢোকানো।
ডাক্তার করিগ্যান শিস দিয়ে উঠে বললেন—একটা গোয়েন্দা কাহিনীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যেন।
লেজুন হেসে বলতে লাগলেন—তার চেয়ে সোজা। ফাদারের পকেটটা ফুটো। সার্জেন্ট পাইন ফাদারের বাড়ির ঝিয়ের সাথে কথা বলেছে। মনে হচ্ছে, ঝিটা অগোছালো স্বভাবের। তাই ফাদারের পোশাক-আশাক সাফাই করে গুছিয়ে রাখে না, অথচ এটা তার করার কথা। ঝি তা মেনেও নিয়েছে। কাগজের টুকরো বা চিঠি যাতে ফুটো দিয়ে আলখাল্লার সেলাইয়ে ঢুকে না যায় তাই ফাদার ওগুলো জুতোর ফাঁকে গুঁজে রাখতেন।
—এবং খুনী তা জানতো না, তাই তো?
খুনী তো ভাবতেই পারেনি। মনে হয়, সামান্য কিছু কৃপণের ধন নয়। সে হাতড়াতে চাইছিলো এই চিরকুটখানা। চিরকুটে কি লেখা আছে। লেজুন ড্রয়ার খুলে একখানা দোমড়ানো কাজের টুকরো বার করলেন।
কয়েকটা নামের একটা তালিকা। বললেন গোয়েন্দা ইনসপেক্টর।
ডাক্তার করিগ্যান কৌতূহলী দৃষ্টিতে চিরকুটখানা দেখলেন। ওরসিরদ— স্যাণ্ডফোর্ড- পারকনিস—হেসকেথ কিউবয়—শা ইরিমণ্ডস ওয়ার্থ—টাকারটন—করিগ্যান। দেলা ফন্টেন? তালিকাটা দেখার পর ডাক্তারের চোখ কপালে উঠলো। বললেন—দেখছি, আমারও নাম রয়েছে চিরকুটে।
এর কোনো নামের লোককে কি চেনেন, জানেন? ইনসপেক্টর শুধোলেন। কাউকে চেনা মনে হচ্ছে না। এবং ফাদার গোরম্যানের সাথেও কখনও দেখা হয়নি? কক্ষনো না। তাহলে দেখছি আপনি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।
—আচ্ছা, এই তালিকা দেখে কোনো ধারণা কি গোয়েন্দাদের মাথায় এসেছে। ডাক্তার শুধালেন। লেজুন সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুধু বললেন—সন্ধ্যে সাতটার সময় একটা ছোকরা ফাদার গোরম্যানকে ডাকতে এসেছিল। এক মরণাপন্না বৃদ্ধা ফাদারকে না কি ডাকছে। ছোকরার সাথেই ফাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
কোথায়? যদি আপনার জানা থাকে।
আমরা জানি। এটা জানতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগেনি। তেইশ নম্বর বেন্থাল স্ট্রিটে যান। কপিন্স নামে এক মহিলার বাড়ি, রোগিণী মিসেস ডেভিস। পাদরী ওখানে হাজির হল সাড়ে সাতটার সময় এবং রোগীর সঙ্গে আধঘণ্টা থাকেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছবার ঠিক আগের মুহূর্তেই রোগিণীর মৃত্যু ঘটে।
বুঝেছি।
—বাড়ির খুবই কাছে টনির কফিখানায় এরপর ফাদার ঢোকেন। খুবই ভদ্র কফিখানা, এর সঙ্গে অপরাধের কোনো রকম সংশ্রব নেই। সামান্য খাবার খরিদ্দারদের দিতে সক্ষম টনি—কারণ খুব বেশি খরিদ্দার তার কফিখানায় ঢোকে না। ফাদার এক পেয়ালা কফি চাইলেন। তারপর নিজের পকেট হাতড়ালেন। কিন্তু যা খুঁজছিলেন পেলেন না। এবং কফিখানার মালিক টনির কাছে এক টুকরো কাগজ চাইলেন ফাদার, নিজের হাতের টুকরোটা দেখিয়ে ইনসপেক্টর বললেন-এই সেই টুকরোটা।—এবং তারপর?
টনি কফির পেয়ালা এনে দেখলো ফাদার চিরকুটে কি লিখেছে। একটু পরেই বাস্তবে কফির পেয়ালায় চুমুক (অবশ্য এর জন্য আমি তাঁকে দোষ দিচ্ছি না) না দিয়ে চিরকুট লেখা শেষ করে এবং চিরকুটখানা জুতোর মধ্যে গুঁজে ফাদার বেরিয়ে যান।
সেখানে আর কেউ কি তখনো ছিলো?
—টেডি ছোকরাদের ধরনের তিনটে ছোকরা কফিখানায় ঢুকে একখানা টেবিলে বসে। তারপর আসে একজন বয়স্ক লোক। বসে একটা টেবিলে। কিন্তু কোনো কিছু দিতে না বলে বয়স্ক লোকটা উঠে কফিখানা থেকে বেরিয়ে যায়।
লোকটি কি ফাদারের পিছু নিয়েছিলো?
পিছু নিতে পারে। লোকটা যে কখন বেরিয়ে চলে যায় টনি তা দেখেনি এমন কি সে দেখেনি যে সে কিরকম দেখতে। তবে এটুকু বলেছে যে সে একদম সাধারণ লোক। আরো পাঁচজন লোকের মতন। সাদামাটা ধরনের দেহের উচ্চতা মাঝারি। মনে পড়তে বললো, লোকটা একটা গাঢ় নীল রংয়ের ওভারকোটে দেহ ঢেকে রেখেছিল। তবে ওভারকোটটা দেখতে বাদামী হতে পারে। লোকটার গায়ের রঙ কালোও নয় ফরসাও নয়। এ ব্যাপারটার সাথে যে তার কোনো যোগ আছে সে তা নজরও করছে না। আর তা কেউ জানেও না। তাছাড়া লোকটি আমাদের কাছে এসে বলেওনি যে সে টনির কফিখানায় পাদরীকে দেখেছিলো। অবশ্য তার এসে বলবার সময় এখনও পার হয়ে যায়নি। আমরা ঘোষণা করেছি যারা রাত পৌনে আটটা থেকে সওয়া আটটার মধ্যে পাদরী গোরম্যানকে দেখেছিলো তারা যেন আমাদের কাছে এসে খবর দিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত মাত্র দুজন আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে—একজন মহিলা এবং আর একজন কাছের এক ওষুধের দোকানের কেমিস্ট। একটু পরেই আমি নিজে ওদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করবো। রাত সওয়া আটটার সময় ওয়েস্ট স্ট্রিটে দুটি ছোকরা ফাদারের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছিল। জানেন তো সে কথা। বাস্তবে ওটা একটা সুঁড়ি পথ—রেল লাইন এক ধারে। পরের ঘটনা তো সবই আপনার জানা।
চিরকুটের ওপর টোকা দিয়ে মাথা নাড়লেন ডাক্তার করিগ্যান। শুধালেন এ সম্বন্ধে কি ভাবছো?
মনে হয় এই চিরকুটখানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বললেন লেজুন।
মরণাপন্না রমণী নিশ্চয় তার কাছে কিছু বলেছিলো এবং ভুলে যাওয়ার আগে যেমনি সুযোগ এসেছে অমনি কাগজের উপর নামগুলো পাদরী লিখে রেখেছেন। তবে সিল করা খামে ভরা স্বীকৃতি পত্র দিলে পাদরী এ কাজ করতেন কিনা সেটাই জানার বিষয়। তাই না?
এটা সিল করা খামে গোপনে দেওয়ার প্রয়োজনই হয়ত ছিলো না, বললেন গোয়েন্দা ইনসপেক্টর লেজুন—ধরুন, একটা দৃষ্টান্ত দিই, এই এই নামগুলোর সঙ্গে ব্ল্যাকমেল করবার ষড়যন্ত্র জড়িয়ে থাকতে পারে।…
—ঐটা তোমার ধারণা, তাই না ইনসপেক্টর?
আমার মনে এখনও কোনো ধারণা গড়ে ওঠেনি। এটা স্রেফ শুরু করার আগে। একটা অনুমান। এই লোকগুলোকে ঠকানো হচ্ছিলো, ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা চলছিলো। ওই মরণাপন্না রমণী হয় নিজে ব্ল্যাকমেলার ছিলো আর না হয় তাকেই ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছিলো। আমি বলবো সাধারণ ধারণাটাই হচ্ছে অনুশোচনা, স্বীকৃতি দান এবং যতদূর সম্ভব ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ।
ফাদার গোরম্যান এই দায়িত্ব গ্রহণ করছিলেন। এবং তারপর?
প্রত্যেকটি ঘটনার কারণ এখন অনুমান নির্ভর। বললেন ইনসপেক্টর লেজুন—এটাকে অর্থ রোজগারের একটা ফাঁদ বলা যায়। এবং কেউ এই অর্থ প্রদানের ব্যবস্থাটাকে বন্ধ করতে চায়নি। কেউ একজন জানতে পেরেছিল, মিসেস ডেভিস মরণাপন্না এবং তিনি গীর্জার ফাদারকে ডেকে পাঠাবেন। এরপর সব কিছু পরপর ঘটেছে।
চিরকুটখানা পরখ করতে করতে করিগ্যান বললেন—অবাক হয়ে ভাবছি। আচ্ছা শেষ দুটো নামের শেষে যে জিজ্ঞাসা চিহ্ন বসানো হয়েছে তার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?
এমন হতে পারে যে শেষ নাম তাঁর সঠিকভাবে মনে আছে সে ব্যাপারে ফাদার গোরম্যান সুনিশ্চিত ছিলেন না।
এটা হয়ত করিগ্যানের বদলে হবে সুল্লিগ্যান। একটু হেসে সায় দিয়ে বললেন ডাক্তার, এটা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই দেলা ফন্টেন নামটা—আমার আর তোমার কাছে মানে…বুঝতে পারছো তো কি বলছি। এটা একটা আজব ব্যাপার কারণ এর একটারও নামের সঙ্গে ঠিকানা দেওয়া নেই…..। ডাক্তার আবার নামগুলো পড়লেন।
—পারকিস…অজস্র পারকিন্স আছে। স্যাণ্ডফোর্ড নামটা অসাধারণ নয়। আবার এই হেসকথ ডিউবয় একেবারে গাল ভরা নাম। এ ধরনের নাম অনেক থাকতে পারে না। বলতে বলতে আকস্মিক আবেগে ঝুঁকে বসে টেবিল থেকে টেলিফোন ডাইরেকটারিটা টেনে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে ডাক্তার আবার বলতে লাগলেন। ইংরাজী ই থেকে এল পর্যন্ত সব নামগুলো একবার খুঁজে দেখা যাক। হেসকথ… মিসেস-এ… জন এ্যাণ্ড কোম্পানি…প্লাম্বারস…স্যার ইমিডোর। আহা। এই যে পেয়েছি। হেসকথ ডিউবয়, লেডি ঊনপঞ্চাশ, একে সেমিয়ার স্কোয়ার, এম. ডাব্লু ওয়ান। ওকে ফোন করে এখন কি বলা হবে।
—কি বলবেন?
উৎসাহ পাওয়া যাবে, ডাক্তার করিগ্যানকে খুশিভরা গলায় বললেন।
—বেশ, কথা বলুন। বললেন লেজুন।
—কি বলবো? করিগ্যান তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
লেজুন খুশি হয়ে বললেন- বললুম ত কথা বলুন। এমন চমকে মারেন না। তারপর নিজেই ফোনের রিসিভারটা হাতে নিয়ে ডাক্তার করিগ্যান শুধালেন—কত নম্বর?
—গ্রসভেনর ৬৪৫৭৮।
লেজুন নম্বরটা আওড়ালেন। তারপর রিসিভারটা ডাক্তারের হাতে দিয়ে বললেন— নিন, এবার কথা বলুন।
—এটা কি লেডি হেসকথ ডিউবয়ের বাড়ি।
—আচ্ছা, আচ্ছা, হাঁ…বলছি…।
এসব ছুটকো কথায় কান না দিয়ে ডাক্তার বললেন-আমি কি তার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারি?
—না কথা বলতে পারেন না। লেডিজ হেসকথ ডিউবয় গত এপ্রিল মাসে মারা গেছেন।
—ওহো! চমকে উঠলেন ডাক্তার করিগ্যান। তারপর ‘কে কথা বলছেন’ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রিসিভার রেখে দিলেন।
ইনসপেক্টর লেজুনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—ও। তাহলে এ জন্যই তুমি আমাকে ফোনে কথা বলতে দিতে তৈরি ছিলে? লেজুনের মুখে বিদ্বেষপূর্ণ হাসির ঝিলিক। বললেন—বাস্তবকে তো আমরা সত্যি সত্যি অবহেলা করতে পারি না।
চিন্তিত মুখে বললেন তখন ডাক্তার—গত এপ্রিল, তার মানে পাঁচ মাস আগে। ঠিক পাঁচ মাস আগে যখন ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের বা এই ধরনের একটা কাজ বন্ধ হওয়ায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তখন আচ্ছা, মহিলা আত্মহত্যা বা ওইরকম আর কিছু করেনি তো।
—না। মহিলার মস্তিষ্কে টিউমার হয়েছিল। নামের তালিকাটার ওপর আর একবার নজর বুলিয়ে নিতে নিতে বললেন ডাক্তার—তাহলে আবার আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে। লেজুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তালিকাটা দেখিয়ে বললেন—এই তালিকাটা থেকে আমরা কোনো ফায়দা তুলতে পারবো কি না তা বুঝতে পারছি না। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে বসে সময় কাটাবার জন্য হয়ত তালিকাটা বানানো হয়েছে। না হলে এ তালিকাটা থেকে আমরা ফায়দা তুলতে পারতাম।
—এখনও এই তালিকাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে তুমি কি কিছু মনে করবে, ইনসপেক্টর? একেবারেই না। কাজ করুন। আপনার সাফল্য কামনা করছি।
—তার মানে চাইছো আমি যাতে সফল না হই। এত নিশ্চিত হয়ো না। আমি এই করিগ্যান নামটা নিয়েই প্রথম নাড়াচাড়া করবো ভাবছি। তা সে লোক মিস্টার বা মিসেস কিংবা মিস হোক-আর এই নামটার শেষেই তো বসানো হয়েছে এক বিশাল জিজ্ঞাসার চিহ্ন।