ঊনবিংশ অধ্যায়
ভেনবলসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। আনমনা হয়ে গাড়ির পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজন লোকের সাথে ধাক্কা লাগলো। দুঃখিত হয়ে লোকটির কাছে ক্ষমা চেয়ে বললাম–এর আগে এখানে কোনোদিন আসিনি। একটা টর্চও আনতে ভুলে গেছি।
লোকটি নিজে টর্চটি জ্বালিয়ে বললো—আমিও এই প্রথম এখানে এসেছি। আপনি আমার টর্চটা নিয়ে যান।
আলোয় নজরে পড়লো, লোকটি মাঝ বয়সী। গোল মুখ কালো চোখ আর চোখে চশমা পরণে কালো দামী আর ভালো জাতের একটা বর্ষাতি। এক নজরে মনে হলো লোকটি অভিজাত বংশীয়। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম। পকেটে টর্চ থাকতেও লোকটি কেন অন্ধকারে হাঁটছিলো!
শুধালাম—আপনি কি বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। না, না। আমিও আপনার মতন বাইরে যাচ্ছি। আমি বাস স্টপ পর্যন্ত যাবো। সেখান থেকে বোর্নমাউথগামী বাস ধরবো। আর আপনি কোথায় যাবেন।
—এই পাশের একটা গ্রামে থাকি। সেখানেই যাবো বলে বেরিয়েছি।
আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম।
—আপনি কি মিস্টার ভেনবলসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন? লোকটি জানতে চাইলো, জবাবে বললাম—হাঁ। তা আপনিও কি ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?
—না। আসলে বোর্নমাউথে কিংবা ওরই কাছাকাছি একটা গ্রামে একখানা বাংলো কিনেছি। আর সেই বাংলোতে সম্প্রতি এসে উঠেছি।
আমার মন চমকে উঠলো। বোর্নমাউথ আর সেখানকার একটা বাংলো বাড়ি—কথাগুলো তো এর আগেই আমার কানে এসেছে। কিন্তু কার কাছে শুনেছি? আমি যখন মনে করতে চেষ্টা করছি তখনই লোকটি মনের দ্বিধা ভাব ঘুচিয়ে বললো- আপনি নিশ্চয় ভাবছেন, আমি একটা আজব লোক। কেননা লোকটা বাড়িটা চেনে না অথচ বাড়িটির নিচে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমি নিজের কথা ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছি না। তবে আমি ভদ্রলোক। বোর্নমাউথে নতুন এলেও ওখানে আমি সুপরিচিত। আমি একজন ঔষধ প্রস্তুতকারী। লন্ডন শহরে ব্যবসা করতাম। এখন ব্যবসা থেকে অবসর নিয়ে এখানে বসবাস করার জন্য বাংলো কিনেছি। বাসও করছি। আমার নাম জ্যাকেরিয়া অসবর্ণ। লন্ডন শহরের বার্টন স্ট্রীট-এর প্যাডিংটন গ্রীনে আমার খুবই চালু ব্যবসা ছিলো। আমরা বাবার আমল থেকেই ওই ব্যবসা ওখানে চলছিলো। পাড়া পড়শীরা খুবই ভালো। তবে এখানে দিন বদলে গেছে। আচ্ছা এটা কি মিস্টার ভেনবলসের বাড়ি? মনে হয়, তিনি আপনার বন্ধু, তাই না?
ইচ্ছে করেই বললাম — ঠিক বন্ধু – বলা যায় না।
এর আগে মাত্র একবার আমার সঙ্গে মিস্টার ভেনবলসের দেখা হয়েছিলো।
রাজপথের ধারে একটা পরিচ্ছন্ন কফি ঘর। প্রায় ফাঁকা। শুধু এক যুগল বসে আছে এক কোণে, কফি দেওয়ার হুকুম দিয়ে মিস্টার অসবর্ণ বসলো। আমি তার মুখোমুখি।
একটু ঝুঁকে মিস্টার অসবর্ণ বলতে লাগলো—ঘটনাটার খবর কাগজে বেরিয়েছিলো। তবে খুব চাঞ্চল্যকর খবর নয়। ক্যাথলিক গির্জার এক পাদরি লন্ডন শহরে আমি যে পাড়ায় থাকি সেখানে এক রাতে খুন হয়েছিলো। আজকাল প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কাগজে দেখলাম পুলিশ দপ্তর ঘাষণা করেছে যে, সে রাতে নিহত ফাদার গোরম্যানকে যারা দেখেছে তাদের পুলিশ জেরা করতে চায়। সেদিন আমার দোকানের দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম। পিছন থেকে একটি-লোক ফাদার গোরম্যানকে অনুসরণ করছিলো। তার অস্বাভাবিক চেহারা আমার দৃষ্টি আর মন আকর্ষণ করেছিলো। লোককে খুঁটিয়ে দেখা এবং তাকে বহুদিন মনে রাখা আমার একটা শখ। বাতিকও বলতে পারেন। এবার আমার কাহিনীর সবচেয়ে অবাক করা অংশ বলছি। দিন দশেক আগে আমি এক ছোট্ট গ্রামের গির্জার উৎসবে গিয়েছিলাম। ওখানে সেই লোকটাকে একখানা চাকা লাগানো চেয়ারে বসে ঘুরছে দেখলাম। মনে হচ্ছে লোকটা কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছে। লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ওই পঙ্গু লোকটার নাম ভেনবলস। দু-তিন দিন পরে পুলিশকে চিঠি লিখে সব কথা জানালাম। তার কিছুদিন পরে ইনসপেক্টর লেজুন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে জানালেন যে, আমার লোক চিনতে ভুল হয়েছে। কেননা ভেনবস্ পোলিও রোগে পঙ্গু। হাঁটতে পারে না। সে যে পঙ্গু বড় বড় চিকিৎসকরা তা স্বীকার করেছেন। তাই ইনসপেক্টর বলে গেছেন যে, সামান্য দৈহিক অক্ষম, লোক চিনতে পারিনি।
—তাহলে যে ব্যাপারটা মিটেই গেছে বললাম।
—আমি জেদী লোক, মিস্টার ইস্টারব্রুক। দিন যত পার হচ্ছে আমি তত নিশ্চিত হচ্ছি যে, সে দিন রাতে আমি ভেনবলসকে দেখেছিলাম। দূর থেকে দেখলেও লোকটার চোখ নাক আর কণ্ঠমণি আমার নজর এড়ায়নি। এমন কি, ওর ঘাড়ের কৌণিক অবস্থানও আমার নজরে পড়েছিলো। তাই ওকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি। পুলিশ বলছে এটা অসম্ভব।
—কিন্তু অমন পঙ্গু হলে তো…।
উত্তেজিত ভাবে হাত নাড়িয়ে অসবর্ণ আমাকে থামিয়ে বলতে লাগলো –এটা একটা নিখুঁত পীড়ার ভান। একজন আসল পঙ্গুকে মিস্টার ভেনবলস সাজিয়ে ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়। কাজেই ডাক্তারের কাজে কোনো দোষ নেই। নাম ভাঁড়িয়ে মিস্টার ভেনবলস এটা করেছে। এখন এই গ্রামে যখন ঘোরাঘুরি করে তখন চাকা লাগানো চেয়ারে বসে ঘোরে।
—তাহলে ওর খানসামা তো সব জানে। বাধা দিলাম।
—কিন্তু খানসামা ওর দলের লোক। সে তাই সত্যি কথা বলবে না। মনে হয় অন্য চাকর বাকরও একই দলের।
বাস এসে থামলো। অসবর্ণ ছুটে গিয়ে বাসে উঠলো।
আমি ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম। মিস্টার অসবর্ণ এক আজব, চমকদার তথ্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাকেই স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, এর মধ্যে কিছু সত্য রয়েছে।