৫
ইতিমধ্যে রেক্স টেলিফোন সেরে ফিরে এলেন। খুশির সঙ্গে বললেন, আমাদের ভাগ্য ভালো। ক্যাস্টেলনাওকে আমাদের চেসাপীক ব্যাঙ্কিং অ্যান্ড ট্রাস্ট কর্পোরেশনের নাম বললাম, ব্যাঙ্ক সম্পর্কীয় বিশেষ কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, এবং যেহেতু কথাটা গোপনীয় তাই তাঁর অফিসে না গিয়ে আজ রাত্রে তাঁর ওখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করতে চাই; বড় অঙ্কের টাকা এর সঙ্গে জড়িত অছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লুব্ধ হলেন এবং রাত দশটা নাগাদ তাঁর ওখানে দেখা করতে বললেন।
ডিউক বললেন, বেশ, এবার শুনি তুমি কী মতলব করেছ?’
রেক্স বললেন, বলতে গেলে কোনো মতলবই আমি করিনি। মোট কথা, আচমকা ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ব, দু-একটা কথার পরেই বলব যদি মোকাটা সম্বন্ধে যা কিছু জানেন তা না বলেন তো চোখ উপড়ে নেব। ডিউক বললেন, ঠিকই মতলব করেছ। কিন্তু নিশ্চয় তার ভৃত্যেরা আছে, তারা যাতে বাধা দিতে না পারে সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
রিচার্ড বললেন, আমরাও যদি সঙ্গে যাই তো কি কোনো আপত্তি আছে? আমরা তিনজনেই যদি যাই তাহলে নিশ্চয় অনেকটাই বেশি জোর পাবে। রেক্স বললেন, বেশ তো, আপত্তি কিসের? মেরী হোটেলেই থাকবে।
প্রচণ্ডভাবে আপত্তি জানিয়ে মেরী বলে উঠলেন, উঁহুঁ কিছুতেই না, আমিও সঙ্গে থাকব। নিজেকে আমি ঠিক সামলাতে পারব, এবং সেরকম অবস্থা হলে ঠিকই সরে যাব। তোমরা ফ্লাওয়ারের খোঁজ করবে, আর আমি কিনা তখন হোটেলে বসে থাকব?
রিচার্ড এবং ডিউক দু-জনেই তাঁকে সমর্থন করলেন। ডিউক সেইসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন রিচার্ড আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে এনেছেন কি না, এবং ভৃত্যদের সম্বন্ধে কী ভেবেছেন জিজ্ঞাসা করলেন।
রিচার্ড বললেন, হ্যাঁ, প্যান্টের পিছনের পকেটে রেখে কাস্টমস থেকে বেরিয়ে এসেছি। গুলিভরা আছে।
ঠিক আছে। তার সাহায্যে চাকরদের সামলাবে, আমি আর রেক্স ক্যাস্টেলনাওকে সামলাব।
ঠিক সময়ে পৌঁছে তাঁরা ক্যাস্টেলনাও সম্বন্ধে খোঁজ করে জানলেন, ছ-তলায় বাহাত্তর নম্বরে আছে। তাঁদের নিয়ে লিফ্ট উঠে গেল।
রেক্স ভৃত্যকে বললেন, এঁরা আমার বন্ধু, একই কাজে মঁসিয়ে ক্যাস্টেলনাও-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আজ্ঞে আসুন এদিকে, তিনি আপনার জন্যে প্রতীক্ষা করছেন।
মেরী একটা কোচে বসলেন, অন্যেরা এগিয়ে গেলেন। দেখুন, আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় আছে, অতীতে বেশ কয়েকবার আপনাদের সঙ্গে কারবারও করেছি। এই বলে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টতে অন্যদের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এঁরাও কি এই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে যুক্ত?
হ্যাঁ ইনি ডিউক দ্য রিশলো, আর ইনি মিঃ রিচার্ড ঈটন। সকৌতূহলে ডিউকের মুখের দিকে তাকালেন তিনি। ধীরে ধীরে বললেন, প্রথমটা চিনতে পারিনি বলে ডিউক আমায় ক্ষমা করবেন, অনেকদিন পরে দেখা হল। কিন্তু আমার ধারণা ছিল প্যারিসের আবহাওয়া আপনার ঠিক অনুকূল ছিল না। যাই হোক সে-সব হারানো দিনের কথা না তোলাই সুবিবেচনার কাজ হবে।
ডিউক বললেন, ‘অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ এসেছি, সে জন্যে আমার উপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে তা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয়েছি।’
বসুন, বসুন আপনারা, ক্যাস্টেলনাও বললেন, বলুন আমাকে কী করতে হবে?
কিন্তু কেউই বসলেন না। কোনোরকম ভূমিকা না করে রেক্স বলে উঠলেন, টেলিফোনে যে কাজের কথা বলেছিলাম সেটা কিছু নয়, দেখা করার একটা অছিলা মাত্র। আমাদের আসার আসল কারণ, আমরা জানি আপনি মোকাটার সঙ্গে যুক্ত।
পরম বিস্ময়ে ফরাসীটি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ক্রোধে ফেটে পড়ার উপক্রম করতেই রেক্স তাড়াতাড়ি বাধা দিলেন। বললেন, অস্বীকার করে লাভ নেই, কারণ অনেক কিছুই আমরা জানি। পরশু রাতে আমরা আপনাকে চিলবেরির অনুষ্ঠানে দেখেছি, আপনি একজন শয়তানপন্থী। আপনাদের নেতা মোকাটা সম্বন্ধে যা কিছু জানেন সব আপনাকে বলতে হবে।
ক্যাস্টেলনাও-এর কালো চোখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, চোরা চোখে তিনি একটা ড্রয়ারের দিকে তাকালেন।
তা লক্ষ্য করে নড়বারও সময় না দিয়ে রিচার্ড ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন, যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। একটু নড়বার চেষ্টা করলেই কুকুরের মতো গুলি করব।
ডিউকও ফরাসীটির দৃষ্টি লক্ষ্য করেছিলেন, তিনি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি গিয়ে কয়েকটা ড্রয়ার খুলতেই পেয়ে গেলেন রিভলবারটা, দেখলেন সেটা গুলিভরা। সেটা শয়তানপন্থীর দিকে উদ্যত রেখে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, কী, ভালোয় ভালোয় সব বলবেন, না জোর করতে হবে?
শয়তানপন্থী বললেন, জোর করে কিছু বলাতে পারবেন না। তবে, ঠিক কী জানতে চান জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারি।
প্রথম প্রশ্ন, মোকাটার অতীত সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?
জানি খুব সামান্যই, তবু যা জানি তাতে বলব, যদি তাঁর বিরুদ্ধে লাগতে চান তো খুব ভুল করবেন।
রেক্স রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, ঠিক-ঠিক উত্তর দিন, –একটাও বাজে কথা নয়।
বেশ, তাই হোক। দামিয়ে লোকটি অল্পবয়সে লায়ন্সের কোনো গির্জায় পুরোহিতের কাজ করতেন। লোকটি তিনি কোনোদিনই সহজ ছিলেন না। এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্যে তাঁর উপরওয়ালা তাঁর ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করতেন। তারপর কোনো কেলেঙ্কারির জন্যে তাঁকে গির্জা ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তিনি প্রচুর ইন্দ্রিয়াতীত শক্তি জমা রাখেন। বছর কয়েক আগে আমার তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এবং তাঁর ব্যাপারে আমি উৎসাহ বোধ করি। আপনারা সে সব পছন্দ করেন বা না করেন তাতে কিছু যায় আসে না। এর সাহায্যে আমার ব্যবসায়ে প্রচুর সুবিধে হয়েছে। বছরের বেশ কিছু দিন তিনি প্যারিসে থাকেন, প্রায় সময়ই আমি তার সঙ্গে দেখা করি, তা ছাড়া ওইসব সভায় তো দেখা হয়ই। এই পর্যন্তই আমি তাঁর সম্বন্ধে বলতে পারি।
কবে আপনার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা হয়?
চিলবেরিতে দু রাত্রি আগে। মিটিং ভেঙে যাওয়ার পর যখন আমরা আবার একসঙ্গে হয়েছিলাম। আপনারাই নিশ্চয় সে জন্যে দায়ী, তাই না? একটু অদ্ভুত ভুতুড়ে হাসি শয়তানপন্থীর মুখে দেখা দিল। বললেন, জেনে রাখুন, এর মূল্য আপনাদের দিতে হবে।
আজ সন্ধেবেলা তাঁর সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়নি?
না, জানতামই না যে তিনি প্যারিসে এসেছেন। যেভাবে তিনি কথাটা বললেন তাতে তিনি যে সত্য বলছেন তাতে ওঁদের সন্দেহ রইল না।
প্যারিসে এসে তিনি কোথায় ওঠেন?
জানি না। বিভিন্ন জায়গায় আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। কয়েকমাস আগে তিনি যাঁদের সঙ্গে বাস করছিলেন তাঁরা আর্জেন্টিনায় চলে যান। তাই বলতে পারব না এখন তিনি কোথায়।
শয়তানপন্থীদের সমাবেশের আগে আপনি কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা করেন?
দুঃখিত। তা আমি বলব না। অত্যন্ত দৃঢ় গলায় তিনি বললেন।
শয়তানপন্থীর পাঁজরে ঠিক হৃৎপিণ্ডের তলায় পিস্তলটা লাগিয়ে ডিউক মিষ্টি গলায় বললেন, বলবেন বৈকি। খুব জরুরি কাজে আমরা এসেছি যে
দেখে মনে হল না শয়তানপন্থী ভয় পেয়েছেন। বললেন, বৃথাই ভয় দেখাচ্ছেন সে আমি বলতে পারব না, খুন করলেও না। এইসব সমাবেশে যাওয়ার আগে আমরা সবাই তন্দ্রার ঘোরে থাকি, আর তিনি আসার পরে জেগে উঠি। তাই সে সম্বন্ধে বলা সম্ভব নয়।
ডিউক বললেন ও। কিন্তু তাহলেও বলতেই হবে আপনাকে। আমিও সম্মোহন বিদ্যা অল্প কিছু জানি। এখন আপনাকে সম্মোহিত করে জেনে নেব অজ্ঞাতসারে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন।
এই প্রথম ওঁদের মনে হল শয়তানপন্থী ভীত হয়েছেন। বলে উঠলেন, কক্ষনো না, পারবেন না। আমি বাধা দেব।
বাধা পেলে অবশ্য একটু বেশি সময় লাগবে, কিন্তু তাতে আমাকে আটকাতে পারবেন না। ইতিমধ্যে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বাধা না পড়ে কাজে। ভৃত্যকে ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকে বলে দিন আমরা বেশ কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকব, কোনো মতেই যেন আমাদের বিরক্ত করা না হয়।
যদি রাজি না হই?
তাহলে আর একটাও কথা বলার সময় পাবেন না। আপনার মতন একটা ছোট ইঁদুরকে গুলি করে মারতে কোনো অসুবিধা হবে না, তাতে যাই হোক। বাজান ঘণ্টা।
মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করার পর তিনি ঘণ্টা বাজালেন। ডিউক তীক্ষ্ণকণ্ঠে ফিসফিস করে বললেন, রিচার্ড ভৃত্য এসে নির্দেশ নিয়ে যাবার পর তুমি এখান থেকে গিয়ে মেরীর সাথে আমাদের প্রতীক্ষায় থাকবে। তোমার বন্দুক আছে, লক্ষ্য রাখবে যেন কেউ বাইরে যেতে না পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের কথাবার্তা শেষ হচ্ছে। আর যদি মোকাটা আসে তো সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিনা দ্বিধায় গুলি করবে—সব আমার দায়িত্ব।
রিচার্ড বললেন, আমার শুধু সুযোগের অপেক্ষা। ঠিক সেই সময় ভৃত্যটি প্রবেশ করল, —ক্যাস্টেলনাও স্থির কণ্ঠে তাকে নির্দেশ দিলেন। তারপর রিচার্ড বেরিয়ে গেলেন।
তখন ডিউক রেক্সকে বললেন, – টেলিফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখ, যাতে আমাদের আলোচনায় কোনো বাধা না পড়ে। আর আপনি, ক্যাস্টেলনাও, বসুন চেয়ারে গিয়ে।
না, কিছুতেই না, এ অসহ্য! ডাকাতের মতো আপনারা আমার বাড়িতে চড়াও হয়েছেন, তা সত্ত্বেও যথাসম্ভব খবর আমি আপনাদের দিয়েছি। কিন্তু এখন আপনারা যা করতে যাচ্ছেন তাতে বিপদে পড়তে হবে আমাকে। রাজি হব না, কিছুতেই রাজি হব না আমি!
আপনার সঙ্গে তর্ক করব না, এবং আপনাকে হত্যাও করব না, কারণ আপনাকে দিয়ে কাজ করতে হবে। রেক্স এঁকে অজ্ঞান করে ফেল।
রেক্সের এক ঘুষিতে ক্যাস্টেলনাও মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
ক্যাস্টেলনাও-এর যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন তিনি সোজা হয়ে চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর দু-হাত পিছন দিকে বাঁধা আর দু-পায়ের গোড়ালিও একসঙ্গে বাঁধা, আর মাথায় ভীষণ ব্যথা। তিনি দেখলেন ডিউক তাঁর মুখোমুখি বসে, এক নির্মম হাসি তাঁর মুখে।
ডিউক বললেন, এবার আমার চোখের দিকে তাকান। যত তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ হবে ততই আগে গিয়ে আঘাতের শুশ্রূষা করতে পারবেন। আপনি বলবেন আপনি শয়তানপন্থীদের সমাবেশে যাওয়ার আগে কী কী করেন।
উত্তরে ক্যাস্টেলনাও শীঘ্রই চোখ বুজে ফেললেন তারপর মাথা বুকে নামিয়ে আনলেন যাতে ডিউকের চোখে তাকাতে না হয়।
ঘটনা খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না, এবং আমার ধারণা অনিচ্ছুক লোককে সম্মোহিত করা সম্ভব নয়। লাগাই আর এক ঘা, তাহলে হয়ত পথে আসবে। রেক্স বললেন।
তার আর দকার হবে না। অনিচ্ছুক ব্যক্তিকেও সম্মোহিত করা যায় বৈকি। পাগলদের তো প্রায়ই সম্মোহিত করা হয়। যাও ওঁর মাথাটা পিছনে টেনে ধরে চোখের পাতা এমনভাবে খুলে ধর যাতে কিছুতেই বুজোতে না পারেন। খবরটা আমাদের জানতেই হবে, মোকাটাকে পেতে হলে এ ছাড়া আর উপায় নেই।
রেক্স তাঁর দু-চোখের পাতা টেনে উপরে রাখলেন, আর ডিউক তাঁর চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ইস্পাত ধূসর চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শয়তানপন্থীর চোখে। এইভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু তবুও অনিচ্ছুক ব্যক্তিটিকে সম্মোহিত করা সম্ভব হল না। কতবার ডিউক বললেন, এবার আপনি ক্লান্ত, ঘুমোন এখন, কিন্তু তবুও তিনি তেমনি শক্ত হয়ে বসে রইলেন। এভাবেই কেটে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা, শয়তানপন্থী জানেন যে কোনো মুহূর্তে মোকাটা এসে পৌঁছতে পারেন, তখন আর শত্রুপক্ষের কিছুই করার থাকবে না। তাঁর দৃষ্টি ডিউকের থুতনিতে নিবদ্ধ।
বেজে গেল রাত দুটো তখনও শয়তানপন্থী কাবু হলেন না, বলে উঠলেন, দেব না—দেব—না আমাকে সম্মোহন করতে! রাত দুটোর একটু পরে ক্যাস্টেলনাও ফুঁপিয়ে উঠলেন। ডিউক বুঝলেন তিনি তাঁকে জয় করেছেন। এর মিনিট দশেক পরে আর রেক্সের চোখের পাতা টেনে রাখার প্রয়োজন হল না। সে চোখ নিষ্কম্প। তা বন্ধ করার শক্তি তাঁর নেই। তেমনি তাঁর চোখ ডিউকের চোখে স্থির নিবদ্ধ রইল।
নিচু গলায় ডিউক প্রশ্ন করে যা যা জানবার ছিল তা সব জেনে নিলেন। জানলেন শয়তানপন্থীদের সমাবেশ বসবে সীন নদীর তীরের নিকটবর্তী এক পরিত্যক্ত গুদাম ঘরে। কিভাবে সেখানে যেতে হবে এবং পৌঁছবার পর কেমন করে প্রবেশ করতে হবে তাও জেনে নিলেন।
ডিউক ঘড়ি দেখলেন, সওয়া তিনটে বাজে। ক্লান্ত স্বরে বললেন, যাই হোক অনেক সময় গেল আরও বেশি দেরি হত। এমনিই থাকুক ও, সকালের আগে ওই ঘুম ভাঙবে না। একটা কাজ কর, তোমার রুমালটা ওর মুখে গুঁজে দাও, তাড়াতাড়ি। তাহলে আর চিৎকার করতে পারবে না।
রেক্স বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। কিন্তু ধরুন যদি আমরা চলে যাওয়ার পর মোকাটা আসে? যে ঝুঁকি নিতে হবে আমাদের—চল, চল, তাড়াতাড়ি।
ভাগ্যের ভালো ফলের দরুণ সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন এবং অনেক বকসিসের লোভে সে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। পাহাড় পার হয়ে নদী অতিক্রম করে, শেষ পর্যন্ত প্যারিসের এক ঘিঞ্জি এলাকায় পৌঁছে তাঁরা ট্যাক্সিচালককে বিদায় দিলেন।
ডিউককে অনুসরণ করে তাঁরা একটা সরু গলি ধরে এগিয়ে চললেন। গলিটা যেমন স্বল্প আলোকিত তেমনি নোংরা আর দুর্গন্ধ। সেখান থেকে নদীর একটা ঘাটে পৌঁছলেন, তারপর বাঁয়ে বাঁক নিয়ে স্তূপীকৃত আবর্জনা অতিক্রম করে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তাঁদের থামতে হল। ডিউক বললেন, এই হল জায়গাটা। কিন্তু ক্যাস্টেলনাওয়ের নিকটে চাবি ছিল না, অগত্যা ভেঙেই ঢুকতে হবে। খুঁজে দেখ যদি সিঁদকাঠির মতো কিছু পেয়ে যাও
সেই আধো-অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা লিভার পাওয়া গেল, তা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। সেটা লাগিয়ে সকলে একত্রে আচমকা সর্বশরীর প্রয়োগ করতে তালা খুলে গেল। তখন কাঠের দরজা খুলে সবাই ভিতরে গেলেন।
ডিউক দেশলাই জ্বালালে দেখা গেল জায়গাটা খালি। দূর কোণে আরও একটা দরজা, সেটাও সেই লিভারের সাহায্যে ভাঙা হল—ক্যাস্টেলানও বলেছিল এর একটা গোপনীয় চাবি আছে।
দেশলাই নিবিয়ে দিয়ে ডিউক ক্যাস্টেলনাওয়ের ছোট পিস্তলটা বার করলেন। বললেন, রেক্স এস পিছনে পিছনে। রিচার্ড, তুমি তোমার বন্দুক নিয়ে পিছনটা সামলাও আর মেরী লাওকে দেখ। কোনো শব্দ করো না, হয়ত আমরা পেয়েও যেতে পারি মোকাটাকে।
একসার সিঁড়ি তিনি অনুমান করতে পারলেন, সিঁড়িটা নেমে গেছে। পায়ের শব্দ হল না, কারণ সিঁড়িতে বিছানো রয়েছে কার্পেট। সন্তর্পণে এগিয়ে চললেন সবাই। সিঁড়ি শেষ হলে একটা সুড়ঙ্গপথ, সেখান দিয়ে তাঁরা অগ্রসর হলেন। হঠাৎ বাধা পেলেন তাঁরা, ডিউক বুঝলেন সেটা একটা কাঠের পার্টিশন, এবং এও বুঝলেন যে সেটা ঠেললে সরে যায়। এবং সহজেই সেটা নিঃশব্দে সরানো গেল। সেখানে একটা বাতি উপর থেকে ঝুলছে।
পায়ের আঙুলে ভর করে, বন্দুক বাগিয়ে তাঁরা দেখলেন ঘরটা বিলাসবহুল আসবাবপত্রে সুসজ্জিত, শয়তানের উপযুক্ত ঘরই বটে। বেদীর উপর মেণ্ডিসের ছাগলের এক ভয়ঙ্কর মূর্তি আর দেয়ালে দেয়ালে বীভৎস বীভৎস ছবি। হাতলওলা চেয়ারগুলো দামি লাল ভেলভেটে মোড়া।
কোথাও কোনো শব্দ নেই, সুগন্ধি ধূপে বাতাস আমোদিত।
হঠাৎ পুরোহিতের পোশাক পরা এক মূর্তি দেখা দিল, উবুড় হয়ে পড়ে আছে।
একি, এ যে সাইমন।
সবাই দৌড়ে গেলেন সেখানে। রেক্স তার নিকটে হাঁটু পেতে বসলেন। তাঁকে চিৎ করে দেওয়া হল, পরীক্ষা করে দেখা গেল শ্বাস পড়ছে। তবে, বড় ধীরে ধীরে। পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বার করে ডিউক তাঁর নাসিকার কাছে ধরলেন। হঠাৎ শিউরে উঠলেন সাইমন, চোখ খুলে তাঁদের দিকে তাকালেন।
তাঁর শিথিল দু-হাত নিজের হাতে ধরে মেরী লাও বলে উঠলেন, সাইমন সাইমন! এই যে আমরা এসে গেছি।
কেঁপে উঠলেন সাইমন, উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কী, কী ব্যাপার?
রেক্স বললেন, কী আর ব্যাপার। মোকাটার নিকটে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে আমাদের সব মতলব ভেঙ্গে দিয়েছিলে। তুমিই বলবে ঘটনা কি।
অট্টহাসি হেসে সাইমন বললেন, তা, দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি আমাকে তাঁর প্লেনে করে প্যারিসে নিয়ে আসেন। কিন্তু তোমরা কেমন করে এখানে এলে?
সে পরে জানবে। ফ্লাওয়ারকে দেখেছ?
হ্যাঁ যে গাড়ি তিনি আমার জন্যে পাঠিয়েছিলেন তাতে ফ্লাওয়ার ছিল। তার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে তর্ক হল। তিনি শপথ করে বললেন আমি যদি তাঁর নির্দেশমত চলি তাহলে তিনি কথা রাখবেন।
মিথ্যে–মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছেন, এবং আমরা জানতামও আমাদের মিথ্যে আশ্বাস দেবেন। কেউ নেই এখানে, নিশ্চয় তিনি ফ্লাওয়ারকে নিয়ে চলে গেছেন।
জান কি তাঁর পক্ষে কোথায় যাওয়া স্বাভাবিক?
শেষ যখন ফ্লাওয়ারকে দেখি তখন সে ওই চেয়ারটায় অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। আর তার পরে আমি যা জানতে পারলাম তা হল, তোমরা এসেছ।
নিশ্চয় মোকাটা জানেন কবচটা কোথায় আছে? আচমকা ডিউক জিজ্ঞাসা করলেন। মাঝখান থেকে রিচার্ড বলে উঠলেন নিশ্চয়, সেটা পাওয়াই তো তাঁর উদ্দেশ্য। সে জন্যে মুহূর্তের জন্যেও সময় নষ্ট করবেন না।
তাহলে তো সাইমন জানবে সে জায়গাটা কোথায়।
ডিউকের মুখের দিকে তাকিয়ে রেক্স বললেন, কেমন করে জানবে অবচেতন মনে? এখন আমাদের একমাত্র আশা, সাইমনকে সম্মোহিত করে সব কিছু জেনে নেওয়া। সেইসঙ্গে জেনে নেওয়া কবচটা কোথায় লুকানো আছে, এবং আমি খুব জোর করেই বলতে পারি যে এই মুহূর্তে মোকাটাও সেদিকে চলেছেন।
তুমি রাজি, সাইমন?
নিশ্চয়! জানেনই তো যে আমি সব রকমেই সাহায্য করতে প্রস্তুত।
বেশ। তাঁকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরে ডিউক বললেন, এবার ঘুমোও সাইমন।
কাঁপতে কাঁপতে সাইমনের চোখ বন্ধ হয়ে গেল, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস দীর্ঘ আর স্বাভাবিক হয়ে এল।
ডিউক বললেন, তুমি মোকাটার সঙ্গে এখানে আছ। শনির উপাসনা এখনই আরম্ভ হবে। বল সেই সময় মোকাটা কী বলেছিল।
যে সব কথা সাইমন এর উত্তরে উচ্চারণ করলেন তা ঘুমের ঘোরে হলেও বেশ স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারিত হল, যদিও ডিউক ছাড়া আর কেউই তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারলেন না।
ডিউক বললেন, এগিয়ে যাও পনেরো মিনিট। তার পর থেকে বল।
সাইমনের কথা এবারও ওঁদের বোধগম্য হল না।
বেশ এগিয়ে যাও আরও পনেরো মিনিট। তৈরি হয়েছিল, কবচটা যেখানে, পোঁতা। আছে তার উপরে বেদীর ডাইনে যে পাথর, তার নিচে পাওয়া যাবে।
পেছিয়ে যাও এক মিনিট।
অ্যাটিলার মৃত্যুতে গ্রীকটি সেটা তুলে নিয়ে নিজেদের দেশে যায়। ইয়ানিনা শহরে পৌঁছলে শয়তানরা তাকে ঘিরে ধরে আর তাকে তাদের দলের হাতে সমর্পণ করে। তখন শহর থেকে কুড়ি মাইল পূর্বে মেটশোভা পাহাড়ের উপরে যে বিহার, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। যে সব শয়তান তার শরীর আশ্রয় করে ছিল তাদের দূর করতে না পেরে তারা তাকে মাটির নিচের একটা গহ্বরে বন্দী করে রাখে, এর সাত বছর পরে সব কয়েদখানা ভেঙে ফেলা হয়, এবং সেখানে একটা গুপ্ত কুঠি তৈরি হওয়ার পর একটা মন্দির গড়ে ওঠে, আর কবচটা সেখানেই লুকানো থাকে। ক্রমশই তার প্রভাব সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, এবং সকলের মধ্যেই লোভ আর শয়তানি সংক্রামিত হয় তারপর তুর্কিদের আক্রমণের আগেই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। বাঁদিকের ছোট গির্জাটা তৈরি হয়েছিল। কবচটা যেখানে পোঁতা হয়েছে তার উপরে।
বেশ, এবার জেগে ওঠ। এমন সময় পিছনে একটা ক্ষীণ আওয়াজ পেয়ে সবাই চমকে ফিরলেন সেদিকে। সেখানে ছায়ার মধ্যে চার মূর্তি দাঁড়িয়ে। যিনি সব থেকে লম্বা হঠাৎ এগিয়ে এলেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে রিচার্ড বন্দুক হাতে নিলেন। কিন্তু লোকটি বলে উঠলেন, থামুন। আপনি তার আগেই আমার বন্দুকের আওতার মধ্যে এসে গেছেন। দেখা গেল একটা অটোম্যাটিক বন্দুক তাঁর হাতে। এগিয়ে এল আরও দু-জন। আর চতুর্থ জন হচ্ছে ক্যাস্টেলনাও।
তাহলে ইনিই হচ্ছেন সেই রাজতন্ত্রী যিনি একদা প্রচুর ঝঞ্ঝাটের সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর দেয়ালের কুৎসিত ছবিগুলো চোখে পড়লে বলে উঠলেন, আন্দাজ করেছিলাম কিছুদিন ধরেই এক গুপ্ত সম্প্রদায় প্যারিসের কোনো এক জায়গায় করে চলেছে শয়তানের উপাসনা, এবং তারাই দায়ী কিছু কিছু মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু এতদিন তাদের হদিশ পাইনি। আপনাকে সরকারের শত্রু বলে গ্রেপ্তার করছি নিরুদ্দেশ মানুষদের চুরি করার ও হত্যার দায়ে আর এইসব নোংরা কাজের জন্য।
গোয়েন্দাটির মুখের দিকে দশ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে রইল ওরা। বোঝা গেল মোকাটা এসে ক্যাস্টেলনাওকে মুক্ত করেন, এবং সব বৃত্তান্ত শুনে বুঝতে পারেন যে তাঁরা নিশ্চয়ই গুপ্ত গৃহে হানা দেবেন। সুতরাং এই সুযোগে পুলিশে খবর দিয়ে তারা যেমন শয়তানপন্থী হিসাবে সরাসরি ধরা পড়বেন তেমনি ডিউকও তাদের হাতে পড়বেন পলাতক রাজতন্ত্রী হিসেবে। এবং সেই দশ সেকেন্ডের মধ্যেই এসব ডিউকের মাথায় খেলে গেল। বুঝলেন সাইমনের পোশাক দেখে আর তাঁদের শয়তানপন্থী বলে মনে করতে পুলিশের অসুবিধে হবে না এবং এই সুযোগে মোকাটা তাঁর প্লেনে কবচ উদ্ধারে বেরিয়ে পড়বেন ফ্লাওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মোকাটা কবচ উদ্ধার করে পৃথিবীর বুকে মহা বিপর্যয় ডেকে আনবেন। ডিউক দেখলেন সামনে তাঁর এখন একটাই পথ। জীবন বিপন্ন করেও অত্যন্ত আচমকা গোয়েন্দাকে লক্ষ্য করে তিনি ভীষণ বেগে লাফিয়ে উঠলেন।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটল গোয়েন্দার গুলি। তা ডিউকের বাঁ বাহুতে লাগল বটে, কিন্তু তাহলেও সে ছিটকে পড়ল। সাইমন আর মেরী একসঙ্গে অন্য গোয়েন্দাটিকে আক্রমণ করে বসলেন, কারণ, সবাই জানেন এ ছাড়া আর উপায় নেই তাঁদের গ্রেপ্তার এড়াতেই হবে। রিচার্ড বন্দুক বার করার সময় পেলেন না, তৃতীয় লোকটি তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরেছে। তবে, রেক্স তাঁর ডাণ্ডা দিয়ে পুলিশটার মাথায় সজোরে আঘাত করলেন, আর সে সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়ল। তখন রেক্স প্রচণ্ড বেগে ক্যাস্টেলনাওকে আক্রমণ করলেন এবং তাঁর এক প্রচণ্ড ঘুষিতে লুটিয়ে পলেন ক্যাস্টেলনাও।
ডিউকের বাঁ হাত ঠান্ডা হয়ে ঝুলে পড়ল।
শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষ বিধ্বস্ত হল। তখন সবাই ডিউকের ক্ষতের দিকে মন দিলেন। গুলি হাড়ে লাগেনি, তবে মাংসপেশী ছিন্ন করেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তাঁর। তিনি বললেন, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু সাইমন এই মুহূর্তে তুমি ওই পুরোহিতের পোশাক ছেড়ে ফেল। এক্ষুনি আমাদের পালাতে হবে এখান থেকে।
চট্পট্ করে মেরী ক্ষত বেঁধে দিলেন, আর রিচার্ড আহত হাতটা তাঁর গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলেন।
মানচিত্র দেখে জানা গেল, তাঁদের যেতে হবে মাইল চোদ্দশ। বেলা বারোটা নাগাদ পৌঁছবেন ভিয়েনায়। সেখান থেকে আড়াইটে বাজবে ফিউমে পৌঁছাতে আর ইয়ানিনা পৌঁছাতে আটটা। রিচার্ড ও রেক্স পর্যায়ক্রমে প্লেন চালাবেন।
প্রচণ্ড বেগে প্লেন চলছে। একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। মেরীর যখন ঘুম ভাঙল তিনি শুনতে পেলেন, সাইমন প্লেন থেকে নেমে কথা বলছেন এরোড্রোমের এক কর্তাব্যক্তির সঙ্গে। সাইমন তার কাছে ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলেন এক বেঁটেখাটো, টাকমাথা, গোলগাল মানুষের সম্বন্ধে। যার কাছে আছে একটি ছোট মেয়ে। কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন না লোকটির উত্তর। পরমুহূর্তে সাইমন প্লেনে উঠে ডিউককে বললেন, উনি নিশ্চয়ই সেই পথটা ধরেছেন। দেড় ঘণ্টা এগিয়ে আছেন আমাদের থেকে হয়ত তাঁর নিজস্ব গাড়ি ছিল প্যারিসে, যে জন্য সে খানিকটা বেশি সময় পেয়েছে। ভিয়েনায় কুয়াশা ছিল। যে জন্য মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে মোকাটার পক্ষে এখান থেকে যাত্রা করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ সময় বাঁচানো গেছে আধ ঘণ্টা। প্লেন এগিয়ে আড্রিয়াটিক, আর আয়োনিয়ান সমুদ্রের সংযোগ স্থল। তারপর পৌঁছে গেল কর্ফুর উপর। সেখান থেকে সিধে এগিয়ে চলল সেই পর্বতশ্রেণীর দিকে যাকে গ্রীসের মেরুদণ্ড বলা যেতে পারে।
একটা কুয়াশা উঠে আসছে, তাতে আড়াল হয়ে যাচ্ছে দূরের ফসলের ক্ষেতগুলি। দিনের আলো নিস্তেজ হয়ে আসছে, সূর্যের শেষ রশ্মি বহুদূরবর্তী তুষারে ঢাকা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ সাইমন বলে উঠলেন, ঐ, ঐ মোকাটার প্লেন। প্লেনটা মাটিতে নেমেছে। রেক্সও প্লেন নামালেন, তার পঞ্চাশ গজের মধ্যে পৌঁছে। তাড়াহুড়ো করে সকলে নেমে গেলেন। প্লেন নামতে এক ব্যক্তি এগিয়ে এল। তার সাথে ডিউক কথা বলে ফিরে এসে বললেন, লোকটি এক মেকানিক, ফরাসী। বলছে মাত্র আধ ঘণ্টা হল মোকাটার প্লেন নেমেছে। প্লেনটা এসেছে মোনাস্টিক থেকে, তার ইঞ্জিনে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল, সেজন্য দেরী হয়েছে। কেউ ও পথে আসে না নেহাৎ পাগল না হলে। ও বলছে একটা গাড়ি পাওয়া যেতে পারে। ও-ই এই এরোড্রামটা চালায়।
দীর্ঘ নিদ্রার পর রিচার্ডের ঘুম ভাঙল। তখনও ভালো করে ঘোর কাটেনি। হঠাৎ দেখলেন সবাই একটা খোলা প্রাচীন ফোর্ড গাড়িতে উঠে বসেছেন যার হুড ছেঁড়া-খোঁড়া। সামনে কুড়ি গজের বেশি দৃষ্টি চলে না। গাড়ির বাতি সেই অন্ধকার খুব সামান্যই কাটাতে পেরেছে। কোথাও ঘরবাড়ির চিহ্নমাত্র নেই।
পাহাড়ের ছোট ছোট সারির আড়ালে সূর্যের শেষ আলোও ঢাকা পড়ে গেল। রাস্তা খুব বন্ধুর, গাড়ি চলেছে ধাক্কা খেতে খেতে। পেছনের চাকা থেকে পাথরের নুড়ি ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে।
তাঁরা আছেন একটা অচেনা ঘরে। ঘরটা পূর্বমুখো এবং ছাদটা নিচু। বড় বড় দরজা কাঠের ঘরটায়, সেই দরজার তলা দিয়ে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন কুয়াশা পাক খেতে খেতে উঠে আসছে। একটা টেবিলের উপরে একটা বাতি রাখা আছে। সেই আলোয় দেখলেন, ঘরটার মাটির মেঝে ঠান্ডা।
মেরীর যখন ঘুম ভাঙল দেখলেন রেক্স বেঞ্চে বসে আছেন, আর অন্যেরা একটা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। এক চাষার মেয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা কইছে। তার মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কথাটা পয়সা নিয়েই হয়ত, কারণ তিনি দেখলেন ডিউকের হাতে একতাড়া নোট। মেয়েটি চলে গেলে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা কইতে লাগলেন। কয়েকটা কথা তাঁর কানে এল : ভেবেছিলাম ধ্বংস স্তূপ…লোক আছেন এখনও…আমাদের ওখানে যেতে নিষেধ করছে…না, ওখানে যেতে কোনো অনুমতির দরকার হয় না।
ওদের কাছে জায়গাটা বিধর্মীদের জন্যে। মোকাটার সঙ্গীসাথী? না, সাধারণ পলাতক কয়েদি মনে হয়, কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের লোক বলে মিথ্যে পরিচয় দেয়। কবচের লোভেই হয়ত, হবে চল্লিশ পঞ্চাশ জনের মতো দিনের বেলায়ও এখানকার লোক ওখানে যায় না। আর রাত্রে যতই টাকা দেওয়া হোক কেউ যেতে চাইবে না। একজন ড্রাইভার পেয়েছেন বলছেন? হ্যাঁ মোটামুটি তাই। কেন দোষটা কী তার?—জানি না। মেয়েটি তাকে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না,—তার কথা বুঝতে পারাই মুস্কিল, গ্রামের কোনো বদ লোক নাকি? যাই হোক অন্য কাউকে না পেলে ওকেই বিশ্বাস করতে হবে।
ডিউক মেরীর চোখের উপর হাত বুলিয়ে নিলেন। কী বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল? ক্লান্ত, অত্যন্ত ক্লান্ত মেরী। এক চাষীর মেয়ের সঙ্গে ভাঙা বিহারটার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তাকে বিহারের ব্যাপারে আতঙ্কিত বলে মনে হল। বার বার যেতে বারণ করছিল। কিন্তু কিভাবে কথাবার্তা হল? ইউরোপের প্রায় সব ভাষাই তিনি বুঝতে পারেন, তবে আধুনিক গ্রীক ভাষা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ছিল সামান্য। যাই হোক যেতেই হবে তাঁদের…
এক ছোটখাটো কুঁজো ব্যক্তি উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ চোখে ডিউরুকে নিরীক্ষণ করছে। অন্যেরা লোকটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। অত্যন্ত সেকেলে একটা ঘোড়ার গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো রোগা পটকা ঘোড়া সেই গাড়িতে জোতা। গাড়িটা তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সবাই উঠলে গাড়িটা চলতে থাকল। অদ্ভুত, চতুর চোখে একবার তাঁদের দিকে তাকাবার পর সেই কুঁজো গারোয়ান তার জায়গায় গিয়ে বসল। গাড়ি চলল ঢুলতে ঢুলতে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেল। পথের দু-দিকে পাথরের দেয়াল, সর্বত্র ভূতুড়ে স্তব্ধতা বিরাজ করছে।
পথ ভীষণ এবড়ো খেবড়ো, ঘোড়া কোনোরকমে হেঁটে হেঁটে চলেছে। সাইমনের দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। স্যাঁতসেঁতে ধূসর আবহাওয়া যেন তাঁর হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। মনে করতে চেষ্টা করলেন কবে এবং কোনো সময়ে তিনি প্যারিস ছেড়েছেন, গতরাতে তার আগের রাতে, না কি তারও আগের রাতে? মনে করতে পারলেন না। পথের যেন শেষ নেই। কারও মুখে কথা নেই, গাড়ি তেমনি ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলেছে।
শেষ পর্যন্ত গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ান উপর দিকে দেখিয়ে দিল, তারপর পয়সা নিয়ে চলে গেল। শেষবারের মতো তাকে দেখবার জন্য ডিউক ফিরে তাকালেন, কিন্তু অতন্ত অবাক হলেন গাড়িটায় কোনো প্রকার আলো নেই দেখে।
হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চললেন সবাই সেই পায়ে চলা পথ ধরে। খানিকটা এগোবার পর প্রাচীন বিহারটা তাঁদের চোখে পড়ল, পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক পাশ ভেঙে পড়েছে। নতুন উৎসাহে তাঁরা উঠতে শুরু করলেন প্রবেশপথের অর্ধচন্দ্রাকৃতি তোরণের দিকে। গেট খোলা, দরজা খসে পড়েছে। ভিতরে প্রবেশ করলেন, কিন্তু তবুও কোনো সাড়া পেলেন না।
এগিয়ে চললেন সবাই। এক জায়গা দিয়ে আলোর একটু আভাস আসছিল, সেদিকে এগোলেন। তাঁদের মনে হল এই অংশটারই সব থেকে কম ক্ষতি হয়েছে, সাধু সন্তরা এখানেই থাকেন। একটা রুক্ষ হাসি আর তারপর গ্লাস ভেঙে যাওয়ার আওয়াজ তাঁদের কানে এসে তাঁদের এই ধারণার সমর্থন করল।
সরাইখানা থেকে বেরোবার পর থেকেই একটা আতঙ্কের আভাস ডিউককে পেয়ে বসেছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল ওখানে বিপদ আছে।
এগোতে এগোতে আবার একটা উঠোন তাঁরা পেয়ে গেলেন। হয়ত খ্রিস্টধর্মের প্রথম যুগের সাধু সন্তরা এই বিহার নির্মাণ করেছিলেন। হয়ত তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ করত, জনসাধারণের কল্যাণে কত ভালো কাজ করত।
চওড়া সিঁড়ি বেয়ে তাঁরা ক্রমেই উঠে চলেছেন, তারার আলোয় পথ ভালো করে দেখা যায় না। অবশেষে তাঁরা একটু নিচু দরজার সামনে পৌঁছলেন। একটা সিঁড়ি সেখান দিয়ে নেমে ঘন অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে মিশেছে।
মেরীও চলেছেন হোঁচট খেতে খেতে। এরই নিচে তো সেই কবচ সমাহিত। তাঁর মনে হল যে কুয়াশা নেই। হয়ত তাহলে মোকাটা তাঁদের আগে পৌঁছতে পারেননি কিন্তু ফ্লাওয়ার কোথায়—তাঁর ফ্লাওয়ার। ডিউকের হাতে যে একটা লন্ঠন সেটা এতক্ষণ পর রিচার্ডের চোখে পড়ল। হয়ত সরাইখানা থেকে ধার করে এনেছেন। একটুখানি মোমবাতি তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল, সেটা সরিয়ে নিলেন তিনি। ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে তিনি বাতি হাতে সেই অন্ধকার, ভ্যাপসা গন্ধে ভরা সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চললেন, অন্যেরা অনুসরণ করলেন।
সিঁড়ি শেষ হল একটু নিচু গুপ্তগৃহের সামনে এসে। লণ্ঠনের আলোয় মনে হল যেন ঘরটার শেষ নেই।
পূর্ব দিকে ডিউক এগোলেন, বেদীটার অবস্থিতি উপরের গির্জার বেদীর নিচেই হবে আন্দাজ করে।
কিন্তু কুড়ি গজের মতো এগিয়েই তাঁকে হঠাৎ থামতে হল। ঘরের ঠিক মাঝখানেই একটা কালো নীরেট বস্তু পথরোধ করে খাড়া আছে।
বিড়বিড় করে বললেন, ওহো, ভুলেই গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে বেদী ঘরের মধ্যস্থলেই স্থাপিত হত।
নিশ্চয় তাহলে আমরা এখানে পৌঁছনোর ব্যাপারে মোকাটাকে টেক্কা দিতে পেরেছি। রেক্সের কণ্ঠস্বরে বিজয়ীর সুর।
রিচার্ড বললেন, হয়ত মোটামোভা থেকে গাড়ি জোগাড় করতে পারেননি—আমাদের গাড়োয়ানের নিশ্চয় মাথার ঠিক ছিল না যে জন্যে রাজি হয়েছিল। রিচার্ড জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা আমরা যে ঠিক জায়গাতেই এসে গেছি এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই তো? আমার মগজ হয়ত ঠিক কাজ করছে না, কিন্তু তাহলেও আমার মনে হচ্ছে, সাইমন সম্মোহিত অবস্থায় যেন একটা পাশের ঘরের কথা বলছিল।
কেউ উত্তর করলেন না। কথাটা সকলের মনেই ঘুরছে। এমন সময় তাঁদের মনে হল যেন পেছন থেকে কে লক্ষ্য করছে।
রেক্সের হাত থেকে লণ্ঠনটা পড়ে গেল, ডিউক পাক খেয়ে ফিরলেন, মেরীর মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ বেরিয়ে এল। তাঁদের মাত্র দশ পা পেছনে একটা অস্পষ্ট আলো দেখা গেল, আর তাঁদের চোখে পড়ল, কয়েক ধাপ সিঁড়ি সেখানে উঠে এসেছে, তার ওপারে একটা ঘর যেখানে একটা ছোট বেদী। সেখান থেকে ডান দিকের একটা পাথর ধসিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে মোকাটা।
প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ চিৎকার করে রেক্স এগোতে গেলেন, কিন্তু শয়তানপন্থী হঠাৎ তাঁর বাঁ হাতটা তুললেন। একটা কালো চুরুটের মতো আকারের বস্তু সেই হাতে ধরা। সেটা ঘিরে ফসফরাসের আলো বিকীর্ণ হল, যার ফলে সেই প্রায়ান্ধকারেও কালো বস্তুটি দেখা গেল স্পষ্ট। তার কিরণ যেন তাঁদের দেহ ভেদ করে তাঁদের এগিয়ে আসা বন্ধ করে দিল, তাঁরা চলৎশক্তি হারিয়ে ফেললেন।
একটা কথা উচ্চারণ না করে মোকাটা সেই বস্তুটি নিয়ে তাঁদের ঘিরে ঘুরে গেলেন। ফলে ফসফরাসের একটা ঝলমলে বৃত্তের সৃষ্টি হল। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলে তাঁরা অনুভব করলেন, তাঁদের শরীরে কোনো উত্তেজনা নেই।
আবার তাঁরা মোকাটাকে আক্রমণ করতে গেলেন, কিন্তু এবারও সেই ফসফরাসের বৃত্তে বাধা পেলেন। বুঝতে অসুবিধে হল না যে, এই বৃত্তের বাইরে যাওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। মোকাটা ধীরে ধীরে যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে ফিরে গিয়ে একে একে কালো মোমবাতিগুলো জ্বালতে লাগলেন। এমন সময় অবর্ণনীয় আতঙ্কের সঙ্গে মেরী দেখলেন, যেখান থেকে কবচটা খুঁড়ে তোলা হয়েছে তার নিকটে কোণের দিকে ফ্লাওয়ার গুঁড়ি মেরে রয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফ্লাওয়ার বলে দু-বাহু বাড়িয়ে সানুনয় চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু মনে হল না ফ্লাওয়ার তা শুনতে পেয়েছে। চোখ গোল গোল করে সে সেখানেই রয়ে গেল।
ধূপদানিতে ধূপ জ্বেলে মোকাটা ধূপদানিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন।
নীরবে এমন ধীরে ধীরে আর নিঃশব্দে মোকাটা ঘুরতে লাগলেন যে যদি বিড়-বিড় করে মন্ত্র না আওড়াতেন তাহলে ব্যাপারটাকে ভূতুড়ে বলে মনে করা যেত। এবং এমন সময় ফ্লাওয়ার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যে কান্না শুরু করল তা যে রূঢ় বাস্তব তাতে সন্দেহ নেই, তাঁদের অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত যেন কান্নায় বিদীর্ণ হয়ে গেল।
পর পর কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন তাঁরা সেই বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করতে পারলেন না তখন সেই চেষ্টা থেকে বিরত হলেন। তারপর মহা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, সেই ধূপের ধোঁয়ায় যে মেঘের সৃষ্টি হয়েছিল তা আকার গ্রহণ করছে।
সেটাকে সাইমনের বাড়িতে দেখা মোকাটার কৃষ্ণকায় ভৃত্যের মুখ বলে রেক্সের প্রথমে মনে হল, কিন্তু দেখা গেল তা পালটে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। থুতনিতে ছুঁচলো দাড়ি দেখা দিল, তারপর মাথায় দেখা দিল, চারটে বড় বড় বাঁকানো শিং। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা স্পষ্ট, নীরেট হয়ে সেই বিশাল মেন্ডিসের ছাগলে রূপান্তরিত হল, রক্তবর্ণ চোখের দৃষ্টিতে বিচ্ছুরিত হতে থাকল অত্যন্ত অশুভ এক প্রভাব। বিশাল দুই নাসারন্ধ্র থেকে নির্গত হতে থাকল জীবননাশী পৃতি গন্ধ।
কবচটা তুলে মোকাটা তার কপালে পরিয়ে দিলে তা ভাস্বর, অপূর্ব রত্নের মতো প্রভা বিস্তার করতে লাগল। তখন মোকাটা ঝুঁকে পড়ে শিশুটিকে তুলে নিলেন। তারপর তার সব পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন আর উলঙ্গ দেহটি পশুটার উত্তোলিত আসনের দুই পায়ের নিচে বেদীর উপরে লম্বা করে ছুঁড়ে ফেললেন।
বন্দীরা মহা আতঙ্কে ব্ল্যাক ম্যজিকের মন্ত্রের ভয়ঙ্কর কথাগুলো উচ্চারিত হতে শুনতে লাগলেন।
সমস্ত শক্তি হারিয়ে তাঁরা অসহায়ভাবে লক্ষ্য করলেন ধূপদানিটা ঘুরছে আর শুনলেন সেই মন্ত্র যা ঈশ্বরের নিন্দায় মুখর। মোকাটার উদ্দেশ্য, মন্ত্রপাঠ শেষ করে তিনি শয়তানের পুরোহিত হিসেবে শিশুটির গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত কেটে ফেলে তার আত্মা নরকে সমর্পণ করবেন।
আতঙ্কে মত্তপ্রায় হয়ে তাঁরা দেখলেন, মোকাটার ছুরি শিশুটির উপরে আঘাতের জন্য উদ্যত।
রেক্সের গাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। তাঁর দু-বাহুর পেশীগুলো থর-থর করে কাঁপছে, তিনি ছটফট করছেন মোকাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। সেই অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তিনি আটকা পড়ে আছেন।
ডিউক তখনও নীরবে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে প্রার্থনা করে চলেছেন। সেই মৌন প্ৰাৰ্থনা ইথারে তরঙ্গায়িত হচ্ছে। তিনি খুব ভালো করে জানেন দৈহিক কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না। এবং এখন এই মূর্তিমান ভয়ঙ্কর অশুভের বিরুদ্ধে সেই প্রার্থনাও কার্যকর হবে কি না সন্দেহ।
রিচার্ডও তাঁর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তাঁর নীরক্ত মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে, চোখে অপলক দৃষ্টি। দু-বাহু এমনভাবে প্রসারিত যেন ফ্লাওয়ারকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেই বাহু নাড়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। ডিউক আর রেক্সের মাঝখানে সাইমনও নতজানু হলেন। তাঁরই বোকামির জন্যে এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড সঙ্ঘটিত হতে চলেছে, একথা চিন্তা করে আর তাঁর অনুশোচনার অন্ত নেই। তাঁর আত্মাকে শয়তানের হাতে তুলে দিতে তিনি প্রার্থনা করলেন আর বিনিময়ে ফ্লাওয়ারের মুক্তি ভিক্ষা করলেন।
পলকের জন্যে থামলেন মোকাটা। যদিও ছুরিটা তেমনি উদ্যত রইল—সাইমনের প্রার্থনার স্পন্দন এতই প্রবল হয়েছিল যে তাঁর–কাছেও পৌঁছেছিল।
কিন্তু সাইমনকে তো তাঁর আর এখন প্রয়োজন নেই, যেটুকু দরকার ছিল তা তিনি নিঃশেষে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মুখে নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল, মাথা নেড়ে তিনি সাইমনের ইচ্ছা অগ্রাহ্য করলেন।
মত্ত প্রচেষ্টায় ডিউক প্রার্থনা করে চলেছেন আর ক্রুশচিহ্ন আঁকছেন যাতে মোকাটার আঘাত প্রতিহত করতে পারেন, কিন্তু কবচের এক কিরণচ্ছটায় তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হল। রিচার্ডের মুখ দিয়েও কোনো আওয়াজ নির্গত হল না। মাথা হেঁট করে রেক্স আক্রমণে উদ্যত হলেন, কিন্তু তাঁকেও ব্যর্থ হতে হল।
হঠাৎ মেরী মানস চক্ষে আপিনের লোহিত গ্রন্থটি খোলা দেখতে পেলেন, তার অস্পষ্ট হয়ে আসা কয়েকটা লাইনও যেন তাঁর চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল এবং একটা পাঁচ মাত্রার বাক্যের তাৎপর্যও তাঁর বোধগম্য হল; যারা বিনা লালসায় ভালোবাসতে পারে, চরম বিপদের সময় তাদের মধ্যে একটা শক্তি সঞ্চারিত হয়।
তাঁর দু-ঠোঁট ফাঁক হল এবং সেই পাঁচ মাত্রার কথা তিনি উচ্চারণ করে বসলেন যা তিনি কোথাও পড়েননি বা শোনেননি, এবং যার অর্থও তিনি ভালো করে জানেন না।
সঙ্গে সঙ্গে কথাটার ফল ফলল। সমস্ত ঘরটা কেঁপে উঠল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। দেয়ালগুলো পেছিয়ে গেল, মেঝেটা পাক খেতে থাকল, গোপনীয় ঘরটা এমন প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে আরম্ভ করল যে পাছে পড়ে যান তাই তাঁরা প্রাণপণে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন, বেদীর মোমগুলি দুলতে থাকল, সেটের কবচ ভয়ঙ্কর ছাগলটার মাথা থেকে ছিটকে পড়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নামতে নামতে ডিউকের পায়ের কাছে থামল।
মোকাটা টলতে টলতে পেছিয়ে পড়লেন আর পেছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে তাঁর উপর খাড়া হল,—তার নাসিকা থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ বেরিয়ে এল, ভয়ঙ্করভাবে দু-চোখ ঘুরতে থাকল, তাদের বিকিরিত অশুভ আলোয় ঘর পূর্ণ হল। পশুটা ক্রমশ বড় হতে হতে শেষ পর্যন্ত যেন সমস্ত ঘরটা ভরে ফেলল। সবাই ভয় পেল। দুর্গন্ধে সবার মধ্যে মনের ভাব তীব্র হয়ে উঠল। মহা আতঙ্কে মোকাটার হাত থেকে ছুরিটা খসে পড়ল। তিনি নরক থেকে যে ভয়ঙ্করকে আহ্বান করে এনেছিলেন, এই অন্তিম চিৎকারের সঙ্গে সে সামরে এক পায়ের খুড় দিয়ে আরো আঘাত করল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর বেগে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ে স্থির হয়ে গেলেন।
এমন সময় এমন এক বজ্রাঘাত হল যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, গুপ্ত গুহার ঘূর্ণন বন্ধ হল, মুছে যেতে থাকল শয়তানের মূর্তিগুলো, বৃত্তের বন্দীদের চোখের সামনে মোকাটার কৃষ্ণকায় ভৃত্যটি ক্রোধে, ছাগলের মূর্তিটির সামনে দেখা দিল যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে। তারপর তা ও মিলিয়ে গেল পাঁকানো ধোঁওয়ার সাথে। বেদীর উপরে যেসব কালো মোমবতি ছিল সেগুলো নিভে গেল দপ-দপ করে। কেবলমাত্র কবচের ফসফরাসের আলোতে ঘর আলোকিত হয়ে রইল। ডিউক সেটা তুলে খোলা হাতে রাখলেন। ফ্লাওয়ার উঠে বসেছে সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল। সে বেদী থেকে নেমে এল একটু কেঁদে, কিন্তু তবুও তাঁর চোখে ফুটে উঠল না দৃষ্টি—যেন যারা ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ায় তাঁরও তেমনি অবস্থা।
হঠাৎ এমন এক স্তব্ধতা নেমে এল মানুষের বোধগম্য নয় এবং শোনা গেল এমন এক সঙ্গীত যা পৃথিবীসম্ভূত নয়—যেন বাইরে থেকে আসছে, অনেক দূর থেকে। কোনো গুহা থেকে ঝর্ণার জল নির্গত হওয়ার কথা মনে পড়ে। তারপর তা ক্রমশঃ জোরাল হতে থাকল। তাদের মুক্তি হল সমস্ত আতঙ্ক থেকে। সকলেই নতজানু হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগল সেই পবিত্র সঙ্গীত। আর সকালের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল ফ্লাওয়ারের উপর। অত্যন্ত ধীরে ফ্লাওয়ার এগিয়ে আসতে লাগল এবং দেখা গেল তার মধ্যে যেন এক অপূর্ব পরিবর্তন ঘটে চলেছে। তার দেহ যে মুহূর্ত আগে ছিল নগ্ন, তাঁকে পোশাকের মতো ঘিরে রইল এক সোনালী কুয়াশা। তার কাঁধ চওড়া হল, বড় হয়ে উঠল শরীর, তার মুখাবয়ব প্রথমে ছিল অস্পষ্ট তা শিশুসুলভ বর্তুলাকার হারিয়ে হয়ে উঠল পূর্ণবয়স্কের মতন। সেই সোনালী স্বচ্ছ কুয়াশা স্থূল হতে হতে গৈরিকবর্ণ কমনীয় রেশমের পোশাকে পরিণত হল, মাথার ঘন কোঁকড়ানো চুল ঘুচে গিয়ে সেখানে দেখা দিল সুন্দর সুসমঞ্জস্ মুণ্ডিত মস্তক।
উচ্চ নাদের সঙ্গে গান সমাপ্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে শিশুসুলভ যা কিছু তার মধ্যে ছিল সব কোথায় যেন দূর হয়ে গেল। পুনর্গঠিত পুরুষকে সেখানে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল ফ্লাওয়ারের পরিবর্তে। পোশাক এবং চেহারা দেখে মনে হল তিব্বতের লামা, এবং তার কমনীয় মুখ দেখে তাকে যতটা আৰ্য ততটাই মঙ্গোলীয় মনে হল,—দুয়ের যা কিছু ভালো তার সংমিশ্রণ বলা চলে। তা দেখে যেমন মনে হয় যে জাতির সীমা অতিক্রম করেছে তেমনি জাগতিক অর্থে যা সময় তাও সে অতিক্রম করে গেছে। তাকে দেখে যেমন পূর্ণ গতি মানুষের শক্তির আধার মনে হয় তেমনি মনে হয় যেন এমন কোনো সুন্দর-কান্তি তরুণ যার ছাত্রজীবন জ্ঞানের সন্ধানে অতিবাহিত হয়েছে। যে গম্ভীর দৃষ্টিতে সে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে তাতে যেমন শক্তি জ্ঞান ও ক্ষমতার পরিচয় তেমনি পরিচয় অসীম কোমলতার ও স্বর্গসুলভ করুণার, নশ্বর মানুষ যার পরিচয় পায়নি।
সে যে কথা বলল তা তার মুখ থেকে নির্গত হল না, কিন্তু তবুও নতজানু সকলেই সেই নিচু, মিষ্টি, সুরেলা শব্দ অত্যন্ত স্পষ্ট শুনতে পেলেন।
সে বলল বারবার জীবন-মৃত্যু পার হয়ে আজ আমি আলোর দেবতা, সম্পূর্ণ পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছেছি। যে গোপন উপত্যকায় আমি ধ্যানমগ্ন ছিলাম সেখান থেকে আমাকে ডেকে এনে অন্যায় করেছ। তবে এইজন্যে তোমাদের অপরাধ নিচ্ছি না যে তোমাদের প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত অধিক। এখানে একজন আছে, অসাধু উদ্দেশ্যে গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করে যে নিজের জীবন-শিখার উপর বিপদ ডেকে এনেছে এবং আর একজন যে জলের ওপারে শায়িত আছে। সেই একই কারণে সেও নিজের উপর আঘাত ডেকে এনেছে। এবং পরস্পরের প্রতি তোমাদের যে ভালোবাসা তার শক্তিও কার্যকর হত না যদি না ওখানে না থাকত। যে প্রার্থনা স্বার্থ-চিন্তারহিত হয়ে উৎসাহিত হয় তা রক্ষকের কর্ণে এসে উপস্থিত হয়, যে জন্যে মুহূর্তের জন্যে আমি তোমাদের কাছে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি পেয়েছি।—সেই শিশুর মাধ্যমে যার মধ্যে অপবিত্রতার স্পর্শমাত্র নেই। শত্রু চিরদিনের জন্যে শয়তানের অন্ধকার এলাকায় বিতাড়িত হয়েছে। জীবনের নির্দিষ্ট অবশিষ্ট দিনগুলি পার হয়ে যাও, শান্তি লাভ কর। নিদ্রা যাও, নিদ্রান্তে যথাসময়ে ফিরে যাবে।
পলকের জন্যে তাঁদের মনে হল তাঁরা গুপ্তগৃহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে আছেন। বৃত্তটা যে জ্বলন্ত সূর্যে পরিণত হয়েছে, তার মাঝখানে তাদের শরীরগুলো কালো কালো ছায়ার মতো প্রতীয়মান হচ্ছে। মৃত্যুর শান্তি আর স্তব্ধতা বড় বড় তরঙ্গ হয়ে তাঁদের উপর আছড়ে পড়ছে। বিহারের ঊর্ধ্বে এখন তাঁরা, ধ্বংসকবলিত বিহার বর্তমানে তাঁদের কাছে সুদূরের বিন্দুমাত্র, তারপর সমস্ত কিছুই মিলিয়ে গেছে।
সময় স্তব্ধ। মনে হচ্ছে যেন তাঁরা হাজার হাজার বছর ধরে ভাস্বর পরমাণু হয়ে নিঃসীম শূন্যে যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছেন তার উচ্চতা পৃথিবী থেকে বহু সহস্র মাইল, সেখানে কোনো তারতম্য নেই, নেই কোনো শব্দ, সেখানে তাঁরা অবিরত ঘুরছেন আর ঘুরছেন। সকল উপলব্ধির অতীত সে স্থান। কিংবা যেন পরম স্বচ্ছন্দে পাঁচশো বাঁও জলের তলায় বিচরণ করছেন যেখানে কোনো তরঙ্গ পৌঁছায় না।
তারপর যুগ যুগ অতিক্রান্ত হলে আবার তাঁরা ক্যার্ডিন্যালস বালি দেখতে পেলেন—তাঁদের অনেক অনেক নিচে, সেই বৃত্তের মধ্যে অন্ধকারে তাঁদের দেহ ঢেকে গেছে। ভূতুড়ে স্তব্ধতার মধ্যে যুগযুগান্তের ধুলো নেমে আসছে, নেমে আসা সেই মসৃণ ধূসর ধুলোরাশি ক্রমেই তাঁদের আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
ডিউক মাথা তুললেন। তাঁর মনে হল যেন সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর কয়েকদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। চোখে হাত দিলেন তিনি। আধো অন্ধকার লাইব্রেরিতে পরিচিত বইয়ের তাকগুলো তাঁর চোখে পড়ল, ছাদের আলোগুলোও একটু দপদপ্ করেই জ্বলে উঠল।
তাঁরা লক্ষ্য করলেন সাইমনের চোখে আর সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি নেই, যদিও তিনি তখনও সেই গণ্ডীর কেন্দ্রস্থলে বাঁধা রয়েছেন।
ঝুঁকে পড়ে তাড়াতাড়ি তাঁর বাঁধন খুলতে শুরু করলেন। মেরী জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন, আর রিচার্ড তাঁকে বিড়-বিড় করে মিষ্ট স্বরে বলছেন—আর ভয় নেই মেরী, আর ভয় নেই। হঠাৎ রেক্সের গলা শোনা গেল—ও তো মারা যায়নি, তাই না? সবাই শুনে তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। জানালা দিয়ে আসা সকালের আলোয় রেক্সকে দীর্ঘ আর অবিন্যস্ত মনে হল, তাঁর দু-হাতে ট্যানিথের দেহ। কেঁদে ফেললেন মেরী, দৌড়ে গেলেন ফ্লাওয়ারের গৃহে রিচার্ডও পিছু দৌড়লেন।
তাড়াতাড়ি ডিউক রেক্সের কাছে গেলেন। সাইমন উঠে দাঁড়ালেন, বলে উঠলেন এক অতি আশ্চর্য স্বপ্ন আমি দেখেছি।
কিসের স্বপ্ন?-
যে আমরা সকলে মিলে প্যারিসে গিয়েছিলাম।
তিনজনে মিলে ট্যানিথের শরীর নামাতে নামাতে ডিউক বললেন, আর সেখান থেকে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত অভিযানের স্বপ্ন?
হ্যাঁ। কিন্তু কেমন করে—কেমন করে আপনি তা জানলেন?
কারণ আমিও গিয়েছিলাম সে যদি স্বপ্ন হয় তো স্বপ্নেই।
এমন সময় সিঁড়ি থেকে অত্যন্ত উচ্চ হাসি শোনা গেল, এবং পরমুহূর্তেই মেরীকে দেখা গেল, ফ্লাওয়ারকে কোলে করে নেমে এসেছেন, তাঁর গাল বেয়ে চোখের জল ঝরছে। সবেমাত্র সে ঘুম থেকে উঠেছে। বড় বড় নীল চোখে ফ্লাওয়ার সকলের দিকে তাকাল। বলল, ফ্লাওয়ার সাইমনের কাছে যাবে।
ডিউক পরীক্ষা করছিলেন ট্যানিথকে। সাইমন তাঁর পাশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর চোখের দৃষ্টিতে মহৎ হৃদয়ের পরিচয়। বললেন, না লক্ষ্মীটি আমার শরীর এখনও ভালো হয়নি।
তাড়াতাড়ি করে রিচার্ড বললেন, বাজে কথা, ও সবই দূর হয়ে গেছে। যাও যাও, ওকে নাও গিয়ে—দেখ মেরী জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।
সাইমন গিয়ে কোলে তুলে নিলেন ফ্লাওয়ারকে তখন মেরী রিচার্ডের দিকে ঝুঁকে পড়লেন বললেন, ঠিক আছি রিচার্ড, আমি ঠিক আছি। এক্ষুনি আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠব—কিন্তু যা দেখলাম তা কি সত্যিই স্বপ্ন?
হঠাৎ বলে উঠলেন ডিউক, রেক্স, রেক্স বেঁচে আছে, ট্যানিথ বেঁচে আছে! শিগগির একটু ব্রান্ডি!
মেরীকে আশ্বস্ত করে রিচার্ড বলে উঠলেন, নিশ্চয় স্বপ্ন নয় তো কী? ঘর থেকে আমরা একেবারেই বাইরে যাইনি।
ও!—কিন্তু দেখ, দেখ মেয়েটিকে! মেরী ট্যানিথের কাছে গিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর মাথা কোলে তুলে নিলেন। ইতিমধ্যে রেক্স হন্তদন্ত হয়ে ব্রান্ডি নিয়ে এসেছেন। ট্যানিথের থুতনি রিচার্ড চেপে ধরলেন, দুজনের চেষ্টায় একটুখানি ব্রান্ডি তাঁকে খাওয়ানো হল। হঠাৎ ট্যানিথ কেঁপে উঠলেন, তারপর চোখ খুললেন। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! রেক্স বলে উঠলেন।
ট্যানিথ হাসলেন, রেক্সের নাম উচ্চারণ করলেন। তাঁর মুখের স্বাভাবিক রঙ ফিরে এল।
বলে উঠলেন মেরী, এমন দুঃস্বপ্ন আমি জীবনে কখনও দেখিনি। সেই গুপ্তগৃহ, সেই ভয়ঙ্কর মানুষটা—যে …
সাইমন বাধা দিলেন, তাহলে তুমিও দেখেছ?
রিচার্ড বললেন, কিন্তু সকলেরই কি একই স্বপ্ন দেখা সম্ভব?
তাহলে আমিও নিশ্চয় স্বপ্নই দেখেছি! রেক্স বলে উঠলেন।
ডিউক আস্তে আস্তে বললেন, হ্যাঁ ট্যানিথের উপস্থিতিই তার প্রমাণ। তার মৃত্যু হয়নি এবং স্বপ্নটা আরম্ভ হয় যখন তুমি ট্যানিথকে কোলে করে এখানে এসেছিলে তখন থেকে। গত রাত্রে যখন আমাদের দেহ ঘুমিয়ে ছিল আমাদের অবচেতন সূক্ষ্ম দেহ তখন শরীর থেকে বেরিয়ে অন্য এক স্বরে মোকাটার সঙ্গে লড়াই করে চলেছিল।
সাইমন বললেন, অ্যা, মোকাটা? তা স্বপ্নই যদি, তাহলে নিশ্চয় সে মরেনি?
হ্যাঁ সে মরেছে, স্থির কণ্ঠে ট্যানিথ বললেন, রেক্সের হাতে ধরে দাঁড়িয়ে উঠে। কেমন করে তুমি এত নিশ্চয় হলে? রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন।
ঐ তো দেখতে পাচ্ছি, বেশি দূরে নয়, সিঁড়িতে মরে পড়ে আছে।
তাহলে কেমন করে তাকে স্বপ্নে দেখতে পেলাম? রিচার্ডের প্রশ্ন।
কিন্তু আমি কোনো স্বপ্ন দেখিনি। মোকাটা আমার ঘরে এসে আমাকে ঘুম পাড়াবার পরে কী হয়েছিল আমার মনে নেই। পাবে তাকে ঐ রকম জায়গাতেই। এই বাড়িরই খুব নিকটে। ডিউক মনে মনে বললেন, সেই পুরানো নিয়ম—জীবনের বিনিময়ে জীবন্ত আত্মার বিনিময়ে আত্মা। যেহেতু তোমাকে পেয়েছি অতএব অবশ্যই সে মরেছে।
সাইমন বললেন, যাই হোক তাহলে আমরা এই বুকচাপা দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত তো?
তা ঠিক। স্বপ্ন হোক বা না-ই হোক, আলোর দেবতা এসে অন্ধকার দূরীভূত করে তো বলেই গেছেন ঠিক সময়ে আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হবে।-এস রিচার্ড দেখি কোথায় আমাদের কোট, ঘুরে আসি বাগানটা, এই বীভৎস ব্যাপারের শেষ হোক।
তাঁরা এগিয়ে গেলে ট্যানিথ হাসি মুখে রেক্সকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা কাল রাত্রে তুমি যা বলেছিলে তা কি তোমার মনের কথা?
নিশ্চয়, তা নয় তো কী? রেক্স হেসে বললেন, বাজে কথা।
কিন্তু জানোই তো আমার আয়ু কতটুকু।
তুমি সকলের কাছেই মৃত ছিলে, সেখানেই তোমার ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক হয়েছে, অসতর্কতা কেটে গেছে। আমাদের আয়ু এখন একশো বছর, বুঝলে?
কথাটা ট্যানিথের ঠিক বিশ্বাস না হলেও এক নতুন আশা তাঁর মনে জাগল। এবং যেহেতু এই বিশ্বাসে ভর করলে দু-জনেরই সুখ, তাই দু-জনেই এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
বাইরে কুয়াশা নেই, লাইব্রেরি ঘরের বাইরে মোকাটার মৃতদেহ দেখা গেল। মৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে ডিউক বললেন, করোনার সহজেই—হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ায় মৃত্যু, এই রায় দেবেন। পুলিসে ফোন করছি—কেউ বলব না যে একে চিনি বা আগে কখনও দেখেছি। মার্লিনকেও ফোন করে কথাটা চেপে রাখতে বলবে।
ঠিক অজানা ব্যক্তির স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু। এ গল্পের উপসংহার এই
না রিচার্ড আমাদের জন্যে কিন্তু আরও একটু বাকি আছে, এই বলে ডিউক সকলকে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরগুলোর একটায়। দরজা খুলে দেখা গেল একটায় কয়লায় উনুন জ্বলছে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডিউক হাতের মুঠোটা ধীরে ধীরে খুললেন।
রিচার্ড বলে উঠলেন, একি, এটা আপনি কোথা থেকে পেলেন?
ডিউকের হাতে ছিল সেটের কবচ, শুকিয়ে মমি হয়ে যাওয়া, আকারে মানুষের কড়ে আঙুলের মতো—শক্ত, আর এতদিনে কালো হয়ে যাওয়া।
ডিউক বললেন, ঘুম যখন ভাঙল দেখলাম এটা আমার মুঠোর মধ্যে রয়েছে।
কিন্তু কোথাও থেকে তো নিশ্চয় ওটা এসেছে?
যে অশুভের সঙ্গে আমরা লড়েছি এটাই হয়ত তার মূর্ত প্রকাশ, নষ্ট করে ফেলার জন্যেই আমাদের দেওয়া হয়েছে। এই বলে তিনি সেটা জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করলেন। সবাই তাকিয়ে রইলেন যতক্ষণ না সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
রিচার্ড কিন্তু এই যুক্তি মানতে পারলেন না। বললেন, কিন্তু যদি স্বপ্নই হবে তাহলে এর কী ব্যাখ্যা করবেন?
তা জানি না। সত্যের যাঁরা শ্রেষ্ঠ দিশারী তাঁরাও অজানার আবরণ সামান্যই উন্মোচন করতে পেরেছেন। তবে আমার ধারণা, স্বপ্নে আমরা যেখানে বিচরণ করেছিলাম বর্তমানের বিজ্ঞানে তাকে চতুর্থ আয়তন বলে—যার সঙ্গে সময়ের কোনো সম্পর্ক নেই।