৪
ট্যানিথ একা একা বসে ছিলেন, রেক্সকে দেখেই লাফিয়ে উঠে দৌড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
দু-হাতে সজোরে তাঁর হাত চেপে ধরলেন।
ট্যানিথকে দেখে রেক্সের ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত বলে মনে হল, তাঁর পোশাকও নোংরা, ট্যানিথ বলে উঠলেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তুমি এসে পড়েছ!
কিন্তু কেমন করে তুমি জানলে যে আমি কার্ডিন্যালস্ বলিতে আছি?
দেখ গত রাতের ঘটনার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, যখন তোমার গাড়ি চুরি করে আমি ওদের বাৎসরিক উৎসবে যাব বলে বেরিয়েছিলাম নিশ্চয় তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই তো গাড়িটা ধাক্কা খেল—সে সব তো তুমি শুনেছ। জান সেখান থেকে ঐ পাঁচ মাইল পথ আমি পায়ে হেঁটে গেছি।
ট্যানিথের ঐ পথ অতিক্রম করতে করতে যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল সব তিনি শোনালেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গল্পের সেই স্থানে এলেন যখন তাঁকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই সভার দিকে এগোতে হচ্ছিল। তিনি বললেন, তারপর আমার মনে হল, ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হয়ে হঠাৎ ঠিক করলেন ঐ ধর্মহীনদের মেরে শেষ করবেন। বাজের মতো একটা বিকট আওয়াজ, তার পরেই বিশাল বিশাল, দুঃস্বপ্নে দেখা দৈত্যের চোখের মতো অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো আমার উপরে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমি চিৎকার করে একপাশে লাফিয়ে পড়লাম। পড়ে গেলাম, আবার লাফিয়ে উঠলাম। যে শক্তি আমাকে ঐ সভার দিকে টানছিল সেটা হঠাৎ দূর হয়ে গেল। মহা আতঙ্কে আমি পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।
এমন সময় কিসে যেন ধাক্কা খেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লাম আমি। তারপর খুব সম্ভব জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
রেক্স বললেন, সেটা আমাদের গাড়িটা। কিন্তু আমার ঠিকানা তুমি পেলে কোথায়?
সে আর এমন কী? সম্বিৎ যখন ফিরল তখন আমি ঘাসের উপর শুয়ে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবার দৌড়তে লাগলাম কোথা যাচ্ছি, জানি না —তখন আমার পক্ষে এইটুকু জানাই যথেষ্ট যে ওই ভয়ঙ্কর উপত্যকা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে আমি আবার অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে একটা খানায় শুয়ে ঘুমিয়ে নিলাম একটু।
ঘুম ভাঙল সকাল হলো। তখন দেখলাম আমি আছি একটা বড় রাস্তার কাছে। শহরের কেন্দ্রে একটা হোটেলে উঠতে যাবো, এমন সময় মনে হল আমার কাছে পয়সা-কড়ি কিছুই নেই। তবে আমার কাছে একটা ব্রোচ ছিল সেটা বন্ধক দিয়ে কুড়ি পাউন্ড পেলাম। তখন এলাম হোটেলে। কেন যে মাদাম দুর্যের কথায় ভুলে এমন সব কাণ্ড করতে যাচ্ছিলাম জানি না। তবে, আমার সেই মনোভাবের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে এবং তখনই ঠিক করেছি যেমন করে হোক মোকাটার সংস্পর্শ এড়িয়ে ঠিক অর্থাৎ সৎপথে চলব। এক বিশেষ পরিবর্তন আমার মধ্যে এসেছে। আমি একা, রেক্স—বড় একা, তুমি ছাড়া আর আমার বন্ধু বলতে কেউ নেই ট্যানিথ থামলেন। তা না হয় হল। কিন্তু বললে না তো, আমার ঠিকানা জানলে কি করে?
কী জান অজানাকে জানা আর কিছু নয়, বহির্দৃষ্টিকে আড়ালে রাখা, যাতে অন্তর্দৃষ্টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হোটেলে পৌঁছেই আমার ভীষণ ঘুম পেল। কিন্তু ঘুমানো তো চলবে না, তাই অল্প কাগজ আর একটা পেন্সিল চেয়ে নিয়ে আমি সেই কাগজ নিকটে রেখে পেন্সিল হাতে আচ্ছন্নের মতো শুয়ে রইলাম। তারপর যখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম, তখন দেখলাম যা জানতে চেয়েছি তা জানতে পেরেছি।
এই অদ্ভুত জবাবদিহিও রেক্স সহজভাবেই গ্রহণ করলেন, অথচ ক’দিন আগে হলে একে তিনি নেহাত আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতেন। যাই হোক ট্যানিথ যখন নিরাপদে আছে তখন তাঁকে এখন সাইমনের কাছে যেতে হবে। কিন্তু সে কথা শুনে ট্যানিথ বললেন, না না, তা হয় না, তাহলে ‘আমাকেও সেখানে নিয়ে চল, নইলে মোকাটা নিশ্চয়ই আমাকে এসে নিয়ে যাবেন, তাঁকে বাঁধা দেওয়ার শক্তি আমার নেই। এবং আমাকে এখানে একা রেখে যাওয়াটা শুধু আমার পক্ষে নয়, তোমার বন্ধু সাইমনের পক্ষেও অত্যন্ত বিপজ্জনক। মোকাটা এসেই প্রথমে আমাকে আচ্ছন্ন করবেন, তারপর আমাকে মাধ্যম করে সাইমনকে এখানে টেনে আনা—তার পক্ষে এ কাজ কিছুই নয়।
তখন রেক্স বাধ্য হয়েই এখানে থেকে যেতে রাজি হলেন। আশ্বস্ত হলেন ট্যানিথ
রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, এসব কাজের মাধ্যম হিসাবে তোমাকে কেন, মোকাটা তো যে কোনো কাউকেই ব্যবহার করতে পারতেন, যেমন মাদাম দুৰ্ফে?
এর কারণ, তাঁর আর আমার মধ্যে একটা আশ্চর্য যোগসূত্র আছে। তাঁর মতো আমারও নম্বর কুড়ি!
তার মানে?
এ হচ্ছে ভাগ্য গণনার ব্যাপার। A থেকে Z পর্যন্ত প্রত্যেকটা অক্ষরের একটা করে সংখ্যা আছে, যেমন– A = 1, B = 2, C = 3, D = 4, E = 5, F = 8, G = 3, H = 5, I বা J = 1, K = 2, L = 3, M = 4. N = 50 = 7, P = 8, Q = 1. R = 2, S = 3, T = 4, U = 6, V = 6, W = 6, X = 5, Y = 1, Z = 7। সুতরাং দেখা যাচ্ছে
M = 4
O = 7
C = 3
A = 1
T = 4
A = 1
——–
20
T = 4
A = 1
N = 5
I = 1
T = 4
H = 5
——–
20
তাহলে বুঝতে পারছ আমাদের দু’জনের মধ্যে কত সাদৃশ্য। এবং এই কারণেই আমাকে মাধ্যম করা ওঁর পক্ষে সহজ। আচ্ছা, এবার সাইমনের ব্যাপারটা দেখা যাক।
S = 3
I = 1
M = 4
O = 7
N = 5
——-
20
সাদৃশ্য লক্ষ্য করে অত্যন্ত অবাক হলেন রেক্স। তারপর তাঁর নিজের, রিচার্ডের, দ্য রিশলোর আর মেরী লাওয়ের নম্বর নিয়ে দেখা গেল তা ওঁদের সঙ্গে মিলছে না।
রেক্সের এসব ব্যাপার সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। একবার ভাবলেন ট্যানিথকে রিচার্ডের বাড়িতে নিয়ে গেলে কেমন হয়,—নিশ্চয় তাঁরা ট্যানিথকে ফিরিয়ে দেবেন না। কিন্তু সে মতলব তাঁর পছন্দ হল না। ট্যানিথের অনুরোধে তিনি ঠিক করলেন রাতটা ট্যানিথের সঙ্গে সেখানেই কাটাবেন। তখন দু’জনে খিড়কির দরজা দিয়ে বাগানে চলে গেলেন। মে মাসের অপূর্ব বিকেল। দু’জনে খুব ক্লান্ত ছিলেন, বসে পড়লেন এক জায়গায়।
হঠাৎ রেক্স, বলে উঠলেন, তুমি তো আমাকে ভালোবাসো ট্যানিথ, তাই না?
হ্যাঁ রেক্স, কিন্তু তুমি যেন আমাকে ভালোবাসো না, বলছি তো, আমার আয়ু আর বেশিদিন নেই, এই বছরের মধ্যেই আমার মৃত্যু হবে
না, কক্ষনো না! শয়তান মোকাটার প্রভাব অবশ্যই আমরা কাটাতে পারব—মানে, ডিউক নিশ্চয় পারবেন।
ট্যানিথ বললেন, না রেক্স, এ ব্যাপারে ডিউকের কিছুই করার নেই, এ আমার অদৃষ্টের লিখন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত ট্যানিথের চোখ বুজে গেল। তিনি গভীর ঘুমে ডুবে গেলেন।
এ দিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। রেক্সের ভাবনা হল, যদি রাত্রে না ফেরেন তবে রিচার্ডের বাড়িতে ওঁরা কী ভাববেন কে জানে। এদিকে অন্ধকার নেমে এল, তখনও ট্যানিথ ঘুমে আচ্ছন্ন, অথচ বনের মধ্যে তাঁরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই।
ডিউক যখন ফিরলেন তখন বাজে বেলা পৌনে ছটা। মোকাটার গল্প শুনলেন। কিন্তু তাতে অবাক হলেন না; এবং যখন শুনলেন রেক্স গ্রামে গেছেন এবং তখনও ফেরেননি, অত্যন্ত দমে গেলেন তিনি। বললেন, রেক্সের একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকা উচিত ছিল। এক্ষুনি ফোন করতে হবে।
কিন্তু, ফোন করে শুধু জানা গেল তিনটে নাগাদ এক মহিলা সেখানে এসেছিলেন, এবং এক আমেরিকান ভদ্রলোক কিছুক্ষণ পরেই এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। তারপর তাঁরা বাগানে যান, কিন্তু সেই থেকে আর তাঁদের দুজনের এক জনকেও দেখা যায়নি।
অত্যন্ত ঘাবড়ে গেলেন ডিউক। সাইমন উপরে ফ্লাওয়ারের কাছে আছেন শুনে গেলেন সেখানে। বললেন, ফ্লাওয়ারের প্রভাব সাইমনকে রক্ষা করার ব্যাপারে বিশেষ সাহায্য করবে। এ হেন পরিস্থিতিতে পবিত্র কুমারীরা অত্যন্ত শক্তিশালী হয় এবং সেই কুমারী যত অল্পবয়সী হয় তার শক্তিও ততই বেশি হয়। ফ্লাওয়ারের মতো ছোট মেয়ে যার প্রার্থনা করার বয়স হয়েছে, অশুভের বিরুদ্ধে তার প্রভাব অত্যন্ত অধিক হয়ে দেখা দেবে। মনে নেই যীশুখ্রিস্টের কথা ‘যদি শিশুর মতো সরল হতে না পারো তো স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।’ কী, এতে কোনো আপত্তি আছে, রিচার্ড?
না, কিছু না। সাইমনের কল্যাণ প্রার্থনা করলে কেন ওর কোনো অনিষ্ট হবে? চলুন লাইব্রেরির ভিতর দিয়ে যাই।
আটকোণা লাইব্রেরি ঘরের সাত দিকেই ছাদ পর্যন্ত উঁচু বইয়ে ঠাসা আলমারি, আর একটা দিকে বড় বড় জানালা।
ফ্লাওয়ারের ঘরে তাকে পাওয়া গেল না, সে ছিল স্নানঘরে, সাইমন স্নান করাচ্ছিলেন তাকে।
কাছে গিয়ে ডিউক জিজ্ঞাসা করলেন, কী গো, মা কি প্রত্যহ রাত্রে শোনে যখন তুমি প্রার্থনা কর?
হ্যাঁ রোজই।
তা, তুমি কি কোনোদিন মাকে প্রার্থনা করতে শুনেছ?
না তো! আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর মা বাবাকে শুনিয়ে প্রার্থনা করে।
আজ রাত্রে কিন্তু আমরা সক্কলে, এক সঙ্গে প্রার্থনা করব। সবাই হাঁটু গেড়ে গোল হয়ে বসব আর সাইমন কাকা মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসবে। কেমন, ভালো হবে না?
হ্যাঁ, খুব ভালো হবে।
সবাই তখন মেরীর বসবার ঘরে গেলেন। রেক্সের কোনো খবর মিলল না, টেলিফোন করেও জানা গেল না।
ডিউক বললেন, আজ একটু সময় থাকতে সান্ধ্য আহার সারতে হবে। তবে নৈশাহারটি হবে যথাসময়ে। তারপর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে চাকরেরা কেউ এ রাত্রে বাড়ির এই অংশে না আসে।
এবং সাইমনের কথায় সায় দিয়ে ঠিক হল, টেলিফোনটাও আজ রাতের মতো কেটে দেওয়া হনে।
রিচার্ডের আলৌকিক ব্যাপারে কোনোরকম বিশ্বাস ছিল না। ডিউক কিছু কাহিনি শোনালেন এবং মেরীও সাইবেরিয়ারর কিছু ডাইন-ডাইনীদের গল্প শোনালেন। তাতে রিচার্ডের অবিশ্বাসে খানিকটা আঘাত লাগলেও তা একেবারে দূর হল না।
আটটা বাজল, গোধূলি নেমে আসতে আরম্ভ করেছে। বাগানের দূর প্রান্তের গাছের তলা ছায়ায় ঢেকে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁদের নতুন করে ভয় পাওয়ার মতো কিছু হল না।
যথাসময়েই রাত্রের আহার সাজানো হয়েছিল, সবাই গিয়ে বসলেন, রাত্রের আহার সেরে সবাই গেলেন লাইব্রেরিতে। ডিউক বললেন, ঘরটাকে যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে; বিশেষ করে মেঝেটা।
আবার সরাইখানায় ফোন করা হল, কিন্তু রেক্সের কোনো খবরই পাওয়া গেল না। তারপর টেলিফোন সংযোগ কেটে দেওয়া হল।
প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ওই অবস্থায় যথাসাধ্য করা হল। ডিউকের একটা ব্যাপারেই মন খুঁত খুঁত করছিল, যে পবিত্র জলের জন্যে তিনি গিয়েছিলেন তা পাননি। তাঁর চেনা পুরোহিত ছিলেন না।
রিচার্ড বললেন, ধূসর চক্ষু, এই যে কবচের কথা শুনি তার কথা একটু বলুন না।
আচ্ছা বেশ। ওসাইরিসের গল্প জান, – জান কেমন করে ওসাইরিসের মৃত্যু হয়েছিল? জান না? তাহলে শোন। ওয়াইরিস ছিলেন রাজা এবং দেবতা। প্রচুর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি রাজ্য শাসন করতেন, তাঁর ছিল এক ভাই, তাঁর নাম সেট আর তাঁর রানীর নাম আইরিস। সেই ছিলেন শয়তান রাজ্যলোভী। ওয়াইরিসকে হত্যা করার এক অভিনব উপায় তিনি আবিষ্কার করেন। একটা অতি সুন্দর কাফন তিনি তৈরি করান, অত চমৎকার কাফন কেউ কখনও দেখেনি। তিনি ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তির ঠিক এই কাফনের মাপের শরীর হবে তাকেই এটা দেওয়া হবে। কাফনের লোভে অনেকেই এসে কাফনে শুয়ে দেখলেন, কিন্তু কারোরই শরীর ঠিক মাপের হল না। তখন সেট ওসাইরিসকে কাফনে ঢুকে শুয়ে পড়তে বললেন, এবং দেখা গেল, সেটা ঠিক তাঁর মাপের হয়েছে। সেট তৈরি হয়েই ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লোকজন ওসাইরিসকে বেরিয়ে আসার সুযোগ না দিয়েই ডালাটা গলানো সীসে দিয়ে খুব মজবুত করে বন্ধ করে দিল। দম বন্ধ হয়ে ওসাইরিসের মৃত্যু হল। যেহেতু ওসাইরিস ছিলেন দেবতা তাই তাঁকে মারলে যদি রক্তপাত হত তাহলে মহা অনর্থ দেখা দিত। কিন্তু সেট বিনা রক্তপাতেই কাজ হাসিল করলেন। তখুনি তিনি দলবল নিয়ে সিংহাসন দখল করতে গেলেন।
কিন্তু আইরিস সময় থকতে খবরটা পেয়েছিলেন। কোনো রকমে পালালেন তিনি।
পরদিন সকালেই সেটের আদেশে কাফনটা নীল নদের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল।
কিন্তু আইরিস কাফনটা উদ্ধার করলেন, তারপর প্যাপিরাসের জলাভূমিতে কাফন সুদ্ধু তিনি লুকিয়ে থাকলেন, কারণ তখন আর সমাহিত করার সময় ছিল না।
খবরটা যখন সেটের কাছে পৌঁছল, তিনি স্থির করলেন যেমন করেই হোক আইরিসকে হত্যা করবেন। তারপর ওসাইরিসের দেহ একেবারে নষ্ট করে দেবেন, যাতে সমাধি দেওয়া না সম্ভব হয়।
মাসের পর মাস অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সেট কাফনটা উদ্ধার করতে পারলেন না। একদিন রাত্রে সেট তাঁর শয়তান সঙ্গীদের সঙ্গে শিকারে বেরিয়েছেন। ঘোড়ার খুরের শব্দে আইরিস লুকিয়ে পড়েছিলেন। শিকারীদের একজন কাফনটা দেখতে পায় এবং সেটাকে ওসাইরিসের কাফন বলে চিনতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে কাফন ভেঙে তারা ওসাইরিসের দেহ টেনে বার করে। সেট সেটাকে চৌদ্দ টুকরো করে ফেলেন এবং সেইসব টুকরো রাজ্যের দুর দূর অঞ্চলে নিক্ষেপ করেন, যাতে কোনোভাবেই একত্র করা সম্ভব না হয়।
আইরিস ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা, গোপনে থেকে সব দেখলেন।
এর অনেক বছর পরে আইরিসের পুত্র মহান দেবতা থোরাক্স, যিনি ছিলেন আলোর দেবতা, সেটের প্রতারণার ফলে যে অন্ধকারের আবরণে পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল তা তুলে ফেলে দেশের রাজা হলেন। তখন আইরিস স্বামীর খণ্ডিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্যে সারা দেশ খুঁজে বেড়ালেন, এবং যেখানে যেটা পেলেন সেখানেই সমাহিত করে তার উপর একটা করে বড় মন্দির স্বামীর স্মৃতিতে রচনা করলেন। সবসুদ্ধু তেরটা খণ্ড তিনি পেলেন, কিন্তু চতুর্দশতম খণ্ডটা কোথাও পেলেন না। সেই খণ্ডটা সেট সযত্নে পবিত্র করে রেখে দিয়েছিলেন। এবং ঠিক এই কারণেই থোরাক্স তিন তিন বার যুদ্ধে সেটকে পরাস্ত করলেও বধ করতে পারেননি।
গূঢ় তত্ত্বের ইতিহাসে জানা যায় যে এই হারানো অঙ্গের কথা অনেক বার শোনা গেছে, এবং যুগ যুগের ইতিহাসে অনেকবারই তার হদিশ হারিয়ে গেছে, এবং যখনই আবার পাওয়া গেছে তার ফলে পৃথিবীতে মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে। এবং বিশেষ করে সেই কারণেই আমাদের প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে যাতে মোকাটা কোনোমতেই সেই সেটের কবচ না পেতে পারেন।
ডিউকের কাহিনী শেষ হল। তারপর তিনি বললেন, এবার সবাই মন দিয়ে শোন যা বলছি। ঠিক কিভাবে যে আক্রমণ আসবে তা বলতে পারি না, এবং হয়তো আক্রমণ আদৌ নাও আসতে পারে। তবে, মোকাটা বলে গেছেন তিনি যেমন করে হোক সাইমনকে নিয়ে যাবেন, এবং তিনি যে মিথ্যে ভয় দেখাননি তা আমি বিশ্বাস করি। সে জন্যে আমরা ঘরটা যথাসম্ভব পরিষ্কার করে রেখেছি, মন্ত্রপূত করে তুলেছি। হয়তো এমন কোনো মহা আতঙ্কের দৃশ্য আমাদের দেখতে হবে যার সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। হয়তো সবথেকে যা ভয়ঙ্কর তাকেই সে পাঠিয়ে দিয়ে সাইমনকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। কিংবা হয়তো তার আক্রমণ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নেবে। হয়তো তার প্রভাব আমাদের ভিতর থেকেই আসবে, হয়তো তখন আমরা বলব মিথ্যেই এত কষ্ট করে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছি, দিব্যি আরামে ঘুমোতে গেলেই ভালো হয়। মনে রাখবে, যদি কারও মনে অমন ভাবের উদয় হয় তো বুঝবে তা মিথ্যে। সব থেকে বড় আঘাত হয়তো সাইমনের উপরেই পড়বে, তাকে আমরা রক্ষা করবই যেমন করে হোক। প্রয়োজন হলে বা-প্রয়োগেও ক্ষান্ত হবো না। ইতিমধ্যে আমরা সর্বদাই প্রার্থনা করে চলবো। শুয়ে পড়লেন সবাই, বাতিগুলো জ্বলতে থাকল। এ হেন অবস্থায় ঘুম অসম্ভব, কিন্তু তবুও কেউ কোনো কথা বললেন না।
কোথা থেকে একটা ঘড়ির টিক-টিক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অগ্নিস্থান থেকে কাঠ ফাটার আওয়াজ আসছে। শেষ পর্যন্ত রাতের ছোট ছোট আওয়াজে তরঙ্গগুলোও বন্ধ হয়ে গেল, নেমে এল এক নিবিড় স্তব্ধতা।
পরম লারামে ট্যানিথ নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছেন। এ ঘুম হল ক্লান্তির, অবসন্নতার, রেক্স তখন দেখলেন ঘড়িতে আটটা বাজে। ভাবলেন নিশ্চয় ইতিমধ্যে ডিউক ফিরে এসেছেন, তিনি যে জীবনের শেষ শক্তি দিয়েও মোকাটার সঙ্গে লড়বেন সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহমাত্র নেই।
অন্ধকার নেমেছে। স্তব্ধ বনে গাছগুলো হয়ে উঠেছে অস্পষ্ট। ইতিমধ্যে তাঁরও ঘুম পেয়েছে, কিন্তু তিনি ঠিক করেছন কিছুতেই ঘুমোবেন না।
ঘণ্টাখানেক পরে ট্যানিথ জেগে উঠলেন, তাকালেন চোখ পিটপিট করে। বললেন, রেক্স, আমরা কোথায়? কী দুঃস্বপ্নই না দেখলাম!
আমরা সরাইখানার বাগানে। চল এবার ঘরে ফিরি, দেখি কিছু খাবার পাওয়া যায় কি না। ফিরে গিয়ে বন্ধুদের খবর নেবার জন্যে টেলিফোন করতে চাইলেন, কিন্তু এক্সচেঞ্জ থেকে শুনলেন ওখানকার লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। তখন সরাইয়ের কর্তার দাক্ষিণ্যে খাওয়া জুটল। কর্তা বললেন তাঁর এখানে খুব ভালো মদ আছে।
রেক্সের ডিউকের কথা মনে পড়ে গেল—মদ আর মাংস চলবে না। কিন্তু গত দু’দিন ধরে শরীরের উপরে যেরকম ধকল গেছে তাতে একটু মদ না খেলে ক্লান্তি সহজে যাবে না। এই ভেবে আপত্তি করলেন না।
খাওয়া দাওয়া সেরে রেক্স আবার ডিউকদের টেলিফোনে পেতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেই একই উত্তর, লাইন কাটা।
কথায় কথায় রেক্স বুঝতে পারলেন ট্যানিথের আতঙ্ক এখনও কাটেনি।
তিনি বললেন, এত ভয়ের কী আছে ট্যানিথ? ও কি তোমাকে হত্যা করবে?
মৃত্যুকে আমি বেশি ভয় করি না। তাছাড়া আর ক’দিনই বা আমার আয়ু আছে। আমার ভয় যদি উনি মৃত্যুর পরেও আমার আত্মাকে কলুষিত করেন। কোনো বিশেষভাবে হত্যা করার পর মোকাটার মতো মানুষের পক্ষে আমাকে সাধারণের চোখে মৃত প্রমাণ করলেও আত্মাকে বেঁচে থাকতে হবে ভ্যাম্পায়ার হয়ে—শুনেছ তো ভ্যাম্পায়ারের কথা?
হ্যাঁ, বইয়ে পড়েছি। রোজ রাত্রে তারা খবর থেকে উঠে এসে মানুষের রক্ত পান করে তাই তো? কবর থেকে তাদের তুলে মাথা কেটে ফেলে হৃৎপিণ্ডে কাঠের শূল গেঁথে দিতে তবে আত্মা মুক্তি পায়। কিন্তু সত্যিই কি ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু আছে, তুমি বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ করি। অসংখ্য গল্প শোনা যায় ভ্যাম্পায়ারের সম্বন্ধে কার্পাথীয়ানদের দেশে, যেখান থেকে আমি এসেছি, তা ছাড়া পোল্যান্ডে, হাঙ্গারিতে আর রোমানিয়াতেও। ও অঞ্চলের মানুষের কাছে শুনবে। কবর দেওয়ার বেশ কয়েক মাস পরেও ওদের দেহে কোনো ক্ষয়ের চিহ্ন দেখা যায় না। এবং চোখের দৃষ্টিতে ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে। এমনকি কখনও কখনও তাদের কষ বেয়ে রক্তের দাগ পর্যন্ত চোখে পড়ে। ওই এক ভয়, তা ছাড়া আর আমার কোনো ভয় নেই।
রেক্সের শরীর শিউরে উঠল। বললেন, এ বিষয়ে নিশচয়ই ডিউক আরও ভালো করে বলতে পারবেন, এবং যাতে তুমি মোকাটার খপ্পরে না পড় সে ব্যবস্থাও তিনি নিশ্চয় করতে পারবেন।
এমন সময় কোনো ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজল। টানিথ বলে উঠলেন, এই আরম্ভ হল মে মাসের ২রা তারিখ। সেটা হল আমার জন্মদিন—মহা আশঙ্কার দিন। আজ রাতে তুমি মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে থাকবে না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাই হবে। ছেড়ে থাকব না, এবং দু’জনের একজনও ঘুমাবো না। ট্যানিথ অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। বললেন, যাই উপরে গিয়ে নাকে একটু পাউডার লাগিয়ে আসি। এক্ষুনি ফিরে আসব।
বাঃ এই না কথা হল দু’জনে একত্রে থাকব? ঠিক আছে এজন্যে, তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি, আর বেশি নয় কিন্তু, তার মধ্যে যদি না ফেরো তো আমি, কিন্তু উপরে যাব।
ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে ট্যানিথ উপরে উঠে গেলেন চুপচাপ বসে রেক্স ‘কার্ডিন্যালস্ ফলি’-র বন্ধুদের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ সময় পার হয়ে গেল ট্যানিথের ফিরে আসার কথা। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মাত্র দু’মিনিট হয়েছে। গত ক’দিনের কত কথাই মনে পড়ছে : মাদাম দ্য উর্যের চুরুট খাওয়ার কথা, তারপর আবার ফিরে ট্যানিথের কথা।
রেক্সের একটুও ঘুম পায়নি। সে আধো অন্ধকারে তিনি কতক্ষণ বসে ছিলেন তার খেয়াল নেই। তাঁর প্রহরায় প্রথম দিকটার হয়তো কোনো অদ্ভুত শক্তি তাঁর দৃষ্টিতে বিভ্রম সৃষ্টি করেছিল। ঘড়ি ঠিকই যথারীতি এগিয়ে গিয়েছিল, যদিও তাঁর মনে হয়েছিল যেন বেজায় আস্তে আস্তে চলছে। যাই হোক যে চোখ দুটি ছায়া থেকে তাঁর উপর লক্ষ্য রাখছিল তার পরে আর তাঁর কিছুই মনে নেই, গভীর ঘুমে তিনি অদ্ভুত হয়ে পড়েছিলেন।
এদিকে কার্ডিন্যালস ফলিতে সবাই শুয়ে পড়েছেন। ডিউক একটা গণ্ডী কেটেছিলেন, বলেছিলেন কোনোমতেই যেন কেউ এই গণ্ডীর বাইরে না যায়। গণ্ডীর কেন্দ্রের দিকে মাথা করে তাঁরা সবাই শুয়েছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। কত চিন্তা তাঁদের মনে। কিন্তু সব থেকে অস্থির রিচার্ড স্বয়ং। তিনি ছিলেন ভোজন বিলাসী। তার উপর এসব ব্যাপারে তাঁর অবিশ্বাস এখনও কাটেনি। ছটফট করতে করতে তিনি এক সময় আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, ধেত্তেরি আমি উপরে চলে যাচ্ছি, এসব আমি একটুও বিশ্বাস করি না।
ডিউক বুঝলেন অবিশ্বাসী বলে মোকাটার প্রভাব তাঁর উপরেই বেশি করে পড়েছে—এ যে মোকাটার প্রভাবের ফল সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহমাত্র রইল না। তিনি বললেন, বন্ধ রিচার্ড, হয়তো তোমার কথাই ঠিক, মিথ্যেই আমরা ভয় পেয়ে এত কষ্ট করছি, ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে আসলে কিছু নেই। কিন্তু তাহলেও আমরা যে ভয় পেয়েছি এটা তো ঠিক, তাই অন্তত বন্ধুত্বের খাতিরে আজ রাত্রে তুমি এই গণ্ডীর বাইরে যেও না।
রিচার্ড এ কথায় আর কী করবেন, মৃদু হেসে রাজি হয়ে গেলেন।
সবাই তখন পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে রইলেন।
দলের মধ্যে সব থেকে দুর্বল হিসেবে সাইমনকেই ডিউক বিশেষ করে লক্ষ্য করতে লাগলেন। দু-হাঁটুতে হাত রেখে তিনি বইয়ের সারির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। যদিও কিছুই তাঁর চোখে পড়ছে না, ডিউকের মনে হল যেন তিনি কান পেতে কিছু শুনতে চেষ্টা করছেন। হঠাৎ একটা ধরা গলায় সাইমন বলে উঠলেন, বেজায় তেষ্টা পেয়েছে জল পান করব।
ডিউক খুব কষ্ট করে হাসি চাপলেন, একে মোকাটার আরও একটা ছোটখাটো প্রভাব বলে বুঝতে তাঁর অসুবিধে হল না। গণ্ডীর মধ্যেই ডিউক জল রেখেছিলেন, এক গ্লাস জল তিনি সাইমনকে দিলেন।
জলে একটু চুমুক দিয়েই সাইমন বলে উঠলেন, একি রিচার্ড, তোমরা কি কুয়োর জল খাও? এ জল যেমন বিস্বাদ তেমনি বাসি?
ডিউক বুঝলেন কোথা থেকে আক্রমণটা আসছে। সাইমনের গ্লাসটা নিয়ে তিনি একটা পাত্রে রাখা জল বড় জগটায় টেনে সাইমনকে দিলেন। মাত্র কয়েক ফোঁটা জল পাত্রটায় ছিল। তারপর সেই জল সাইমনকে পান করতে দিলেন। এবার আর সাইমনের কোনো আপত্তি হল না। বললেন আগের জলটাও হয়তো ভালোই ছিল। কল্পনাতেই আমি সেটাকে খারাপ মনে করেছিলাম।
এরপর অনেক সময় কেটে গেল। কোথায় যেন একটা ইঁদুর শব্দ করছিল, আওয়াজটা একটু জোরেই হচ্ছিল। শব্দটা এমন একঘেয়ে লাগছিল যে মেরীর স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠল, তিনি চিৎকার করে উঠতে উপক্রম করলেন। তবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আওয়াজটা বন্ধ হল। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় জানালার কাঁচেও বৃষ্টির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না, নতুবা তাতেও একটা স্বাভাবিক ঘটনার পরিচয় মিলত।
মনে হল যেন রাতের পর রাত তাঁরা সেখানে বসে আছেন, সামান্য খাওয়াদাওয়া যা করেছেন তারপরে যেন কত দিন কেটে গেছে। তাঁদের ক্লান্ত দেহে ঘুম নেমে আসছে। শুয়ে পড়লেন রিচার্ড যদি একটু ঘুমোতে পারেন, কেবল ডিউকই সজাগ রয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। তিনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। আর সেইসঙ্গে তাঁর দৃষ্টি ছাদের উপর পড়ল, তাঁর মনে হল যেন আলোর ঔজ্জ্বল্য কমে গেছে, হয়তো এ তাঁর কল্পনা হতে পারে, তাই তিনি জাগালেন সকলকে। ডিউক কেন তাঁকে স্পর্শ করেছেন তা বুঝতে পেরে সাইমনও তাঁকে সমর্থন করলেন। তারপর সবাই তাকালেন কার্নিসের দিকে। যেখান থেকে আলো আসছিল।
আলোর এই কমে আসা এতই ধীরে ধীরে হচ্ছিল যে তা উপলব্ধি করাই কঠিন হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, যেন তাঁরা ভুল দেখছেন। কিন্তু না, ভুল নয় বলেই পরক্ষণে মনে হল,—এমন কয়েকটা জায়গায় ছায়া দেখা দিল যেখানে আগে ছায়া ছিল না। সত্যিই আলো তাঁদের চোখের নিকটেই ক্ষীণ হয়ে চলেছে।
বইয়ের আলমারির ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠছে, ছাদের মাঝখানটা ধূসর হয়ে উঠল। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে তাঁরা লক্ষ্য করলেন ঘরটা একটু একটু করে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে, সম্পূর্ণ চুপিসারে ছাদের ছায়া প্রলম্বিত হচ্ছে, তাকের বইগুলো হয়ে উঠছে অস্পষ্ট। অবশেষে দেখা গেল যেন এরমধ্যে যুগ যুগ কেটে গেছে, দেখা গেল সব আলো নিবে গেছে, কেবল মাত্র বইয়ের তাকের উপরকার বাতিগুলো ছাড়া, সেগুলোর থেকে সামান্য আলো আসছে, তা ছাড়া আর কোনো আলো নেই। হঠাৎ কেঁপে উঠলেন রিচার্ড, বলে উঠলেন, উঃ কী শীত! ডিউকও ঘাড় নেড়ে তা মেনে নিলেন। কাঁধের পিছনে তিনি প্রথম সেই শৈত্য প্রবাহ অনুভব করলেন, যেখান থেকে তা আর সবদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই অচেনা অজানার মুখোমুখি হতে চকিতে তিনি ফিরলেন।
কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। কেবল বইয়ের আবছায়া ছাড়া। বাতির শিখাগুলোও সেই অদৃশ্য হাওয়ায় নেচে যেতে থাকল। ডিউক প্রার্থনা শুরু করলেন। তখন সেই হাওয়াটা বন্ধ হল বটে, কিন্তু অপর এক কোণ থেকে নতুন উৎসাহে বইতে শুরু করল। সেদিকে ফিরলেন, কিন্তু তক্ষুনি আবার তা তাঁর পেছন দিয়ে বইতে লাগল।
সেই অপবিত্র হাওয়া গণ্ডী ঘিরে ঘুরছে, সেই সঙ্গে নিচু গলায় একটা কান্নার আওয়াজও তাঁদের কানে এসে প্রবেশ করল। বাতাসের বেগ ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠেছে। মেরু অঞ্চলের শৈত্য সেই হাওয়ায়, সেই শীত যেন অদৃশ্য আঙুলে তাঁদের টুকরো টুকরো করতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত তা প্রায় প্রচণ্ড তুষার ঝঞ্ঝায় পর্যবসিত হল। আলোগুলো একটু দপ্ দপ্ করেই একেবারে নিবে গেল।
রিচার্ডের অবিশ্বাস এই ব্যাপারে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। মেরীকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি একটা দেশলাই জ্বেলে নিকটবর্তী মোমবাতিটা ধরালেন। তারপর পরেরটা ধরাতে যাবেন, সঙ্গে সঙ্গে শয়তান কনকনে হাওয়াটা এসে মোমবাতিটা আবার নিবিয়ে দিল। পুনরায় একটা কাঠি জ্বালালেন, কিন্তু সেটা সঙ্গে সঙ্গেই গেল নিবে। তারপর আর একটা—কিন্তু কোনোটাই জ্বলল না।
পলকের জন্যে সাইমনের মুখ তাঁর চোখে পড়ল। সে মুখে রক্ত নেই, চোখের মণিদুটো অস্বাভাবিক ভাবে ঠেলে আসছে। তিনি হাঁটু গেড়ে বসলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মাঝখানকার সব আলো গেল নিবে, অন্ধকারে ডুবে গেল ঘরটা।
এস সবাই হাতে হাত দিয়ে থাকি, ডিউক বলে উঠলেন, তাড়াতাড়ি—এর ফলে আমাদের প্রতিরোধ জোর পাবে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন গণ্ডীর মাঝখানে তাঁরা বৃত্তাকারে দাঁড়ালেন, হাতে হাত রেখে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে।
যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল ঝড়টা থেমেও গেল তেমনি আচমকা। আবার এক অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। আর তারপরেই সম্পূর্ণ আকস্মিকভাব এক অপ্রতিরোধ্য কাঁপুনি মেরীকে পেয়ে বসল।
সামলে নাও মেরী, রিচার্ড আরও জোরে হাত চেপে ধরে বললেন—এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে। তিনি ভেবেছেন বুঝি মেরী শীতেই কাঁপছেন—শীত সকলের পোশাকে ভেদ করে শরীরে প্রবেশ করেছিল। আসলে কিন্তু তখন মেরীর দৃষ্টি অগ্নিস্থানের উপর নিবদ্ধ ছিল- তাঁর দুটি হাঁটু ভীষণভাবে কাঁপছে—তোতলাতে তোতলাতে বললেন, দেখ দেখ আগুনটা!
সবাই তাকিয়ে দেখলেন, কী দেখে মেরী অমন ভয় পেয়েছেন। যে সব কাঠ ওখানে জমা ছিল সবই জ্বলে উঠেছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে সে সবই নিবে গেছে এবং তারপর তাঁদের চোখের সামনেই টকটকে অঙ্গারগুলো সব কালো হতে শুরু করেছে। যেন কোনো দৈত্য অদৃশ্য হাত দিয়ে চেপে নিবিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই আর একটুও আলো সেখানে দেখা গেল না।
প্রার্থনা কর—সবই প্রার্থনা কর। ডিউক বলে উঠলেন। তাঁদের চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। তবে কার্নিসের ইলেকট্রিক বাতিগুলো যে একেবারে নিবে গেছে তা নয়, দপ্ দপ্ করছে, যে কোনো সময়েই নিবে যেতে পারে।
এমন সময় জানলার কাঁচে যেন কামানের আওয়াজ হল, স্তব্ধতা ছিন্ন করে সেখানে জোরে জোরে ধাক্কার আওয়াজ শোনা গেল।
কে? রিচার্ড জিজ্ঞাসা করলেন।
চুপচাপ যেমন আছ থেকে যাও। ডিউক বললেন।
হঠাৎ বাইরে থেকে বাগানে একটা শব্দ শোনা গেল। সে গলা সকলেরই পরিচিত, তা রেক্সের।
আলো জ্বলছে দেখছি। এসে খুলে দাও।
স্বস্তির শ্বাস ফেলে রিচার্ড এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ডিউক ঘাড় ধরে তাঁকে বাধা দিলেন—বোকামি কোরো না, এ নির্ঘাত একটা ফাঁদ!
এস, খুলে দাও, দেরি করছ কেন? তাড়াতাড়ি কর—প্রচণ্ড ঠান্ডা এখানে! রেক্সের গলা আবার শোনা গেল।
ব্যাপারটা যে ভৌতিক, রিচার্ড ছাড়া সবাই তা উপলব্ধি করলেন। রেক্সের কণ্ঠস্বরের অমন নিখুঁত অনুকরণ শুনে মহা আতঙ্কে শিউরে উঠলেন সবাই। কারোরই বুঝতে দেরি হল না, এর উদ্দেশ্য, প্রতিরোধ ভাঙন ধরানো। আবার সেই স্বর, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, রিচার্ড, আমি রেক্স বলছি, রেক্স! এ কী পাগলামি হচ্ছে—খুলে দাও বলছি। কিন্তু চারজনের কেউ একটুও নড়লেন না বা সাড়া দিলেন না।
কণ্ঠস্বরটা আর শোনা গেল না, আবার দীর্ঘ সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এল। ডিউকের মনে হল শত্রুপক্ষ সময় নিচ্ছে শক্তি সঞ্চয় করার জন্যে, এবার সোজাসুজি আক্রমণ করবে, এবং এই ব্যাপারটাকেই তাঁর আবার বেশি ভয়, এ আত্মবিশ্বাস তাঁর ছিল যে তাঁর যা বুদ্ধি তাতে অন্যদের সহযোগিতা পেলে এসব বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু পবিত্র জলটা সংগ্রহ করতে না পারায় তিনি একটু অসুবিধেয় পড়তে পারেন, প্রতিরক্ষার অন্যান্য যে সব ব্যবস্থা নিয়েছেন চরম মুহূর্তে হয়তো তা যথেষ্ট নাও হতে পারে।
ও কী, কী ও! সাইমন চিৎকার করে উঠলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সবার দৃষ্টি ঘরের কোণের নতুন বিভীষিকার দিকে নিবদ্ধ হল। দেখলেন ছায়াগুলো এক সঙ্গে হয়ে নিবিড়তর তিমিরের সৃষ্টি করতে চলেছে।
কি একটা বস্তু নড়ছে সেখানে। অন্ধকারে ফসফরাসের মতো একটা আলো তাঁদের চোখে পড়ল, তার বহিঃরেখা ক্রমেই হতে থাকল স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর। সে আলো কোনো মানুষের বা কোনো জন্তুর নয়, যেন এক অতিকায় জীবন্ত বস্তুর, যা সেখানে রয়েছে! তার না আছে মুখ না আছে চোখ, কিন্তু অত্যন্ত অমঙ্গলসূচক এক আভা সেখান থেকে বিকিরিত হচ্ছে।
হঠাৎ তার মধ্যে আর ভূতুড়ে ভাবটা রইল না। দেখা গেল বস্তুটির চামড়া সাদাটে, কুষ্ঠরোগীর মতো অপবিত্র মেরুদণ্ডহীন বস্তুটি থেকে শয়তানি উপছে পড়ছে, ঘায়ের আর কলুষ্যের বীভৎস গন্ধে ঘর ভরে উঠল। বস্তুটি যত ঘুরছে ততই এক বিষাক্ত তরল পদার্থ তা থেকে নির্গত হয়ে পালিশ করা মেঝের উপর দিয়ে একাধিক ধারায় গড়িয়ে চলেছে। বস্তুটি অবাস্তব নয়, জীবন্ত তারপরই হঠাৎ বস্তুটি বিদ্রূপের চাপা হাসি হেসে উঠল।
হাতের পিছন দিয়ে মুখ চেপে মেরী রিচার্ডের একেবারে গা ঘেঁষে বসলেন। রিচার্ডের চোখের পাতা পড়ছে না। মুখে ঠান্ডা ঘাম দেখা দিচ্ছে। ডিউক শয়তানির চরম প্রকাশ বলে বুঝতে পারলেন ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন শেষ পর্যন্ত।
সঙ্গে সঙ্গে বস্তুটি বেড়ালের মতো তৎপরতার সঙ্গে নড়তে শুরু করল, আর সেই সঙ্গে বিষাক্ত তরল দুর্গন্ধের একটা ধারা সৃষ্টি হল।
সবাই ফিরলেন সেটার দিকে, আর তাই দেখে সেটা বিদ্রূপের এমন এক শয়তানি হাসি হেসে উঠল যে সবাই অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লেন।
মুহূর্তকাল জানালার কাছে থেকে তারপর বস্তুটি ফিরে চলে গেল যেখানে তাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল।
হা ঈশ্বর! রিচার্ড বলে উঠলেন। ফ্লাওয়ারের ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুলে গেল একটু একটু করে। ফাঁক দিয়ে। প্রথমে দেখা দিল একটা সঙ্কীর্ণ সাদা রেখা যার উচ্চতা তিন ফুটের মতো। দরজাটা ভালো করে খুলে গেলে মেরী ভয়ে চিৎকার করে উঠে বসলেন—একি, এ যে ফ্লাওয়ার!
অন্য সকলেও চিনতে পারলেন তাকে। বস্তুটি থেকে তার দূরত্ব দু-গজের বেশি হবে না। শয়তানসুলভ মুচকি হাসি হেসে সেই বস্তু সেই দূরত্ব কমিয়ে এক গজে নিয়ে এল।
মেরীকে বাধা দিয়ে ডিউক বললেন ফ্লাওয়ার নয়, ও হচ্ছে ওদের ছলনা। হতেই পারে না। রিচার্ড, ও ফ্লাওয়ার না হয়েই যায় না-দেখ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। হেসে উঠল বস্তুটি, কিন্তু এবারের হাসিতে পরাজয়ের ক্রোধ প্রকাশ পেল। শিশুর মূর্তিটা মড়ার মতো নীলচে হয়ে গেল, ওদের প্রার্থনার ফলে কাঁপতে থাকল সেটা। তারপর শিশুটি আর মূর্তিটি ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হতে হতে মিলিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। আবার সেই ‘শিশু’শব্দ, নিশ্চল অন্ধকার বিরাজ করল।
স্বস্তির শ্বাস ফেলে ডিউক তার বন্দীকে মুক্তি দিলেন এবং বললেন কেমন, বিশ্বাস হল তো? কিন্তু উত্তর দেবার সময় হল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নতুন আক্রমণ শুরু হল। গণ্ডীর মাঝখানে ছিল সাইমন। মেরী অনুভব করলেন সাইমনের সারা দেহ কাঁপছে। তাঁকে শান্ত করতে মেরী কাঁধে হাত দিয়ে উপলব্ধি করলেন সাইমনের কাঁপুনি ভীষণভাবে প্রবল হয়ে উঠেছে, তিনি বিড়-বিড় করে কি সব বলছেন। তারপরেই তিনি যেভাবে ফুঁপিয়ে উঠলেন তাকে হৃদয় বিদারক বলা যেতে পারে।
তাড়াতাড়ি সাইমনের দিকে ঝুঁকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী সাইমন? কিন্তু সাইমন কোনো জবাব না দিয়ে তেমনি রয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে অকস্মাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে সিধে হলেন। বললেন বলব না, বলব না—কিছুতেই আমাকে বলতে পারবেন না! তারপর টলতে টলতে জানালার দিকে এগোতে থাকলেন। কিন্তু তার আগেই মেরী তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন বলে উঠলেন, ‘সাইমন, প্রিয় সাইমন যাবে না।—আমাদের ছেড়ে তুমি যাবে না।’
মুহূর্তের জন্যে থামলেন সাইমন, তারপর তাঁর দেহ এমন ভীষণভাবে কাঁপতে আর পাক খেতে লাগল যেন এক অমানুষিক শক্তি তাঁকে ভার করেছে। তাঁর মুখের হাসি হাসি ভাব কোথায় শেষ হয়ে গেছে, সেই অস্পষ্ট আলোয় সেখানে দেখা দিয়েছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিব্যক্তি। হাঁ করা দাঁত বার করা মুখে প্রচণ্ড ক্রোধের প্রকাশ। চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আর থুতনি বেয়ে লালা ঝরে পড়ছে।
ডিউক বলে উঠলেন ধর রিচার্ড, শীঘ্রই ধরো সাইমনকে। ওরা ওকে বশ করেছে ঈশ্বরের দোহাই, ধর। ধর।
ডিউক আর রিচার্ড দু-জনে মিলে কোনোরকমে সাইমনকে নিবৃত্ত করলেন। হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর! ফুপিয়ে উঠলেন মেরী। সাইমনের বুক ধড়ফড় করছে যেন মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে ফেটে পড়বে। মরিয়া হয়ে উঠলেন মুক্তিলাভের জন্য। কিন্তু তিনি কাবু হয়ে পড়লেন শেষ পর্যন্ত তারপর তাঁর হাত পা বেঁধে ফেলা হল।
সঙ্গে সঙ্গে ডিউক আবার নতুন আক্রমণের মোকাবিলায় তৎপর হয়ে উঠলেন। যদিও জানেন না তা কী আকার নিয়ে, কোনো দিক থেকে আসবে।
সাইমনকে ঘিরে তিনজনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে চারদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখলেন। দেরি করতে হল না। প্রথমে অস্পষ্ট হলেও একটু পরেই দরজার নিকটে কালোমত একটা বস্তু তাঁদের চোখে পড়ল, এক নতুন বিভীষিকা গড়ে উঠতে শুরু করেছে।
সাহস সঞ্চয়ের জন্যে তাঁরা পরস্পরের হাত আরও জোরে চেপে ধরলেন। তাঁদের চোখের নিকটে এক নতুন কলেবর মূর্ত হতে চলেছে। একটু একটু করে সেটাতে একটা পশুর মুখ ফুটে উঠল। মুখটা লম্বা, কালো, আর ছোট ছোট দুটো আলোর বিন্দু তাঁদের চোখ বরাবর দেখা দিল! আলোক বিন্দু দুটো ক্রমশই বড় হতে থাকল। সে দুটো হচ্ছে চোখ, যেন বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে, আগুনের ঔজ্জ্বল্য তাতে। সে চোখের স্থির নিষ্পলক দৃষ্টি যেন মেরীর চোখে বিদ্ধ হল। মেরী পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর হাঁটু ভীষণভাবে কাঁপতে লাগল। মাথাটার পরে নড়ে উঠল তার কাঁধ, এবং শেষ পর্যন্ত পাও দৃশ্যমান হল।
মহা আতঙ্কের সঙ্গে রিচার্ড বলে উঠলেন, একি, এ যে ঘোড়া! কিন্তু সহিস নেই ঘোড়াটার!
একটা আর্ত আওয়াজ ডিউকের মুখ থেকে নির্গত হল। কোনো রকমেই সাইমনকে উদ্ধার করতে না পেরে মোকাটা শেষ পর্যন্ত সকলকেই ধ্বংস করে প্রতিশোধ নেবে ঠিক করেছে, পাঠিয়েছে মৃত্যুর দূতকে!
ঘোড়াটার পিঠে চামড়ার লাল জিন, অদৃশ্য পা রেকাবে রাখা, অদৃশ্য হাতে লাগাম ধরা। ডিউক ভালো করেই জানেন, এই ভয়ঙ্কর ঘোড়সওয়ারকে যে দেখতে পারবে সে আর তার বর্ণনা করার সুযোগ পাবে না।
প্রচণ্ড জোরে জোরে ঘোড়াটা ডাক ছাড়তে থাকল, তার পত্র নিশ্বাস বাষ্প মেঘের মতো ভাসছে। তার নাক কুঁকড়ে গেল, ঠোঁট পিছিয়ে গিয়ে দু-সারি হলদে দাঁত দেখা দিল। মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকল।
ডিউক প্রাণপণে প্রার্থনা করে চললেন এবং অন্যেরাও তাই করলেন।
হঠাৎ কোনো অদৃশ্য পা রেকাব দিয়ে ঘোড়াকে আঘাত করল আর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা তাঁদের দিয়ে এগিয়ে গেল। ডিউক তাঁকে চেপে ধরে ছিলেন কিন্তু তা সত্ত্বেও মেরী চিৎকার করে মুক্তির জন্যে ছটফট করতে লাগলেন। চোয়াল শক্ত করে ডিউক তাকিয়ে রইলেন ঘোড়াটার প্রতি।
রিচার্ডের মাথায় তখন একমাত্র চিন্তা, কেমন করে মেরীকে রক্ষা করা যেতে পার। সঙ্গে সঙ্গে এক পা এগিয়ে তিনি রিভলবার বার করে গুলি ছুঁড়লেন।
সঙ্গে সঙ্গে বাজের মতো আওয়াজ উঠল। পর-পর তিনি গুলি করে চললেন, ঘর আলোয় আলোময় হয়ে উঠল।
গুলি বন্ধ হলে অত্যন্ত নিবিড় স্তব্ধতা বিরাজ করল এবং আবার ঘরটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হল। পলকের জন্যে ডিউকের ভৃত্যদের কথা মনে পড়ল—এত আওয়াজের পরেও কি তারা আসবে না? তাদের উপস্থিতিতে হয়ত এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারত।
কিছু সময় পরে তাঁরা দেখলেন, পাতাল থেকে পাঠানো যমদূতের ঘোড়াটার শরীর আবার একটু একটু করে গড়ে উঠেছে।
মেরী ডিউকের কাঁধ ধরে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পিছলে পড়লেন। ডিউকের তখন তাঁর জন্যে কিছুই করার ছিল না, ঘোড়াটা ততক্ষণে তাঁদের উপরে এসে পড়েছে। ডিউকের মন্ত্রপূত গণ্ডীর কাছে এসেই কিন্তু ঘোড়াটা ভয় আর যন্ত্রণাসূচক আওয়াজ তুলল, যেন উত্তপ্ত লৌহশলাকার স্পর্শ পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে পিছিয়ে বইয়ের আলমারিগুলোর নিকটে চলে গেল।
রিচার্ড মেরীর শিথিল শরীর স্পর্শ করলেন। ভয়ে সবাই গণ্ডীর মাঝখান থেকে এক প্রান্তে চলে গেছেন। হঠাৎ নিচু হতেই রিচার্ডের পায়ে লেগে পবিত্র জলের একটা পাত্র উল্টে গেল, সব জল পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিজয়সূচক বিকট গর্জনে ঘর ভর্তি হল, আওয়াজটা এল পায়ের তলা থেকে, এবং সেই বস্তুর মতো বস্তুটি আবার দেখা দিল।
ডিউকের মনে হল—সব শেষ, অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত। তখন ডিউক যে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন মানুষ তা উচ্চারণ করতে পারে শুধু তখনই যখন তার আত্মা ধ্বংস হতে বসেছে। স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ গলায় ডিউক সেই ভয়ঙ্কর সুআত্মা তন্ত্রের শেষ দু-লাইন উচ্চারণ করলেন।
দেখতে দেখতে ঘোড়া কোথায় মিলিয়ে গেল, বস্তার মতো বস্তুটিকেও আর দেখা গেল না।
আলোর প্রভুরা তাঁদের রহস্যময় অজেয় শক্তি নিয়ে প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছেন, অমঙ্গলের অন্ধকার পরাস্ত হয়েছে।
নেমে এল পরম স্তব্ধতা। কিন্তু এই প্রার্থনার ফলে তাঁদের দেহ সূক্ষ্ম স্তরের পঞ্চম স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছিল। ডিউকের মনে হল, আর বোধ হয় তাঁদের পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। আলোর সারবস্তুকে আবাহন করতে হলে যে সাহসের প্রয়োজন তা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় প্রাণের যা বেগ ও ক্ষমতা তা সম্যকভাবে উপলব্ধি করা। শক্তিতে তা অন্ধকারকে ধ্বংস করে, কোটি ক্ষমতাসম্পন্ন আলোও কিছুই নয় তার কাছে।
পলকের জন্যে মনে হল যেন তাঁরা বাড়ির ছাদ ভেদ করে উঠে এসেছেন এখন তাকিয়ে আছেন যেদিকে। পঞ্চপ্রদীপ জ্বলন্ত তারার মতো প্রতিভাত হচ্ছে। তাঁদের অবস্থিতি বাড়ির উপরে, কার্ডিন্যালস্ ফলিকে একটা দুরন্ত কালো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। অন্য সব কিছুই মিলিয়ে গেছে।
তারপর পুনরায় বাড়িটা তাঁদের দৃষ্টিগোচর হল, আর দৃষ্টিগোচর হল গণ্ডীর ভিতরে তাঁদের অন্ধকারে শায়িত দেহ। ডিউক মাথা তুললেন। চোখে হাত বুলিয়ে দেখলেন। বইয়ের আলমারি ইত্যাদি সব পরিচিত বস্তুই যথাস্থানে আছে। কার্নিসের বাতিগুলোও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সকলেই একটু একটু করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেলেন। সাইমনের চোখও এখন সেই ভয়ঙ্করের আকর্ষণ থেকে মুক্ত।
ডিউক বলে উঠলেন, আর আমাদের কোনো ভয় নেই, মোকাটা শেষ হয়েছে। সে মৃত্যুদূতকে আমাদের পিছনে লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তাকে ব্যর্থ হতে হয়েছে তাই এখন সে নিয়োগকর্তার উপরেই প্রতিশোধ নেবে।
ঠিক-ঠিক জানেন আপনি? সাইমন জিজ্ঞাসা করলেন।
নিশ্চয়। প্রতিশোধের যুগযুগান্তের নিয়ম এ, এর ব্যতিক্রম সম্ভব নয়। আজই রাত্রে সে মৃত্যু মুখে পতিত হবে।
সাইমন বললেন, কিন্তু জেনে রাখুন, এসব কাজ মোকাটা নিজের হাতে করেন না, অন্য কোনো ব্যক্তিকে সম্মোহিত করে তাকে দিয়ে করান। সুতরাং এর প্রতিশোধ সেই ব্যক্তির উপরেই গিয়ে পড়বে, মোকাটার উপরে নয়।
এমন সময় বাইরে দ্রুত পায়ের শব্দ, আর তার কিছুক্ষণ পরেই খুব ভারি বুটের আঘাতে একটা জানালা ভেঙে পড়ল। দেখা গেল, রেক্স দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দু-হাতে ধরা এক শিথিল দেহ। দেহটি নামিয়ে রাখলে দেখা গেল তিনি ট্যানিথ। তাঁকে দেখে মৃত বলে মনে হল। জলের বন্যা বয়ে গেল রেক্সের দু-চোখে।
কী করে এটা ঘটল? ডিউক জিজ্ঞাসা করলেন। রেক্স হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জানি না। মোকাটার ভয়ে ও আমাকে ওখানে রাত কাটাতে বলে, একা থাকতে ভরসা পাচ্ছিল না। ফলে আমাকে ওখানেই থেকে যেতে হয়। আমি বেশ কয়েকঘণ্টা ঘুমিয়ে ছিলাম। মাঝরাত নাগাদ ও পাঁচ মিনিটের জন্যে বেরিয়ে যায় – হা ঈশ্বর, কেন যে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙামাত্র দৌড়ে গেলাম উপরে। দেখলাম ও ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে—ঘুমোচ্ছে মনে করেছিলাম। জাগাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে ওকে তুলে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়তে দৌড়তে এসে পৌঁছলাম। রিচার্ড একটা আয়না নিয়ে ট্যানিথের মুখের কাছে ধরলেন, কিন্তু শ্বাসের কোনো চিহ্নই ফুটে উঠল না। বললেন, ওর হৃৎ স্পন্দন বন্ধ হয়েছে, রেক্স। বড়ই দুঃখের কথা।
সাইমন বললেন, ওসব সেকেলে পরীক্ষায় ঠিক প্রমাণ হয় না। বিজ্ঞানীরা বলেন, এমনকি যদি ধমনী ছিন্ন করেও রক্ত না পাওয়া যায় তাহলেও প্রাণ থাকা সম্ভব।
ডিউকও এ কথায় সায় দিলেন। বললেন, তা বটে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে এর মৃত্যু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। রেক্স বললেন, ওকে তুলে নেবার সময়ে আমারও তাই মনে হয়েছিল। হায়, তাহলে তো ওর ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হল। কিন্তু ও কি সত্যিই মৃত?
ডিউক বললেন, বুঝেছি তুমি কী জানতে চাও—কোনো ভ্যাম্পায়ার মৃত্যুর পরে ওর শরীরে ভর করেছে কি না। তবে, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার কয়েকটা পরীক্ষা আছে। ভ্যাম্পায়ারদের কতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে। মানুষের খাদ্য তারা খাবে না। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের সময় ছাড়া কোনো স্রোতা পার হতে পারবে না। তা ছাড়া রসুনকে ওরা ভীষণ ভয় পায়। রসুনের স্পর্শ লাগলেই চিৎকার করে ওঠে, এবং ক্রশকে যে ভয় পায় তা বলাই বাহুল্য। আচ্ছা, তাহলে দেখাই যাক পরীক্ষা করে।
নিজের গলা থেকে রসুনের মালা খুলে ডিউক ট্যানিথকে পরিয়ে দিলেন, তারপর তার শরীরের উপরে ক্রুশচিহ্ন আঁকলেন এবং তাঁর ছোট সোনার ক্রুশটা তার ঠোঁটে রাখলেন। কিন্তু কোনো বৈলক্ষণই লক্ষিত হল না।
ডিউক বললেন, হ্যাঁ রেক্স, ও মারাই গেছে, তবে কোনো পিশাচ ওর শরীর দখল করেনি এই যা সান্ত্বনা।
সাইমন ডিউককে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ওর মধ্যে প্রাণের সাড়া জাগানোর কি কোনো উপায়ই নেই? কী জানেন, কোনো সাধারণ ডাক্তারই বলবে না ও বেঁচে আছে। কিন্তু আমি জানি এহেন মধ্যবর্তী অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে এমন মানুষ আছে।
তার মানে? তুমি বলতে চাও আমি ওকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করব?
সাইমন বললেন, মানে, যদি প্রক্রিয়াটা আপনার জানা থাকে আর কি। আপনি এত জানেন, ভেবেছিলাম হয়ত সেটাও আপনার জানা থাকতে পারে। ওর আত্মা নিশ্চয় এখনও ওকে ছেড়ে বেশি দূরে যায়নি।
তা আমি জানি। কিন্তু সাইমন, মৃতকে ডেকে আনা আমি পছন্দ করি না। তাদের ফিরিয়ে আনার কথা নয়, এবং তখন যে তারা ফিরে আসে তা স্বেচ্ছায় নয়। তা ছাড়া লাভটা কী হবে বল, বড় জোর কয়েক মুহূর্তের জন্যে আসতে পারে।
তা জানি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্যটা আপনি বুঝতে পারছেন না। রেক্সের দিক দিয়ে যে সে মৃত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ভাবছি মোকাটার কথা। কাল রাত্রে আপনি বলছিলেন তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হত্যা করা উচিত। আমি বলতে চাই কয়েক মুহূর্তের জন্যে যদি ট্যানিথকে ফিরিয়ে আনা যায় তো হয়ত ওর মুখে জানতে পারা যাবে কিভাবে মোকাটাকে কাবু করা যেতে পারে। যে ভৌতিক স্তরে সে এখন আছে সেখানে তার দৃষ্টির আর অন্তর্দৃষ্টির কোনো সীমা পরিসীমা নেই।
ঠিক বলেছ সাইমন! আমি সেই চেষ্টাই করব।
আর সেও অবশ্যই এই খবরটা আমাদের দিতে উদ্গ্রীব। তবে, সময় লাগবে একটু। এবং এও হতে পারে যে শেষ পর্যন্ত আমি ব্যর্থ হব।
ডিউকের প্রক্রিয়া আরম্ভ হল। তার বিস্তারিত বিবরণ না-ই বা দিলাম, পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে
কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে তা সাইমনই প্রথমে উপলব্ধি করলেন। ট্যানিথের মাথার কাছে রে ধূপটা জ্বালা ছিল সেটা থেকে অন্যগুলোর চেয়ে বেশি ধোঁয়া বেরোতে থাকল। এবং তারপর এও মনে হল যেন সেটা দেখাও যাচ্ছে আগের থেকেও স্পষ্ট। তিনি ডিউকের হাতে চাপ দিয়ে ইশারা করলেন, এবং রিচার্ডও লক্ষ্য করেছিলেন ব্যাপার। এবং একটা নীলাভ আলোও সেখানে তাঁদের চোখে পড়ল।
সেই আলো ক্রমে ঘনত্ব পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত দু-ইঞ্চি ব্যাসের একটা গোলকে পরিণত হল। গোলকটা মাথা থেকে ধীরে ধীরে নেমে ট্যানিথের শরীরের মাঝখানে পৌঁছল। তারপর কিছুক্ষণ সেখানে স্থির থেকে ক্রমেই উজ্জ্বল হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত জোরালো নীল আলোয় পরিণত হল। তারপর একটু উঁচু হয়ে তার দেহের উপরে ঘুরল কিছুক্ষণ।
অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে তাঁরা লক্ষ্য করে চললেন, গোলকটা ক্রমেই বেশ খানিকটা জায়গায় ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে এবং তার রঙও হালকা হয়ে আসছে। তখন সাতটা ধূপদানির ধোঁয়া পাক খেতে খেতে এসে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাথার আর কাঁধের অস্পষ্ট বহিঃরেখার সৃষ্টি করল, যা তখনও ধোঁয়াটে আর অস্বচ্ছ। ক্রমে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও সব তার সঙ্গে যুক্ত হল নিচে। শায়িত দেহের সঙ্গে তার সাদৃশ্য লক্ষিত হল।
এখন কী হতে চলেছে তা দেখবার জন্যে তাঁরা দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে রইলেন। ক্রমশ সব দিক ঘিরে একটা জ্যোতির্বলয় তাঁদের চোখে পড়ল।
সবাই দৃষ্টি ও শ্রবণেন্দ্রিয় খুব তীক্ষ্ণ করে রয়েছেন। খুব অস্পষ্টভাবে একটা কথা তাদের কানে এল, ‘আমাকে ডেকেছেন, এই যে আমি।’ ডিউক আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি তুমি ট্যানিথ?’
‘হ্যাঁ’।
‘আমাদের প্রভু যীশুখ্রিস্টকে তুমি স্বীকার কর?’
‘করি।’
‘তুমি কি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছ, না কি তুমি এখান থেকে চলে যেতে চাও?’
‘ডেকেছেন বলে এসেছি এবং সেজন্যে আমি খুশি।’
‘এই লোকটা সম্বন্ধে কি এমন সব খবর তুমি দিতে পার যা আমাদের কাজে লাগতে পারে?’
‘না, তাতে নিষেধ আছে। তবে আপনারা ডেকেছেন, তাই আপনাদের বিশেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য।’
‘মোকাটা কী করছেন এই মুহূর্তে?’
‘নতুন করে আপনাদের বিরুদ্ধে মতলব ভাঁজছেন?’
‘কোথায় তিনি?’
‘আপনাদের খুব কাছেই
‘বলতে পার না ঠিক কোথায়?’
‘না স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না, অন্ধকারের পোশাকে তাঁর শরীর ঢাকা।’
‘এই গ্রামের মধ্যেই কি?’
‘খুব সম্ভব।’
‘কাল এমন সময়ে তিনি কোথায় থাকবেন?’
‘প্যারিসে।’
‘প্যারিসে তিনি কী করবেন, দেখতে পাচ্ছ?’
‘এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা কইবেন যার বাঁ কানের একাংশ নেই। একটা বড় বাড়ি সেটা। দু-জনেই অত্যন্ত রাগান্বিত।’
‘বেশি দিন কি তিনি প্যারিসে থাকবেন?’
‘না। দেখতে পাচ্ছি তিনি অত্যন্ত দ্রুত সূর্যোদয়ের দিকে এগোচ্ছেন।’
‘শেষ পর্যন্ত তাঁকে কোথায় দেখতে পাচ্ছ?’
‘মাটির নিচে।’
‘মানে–আমাদের দিক থেকে তাহলে তিনি মৃত?’
‘না। এক অত্যন্ত প্রাচীন অট্টালিকার গর্ভগৃহে তিনি আছেন সেখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত দূষিত। দেখতে পাচ্ছি না তিনি সেখানে কী করছেন। আমাকে ঘিরে যে আলো তা আমাকে এই দৃশ্য থেকে আড়াল করছে।’
‘তিনি কী মতলব করছেন এখন?’
‘আমাকে আবার ফিরিয়ে নিতে।’
‘মানে তিনি চেষ্টা করছেন তোমার আত্মাকে তোমার দেহে প্রতিষ্ঠিত করতে?’
‘হ্যাঁ। আপনাদের উপর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি আমার আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। যদি আমি আপনাদের সমপর্যায়ে থাকতাম তাহলে আত্মাকে তাঁর বিশেষ কাজে লাগাতে পারতেন, কিন্তু এখন আমার যা অবস্থা তাতে তাঁর পক্ষে তা সম্ভব হবে না।
‘কিন্তু স্থায়ীভাবে কি তোমাকে তোমার শরীরে ফিরিয়ে আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব?’
‘হ্যাঁ, যদি এক্ষুনি কাজ শুরু করেন, যতক্ষণ চাঁদ অন্ধকারের মধ্যে আছে।’
‘তুমিও কি ফিরে আসতে চাও?’
‘না। চাইতাম, যদি ওর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই।’
‘কিন্তু কেমন করে তিনি তোমার আত্মাকে শরীরে ফিরিয়ে দেবেন?’
‘উপায় মাত্র একটাই, তা হচ্ছে ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্য নেওয়া।’
‘অর্থাৎ এক খ্রিস্টান শিশু বলি দিয়ে?’
‘হ্যাঁ যুগ-যুগান্তের নিয়ম হচ্ছে এই–আত্মার বিনিময়ে একমাত্র সেই উপায়েই এক খ্রিস্টান শিশুর আত্মার বিনিময়ে আমার আত্মা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। এবং তা সম্ভব হবে যদি আমার দেহ অক্ষত থাকে, এবং সে ক্ষেত্রে আমার ফিরে যাওয়া ব্যতীত কোনো উপায় থাকবে না।’
‘কিন্তু–’
ডিউকের পরবর্তী প্রশ্নে রেক্স বাধা দিলেন। এ উত্তেজনা আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। ডিউক যে শুধু ট্যানিথের সূক্ষ্ম দেহের সঙ্গে কথা কইছিলেন তা তিনি জানতেন না, ভেবেছিলেন বুঝি ডিউক মৃত ট্যানিথকে অন্তত ক্ষণকালের জন্যে সঞ্জীবিত করতে পেরেছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, ট্যানিথ ট্যানিথ সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম দেহ টুকরো টুকরো হয়ে মিলিয়ে গেল।
জ্বলন্ত চোখে ডিউক বজ্রগলায় বলে উঠলেন, মূর্খ, মহা মূর্খ তুমি! আসন্ন ভোরের অস্পষ্ট আলো তখন সবে আসতে আরম্ভ করেছে। ক্রুদ্ধ আক্রোশে তাঁরা ফেটে পড়তে উদ্যত, এমন সময় সবাই অত্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। এক তীক্ষ্ণ চিৎকার ছুরির মতো সেই বদ্ধ, ভারাক্রান্ত আবহাওয়াকে বিদীর্ণ করল।
ফ্লাওয়ার, ফ্লাওয়ার! চিৎকার করে উঠলেন মেরী, আর সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে ফ্লাওয়ারের ঘর লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রিচার্ড আগে পৌঁছে গেছেন সেখানে। ইতিমধ্যে অন্য সকলেও সেখানে পৌঁছে গেলেন।
ঘর খোলা, ধূসর কুয়াশায় বাইরের বাগান আচ্ছন্ন। খাটে ফ্লাওয়ার নেই। রেক্স বললেন, এই যে জানালার বাইরে একটা মই দেখছি। এখান দিয়েই পালিয়েছে। তখন কত তন্ন-তন্ন করে খোঁজ হল তা সহজেই কল্পনা করতে পারি। কিন্তু অত্যন্ত ঘন কুয়াশায় সব ঢাকা থাকায় আর তা সহজসাধ্য হল না। মেরীর অবস্থা কথায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ডিউক বলে উঠলেন, কিন্তু নার্স? তার কী হল? এত হট্টগোলেও কি তার ঘুম ভাঙল না?
ইলেকট্রিক বাতিটা জ্বেলে দিলেন তিনি। দেখলেন, নার্স দিব্যি তার খাটে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, নাড়া দিয়েও ঘুম ভাঙানো সম্ভব হল না।
ব্যাপারটা বুঝতে ডিউকের বাকি রইল না। লোকটা তাকে সম্মোহিত করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, যথাসময়ে সে জাগবে। তার আগে তাকে জাগানো সম্ভব হবে না।
হঠাৎ একটা টাইপ করা কাগজ ফ্লাওয়ারের বিছানার উপরে দেখা গেল। চিঠিটা হল : ছোট মেয়েটির ব্যাপারে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কাল সকালেই তাকে ফেরত পাবেন যদি কয়েকটা শর্ত পালন করেন। শর্তগুলো এই : প্রথম শর্ত, পুলিশ লাগাবেন না। গতকাল যে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম তার ফলে এক অতি অপূর্ব নব-আবিষ্কৃত মিডিয়ামের মৃত্যু হয়েছে, যাকে আমি আরও কিছু কাজে লাগাতে পারতাম। আমি যখন ঘুমোচ্ছিলাম মিঃ ভ্যান রাইন তখন মেয়েটিকে নিয়ে যান, এবং সে এখন আপনার আশ্রয়ে। আমি বিশেষভাবে চাই আপনারা তার দেহ যত্ন করে রাখবেন, যেভাবে আছে ঠিক সেইভাবেই লাইব্রেরি ঘর দেবেন যতক্ষণ না আমার নতুন নির্দেশ পাচ্ছেন। তদন্তের বা কবর দেবার চেষ্টা করবেন না। যদি আদেশ অমান্য করেন তাহলে এমন কিছু শক্তি আমি পাঠাব যার কথা মঁশিয়ে দ্য রিশলো জানেন। আগামী দিনে আপনারা কেউ লাইব্রেরি ঘর থেকে বেরোবেন না, এবং ভৃত্যদের বলে দেবেন যেন কোনোমতেই আপনাদের বিরক্ত না করে, এজন্য ভৃত্যদের সুবিধেমতো কোনো কারণ দেখিয়ে দেবেন।
এবং শেষ শর্ত, বন্ধু সাইমন এসে আমার সঙ্গে যোগ দিয়ে যে কাজ করছিল আবার তাতে লিপ্ত হবে। বেলা বারোটায় সে একা বাড়ি থেকে বেরোবে। ওখান থেকে যে রাস্তা দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে গেছে, সে পায়ে হেঁটে সেই পথে দেড় মাইল এগিয়ে যাবে, সেখান থেকে তাকে নিয়ে আমার ব্যবস্থা থাকবে। এবং আজ রাতে শয়তানের উপাসনার যে ব্যবস্থা হয়েছে তাতে সে স্বেচ্ছায় আমাকে সাহায্য করবে, সেট-এর কবচ উদ্ধারের ব্যাপারে তাকে বিশেষ প্রয়োজন।
এই সব নির্দেশ পালনে যদি অল্প অবহেলাও হয় তাহলে কী ফল হবে আপনি জানেন। এবং সব কিছু ঠিক-ঠিকভাবে পালিত হলে তখন সাইমন আর শিশুটি সুস্থ দেহ-মনে আপনাদের কাছে ফিরে যাবে।
চিঠি পড়ে মেরী হাত মোচড়াতে মোচড়াতে কেঁদে ফেললেন। বলে উঠলেন, কী হবে ধূসরচক্ষু, কী করব আমরা?
ঈশ্বরই জানেন। ডিউক খুব আস্তে-আস্তে বিষণ্ণভাবে বলে উঠলেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে, আমরা ওর হাতে পড়ে গেছি। আর, সবথেকে অসুবিধে হচ্ছে এই যে, যদি বা সাইমন ওঁর কাছে যেতে রাজি হয় তাহলেও যে উনি ফ্লাওয়ারকে ফেরৎ দেবেন তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
রিচার্ড কিন্তু ঠিক করেছেন তিনি পুলিশে খবর দেবেন, যদিও মেরী বা ডিউক দু-জনেরই সে ইচ্ছে নয়। ইতিমধ্যে টেলিফোন কার্যকর করা হয়েছে, কিন্তু মেরী রিচার্ডকে এই মুহূর্তে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করতে বারণ করলেন। ডিউককে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আমরা . তার শর্ত মানছি কি না তা জানতে পারা কি, মোকাটার পক্ষে সম্ভব হবে?
ডিউক বললেন, হ্যাঁ হবে। তবে, এ ব্যাপারে সাইমন আরও ভালো করে বলতে পারবে। সেই দুর্লভ হাসি সাইমনের মুখে খেলে গেল সেজন্যে সবাই তাকে পছন্দ করেন। তিনি বললেন, ওঁর একটা আয়না আছে তাতে উনি যা দেখতে চান তাই দেখতে পান। লন্ডনে পৌঁছে তিনি তাঁর গোটা ছয়েক মিডিয়ামকে সম্মোহিত করে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাঠাতে পারেন। আমরা এই ঘরেই থেকে যাচ্ছি না এখান থেকে বেরোচ্ছি তা জানতে পারা তাঁর পক্ষে ছেলেখেলা মাত্র।
তারপরে বললেন, এই যে ব্যাপারটা ঘটে গেল এ শুধু আমারই জন্যে, সুতরাং এখন আমার একটাই কাজ, এবং সেটা যে কী তা না বললেও চলে।
ডিউক বললেন, আমি জানতাম সাইমন এই কথাই বলবে, ওকে তো জানি- এবং পরিণাম যাই হোক না কেন। আমি বলব সাইমন ঠিকই বলেছে, যদিও এ ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করার কথা ভাবতে গেলে আমার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। তবে, ঠিক সরাসরি গিয়ে আত্মসমর্পণ করাটাতে আমি সায় দিতে পারছি না।’
মেরী মরিয়া হয়ে সাইমনের হাত ধরে বলে উঠলেন, কেন, এ ছাড়া কি কোনো উপায়ই নেই? বিপদ আমাদের, তার জন্যে সাইমন আত্মসমর্পণ করবে, এ বড় ভয়ানক কথা!
ডিউক বললেন, আসলে কিন্তু আমার ব্যর্থতার ফলেই এই অবস্থার উদ্ভব হল। সুতরাং সাইমন নয়, তার বদলে যাওয়া উচিত আমারই। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে এই মোকাটার দরকার সাইমনকেই, আমাকে দিয়ে তার চলবে না।
রিচার্ড বলে উঠলেন, ওসব বাজে কথা বন্ধ করুন, ঈশ্বরের দোহাই। দোষ কারোরই নয়। বিপদে পড়ে এখানে এসে ঠিকই করেছেন, বিপদেই তো বন্ধু বন্ধুকে দেখে। বিপদে পড়লে মেরী আর আমিও আপনাদের সাহায্য চাইতাম। এহেন একটা সম্ভাবনার কথা তো আগে থেকে আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। একে একটা দুর্ঘটনা বলে মানতে হবে, এবং এ ব্যাপারে ফ্লাওয়ারকে রক্ষার দায়িত্ব অন্য সকলের সঙ্গে আমাদেরও।
রিচার্ড চমৎকার কথা বলেছ। কিন্তু সে যাই হোক, মোকাটার কথামত আমি গিয়ে আত্মসমর্পণ করব ঠিক করেছি। এ ছাড়া আর এখন আমাদের কিছু করবার নেই।
যখন কোনো ভাবেই কোনো সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না তখন মেরী রেক্সকে বললেন, রেক্স, তুমি তো কিছু বলছ না?
রেক্স বললেন, কী করা যেতে পারে সেই চিন্তাই আমি করছিলাম। সমস্যাটা যে যথেষ্ট কঠিন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা কি গোড়াতেই একটা ভুল করছি না? আমার তো মনে হয় চুপচাপ থাকাই ভালো। কথায় বলে—শত্রুকে যথেষ্ট দড়ি দাও, শেষ পর্যন্ত সে নিজের গলায়ই দেবে। কোনোরকম আপোষ করাই আমাদের নীতিবিরুদ্ধ। যদি আমরা মোকাটার নির্দেশ অনুযায়ী এখানেই থেকে যাই তাহলে আর কিছু না হোক ফ্লাওয়ারের সম্বন্ধে আমাদের কোনো ভয় থাকবে না। কিন্তু মোকাটার নির্দেশ মানার ব্যাপারটা আমাদের ওই পর্যন্তই তার বেশি নয়। আমরা জানি সাইমন আত্মোৎসর্গ করতে রাজি, কিন্তু আমার মনে হয় না তাতে রাজি হওয়া উচিত, তাকে এখানেই রাখব আমরা। তখন মোকাটাকেই প্রচুর মাথা চুলকোতে হবে। এবং সেই সিদ্ধান্তের ফলে পরিস্থিতি অন্তত বর্তমানের থেকে খারাপ হবে না। এবং ভাগ্য প্রসন্ন হলে শেষ পর্যন্ত ওর উপরে সুবিধে নেওয়ারও সুযোগ মিলতে পারে।
ডিউক হাসলেন, বেশ ক-দিন পরে তাঁর মুখে হাসি দেখা দিল। মতলবটার বিশেষ তারিফ করলেন তিনি। বললেন, সত্যিই আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি নতুবা এই মতলব কেন আমার মাথায় এল না? রেক্স, তোমার এইরকম শোকের দিনেও যে তুমি আমাদের সমস্যার প্রকৃত সমাধান দেখালে এ জন্যে অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
মতলবটা অন্য সকলের কাছেও স্বাগত হল। শেষ পর্যন্ত সকাল হল। তবে তা যে বিশেষ কাজের হল তা কিন্তু নয়। এমন ঘন কুয়াশা যে দৃষ্টি পনেরো গজের বেশি এগোতে পারে না।
সবাই শুয়ে পড়লেন। মেরীর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ক্রমেই কমে আসতে লাগল।
হঠাৎ তিনি দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলেন পুরুষেরাও। সবাই ঘিরে দাঁড়ালেন তাঁকে। অন্ধকারে মেরীর তাঁদের ছায়ামূর্তি বলে মনে হল। ইলেকট্রিক বাতির সুইচটা টিপে দিলেন ডিউক। সেই আলোয় দৃষ্টি গোচর হল যে, সাইমনের বিছানা খালি পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সবার দৃষ্টি জানালায় চলে গেল, খোলা রয়েছে জানালা। তিনি শর্তপূরণের জন্য মোকাটার নিকটে চলে গেছেন। মেঝেতে খড়ি দিয়ে লেখাটার প্রতি রেক্স সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং পড়লেন :
দয়া করে এ নিয়ে ভাববেন না। বাধা দেবার চেষ্টা করবেন না। এ জন্যে আমিই দায়ী, তাই আমি শর্ত পূরণ করতে চললাম। মোকাটার কথামত কাজ করুন, ফ্লাওয়ারকে বাঁচাতে হলে ঐটিই একমাত্র উপায়। সবাই ভালোবাসা নেবেন—সাইমন
রেক্স হায় হায় করে উঠলেন। বললেন, আমার অমন সুন্দর মতলবটা ভেস্তে দিল! ফ্লাওয়ারকে তো পেয়েছেই, তার উপর এখন ওকেও হাত করল। এবং তার আগে তো ট্যানিথকে মেরেইছে। আর এখন আমাদের কোনো আশাই রইল না।
ডিউক ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, ঠিক এমনটিই আমি ভয় করেছিলাম। অবশ্য আমি বলেছিলাম ওর যাওয়াই উচিত, তবে তা হল শর্তসাপেক্ষ। শর্তটা যা আমার মাথায় ছিল তা হচ্ছে, একটু দূরত্ব রেখে আমরা পিছু নেব। কিন্তু তার থেকে রেক্সের মতলবটা এত ভালো মনে হয়েছিল যে সে মতলব ত্যাগ করেছিলাম।
রেক্স বললেন, যাই হোক এখন আর এ নিয়ে আলোচনার কোনো সার্থকতা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন আমরা কী করব।
আমরা এখন সরাসরি প্যারিসে যাব, এই কথা ডিউক বললেন, মনে আছে নিশ্চয়, ট্যানিথ বলেছিল মোকাটা সেখানে একজন কান কাটা লোকের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সে হচ্ছে ব্যাঙ্কের মালিক ক্যাস্টেলনাও। তাই এখন আমাদের কাজ তাদের খুঁজে বার করা। যেতে হবে প্লেনে, রিচার্ডের চার সীটের প্লেনই হবে যথেষ্ট। মোকাটাকে যদি ক্রয়ডন পর্যন্ত গাড়িতে যেতে হয় তাহলে আমরা তাঁর আগেই পৌঁছে যাব।
ফ্লাওয়ারের ঘরের দিকে চোখ পড়লে মেরীর আবার প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা হল। সবাই প্রস্তুত হয়ে প্লেনে উঠলে প্লেন সেই কুয়াশার মধ্যে আস্তে আস্তে উঠতে আরম্ভ করল। কিছুটা ওঠবার পর কুয়াশা নিচে পড়ে রইল, উপরে নীল আকাশ।
ডিউক আর মেরী বসে ছিলেন প্লেনের ভিতরে। মেরীকে তিনি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন না, কেবল তাঁর হাত দু-হাতের মধ্যে ধরে রাখলেন।
প্লেন থেকে নেমে তাঁরা ট্যাক্সি নিয়ে প্লেস ভ্যাণ্ডোমে-এ গেলেন। রেক্স তাঁদের নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করলেন। ম্যানেজারের এক সহকারী রেক্সকে দেখেই চিনতে পারলেন, শীঘ্রই এসে তাঁকে স্বাগত জানালেন।
রেক্স তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ক্যাস্টেলনাও নামে কোনো ব্যাঙ্কের মালিককে তিনি চেনেন কি না।
লোকটি বয়স্ক, মাথায় পাকা চুল—তাঁর বাঁ কানের একটুখানি কাটা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনি বৈকি। প্রায়ই তিনি এখানে লাঞ্চ খেতে আসেন।
বেশ। কিন্তু জানেন কি, তিনি কোথায় থাকেন?
আজ্ঞে না। আচ্ছা, জেনে বলছি। এই বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন একটা টেলিফোন ডাইরেক্টরি নিয়ে, তার একটা পাতা খোলা। জিজ্ঞাসা করলেন, আজ্ঞে তাঁকে কি টেলিফোন করতে চান?
হ্যাঁ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন আমি কথা বলব।
লোকটি চলে গেলে রেক্স বললেন, ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন, ওর সঙ্গে মোকাবিলার জন্যে একটা মতলব আমি এঁটেছি।
বেশ ঠিক আছে। ডিউক রাজি হয়ে গেলেন। রেক্স চলে গেলে ডিউক বলে উঠলেন, প্যারিসকে আমি বড় ভালোবাসি। এর শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য, সবাই আমার অত্যন্ত প্রিয়। সেই যে চলে গিয়েছিলাম তারপর পনেরো বছরের মধ্যে একবারও ফিরে আসিনি। রাজতন্ত্রীদের বিদ্রোহের সময় তাদের পক্ষ নিয়ে আমি যে ভূমিকা নিয়েছিলাম সে জন্যে ফরাসী সরকার কোনোদিনই আমায় ক্ষমা করেনি। সে আজ অনেকদিনের কথা। সেই থেকে আর আমি সাহস করে ফ্রান্সে আসিনি। এর মধ্যে যে দু-একবার এসেছি তা অত্যন্ত গোপনে, এবং খুব জরুরী প্রয়োজনে। আমার খোঁজ পেলে যে কর্তাব্যক্তিরা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জেলে পুরবে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই।
সত্যি ধূসরচক্ষু, আপনি না এলেই ভালো করতেন। এ ব্যাপারটা আমি খেয়াল করিনি। ভেবো না, এতদিনে অবশ্য কর্তা ব্যক্তিরা যে সব ভুলে গেছে।