দি অ্যাডভেন্ট অফ স্যাটান – ৩

এদিকে মরিয়া ট্যানিথ চারদিক থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। খুব কঠিন একটা বাঁক নিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আর সামলাতে পারলেন না, গাড়ি প্রচণ্ড জোরে একটা গোলাবাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেতেই তিনি সামনের কাঁচের উপর ছিটকে পড়লেন। 

বেশ কিছুক্ষণ অবসন্ন হয়ে পড়ে রইলেন, তারপর যখন বুঝতে পারলেন যে কোনো বড়রকম আঘাত পাননি এবং যে কোনো সময়েই পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারেন, তখন কোনোরকমে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামলেন। তাঁর মাথা ঘুরছে, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। কাছেই একটা বড় গর্ত ছিল। কোনোরকমে শরীরটা তার মধ্যে নিক্ষেপ করলেন, গাড়িটা যেখানে পড়ে আছে সেখান থেকে এ জায়গার ব্যবধান ত্রিশ গজের মত! 

দম ফিরে পাওয়ার জন্যে যতটুকু বিশ্রাম দরকার তার পরেই তিনি উঠে কোনোরকমে এগিয়ে চললেন এবং খানিক পরেই একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে গেলেন। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন পুলিশ তখনও গাড়ির আশপাশ খুঁজে দেখছে। তখন তিনি দৌড় শুরু করলেন এই আশা করে যে অন্ধকারে ধরা পড়বেন না। 

মাইলখানেক দৌড়োবার পর ট্যানিথ সম্পূর্ণ বেদম হয়ে পড়লেন, আর পারছেন না, বুক ধড়ফড় করছে। তাঁর মনে হল আর এখন ধরা পড়ার ভয় নেই, এখন কী করবেন তাই ভাবছেন। ম্যাপে যা দেখেছিলেন তাতে তাঁর মনে হল, চিলবেরির যে বাড়িতে শয়তানপন্থীরা একসঙ্গে হয়ে যেখান থেকে বাৎসরিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবে, সে জায়গার ব্যবধান অন্তত পক্ষে বারো মাইলের মত। এবং যদি বা পথ চিনে যেতে পারেন তাহলেও হেঁটে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। 

এই প্রথম তাঁর মনে দ্বিধা দেখা দিল—তিনি যে শয়তানপন্থীদের দলে ভিড়তে যাচ্ছেন সেটা ঠিক হচ্ছে কিনা। যে কয়েক মাস তিনি ওদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন তাতে স্বাভাবিক চিন্তাধারার বদলে তাঁর মনে কেবল কিছু ধোঁয়াটে বিষয়ই প্রবেশ করানো হয়েছে। মানুষ হিসেবে ওরা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আপাতদৃষ্টিতে তাদের স্বাভাবিক ধনী ঘরের মানুষ বলে মনে হলেও তারা এই জীবনের আড়াল থেকে অশুভ জীবন যাপন করে এবং মায়া দয়ার কোমলতার কোনো বালাই তাদের মধ্যে নেই। সেই একটা দিন আমুদে, উৎসাহী রেঞ্জের সঙ্গে ফাঁকায় ঘোরার পর তিনি শয়তানপন্থীদের নিষ্ঠুরতার কথা ভুলে ছিলেন। 

উঠে দাঁড়িয়ে তিনি ঐ অবস্থায় যথাসাধ্য পোশাক ঠিক করে নিলেন। দুর্ঘটনার পরে তাঁর ব্যাগ হারিয়ে গেছে, ফলে পয়সাকড়ি কিছুই নেই, তার উপর চিরুনিটাও নেই যে একটু চুল আঁচড়ে নেবেন। তাঁর এখন চিন্তা রাত কাটানোর মত একখানা আস্তানা খুঁজে পাওয়া তারপর কাল লন্ডনে ফিরবেন। একটা দুশ্চিন্তা ঘুচেছে। গাড়িটা যখন পেয়ে গেছেন তখন আর নিশ্চয় রেক্স তাঁর পেছনে পুলিশ লাগাবেন না। 

ট্যানিথ এগিয়ে চলেছেন, হঠাৎ একটা কালো কুঁজো শরীর তাঁর পাশে দেখা দিল। প্রথমটা তিনি চমকে উঠেছিলেন। তারপর যখন দেখলেন সে একটা কুঁজো বুড়ি, তখন আশ্বস্ত হলেন। 

খনখনে গলায় বুড়ি জিজ্ঞাসা করল, কী গো বাছা, পথ হারিয়েছ নাকি? 

হ্যাঁ ডিভাইজেম রোডের রাস্তাটা আমাকে দেখিয়ে দিতে পারো? 

এযে গো লক্ষ্মী, এসো, আমিও তো সেইদিকেই যাচ্ছি। বুড়ির গলার আওয়াজটা কেমন যেন তাঁর পরিচিত বলে মনে হল। 

ধন্যবাদ বুড়িমা। এই বলে ট্যানিথ বুড়ির পেছন পেছন এগিয়ে চললেন, আর মনে করার চেষ্টা করছেন কোথায় ঐ কণ্ঠস্বর শুনেছেন। 

আয় তোকে হাতে ধরে নিয়ে যাই,–এই বলে বুড়ি তাঁর হাত চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ট্যানিথের মনে পুরানো দিনের স্মৃতি জেগে উঠল। এ হচ্ছে সেই বেদের মেয়ে যাকে তিনি এক মেলায় দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন তখন ছোট্টটি। বুড়ি মিজকা কত আশ্চর্য আশ্চর্য খবর রাখত। এক গ্লাস জলের দিকে তাকিয়ে মানুষের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতও সে গণনা করে বলতে পারত। উৎসাহী ছাত্রের মত ট্যানিথ অনেক কিছুই তার হাতে শিখেছিলেন। 

বলে উঠলেন, তুমি মিজকা, তাই না? 

হ্যাঁ রে বুড়ি, মিজকা। আজ রাত্রেই এসেছি তোকে ঠিক পথ ধরিয়ে দিতে। বুড়ির মিষ্টি কথায় আবার এক নূতন অনুভূতি ট্যানিথের মনে জাগল। 

বুড়ির বলল, ওরে আমি এসেছি তোকে ঠিক পথে নিয়ে যেতে। আয় আমার সঙ্গে।

হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলেন ট্যানিথ। বললেন, না আমি যাব না-। যাব না ওখানে… 

বুড়ি মুখ টিপে হাসল। বলল, এ আবার কী বোকার মত কথা? সেই ছেলেবেলা থেকেই তো তুই এই পথে চলে এসেছিস, সেই যখন ছোট্টটি ছিলি সেই তখনই তো মিজকার কথা শুনে এই পথ বেছে নিয়েছিলি। এই রাতের জন্যে আমি এতকাল অপেক্ষা করে ছিলাম। 

রেক্সের সংস্পর্শে আসার পর থেকে যে নতুন ভাব ট্যানিথের মনে এসেছিল বুড়ির প্ররোচনায় আবার তাতে নাড়া লাগল। তাঁর রেক্সকে মনে হল বোকা সোকা হাসি খুশি মানুষ, আর ডিউককে নির্বোধ মনে হল। কেবলই বাগড়া দেওয়া যার কাজ,—যা করতে যাচ্ছেন তার মধ্যে যে কত বিপদ তা বুঝতে পারছেন না। আর মোকাটার কত ক্ষমতা, কত জ্ঞান! যে সম্মান তাঁকে দেওয়ার কথা হচ্ছে তা গ্রহণ না করা তাঁর পক্ষে অকৃতজ্ঞতা হবে। 

বুড়ি বলল, তা ছাড়া জায়গাটা বেশি দূরেও নয়, এখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল। চল, চল আমার সঙ্গে। 

কেমন একটা ঘোর যেন ট্যানিথের মধ্যে এবং তাঁর চোখ বুজে আসছে, বুজে আসছে। বিড় বিড় করে তিনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ জ্ঞান, শক্তি! শীঘ্রই চল শীঘ্রই চল, না হলে খুব দেরি হয়ে যাবে। 

যেটুকু সংশয় ছিল তাও দূর হল শেষ পর্যন্ত। 

বুড়ি খুশি হয়ে বলল, এই তো ঠিক বলছিস রে! তবে, ভয় নেই, সময় থাকতেই পৌঁছে যাব ঠিক, এই তো সবে সন্ধ্যে। 

মিজকার পাশে পাশে ট্যানিথ যেন যন্ত্রচালিতের মত চলেছেন। এক নতুন শক্তি যেন তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে, সারা দিনের ধকল সত্ত্বেও। হঠাৎ এক সময় তাঁর পায়ে একটা রোমশ বস্তুর ছোঁয়া লাগায় তাকিয়ে দেখলেন, একটা কালো বেড়াল। 

মুহূর্তের জন্যে ট্যানিথ চমকে উঠলেন। কিন্তু বুড়ি মৃদু হেসে তাঁকে আশ্বস্ত করল। বলল, আর ভয় করছিস কেন, এ তো নেবিরোস, ওর সঙ্গে তুই কত খেলেছিস! তোকে দেখে ও খুব খুশি হয়েছে। 

বেড়ালটাকে আদর করার জন্যে ট্যানিথ ঝুঁকে পড়ায় বেড়ালটা খুশির ডাক ডেকে উঠল। দু’জনে আবার এগিয়ে চলল। ট্যানিথের মনে হল যেন কত ঘণ্টা ধরে তিনি হেঁটে চলেছেন। হঠাৎ এক সময় বুড়ি ট্যানিথের হাত ধরে হাড্ডিসার চাপা গলায় বলে উঠল : চোখ বোজ রে, চোখ বোজ, তাকাস নে, এখানে যা আছে তা তোর পক্ষে ভালো নয়। চল যেভাবে আমি নিয়ে যাচ্ছি। 

বুড়ির কথামত ট্যানিথ চোখ বন্ধ করেই চলতে লাগলেন এবং তা সত্ত্বেও তিনি একবারও হোঁচট খেলেন না। কিন্তু তাঁর মনে হল, শুধু বুড়ি নয়, আরও কে একজন যেন তাঁর সঙ্গে রয়েছে। 

এমন সময় একটা চাপা মিষ্টি আওয়াজ তাঁর কানে এল : ট্যানিথ লক্ষ্মীটি, তাকা–আমার দিকে তাকা। 

সঙ্গে ট্যানিথ চোখ খুললেন,–এ কণ্ঠস্বর যে তাঁর একান্ত পরিচিত। দেখলেন তাঁর মা সাদা পোশাকে তাঁর ডাইনে,–এই পোশাকেই তিনি তাঁর মাকে শেষবার দেখেছিলেন। মায়ের মূর্তি এই অন্ধকারে এক অস্বাভাবিক আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। 

মা বললেন, তুই বিপথে যাচ্ছিস ট্যানিথ। আমার কথা শোন, ফিরে যা—সময় থাকতে ফিরে যা! 

ট্যানিথের হঠাৎ উপলব্ধি হল মিজকা মারা গেছে, যে তাঁকে নিয়ে চলেছে সে শয়তানপন্থীদের কোনো চর ছাড়া কিছু নয়। 

তখনও মিজকা তাঁর বাঁয়ে থেকে ক্ষমতা, প্রভুত্ব ইত্যাদির লোভ দেখিয়ে চলেছে। 

ট্যানিথ আবার তাঁর মায়ের গলা শুনতে পেলেন, ট্যানিথ, তোর মহা বিপদ বলেই আমি তোর কাছে আসার অনুমতি পেয়েছি, এবং বেশিক্ষণ থাকতেও পারব না। ও পথ অশুভ পথ, ও পথ ছেড়ে তুই সুপথ ধর, এখনও সময় আছে। তারপরেই মায়ের কণ্ঠস্বরে একটা বিশেষ পরিবর্তন এল। মা বলে উঠলেন, চলে যা মিজকা, – যেখান থেকে এসেছিস সেখানে চলে যা! হোরাক্সের মা আইসিসের নামে, হাউকির মা কোয়ান ইরিনের নামে, প্রভু যীশুর মা মেরীর নামে আমি তোকে চলে যেতে হুকুম করছি। 

যেভাবে কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ থেমে গেল তাতে ট্যানিথের মনে হল যেন তাঁর মাকে কথা শেষ করার আগেই টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উন্মত্তের মত চিৎকার করে ট্যানিথ দু হাত বাড়িয়ে দৌড়ে গেলেন যেখানে তাঁর মাকে দেখেছিলেন, কিন্তু যেখানে কিছুই দেখতে পেলেন না। 

আতঙ্কে তাঁর মনে ভরে উঠল। তিনি তাকিয়ে দেখলেন তিনি যেখানে আছেন তার নিচে শয়তানপন্থীদের সমাগম হয়েছে। বুঝতে পারলেন, অশুভ শক্তি যে সময়ে তাঁকে এতদূরে নিয়ে এসেছে তাতে তাঁর পক্ষে সময় থাকতে এই অশুভ সভায় যোগ দেওয়া সম্ভব হবে। 

ট্যানিথ কিছুক্ষণ সময় ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর মুখ থেকে সমস্ত রক্ত চলে গেছে, আতঙ্কের এক শিহরণ তাঁর সারা শরীরে বয়ে যাচ্ছে। তাঁর ইচ্ছে হল দৌড়ে চলে যান যে পথ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু যে প্রাণী সিংহাসনে বসে আছে তার থেকে তিনি মুখ ফেরাতে পারলেন না। কী এক প্রচণ্ড শক্তি যেন তাঁর পেছিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েচে। মায়ের সাবধানবাণী তখনও তাঁর কানে ধ্বনিত হচ্ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে অন্য দিকে চোখ ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। 

সময় যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। উপত্যকা থেকে যেন এক অপাবি শৈত্য গুড়ি মেরে উঠে এসে পা থেকে আরম্ভ করে আস্তে আস্তে একটু করে তাঁর সর্বশরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। একদিকে শয়তানপন্থীদের আকর্ষণ আর অন্য দিকে তাঁর মায়ের আকর্ষণ। এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে তিনি চলৎশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললেন। তাঁর ইচ্ছে হল বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকেন, কিন্তু কিছুতেই পারলেন না। প্রার্থনা করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু একটা কথাও উচ্চারণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। অথচ তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারলেন যে শয়তানপন্থীদের এই সভা প্রত্যক্ষ করাও মহা পাপ। 

হাঁটু পেতে চেষ্টা করলেন প্রার্থনায় বসতে, এই আশ্চর্য দৃশ্য থেকে পেছিয়ে আসতে, কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। 

এমন এক সময় দেখলেন শয়তানপন্থীরা তাদের পোশাক খুলে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীর শিউরে উঠল, গুলিয়ে উঠল। বমনেচ্ছা জাগল। মনে মনে বলে উঠলেন, ‘উন্মাদ, উন্মাদ ওরা।’ কথাটা বার বার উচ্চারণ করতে থাকলেন। সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তাঁর দেহ দুলছে, তিনি তিক্ত অশ্রু বিসর্জন করছেন। কনকনে হাওয়ায় তাঁর দাঁতে দাঁত লেগে আওয়াজ উঠছে। 

প্রচণ্ড কোলাহলের সঙ্গে একসময় ওদের নৃত্য শেষ হল। তারপর সিংহাসনে বসা ছাগবেশী মানুষটির নিকটে সকলে গেল। ট্যানিথ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন এবার কী ঘটতে চলেছে। এবং সেই সঙ্গে আবার চেষ্টা করলেন পেছিয়ে যেতে। তারপর লক্ষ্য করলেন সাইমনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এবং এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে উপস্থিত হয়েছে অভিষেকের দিন। এবং এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন আতঙ্ক পেয়ে বসল তাঁকে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর দুই পা সচল হল। পা দুটো যেভাবে একটার পর একটা পড়তে পড়তে নেমে যেতে শুরু করল তাতে তিনি আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। চিৎকার করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। পিছু হঠার চেষ্টাও ফলবতী হল না। এক অমোঘ টানে তাঁকে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হল। 

ভুতুড়ে নাচ আর গানবাজনা বন্ধ হয়ে পূর্ণ স্তব্ধতা বিরাজ করল। শয়তানপন্থীদের মধ্যে যারা নিকটতম তাদের থেকে তাঁর দূরত্ব শেষ পর্যন্ত দশ গজের মধ্যে এসে গেল। হঠাৎ ট্যানিথ অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। ছাগ মুখোশধারীর জ্বলন্ত চোখ তাঁর উপর নিবদ্ধ হল যদিও তখনও তিনি ছিলেন আড়ালে। 

ট্যানিথ বুঝতে পারলেন যে, আর তাঁর কোনোরকমেই নিস্তার নেই। রেক্সের আর তাঁর মায়ের কথা সতর্কতার বাণী বড় বেশি দেরিতে এসেছিল। শয়তানপন্থীদের আকর্ষণ উপেক্ষা করা কোনোমতেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারেই তিনি সেই অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হতে চলেছেন। 

রিশলোর হতাশ ভাব লক্ষ্য করে রেক্সেরও প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মতই অবস্থা হল, শীতল ঘাম তাঁর কপালে দেখা দিল। কিন্তু তবুও তিনি সেই আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে চললেন। যে বন্ধুর অদম্য উৎসাহে তিনি চালিত হয়ে এসেছেন তাঁর এই অবস্থা দেখে এখন তিনি নিজের হাতেই হাল ধরবেন ঠিক করলেন। এটুকু বুঝতে তাঁর অসুবিধে হল না যে বন্ধুবরের এই অবসন্নতার কারণ হচ্ছে বিপদের গুরুত্ব সম্পন্ধে অধিক উপলব্ধি। 

তাই হঠাৎ বলে ফেললেন, কিন্তু এ অবস্থায় তো পেছিয়ে যাওয়া চলে না। ঠিক আছে আপনি এখানেই থাকুন, আমি একাই যাচ্ছি। 

ডিউক তাঁকে বাধা দিলেন। বললেন, না না রেক্স, দেখার সঙ্গে সঙ্গে এরা তোমাকে হত্যা করবে। 

বটে? বেশ, দেখাই যাক না। সে ক্ষেত্রে তো কিছু না হোক ওদের পেছনে পুলিশ লাগানোর একটা কারণ আপনি পাবেন যা পুলিশ বুঝবে, এবং আমিও সান্ত্বনা পাব যে আমাকে হত্যা করার ফলেই ওদের ফাঁসি হতে চলেছে। 

আরে দাঁড়াও দাঁড়াও,—একা তোমাকে যেতে দেব না। তুমি কি জান না যে মৃত্যুভয় আমার একেবারেই নেই বললেই চলে। জেনে রাখ ঐ ছাগলের দৃষ্টি যদি তোমার চোখে পড়ে তো তুমি পাগল হয়ে যাবে, তখন আমি পুলিশকে কী বোঝাব? জেনে রাখ, পাগলাগারদের অধিকাংশ রোগীই হয়তো পাগল হয়ে গেছে অত্যন্ত ভয়াবহ কোনো দৃশ্য দেখার জন্য। 

রেক্স এখন মরিয়া। তিনি বলেন, তা হোক, সে ঝুঁকি আমি নেব। এই বলে তিনি ক্রুশটা তুলে নিলেন। বললেন, এই ক্রুশই আমাকে রক্ষা করবে। 

বেশ ঠিক আছে।—কিন্তু কী জান, শুধু বর্তমান জীবনের কথাই নয়, আমি পরের জীবনের কথাও ভাবছি—এ জীবন তো কিছুই নয়। হা ঈশ্বর যদি দিনের আলো ফুটত, বা কোনোদিক থেকে কোনোরকম আলোর আভাস পেতে পারতাম যা এই অন্ধকারের উপাসকদের উপরে প্রভাব ফেলতে পারে। 

কিন্তু সে নিয়ে আর এখন চিন্তা করার সময় নেই, তাড়া আছে, ভীষণ তাড়া এখন।

দাঁড়াও দাঁড়াও। হঠাৎ ডিউক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন : ঠিক হয়েছে, পেয়ে গেছি! এস এস—তাড়াতাড়ি, বলেই তিনি পাহাড় বেয়ে উঠে যেতে শুরু করলেন। 

রেক্স পিছু নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন কী কী মতলব ঠিক করেছেন? 

গাড়িটা, গাড়িটা। হাঁপাতে হাঁপাতে ডিউক বললেন গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে—ওদের আক্রমণ করা সব সময়েই অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু এর ফলে হয়তো আমরা একটা সুযোগ পেয়ে যেতে পারি। 

রেক্সের মনে হল ডিউক আবার তাঁর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেয়েছেন। ডিউক বলে চললেন, দশ ভাগের মধ্যে এক ভাগ হয়তো আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা আছে, তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। যখন বলব হেডলাইট দুটো জ্বেলে দেবে আর পাশ দিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রুশটা সিংহাসনের ঐ বস্তুটির দিকে ছুঁড়ে মারবে। তখন হয়তো সাইমনকে উদ্ধার করার একটা সুযোগ আসতে পারে। 

অপূর্ব, অপূর্ব মতলব। রেক্স হাসতে হাসতে বললেন, তাঁর সব উত্তেজনা কোথায় চলে গেছে—চলুন তাহলে, চলুন! 

কিছু সময়ের মধ্যেই শয়তানপন্থীদের মধ্যে যে ছিল সবার কাছে গাড়ি প্রায় সেখানে পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডিউকের ইশারায় রেক্স গাড়ির অত্যন্ত শক্তিশালী হেডলাইট দুটো জ্বেলে দিলেন। 

একমুহূর্তে প্রখর আলোর ঝলকে ওদের বর্বরতা প্রকাশ হয়ে গেল—গাড়ি যতই এগোতে লাগল ততই তা বেশি মাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। ডিউক ঈশ্বরকে স্মরণ করে প্রচণ্ড বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন, সোজা সিংহাসনে বসা মেণ্ডিসের ছাগলকে লক্ষ্য করে। 

তখন আলোর অন্ধ-করা প্রথম ঝলকে উলঙ্গ শয়তানপন্থীরা আড়াল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠল—কোনো অতিবিশাল দৈত্য যেন দুই চোখ মেলে তাদের উপর লাফিয়ে পড়েছে। 

ঘুচে গেল উন্মত্ত উল্লাস। ওরা যেন বুকচাপা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে অসহায় অবস্থা সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উল। আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে, উলঙ্গের দল ছড়িয়ে পড়তে লাগল আর গাড়িটা প্রচণ্ড বেগে সোজা ছাগলটার দিকে ধেয়ে চলল। হেডলাইটের আলো সেখানে পড়ছে কিন্তু রেক্সের পলকের জন্য ভাবনা হল, যদি ছাগলের অশুভ দৃষ্টির প্রভাবে গাড়ির হেডলাইট অকেজো হয়ে যায়! কিন্তু অকুতোভয় ডিউক তাকে লক্ষ্য করে স্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে সামনে এগিয়ে চললেন। 

রেক্স যখন হেডলাইট জ্বেলে দিয়েছিলেন সেই থেকে মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ি সোজা একেবারে ওদের মধ্যে পৌঁছে গেল। তখন রেক্স গাড়ির পাদানিতে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ক্রুশটা ছাগলকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে, পাছে সিংহাসনের ধাক্কা লাগে সেই ভয়ে ডিউক গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন। সাইমন অন্যদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি অত্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেছেন। 

নারকীয় বেদীতে যে সব কালো মোমবাতি জ্বলছিল সব গেল নিবে, যে কোনো অদৃশ্য হাতের প্রভাবে। আবার সেই আতঙ্কিত আলোয় দেখা গেল, রেক্সের নিক্ষিপ্ত ক্রুশ ছাগলের মুখ ভেদ করে চলে গেছে। 

পোড়া মাংসের গন্ধ মোমবাতির গন্ধকের গন্ধের মিশে যেন বিষাক্ত গ্যাসে পরিণত হল। কিন্তু তখন আর তাঁদের এসব চিন্তার সময় নেই, সেই সময়েই রেক্স সাইমনকে ঘাড়ে ধরে গাড়িতে তুলে নিলেন। এলিয়ে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালেন সাইমন। ডিউকের মুখে পুনরায় স্তোত্র উচ্চারিত হতে লাগল। 

বড় রাস্তায় পৌঁছে ডিউক লন্ডন লক্ষ্য করে গাড়ি জোর বেগে ছুটিয়ে দিলেন। 

লন্ডনের প্রবেশের মুখে পৌঁছে ডিউক গাড়ি থামিয়ে রেক্সের মুখের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ওর কী খবর? 

একবারে চুপচাপ পড়ে আছে। 

পকেট থেকে একটা ফ্লাস্ক বার করে ডিউক রেক্সের হাতে দিলেন। বললেন, এর যতটা পার ওকে খাইয়ে দাও, হয়তো তাহলে খানিকটা সামলে নিতে পারবে। 

সাইমনের মুখ জোর করে খুলে রেক্স সেই পুরানো ব্র্যাণ্ডি খানিকটা খাইয়ে দিলেন।

হঠাৎ সাইমনের দম আটকে গেল। তিনি খাবি খেয়ে মাথা ঝাঁকালেন, চোখ মেলেন, কিন্তু সে দৃষ্টি দেখে মনে হল না তিনি রেক্সকে চিনতে পেরেছেন। তারপরই তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মাথা হেলে পড়ল। 

রেক্স বললেন, যাই হোক ও যে বেঁচে আছে তাই যথেষ্ট। এক্ষুনি ওকে নিয়ে আমাদের লন্ডনে কিংবা কোনো ডাক্তারের নিকটে যাওয়া দরকার। 

সাহস পাচ্ছি না রেক্স। শয়তানরা সামলে উঠে সম্ভবত চিনবেরির কাছের বাড়িটায় চলে যাবে এবং তারপর যে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়ন্ত্রে লিপ্ত হবে তাতে সন্দেহমাত্ৰ নেই। 

মানে, বলতে চাইছেন যেহেতু মোকাটা আপনার বাড়ি চেনে না তিনি তাই আবার সাইমনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতলব করবেন? 

তার থেকেও খারাপ, সন্দেহ আছে তারা আমাদের আদৌ সেখানে পৌঁছতেই দেবে কি না। 

তা কেমন করে ওদের পক্ষে সম্ভব হবে? 

যে কোনো নিকৃষ্ট প্রাণীকেই ওরা বশ করতে পারে–বাদুড়, ইঁদুর, সাপ, পেঁচা, বিড়াল, খেঁকশিয়াল এমনকি কোনো কোনো জাতের কুকুরকে পর্যন্ত, যথা নেকড়ে-কুকুর আর অ্যালসেশিয়ান। সেরকম কোনো প্রাণী যদি আমাদের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয় তাহলে গাড়ি উলটে যাওয়া সম্ভব। তা ছাড়া প্রকৃতির উপরেও নিশ্চয় ওদের একটু আধটু নিয়ন্ত্রণ আছে। খুব ঘন কুয়াশা পাঠিয়ে ওরা আমাদের সারাদিন আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে। যে কোনো গাড়ি সামনের দিক থেকে এসে আমাদের গাড়ির হেডলাইট দেখতে না পেয়ে প্রচণ্ড বেগে মুখোমুখি ধাক্কা মারতে পারে। তাহলে লন্ডনের এই সত্তর মাইল পথে আমাদের কোনো মারাত্মক দুর্ঘটনায় ফেলা ওদের পক্ষে অসম্ভব হবে না। সুতরাং যতক্ষণ না দিনের আলো দেখা দিচ্ছে ততক্ষণ আমাদের মহা বিপদের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। 

রেক্স বললেন, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে তো আমরা এখানেই থেকে যেতে পারি না। 

তা তো বটেই। এমন কোনো বিশেষ জায়গা এখন আমাদের প্রয়োজন যেখানে সাইমন নিািরপদ, অন্তত যতক্ষণ না ভোর হচ্ছে। 

কোনো গীর্জা হলে হয় না? 

হ্যাঁ, কিন্তু খোলা পাওয়া চাই তো তাছাড়া কেমন করে গীর্জার লোকদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব, তারা তো আমাদের পাগল মনে করবে। হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে। ব্রিটেনের সব থেকে পুরানো মন্দিরে আমরা যাব, যার মাথায় ছাদ নেই। এই বলে ডিউক স্বস্তির হাসি হেসে গাড়ি চালিয়ে দিলেন। 

শেষ পর্যন্ত গাড়ি স্টোনহে রেঞ্জে পৌঁছে গেল। অধিবাসীরা সবাই সুপ্ত। অন্য দিকে যে আলোর সাথে অন্ধকারের ক্ষমতার লড়াই চলছে সে সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞানই নেই। রাস্তার পাশে গাড়ি রাখার জায়গার ডিউক গাড়ি রাখলেন। তারপর রেক্স সাইমনকে কাঁধে তুলে নিলেন এবং ডিউক তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকলেন। পুরানো মন্দিরটি বহু যুগ ধরে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরটির কোনো কোনো অংশ ভেঙে পড়ছে। সেইসব ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে ডিউক বেদীর কাছে এগিয়ে চললেন। ডিউকের ইঙ্গিতে রেক্স সাইমনকে সেখানে শুইয়ে রাখলেন,–তখনও তাঁর জ্ঞান আসেনি। ডিউক বললেন, ভ্যান, এই মন্দিরটি ইউরোপের পবিত্রতম স্থানের অন্যতম, যুগ যুগ ধরে কত মানুষ যে এখানে উপাসনা করে গেছে তার সংখ্যা নেই,–অন্ধকারের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আলোর শক্তির আবাহন করেছে,—তাদের আত্মার অনুরণন আমাদের ঘিরে রয়েছে, ভোর পর্যন্ত আমাদের এখানে কোনো ভয় নেই। 

রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন, একে নিয়ে এখন কী করবেন? 

প্রথম কাজই হবে একে অশুভের প্রভাব থেকে মুক্ত করা। এস আমরা হাঁটু নিচু করে প্রার্থনা করি। জেনে রেখো শুদ্ধ মন নিয়ে প্রার্থনা করলে তা কখনও ব্যর্থ হয় না। কিন্তু সাবধান, ও যদি লাফালাফি করে তো ওকে ধরে রাখতে হবে, কারণ যদি অশুভের কোনো প্রভাব এখনও ওর মধ্যে থেকে থাকে তো ও তা মত্ত আক্রোশের সঙ্গে বাধা দেবে। 

খানিকটা পবিত্র জল নিয়ে ডিউক সাইমনের কপালে ছিটিয়ে দিলেন। সেই জল কিছুক্ষণ পরে কপাল থেকে গড়িয়ে একটু একটু করে তাঁর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ল। 

ডিউক বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, কোনো অশুভ শক্তি সাইমনের মধ্যে নেই। তা যদি থাকত তো এই পবিত্র জল তার কপালে ফুটন্ত তেলের মতো জ্বালা ধরিয়ে দিত যার ফলে ওকে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠতে হত। তবে, ওর মধ্যে এখনও অশুভের স্পর্শ রয়ে গেছে, তাই এখন আমাদের কাজ হবে ওকে তা থেকে মুক্ত করা। আর সেইসঙ্গে চেষ্টা করতে হবে যাতে মোকাটার প্রভাব আর ওর উপরে না পড়ে। তারপর লক্ষ্য করতে হবে, ওর এই আচ্ছন্ন ভাব কেটে যাচ্ছে কিনা। 

সাইমনের শরীরে পবিত্র জল আর পবিত্র তেল মাখানো হল। আরও অনেক রকম প্রক্রিয়াই ডিউক করলেন যার কোনো তাৎপর্যই রেক্সের বোধগম্য হল না। 

ঘণ্টাখানেক ধরে এইসব ব্যাপার চলার পর ডিউক আবার সাইমনকে পরীক্ষা করলেন। তাঁর দেহ আর এখন ততটা ঠান্ডা নয়, মুখে আতঙ্কের যে সব রেখা ফুটে উঠেছিল তাও ঘুচে গেছে। তিনি এখন স্বাভাবিক ঘুমে আচ্ছন্ন, তাঁর শ্বাস প্রশ্বাসও এখন স্বাভাবিক 

ডিউক বললেন, আমরা যে ওকে বাঁচাতে পেরেছি সেটা হল ঈশ্বরের অপার কৃপা। যাই হোক এখন ঘুমোতে দেব। জাগলে নিজে থেকে জাগবে। আগে আমাদের বিশ্রাম করা দরকার কারণ এখন আর কিছু করার নেই। 

রেক্স বললেন, কী প্রাচীন এই মন্দির! এর কত বয়স হবে মনে হয়? 

প্রায় চার হাজার বছর। 

হঠাৎ সাইমনকে নড়তে দেখে ওঁরা উঠে দাঁড়ালেন। সাইমন আস্তে আস্তে তাঁদের দিকে ফিরলেন, এবং তাঁর দৃষ্টি দেখে ওঁরা বুঝতে পারলেন সাইমন চিনতে পেরেছেন। ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোথায়? 

কথার কোনো জবাব না দিয়ে ডিউক সাইমনকে তাঁর আর রেক্সের মাঝখানে হাঁটু পেতে বসালেন এবং নিজেরাও হাঁটু পেতে বসলেন, আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমরাও আবৃত্তি কর। 

হে ঈশ্বর, আমাকে কৃপা কর, আমার সব পাপ এবং অপরাধ তোমার অপার মহত্ব দিয়ে দয়া করে ধুয়ে দাও, আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি। 

তারপর ডিউক ধর্মগ্রন্থ থেকে যেসব কথা পড়লেন সেগুলোও ওঁরা তাঁর সঙ্গে আবৃত্তি করলেন। তারপর সবাই উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাবার্তা আরম্ভ করলেন। 

ডিউক তখন সাইমনকে যা যা ঘটেছিল তাই বললেন। সাইমনের মগজ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ায় তাঁর বুঝতে অসুবিধে হল না কী ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুর মতো কান্না শুরু করলেন তিনি। তখন তাঁর স্মৃতি জাগরণ হয়ে উঠল, তাঁর বাড়িতে যে সমাবেশ হয়েছিল তার কথা। ডিউক তাঁকে সমাহিত করেছিলেন তাও মনে পড়ল। তারপরের কিছুই মনে নেই যতক্ষণ না তিনি সেই উপত্যকার বাৎসরিক সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। এবং তখন যা দেখেছিলেন তাও তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, যেন তাতে তাঁর কোনো অংশ ছিল না, যেন দূর থেকে দেখেছিলেন। এবং যখন শেষ পর্যন্ত দেখেন তাঁরই মত এক ব্যক্তি সেইসব ঘৃণ্য অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে তখন একেবারে আতঙ্কের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। অথচ নাকি আর তাঁর কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। 

পুব আকাশে ভোরের আলো প্রবেশ করছে। ডিউক সস্নেহে সাইমনকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, এ নিয়ে বেশি মন খারাপ কোরো না সাইমন। যাই হোক এবারের মতো তো আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি। এই বলে তিনি রেক্সকে সাইমনের জন্যে কিছু পোশাক কিনে আনতে পাঠালেন। গাড়ি নিয়ে রেক্স বেরিয়ে পড়লেন। 

রেক্স চলে গেলে ডিউক সাইমনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, কেমন করে তুমি ঐ ভীষণ বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়লে? 

সাইমন বললেন, তাহলে শুনুন। প্যারিসে থাকতে এক ফরাসী ব্যাঙ্কারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, তাঁর নাম হচ্ছে ক্যাস্টেলনাওয়ের। ওর বাড়িতে আমার মোকাটার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। বলেন পরের দিন রাত্রে তিনি ম্যাজিক নিয়ে একটা পরীক্ষা করবেন। গেলাম সেখানে, অনেক কিছুই তিনি আমাকে দেখালেন, বললেন এর ফলে প্রচুর জ্ঞান আর শক্তি লাভ হয়। সেই যে আমি লোভে পড়েছিলাম সেই থেকেই শেষ পর্যন্ত আমার এই দুর্দশা। 

হায় বেচারা সাইমন। আচ্ছা এবার এই মোকাটা সম্বন্ধে কিছু বল শুনি। 

তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রচণ্ড! এবং ইচ্ছে করলে তিনি মানুষের সঙ্গে অতি চমৎকার ব্যবহার করতে পারেন। অসাধারণ বুদ্ধি ধরেন, এবং অনেক পড়াশুনা করেছেন। বিশেষ করে স্ত্রীলোকদের উপরে তাঁর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। 

তাঁর অতীত সম্বন্ধে কি কিছু বলতে পার? 

না বিশেষ নয়। তাঁর নাম দাঁমিয়ে, জাতে ছিলেন ফরাসী কিন্তু পদবি জানি না। কিন্তু তাঁর মা আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী। তিনি গীর্জার বৃত্তি গ্রহণের জন্য লেখাপড়া শিখেছিলেন, কিন্তু সেই বৃত্তি পছন্দ না হওয়ায় তা ত্যাগ করেন। সূচিশিল্পে তিনি অত্যন্ত নিপুণ। এবং তাঁর ম্যানিয়া ছিল দু হাত খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। তিনি ছিলেন সঙ্গী হিসেবে অপূর্ব সঙ্গী। যখন তিনি খুব দামী সেন্ট ব্যবহার করতেন তখন ছাড়া—আর মিষ্টির প্রতি তাঁর যে লোভ তা স্কুলের ছেলেমেয়েদেরকেও হার মানায়, তাঁর ব্যবহারে একটাই দোষ ছিল অত্যন্ত রাগ। ব্যবহার সুন্দর হলেও তিনি অল্পতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন। সে অবস্থায় প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মতো থাকবার পর দিন দুয়েকের জন্যে কোথাও চলে যান। একবার সেই দু দিনের অন্তর্ধানের পরে যখন ফিরছিলেন তখন হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হয়। কী চেহারা হয়েছিল তখন। গালে দু দিনের দাড়ি, শরীর নোংরা, পোশাক সব ছিন্নভিন্ন, আর অসহ্য মদের গন্ধ তাতে, মনে হল এই দু দিন তিনি একটুও ঘুমোননি, আর যত কুকীর্তি সম্ভব তার কোনোটাই বাদ দেননি। তাছাড়া তার সম্মোহন করার শক্তিও অসাধারণ। 

এমন সময় রেক্স ঘরে ঢুকলেন তাঁদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ল। একগাল হাসি হেসে দেখালেন তিনি সাইমনের জন্য কী পোশাক কিনে এনেছেন। বললেন, কাপড়ের দোকান সব বন্ধ থাকায় একটা খেলাধুলোর দোকান থেকে আমাকে কিনতে হল। 

যে সব জিনিস রেক্স কিনে এনেছেন সাইমনকে সেগুলো দেখতে দেখে ডিউক হাসিতে ফেটে পড়লেন। সাইমন বললেন, উঁহু, এসব পরে আমি লন্ডনে যেতে পারব না। ডিউক ঘোষণা করলেন, লন্ডনে নয়, আমরা যাচ্ছি কার্ডিন্যালম বালিতে। 

সেকি, মেরী লাও-এর বাড়িতে? 

রেক্স বলে উঠলেন, কিন্তু এ মতলব কেন মাথায় এল? 

এ কথায় সাইমন খুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকলেন। বলে উঠলেন, না না, এ আমার একটুও ভালো লাগছে না, এ আমি চাই না। এর ফলে যদি ওদের বিপদে পড়তে হয় তাহলে আমি কোনোদিনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। 

আমার কথামতো চলবে, বন্ধু! এমন স্বরে ডিউক বলে উঠলেন যাতে কেউ কোনো আপত্তি করতে না পারে। বললেন, রিচার্ড আর মেরী লাও, এরাই হল আমাদের পরিচিতদের মধ্যে সব থেকে বেশি মানসিক শক্তির অধিকারী। সেখানকার আবহাওয়াই হবে সাইমনের বর্তমান অবস্থার পক্ষে বিশেষ অনুকূল এবং আমরা যে সেখানে বিশেষভাবে স্বাগত হব তাতেও সংশয় নেই। যদি উপযুক্ত সাবধানতা নিই তাদের কোনো অনিষ্ট হবে না, এবং তাদের মনের শক্তি আমাদের মধ্যে কিছুটা বাড়তি মনের শক্তি এনে দেবে, যার দরকার আমাদের কাজে অত্যন্ত বেশি। তা ছাড়া কী জান, একমাত্র তারাই আমাদের কাহিনি বিশ্বাস করবে, পাগলের কথাবার্তা বলে উড়িয়ে দেবে না। নাও, যাবার জন্য প্রস্তুত হও। 

ঘাড় নেড়ে সাইমন পাথরগুলোর অন্তরালে চলে গেলেন। রেক্স বললেন, ঠিক আছে, আর আমি স্থানীয় সরাইখানায় ডিম আর শুয়োরের মাংস অর্ডার দিয়ে এসেছি, ভীষণ খিদে পেয়েছে। 

ডিউক বললেন, নো, ডিম আর ফল, শুয়োরের মাংস আপাতত আমাদের কারুরই চলবে না, মাংস এড়িয়ে যেতেই হবে। মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে দৈহিক শক্তি একটু কমানো একান্তভাবেই প্রয়োজন। 

একটা আর্ত ধ্বনি রেক্সের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। তিনি বললেন, হায় সাইমন! কেন যে তুমি এই কবচের খোঁজে বেরিয়ে বন্ধুদের এমন বিপদে ফেললে! 

ডিউক বলে উঠলেন, ভালো কথা, সাইমন, কি এই কবচ বল তো যার কথা রেক্স কাল রাত্রে বলছিল? 

উদ্ভট পোশাক পরতে পরতে সেখানে থেকেই সাইমন বললেন, সেই কবচ পাওয়ার জন্যেই মোকাটা আমাকে ফিরিয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। কোনোও স্থানে সেটা পোঁতা আছে, যুগ যুগ ধরে শয়তানপন্থীরা তার সন্ধানে ফিরছে। যে সেটা পাবে সে হবে অসীম ক্ষমতার অধিকারী। মোকাটা জেনেছেন, সেটা কোথায় আছে তা তিনি জানতে পারবেন যদি রণদেবতা মঙ্গলের সঙ্গে শনির এক সঙ্গে উপযুক্ত ভাবে পূজা আরাধনা করতে পারেন, এবং সেই কাজে এমন একজনের সাহায্য তাঁর দরকার যার কোনো বিশেষ সালে মঙ্গল আর শনির মিলিত হওয়ার লগ্নে জন্ম হয়েছে। এ হেন মানুষ খুব বেশি থাকতে পারে না। আমার অপরাধ, আমিই হলাম সেইরকম একজন। এবং যদিও বা সে এইরকম আর কাউকে পেয়ে যায় হয়তো অন্যান্য দিক দিয়ে ওকে এ ব্যাপারে আমার মতো উপযুক্ত মনে হবে না। 

হ্যাঁ, তা বুঝতে পারলাম, কিন্তু কী বস্তু এই কবচটা? 

ঠিক জানি না। কী জানেন, গত দুমাস ধরে মোকাটার নির্দেশ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই আমার মগজ ঠিক কাজ করছে না। তবে, সেটার নাম গেটের কবচ। 

কী কী বললেন? লাফিয়ে উঠলেন ডিউক। আর সেই মুহূর্তেই সাইমন নূতন পোশাকে সেজে উপস্থিত হলেন। দেখে রেক্স হো হো হাসিতে ফেটে পড়লেন। কিন্তু ডিউকের গম্ভীর মুখ দেখে সংযত হয়ে উঠলেন। 

ডিউক প্রায় আস্তে আস্তে বললেন, ও গেটের কবচ। হ্যাঁ তার সঙ্গে চার ঘোড়সওয়ারের সম্বন্ধ আছে মনে হচ্ছে—’অ্যাপোক্যালিপসের চার ঘোড়সওয়ার’–যথা যুদ্ধ, প্লেগ, দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যু। অ্যাপোক্যালিপস হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের সমাপ্ত অধ্যায়, কথাটির অর্থ হচ্ছে রহস্যোদ্‌ঘাটন। এই চার ঘোড়সওয়ার যখন একসঙ্গে হয়েছিল তখন যে কি ঘটনা ঘটেছিল সে তো আমরা সকলেই জানি। 

রেক্স বললেন, অবশ্যই আপনি বিশ্বযুদ্ধের কথা বলছেন? 

ঠিক। এবং যারা খবর রাখে তারা সবাই জানে যে শয়তানপন্থীদের মধ্যে যারা সব থেকে ভয়ঙ্কর তাদেরই একজন সেই গুপ্ত গেটের সন্ধান পেয়েছিল, এবং সেই গেট খুলে ঐ চার অশ্বারোহীকে মুক্ত করে দিয়েছিল। 

রেক্স বললেন, জার্মানিরা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে একটু এগিয়ে ছিল, কিন্তু তাহলেও শুধু তারা নয়, আরও প্রচুর দেশকেও এজন্য দায়ী করা যেতে পারে। 

ডিউক বলে উঠলেন, মূর্খ, মূর্খ তুমি! যুদ্ধ জার্মানি শুরু করেনি। শুরু করেছিল রাশিয়া, সারাজেভোর হত্যাকাণ্ডে উস্কানি দিয়ে। অস্ট্রিয়ার দাবিতে বাধা দেবার জন্যে সে সার্বিয়াকে সাহায্য করে। রাশিয়াই প্রথমেই জার্মানিকে আক্রমণ করে যুদ্ধ শুরু করে। সন্ন্যাসী রাসপুটিনের শয়তানিই ছিল এই যুদ্ধের ব্যাপারে দায়ী। ব্ল্যাক ম্যাজিকের ব্যাপারে তার মতো ওস্তাদ বেশ কয়েক শতাব্দীর মধ্যে জন্মায়নি। চার ঘোড়সওয়ারকে ছেড়ে দেওয়ার একটা দরজার সন্ধান সে পেয়েছিল যাতে তারা এসে মানুষকে হত্যার ও ধ্বংসের তাণ্ডবে মাতিয়ে তুলতে পারে। সে হচ্ছে প্রথম। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে এই গেটের কবচ। ওই ধরনের আর একটা তাণ্ডবের জন্যে এখন ইউরোপ প্রস্তুত। সুতরাং প্রশ্নটা আর এখন শুধুমাত্র সাইমনকে উদ্ধার করাই নয়, মোকাটা কবচটা হাত করার আগে আমাদের তাঁকে হত্যা করতে হবে, নতুবা আবার একটা বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। 

এবার নিয়ে রিচার্ড ঈটন দুবার টেলিগ্রামটা পড়লেন : খুব জরুরি, লাঞ্চ খাবে না। সাইমন অসুস্থ তাকে নিয়ে রেক্স আর আমি বিকেলবেলা যাচ্ছি। মেরী লা-ও খাবে না। ফ্লাওয়ারের জন্যে চুমু। দ্য রিশলো। 

হতবুদ্ধি রিচার্ড মৃদু হেসে টেলিগ্রামটা তাঁর স্ত্রীর হাতে দিলেন। বললেন, নাও, ডিউকের টেলিগ্রাম। উনি কি পাগল হয়ে গেছেন? 

 ধ্যাৎ কি যে বল; উনি যাই করুন কোনোমতেই আমি ওঁকে পাগল বলে ভাবতে পারব না।

কিন্তু ভেবে দেখ, অমন চমৎকার বাগদা চিংড়ি এল, আর আজই কিনা লাঞ্চ বারণ। মেরী লাও বললেন, কী পেটুক, কী পেটুক তুমি! উদরপূর্তি ব্যতীত আর তোমার কোনো চিন্তাই নেই। 

রিচার্ড বললেন, ওসব কথা থাক। কিন্তু ডিউকের কী উদ্দেশ্য বল তো? 

তা কী করে বলব? তবে, বিশেষ কারণ যে আছে তাতে সন্দেহ নেই, নতুবা তিনি অমন টেলিগ্রাম করতেন না। 

এমন সময় ‘মা, মা।’ শব্দ করতে করতে যে ছোট্ট মেয়েটি এল তাকে মেরী লাও-এর ছোট সংস্করণ বলা যেতে পারে। এল যেন ঘূর্ণিবায়ুর মতো। সে বলে উঠল, জান, জিমের লেগেছে! 

রিচার্ড বললেন, তাই নাকি? আহা, বেচারা জিম! দেখতে হবে তো! 

ফ্লাওয়ার বলল, বড্ড লেগেছে গো! এই বলে সে তার মায়ের স্কার্ট ধরে টানতে লাগল জান, ম্যাজিকের তরোয়ালে কেটে গেছে। 

আহা, বেচারা! মেয়ের ঘন কোঁকড়ানো চুলে আঙুল চালাতে চালাতে মেরী লাও বলে উঠলেন। তিনি জানেন, ম্যাজিকের তরোয়াল বলতে ও কাস্তে বোঝাচ্ছে। জিজ্ঞাসা কর, তা কোথায় সে? 

দিদা বেঁধে দিয়েছে। আর জান, আমি খুব সাহায্য করেছি! 

রিচার্ড জিজ্ঞাসা কলেন, তা রক্ত দেখে তুমি ভয় পাওনি তো? 

এ কথায় ফ্লাওয়ার ঝাঁকড়া মাথা দুলিয়ে বলল, না! মা বলেছে ফ্লাওয়ার কিছুতেই ভয় পায় না। কেন রক্ত দেখে ভয় পাব? 

তার বাবা বললেন, যারা বোকা তারা মাঝে মাঝে ভয় পায়। কিন্তু তাই বলে মা-র মতো, তোমার মতো আর আমার মতো ব্যক্তি কি ভয় পায়? আমরা তো আর বোকা নই! 

ঠিক সেই সময় ফ্লাওয়ারের নার্স এলেন। বললেন ও কিছু নয়, ও ওর কাস্তেয় ধার দিচ্ছিল, আঙুলটা একটু কেটে গেছে। 

ফ্লাওয়ার সুর তুলে বলে উঠল, কিন্তু ভেবে দেখ, যদি ও কাজ করতে না পারে?

কেন, কী হবে তাহলে? তার বাবা জিজ্ঞাসা করলেন। 

বেশ কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করে ফ্লাওয়ার বলল, ও তো গরিব, ছেলেমেয়েদের খাওয়াবার জন্যে তো ওকে কাজ করতে হবে। তাই যদি কাজ করতে না পারে তাহলে মুস্কিলে পড়বে না? 

তার বাবা তার সঙ্গে এক মত হলেন। বললেন, সত্যিই ব্যাপারটা গুরুতর। তাহলে কী করা যায় বল তো? 

সবাইকেই কিছু কিছু দিতে হবে। রিচার্ড বললেন, তা আমি আড়াই শিলিং দেব।

আমিও আড়াই শিলিং দেব। উদার ফ্লাওয়ার বলল। 

তা পয়সাটা তোমার আছে তো? তার মা জিজ্ঞাসা করলেন। 

একটু ভেবে দেখল ফ্লাওয়ার। তারপর বলল, না, বোধ হয় নেই। তাই তার বদলে আধ পেনি দেব 

বাঃ খুব ভালো। আর আমি দেব এক শিলিং। তার মা বললেন, ব্যস, তাহলেই হল তিন শিলিং আর সাড়ে ছ পেনি তাই না? 

কিন্তু দিদাও তো কিছু দেবে? এই বলে সে নার্সের দিকে তাকাল। নার্স হেসে বললেন, তিনি চার পেনি দেবেন। 

রিচার্ড হেসে বললেন, বাঃ তাহলে তো সবসুদ্ধ হল তিন শিলিং, আর সাড়ে দশ পেনি। তবে আর কী, ও তো বড়লোক হয়ে যাবে! জীবনে আর কোনোদিনই অভাবে পড়বে না, তাই না? বেশ, এবার টলতে টলতে চল লাঞ্চে। 

তখনও লাঞ্চ ঠিক সারা হয়েছে কি না হয়েছে, এমন সময় মার্লিন এসে খবর দিল, অতিথিরা এসেছেন। আশ্চর্য হলেন ওঁরা, কারণ তখন সবে বেলা দুটো। 

বড় বড় জানালা দিয়ে ওঁদের আসতে দেখে মেরী লাও বলে উঠলেন, ঐ যে এসে গেছেন! দেখ দেখ সাইমনের দিকে তাকিয়ে! নিশ্চয় ওঁরা সবাই পাগল হয়ে গেছেন! 

আশ্চর্য নয় এমন মনে করা। সাইমনের পরণে হাফপ্যান্ট, হাতাহীন কোট যার নাম কেপ, যা পরে সাইকেল চালায় আর বেগুনি আর কমলালেবু রঙের উদ্ভট ক্রিকেট খেলোয়াড়ের টুপি। অভ্যর্থনা পর্ব তাড়াতাড়ি শেষ হল, সবাই গেলেন বসবার ঘরে। 

ডিউককে মেরী লাও বললেন, ধূসর চক্ষু, আপনার টেলিগ্রাম পেয়ে পর্যন্ত আমরা ভেবে মরছি, ব্যাপারটা কী হতে পারে! ভৃত্যেরা আমাদের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে শুনেছেন, না কী? 

সত্যি রাজকন্যা, সত্যিই, তুমি ব্যাপারটা জানতে চাও? সে এক আশ্চর্য কাহিনী। জেনে রাখ আমি যে আজকের দিনে মদ মাংস খেতে বারণ করেছি, এ নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে মানতে হবে। 

রিচার্ড বললেন, তা, আপনার প্রিয়- পানীয় শেরীতে তো আপত্তি নেই? এই বলে তিনি ঘণ্টা বাজাতে উদ্যত হলেন। 

ডিউক হাত তুলে বাধা দিলেন, বললেন, হ্যাঁ আপত্তি আছে, সত্যি বলছি। 

আর সাইমন বললেন, আমরা একটা ঝামেলা, বিশেষ ঝামেলায় পড়েছি। 

সেটা বুঝতে পারছি। একটা অস্বস্তিকর হাসি হেসে রিচার্ড বললেন। বন্ধুদের চেহারা দেখে, যে উত্তেজনার ভাব নিয়ে তাঁরা এসেছেন তা প্রত্যক্ষ করে তিনি তা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা সাইমনের ওই উদ্ভট পোশাকের মানে কী? 

ডিউক বললে, ‘হতবাক’ হওয়ারই কথা, কিন্তু ঘটনাটা হল, ওকে ভীষণভাবে ডাইনের খপ্পরে পড়তে হয়েছিল। 

হ্যাঁ কিছু যে ওর হয়েছিল তা বোঝাই যাচ্ছে। তা সেটা স্পষ্ট করেই বলুন না, ওসব আজগুবি কথা রেখে। রিচার্ড বলে উঠলেন। 

যা বলছি ঠিকই বলছি। কয়েক মাস পূর্বেই ওকে কালো ম্যাজিক সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলাম ও তা মানেনি, এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে যে রেক্স আর আমি ওকে উদ্ধার করে আনতে সক্ষম হয়েছি তা হল ঈশ্বরের অশেষ কৃপা। 

রিচার্ড কিছুক্ষণ বাদামি চোখে ডিউকের ধূসর চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, দেখুন আপনারা আমাদের যে রকম ঘনিষ্ঠ তাতে আপনাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তামাশাটা কি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে না? এই বিংশ শতাব্দীতে ম্যাজিকের প্রভাব নিয়ে কথা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন। 

বেশ, তাই যদি মনে কর তো একে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলতে পার। জান তো, ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে পরিবর্তন ঘটানোকেই বলা হয় ম্যাজিক। 

মেরী লাও বললেন, কিংবা বলা যেতে পারে, না বুঝে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টাকেও বলা যেতে পারে। 

ডিউক বললেন, ঠিক, এবং রিচার্ড ঠিক সেই চেষ্টাই করছিল। 

কী আবোল তাবোল বকছেন? রিচার্ড বলে উঠলেন। 

ডিউক বললেন, ইলেকট্রিক না বলে যদি বল স্পন্দন তাহলে বরং আরও ঠিক হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা স্পন্দনের, মাটির নিচে যে জল আর স্পন্দনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তোমার হাতে ধরা হ্যাজেলের জলের মধ্যে যখনই তুমি সেই অন্তঃসলিলা ঝর্ণার ঠিক উপরে পা ফেলছ। এ হল ছোটখাটো ম্যাজিকের উদাহরণ। 

আর সাইমন বললেন এবং মোজেস যে মরুভূমির পাথরে আঘাত করে সেখান দিয়ে জল তুলতে পেরেছিলেন সেও এই ধরনের উদাহরণ। 

এতক্ষণ ধরে মেরী খুব মনোযোগ সহকারে ডিউকের কথা শুনছিলেন। এখন বললেন, ম্যাজিক বলে এক বস্তু আছে তা সবাই জানে, এবং সেই একই কথা ডাকিনীদেবী সম্বন্ধেও বলা যায়। সাইবেরিয়া বনের ধারে যখন আমি একটা ছোট গ্রামে বাস করছিলাম তখন অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছিলাম। গ্রামের সীমানায় যে বৃদ্ধা একা একা বাস করত গ্রামবাসীরা তাকে অত্যন্ত ভয় করত। কিন্তু ছোটখাটো ম্যাজিক বলতে আপনি কী বলতে চান? 

ম্যাজিক দু রকমের। এক হচ্ছে, কোনো কোনো প্রক্রিয়ার ফলে আমরা জ্ঞাত হই একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে, কিন্তু কেন তা ঘটে এবং কারণ কি তা আমরা জানি না। যেমন ধর, খড়ি দিয়ে মাটিতে একটা লাইন টেনে যদি কোনো ছাড়া মুরগিকে ধরে তার ঠোঁট কিছুক্ষণের জন্যে সেই লাইনের নিকটে নিয়ে যাওয়ার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়, বোকা মুরগি সেই লাইন পার হয় না, কারণ তার অনুমান সে তখনও খোঁটায় বাঁধা আছে, তাই লাইন পার হওয়া সম্ভব নয়। আসলে যা প্রকৃতপক্ষে ঘটতে দেখি তাই আমরা জানি। এ হচ্ছে ছোটখাটো ম্যাজিকের দৃষ্টান্ত স্বরূপ। অতীতের ছোটখাটো ডাইন আর ডাইনীদের অধিকাংশেরই ধারণা ছিল না, যা তারা দেখাচ্ছে তা কেমন করে সম্ভব হচ্ছে। এটুকুও শুধু তারা পুরুষানুক্রমে জেনে এসেছে যে কোনো কোনো ঘটনার সমাবেশ হলে কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটে থাকে। 

এই প্রথমবার রেক্স কথা বললেন। হঠাৎ মুখ তুলে বলে উঠলেন, আমার তো মনে হয়, বিশ্বাসপ্রবণ ব্যক্তির বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে চতুর ম্যাজিশিয়ানরা কাজ হাসিল করে। 

ঠিক। কিন্তু ম্যাজিশিয়ান বোকা নয়, সে শ্রোতাদের বলে না যে তার কথা মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে, সে শুধুমাত্র অভ্যাস মতো সেই সব প্রক্রিয়া করে, যাতে সে জানে, তার মনোযোগের শক্তি বৃদ্ধি পায়। 

খানিকটা অবিশ্বাসী মন নিয়ে রিচার্ড কথাটা মেনে নিলেন। বললেন, কিন্তু তার মানে কি এই যে সাইমনকে এইভাবে বোকা বানানো হয়েছে? 

না, এছাড়া বড় বড় ম্যাজিকেও আছে, যা দেখানো সম্ভব কেবলমাত্র ঐ বিদ্যায় বিশেষভাবে শিক্ষিত কিছু মানুষের পক্ষেই। শুধু কয়েকটা প্রক্রিয়ার ফলে যে কোনো বিশেষ ফল দেখা যায় তাই নয়, কেন তা দেখা যায় তাও তারা জানে। এই সব মানুষ হয় অমিত ক্ষমতার অধিকারী, এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক তারা এবং এ হেন এক মানুষের কবলে পড়েছিল সাইমন। 

রিচার্ড স্বীকার করলেন কথাটা, এবং বুঝতে পারলেন ডিউক যা বলছেন তা সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছেন। বললেন, ব্যাপারটা তাহলে অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এবার গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। 

বেশ, তাহলে বসা যাক। আমি যা বলব তাতে কোনো খুঁত বা সন্দেহ থাকলে রেক্স আমাকে সংশোধন করে দেবে। 

তখন ডিউক গত আটচল্লিশ ঘণ্টার সব ঘটনা খুলে বললেন তারপর মেরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এর পরেও তারা সাইমনকে তাঁকে আর রেক্সকে বিপদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও আশ্ৰয় দেওয়া নিরাপদ মনে করেন কি না। 

মেরী বললেন, অবশ্যই আশ্রয় দেবো। প্রত্যাখ্যান করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। থেকে যান যতদিন খুশি, এবং যখন বুঝবেন আর সাইমনের কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই তার আগে যাবেন না। 

রিচার্ডও সায় দিলেন ঘাড় নেড়ে। বললেন, অবশ্য তা নয় তো কী? এবার বলুন কিভাবে আমরা আপনাদের সাহায্য করতে পারি। সাইমন বললেন, অত্যন্ত মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিলে, কিন্তু যদি এর ফলে তোমাদের কোনো বিপদ ঘটে তাহলে আমি কোনোমতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। রেক্স বললেন, ও প্রসঙ্গ নিয়ে আর নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নেই, গাড়িতে আসতে আসতেই ও নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। ডিউক তো তোমাকে ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যদি যথেষ্ট সাবধান হওয়া যায় তো রিচার্ড আর মেরীর কোনো বিপদ হবে না। 

ডিউক বললেন, ঠিক তাই, এবং এ বিষয়ে তোমরা প্রচুর সাহায্য করতে পারবে। মনে রাখতে হবে সাইমনের পক্ষে বিশেষ প্রতিরোধ সম্ভব হবে না। কারণ সে বেশ কিছুকাল মোকাটার প্রভাবের মধ্যে ছিল। এবং গত রাতের ধকলের পরে রেক্সের আর আমারও শক্তি অনেকটা খর্ব হয়েছে। ওদের সঙ্গে যুঝতে হলে আমাদের প্রচুর শক্তির প্রয়োগ করতে হবে, এবং এই লড়াইয়ে তোমাদের সাহায্য পাওয়ার ফলে এখন কাঁটা আমাদের দিকেই ঝুঁকছে। এখানে আশ্রয় না পেলে যে কী করতাম ভেবে পাচ্ছি না, কার অন্য কারুকেই এইসব গল্প বিশ্বাস করানো সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। 

রিচার্ড হেসে বললেন, কিন্তু আমাদের ঠিক কী করতে হবে, ধূসর চক্ষু? 

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন ডিউক। বললেন, আমাকে এখন অক্সফোর্ডে যেতে হবে। সেখানকার এক পুরোহিতের নিকট থেকে কিছুটা পবিত্র জল নিয়ে আসব। তখন তাই-ই হবে আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিরোধ। ইতিমধ্যে তোমরা সাইমনের উপর লক্ষ্য রাখবে। বিদায় নিলেন, ডিউক। 

মেরী রেক্সকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা এ বিষয়ে তুমি কী মনে কর? তার আগে রিচার্ড সাইমনকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছেন।

তাঁর মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর রেক্স বললেন, নরকের দ্বারে আঘাত করে আমরা ফিরে এসেছি। তারপর তিনি ট্যানিথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা সব বললেন। এ নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় প্রধান চাকর মার্লিন এসে খবর দিল মিঃ ভ্যানরাইনের নামে টেলিফোন এসেছে। 

রেক্স তার সঙ্গে গেলেন। 

কে রেক্স? ওঃ, তোমাকে পেয়ে কী খুশি যে হলাম! এক্ষুনি দেখা হওয়ার দরকার–এক্ষুনি! 

একি, ট্যানিথ নাকি? আমার ঠিকানা তুমি কেমন করে পেলে?

সে এলেই শুনবে—জলদি, জলদি কর! কিন্তু কোথায় তুমি?

গ্রামের সরাইখানায়, তোমার ওখান থেকে এক মাইলের মধ্যে। 

ঠিক আছে, যাচ্ছি। এই প্রথম তিনি উপলব্ধি করলেন যে তাঁর মধ্যে ভালোবাসার উদ্রেক হয়েছে। 

মেরীর নিকটে সব কথা খুলে বললেন রেক্স 

মেরী বললেন, নিশ্চয় যাবেই তো। কিন্তু অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরবে নিশ্চয়, কেমন? নিশ্চয়। 

রেক্স বাগান ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোটখাটো মূর্তি বাড়িতে প্রবেশ করল। প্রধান চাকর মার্লিন মেরীকে খবর দিল মোকাটা নামে এক ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন নিশ্চয়। মুহূর্তের জন্যে মেরী লাও ইতস্তত করলেন। গত এক ঘণ্টা ধরে এর ভয়ঙ্কর শক্তি সম্বন্ধে তিনি অনেক কথা শুনেছেন। কিন্তু ভাবতেও পারেননি যে এত তাড়াতাড়ি তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। প্রথমেই ইচ্ছা হল রিচার্ডকে ডেকে পাঠান, কিন্তু তার পরেই মনে হল সেটা ঠিক হবে না। কারণ একে তো ডিউক আর রেক্স বাড়ি নেই, তার উপর যদি রিচার্ডকেও আসতে হয় তাহলে সাইমন একা পড়ে যাবেন, এবং ডিউকের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল সাইমনকে কোনো সময়েই একা থাকতে না দেওয়া। তাই ঠিক করলেন রিচার্ডকে ডাকবেন না। 

মালিনকে বললেন আগন্তুককে ডেকে আনতে আর বলে দিলেন ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন সে এসে উপস্থিত হয়। 

মোকাটা এলে মেরী লাও তাকে কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করতে লাগলেন। পরণে ধূসর রঙের টুইডের সুট আর কালো টাই, মাথাটা প্রকাণ্ড টাকে ভর্তি, কলারের উপর গলায় অনেকগুলো ভাঁজ। 

বেশ সুরেলা গলায় মোকাটা শুরু করলেন, বিনা আমন্ত্রণে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসার জন্যে দুঃখিত। তবে হয়ত আমার নাম শুনে থাকবেন। এই বলে মোকাটা করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। 

মাথা নেড়ে মেরী লাও স্বীকার কলেন তাঁর নাম শুনেছেন। কিন্তু করমর্দন করলেন না। প্রেততত্ত্বের বিষয়ে কিছু না জানলেও এটুকু তিনি জানতেন যে এ হেন লোককে স্পর্শ করা বা নিজের বাড়িতে কিছু খেতে দেওয়া কোনোমতেই উচিত নয়। 

মোকাটা বললেন, আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। তবে জানি না আমার সম্বন্ধে যা শুনেছেন তা সত্যি কি না। সাইমন আমার বিশেষ বন্ধু, যখন অসুস্থ ছিল আমি তার প্রচুর দেখাশুনা করেছিলাম। 

তা হবে। কিন্তু আপনি কেন এসেছেন? 

সাইমন তো আপনার কাছে, তাই না? 

হ্যাঁ, এবং এখন সে বেশ কয়েকদিন এখানেই থাকবে। হঠাৎ তাঁর মোকাটাকে বিশেষ সুপুরুষ বলে মনে হল। 

মোকাটা বললেন, কিন্তু কী জানেন? কিছু বিশেষ কাজে এখন তাঁকে লন্ডন যেতে হবে।

তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। 

ও। তা আমি ভেবেইছিলাম আপনার এইরকম মনোভাব হবে, নিশ্চয় আমার বন্ধু ডিউক আমার সম্বন্ধে আপনার মনকে বিষিয়ে দিয়েছেন, এমন সব কথা বলেছেন যা সম্পূর্ণ আজগুবি। যাই হোক তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তবে বিশ্বাস করুন, আমার সঙ্গে যদি না যায় তাহলে সাইমন বিশেষ বিপদে পড়বে। 

না, তার কোনো বিপদ হবে না যতদিন সে আমার গৃহে আছে। 

না গেলে যে সাইমনের কী ভীষণ বিপদ হবে তা আমি আপনাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না—এ কি চকোলেট! নিকটবর্তী একটা বড় বাক্সের দিকে হাত বাড়িয়ে মোকাটা সম্পূর্ণ অবান্তরভাবে প্রশ্নটা করলেন। তারপর বললেন, হয়তো আমাকে রূঢ় মনে করবেন, কিন্তু সত্যিই আমি চকোলেটের বিশেষ ভক্ত। 

দুঃখিত বাক্সটা খালি। বলে যাস সাইমন সম্বন্ধে কী বলছিলেন। 

হাত সরিয়ে নিয়ে মোকাটা বললেন, বড়ই দুঃখের কথা, বলেই তিনি এগিয়ে গিয়ে বাক্সটা তুলে ধরলেন এবং সেটা ভারি দেখে বুঝলেন গৃহকত্রী মিথ্যে বলেছেন। 

ছোঁবেন না, ওটা আমি আমার ছোট মেয়েটিকে দিয়েছি। ও ওতে মার্বেল রাখে। বাক্সটা তিনি নিজের কাছে রাখলেন। 

মোকাটা যা মনে করেছিলেন, দেখলেন তার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি মহিলাটির। তাহলেও তিনি যেটুকু এগোতে পেরেছেন তাতে খুশি, প্রথমে মহিলাটির কাছে যে বাধা পেয়েছিলেন তার তীব্রতা কমে গেছে। আরও কিছুক্ষণ তিনি গৃহকর্তার সঙ্গে কথা কইবেন, আর বাকি যা করার তা করবে তাঁর চোখ আর কণ্ঠস্বর। 

মুহূর্তকাল দু’জনে তাকিয়ে রইলেন পরস্পরের চোখের দিকে। তারপর মোকাটা অন্য দিক দিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন। বললেন, মিসেস ঈটন, বুঝতে পারছি স্বভাবতই আপনি অবিশ্বাস করছেন। কিন্তু হয়তো আপনার ধারণা পালটাবে যদি আমার বক্তব্য শোনেন। 

তাতে কোনো হের ফের হবে না। মেরী শান্ত সুরে বললেন। 

তা সত্ত্বেও মোকাটা বলে চললেন, ম্যাজিক ভালো কি মন্দ তা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। শুধু এই বলছি, সাইমন বেশ কিছুকাল এ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। এতে উৎসাহ পেয়েছে এবং তার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনার পরিচয় দিয়েছে। ডিউক হয়তো আপনাকে বলেছেন আমি অত্যন্ত খারাপ লোক। কিন্তু তাতে আমার অনেক আপত্তি। ম্যাজিক ব্যাপারটা ভালো বা মন্দ কিছুই নয়, তা শুধু ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগে পরিবর্তন ঘটানো। এর উপরে বিরূপ ধারণার কারণ, এর অভ্যাস গোপনে সংঘটিত হয়। এবং যুগ যুগ ধরে গীর্জা এর বিরুদ্ধতা করার ফলেই যে এই গোপনতা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে আপনার মধ্যেও যে এ সম্বন্ধে বিরূপতা জাগবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, এই গুপ্ত বিদ্যায় যারা বিশেষ পারদর্শী তারা যে কোনো বিশেষ শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে যা সাধারণ অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। ম্যাজিক যদি ওস্তাদ আয়ত্তের মধ্যে রাখে তাহলে তার ফলে অনিষ্টের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কোনো নিপুণ ইলেকট্রিশিয়ান কত সহজে বিদ্যুৎ নিয়ে নাড়াচাড়া করে, অথচ সেই বিদ্যুৎ কোনো শিশুর পক্ষে মারাত্মক হতে পারে, এ ঘটনাও কতকটা তেমনি, ব্যাপারটা কি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পেরেছি? 

হ্যাঁ, মেরী অস্ফুট স্বরে বললেন। এই দীর্ঘ বক্তৃতা চলছিল যতক্ষণ মোকাটা এক দৃষ্টে তাঁকে লক্ষ্য করেছিলেন, এবং ক্রমেই মোকাটার প্রতি তার সব বিরূপতা একটু একটু করে দূর হয়ে যেতে থাকল। এবং শেষ অবধি তাঁর মনে হল এই অত্যন্ত সুপুরুষ, মার্জিত রুচির মানুষ কখনই কারও পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে না। 

মোকাটা বলে চললেন, ভারি খুশি হলাম আপনার কথা শুনে। বলতে কি, আমি অবশ্য করে জানতাম যে একটু সময় পেলেই, আপনার মধ্যে যে ভুল অনুমান জন্মেছে তা দূর করতে পারব। আগামী দু এক মাসের মধ্যে যদি আপনি লন্ডনে যান তো আশা করি আমার সাথে দেখা করবেন। এবং সাইমন যে আনন্দ মনেই আমার সঙ্গে যেতে চাইবে এ বিষয়ে আমার মধ্যে সন্দেহমাত্র নেই। 

আপনার কথা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক মনে হচ্ছে। নিচু গলায় মেরী বললেন, মোকাটার দু চোখ তখনও তাঁর উপর স্থির নিবদ্ধ। মোকাটাকে তাঁর আবার বিশেষ সুদর্শন বলে মনে হল, এবং তাঁকে দেখে প্রথমে যে ভীত হয়েছিলেন এজন্য তাঁর নিজেকে মূর্খ বলে মনে হল। মে মাসের রোদ গাছ পাতার ফাঁক দিয়ে এসে মোকাটার মুখে পড়ছে, তাতে মেরী লাও-এর মনে হল যেন তাঁর চোখ দুটো আগের থেকে অনেক বড় হয়ে উঠেছে। 

মোকাটা জিজ্ঞাসা করলেন, ডিউক কখন ফিরবেন? দুঃখের বিষয় আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে খুশি হতাম। 

মেরীর মনে হল তিনি উত্তর করলেন, ঠিক জানি না। তবে মনে হয় না ছ-টার আগে আসবেন। 

আর দৈত্যের মতো চেহারার আমেরিকান বন্ধুটি? 

জানি না, তিনি গ্রামে গেছেন। 

বড়ই দুঃখের। ওঁরা কথা কইছেন, তাই না? 

হ্যাঁ, ওরা উপরতলায় আছেন। 

আপনাকে যেমন বললাম তেমনিভাবে এবার আপনার স্বামীকেও সব বুঝিয়ে বলব, নিশ্চয় তিনি বুঝতে পারবেন যে সাইমনের উচিত আমার সঙ্গে ফিরে যাওয়া। এক গ্লাস জল পান করতে পারি? গ্রাম থেকে হেঁটে এসেছি, খুব তেষ্টা পেয়েছে। 

অবশ্যই! বলে গৃহকর্ত্রী যন্ত্রচালিতের মতো উঠে গিয়ে ঘণ্টা বাজালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তার চেয়ে চা বা মদ আর একটু বিস্কুট হলে ভালো হয় না? 

আপনার বড় দয়া। শুধু এক গ্লাস জল আর একটা বিস্কুটই যথেষ্ট হবে। 

মার্লিন এক গ্লাস জল আর কিছু বিস্কুট এনে মোকাটার পাশে রাখল। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে মোকাটা আবার মেরীর চোখের দিকে তাকালেন। 

মেরীর দেহ একেবারে শিথিল হয়ে এল, চোখের পাতা এমন ভারি হয়ে গেল যে খোলা রাখাই কষ্টকর হচ্ছে। এমনকি তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েন। এর কোনো কারণ তাঁর জানা ছিল না। 

মৃদু হাসির সঙ্গে মোকাটা তাঁকে লক্ষ্য করে চললেন। বুঝতে পারলেন তিনি মেরী লাওকে আয়ত্তে এনে ফেলেছেন, মুহূর্তমধ্যেই তিনি নিদ্রা যাবেন। তখন আর তাঁকে পাশের ঘরে রেখে আসা কঠিন হবে না। তারপর আর কী ঘণ্টা বাজিয়ে ভৃত্যকে দিয়ে গৃহকর্তাকে ডেকে পাঠাবেন, এবং গৃহকর্তা এসে স্ত্রীর খোঁজ করলে বলবেন তিনি স্বামীর খোঁজে বাগানে গেছেন। তারপর গৃহস্বামীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে তাঁকেও হাত করে ফেলবেন। তারপর শুধু সাইমনকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়া। 

মেরীর চোখ একবার খুলছে, আবার বন্ধ হচ্ছে, হঠাৎ তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে সজাগ হয়ে উঠলেন। বললেন, ক্লান্ত আমি ভীষণ ক্লান্ত। কী যেন বলছিলেন? কথাটা তিনি ঘুম জড়ানো গলায় বললেন। 

ইতিমধ্যে মোকাটার চোখ তাঁর কাছে অতি প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে, তখনও তা তাঁর দয়ালু চোখের উপর স্থির নিবদ্ধ। মোকাটা বললেন, আর কথা বলব না। এখন আপনি ঘুমোবেন, আর মে মাসের সাত তারিখে সেন্ট জনস্ উডের সাইমনের বাড়িতে বেলা চারটের আমার সঙ্গে দেখা করবেন। 

আবার মেরীর চোখের পাতা নেমে এল, কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি আবার সজাগ হয়ে উঠলেন, কারণ ঠিক সেই সময়েই তাঁর ছোট্ট মেয়ে ফ্লাওয়ার সজোরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল। 

জেগে উঠালেন তিনি। বললেন কী ফ্লাওয়ার? মোকাটা ক্রোধে হতাশায় আঙুল মটকাতে শুরু করলেন। শিশুটির আকস্মিক প্রবেশের ফলে স্পন্দনের যে তরঙ্গ গড়ে উঠেছিল তা ছিন্ন হল। 

হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্লাওয়ার বলল, বাবা তোমাকে খুঁজতে পাঠিয়ে দিল। জান, আমরা বাগানে ঘোড়া ঘোড়া খেলছিলুম তো, কিন্তু সাইমন কাকা বললেন ও ঘোড়া নয়, ও হল ড্রাগন। বাবা বলল তুমি গিয়ে তাকে বলে দেবে যে ড্রাগন নয়, ঘোড়া 

ও, এই বুঝি আপনার মেয়ে? কী চমৎকার মেয়েটি! কথাটা খুব মিষ্টি করে বলে মোকাটা ফ্লাওয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, এস, আমার…

কিন্তু মেরী আর তাঁকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না, বিপদ সম্বন্ধে ইতিমধ্যে তিনি সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠেছেন বলে উঠলেন, ছোঁবেন না—ছোঁবেন না বলছি ওকে! সঙ্গে সঙ্গে মোকাটার জ্বলন্ত চোখের সামনে থেকে সরিয়ে আনলেন—খবরদার বলছি! 

মোকাটা এমন ভাবে বললেন যেন আহত হয়েছেন তিনি। কিন্তু মিসেস ঈটন নিশ্চয় আপনি মনে করেন না যে আমি ওর কোনো অনিষ্ট করতাম? 

ঘণ্টা বাজিয়ে মেরী বলে উঠলেন, পশু কোথাকার আমাকে সম্মোহন করার চেষ্টা হচ্ছিল?

কী যে বাজে কথা বলেন! 

মার্লিন এলে মেরী ফ্লাওয়ারকে তার হাতে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মিঃ ঈটনকে ডেকে আন এই মুহূর্তে! তিনি বাগানে আছেন 

মার্লিন তাড়াতাড়ি ফ্লাওয়ারকে নিয়ে চলে গেলে মোকাটা আবার মেরী লাওয়ের দিকে তাকালেন, সে চোখে তখন শীতল দৃষ্টি। বললেন এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে আমার সাইমনের সঙ্গে দেখা করা অত্যন্ত দরকার। 

না, দেখা হবে না, ভালো চান তো আমার স্বামী আসার আগেই চলে যান। তারপর যখন লক্ষ্য করলেন তিনি মোকাটার চোখে তাকিয়ে আছেন, সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু তাহলেও মোকাটা জলের গ্লাসটা তুলে নিতে যাচ্ছেন তা লক্ষ্য করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে তিনি তাড়াতাড়ি গ্লাসসুদ্ধ টেবিলটা উল্টে দিলেন, মোকাটা যে বাধা দেবেন তার সময়ও পেলেন না। গ্লাসটা ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল, বিস্কুটগুলো সব মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। 

মোকাটা ভীষণ রাগান্বিত হলেন—ঐ পুঁচকে বাচ্চাটাই কিনা তাঁর সব মতলব মাটি করে দিল! দানবিক আক্রোশে তাঁর মুখভাব অতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, চোখেও স্বাভাবিক কুৎসিত দৃষ্টি দেখা দিল। সে দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে মেরী লাও দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। এমন সময় ঘরের দরজা থেকে কথা শোনা গেল : আরে এসব কী? 

হাঁপাতে হাঁপাতে মেরী বলে উঠলেন, রিচার্ড এই হচ্ছে মোকাটা, এ আমাকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করছিল। বার করে দাও একে! 

রিচার্ডের মুখের মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে তিনি এক পা মোকাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। বলে উঠলেন, দেখুন, আপনি যদি বয়সে আমার দ্বিগুণ না হতেন আর এটা যদি আমার নিজস্ব বাড়ি না হত তো আমি আপনার মুখ ভেঙে দিতাম। এবং যদি এর পরে আপনি এই মুহূর্ত আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে না যান তো সত্যিই আপনার মুখ ভেঙে দেব! 

এর পরেও যেভাবে মোকাটা চট করে মেজাজ সামলে নিলেন তা দেখেও বিশ্বাস হয় না। তাঁর মুখ পুনরায় সুন্দর আর হাসি হাসি হয়ে উঠল, এবং তিনি একটুও ভয় পেলেন না, বললেন, আমার নামে অনেক মিথ্যে কথা শুনে আপনার স্ত্রী আমার প্রতি অবিচার করছেন। 

আপনার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। এখন দয়া করে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।

মোকাটা বললেন, মিঃ ঈটন, আপনি অবুঝের মতো কথা বলছেন। আমি এসেছি সাইমনকে লন্ডনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। 

না, তা হবে না। 

দয়া করে এক মুহূর্ত আমার বক্তব্য শুনুন— 

অত্যন্ত রাগান্বিত স্বরে রিচার্ড তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, দেখুন, এই মুহূর্তে যদি আপনি না বেরিয়ে যান তো খুব খারাপ হবে বলছি! 

মোকাটা বললেন, কিন্তু সাইমনকে এইভাবে আটকে রেখে আপনি শুধু তার উপরেই নয়, আপনার উপরেও মহা বিপদ ডেকে আনছেন। কিন্তু যাই হোক আপনি যখন যুক্তি শুনবেন না তখন অন্তত আমাকে পাঁচ মিনিট তার সঙ্গে কথা কওয়ার সুযোগ দিন। 

না, পাঁচ সেকেন্ডও নয়। 

এই যদি আপনার শেষ কথা হয় তো ঠিক আছে, মোকাটা বললেন। মনে হল যেন তাঁর শরীর যেমন প্রকাণ্ড শক্তিতে যেন হঠাৎ সেই দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই শক্তি যেন জ্যোতি বিকিরণ করছে। তারপর বললেন, আজই রাতে আমি এক দূতকে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। জীবিত বা মৃত, যে কোনো অবস্থায় সে অতি অবশ্যই সাইমনকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। 

বেরিয়ে যান – বেরিয়ে যান বলছি! 

আর একটা কথা না বলে, একবারও পিছনে না তাকিয়ে মোকাটা চলে গেলেন।

মেরী মোকাটার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তার সমস্ত দেহ কেঁপে উঠল। বলে উঠলেন, কী আশ্চর্য, এই রোদেও লোকটার কোনো ছায়া পড়ল না! 

.