দিঘা সৈকতে আতঙ্ক – ৯

নয়

আবার সেই ভাঙা বাড়িতে। তবে এবারে ওরা কিন্তু গোপন সুড়ঙ্গপথে নয়, একেবারে উঁচু বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে গিয়ে সেই পোড়ো বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গেল। কিন্তু ঢোকার আগেই এক ঝলক তীব্র আলো এসে পড়ল মুখে। ওরা দেখল দু’জন বলিষ্ঠ চেহারার লোক ওদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। লোক দু’জনের একজন বাজখাঁই গলায় বলল, এই। কী চাই এখানে? অ্যাটম বলল, কী আবার চাইব। আমরা শোব এখানে।

অপরজন বলল, কোথায় থাকিস তোরা?

আমরা দাগি আসামি। রাজভবনে থাকি না। ফুটপাথে থাকি। কিন্তু এত জমা খরচ তোমাদের দিতে যাব কেন হে? যাও, ভাগো হিয়াসে।

রুখে উঠল অন্যজন, স্পর্ধা তো কম নয়। এক ফোঁটা ছেলে ‘হে’ বলে কথা বলছে আমাদের সঙ্গে? তুই-তোকারি করছে! মেরে মুখ ভেঙে দেব এখুনি।

অ্যাটম বলল, এঃ। তাই নাকি? আমরাই বলে মানুষ চেলিয়ে বেড়াই। আর উনি কিনা এসেছেন আমাদের কাছে রোয়াব নিতে। দেখছ তো হাতে কী? বলেই একটা নেপালা বার করে সেটা উঁচিয়ে অ্যাটম বলল, দেব এটা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে ?

লোক দু’জন এতটা বাড়াবাড়ি হবে ভাবতে পারেনি। তাই সভয়ে একটু পিছিয়ে এসে বলল, বড্ড যে? দেখবি মজাটা?

অ্যাটম বলল, পেটোরে, একটা ইঁদুরের গর্ত দ্যাখ। এরা রাতের অন্ধকারে কার তাড়া খেয়ে পোড়ো বাড়িতে ঘুর ঘুর করছে, আবার আমাদের মতো নিশাচরকে এসেছে চোখ রাঙাতে। বলেই বলল, দ্যাখো সারাদিন অনেক অপকর্ম করে রাত্রিবেলা এখানে এসে ঢুকেছি। এখন মানে-মানে ফুটে পড় দেখি বাবা। ঘুম পেয়েছে। একটু শান্তিতে ঘুমোতে দাও। তোমরা থাকলে আমাদের অসুবিধা হবে।

লোকদুটি পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কী যেন বলাবলি করল। তারপর বলল, কী নাম বল তো তোদের?

কী নাম বলব বলো গুরু। আমাদের নাম অ্যাটম আর পেটো। আমাদের মাটির নীচে পুঁতলে আমরা পাহাড়ের মাথায় গাছ হয়ে ফুটি।

অ। তোরাই সেই মাল, পুলিশ যাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে।

ইয়েস। ওই জন্যেই তো এত জায়গা থাকতে ভরদুপুরে এই সার্কিট হাউসে এসে জুটেছি।

তোরা তো সাংঘাতিক চিজ় রে! কাজ করবি আমাদের দলের হয়ে?

অ্যাটম বলল, নগদে না বাকিতে?

নগদেরে বাবা। আমাদের বস তোদের মতো ছেলেকে পেলে বুকে করে রাখবে। আমরাও চাই তোদের মতো দু’-চারটে ছেলে অপাত্রে পড়ে যেন নষ্ট না হয়ে যায়। আসলে আমরা দু’জন লোককে সরাতে চাই। সে কাজ তোদেরই করতে হবে।

গুরু গুরু। এ পর্যন্ত আমরা তেইশজনকে সরিয়ে দিয়েছি। আর দু’জনকে দিতে পারলেই পঁচিশ হয়ে যাবে। মানে রজত জয়ন্তী না কী যেন বলে?

ওসব বাজে কথা রাখ। আগে আমাদের কথা শোন। আমরা এই বাড়ির ভেতর একটা ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু ছেলেটা দেখছি কীভাবে দড়ি কেটে হাপিশ হয়ে গেছে। ঘরের পেছনে এক জায়গায় একটা গর্ত ছিল আগে আমরা দেখিনি। হয়তো সেখান দিয়ে পালিয়েছে সে।

অ্যাটম-পেটো উৎসাহিত হয়ে বলল, কতক্ষণ আগে বলো তো?

তা তো বলতে পারব না। দিনের বেলাও হতে পারে, সন্ধের সময়ও হতে পারে।

আমরা কিন্তু সন্ধেবেলা একটা ছেলেকে বালির ওপর দিয়ে ছুটতে দেখেছিলাম। ছেলেটা আমাদের দেখে আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিল। আমরা ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছেও দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যেই না বলেছে ও একজন পুলিশ অফিসারের ছেলে, অমনি বলব কী গুরু মাথাটা উঠল চড়াত করে। দিলাম এই যন্তরটা ব্যাটার পেটের ভেতর ফকাত করে ঢুকিয়ে। ছেলেটা যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। তারপর যখন দেখলাম ছেলেটা মরেই যাবে, তখন খুব ভয় হল। হাজার হলেও পুলিশের ছেলে তো। দু’জনে মিলে টেনে হিঁচড়ে ছেলেটাকে দিলাম ছুড়ে সমুদ্রের জলে। অমনি গুডলাক কীরকম দ্যাখো, কোথা থেকে একটা হাঙড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর। তারপর আলুভাতের মতো করে মুখে নিয়ে উধাও হল গভীর সমুদ্রে।

বলিস কীরে! একেবারে মেরেই ফেললি?

হ্যা, ওই কাজটা আমরা খুব চটপট করে ফেলতে

পারি।

যাক। যা হবার হয়েছে। আপদ গেছে। এখন চল দেখি আমাদের বসের কাছে নিয়ে যাই তোদের। বস খুব রেগে যাবে আমাদের ওপর। তবু ভাল যে, বুদ্ধি করে ছেলেটাকে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিস এবং হাঙরটা সময়মতো এসে খুনের প্রমাণ লোপ করে দিয়েছে। সবই দৈবের যোগাযোগ।

হ্যাঁ। দৈব যে কবে এইরকম যোগাযোগ ঘটিয়ে তোমাদেরও ওই ছেলেটার মতো দশা করবে তাই ভাবছি। চলো, ঘুম তো মাথায় উঠল। এখন তোমাদের বস কীরকম একবার দেখে আসি।

ওরা সেই অন্ধকারে লোকদুটির পিছু নিল।

ওদের সঙ্গে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে যেতে যেতে অ্যাটম আর পেটো খুব সতর্কভাবে চারদিকে নজর রেখে পথঘাট চিনে নিতে লাগল। দরকার হলে এই পথেই আবার হয়তো আসতে হবে ওদের।

লোক দু’জন বলল, দ্যাখ ভাই তোরা খুব খতরনক ছেলে আমরা জানি। কিন্তু আমাদের দলের সঙ্গে যদি বেইমানি করিস তা হলে কিন্তু সর্দার তোদের আস্ত রাখবে না। আর এমনিতেই তোরা হচ্ছিস দাগি ছেলে। পুলিশের খাতায় রেকর্ড তোদের অত্যন্ত খারাপ। কাজেই পুলিশের চোখরাঙানির হাত থেকে যদি বাঁচতে চাস তো আমাদের দলে আয়। কিন্তু আমরা ভেবে পাচ্ছি না, এইটুকু বয়সে তোরা এত শয়তান কী করে হলি?

অ্যাটম বলল, আরে গুরু, আমরাও তো ভেবে পাচ্ছি না তোমাদের এতখানি বয়েস হয়েছে, বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে তবুও তোমরা এরকম শয়তানের ধাড়ি হয়ে এইসব বদ কর্ম করে বেড়াচ্ছ কেন? আমরা না হয় অকালে পেকেছি। তোমরা? তোমরা কোন সকালে পেকেছ বাবা?

নাঃ। তোরা বড্ড ডেপো হয়েছিস দেখছি। তোদের সঙ্গে কথায় আমরা পেরে উঠব না। তবে ওই ছেলেটাকে মেরে দিয়ে তোরা কিন্তু ঠিক কাজ করিসনি।

পেটো বলল, ঠিক বলেছ গুরু। আমাদেরও মনে হচ্ছে কাজটা ভাল হয়নি। এখন তোমাদের দুটোকে মেরে পঁচিশ পূর্ণ করতে পারলেই মনে হয় কাজটা ভাল হবে।

লোকদুটি শিউরে উঠল, বলিস কী রে!

হ্যাঁ। কেন না তোমরা ছেলেটাকে চুরি করে আটকে রাখলে বলেই ও আমাদের পাল্লায় পড়ল। আর আমাদের পাল্লায় পড়ল বলেই মরল। ওর মৃত্যুর জন্যে আমরা নয়, তোমরাই দায়ী।

ওরা বলল, আসলে ওই ছেলেটা যে পুলিশের ছেলে তা আমরাও জানতাম না। আমাদের দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রূপেন ও সুখেন নামে দু’জন লোক পালিয়েছিল। আমরা অনেক চেষ্টা করেও লোকদুটোকে ধরতে পারছিলাম না। ওরা যেন ফাঁকা মাঠের বেড়াল। যাই হোক, ওদের দু’জনকে নজরে রাখতে গিয়েই ছেলেটা হঠাৎ আমাদের চোখে পড়ে যায়। আমরাই চালাকি করে কৌশলে ছেলেটাকে অপহরণ করে ওই ভাঙা বাড়িতে আটকে রাখি। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম রূপেন ও সুখেন ওই ছেলেটাকে গুম করতে অথবা মারতে চেয়েছিল। তাই ভেবেছিলাম ছেলেটিকে আমরা ওর অপহরণকারী নয়, উদ্ধারকারী হিসেবেই পরিচয় দেব এবং ছেলেটির মা-বাবা যখন খবরের কাগজে মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বিজ্ঞাপন দেবেন তখনই নিয়ে যাব ওকে। তারপর রূপেন ও সুখেনের বর্ণনা দিয়ে ওদের অ্যারেস্ট করিয়ে দেব। এতে আমরা প্রতিশোধও নিতে পারব এবং দাঁও-ও মারতে পারব। এ কাজটা কিন্তু আমরা আমাদের সর্দারের সম্পূর্ণ অমতেই করেছি। তবে যেই না বুঝেছি হাতটা আমাদের একেবারে উলটো জায়গায় পড়েছে, মানে আমরা নিজেদের অজান্তে একজন পুলিশ অফিসারের ছেলেকে চুরি করে বসে আছি, তখন কিন্তু খুবই বিব্রত বোধ করেছি আমরা।

অ্যাটম আর পেটো বলল, আহা। নেকু রে আমার, ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেই তো পারতে?

ছেলেটাকে ছেড়েই দিতাম। যদি না ওই শয়তানদুটো গিয়ে পুলিশের সঙ্গে হাত মেলাত। ওরা আমাদের অনেকগুলো গোপন ঘাঁটির সন্ধান জানে। ওরা আমাদের দলকে ধরিয়ে দিতে চাইছে। তাই পুলিশের চোখে ওদেরকেই সন্দেহভাজন করবার জন্যে ছেলেটার মাকেও নিয়ে পালিয়ে আসি আমরা। চালে আবার ভুল হয়। ভেবেছিলাম পুলিশ ওই মা এবং ছেলের জন্যে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে আমরা সেই সুযোগে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পার পেয়ে যাব। কিন্তু না! রূপেন ও সুখেন কী জাদুতে পুলিশের বিশ্বাস উৎপাদন করেছিল তা কে জানে? ওরা দিব্যি পুলিশ নিয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করতে আসছিল। আমাদের দলে একটা হাবা ছেলে ছিল। আমরা তাকে পাঠিয়েছিলাম ওই শয়তানদুটোকে শেষ করে দেবার জন্য। কিন্তু তার একটু ভুলের জন্য সব বানচাল হয়ে গেল।

তা না হয় গেল। কিন্তু ছেলেটার মা কোথায়? সেও কি ওই ভাঙা বাড়িতেই আছে?

আরে না না। এক জায়গায় কখনও দু’জনকে রাখে? তাঁকে আমরা অন্য জায়গায় রেখেছি। মানে আমাদের মূল ঘাঁটিতে।

বেশ। এখন তা হলে আমাদের কী করতে হবে?

কিছুই না। যেভাবেই হোক, ওই রূপেন আর সুখেনের মুণ্ডুদুটো নিয়ে এসে আমাদের সর্দারকে উপহার দিতে হবে। পারবি না?

এই তুচ্ছ কাজটুকু করতে যদি না পারি, তো মানুষ খুনের খেলা ছেড়েই দেব আমরা।

ইভাবে কথা বলতে বলতে এক জায়গায় গভীর বনের ভেতর এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। একজন লোক মুখ দিয়ে কুকুরের ডাক ডাকল। অমনই দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা গেল হুয়া-হুয়া-হুয়া। লোকদুটো এবার টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চলল। দু’-এক পা যাবার পরই দেখল কতকগুলো বড় বড় গাছের গুঁড়ির আড়ালে একটি ছোট্ট চালা ঘর। তারই পেছন দিকে এক জায়গায় খড়চাপা দেওয়া একটা কাঠের পাটাতন। সেটা টেনে তুলতেই নীচে নামার সিঁড়ি দেখতে পাওয়া গেল। ওরা ধীরে ধীরে সেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই আলো-অন্ধকারে ভরা কতকগুলো খুপরি ঘরে এসে পড়ল। একটি ঘরে এক মহিলা বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। দুটি অল্পবয়সি মেয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে।

অ্যাটম আর পেটো বলল, ইনিই কি?

হ্যাঁ। ছেলেটির মা। তবে সাবধান। ওঁর ছেলেকে যে তোমরা মেরে ফেলেছ একথা উনি যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারেন। উঃ কী কুক্ষণেই যে এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম।

অ্যাটম বলল, এই তা হলে তোমাদের ঘাঁটি? তা এখন পুলিশ এসে যদি ঘাঁটি আক্রমণ করে তা হলে পালাবে কোথায়?

সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সমুদ্র-মুখ পর্যন্ত একটা মানুষপ্রমাণ বড় ড্রেনের সঙ্গে এই সুড়ঙ্গের যোগাযোগ আছে। এটা ডিনামাইট দিয়ে ধসিয়ে সেখান দিয়ে আমরা পালাব।

অ। রূপেন আর সুখেন বুঝি সেই সমুদ্র-মুখেও পুলিশ পাঠাবে না।

ঠিকই বলেছ তোমরা। সেইজন্যে আমাদের কিছু লোক ইতিমধ্যেই আরও একটি পালাবার পথ তৈরি করতে লেগে গেছে।

কিন্তু তোমরা পুলিশ আসবার আগেই এখান থেকে পালাচ্ছ না কেন?

অসুবিধে আছে। নেহাত বেকায়দায় না পড়লে এই ঘাঁটি থেকে বেরোব না আমরা। কেন না এই ঘটনার পর পুলিশ এখন জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে কড়া নজর রেখেছে। আমরা এখান থেকেই চেষ্টা করছি পুলিশকে ঘাঁটির ধারেকাছে আসতে না দেবার। যাক। কথায় কথায় রাত হয়ে যাচ্ছে। এখন তোমরা একটু অপেক্ষা করো। সর্দারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি তোমাদের। এই বলে লোক দু’জন চলে গেল।

অ্যাটম আর পেটো তখন চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ভেতরে লোকজন কাউকেই তেমন দেখা গেল না। এক জায়গায় একটি বন্ধ দরজার সামনে টুল পেতে এক প্রহরী বন্দুক হাতে ঘর পাহারা দিচ্ছে। অ্যাটম আর পেটো সেই ঘরের কাছে গিয়ে বলল, এই ঘরের ভেতরে কী আছে গো?

প্রহরী রক্তচক্ষুতে চেঁচিয়ে উঠে, ভাগো হিয়াসে।

অ্যাটম বলল, আমাদের সঙ্গে এইভাবে কথা বোলো না বাবা। মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব এখুনি। আমরা তেইশটা মার্ডার করেছি। তুমি ক’টা করেছ?

প্রহরীটা লাফিয়ে উঠে বলল, এক ফোঁটা ছেলে। কথা বলতে শিখিসনি? কী করে এর ভেতর ঢুকলি তোরা?

পেটো বলল, কী করে আবার? তোমার বাবারা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।

প্রহরীটা পেটোর চুলের মুঠি ধরে চিৎকার করে ডাকল, জানকিপোরসাদ! এ জানকিপোরসাদ ! ইধার আও তো।

অ্যাটম প্রহরীটার পেটে সজোরে একটা ঘুসি মেরে বলল, জানকিপ্ৰসাদ ক্যা কিয়েগা হামারা? তুমহারা হিম্মত নেহি? উল্লু কাঁহাকা?

প্রহরীটা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে পেটোর চুলের মুঠি ছেড়ে অ্যাটমকে মারবার জন্য যেই না হাত ওঠাল অমনি এক বজ্রগর্ভ কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠল সেখানে, রুখ যাও।

প্রহরী সচকিত হয়ে হাত নামিয়ে সরে দাঁড়াল। অ্যাটম ও পেটো সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সেই মূর্তিমান বিভীষিকার দিকে। দেখল দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারার এক চাপদাড়ি সর্দারজি, কালো চশমায় চোখ ঢেকে, মাথায় পাগড়ি এঁটে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

যে লোক দু’জন অ্যাটম ও পেটোকে এখানে নিয়ে এসেছিল তারাও যেন কীরকম কেঁচোর মতো দাঁড়িয়ে আছে সর্দারজির পাশে।

সর্দারজি তাদের বললেন, শোনো, তোমাদের এখানে থাকবার আর দরকার নেই। তোমরা বরং বাইরে পাহারা দাও। যদি বিপদ বোঝো আমাকে খবর দেবে। আমি এদের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। বলে অ্যাটম ও পেটোকে বললেন, আমার সঙ্গে এসো।

অ্যাটম ও পেটো সর্দারজির সঙ্গে একটি সুসজ্জিত ছোট্ট ঘরে এসে ঢুকল। ঘরের দেওয়ালে একটি মাত্র কালীর ছবি ছাড়া আর কোনও ছবি নেই। সর্দারজি ওদের বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাদের মতো মারাত্মক কাউকেই খুঁজছিলাম। তোমরা যদি আমার হুকুমমতো চলতে পারো বা যদি দল ছেড়ে পালিয়ে না যাও, তা হলে আখেরে উন্নতি করবে। তা সে যাই হোক, আপাতত আমার দলে নাম লিখিয়ে দুটো মার্ডার করে তোমাদের হাতেখড়ি দিতে হবে আজ।

অ্যাটম বলল, কাকে মার্ডার করতে হবে বলুন?

সর্দারজি দুটো ছবি বার করে ওদের হাতে দিয়ে বললেন, এই মুখদুটো চিনে রাখো। এদেরই মারতে হবে।

পেটো মিথ্যে করে বলল, আরে! এ মুখ তো আমরা চিনি। একদিন আমাদের দু’জনকে এরা আচ্ছা করে এমন ধোলাই লাগিয়েছিল যে কী বলব। কিন্তু কী দিয়ে মারব সর্দার?

কী দিয়ে মারতে তোমাদের সুবিধে হয়?

যদি দু’জনে দুটো ডিস্যুম-ডস্যুম পাই।

ওসব চালাতে পারো?

অ্যাটম বলল, আগে দিন না। তারপর আপনারই পেটটা ফুটো করে দেখিয়ে দিচ্ছি পারি কি না।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই সর্দারের একটি থাপ্পর খেয়ে ঘরের মেঝেয় ছিটকে পড়ল অ্যাটম। সর্দার নির্বিকার ভাবে বললেন, নাও। গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে বসো। ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় একটু সমীহ করে কথা বলবে।

এমন সময় দরজার কাছে দু’জন লোক এসে দাঁড়াতেই সর্দারজি বললেন, বলো।

অল ক্লিয়ার সর্দারজি।

কোথাও কিছু পড়ে নেই তো?

না। পুলিশ এর ভেতরে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোনও কিছু পাবে না। সব পলিথিনের প্যাকেট মুড়ে বালিতে পুঁতে রেখেছি।

মেসিনটা কোথায় রাখলে?

সোনার পাতগুলোর সঙ্গে বেঁধে।

পরে জায়গাটা ঠিক চিনে নিতে পারবে? হ্যা সর্দারজি।

জাল নোট কতগুলো আছে এখানে?

তা প্রায় দু’-তিন বস্তার মতো।

বিপদ বুঝলে ওগুলো পুড়িয়ে

দিয়ো।

আচ্ছা। বলে চলে গেল ওরা।

এমন সময় আরও একজনের আবির্ভাব হল সেখানে। এই লোকটি বলল, সর্দারজি! সুখেন আয়া।

সর্দারজি একটুও বিস্মিত না-হয়ে বললেন, আনে দো।

লোকটি চলে গেল এবং একটু পরেই সুখেনকে নিয়ে এসে হাজির করল সেখানে। সর্দারজি হেসে বললেন, বসো সুখেন। এই ছেলেদুটিকে চেনো? অ্যাটম ও পেটোর দিকে তাকিয়ে সুখেন বলল, না। চেনা দূরের কথা ওদের দেখিওনি কখনও।

সে কী! তুমি নাকি ওদের বেধড়ক পিটিয়েছিলে একবার? হবে। হয়তো খেয়াল নেই।

তা যাক গে। এখন বলো, তোমার ওই পুলিশবন্ধুদের ছেড়ে হঠাৎ এই গরিবের পর্ণকুটিরে এসে হাজির হলে কেন?

সুখেন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, সর্দার! আমাকে মাফ করুন সর্দার। আমি ওই ব্যাটা রূপেনের কথায় দলছুট হয়ে খুব ভুল করেছি। আসলে ওই ছেলেচুরির ব্যাপারে আমরা পুলিশের সন্দেহের চোখে পড়ে গেছি জেনে পুলিশকে বলতে গিয়েছিলাম যে, ও-চুরি আমরা করিনি। তারপর—।

আর কিছু বলার আছে তোমার?

আমি আবার আপনার দলে ফিরে আসতে চাই সর্দার।

সর্দার হেসে বললেন, তা কী করে হয়? তুমি তো জানো, দলত্যাগীদের আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া রূপেন ধরা পড়ে পুলিশের হেফাজতে আছে। এসব যদি তোমাদের অভিনয় না-হয়, তা হলে এতক্ষণে তো মারের চোটে সব কথা সে কবুল করে ফেলেছে। তুমি এখন যেতে পারো। সর্দার!

ইউ মে গো। তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে আমার দলের বহু লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে। আজই সন্ধ্যায় দিঘার সৈকতে সাত-সাতজন প্রাণ হারিয়েছে। ওই হাবা ছেলেটা যখন অসমঞ্জবাবুকে আমাদের ঘাঁটিতে নিয়ে আসছিল তখন।

অ। তা হলে আমি আপনাদের দলে ফিরে আসতে পারছি না?

না।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে সুখেন সর্দারের দিকে তাক করে বলল, এই অস্ত্রটা কতখানি পাওয়ারফুল তা নিশ্চয়ই জানা আছে? জানি।

তা হলে শিগগির বলো, অসমঞ্জবাবুর ছেলে আর বউকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?

আমার পাগড়িটা খুলে দেখো। হয়তো এর ভেতরে থাকতে পারে।

রসিকতা রাখো। এই রিভলভার আমি তোমার কপালে ঠেকিয়ে রাখলাম। তোমার দলের লোকেদের এখনই বলো তাদের ছেড়ে দিতে! না হলে তুমি এখনই মরবে।

সুখেন, তুমি বড় বোকা। তুমি কি জান, তোমার পেছনে আমার কত লোক দাঁড়িয়ে আছে? রিভলভারটা এখান থেকে না-সরালে ওরাই তোমাকে বরাবরের জন্য সরিয়ে দেবে।

জানি। আমি মরবার জন্য তৈরি হয়েই এখানে এসেছি, আমাকে কেউ এতটুকু আক্রমণ করবার চেষ্টা করলে আমি তোমার খুলি ফুটো করে দেব। হায় হায় রে! বলে একটু নড়বার চেষ্টা করতেই সুখেন বলল, খবরদার হাত ওঠাবে না। আগে যা বলি তাই করো। এখনই ওদের মুক্তি দাও, এক, দুই, তিন। রুখ গয়া কিউ? চালাও গোলি। ম্যায় মরনেকে লিয়ে তৈয়ার হুঁ।

অ্যাটম আর পেটো এই সব দেখে খুবই হকচকিয়ে গেল। ওরা ঘরের বাইরে তাকিয়ে দেখল অন্তত দশজন ভয়ংকর চেহারার সশস্ত্র লোক নিঃশব্দে কখন যেন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে।

সর্দার একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন।

সুখেন বললল, উঁহু। আগে ওদের মুক্তি দাও, তারপর ওইসব করবে। আমি নিজে বাঁচব না জানি। তবুও তোমাকে আমি মারব।

চোখের পলকে অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক। তারপরই ‘গুডুম’ করে একটা শব্দ। এবং পরক্ষণেই একটি চাপা আর্তনাদ।

আলো জ্বলে উঠল আবার। ঘরের মেঝেয় রক্তাপ্লুত অবস্থায় সুখেনকে পড়ে থাকতে দেখা গেল।

সর্দার উঠে দাঁড়িয়ে একবার শুধু বললেন, বদতমিজ কাঁহাকা। তাঁর হাতে একটি ঝকঝকে রিভলভার শোভা পাচ্ছে।

কয়েকজন লোক সুখেনকে তুলে নিয়ে চলে গেল।

সর্দার অ্যাটম ও পেটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে দুশমনি করার পরিণাম তো দেখলে? আশা করি আমার কাজ একটু যত্ন নিয়েই করবে।

অ্যাটম আর পেটো বলল, সর্দারজি, আমরা ওই হাবা ছেলেটার মতো বোকামি করব না। আর বেইমানি করার তো প্রশ্নই ওঠে না! আমরা লিডার খুঁজছিলাম। পেয়ে গেছি। এখন যন্তর দিন। বাকি একটাকে শেষ করে আসছি।

সর্দার সুখেনের হাত থেকে খসে পড়া পুলিশের রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন এটাই নিয়ে যাও। খুব সাবধানে কাজ করবে। মনে রেখো, একটু অসাবধান হলেই মরবে তোমরা। পুলিশেরাই মারবে তোমাদের।

অ্যাটম আর পেটো যেই বেরোতে যাবে, তখনই সেই লোকদুটো, মানে যারা ওদের নিয়ে এসেছিল তারা এসে বলল, বাইরে খুব গোলমাল শুরু হয়ে গেছে সর্দার।

কীরকম!

জঙ্গলের ভেতর দলে-দলে পুলিশ এসে ঢুকছে।

মাত ডরো।

আর সেই পুলিশ অফিসার। মানে মি. অসমঞ্জ রায়। যিনি দিঘা সৈকতে আমাদের গুলিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি হাসপাতালে মারা গেছেন।

আপশোশ কী বাত। তা কী আর করা যাবে? ছেলেটা তো আগেই মরেছে। এখন বাকি রইল মা-টা।

আমাদের মনে হয় ওঁকে আর অযথা আটকে না-রেখে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক। সর্দার তেমনই শান্তভাবে মৃদু হেসে বললেন, নেহি। জগজিৎ সিং জ্যাঙ্গোর থাবা থেকে কারও মুক্তি নেই বন্ধু। ওঁকেও মরতে হবে! আপনা থেকেই যখন ক্রাইমটা তৈরি হয়ে গেছে, তখন এই তো ভাল। জ্যাঙ্গোর ক্যারেকটার বুঝতে এই রহস্যটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠুক। পুলিশ-গোয়েন্দারা ভাবুক। ভেবে ভেবে কূলকিনারা হারাক। কিন্তু ক্রাইমের জগতে এই হত্যাকাণ্ডের কোনওরকম সমাধান যেন কখনও না হয়। আমরা টাকা চাইলাম না, পয়সা চাইলাম না, কোনও শর্ত রাখলাম না, শুধু অকারণে একটা ফ্যামিলিকে স্রেফ পুলিশে চাকরি করার অপরাধে সরিয়ে দিলাম। কিন্তু কেন? কেউ জানবে না। এরই নাম প্যানিক। এইরকম মাঝে মধ্যে অপ্রয়োজনে দু’–একটা খুনখারাপি না করলে ওরা কী করে বুঝবে মি. জ্যাঙ্গো কীরকম ডেঞ্জারাস?

তা হলে বলুন, কী ভাবে কী করব?

যা করবে তা হল স্রেফ ঠান্ডা মাথায় খুন। তোমরা নতুন রাস্তা দিয়ে চলে যাও। আমাদের এলাকার বাইরে গিয়ে ওই মহিলাকে বলবে ‘মুক্তি দিলাম’। এই ছেলেদুটি ওই মহিলাকে সমুদ্রতীর ধরে দিঘার দিকে নিয়ে যাবে। তারপর?

তার আর পর নেই। দূর থেকে ওই মহিলার জন্যে তোমরা একটি মাত্র বুলেট খরচা করবে। কেমন?

অ্যাটম বলল, ওই লোকটাকে মারবার কী হবে তা হলে? যাকে মারবার জন্যে আমরা যাচ্ছিলাম?

দরকার নেই। সে এখন লকআপে কড়া পাহারায় আছে। নয়তো সে নিজেই এইসব পুলিশদের পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে। ওকে আমরা এ যাত্রা নয়, অন্য সময় সরিয়ে দেব।

এমন সময় বুম বুম করে কয়েকটা শব্দ।

সর্দার হেসে বললেন, যাক। এইদিক দিয়ে পুলিশের আক্রমণের আশঙ্কা থেকে আমরা বেঁচে গেলাম। এদিকের মুখ ডিনামাইট চার্জ করে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন বাকি রইল শুধু সমুদ্র-মুখটা।

অ্যাটম বলল, আমরা যদি ওই মহিলাকে নিয়ে সমুদ্র-মুখ দিয়েই বার হই তো ক্ষতি কি?

সর্দার এক মিনিট কী যেন ভেবে বললেন, না। না। না। রূপেন কি এদিকের কথা পুলিশকে না-জানিয়েছে ভেবেছ? তোমরা নতুন পথ দিয়ে যাও। আর শোনো, আমাদের দলের মেয়েদুটোকেও বাইরে বার করে দাও। ওদের বলে দাও ওরা যেন কাছাকাছিই থাকে। পরে আমরা ওদের খুঁজে নেব।

সর্দারের কথামতো তাই করা হল। সর্দার নিজে এসে সুজাতাদেবীকে মুক্তি দিলেন। বললেন, আপনাকে আমরা ছেড়ে দিলাম মিসেস রায়। আপনি এদের সঙ্গে যেতে পারেন।

সুজাতাদেবী আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, কিন্তু আমার ছেলে? সে কোথায়? তাকে দেখছি না কেন?

এখন আপনি তার কাছেই যাবেন। তাকে অন্য এক জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে খুব কান্নাকাটি করছে সে। তার জন্যেই আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছে। যান।

সত্যি বলছেন, আমাকে আমার ছেলের কাছে নিয়ে যাবেন?

মিথ্যে বলে লাভ কী? যান দেরি করবেন না। আপনার ছেলের কাছেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা।

সুজাতাদেবী আশান্বিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই সর্দার অন্য মেয়েদুটোকে বললেন, তোমরাও যাও, তোমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে এখনকার মতো।

এমন সময় সমুদ্র-মুখের সুড়ঙ্গর দিক থেকে এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল দু’জন লোক, সর্দার! এই দেখুন কাকে নিয়ে এসেছি। এই শয়তানটা ছদ্মবেশে এর ভেতরে দু’জন পুলিশকে নিয়ে ঢুকে পড়েছিল।

আরে! এ কী! রূপেনবাবু! এ কী চেহারা তোমার! একেবারে যোগীরাজ হয়ে গেলে রাতারাতি? বাঃ ভাই। তা জেনেশুনে সাপের গর্তে আঙুল ঢোকাতে এসেছিলে কেন?

ছদ্মবেশী রূপেন রক্তচক্ষুতে সর্দারের দিকে তাকিয়ে থুঃ করে থুতু ফেলল। সর্দার বললেন, এর সঙ্গের পুলিশদুটো কোথায়?

সাদা পোশাকের পুলিশ? তাদের দুটোকেই আমরা শেষ করে দিয়েছি।

ভেরি গুড। বলেই রূপেনের নকল জটা ও দাড়ি ধরে টেনে দিলেন সর্দার। টানা মাত্রই খুলে এল সেটা।

রূপেন যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল ওদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার, কিন্তু পারল না।

সর্দার ওর অবস্থা দেখে হেসে বললেন, ইঁদুর জাঁতাকলে পড়লে ঠিক তোমার মতন করে। তোমার বন্ধু সুখেনের সঙ্গে দেখা করবার নিশ্চয়ই খুব ইচ্ছে হচ্ছে তোমার? এখন আমরা তোমার জন্যে সেই ব্যবস্থাই করব। তোমরা দু’ বন্ধুতে পাশাপাশি শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে এবার। বলেই অ্যাটমকে বললেন, এই ছোকরা! তুমি তো কথায় কথায় মানুষ খুন করতে পারো শুনেছি। পারবে খুব সামনে দাঁড়িয়ে এই ভণ্ড সাধুটার ভণ্ডামি দূর করে দিতে?

অ্যাটম বলল, কেন পারব না? বলে একবার পেটোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।

পেটো বলল, আমি।

অ্যাটম বলল, না, আমি

সর্দার বললেন, ঠিক আছে। তোমরা দু’জনেই মারো। একসঙ্গে। এই নাও আমারটাও নাও। বলে নিজের রিভলভারটাও বার করে পেটোর হাতে দিলেন।

অ্যাটম আর পেটো দু’পা পিছিয়ে এল।

সর্দার কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, রেডি? ওয়ান, টু, থ্রি।

অ্যাটম ও পেটোর রিভালভার গর্জে উঠল ‘গুডুম, গুড়ুম, গুড়ুম।’

একটা পেটে, একটা বুকে, একটা কপালে।

রক্তাপ্লুত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন জগজিৎ সিং জ্যাঙ্গো। অভাবনীয় ব্যাপার। চ্যাংড়া ছোঁড়াদুটো করল কী!

অ্যাটম তবুও শান্ত না। রূপেনকে যারা ধরে এনেছিল তাদের বলল, শিগগির ছেড়ে দাও ওঁকে। ছাড়ো।

তারা হতভম্ব হয়ে রূপেনকে ছেড়ে দিতেই পেটো ওর রিভলভারটা রূপেনের হাতে দিয়ে বলল, দাদা! এবার আপনার কাজ আপনি করুন। আমরা এঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

সুজাতাদেবী অ্যাটমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কে বাবা তুমি। এই বিপদে এমন করে আমাদের সাহায্য করলে?

আমরা আপনার ছেলে মা। আমাদের তো মা নেই। এখন থেকে আপনাকেই আমরা মা বলে ডাকব।

বেশ। তাই ডাকবে।

তা হলে চলুন। আর এখানে একটুও থাকা উচিত নয়। কখন কী বিপদ ঘটে কে জানে?

রূপেন ততোক্ষণে সব কটাকে শুইয়ে দিয়েছে মাটিতে।

অ্যাটম বলল, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলে আসুন দাদা। এখানে একা না থাকাই ভাল। আপনার বন্ধু সুখেনবাবু একটু আগেই সর্দারের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

রূপেন বলল, তোমরা এক কাজ করো। ওঁকে থানায় পৌঁছে দিয়ে পুলিশ নিয়ে এদিকে চলে এসো। আমি ততক্ষণ আড়ালে কোথাও লুকিয়ে থেকে ঘাঁটি পাহারা দিই। যাতে ওরা এখান থেকে পালাতে না পারে।

অ্যাটম ও পেটো সুজাতাদেবীকে নিয়ে সুড়ঙ্গপথে ঘাঁটির বাইরে সমুদ্র-মুখে এসে পড়ল।

সুজাতাদেবী বললেন, আমার ছেলের কোনও খবর জান? আমার বাপ্পা! সে কি বেঁচে আছে?

তার জন্যে চিন্তা করবেন না মা। সে আমাদের জিম্মায় নিরাপদ আশ্রয়েই আছে। আগে আমরা আপনাকে থানায় পৌঁছে দেব। তারপর তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব আপনাদের কাছে।

ওরা সমুদ্রতীরে ধরে খুব জোরে পা চালিয়ে দিঘার দিকে রওনা দিল। অ্যাটম আর পেটো অসমঞ্জবাবুর মৃত্যু সংবাদটা বেমালুম চেপে গেল সুজাতাদেবীর কাছে। কী জানি যদি উনি এ সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়েন, তা হলে তো ওঁকে নিয়ে পথ চলাই দায় হবে।

যাই হোক। বেশি দূর যেতে হল না। এক বিরাট পুলিশবাহিনী টহল দিচ্ছিল এক জায়গায়। ওরা সেখানে গিয়ে সুজাতাদেবীকে তাদের হাতে তুলে দিয়েই রূপেনের কথা মতো এক ঝাঁক পুলিশ নিয়ে চলে এল সমুদ্র-মুখে। কিন্তু এ কী! কোথায় কী? সমুদ্র-মুখের সেই সুড়ঙ্গপথ তখন ধস নেমে রুদ্ধ হয়ে গেছে। রূপেন কেন, কারও অস্তিত্বই আর সেখানে নেই।

না থাক। ওরা আবার সেই অন্ধকারে পথ চিনে বালিয়াড়ি আর জঙ্গল পার হয়ে চন্দনেশ্বরের দিকে চলল। রাত শেষ হয়ে এসেছে তখন। ভোরের পাখিরা কলরব শুরু করে দিয়েছে। আকাশের তারাগুলি তখনও জ্বলছে মিটিমিটি। অনেক পথ পার হয়ে ওরা যথাস্থানে এসে পৌঁছল।

অ্যাটম আর পেটো সেই গাছতলায় পৌঁছে চেঁচিয়ে ডাকল, বাপ্পা। বাপ্পাভাই নেমে এসো। আমরা এসে গেছি।

কিন্তু না। ওদের অনেক ডাকাডাকিতেও নেমে এল না বাপ্পা। অ্যাটম আর পেটো সেই শক্ত লতা ধরে চড় চড় করে ওপরে উঠে দেখল কেউ কোথাও নেই। আবার রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গেছে ছেলেটা।

না। দীঘা সৈকতে আর কোনও আতঙ্ক নেই। আজকের এই সূর্যকরোজ্জ্বল সুন্দর সকালে সবার মুখে তাই হাসি। অঞ্চলের সন্ত্রাস কুখ্যাত দস্যু জ্যাঙ্গোর মৃত্যু যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়েছে সকলকে। ওদের দলের কাউকেই ধরা যায়নি যদিও, তবুও নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই ধস চাপা পড়ে মরেছে বলে পুলিশ-প্রশাসন, জনসাধারণ সবাই খুশি।