আট
অপরজন বলল, বল, মেট্রো সিনেমার লবিতে।
বাপ্পা উঠে বসে দু’হাতে চোখ রগড়ে বলল, তোমরা কারা? আরে! তাও জান না? আমার নাম ধর্মেন্দর, ওর নাম অমিতাভ বচ্চন। বাপ্পা বুঝল দু’ দুটো সিনেমাখোর বখাটের পাল্লায় এসে পড়েছে ও। তবু ওদের কথায় রাগ না করে বলল, সত্যি বলছি, আমি জানি না আমি কোথায়। সে কী! তুমি আঁতুড়ের ছেলে নাকি যে কোথায় ভূমিষ্ঠ হয়েছ তা জান না! বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাপ্পার সবুট লাথি ছেলেটির মুখে এসে পড়ল। অপর ছেলেটি তারই মোকাবিলা করবার জন্য যেই-না বাপ্পাকে আক্রমণ করতে যাবে অমনি আর এক লাথি এসে পড়ল তার মুখে।
ছেলেদুটি ছিটকে পড়ল দু’দিকে। তারপর মুখে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, কামাল কর দিয়া গুরু। আমরা যদি ধর্মেন্দর-অমিতাভ হই, তুমি তো তা হলে ড্যানি।
বাপ্পা বলল, শোনো, তোমরা কে তা জানি না। যদি আমাকে এখান থেকে
পালাবার সুযোগ করে দিতে না-পার তা হলে তোমরা খুব ভুল কাজ করবে।
কী আবোল-তাবোল বকছ তুমি গুরু? আমরা তোমাকে ধরে এনেছি, না বেঁধে রেখেছি? একটা বিড়ি খাবে।
বাপ্পা বলল, না, ওসব তোমরা খাও। আর অযথা বখাটের মতো আমাকে গুরু গুরু কোরো না।
আমরা বখাটেই তো।
হতে পারো। কিন্তু আমার নাম বাপ্পা। তোমরা নিশ্চয়ই আমাকে পাহারা দেবার জন্য রয়েছ?
কামাল কর দিয়া গুরু। কী যা তা বলছ?
আবার ‘গুরু!’
ওঃ হো, তোমায় গুরু বললে তুমি তো আবার আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি কি আমাদের মতো নও? মানে নিজের থেকে পালিয়ে এসে এখানে লুকিয়ে থাকনি?
না আমাকে চুরি করে নিয়ে এসে রাখা হয়েছে।
রেগে যাও। তা কী তুমি বলছ,
ছেলেদুটি বিস্মিত হয়ে বলল, তাই নাকি? তবে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আমরা কিন্তু তা নই। আমাদের মা নেই, বাবা নেই। তারা কেউ কোনও কালে ছিলেন কি না তাও জানি না। হয়তো আমরা আকাশ থেকে ঢিপ করে পড়েছি। নয়তো এমনিই গজিয়েছি মাটিতে। অর্থাৎ ধরে নিতে পারো একেবারেই রাস্তার ছেলে আমরা। চুরিচামারি করে, ছিনতাই করে, এরওর পকেট মেরে যা পাই তা সমান ভাগে-ভাগ করে নিই দু’জনে। আমাদের মধ্যে হিসাব নিয়ে কোনও গোলমাল হয় না কখনও। আমাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই, ফুটপাথই আমাদের ঠিকানা। আমরা বেশির ভাগ সময় বজবজে থাকি। একবার মেট্রোয় সিনেমা দেখতে গিয়ে ভুল করে পকেট মেরে বসে আছি এক দারোগাবাবুর। তারপর যখনই বুঝতে পেরেছি হাতটা একটু অন্য জায়গায় পড়ে গেছে আর পুলিশ হন্যে হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাদের অমনি ‘মার খিঁচ’। ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে পালিয়ে এসে একেবারে ওড়িশায়। কিছুদিন বালেশ্বরে থেকে, এখন এই পোড়ো বাড়িটাতে আশ্রয় নিয়েছি। এটা মাটির নীচের ঘর। এর একপাশের মাটি সরে যাওয়ায় সেখানকার ইটের ফাঁক দিয়ে একটা গর্ত করে নিয়েছি আমরা। তাই দিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকি। কেউ টের পায় না। আমরা প্রায়ই রাত্রিবেলা এখানে আশ্রয় নিই এবং দিনের বেলা কাজকর্ম করতে যাই। তা থেকে ভেবেছিলাম তুমিও বুঝি আমাদের মতোই ‘এগারো নম্বরি।’ কিন্তু তুমি এসব কী বলছ?
যা বলছি ঠিকই বলছি। বিশ্বাস করো ভাই। আমার বড় বিপদ। তোমরা কি পারবে আমাকে উদ্ধার করতে?
ছেলেদুটি এবার অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল বাপ্পার মুখের দিকে। তারপর বলল, তুমি আমাদের ভাই বলে ডাকলে? আমাদের এক বন্ধু ছিল তার নাম স্যান্ডুইচ। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে। একমাত্র সে-ই আমাদের ভাই বলে ডাকত। সেই আমাদের ‘গুরু’ বলতে শিখিয়েছে। চুরি-ছিনতাই শিখিয়েছে। দু’-একটা ইংরেজি নাম শিখিয়েছে। তা সে এখন নেই। খারাপ অসুখ করে মরে গেছে ছেলেটা। কিন্তু আমরা দু’জনে প্রথম শ্রেণির বিশ্ববখাটে এবং রাস্তার ছেলে জেনেও তুমি যখন আমাদের ভাই বলে ডেকেছে, তখন তোমার এই ভাই ডাকের মর্যাদা আমরা দেবই। তোমার জন্যে জান দিয়ে দেব আমরা।
বাপ্পা বলল, ঠিক আছে। যদি তোমরা কোনওরকমে আমাকে মুক্তি দিতে পারো এদের খপ্পর থেকে, তা হলে আমিও তোমাদের জন্যে যথাসাধ্য করব। যাতে তোমরা ভাল ছেলে হতে পারো, ভাল খেতে পরতে পাও, ভাল একটা আশ্রয় পাও, সব ব্যবস্থা করে দেব। তোমরা স্কুলে পড়বে, লেখাপড়া শিখবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। তোমাদের দু’জনের আমি নতুন নাম দেব। অনেক কিছু করব।
সত্যি বলছ, তুমি আমাদের জন্যে এত সব করবে?
সত্যি বলছি। কেন না তোমরা যে আমার ভাই। তা ছাড়া তোমরা তো জান না আমি একজন পুলিশ অফিসারের ছেলে। আমার বাবার ক্ষমতা অনেক।
পুলিশের নাম শুনেই লাফিয়ে উঠল ছেলেদুটি। বলল, ও। তাই বলো। সেইজন্যেই ওরা তোমাকে এইখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে। শোনো ভাই, পুলিশের সঙ্গে কিন্তু আমাদের অত্যন্ত দুশমনি। পুলিশ আমাদের ধরতে পারলে পিটিয়ে ছাল তুলে দেবে।
না। তোমরা আমার উপকার করলে পুলিশ তোমাদের কিচ্ছু বলবে না। আমি বাপিকে বলে দেব তোমাদের কিছু না-বলতে। আর তা ছাড়া তোমরা তো এরপর খারাপ ছেলে থাকছ না। কিন্তু তোমাদের কি সত্যিই ফিল্মস্টারের নাম ছাড়া আর কোনও নাম নেই?
আছে। ও নামও অবশ্য আমাদের নিজেদের দেওয়া না। অর্থাৎ আমাদের সেই বন্ধু স্যান্ডুইচ, সে-ই নাম রেখেছে আমাদের। আমার নাম অ্যাটম, ওর নাম পেটো।
এমন সময় ঘরের এক কোণে ছাদের দিকে একটু ঘরঘর শব্দ শোনা গেল। দেখা গেল ঘরে নামা-ওঠার জন্যে একটা চৌকো মুখ আছে, তার মুখটা ঢাকা দেওয়া ছিল, সেটা সরে গেল। অমনি দেখা গেল একটা দড়ির মই নেমে আসছে।
অ্যাটম আর পেটো লাফিয়ে উঠে বলল, মনে হচ্ছে যারা তোমাকে এখানে রেখেছিল তারা আসছে। যদি ওরা তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়, তা হলে আমরা ওদের ফলো করব। আর না হলে পরে এসে উদ্ধার করব তোমাকে। এখন আমরা পালাই। বলেই গুপ্তস্থান থেকে বেরিয়ে বাইরের একটি মানুষপ্রমাণ বড় ড্রেনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল ওরা। ড্রেনটি শুকনো। শহরের ময়লা জল নিষ্কাশন হয় এর ভেতর দিয়ে। ড্রেনের মুখের কাছেই সমুদ্রের জল চলে এসেছে এখন। কেন না এটা জোয়ারের সময়। ওরা সেই জলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে লাগল।
বাপ্পা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওপর দিকে। দড়ির মই বেয়ে বলিষ্ঠ চেহারার এক ন্যাড়া মাথা বেঁটে মস্তানকে নেমে আসতে দেখা গেল। তার হাতে কলা, পাঁউরুটি, ডিমসেদ্ধ ইত্যাদি। লোকটা নেমে এসে দাঁত বার করে বাপ্পার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল।
বাপ্পার গা যেন জ্বলে গেল। ভাল করে তাকিয়ে সেই দেঁতোহাসির ছিরি দেখেও সে বুঝতে পারল না এগুলো দাঁত না, অন্য কিছু।
লোকটি তেমনই হাসতে হাসতে বলল, দেখছ কী? কী এত দেখার আছে? তোমার দাঁতের ছিরি দেখছি।
ও আর অত করে দেখার কী আছে? এখন খেয়ে নাও। আমার এই দাঁতগুলো একটা সোনা, একটা রুপো, একটা লোহা, একটা পেতল আর তামা দিয়ে বাঁধানো।
বাপ্পা হঠাৎ ভল্ট খেয়ে লাফিয়ে উঠে ওর মাথা দিয়ে লোকটার পেটে একটা গোত্তা মেরে বলল, এটা তো বেশ নরম দেখছি। এর ভেতরের নাড়ি-ভু নিশ্চয়ই তার দিয়ে পাকানো নয়।
লোকটার হাত থেকে খাবারগুলো পড়ে গেল। সে দু’হাতে পেট-চেপে বসে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল। বাপ্পা একটা ডিম সেদ্ধ কুড়িয়ে নিয়ে লোকটার মুখে গুঁজে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে নাও। খুব পুষ্টিকর খাদ্য এটা। খেলে শরীরে বল পাবে। উঠে দাঁড়াতে পারবে। বলেই ঝুলন্ত দড়ির মই বেয়ে ওপরে উঠে পড়ল। তারপর মইটা তুলে নিয়ে মুখটা আবার ঢাকা দিয়ে চারদিক বেশ ভাল করে দেখে নিল।
আসলে এটা একটা পোড়ো বাড়ি। এর নীচে আন্ডারগ্রাউন্ড’ ঘর। হয়তো কোনও জমিদার কোনও সময়ে তৈরি করিয়ে ছিলেন এটা। এখন শয়তানরা তাদের খারাপ কাজের জন্য ব্যবহার করছে। একেবারে ঘন ঝাউবন, বালিয়াড়ি আর সমুদ্রতীরে এই ভাঙা পোড়ো বাড়ি। সমুদ্র হয়তো অচিরেই গ্রাস করবে এটিকে। যাই হোক এর ভেতর থেকে একবার বেরোতে পারলে আর ওকে পায় কে? বাপ্পা ধীরেধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়েই উঁচু একটি বালিয়াড়িতে এসে পৌঁছুল।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ষণ্ডামার্কা জোয়ান লোক ছুটে এল ওর দিকে, আরে! এ ছেলেটা এখানে বেরিয়ে এল কী করে?
বাপ্পা চকিতে দু’ মুঠো বালি তুলে ছুড়ে দিল দু’জনের চোখে। একজন তো ‘গেলুম রে বাবা রে’ বলে বসে পড়লেও অপরজন শক্ত হাতে ধরে ফেলল বাপ্পাকে। তারপর বেশ কঠিন হাতে ওকে ধরে টানতে টানতে আবার সেই ঘরের ভেতর নিয়ে এল। তারপর সিঁড়ির মুখের ডালা সরিয়ে দড়ির মইটা নামিয়ে দিতেই নীচের লোকটি উঠে এল ওপরে। উঠে এসেই বাপ্পার গালে মারল এক চড়। তারপর ওর হাতদুটো শক্ত করে বেঁধে আবার ওকে নামিয়ে আনল নীচের ঘরে।
যে লোকটার পেটে আঘাত করে বাপ্পা পালিয়েছিল সে লোকটি বাপ্পার চুলের মুঠি ধরে বলল, বড্ড বেশি মস্তান হয়েছিস না? পুলিশের বাচ্চা এর মধ্যেই মারপিটের অনেক রকম কায়দা রপ্ত করেছিস দেখছি। এবার কী করবি? বেশ ছাড়া ছিলি, এবার বাঁধা থাক। এরপরও যদি বেশি বেয়াদপি করিস তো গলাটিপে মেরে ফেলব। তারপর বস্তায় পুরে ফেলে দেব সমুদ্রের জলে। কেউ টেরও পাবে না।
বাপ্পা ক্ষোভে-দুঃখে কেঁদে ফেলল এবার।
ওর কান্না দেখেও মন ভিজল না ওদের। বলল, কোনওরকমেই এখান থেকে পালাবার চেষ্টা কোরো না বুঝলে? আমাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধ হলেই তোমার সম্বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাপ্পা বলল, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আমার মায়ের কাছে যাব। আমার বাপির কাছে যাব আমি, আমাকে ছেড়ে দাও।
লোকটি বলল, কেন, তোমার বাবা তো মস্ত গোয়েন্দা। পরের ছেলে হারিয়ে গেলে খুঁজে বার করেন। এখন নিজের ছেলেকে খুঁজে বার করুন। এ এমন জায়গায় নিয়ে এসে ফেলেছি যে তোমার ঠাকুর্দা এসেও উদ্ধার করতে পারবেন না তোমাকে।
বাপ্পা বলল, আমি কোথায়?
আমাদের খপ্পরে, আবার কোথায়? তা যাক। শোনো, তুমি এখন আমাদের ছেলে। যা বলি মন দিয়ে শোনো। এখানে ঘরের মেঝেয় যে খাবারগুলো পড়ে আছে, ওগুলোই আপাতত কুড়িয়ে খেয়ে নাও। আমরা হয়তো সারাদিনে আর নাও আসতে পারি। যদিও হাত বাঁধা আছে, তবুও খেতে অসুবিধে হবে না। কেন না সামনের দিক থেকে বাঁধা। ঘরের কোণে একটা কুঁজোয় জল আছে। কষ্ট করে গড়িয়ে খেয়ো। কোনও গ্লাস নেই কিন্তু। পারি তো আমরা রাত্রিবেলা আসব। বলেই চলে গেল ওরা।
ওরা চলে গেলে অসহায় বাপ্পা অনেকক্ষণ গুমরে গুমরে কাঁদল। তারপর মেঝে থেকে সেই ছড়িয়ে থাকা খাবারগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেল। এছাড়া উপায়ই বা কী? অ্যাটম আর পেটো কি ওকে উদ্ধার করতে সত্যিই আসবে? যদি আসে তো কখন আসবে ওরা? কিন্তু যদি না-আসে? তা হলে বাপ্পার জীবনের অন্তিম পরিণতি কী হতে পারে, তা ওর অজানা নয়। খবরের কাগজে এইরকম ছেলে চুরির ঘটনা ও অনেক পড়েছে। কাজেই সেরকম একটা মর্মান্তিক পরিণতির কথা মনে হতেই সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল ওর।
না। সারাদিনে আর কেউ এল না। খিদের জ্বালায় ছটফট করে ওই বদ্ধ ঘরে বাপ্পার সারাটা দিন যে কীভাবে কাটল, তা বলার নয়। সন্ধের পর টর্চ হাতে গোপন পথে চুপিসারে অ্যাটম আর পেটো এসে হাজির হল। ,
ওরা এসে বলল, কী গো, এখনও রেখেছে ওরা তোমাকে? আমরা তো ভাবলাম নিয়েই গেছে বোধহয়। সকালে অনেকক্ষণ বাড়িটার দিকে নজর রেখেছিলাম আমরা। কিন্তু তোমাকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখিনি। দুপুরবেলা আমরা খেতে গিয়েছিলাম। ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তোমার জন্যে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। ভাবলাম তোমাকে কথা দিয়েও আমরা হয়তো আমাদের কথা রক্ষা করতে পারলাম না। এতক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই তোমাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে এখান থেকে। তবে এখনও যখন তুমি আছ, তখন আর তোমার ভয় নেই।
বাপ্পা বলল, ভগবান তোমাদের ভাল করুন ভাই। আগে তোমরা আমার বাঁধন খুলে দাও।
ওরা ছুরি দিয়ে দড়ি কেটে বাপ্পাকে বাঁধনযুক্ত করল।
বাপ্পা বলল, ওঃ বাঁচালে। কিন্তু আর. এক মুহূর্ত এখানে নয়। তোমরা এখনই আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো এখান থেকে। সকালে আমি পালাতে গিয়েও ধরা পড়ে গেলাম।
ঠিক আছে ব্যস্ত হবার কিছু নেই। বলে ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু খাবার বার করে বলল, আগে এগুলো খেয়ে নাও দেখি।
কী আছে ওতে?
আরে খাও না। কয়েকটা কচুরি, ছানার গজা, অমৃতি এইসব আছে। না-খেলে পালাবে কী করে?
দেরি হয়ে যায় যদি?
যায় যাবে। তবে জেনে রেখো এখন যখন আমরা দু’জনে এখানে এসে গেছি, তখন কারও সাধ্য নেই যে আমাদের কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নেয়। মনে রেখো তুমি এখন ওদের খপ্পরে নয়। ওরা এখন আমাদের খপ্পরে।
কী যে বলো। ওরা অত্যন্ত সাংঘাতিক।
আমরা ওদের চেয়েও সাংঘাতিক। বিশেষ করে রাত্রিবেলা আমাদের দু’জনকে যেন ভূতে এসে ভর করে। আমরা পারি না এমন কোনও কাজ থাকে না। যাক গে। এখন ধীরেসুস্থে খেয়ে তো নাও।
বাপ্পা গোগ্রাসে খেতে লাগল।
অ্যাটম বলল, আমরা একবার দিঘায় গিয়েছিলাম। সেখানে একটা দুঃসংবাদ পেলাম।
কী দুঃসংবাদ ?
তোমার মাকেও ওরা নিয়ে গেছে।
সে কী ! আমার মামণিকে…!
হ্যাঁ। আমার যতদূর ধারণা ওরা তোমাদের পরিবারের সবাইকে এক এক করে শেষ করে দেবে! দিঘায় গিয়ে একবার তোমার মায়ের ঘটনাটা শুনে মনে হল, পুলিশ তোমাকে উদ্ধার করলে ওরা যদি তোমার মাকে মেরে ফেলে? তা ছাড়া ধরো পুলিশ আসার আগেই তুমি যদি এখান থেকে পাচার হয়ে যাও, তা হলে আমরা দু’জনে ফলস পজিশনে পড়ে যাব। এবং মিথ্যে কথা বলার দায়ে মারধোর খেয়ে মরব। বিশেষ করে পুলিশের খাতায় আমাদের রেকর্ড ভাল নয়।
বাপ্পা ডুকরে কেঁদে উঠল একবার। তারপর বলল, ওঃ হো। তোমরা কি ভুল করলে ভাই। কেন একবার পুলিশকে বললে না। আমার মা, মামণি— আর কি মাকে আমি কখনও দেখতে পাব? ওরা কোথায় নিয়ে গেল আমার মাকে?
যেখানেই নিয়ে যাক। আমরা তাঁকে ফিরিয়ে আনবই। অত ভেঙে পড়লে চলবে কেন? থাকলে কাছেপিঠেই থাকবেন উনি। চারদিকে যে রকম পুলিশের টহলদারি তাতে পালাতে বেশি দূর হবে না।
বাপ্পার খাওয়া শেষ হতেই ওরা বলল, এবার পালানো যাক। আগে আমরা তোমাকে আমাদের গোপন ডেরায় লুকিয়ে রাখি, তারপর আসল ঘাঁটির খোঁজ নিচ্ছি ওদের। জেনে রেখো, এটা ওদের আসল ঘাঁটি নয়। ওরা ভীষণ চালাক। তাই তোমাকে অপহরণ করে নিজেদের ডেরায় না-রেখে এইখানে লুকিয়ে রেখেছে। তা যাক। তুমি এখন মুক্তি পেলেও তোমার বাবার কাছে যাবে না, বা পুলিশকে ধরা দেবে না। ওরা তা হলে অঞ্চল ছেড়ে পালাবে। হয়তো তোমার মায়েরও ক্ষতি হবে তাতে। তোমার অন্তর্ধান রহস্য যেমন পুলিশের কাছে, তেমনই ওদের কাছেও রহস্যময় হয়ে উঠুক। পরে অবস্থা বুঝে আমরা ব্যবস্থা করব।
বাপ্পা খুব তাড়াতাড়ি ওদের সবকিছু বুঝে নিয়ে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে বলল, চলো, আর দেরি নয়।
ওরা তিনজনে সেই গুপ্তস্থানে এল। তারপর গর্তের মধ্যে দেহটাকে গলিয়ে দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল সেই অন্ধকার ড্রেনের ভেতর। অ্যাটম টর্চ জ্বেলে অন্ধকার পার হয়ে সমুদ্রতটে পৌঁছল। তারপর বাইরেটা খুব ভাল করে একবার দেখে নিয়ে ইশারা করল ওদের। পেটো বাপ্পাকে নিয়ে বাইরে এল।
সমুদ্রে তখন ভাটার টান। সমুদ্র তাই অনেক দূরে সরে গেছে। ওরা সেই কনকনে ঠান্ডায় বেলাভূমি ধরে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল।
অনেকদূর যাবার পর এক গভীর বনের মধ্যে ঢুকল ওরা। এইখানে একটি সুবৃহৎ গাছের গুঁড়ির কাছে এসে অ্যাটম বলল, আমরা এখন কোথায় আছি জানো তো? ওড়িশায়। তুমি যেখানে ছিলে সেটাও ওড়িশা। তবে বর্ডারে। ওই দেখা যায় দূরে চন্দনেশ্বরের মন্দির। খুব জাগ্রত দেবতা। এক মন হয়ে বাবাকে ডাকলে বাবা ডাক শোনেন। আমরা কাজুবাদামের বনে এসে ঢুকেছি। এই বনে একটা বাদাম গাছের মগডালে আমাদের ঘাঁটি। তোমাকে এখানে লুকিয়ে রেখে আমরা ওদের আসল ঘাঁটির খোঁজ নিতে যাব। এবং চেষ্টা করব তোমার মায়েরও খোঁজখবর নেবার।
কিন্তু ভাই, আমি তো গাছে উঠতে পারি না।
সে জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। গাছে ওঠার উপায় আমাদের করাই আছে। বলেই এক পাশের একটি ডাল থেকে একটি শক্ত মোটা লতাকে টেনে আনল। বলল, এইটা ধরে উঠতে হবে। পারবে তো? হ্যাঁ পারব।
সেই লতা ধরে ওরা তিনজনেই উঠে পড়ল ওপরে। গাছের অনেকটা ওপরে প্রায় মগডালের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি ডালের সঙ্গে বাঁশ-বাখারি দিয়ে চমৎকার একটি মজবুত মাচা করা আছে দেখতে পেল বাপ্পা। অন্তত দু’-তিনজন সেখানে অনায়াসে শুয়ে বসে থাকতে পারে। ঘন পাতার আড়ালে সে-এক এমনই নিরাপদ আশ্রয় যে সেখানে লুকিয়ে থাকলে দিনমানেও কেউ কিছু টের পাবে না।
অ্যাটম বলল, তুমি এইখানে সারারাত শুয়ে থাকো। হয়তো একটু ঠান্ডা লাগবে। তা কী আর করা যাবে। চটপট যা কিছু আছে এখানে, সব গায়ে চাপা দিয়ে নাও। আর এই নাও দড়ি। নিজেকে বেশ শক্ত করে বেঁধে রাখো এর সঙ্গে। যাতে ঘুমিয়ে পড়লে পাশ ফিরতে গিয়ে পড়ে না যাও।
বাপ্পা বলল, কিন্তু আমার এখানে লুকিয়ে থেকে লাভ?
লাভ আছে বইকী ভাই। তুমিই তো এখন সোনার হরিণ। তোমার এখন কোনওমতেই আত্মপ্রকাশ করা চলবে না। আমরা দু’জনে যখন ফিল্ডে নেমেছি, তখন তুমি একদম নিশ্চিন্ত থাকো। আমরা কাগজ-পেনসিল নিয়ে আসব। প্রয়োজন বুঝলে কাল তুমি একটা চিঠি লিখে দেবে। সেটা তোমার বাবাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। তারপর তিনি নিজে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তোমাকে। না হলে আমাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে যদি আবার ধরা পড়ে যাও তো, সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তোমরা এখন কোথায় যাচ্ছ তা হলে?
সেই ভাঙা বাড়ির কাছে, যেখানে তুমি ছিলে। সেখানে সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই তার পিছু নেব আমরা। তারপর ঘাঁটিটা চিনে আসতে পারলে হইচই পাকিয়ে কেলেঙ্কারির চরম করে তুলব। তবে খুব সাবধান। আমরা না-আসা পর্যন্ত তুমি যেন গাছ থেকে নেম না।
বাপ্পা বলল,ঠিক আছে ভাই। যা তোমরা ভাল বোঝ তাই কোরো।
অ্যাটম আর পেটো চলে গেল।
ওরা চলে যেতেই সেই ঘন অন্ধকার বাদাম বনের একটি গাছের আড়াল থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে মৃদু একটু হেসে দেশলাই জ্বেলে একটা বিড়ি ধরাল।